নাগপুর থেকে প্রায় পঞ্চাশ ষাট
কিলোমিটার দূরে তেঁতুল গাছের ছায়ায় ঢাকা বেতুল গ্রাম। কেমন ছন্দ মিলিয়ে দিলাম বলুন? তেঁতুলকে মারাঠিরা বলে চিঞ্চ। এই গ্রামে অনেক মাহারদের বাস ।এরা বুদ্ধ ঠাকুরের পুজো করে । চিঞ্চগাছের ছায়ায় ,গাছের কোটরে বুদ্ধ ঠাকুর বসে আছেন । এই
মাহারদের ভেতর থেকেই উঠে এসে ছিলেন ভীমরাও আম্বেদকার । এখন হয়ত বেতুল ভেতরে বাইরে
আমূল বদলে গেছে কিন্তু সেই কুড়ি বাইশ বছর আগে সেটা নিতান্ত গ্রাম ই ছিল।
এ হেন বেতুল গ্রামে আমাদের পাঁচ ছ জনের দল জিপের ধুলো উড়িয়ে হাজির হলাম এক
বিকেলবেলায় । কারণ আমাদের প্রশিক্ষণের একটা বিশেষ অঙ্গ হল ভিলেজ ভিজিট । গ্রামের
জীবনের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় । শখের পরিচয় । সে যাই হোক, কয়েকজন লোক নিয়ে সরপঞ্চ
এসে আমাদের ওয়েলকাম জানালেন । আমাদের ঠাঁই হল গ্রামের পাঠশালায় । একটা ছোট পাকা
বাড়ি । লাল টালির ছাদ । দলে আমরা দুটি মেয়ে । ঘরে ঢুকে আমি সত্যি সত্যি হাঁ হয়ে গেলাম । দেওয়ালে ঝুলে
রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ আর সুভাষ চন্দ্র ।
তাজ্জব হবার মতই কথা। আর কী আশ্চর্য ,অন্য মেয়েটি জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও
একটাও বাংলা যার মুখে আমি এতদিন শুনতে পাইনি, সে রীতিমতো দলের অন্যদের কাছে তার সংস্কৃতি নিয়ে বড়াই করতে
থাকল ।
সাদামাঠা গ্রাম,পাঠশালায় পড়ুয়ার দল। গোদা হনুমানের গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা ,সরপঞ্চের মাথার বিশাল
পাগড়ি,পাকান গোঁফ আর দলে দলে কুঙ্কু,সদাশিব আর বিঠঠল পাটিলদের দেখে দেখে আমাদের
বেশ ভাল রকম ভিলেজ ভিজিট হচ্ছিল। কিন্তু আসল আকর্ষণ ছিল অন্য জায়গায়। সেটা হল
সরপঞ্চের মেয়ে থুড়ি মেয়ের হাতের রান্না। মাটির চুলার গন্ধমাখা পোহা,আমঠি,ভাকরির
রুটি,পুরন পুলি, কোকাম, বলা বাহুল্য, হুশ হাশ করে শেষ হয়ে যেত। শহুরেপনার ধার ধারত
না কেউ । বছর তিনেক আগে সাতারা হয়ে গান্ধিজির সেবাগ্রাম দেখতে গেছিলাম। সেবাগ্রামের সামনে মাটিতে বসে মারাঠি স্টাইলে খাবার সুন্দর ব্যাবস্থা। আমাদের
ড্রাইভার মারুতি কী খাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলল “জুঙ্কা (ব্যাসন ভাজা)আর ভাকরির রোটি” । সে আরো বলল , এ তো আজকাল বাড়িতে
কেউ বানায় ই না । এ সব গাঁ এর বাড়িতে এক সময় হত । তাই সুযোগ পেয়ে খেয়ে নিচ্ছি ।
গল্পে ফিরে আসি । একদিন গ্রামের হাটে
আমাদের অন্য একটা দলের সঙ্গে হঠাত দেখা
হয়ে গেল । সেই দলে আমার এক হরিহর আত্মা বন্ধু বুদ্ধি দিল একদিনের জন্য আমাদের
গ্রুপে চলে আয় না । যেমন ভাবা তেমন কাজ । কেই বা দেখতে যাচ্ছে ! এমনিতে তো আমরা
নিয়ম ভাঙার মাস্টার ছিলাম সেই সময় ।
ওদের দলে ছিল হিতেশ । বিশালায়তন ছেলেটি নাকি বিরাট বড়লোক অথচ ভারি মাটির কাছাকাছি । একটা সাদা কাপড়ের থান থেকে সারা বছরের ছ’টা জামা নাকি বানিয়ে নেয় । ভাষা জানার সুবাদেই হয়ত গ্রামের লোক দের সঙ্গে তার মিলজুল বেশি ছিল। হিতেশকে বলতে শুনলাম “আজ মুখিয়ার বাড়িতে যে পুজোপাঠ গান বাজনা হবে, সেখানে কে কে যাচ্ছ?”
