“বেঁচে তো আছি
, কিন্তু জীবনের সে
আনন্দ কই”?
তারপর?
না মিল নে
কা খুশি , না জানে কা ঘম । ভেতর থেকে যেন শুকিয়ে যাচ্ছিলাম ।
তারপর?
তারপর আর
কী ? তার আর পর নেই।
নেই কোনো ঠিকানা । একদিন দুম করে ঠিক করলাম যে দিকে দু চোখ যায় চলে যাব । যাবার
আগে কোন রিস্তেদার নয়, হাজির
হলাম এক বন্ধুর বাড়ি । বললাম, এই ঘষটে ঘষটে চলা আর পোষাচ্ছে না, শহর ছেড়ে চলে যাব , আজ রাতেই ।
সে বলল, কোথায় যাবে, কিছু ঠিক করেছ?
না ।
এক কাজ কর, যখন শহর ছাড়বে মনস্থির করেই ফেলেছ আমাদের গ্রামটা একবার ঘুরে এসো । ওখানে আমার বাড়িতে দু তিনদিন থাকো, তারপর ভেবে দেখো ।
বাড়ি গিয়ে
চন্দাকে বললাম আজ বেরিয়ে যাব , দরকারি জিনিশপত্র গুছিয়ে ফেলো । বাচ্চাদের
খাইয়ে দাও । আর হ্যাঁ, তুমি আমার
সঙ্গে যাবে তো?
সে বলল ,যেখানে তুমি আর বাচ্চারা , সেটাই আমার ঘর ।
মোবাইল
থেকে তিনশোটা নম্বর ডিলিট করে ,বাক্স গুছিয়ে খাবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম । গাড়ি চালাবো কি ? হু হু করে দু চোখ ছাপিয়ে জল পড়ছে । এতো দিনের নিজের
শহর জয়পুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ।
চন্দা বলল
, চোখের জলের সঙ্গে
জয়পুর বেরিয়ে যাচ্ছে তোমার ।
নিকল নে দে
।
সেই থেকে
আজ সাত বছর হয়ে গেল এখান থেকে নড়তে পারিনি ।
ঝাল ঝাল
লঙ্কা মাখা ডালমুট ,মিরচি
পকোড়া, সামোসা , বুঁদির
লাড্ডু । আদা দেওয়া চা । পাওয়ানা হাভেলির টেরাসে ঢিমি ঢিমি আলো । পাশেই রঘুনাথ মন্দিরে আরতির ঘন্টা ।
রাজিন্দর
সিং জির একটা ফোন এলো ।
হাঁ হুকুম
, বোলো , আভি যা রহা হু । কুছ লানা হ্যাঁয় ?
রাজিন্দর
জি উঠে পড়লেন ।
গায়ে পড়েই
জিগ্যেস করলাম, এতো
মিস্টি করে কার সঙ্গে কথা কইছিলেন ?
আমার বউ, চন্দা ।
হুকুম বলে
ডাকেন ?
আমরা
রাজপুতরা সম্মান দিয়ে হুকুম বলি, সব্বাইকে । মিচকি হেসে রাজিন্দর উঠে পড়লেন ।
শেখাবতীর
মান্ডাবায় রাত ঢলে এসেছে । আমরাও ক্লান্ত ।দিল্লি থেকে ছ’ ঘন্টার পথ। পাওয়ানা হাভেলি । পাওয়ানা মানে অতিথি । একটা
হাভেলিকে হোটেল বানানো হয়েছে । রাজিন্দর এর লিজ নিয়েছেন । বাবাকে সাহায্য করে সদ্য
যুবক অনুরাগ । দিল্লি পাবলিক স্কুল ছেড়ে জয়পুরের মস্ত মকান ছেড়ে টিমটিমে গ্রাম
মান্ডাবায় যখন এসেছিল তখন নেহাত বালক । বাবার খামখেয়ালিপনায় মদত জুগিয়েছে গোটা
পরিবার । তখন ছিল ছোট্ট কুঠরি । কেঠো চারপাই । কোনো ফুটুনি নেই ।
দিনের পর দিন এভাবেই কেটেছে । মান্ডাবাতেই পড়াশুনো করেছে । সেই সব কথা বলতে কোনো জড়তা নেই তাদের । আর আজ ?
