বৃষ্টি ভেজা জুঁই ফুলের
গন্ধ পেলেই জোনাকিরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসে
। তখন মগজের খুপরির ঘুপচি অন্ধকারে আর
কাঁহাতক থাকতে পারে ওরা ?
নাক আর কানের ফুটো দিয়ে
একটা দুটো একটা দুটো করে বেরুতে থাকে । গিল
কা ইত্তর হাতের কব্জিতে যদি একটু
লাগানো থাকে আর ধুনোদানে যদি বড় ঠাকুমার
জ্বালিয়ে দেওয়া সম্ব্রনী ধিকিধিকি
ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকায় , তাহলে পরিস্থিতি
একেবারেই হাতের বাইরে চলে যায় । তখন ওরা
চশমার সামনে জটলা পাকায় । নীল সাদাটে আলোর একটা ছায়াপথ তৈরি করে সেখানে মধুশালা
বসিয়ে দেয় । সেই সময় ওদের হোশরুবা থেকে ভালো ভালো লাইন পড়ে
শোনাতে হয় ।
“ The free spirit must drink wine
And my eyes are like goblets
My clay was kneaded
with the juice of grapes
…the clergyman passed the decree to remain continuously drunk
“
সবটাই ঠিকঠাক থাকে । ঝামেলা পাকায় শুধু হীরামন । সে সারা ঘর
ফড়ফড় করে ডানা ঝাপ্টিয়ে শান্ত জোনাকিদের ভয় পাইয়ে দেয় । আমি ভীষণ বিরক্ত হই ।
“ তোরা সব দুষ্টু পাখির দল । তোরা খুব বিচ্ছু
।গোবেচারা জোনাকিগুলোকে নাজেহাল করার কী দরকার “ ?
সে বললে , মন্দ বলনি ! আমরা
পক্ষীকুল খুব গোলমেলে আর সেয়ানা । আবার ডাকাবুকোও বটে ।
তবে তুমি ল্যাপটপে এখন যা লিখছ , সে টা কিন্তু আগাগোড়া ভুল
!
আমি বললাম , মানে ? কী বলতে চাস তুই ?
হীরামনের খুরাফাতি বোঝা মুশকিল । হেঁয়ালি ছাড়া আর কিছুই ওর জানা নেই যেন ! আমার
মুখের সামনে ডানার ঝাপটা মেরে বলল , ট্রয় যুদ্ধের কারণ, হেলেন ?
এক্কেবারে ভুল ।
আমি বললাম হ্যাঁ , তুমি সব জেনে
বসে আছ ! সবজান্তা তোতারানি ।
সে অমনি বলে,
বেশি ঘাঁটিও না ।
তুমি দুপুরবেলায় বড় ঠাকুমা ঘুমুলে লুকিয়ে
লুকিয়ে বিল্টু দাদুর আতরের বাক্স খোলো কেন , আমি জানিনা বুঝেছ ? তুমি জান যে আতরে জিন আর পরী থাকে । বিল্টু দাদুর কাছে ওরা
রাত্তির বেলা আসে । তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে
তাই দেখতে গিয়েছিলে । ড্রইং শিখিয়ে বিল্টু দাদু
বাড়ি এলে আমি সব বলে দেব ।
আমি বললাম বিল্টু দাদুকে
আমি ভয় মোটেই পাই না । তুই নিজে কী জানিস
বল দেখি ।
হীরামন চোখ টিপে বলল , পথে এসো , পথে এসো ।চলো চলো , ঘুরিয়ে আনছি ।
আমার সামনে তখন
ধোঁয়াটে ঝিকিমিকি মিল্কিওয়ে। জোনাকির
ছায়াপথ । সেই ছায়াপথে আমার রাহনুমা এক তোতা পাখি আর এক ঝাঁক জোনাকি ।
২
একটা বিশাল রাজহাঁস ।
রাজহাঁসটির পিচ্ছিল সাদা পালক ঢাকা
শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে রাজকীয় জ্যোৎস্না । সেই
জ্যোৎস্নায় স্নান করছে এক পেলব
নারী
। বলে নাকি রাজহাঁস শুদ্ধ , পবিত্র ও আধ্যাত্মিক । পরমহংস । ডিভাইন । সেই
ডিভাইন রাজহাঁস তুঙ্গ মদমত্ততায় যাবতীয় প্রতীকী
সম্ভ্রমকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে আছে সেই নারীকে ।
আমি সেই বিশাল টেম্পেরার সামনে দাঁড়িয়ে হংসমধ্যে
বকযথার মত হীরামনকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী রে ?