ওদের দলে ছিল হিতেশ । বিশালায়তন ছেলেটি নাকি বিরাট বড়লোক অথচ ভারি মাটির কাছাকাছি । একটা সাদা কাপড়ের থান থেকে সারা বছরের ছ’টা জামা নাকি বানিয়ে নেয় । ভাষা জানার সুবাদেই হয়ত গ্রামের লোক দের সঙ্গে তার মিলজুল বেশি ছিল। হিতেশকে বলতে শুনলাম “আজ মুখিয়ার বাড়িতে যে পুজোপাঠ গান বাজনা হবে, সেখানে কে কে যাচ্ছ?”
দলের সবাই হাত পা ছুঁড়ে খুব আপত্তি জানাল। হিতেশ বলল “সে হয় না । ওরা খুব
খারাপ ভাববে । এদিকে তিন বেলা যে বসে বসে ভালমন্দ খাচ্ছ সেটা আর ভেবেই দেখছ না “। বলতে বলতে হিতেশের চোখ পড়ল আমার ওপর । তারপর আর কি , চক্ষুলজ্জার খাতিরে রাজি হতেই হল ।
অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামে শুধু মুখিয়ার বাড়িটায় বিজলি বাতির আলো টিম টিম করছে
। দেওয়ালে ইয়া বড় বড় ঘুঁটে লাগানো আছে। ভেতরে ঢুকে মাটিতে বসলাম । গান শুরু হল । হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছে একটি ছোট্টখাট্ট মেয়ে ,মুখিয়ার মেয়ে । তার নাম কুঙ্কুও হতে পারে । মেয়েটির গলা
থেকে জলদগম্ভীর আওয়াজ বেরুতে লাগল । সে থেকে থেকে চোখ দুটো ওপরের দিকে তুলে “গোবিন্দাআআ
কৃষ্ণা আআ” বলে সুর লাগাতে থাকল । আমার কেমন যেন গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গলের কথা
মনে পড়ছিল । ওইটুকু শরীরে এমন আওয়াজ! এরপর যেটা হল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত
ছিলাম না ।
মেয়েটির গান শেষ হলে হিতেশ ফস করে বলে
বসল
“ এবারে একটা বঙ্গালি ভজন শুনব ।“
ছোকরা বলে কি? অথচ সবাই আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে । আমার মাথার
ভেতরটা একদম ফাঁকা । কিছুই মনে আসছে না ।
শেষমেশ যে বঙ্গালি ভজন গাওয়া হল সেটা হল “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে”। বিঠঠল পাটিলদের
দল পাগড়ি নেড়ে বল্ল বেশ বেশ ।
তারপর উঠে এলাম। হিতেশ প্রোগ্রাম শেষ না হলে আসবে না । কারণ সেটা ভারি খারাপ
দেখাবে। বাইরে বেরিয়ে দেখি নিশুতি রাত, গোরুর গাড়ি গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে,পথে কুকুর
বেড়ালটা পর্যন্ত নেই,শুধু চিঞ্চগাছের ঝুপ্সি ছায়া । বলা
বাহুল্য পথ হারিয়ে ছিলাম । আবার লজ্জার
মাথা খেয়ে মুখিয়ার বাড়ি । কেউ একজন পাঠশালায় পৌঁছে দিয়েছিল ,মনে আছে। এখন মনে হয়, তখন আমরা অনেক নিরাপদ ছিলাম । পদে পদে ভয় এমন
গলা টিপে ধরত না ।
পরের দিন গ্রামের বাসে করে পাল পাল ছাগল,মুরগির সঙ্গে রওনা দিলাম । বেতুল এলে
যেন মনে করে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয় এই বলে বলে কন্ডাক্টরকে প্রায় পাগল করে
আনছিলাম। কেউ কারুর ভাষা বুঝি না,তখন মোবাইলের চল ছিল না। বেতুলে না নামতে পারলে
কী হবে? সারা জীবন ভাকরির রোটি আর চিঞ্চের আচার খেয়ে থাকতে হবে? তবে সে যাত্রা
বেঁচে গেছিলাম ।
কিন্নর সুন্দরীর নীল চোখের এক বিন্দু জলের মত হিমাচলের পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে আছে চন্দ্রতাল লেক । ইন্দো তিব্বত সীমানা বরাবর শীতল মরু অঞ্চলে আমাদের এক্সকারশন চলছিল । সব জায়গাতেই আমরা আশ্রয় ও আতিথ্য পেয়েছিলাম সেনা বাহিনীর কাছে । ট্রেকিং করে চন্দ্রতাল লেক যেতে হবে। এদিকে আমার অবস্থা ছিল বেজায় খারাপ । অথরিটি কে জানান হল । আমাকে মকুব করা হল ট্রেকিং থেকে । না করে উপায় ছিল না কারণ ঘং ঘঙে কাশি আর শ্বাস কষ্ট নিয়ে আমি নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