দিল লগ
গয়া । আব আচ্ছা লগতা হ্যাঁয় । ইতনা সুকুন । এতো
শান্তি এখানে ।
আমি হাঁ
করে ওইটুকু ছেলের কথা শুনি । আর্টিস্ট হতে
চেয়েছিল কিন্তু বাবার জম্পেশ ট্যুর ও হোটেল ব্যাবসায় হাল ধরা তার ভবিষ্যৎ, সে কথা সে বেশ জেনে গেছে ।
আজ ঘুমন্ত
টিমটিমে মান্ডাবার একপ্রান্তে তাদের পেল্লাই বাড়ি , গাড়ি , এনফিল্ড বুলেট । সেই বাড়ির খোলা বারান্দাছাদে রাজিন্দর তার বউ এর
সঙ্গে মনের আনন্দে চা খায় আর ভীমসেন জোশির
জো ভজে হরি কো সদা , ভজন শোনে
। আর জীবনের আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে মৌজ ক’রে আকাশে সপ্তর্ষি মন্ডল দেখায় মেয়েকে ।
২
পনেরো
শতাব্দীর রাজপুত রাজা মহারাও শেখার দেশ , শেখাবতী । শেখাবত
রাজপুতদের দেশ । ঝুনঝুনু চুরু আর সিকার
জেলা নিয়ে আজকের শেখাবতী । মান্ডাবা নওল গড় রাম গড় ফতেপুরের জমি রুখা সুখা । বৃষ্টি বিরল সেই ধুলো প্রান্তরে
আছে খেজরি গাছ ।সেই গাছের ফলের নাম সাংরি । খুব দাম নাকি । খেতে টকটক । আনাজপত্তর
বেশি হয় না তাই ব্যাসনের গাট্টে , ডাল ,আচার এই
সব দিয়েই রকমারি খাবার বানায় । কটকটে লাল শাড়ি লম্বা ঘুঙ্ঘট । মাথায় ঘড়া । বিশাল
পাগড়ি । উটের গাড়ি । গাধার গাড়ি । ধুলো উড়ছে বিন বিন । মুগ ডালের হালুয়া সদ্য
বানানো হয়েছে । তার ওপরে সরু সরু করে কাটা আমন্ড বাদাম ছড়িয়ে দিচ্ছে । গরম লাড্ডু , প্যাঁড়া ।
এখানেই সব
মিস্টি শেষ হয়ে যায় ?
না না
এইসব মিস্টি আমরা দিল্লি জয়পুর আমেদাবাদ মুম্বাই কলকত্তা সব জায়গায় পাঠাই । হুম ।
চেখে দেখুন ।
পাওয়ানা
হাভেলি মান্ডাবার বাজার এলাকায় । ওইটুকুনই বাজার । বাজার ছাড়িয়ে কয়েক পা এগুলেই
শুনশান । আর চারদিকে আরো শুনশান হাভেলি । ইয়া বড় বড় দরজায় বিশাল বিশাল তালা ঝুলছে
। ছোট্ট ছোট্ট খুপরি খুপরি বন্ধ জানালা আর
তারপর ?
সারা
হাভেলির শরীর জুড়ে ছবির পর ছবি । রঙের জাদু । নকশার নেশা । রঙ আর নকশা যখন ঘোর
ধরাচ্ছে ভাবছি এখখুনি ওই ঘুলঘুলি
জানালার একটা পাল্লা একটু ফাঁক হবে আর গোলাপি ঘোমটার ভেতর থেকে কেউ আমাকে মিছরিদানা গলায় ডাকবে
,
খম্মা
ঘানি সা । পধারো মাহরে হাভেলি সা । গলা সুখ গয়ে, থোড়া পানি ফরমাইয়ে সা । কচৌরি খাওগে সা ? মিরচি অচার কে সাথ ।
এখন তো আর
কেউ থাকে না । আমার ভারি একা লাগে । আর কতদিন এই হাভেলি আগলে বসে থাকব ? এসো না , দুটো কথা কই, সা ?