হীরামন বলল , আস্তে কথা বল ।
আর গাড়লের মত কথা বল না । তুমি এখন কয়েকশ
বছর পিছিয়ে গেছ । মনে রেখ এটা ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের ধনকুবের মেদিচিদের বাড়ি ,থুড়ি প্রাসাদ !
এখন রেনেসাঁর সময় । শুকনো
মুখে বাসি রুটি আর পচা চিজ খেয়ে তো
রেনেসাঁ হয় না । পৃষ্ঠপোষকতা লাগে । বুঝলে ?
মেদিচিরা কত শিল্পী
সাহিত্যিককে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলেই এইসব
কালজয়ী শিল্প সৃষ্টি হয়েছে ,কথাটা বুঝলে !
আর দেখেছ
রাজহাঁসটাকে ! আমাদেরই খেচর গোত্র । কী সুন্দর, একবার তাকিয়ে দেখ
। এই ছবির নাম লেদা আর হাঁস ।।
জোনাকিরা হাঁসের ওপর উড়ে গিয়ে বসছে । হাঁসের সাদা পালকে
নীল নীল টুনি বাল্বের মত । আর মেদিচিদের বাড়ির লাগামছাড়া বড়লোকি দেখে আমার সত্যি সত্যি মাথা ঘুরছে । বাবা কী দাপট!
হীরামন বলল , মাইকেল এঞ্জেলো
থেকে শুরু করে লেদা আর হাঁস আঁকেন নি এমন আর্টিস্ট তুমি বোধ হয় খুঁজে পাবেই না ।
শিল্পীরা খুব পছন্দ করতেন এই বিষয়টা ।
যেমন আমাদের দেশে কৃষ্ণের রাসলীলা , কালীয়দমন , শকুন্তলা ও
সখী , নরনারীকুঞ্জর , মনে কর সেরকমই একটা পছন্দের বিষয় ।
আমি বললাম কথা তো হচ্ছিল
ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ নিয়ে । আমরা দলছুট হয়ে খামকা মেদেচিদের বাড়িতে বসে বসে এখন ছবি
দেখব? নাকি ওরা আমাদের তাজা আঙুর টাটকা জলপাই, কিছু খেতে টেতে
দেবে?
হীরামন বলল , আমি যদি শখ করে
একটু গৌর চন্দ্রিকা ভাঁজি ,
তাতে তোমার এতো
আপত্তির কারণ কোথায় হে ? বাড়িতে বসে থাকলে
তো বিল্টু দাদুর ছবি আঁকার রং গুলতে এখন ! তার
থেকে ফ্লোরেন্সে বসে বসে শোনো
মান্ধাতা আমলের এক দিলচস্পি কিসসা ।
আমি বললাম বল , তাহলে । সে বললে
বিলাসী লোকেদের ঘর সাজানোয় লেদা আর হাঁসের
ছবি থাকবেই ধরে নাও ।রেনেসাঁ র সময় থেকে
আরো পিছিয়ে যাও ।আরও । পম্পেই শহরের লাভা ছাইয়ের জঞ্জাল থেকে এখন বেরিয়ে আসছে সেই লেদা আর হাঁস । ফ্রেস্কো ।
সেখানেও বড়লোকদের ভিলাগুলোতেও লেদা আর হাঁস ।
দেবী সরস্বতীর পায়ের তলায়
যে অতি সুবোধ বশংবদ হাঁস , সেই হংস
এখানে এক নারীর সঙ্গে প্রেমোন্মত্ত
।
আমি কথার মাঝখানে বলে
উঠলাম মেদিচিদের বাড়িতে বেশিক্ষণ ভালো লাগছে না, বুঝলি । আমার টাইমক্লকের ভীষণ সমস্যা হচ্ছে । তুই বেরিয়ে চল হীরামন ।
হীরামন বলল , ন্যাকা ! উনি যেন
আজকের মানুষ ! স্পার্টার রানি হেলেনের পায়ে ঝামা
ঘসে দিতে একসময় সে কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বুঝি ? লজ্জা লজ্জা করছে ?
মন দিয়ে শোনো , দেবরাজ জিউস বা জুপিটার এই গ্রিক মহিলা লেদার প্রেমে পড়েছিলেন ।
“A sudden blow : the great wings beating still
above the staggering girl...”
