Tuesday 23 June 2020

আচাভুয়ার বোম্বাচাক // ট্রয়ের যুদ্ধ



  


  বৃষ্টি ভেজা জুঁই ফুলের গন্ধ পেলেই  জোনাকিরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসে । তখন মগজের খুপরির ঘুপচি অন্ধকারে আর  কাঁহাতক থাকতে পারে ওরা  ?
নাক আর কানের ফুটো দিয়ে একটা দুটো একটা দুটো করে বেরুতে থাকে । গিল  কা ইত্তর হাতের কব্জিতে যদি  একটু লাগানো থাকে আর ধুনোদানে যদি বড় ঠাকুমার  জ্বালিয়ে দেওয়া  সম্ব্রনী ধিকিধিকি ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকায় , তাহলে পরিস্থিতি একেবারেই  হাতের বাইরে চলে যায় । তখন ওরা চশমার সামনে জটলা পাকায় । নীল সাদাটে আলোর একটা ছায়াপথ তৈরি করে সেখানে মধুশালা বসিয়ে  দেয় ।  সেই সময় ওদের হোশরুবা থেকে ভালো ভালো লাইন পড়ে শোনাতে হয় 

“ The free spirit must drink wine
And my eyes are like goblets
My clay was  kneaded with  the juice of grapes 
…the clergyman passed the decree to remain continuously drunk “

সবটাই ঠিকঠাক  থাকে । ঝামেলা পাকায় শুধু হীরামন । সে সারা ঘর ফড়ফড় করে ডানা ঝাপ্টিয়ে শান্ত   জোনাকিদের ভয় পাইয়ে দেয় । আমি ভীষণ বিরক্ত হই ।
তোরা সব দুষ্টু পাখির দল । তোরা খুব বিচ্ছু ।গোবেচারা জোনাকিগুলোকে নাজেহাল করার কী দরকার “ ?
সে বললে , মন্দ বলনি ! আমরা পক্ষীকুল খুব গোলমেলে আর সেয়ানা । আবার ডাকাবুকোও   বটে ।
তবে তুমি ল্যাপটপে  এখন যা লিখছ , সে টা কিন্তু আগাগোড়া ভুল !
আমি বললাম , মানে ? কী বলতে চাস তুই ?
হীরামনের  খুরাফাতি বোঝা মুশকিল ।  হেঁয়ালি ছাড়া আর কিছুই ওর জানা নেই যেন ! আমার মুখের সামনে ডানার ঝাপটা মেরে বলল , ট্রয় যুদ্ধের কারণ, হেলেন ?
এক্কেবারে ভুল ।
আমি বললাম  হ্যাঁ , তুমি সব জেনে  বসে আছ ! সবজান্তা তোতারানি ।
সে অমনি বলে,  বেশি ঘাঁটিও   না । তুমি দুপুরবেলায় বড় ঠাকুমা ঘুমুলে   লুকিয়ে লুকিয়ে বিল্টু দাদুর আতরের বাক্স খোলো কেন , আমি জানিনা বুঝেছ ? তুমি জান যে  আতরে জিন আর পরী থাকে । বিল্টু দাদুর কাছে ওরা রাত্তির বেলা আসে ।  তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাই দেখতে গিয়েছিলে  । ড্রইং শিখিয়ে  বিল্টু দাদু  বাড়ি এলে আমি সব বলে দেব ।
আমি বললাম বিল্টু দাদুকে আমি ভয় মোটেই পাই না । তুই নিজে কী  জানিস বল দেখি 
হীরামন চোখ টিপে বলল , পথে এসো , পথে এসো ।চলো   চলো  , ঘুরিয়ে আনছি ।
আমার সামনে তখন ধোঁয়াটে  ঝিকিমিকি মিল্কিওয়ে। জোনাকির ছায়াপথ । সেই ছায়াপথে আমার রাহনুমা এক তোতা পাখি আর এক ঝাঁক জোনাকি     


