Friday 24 November 2017

সামার হলিডে

পাইন গাছের হলুদ রেণু অনেকটা হলুদ আবিরের মতো । ঢাল বেয়ে গ্লেন ভ্যালির রাস্তায় কে যেন  ভিজে   শিফনের ওড়না ফেলে গেছে  । আর সেই পথে  ওরা দুজন হেঁটে গেছে । দুজনের দুজোড়া পায়ের ছাপ সেই ভেজা ওড়নায় । পাশাপাশি । আরো একটু ঢালে নেমে গেলে দেখা যাবে ওরা দুজন বসে আছে , হাত ধরাধরি করে ।দুজনের মুখে মিস্টি হাসি । কোথাও কোনো শব্দ নেই । ঝিমঝিমে সকালের  হালকা রোদ্দুর বিলি কাটছে  ওদের চুলে । ওরা বিএফ জি এফ । বয় ফ্রেন্ড আর গার্ল ফ্রেন্ড । আজকাল বিএফ জিএফ না থাকলে আবার স্ট্যাটাস থাকে না জানো ! তবে স্মিথ আর নাতালি দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসে ।

We're all going on a summer holiday
No more working for a week or two.
Fun and laughter on our summer holiday,
No more worries for me or you,
For a week or two.

হাত ধরাধরি করে ওরা ওপরে উঠে আসতেই স্মিথের বাবা গলা  শোনা গেল “ ব্রেকফাস্ট হয়েছে তোমাদের”?
স্মিথের বাবা নাতালিকে মানে ছেলের গার্ল ফ্রেন্ডকে বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন । মেয়েটা নিতান্তই সরল সোজা । তার ছেলের মতো সেয়ানা নয় । আর অত গুছিয়ে গুছিয়ে কথাও বলতে পারে না । অত বাংলাও জানে না ।  স্মিথ টা তো ঝানু । কিভাবে সব কিছু ম্যানুপুলেট করতে হয় সে বিষয়ে তার ছেলে একেবারে তুখোড় ।
নাতালি চড়াই পাখি কে   স্প্যারো বলে । ঝাঁটাকে বলে ব্রুম স্টিক । একবার নর্থ বেঙ্গলের খুঁটি মারি জঙ্গলে বেড়াতে গেছিল তারপর যখন ওকে জিগ্যেস করা হল কোথায় গেছিলে গো  ,নাতালি বলেছিল খুন্ঠিমাঢ়ি আর ছিলাপাটা ।  আর সবকিছুতেই ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে যায় । যেন কথাটা এই প্রথম শুনছে । সেদিক থেকে মেয়েটি ভারি ভালো ,কিন্তু তার ছেলের হাতে এ মেয়েকে অশেষ হ্যাপা পোহাতে হবে, স্মিথের বাবা বেশ ভালোই বুঝছেন ।
স্মিথের বাবা তার ছেলের মতো বকবকে নন । তিনি চুপচাপ মাল্টিটাসকিং করতে ভালোবাসেন তারা সবাই মিলে গরমের   ছুটিতে  পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে । স্মিথের বাবা মিঠে রোদ্দুরে বসে আছেন , পাইন বনের মধ্যিখানে । বাঁ হাতদিয়ে তিনি মোবাইলে অনর্গল কথা বলছেন , ডান হাত দিয়ে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন । ডানপায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ পায়ের গোড়ালি চুলকুচ্ছেন আর তার দিদি ঘর থেকে বেরোলো কিনা মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখছেন ।
স্মিথের পিসি আবার এই পাহাড় ভ্রমণের মুখ্য উদ্যোক্তা । কারণ তিনি একসময়ে এখানে থাকতেন । দুদিন আগে  রাত একটার সময় ঠান্ডা ঠান্ডা তারা জ্বলা  চড়াই উৎরাই পথ দিয়ে ওরা  যখন এখানে এলো , স্মিথ আর নাতালি তো ঘুমিয়ে কাদা
সকালের রোদ্দুর  আর চকচকে নীল আকাশ দেখে সব্বার মন খুশ ।
তার মধ্যেও পাকা ছেলে   স্মিথ  বাবাকে জিগ্যেস করল “এই এতদূরে পিসি পড়তে আসতো কেন  বলো তো ”?
স্মিথের বাবা বেশি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মানে বেশি শব্দ খরচা করতে ভালোবাসেন নাউদাস মুখে বললেন , কি জানি । হয়তো ওদিকে চান্স টান্স পায় নি , তাই ।  
হুম । নাতালির সঙ্গে স্মিথ চোখাচোখি করল । পিসির মাথাটা বেশ খারাপ সেটা তো জানা কথাই  । কোন একটা বেখাপ্পা জায়গায় তিনি লাঞ্চ খেতে যাবেন । ওদেরও সঙ্গে যেতে হল । সেখানে গিয়েই স্মিথ বুঝেছিল,জায়গাটা সুবিধের নয় ।  এখানে বেশ  গন্ডগোল আছে । যত রাজ্যের পুরোনো ঝুরঝুরে ম্যাগাজিন জড়ো করা , একটা লম্বা দাড়ি লম্বা চুল দৈত্যের মতো লোক আর তার বুড়ি খুনখুনে মা বসে আছে । তারা নাকি ট্রাউট মাছ খাওয়াবে । শিমলায় কি ট্রাউট পাওয়া যায় ? সেতো পাওয়া মানালিতে । তবু পিসির আদিখ্যেতার শেষ নেই । সেইসব স্মোকড পোচড মাছ দেখেই স্মিথের গা গুলিয়ে উঠছিল । কিন্তু কিছু বলা যাবে না।  কারণ পিসির সেন্টিমেন্ট । শেষে নাতালি আর ও মিলে চিকেন ভাজা , পাস্তা আর কোক খেয়ে পেট ভরালো ।