মানে শুধু একটি সাধারণ রাজহাঁস নয়, একটি অতিকায় রাজহংস । তার বিশাল ডানার নিচে ঝটপট করছে একটি নরম নারী ।
তারপর ?
“the broken wall, the
burning roof and tower
And Agamemnon dead . “
আমি দম আটকিয়ে বললাম তারপর ?
তারপর আর কী ? ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ ।স্পার্টার রাজা অ্যাগামেম্নন মারা গেলেন । ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস যে স্পার্টার হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে ছিল , সে একে একে স্পার্টার সব বীর যোদ্ধাদের মেরে ফেলল
। অ্যাকিলিসকে মেরে ফেলল পায়ের
গোড়ালিতে আঘাত করে । অ্যাকিলিস হিল । ওর শরীরের সবচেয়ে দুর্বল অংশ ।
ওর মা অমরতার নদীতে ছেলেকে চান করাতে গিয়ে পায়ের
গোড়ালি ধরে জলে চুবিয়েছিলেন । সারা শরীর জল মাখল , ওই গোড়ালিটুকু ছাড়া ।দশ বছর ধরে স্পার্টার সঙ্গে ট্রয়ের লড়াই চলল ওই হেলেনকে নিয়ে।
আমি বললাম , তারপর ?
হীরামন বলল , তারপর আর কী ? সব ছারখার হয়ে
গেল । অ্যাগামেমনন ছিলেন হেলেনের ভাসুর । হেলেনের পতিদেবতার নাম মেনেলাউস ।
আমি বললাম পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে সুকুমার রায়ের
বড়মন্ত্রীর গুলিসুতো খাবার মত লাগছে । আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না । এবারে চেঁচাবো
কিন্তু হীরামন, এই বলে
দিলাম !
হীরামন বলল , শোনো শোনো । অতও
ধৈর্য হারিও না । তোমায় পরমহংসের মত জলটুকু ফেলে দিয়ে ক্ষীরটুকু খাওয়াই । রামায়ণ মহাভারতের যুদ্ধ মায় পৃথিবীর যাবতীয় অশান্তি
নাকি মেয়েদের জন্য
ঘনিয়ে ওঠে ? কিন্তু ভেবে দেখো সর্বত্র তার
পেছনে পুরুষ কী মারাত্মক কলকাঠি
নাড়ে । এক রাজকীয় অতিকায় বলশালী রাজহাঁস
হয়ে জুপিটার বা জিউস জাপটে ধরলেন নরমসরম লেদা কে
। জবরদস্তি। সেই মিলনে জন্মাল হেলেন। খ্রিস্টের জন্মের মোটামুটি বারশো বছর আগে । কী লোভ , কী লোভ । এখনো এতটুকুও শুধরোয় নি
ব্যাটারা । খ্রিস্টের জন্মের চারশো
বছর আগে টিমেথিইয়াস নাকি প্রথম লেদা আর হাঁসের মূর্তি গড়েন । তারপর থেকে সব ওই কপি
ক্যাট হয়েই চলেছে । ওপরের কবিতাটা একটা সনেট । ইয়েটসের লেখা । উনি কিন্তু বেশ চাবুক হাতেই জিউসের বদমায়েশিকে সনেটে ধরে রেখেছেন ।
শুধু একটা সময় দিয়ে এই গল্পকে বাঁধতে পারবে না , জানো । শুধু স্থান
কাল পাত্র বদলিয়ে বদলিয়ে যায় !ঘটনাটা একই থাকে।
আমি হীরামনের জ্ঞানে মুগধ হয়ে বললাম,তবুও কি জানিস , একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম হেলেনের মায়ের নাম নেমেসিস্।
হীরামন তার বিখ্যাত ফিচেল হাসি দিয়ে বলল , আর ট্রোজান হর্সের মতো আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে হবে না।
আমি হীরামনের জ্ঞানে মুগধ হয়ে বললাম,তবুও কি জানিস , একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম হেলেনের মায়ের নাম নেমেসিস্।
হীরামন তার বিখ্যাত ফিচেল হাসি দিয়ে বলল , আর ট্রোজান হর্সের মতো আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে হবে না।
কাজেই ট্রয়ের যুদ্ধের
কারণ আসলে হাঁস , হেলেন নয় । ওই
“হ" টুকুই যা কমন । এই আমি হীরামন তোমাকে বলে গেলাম হক কথা ।আমি হয়বদন হয়ে শুধু বললাম হায় হায়।
Photo( Marble statue "Leda and swan" from Uffizi Gallery , Florence by Suparna Deb)