একটা  বিশাল রাজহাঁস । রাজহাঁসটির  পিচ্ছিল সাদা পালক  ঢাকা  শরীর  থেকে  গড়িয়ে পড়ছে রাজকীয় জ্যোৎস্না  । সেই  জ্যোৎস্নায়  স্নান করছে এক পেলব নারী
  বলে নাকি রাজহাঁস  শুদ্ধ , পবিত্র ও আধ্যাত্মিক । পরমহংস । ডিভাইন । সেই ডিভাইন রাজহাঁস তুঙ্গ মদমত্ততায় যাবতীয় প্রতীকী  সম্ভ্রমকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে আছে সেই নারীকে 
আমি সেই বিশাল  টেম্পেরার সামনে দাঁড়িয়ে  হংসমধ্যে  বকযথার মত হীরামনকে জিজ্ঞেস করলাম,  এটা কী রে ?
হীরামন বলল , আস্তে কথা বল । আর গাড়লের মত কথা বল না । তুমি এখন  কয়েকশ বছর পিছিয়ে গেছ । মনে রেখ এটা ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের ধনকুবের মেদিচিদের বাড়ি ,থুড়ি প্রাসাদ !
এখন রেনেসাঁর সময় । শুকনো মুখে বাসি  রুটি আর পচা চিজ খেয়ে তো রেনেসাঁ হয় না । পৃষ্ঠপোষকতা লাগে । বুঝলে ?
মেদিচিরা কত শিল্পী সাহিত্যিককে  বাঁচিয়ে রেখেছেন  বলেই এইসব  কালজয়ী শিল্প সৃষ্টি হয়েছে ,কথাটা বুঝলে !
আর দেখেছ রাজহাঁসটাকে  ! আমাদেরই খেচর  গোত্র । কী সুন্দর, একবার  তাকিয়ে দেখ  । এই ছবির নাম লেদা আর হাঁস ।। 
জোনাকিরা  হাঁসের ওপর উড়ে গিয়ে বসছে । হাঁসের সাদা পালকে নীল নীল টুনি বাল্বের মত । আর মেদিচিদের বাড়ির লাগামছাড়া বড়লোকি  দেখে আমার সত্যি সত্যি মাথা ঘুরছে । বাবা কী  দাপট! 
হীরামন বলল , মাইকেল এঞ্জেলো থেকে শুরু করে লেদা আর হাঁস আঁকেন নি এমন আর্টিস্ট তুমি বোধ হয় খুঁজে পাবেই না । শিল্পীরা খুব পছন্দ করতেন  এই বিষয়টা । যেমন আমাদের দেশে কৃষ্ণের রাসলীলা ,  কালীয়দমন , শকুন্তলা ও সখী  , নরনারীকুঞ্জর ,   মনে কর সেরকমই  একটা  পছন্দের বিষয় ।
আমি বললাম কথা তো হচ্ছিল ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ নিয়ে । আমরা দলছুট হয়ে খামকা মেদেচিদের বাড়িতে বসে বসে এখন  ছবি দেখব? নাকি  ওরা  আমাদের তাজা আঙুর   টাটকা  জলপাই, কিছু খেতে টেতে দেবে?
হীরামন বলল , আমি যদি শখ করে একটু গৌর চন্দ্রিকা ভাঁজি , তাতে তোমার এতো আপত্তির কারণ কোথায় হে  ? বাড়িতে বসে থাকলে তো বিল্টু দাদুর ছবি আঁকার রং গুলতে এখন ! তার  থেকে ফ্লোরেন্সে বসে  বসে শোনো মান্ধাতা আমলের  এক  দিলচস্পি কিসসা ।
আমি বললাম বল , তাহলে । সে বললে বিলাসী লোকেদের ঘর সাজানোয়  লেদা আর হাঁসের ছবি থাকবেই  ধরে নাও ।রেনেসাঁ র সময় থেকে আরো পিছিয়ে যাও ।আরও । পম্পেই শহরের লাভা ছাইয়ের জঞ্জাল থেকে এখন  বেরিয়ে আসছে সেই লেদা আর হাঁস । ফ্রেস্কো । সেখানেও  বড়লোকদের ভিলাগুলোতেও  লেদা আর হাঁস ।


দেবী সরস্বতীর পায়ের তলায় যে অতি সুবোধ  বশংবদ  হাঁস , সেই হংস  এখানে এক নারীর সঙ্গে প্রেমোন্মত্ত 
আমি কথার মাঝখানে বলে উঠলাম  মেদিচিদের বাড়িতে  বেশিক্ষণ ভালো লাগছে না, বুঝলি  । আমার টাইমক্লকের  ভীষণ সমস্যা হচ্ছে । তুই বেরিয়ে চল হীরামন ।
হীরামন বলল , ন্যাকা ! উনি যেন আজকের মানুষ !  স্পার্টার রানি হেলেনের পায়ে ঝামা ঘসে দিতে একসময় সে কথা মনে পড়ে যাচ্ছে বুঝি ? লজ্জা লজ্জা করছে ?
মন দিয়ে শোনো  , দেবরাজ জিউস বা  জুপিটার এই গ্রিক মহিলা লেদার প্রেমে পড়েছিলেন ।   

“A sudden blow : the great wings beating still
above the staggering girl...”

