Saturday 14 March 2020

Soliloquy : Kasar Devi



 ই 
ল ম্বা শাদা বাড়িটার কাঠের ছোট্ট গেট খুলে ঢুকে বাগানটুকু  পেরিয়ে গেলেই বেশ সোজা পথে  আমার বাড়ি যাওয়া যায় । শাদা বাড়িটায় কেউ থাকে না । কাজেই বাধা দেবার  লোকও নেই ।  একটা নাম না জানা হলুদ ফুল , খালি দু মিনিট গল্প করতে চায়  গায়ে পড়ে
এই পথে গেলে বাড়ি ফেরা সহজ । তা না হলে ঘুর পথে উৎরাই চড়াই  । ডান দিকের বাড়ির দানবের মত কুকুর গুলো কী বিশ্রি চিৎকার করে যেন আমি চুরি  করতে এসেছি ওদের বাড়ি তাই এই শর্ট কাটটাই আজকাল পছন্দ হয় ।  আজ দারুণ সব পটারি তৈরি হল । গরম আভেন থেকে একের পর এক বেরিয়ে আসছে আমাদেরই নকশা করা সব শিল্পকাজ !  অলিভ সবুজ ,খুব ঘন কালচেটে , সামান্য তামাটে মিশেল , অপূর্ব ! হালকা লালচে একটা আলতো শেড দারুণ পছন্দ হল আমার  ভাবছি নিজেই নিয়ে নেব বাড়ির জন্য  এই করে করে আমার আর ব্যাবসা পত্তর হল না । সব কাজ টাজ গুছিয়ে তালা লাগিয়ে   মেয়েগুলোকে দোলের উপহার হাতে ধরিয়ে এবার বাড়ির পথে । সুগন্ধি মোমবাতিতে ছোট্ট ছোট্ট ফুল পাতা লাগিয়ে বেশ নকশা তুলবে  ওরা হোলির ছুটির পর । শুকনো ফুল , শুকনো পাতা ।  অথচ রঙ নষ্ট হবে না । গতকাল কী প্রচন্ড বৃষ্টি ছিল । আজ আকাশ কেমন পরিষ্কারদূরে  নন্দাদেবী আর ত্রিশূল পাহাড়ের মাথায়  দিনের শেষ আলোটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে । পমেগ্রানেট আর কেরালা লাইম । এই দুটো দিয়ে একটা গন্ধ বানাবো ।  এসবই  আমার নতুন শেখা কাজ  কিনা ! এই সব ভাবতে ভাবতে কখন বাড়ির ছোট্ট কাঠের গেট খুলে ঢুকে পড়েছি ।



দেখেছ ! প্রতাপ এখনো পাপোষগুলো তোলেনি ! যদি বৃষ্টি এসে যায় ।  ছোট্ট আলো জ্বলা বাড়িটা । মোমরঙা আলো জ্বেলে আমার জন্য বসে আছে । চিমনি দিয়ে গলে গলে বেরুচ্ছে স্বপ্নস্রোত , ছোট ছোট কুন্ডলী পাকিয়ে  দুটো পাইন গাছের  মাঝে আটকা পড়ে গেছে যে চকচকে রুপোর থালাটা দেখা যাচ্ছে  , তার চারদিকে ঘুরপাক খাবে ওরা । সেডার । দেওদার কাঠ জ্বালিয়েছে প্রতাপ । কী তার সুগন্ধ ! আমার ছোট্ট বাড়ির চিমনি দিয়ে  সেই সুবাতাস সারা  পাইনবনে ছড়িয়ে পড়ছে । দেওদার গাছকে জড়িয়ে ধরছে । আমি ঘরে না ঢুকে একটু বেতের চেয়ারে বসি ।  সামনে ঝিমঝিমে অন্ধকার । নাশপাতি গাছে ফুল আসবে সেই মে মাসে । আরে , একী !  চন্দ্রবাবু যে হাতের নাগালের মধ্যে  এসে গেছেন । বড্ড বেশি জ্বল জ্বল করছেন যে ।

Last night the moon came dropping its clothes in the street.
I took it as a sign to  start singing
Falling up into the bowl of sky,
The bowl breaks

সেই আলোর বাটি ভেঙে খান খান হয়ে  গান হয়ে ছড়িয়ে পড়লো । আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে । চাঁদ  , অন্নপূর্ণার মাথার  কিরীটে এখন অসক  এ মেহতাব ঢালবেন । ওনার কিরণমালা  যেন গলানো রুপো ।  আচ্ছা , ওই পমেগ্রানেট আর কেরালা লাইম নিয়ে যে পারফিউমটা  বানাবো ওর নাম দেবো অসক  এ মেহতাব ?