আমিও অমনি
যাচ্ছি , গুলাবিইইইই
বলে এগিয়ে যাব , ওমা ! সেই শুনশান পাড়ায় এক দঙ্গল ট্যুরিস্ট । হক্কলে বিদেশি । আর গাইড ! সে একবার স্প্যানিশ একবার ফ্রেঞ্চ একবার স্প্যানিশ
একবার ফ্রেঞ্চ ,ঝড়ের মতো
বলছে কানে মাকড়ি মাতব্বর । খচাখচ ছবি
উঠছে । তাতা সুখা ভাপে সাদা চামড়া লাল । আর কি ! গুলাবি হাওয়া হয়ে গেল ।
আমিও
হাভেলি দেখায় মন দিলাম । দেশের লোক বলতে শুধু আমরাই । শেখাবতী টেনে আনে বিদেশিদের
। তাও নাকি ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ ভাষাভাষীরাই দলে ভারি । কানে মাকড়ি গাইড গুলো ফরফর করে ওদের ভাষা শিখে যায় । অনুরাগ বলে
অনেকে নাকি স্কুলেও পড়েনি । ইশ যে কোন একটা ভাষা জানলে মান্ডাবায় গাইড হয়ে থেকে
যেতাম !
দেশের
লোকও আসে তবে অত আদিখ্যতা তাদের নেই । বেশির ভাগই জাঁকালো শীতে উইকএন্ড কাটাতে আসে
দিল্লি জয়পুর থেকে। আর সেইসব ফ্রেস্কো
মুরালের মধ্যে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তন্নু লাভস
মন্নু লিখে টিখে ধুলো উড়িয়ে চলে যায় ।
দেখলাম
গোয়েঙ্কাদের হাভেলি লাডিয়া হাভেলি ।মুরমুরিয়া হাভেলি । ঝুনঝুনয়ালা , পোদ্দার , শরাফ । কোন হাভেলির নেমপ্লেটে লেখা কলকাতা , মানে বংশের বাতিরা কলকত্তায় থাকে সল্টলেক বা আলিপুরে বা চিত্তরঞ্জন এভিনিউ এ । কোন কোন হাভেলির মধ্যে আবার বংশের ঝড়তি পড়তি লোকেরা থাকে, দিব্যি সংসার পেতে । চুলা জ্বালিয়ে
রান্নার কালিতে সেই সব মহার্ঘ শিল্পকলার গুষ্টির তুষ্টি । কোন
হাভেলি এক্কেবারে বন্ধ । কোথাও বা একটা উদাসীন কেয়ারটেকার । অল্প কিছু টাকা নেবে ।
আর সাঙ্খ্য দর্শনের মতো মুখ করে সেই বর্ণময় তিজোরির দরজা খুলে দেবে । একটা তিজোরির
মধ্যে আমি ঢুকে যাবো । আমার মাথাটা আবার টাল খেয়ে যাবে ।
গুলাবি
আবার ডাকবে, থোড়া ঘিউ নাও না, সা ? ডাল বাটি চুরমা?
৩
মান্ডাবার
জল হাওয়ায় কিছু একটা আছে । মনটা একদম শান্ত । চা নিয়ে হোটেলের ছাদ বারান্দায় বসে
আছি তো আছিই । চারদিকে যে খুব নয়নাভিরাম পারকিতিক দিরিশ্য, তাও নয় । তবু কেমন জানি একটা ভারি ভালো লাগা । অকারণ
। সময় যেন কতদূর পিছিয়ে গেছে । এটাই বোধহয় রাজিন্দর কে টেনেছিল ।
রাজস্থানী মারোয়াড়ি ভাষায় খম্মা মানে ক্ষমা আর ঘানি মানে অনেক । কাউকে সম্মান
জানিয়ে নমস্কার , হ্যালো
বলার জায়গায় ওরা বলে খম্মা ঘানি ।বহুত মেহেরবানি। আর সা , যেমন জি বলা হয় হিন্দিতে । আও সা , বসো সা । খাও সা । এইসব । পালটা বলতে হবে ঘানি ঘানি খম্মা সা ।
তামাম
রাজস্থানে গোটা দশেক প্রধান চিত্র
শৈলী আছে । তার মধ্যে ঢুন্ডহার ঘরানার শেখাবতী কিশানগড় জয়পুর আর আমের শৈলী । শেখাবতী
হাভেলির ছবিগুলোকে কয়েকটা ভাগে ফেলে দেওয়া
দেওয়া যায় । ফুল লতা পাতা,শুধুই অলঙ্করণ , এইসব
অলঙ্করণ রাজস্থানী প্রিন্টে খুব দেখা যায় , বেডকভার , ড্রেস
মেটেরিয়াল , পর্দা । পশু পাখি
। যুদ্ধের ছবি । ঠাকুর দেবতা ।লোকগাথা ।