মানে শুধু একটি সাধারণ   রাজহাঁস নয়, একটি অতিকায় রাজহংস  । তার বিশাল  ডানার নিচে ঝটপট করছে একটি নরম নারী ।
তারপর ?

“the broken wall,  the burning roof and tower
And Agamemnon dead . “

আমি  দম আটকিয়ে বললাম তারপর ?
তারপর আর কী ? ট্রয়ের যুদ্ধ শেষ ।স্পার্টার  রাজা অ্যাগামেম্নন মারা গেলেন । ট্রয়ের রাজকুমার  প্যারিস যে স্পার্টার  হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে ছিল  , সে একে একে স্পার্টার সব বীর যোদ্ধাদের  মেরে ফেলল  । অ্যাকিলিসকে মেরে ফেলল  পায়ের গোড়ালিতে আঘাত করে । অ্যাকিলিস হিল । ওর শরীরের সবচেয়ে  দুর্বল অংশ ।  ওর  মা  অমরতার নদীতে ছেলেকে চান করাতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি ধরে জলে চুবিয়েছিলেন । সারা শরীর জল মাখল , ওই গোড়ালিটুকু ছাড়া ।দশ বছর ধরে স্পার্টার সঙ্গে ট্রয়ের লড়াই  চলল  ওই হেলেনকে নিয়ে।  
আমি বললাম , তারপর ?
হীরামন বলল , তারপর আর কী ? সব ছারখার হয়ে গেল ।  অ্যাগামেমনন  ছিলেন হেলেনের ভাসুর । হেলেনের  পতিদেবতার নাম মেনেলাউস ।

আমি  বললাম পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে সুকুমার রায়ের বড়মন্ত্রীর গুলিসুতো খাবার মত লাগছে । আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না । এবারে চেঁচাবো কিন্তু হীরামন, এই বলে দিলাম  !
হীরামন বলল , শোনো শোনো । অতও ধৈর্য হারিও না । তোমায় পরমহংসের মত জলটুকু ফেলে দিয়ে ক্ষীরটুকু খাওয়াই ।   রামায়ণ মহাভারতের যুদ্ধ  মায় পৃথিবীর যাবতীয়  অশান্তি  নাকি  মেয়েদের  জন্য  ঘনিয়ে ওঠে ?  কিন্তু ভেবে দেখো সর্বত্র  তার পেছনে   পুরুষ কী মারাত্মক কলকাঠি নাড়ে  । এক রাজকীয় অতিকায় বলশালী রাজহাঁস হয়ে জুপিটার বা  জিউস জাপটে ধরলেন নরমসরম  লেদা কে । জবরদস্তি। সেই মিলনে জন্মাল  হেলেন।  খ্রিস্টের জন্মের মোটামুটি বারশো বছর আগে । কী লোভ , কী লোভ । এখনো এতটুকুও শুধরোয়  নি  ব্যাটারা । খ্রিস্টের জন্মের  চারশো বছর আগে টিমেথিইয়াস নাকি প্রথম লেদা আর হাঁসের মূর্তি গড়েন । তারপর থেকে সব ওই কপি ক্যাট হয়েই চলেছে । ওপরের কবিতাটা একটা সনেট । ইয়েটসের লেখা । উনি কিন্তু   বেশ চাবুক হাতেই  জিউসের বদমায়েশিকে  সনেটে ধরে রেখেছেন । 

 শুধু একটা সময় দিয়ে এই গল্পকে বাঁধতে পারবে না , জানো । শুধু স্থান কাল পাত্র বদলিয়ে বদলিয়ে যায় !ঘটনাটা একই  থাকে।  
আমি  হীরামনের  জ্ঞানে মুগধ হয়ে বললাম,তবুও কি জানিস , একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম হেলেনের মায়ের নাম নেমেসিস্।  
হীরামন তার বিখ্যাত ফিচেল  হাসি দিয়ে বলল , আর ট্রোজান হর্সের মতো আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে হবে না।  
কাজেই  ট্রয়ের যুদ্ধের কারণ আসলে হাঁস , হেলেন নয় । ওই “হ"  টুকুই যা কমন ।  এই আমি হীরামন তোমাকে বলে গেলাম হক কথা ।আমি হয়বদন হয়ে শুধু বললাম হায় হায়। 


Photo( Marble statue "Leda and swan"  from Uffizi Gallery , Florence by Suparna Deb)