Thirst drove me down the water
Where I drank the moon’s reflection


মাথার ওপর ওরিয়নের বেল্ট । ধক ধক করছে তিনটি তারা পাশাপাশি । কালপুরুষ ।  মাথার ওপর জেগে থাকে কালপুরুষ । এই দেওদার পাইনের জঙ্গলে আমার এই শান্ত কুটিরে সে আমায় পাহারা দেয় রাতভোর । আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোই ।  প্রতাপের কি কিছু ঠিক আছে ?  কখনো কানে শোনে , কখনো শোনেনা । উধাও হয়ে যায় মাঝে মাঝে । ডেকে ডেকে গলা ব্যথা হয়ে যায়  আমার
কাসার দেবী তো ছোট্ট একটা গ্রাম । চারদিক জুড়ে কুমায়ুন গাড়োয়াল হিমালয় । মাথার ওপর অজস্র নক্ষত্রের জলসা । আমার ভাইপো অরো থাকলে বলত,  ওই যে ঠামি , ওই যে  দাদু । আমি তো আরো অনেক প্রিয়জনকেই দেখতে পাই । ওরা আমার মাথার ওপরে  ইমন কল্যাণ রাগ হয়ে ঝরে পড়ে ।  পাইনের বনে শোঁশোঁ হাওয়া ।সে  হাওয়ার  মাতাল শব্দ শুনে মনে হয় সামনেই সমুদ্র । যেন এখনই হাজির হবে বড় বড় গাঙ চিল ।  ঠোঁটে মাছ ঝুলিয়ে ।

I have a thirsty fish in me
That can never find enough  
of what it’s thirsty for!
Show me way to the ocean !







প্রতাপ রাতে রান্না করেছে ছোলে , জিরা আলু আর রুটি ।গরম গরম ।  নাশপাতি গাছ ঘেরা রান্নাঘর। রান্নাঘরের টেবিলে বসে খাই । মাথার ওপর ডোমের আলো । এই খাবারের যে কী স্বাদ কী স্বাদ ! এতো সাধারণের মধ্যে এতো আনন্দ , তুচ্ছতার মধ্যে এত মাধ্বী ধারা  এতোদিন বুঝতেই পারিনি ।
গাছে গাছে ঘষা লেগে আগুন জ্বলে যায়  আমাদের বাড়ির বাইরে দেখবে পোড়া দাগ , দেওদার গাছের গায়ে । পুড়ে যাওয়া দেওদার কাঠ নিয়ে আসা হয় । টুকরো করে রাখা হয় । সে  আরো পুড়ে পুড়ে আমার  ঘরকে গন্ধে  উষ্ণতায় ওমে  ভরিয়ে রাখে । আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে……

Last year I gazed at the fire  
This year I’m  burnt kabob .

আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি । । কাঠের ছাদে পাইন ফল টুপ টুপ খসে পড়ে , পাতা সরসর করে ।


সকালের আলোয়  নন্দাদেবী , ত্রিশূল অন্নপূর্ণা  লালে লাল হয়ে বলে , আজ যে হোলি । আমি অমনি শুনতে পাই পাহাড়ে ঢোলের আওয়াজদূর থেকে ভেসে আসছে । আজ তেওহার । এখানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবাই রঙ মাখায় ।  সবাই একজায়গায় জড়ো হয়ে একে অন্যকে রঙ লাগিয়ে দিচ্ছে । কেউ তোমাকে জোর করে রঙ দেবে না । হাতে হাতে মিঠাই , আঙুর । মিঠাই এর কথায় মনে হল , আজ হোলি । ঘরে কিছু মিছু আনিয়ে রাখা দরকারঅবিশ্যি কেই  বা আসবে আমার বাড়ি । কিন্তু আয়োজনটি যে সম্পূর্ণ হওয়া চাই । যদি আমায় পড়ে তাহার মনে ……  ভালো মিষ্টি কিনতে হলে আলমোড়া যেতে হবে । কাসার দেবী তো গ্রাম । আলমোড়া বাজারে খিম সিং মোহন সিং রোউতালার  দোকান থেকে বালমেঠাই , চকোলেট আর সিঙ্গোরি কিনে আনতে হবে । সিঙ্গোরি ভারি মজার । পাতায় মোড়া নারকেল আর ক্ষীরের মেঠাই । চকোলেট কিন্তু একটা মিষ্টির র নাম । মিষ্টি আনতে গেলে গোবিন্দই ভরসাআলমোড়া প্রায় দশ কিলোমিটার দূর । ফোন করে গোবিন্দকে ডেকে আনতে হয় । ওর গাড়িতে করেই এখানে সেখানে যাই । বিশু পাগলাও জুটে যায়  এসেই বলে দাও দেখি তোমার ঘরে ফুল সাজিয়ে  দি। শাদা গোলাপি চেরি , গোলাপ , রডোডেন্ড্রন । বিশু চেঁচায় , অত যে ফুলদানি বানাও পটারি ওয়ার্ক শপে সেগুলোই আনোনা দু চারটে । কী হবে ঘরে জমিয়ে রেখে !
ভেতর থেকে এনে ওর হাতে  দি । সে ফুল সাজায় । আবির সাজায় । আবার গান ধরে  বিকশিত প্রীতিকুসুম হে …..আমি বলে উঠি , বাবা, তুই তো দিব্বি গাইতে পারিস রে । সে উৎসাহ পেয়ে আরো গাইতে থাকে । এ ভাবেই জমে ওঠে আমার পাহাড় বাড়ির বসন্ত উৎসব ।