ইতিহাস। দৈনন্দিন জীবন । শেঠ শেঠানি । যানবাহনের ছবি । ব্রিটিশ দের ছবি । যিশু
খ্রিস্টের ছবি । রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি । এমনকি শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর ছবি । সত্যি ! গাইডদের মুখে মুখে নাম ফেরে । হয়তো এমনো হতে পারে এই
আঁকা জোকায় বিদেশী শিল্পীরাও তুলি ধরতো কখনো কখনো ।
সমাজ ও
রাজনীতি যেমন খাতে বয়ে গেছে ফ্রেস্কো মুরালের মধ্যে নতুন নতুন ভাবনা ঠিক সেই ভাবেই
এসেছে । এই অলঙ্করণের কাজ প্রথম দিকে রাজপুতদের মন্দির এবং দুর্গেই দেখা যেত । ব্রিটিশদের
প্রধানত ব্যাবসা করতে আসা , রাজপুতদের দুর্বল ক্ষমতা আর তার পাশাপাশি দেশি বানিয়াদের
রমরমা ।
শেখাবতী মাড়োয়ারি
বানিয়াদের দেশ । বিড়লা ডালমিয়া সরাফ ঝুনঝুন ওয়ালা , পোদ্দার । নামগুলো কি চেনা চেনা না ? চেনা চেনা মানে ? হাড়ে হাড়ে চেনা । হাড়ে হাড়ে কেন চেনা তার আর্থ
সামাজিক ব্যাখ্যার দরকার অন্তত এই লেখার জন্য নেই । মেধা পরিশ্রম কৌশল দিয়ে যে যা অর্জন করতে পেরেছে তা তো
স্বীকার করে নিতেই হয় । ঊনিশ শতকের
গোড়া থেকে শেখাবতীর ছোট গন্ডি ছেড়ে ব্যাবসা
বাড়াতে বিভিন্ন শহরে এই মাড়োয়ারিরা ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে কলকাতায় । ব্যাবসার ফেঁপে ওঠা টাকার একটা অংশ যেত দেশে, মানে এই
শেখাবতী অঞ্চলে । ব্যবসা যত বাড়ে তত বেশি রুপিয়া দেশে পাঠানো হয় । জেত্তা রুপিয়া
তেত্তা জিগদারি । শেখাবতী ভরে ওঠে ঠাটবাটে । জেল্লাদার হাভেলি, মন্দির , ছত্রী , । বিয়ে ,পুজো আচ্চা আর ভিটের টানে শহরিয়া বাবু বানিয়ারা
শেখাবতীমুখো হতেন । দানছত্র চলত । দেমাক জাঁক জমক দেখিয়ে পড়শিদের জানানো হত দ্যাখ
কত পয়সা কামাচ্ছি । যত পয়সা তত জেল্লা । হাভেলির দেওয়াল মাখন মসৃণ । মিহিন
পলেস্তারা ।হাত পিছলে যায় । শেখাবতীর উন্নয়নে মাড়োয়ারিদের
বিরাট ভূমিকা । দেশের বড়বড় রাঘব বোয়াল মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ী শিল্পপতির ভিটে
এই শেখাবতী । এখনো কালেভদ্রে কেউ গিয়ে কখনো বা হাজির হয় , বাপ পিতেমোর ভিটেয় ধুলো ঝেড়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে আসে ।
হাভেলির আনাচ কানাচ উঁচু ছাদ দেওয়াল ভরিয়ে এই ফ্রেস্কো আঁকা খুব
সোজা কাজ ছিল বলে তো মনে হয় না ।
কলকাতায়
বসে থাকা এই সম্প্রদায়কে দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে এদের আপনজমিতে কী ফুল টাই
ফুটিয়েছেন এরা , তার
সুগন্ধ নিয়ে কত গুলাবি আজো ঘুরে বেড়াচ্ছে হাভেলির মধ্যে ।
৪
মান্ডাবা
থেকে ফতেপুর মাত্র কুড়ি কিলোমিটার । এখানে এক মাঝারি মাপের হাভেলি কিনে সেখানে
হোটেল বানিয়েছেন ফরাসি আর্টিস্ট নাদিন লেপ্রিন্স । মহিলা । তার একটা ওয়ার্কশপও আছে
। ফ্রেস্কোগুলোর পুনরুদ্ধারে তার অনেক খাটুনি গেছে । ছবি নিয়ে অনেক কাজ সেখানে