সেই শীতল রুক্ষ মরু অঞ্চলে যেখান থেকে পুরো দলের সঙ্গীসাথী আমাকে টা টা বাই বাই করে
রওনা দিল চন্দ্রতালের দিকে,সেই জায়গাটার নাম
বাতাল ।
না
পাতালের কাছাকাছি নয় ,প্রায় চোদ্দ হাজার ফুট উঁচুতে তার অবস্থান। সেখানে চোখের মনের আরামের মত কিছু নেই,
কিচ্ছুটি না । রুখু এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা,জায়গায় জায়গায় নোংরা কাদা মাখা বরফের
তাল পড়ে আছে । কর্কশ পাহাড় চারদিকে চোখ রাঙাচ্ছে । আর কথায় কথায় সূর্য পাহাড়ের কোলে ঢলে
পড়ছে, চারদিক আবছা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে
আর হাড় কাঁপানো কনকনে হাওয়া । সবুজের নাম গন্ধ নেই। লোকজনেরও । পাথরের খাঁজে একটা ছোট্ট দোকান ।
পাওয়া যায় চা আর ম্যাগি । সঙ্গী বলতে আমার
দুর্বল শরীর অবসন্ন মন, ড্রাইভার আর তার হেল্পার,একজন ফ্যাকাল্টির স্ত্রী যে তার
পুঁচকে মেয়েটাকে নিয়ে অকারণ ব্যতিব্যস্ত।
তার সঙ্গে কিছুক্ষণ পুরনো হিন্দি গান কতো ভাল আর আরবি (কচু,হিন্দিতে)র
তরকারি কতো উপকারী,তোমাদের স্যারের কী বদ মেজাজ এই সব ঘন্টা খানেক আলোচনা করে,
কেশে কেশে আর হাঁপিয়ে আমি আরো ক্লান্ত হয়ে পড়লাম । দলবল কখন ফিরবে কে জানে, আপ ডাউন ষোল কিলোমিটার হেঁটে
ফেরা(পরে জানা গেছিল আরো বেশি) ,এই ভৌগোলিক টোপোগ্রাফিতে, চাট্টিখানি কথা নয় ।
ফিরতে ফিরতে হয়ত বিকেল গড়িয়ে যাবে । কী করব এতোটা সময় ? ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে যাচ্ছি
। এমন সময় ড্রাইভারটি বলল “কুছ কাম করতে হ্যায়”।তাহলে খানিক টা ভাল লাগলেও লাগতে
পারে । সে বলল “ম্যাডামজি, নিম্বুপানি বনাতে হ্যাঁয় ,চলিয়ে” এইবলে সে তার নিজের
রসদ থেকে বেশ কিছু পাতিলেবু ,নুন ,চিনি আর দোকান থেকে হাড় হিম করা জল যোগাড়
করে ফেলল । ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ লাগল না কিন্তু । এর সঙ্গে একটা মহৎ উদ্দেশ্যও জুড়ে দিলো । “ মেড ইন বাতাল “লেমনেড টা বানানো হচ্ছে ট্রেকিং ফেরতাদের জন্য । শুধু বোতলে
পোরা হবেনা। প্ল্যাস্টিকের গ্লাসে ঢেলে দেওয়া হবে। আমরা নিম্বু কাটছি,রস চিপছি,নুন
চিনি জল মিশিয়ে ঘুঁটছি আমাদের সঙ্গী
সাথীদের জন্য। একটা প্রতিকূল পরিবেশে আমরা তিন জন এখন একে অন্যের খুব বন্ধু । হাসি মজাক করতে করতে বাতালের শীতল
শিলাভূমিতে লেবুর শরবত তৈরি হয়ে গেল । উয়োলোগ
কিত না খুশ হো জায়েঙ্গে –ড্রাইভারের মুখে চোখে পরম তৃপ্তি।
সন্ধে হবার মুখে একে একে সব
ফিরতে শুরু করল, ধুঁকতে ধুঁকতে,পা ঘষটে ঘষটে
। রাস্তা নাকি ভয়ানক বাজে । খানা খন্দ আর বোল্ডারে ভর্তি। দূরত্বও নাকি
অনেক বেশি। মোটেও আপ ডাউন ষোল নয় বরং তার দ্বিগুণ । বাস্তবিকই তাই। এর মধ্যেই হাতে হাতে সাপ্লাই হয়ে যাচ্ছে বাতালের
সেই ক্লান্তিহরা সঞ্জীবনী । বন্ধুরা
বিস্মিত ,খুব খুশি । ড্রাইভারের মুখে হাসি ধরে না ।
আমারদিকে এগিয়ে এল পরমার সিং
। কি ব্যাপার তুমি তো গেলে না । তো দিনভর কেয়া কিয়া? ভাব খানা এমন যেন আমি ফাঁকি
মেরে যাইনি ।
আমি বললাম কেন? আমরা নিম্বু
পানি বানালাম । তোমাদের জন্যই তো বানালাম । কেমন ভাল লাগছে না?
গ্লাসের শেষ বিন্দুটা শুষে
নিয়ে ভুরুটুরু কুঁচকে পরমার সিং বলে ওঠে,”তো কেয়া হুয়া”?