Again near the top of mountain
The anemone’s sweet features appear
The hyacinth speaks formally to the jasmine,
“peace be with you”. “And peace to you lad!
Come walk with me in this meadow”





কাসার দেবীর আকাশ জুড়ে পাহাড় । কাসার দেবীর মন্দির  আমার বাড়ি থেকে  দু’কিলোমিটার দূরে ।আমি থাকি পাপারসালি নামে একটা জায়গায় । মন্দিরে হেঁটে যেতে খানিক সময় লাগে ।  মন্দিরে ওঠা , সে  কিন্তু ভারি কঠিন । এই মন্দিরের কাছেই আছে জিও ম্যাগনেটিক লাইন । ভান আলেন লাইন । সারা পৃথিবীতে মোটে  তিনটে । তার মধ্যে কাসার একটা ।  স্বামী বিবেকানন্দ এখানে একটা গুহায় নিবিড় সাধনা করেছিলেন । সে গুহার আকার সিংহের মত । সেখানেই মন্দির ।
ভূচৌম্বিক শক্তির প্রভাবে এখানে ধ্যান জমে খুব ভালো । জীবন সহজ সরল । সহজ সরল জল তৃষিত কে তৃপ্ত করে । তাই  গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যাদের তারা বারবার কাসারে আসে । গোলোক ধাঁধাঁ য় দিশেহারার দলও আসে , কারণ তাদের একটা সরল সিধে পথ চাই । পথ  দেখাও । এই পথ খুঁজতে খুঁজতে হিপির দল ডেরা বাঁধে কাসার দেবীতে । তাই কাসার দেবী গ্রামে মোহনের দোকান দোলমা রেস্তোরাঁয় হরেক  রকম খাবার পাওয়া যায়
এসব করেই দিন কাটে । আমি নকশা আঁকি , রঙ মেশাই , বই খুলে জাপানি ওয়াবি সাবি দেখি । সৌন্দর্য সবকিছুতেই । বাঁকা টেরার মধ্যেও । তোমার দেখার চোখ বদলাও শুধু ।  মেটেলালের পাশে ফিরোজা , গোলাপির পাশে ছাই আর পিঁয়াজ রঙের পাশে প্যাস্টেল সবুজ মিশিয়ে মিশিয়ে দেখি । রোদের রঙ পাল্টায় , ছায়া দীর্ঘ তর হয় । কত পাখি কত রকমের ডাক ।
কাসার দেবীর মন্দিরের পাশে ওই পাথরের সরু লম্বাটে ঝুলন্ত চাতালটায় বসলে মনে হয় শূন্যে ভেসে আছি । ওর ভেতর দিয়ে গেছে সেই চুম্বক রেখা । ওখানেই বব ডিলান তাঁর গান বাতাসে মিশিয়ে দিয়েছিলেন পাখিরা সেই সুর তুলে নিয়েছিল ।  আর আকাশ থেকে অকস এ মহতাব হয়ে ঝরে পড়েছিলেন  আলেন গিন্সবারগ । 
বিশু পাগল বলে , আজ পূর্ণিমা । ছাদের ঘরে আমাকে থাকতে দেবে ?
আমি বলি কেন রে পাগলা ?