চলছে । উনি এখন প্যারিসেই থাকেন তবে কয়েকটি অল্পবয়সী ফরাসি মেয়ে কেউ লেখে কেউ আঁকে
কেউ ছবি তোলে ,এখানে কাজ
করছে । এই খাঁ খাঁ গরমে ধুরধুরে গ্রামে কিসের নেশায় পড়ে আছে । হাভেলির ফ্রেস্কো
দেখে দেখে আশ আর মেটে না ।
বলে নাকি
নওল গড়ের হাভেলিগুলোই সব থেকে বেশি ঠিকঠাক রাখা হয়েছে । তাই চললাম নওল গড় । প্রায়
এক ঘন্টার রাস্তা । পোদ্দার হাভেলি মুরারকা হাভেলি ভগত হাভেলি । পুরো শেখাবতী একটা ওপেন আর্ট গ্যালারি ।
শেঠের
হাভেলির তিনটে ভাগ । মর্দানা । জেনানা । নোহরা ।
মর্দানা , বাইরের ভাগ । গদ্দি তাকিয়া । টানা পাখা । হিশেবের খাতা । মেয়েরা এখানে আসবে না । শেঠের
দল ব্যাবসা বচসা নিয়ে থাকবে এখানে । এ হল বৈঠক খানা । তারপর ভেতর মহল , রসুই ঘর , ভাঁড়ার ঘর , শোবার ঘর,ঠাকুর ঘর আর
পায়রাকে খাওয়ানোর জন্য দানাপানি
রাখার ঘর । এরপর একেবারে পেছনের দিকে নোহরা
। খোলা
চাতাল , চারদিকে পাঁচিল । সেখানে থাকত উট ,হাতি ঘোড়া , ভেড়া গরু ছাগল। খোলা ছাদে
উঁচু পাঁচিলের আবডালে সাঁঝের বেলা বসত জেনানা মহল । মোটামুটি এইরকমই সব
হাভেলির গড়ন ।
রঙদার
জেল্লাদার কাজ নিয়ে শেঠেদের মধ্যে টক্কর চলত । মেটে লাল নীল হলুদ সবুজ এই বেসিক
রংগুলোই বানিয়ে নেওয়া হত । তারপর এক রঙ কে
অন্যের সঙ্গে মিশিয়ে আরো নতুন রঙ
তৈরি হত । ভাগ্যিস বৃষ্টি হয় না । তাহলে
কবেই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতো । ধুলোট পটভূমিতে এই রঙিন প্রাসাদ চিত্রমালা কেউ
আর দেখতে আসত না ।
এই বর্ণিল
জাদুরেখা আর মায়াবী হাভেলির জন্য কত হিন্দি সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এখানে ।
৫
রাজিন্দরজি
ট্যুর আর হোটেল ব্যাবসায় চুল পাকিয়েছেন । জীবনে ঝুঁকি নিয়েছেন বিস্তর । ট্যুরিস্ট
ঘেঁটে ঘেঁটে দেশ বিদেশ ঘুরে ঘুরে তাদের
মুখ দেখেই গোত্র বলে দিতে পারেন । মালয়েশিয়ার একটা দলকে দেখভাল করতে করতেই জানিয়ে দিলেন বিকেলবেলা আমাদের নিয়ে রাম গড়
যাবেন । রামগড়ের শেঠরা খুব বিখ্যাত ছিল । ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে একেবারে বেমক্কা
সপাটে গাড়ি চালিয়ে দিলেন ।
বিকেল
প্রায় শেষ হয়ে আসছে । আমরা একটা অদ্ভুত সুন্দর মন্দিরের মধ্যে ঢুকেছি । শনিমন্দির
। সন্ধের অস্তরাগ রাঙিয়ে দিচ্ছে মন্দিরের কারুকাজ । মন্দিরের মধ্যে মধ্যে শিশার কাজ । এক কুচি আলোতে হাজার জোনাকি জ্বলে
উঠছে । অনুরাগ একটা বাচ্চা ছেলে । বলে উঠল একবার ভাবুন তো , সেই পুরোনো সময়টার কথা । যখন এই হাভেলিগুলো এই মন্দিরটা
নতুন ছিল, এতো লোক ছিলোনা , গাড়ি ছিল না । সন্ধের মুখে হাজার জোনাকি জ্বলে উঠতো,আরতির ঘন্টার সঙ্গে । সেই জোনাকি জ্বলা সন্ধেকে মুঠোয় নিয়ে মান্ডবা ফিরে
এলাম ।
৬
দিল্লিহাটের
রাজস্থানের ফুড স্টলে বসে আছি তার কারণ আসিফ is obsessed with Rajasthan . মুগ ডালের হালুয়া হাতে দিয়ে বললাম মান্ডবা থেকে
এনেছি ।
বাজি (দিদি) মান্ডবা কেন গেছিলে ?
আরে
শেখাবতী দেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের, তাই চলে গেছি ।
আমিও গেছি
। কেউ একজন নিয়ে গেছিল ।
কে?
কাত্যায়নী
।
মেহরাউলির
কোন এক প্রত্ন চত্বরে কোন এক হিমহিমে শীতের সন্ধে বেলা কোন এক বাউন্ডুলে দাস্তানগো
গল্প বলছিল । সামনে সব নুক্কড় দল বসেছিল । পয়সা ফয়সার ধার দিয়ে যাবে বলে মনে হয় না
। হঠাত সেই বাউন্ডুলে দেখে এক লম্বা সুন্দর কোঙ্কড়া চুলো মেয়ে পশমি কুর্তা আর বুট
পায়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছে । তারপর ঠিক বিদেশি কায়দায় সেই মেয়ে মাথার
টুপি খুলে সবার সামনে ধরে আর যে যা পারে দিতে থাকে । গল্প বলা তখনও শেষ হয়নি, তার আগেই মেয়েটি টুপিসমেত টাকা আসিফের সামনে রেখে হাওয়া হয়ে যায় । এই সেই
কাত্যায়নী । রাজপুত মেয়ে । রাজকুমারী সা ।
খুব
ভালোবাসা তাদের । কিন্তু যা
হয় । ভিন ধরমী বাউন্ডুলে ছেলে । পরিনতি যা হবার হল ।
উসকো আতা
নহি থা মানানা
হম জব ভি
নারাজ হোতে থে
উয়ো
চুপচাপ পিছে সে আ কর আপনা সর
হমারে
কাঁধে পর রখ দেতি থী...
উয়ো অ্যা
য়সি মোহব্বত করতী থী
প্রসঙ্গ
খানিক হালকা করার জন্য আমি বললাম আরে জানো তো সেখানে এক ট্র্যাভেল পাগল লোকের
সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে । এই বলে আমি রাজিন্দরের ছবি দেখাই ।
রাজু
ভাইয়া , আরে ইয়ে তো রাজু
ভাইয়া হ্যাঁয় । আমি ওকে খুব ভাল করে চিনি ।
অ্যাঁ ?বলো কি ?
হ্যাঁ, বাজি । আমরা তো ওর হাভেলিতেই ছিলাম ।
আমরাও তো সেখানেই ছিলাম । কি
আশ্চর্য !
আমি ওখানে
বসেই টপাটপ মেসেজ টাইপ করলাম । আপনি কি আমার ভাই আসিফ খান দেহেলভি কে চেনেন? ও আপনার কথা বলছিল ।
কিছুক্ষণ
পর টাইপ ফুটে উঠতে লাগল
হাহাহাহাহা
, আমি ওকে খুব ভাল
করে চিনি । তাহলে কাত্যায়নী রাঠোরকেও চেনেন নিশ্চয়ই । হাভেলিতে হাভেলিতে একজোড়া
কবুতরের মতো ঘুরে বেড়াতো ওরা । ঢোলা মারু , হির রাঞ্ঝা , মুমাল
মহেন্দ্র আর আসিফ কাত্যায়নী ।
আমি
লিখলাম , ওই আসিফের কাছে যে
টুকু শুনেছি ।
সত্যি
পৃথিবীটা খুব ছোট । there is no meeting without reason . সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করা আছে যে । আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি ।
দু
সেকেন্ড চুপ থেকে ইংরেজিতে টাইপ করলাম
আমিও ।
ছবি লেখক
No comments:
Post a Comment