সে বলে ওই ছাদের কাচ দিয়ে  চাঁদ দেখা যায় । আজ চাঁদের আবির মেখে  ঘুমাই ।
গভীর রাতে নিভন্ত চুল্লির কাঠের চিটির পিটির শব্দের মধ্যে বব ডিলান আমার বারান্দায় বসে জ্যোৎস্নায় ভিজেভিজে গান করেন
How does it feel, how does it feel?
To be without a home
Like a complete unknown, like a rolling stone







সেই গান কখন পাখিরা শিখে নিয়েছিল , বললাম না ! চোখ খুলে ভারি একটা আরাম হল । ঝকঝকে রোদ্দুরে পাহাড় দেবতারা দরাজ হাসি হাসছে । ঝরে পড়া চেরি ফুলে ফুলে আমার এক  উঠোন বসন্ত হয়ে আছে । আমি হালকা গরম জামা পরে দরজা খুলে বাইরে বেতের চেয়ারে বসি । বিশু পাগলা কোনভোরে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে চলে গেছে । কতটা চাঁদের আলো মাখল , জানতে হবে তো !

প্রতাপকে ডাকব ডাকব করছি, চা খাবো । তখনই  মোবাইল বেজে উঠল ।
-          সুপর্ণা জি , হোপ ইউ আর ফাইন ।
-          হ্যাঁ , ভাল আছি । আপনি ?
-          আমি রশ্মি । বাড়ির চাবি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় নিতো? পেতলের ঘন্টার পাশে পাখির দানা খাবার জায়গার পাশে , যেমন বলেছিলাম । আগের দিন সব কিছু নিজের হাতে সাজিয়ে রেখে এসেছিলাম আপনার জন্য
-          আপনার কথা আমি ঠিক  বুঝতে পারছি না! আমিই তো  এ বাড়িতেই  থাকি, কাছেই আমার পটারির ওয়ার্কশপ  
-          আরে ! কী আশ্চর্য !  আমারও  তো পটারি , ন্যাচেরাল টাই ডাই  এসবের কাজ । প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে থাকি । আপনি এরপর আমার এখানেও বেড়িয়ে যাবেন  কিন্তু এখানে বহু পুরোনো গুহা আছে , পাতাল ভুবনেশ্বর । গোবিন্দ বলে একটা ছেলে আছে ওকে বললে , গাড়ি চালিয়ে  নিয়ে আসবে  হোপ , ইউ লাইকড মাই হাউস । চাবি খুঁজে পেতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হয় নি ?
-          চাবি ? কেন ? চাবি লাগানো  থাকবে কেন  ? প্রাতাপজি আছেন তো । উনিই তো সব । আমি তো দেখেছি দরজা খোলা , ফ্লাস্কে গরম জল , টেবিলে খাবার , ফায়ার প্লেসে আগুন , রোদের গন্ধ মাখা তোয়ালে , কোনোকিছু কম তো দেখিনি ।
-          প্রতাপ জি ? মানে প্রতাপ ভাইয়া ?  প্রতাপ ভাইয়া তো আজ তিন বছর হল মারা গেছে । এই বাড়িটা , এই স্নো ভিউ বাংলোটাকে খুব খুব ভালোবাসতো । আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার ছিলফ্যামিলি মেম্বার ছিল বলতে পারেন ।    কিন্তু আপনি কি করে ওকে দেখলেন? সুপর্ণা জি , আর ইউ ওকে ? অল ওয়েল ?





তারপর সেই শাদা বাড়িটার শর্ট কাট রাস্তা ধরে গোবিন্দ আমাকে ওর গাড়িতে তুলে নিল  চোখের আড়ালে হুশ হুশ করে স্নোভিউ বাংলো , পাহাড়ের নামজাদা শিখরগুলো একে একে কেমন  মিলিয়ে যাচ্ছে । আমি জানি প্রতাপ ওখানে আবার আসবে , আমার জন্য স্যুপ বানাবে ও । ওকে দেখতে পাবে শুধু বিশু পাগলা ।
অসক এ মেহতাব থেকে চেরি ফুলের মাথায় তখন শিশির জমতে থাকবে । আর সব চেরিফুলের ভেতরে জ্বলতে থাকবে এক একটা জোনাকি !
My soul, don’t try to answer now!
Find a friend and hide.
But what can stay hidden?
Love’s secret is always lifting it’s  head
out from under the covers,
“Here I am”


কবিতা ঃ জালালুদ্দিন মেভলানা রুমি