আরে ,কত বদলে গেছে জায়গাটা । এখানে একটা প্রিমরোজের ঝাড় ছিল অনেক অনেক ছোট্ট ছোট্ট গোলাপি প্রিমরোজ একদম দোতলা পর্যন্ত দেওয়ালটাকে জড়িয়ে থাকত । আজ আর নেই । একদম হাওয়া । পিসি ভুলেই গেছে মাঝখানে কেটে গেছে কতো কতো দিন । একটা নতুন অচেনা গাছ । সে পিসিকে চেনে না । পিসিও তার নাম জানে না ।
ওই গাছটাকে বলে পোটাটো সেলেনিয়াম । স্মিথ পটর পটর করে কেটে কেটে  বলল ।
ও, তা  তুই কি করে জানলি রে ?
পিসি ভাবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কী স্মার্ট ! সব জানে !
তুমি সেই কাল থেকে এখানকার বিভিন্ন লোককে নানান ভুলভাল নামে ডাকছিলে , টেকচান্দ কে করমচান্দ,রাভিন্দরকে পরশুরাম.. ওরা যখন বলছিল যে ওগুলো ওদের নাম নয় , তখন তুমি এমনভাবে তাকালে যেন ওরাই মিথ্যে বলছে ।  তারপর তোমার দিকে হাসিহাসি মুখে ওই যে লোকটা  এলো, তাকে আবার তুমি চিনতেই পারলেনা ।ওই তাদেরই  মধ্যে একজনকে আজ সকালে জিগ্যেস করেছিলাম । স্মিথ আবার গাছপালা পশুপাখি  খুব ভালোবাসে ।
তাই বলে প্রিমরোজকে তুলে দিয়ে পোটাটো সেলেনিয়াম ?  আর দ্যাখ , গাছটা দেখতেও তেমন ভালো নয় । দোতলার ওই ছোট্ট জানালাটা দেখছিস ওখান থেকে গলা বাড়িয়ে প্রিমরোজের ঝাড়ের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে আমার একটা ছবিও আছে । কী সুন্দর ছবি হয়েছিল । ওটা বাথরুমের জানালা ছিল, জানিস । দেখলে কেউ বলবে?
স্মিথ জানে পিসির এই স্মৃতি রোমন্থনের ঝড় টা তাকেই বেশি সামলাতে হবে কারণ পিসেমশাই বা বাবা বা নাতালি কেউই তেমন উৎসাহী শ্রোতা নয় ।

পোট্যাটো সেলেনিয়াম 



যোগেশ জিইইই, পিসি ডাকলো । যোগেশ না মহেশ কেউ একজন এলো । পিসি বল্ল লাউঞ্জ টা খুলে দিন , আমার ভাইপোকে দেখাবো । লাউঞ্জটা এমন বন্ধ রাখেন কেন? আমাদের সময় আমরা এখানে বসে ইংরেজি হিন্দি বাংলা মারাঠি তামিল স্প্যানিশ গোয়ান কত  গান শুনতাম , কত ফাংশান করতাম , কত পারটি হত । পার্টির দিন পালিশ করে করে কাঠের মেঝে এমন চকচকে করে তোলা হত যে পা পিছলে যেত । নরম আলো , সাদা লেসের পর্দা , চকচকে পিয়ানো , কত পেইন্টিং ।
আপকা জমানে  মে হোতা হোগা । এখন তো বন্ধই থাকে । মহেশ অথবা যোগেশ উত্তর দিল ।
সে কি ছেলেমেয়েরা সব কোথায় আড্ডা দেয়? গান বাজনা কোথায় হয় ? পার্টি শারটি ?
আজকাল তো অনেক নতুন জায়গা বানানো হয়েছে । কেমন খোলামেলা ঝাঁ চকচকে ।  দেখেন নি ? সেখানেই হয় ।
কিন্তু কোনো ছেলেমেয়েকেই তো দেখা যাচ্ছে না । আমরা সবাই ঘাসের ওপর বসে রঙিন ছাতার নিচে পড়তে বসতুম ।
পায়ের কাছে এই এতো টুকুন টুকুন ব্যাঙের ছাতা , লালের ওপর কালো ছিটছিটে পোকারা ঘুরঘুর করতো ।
 এত নীল এত সবুজ এত রঙ , এদের তেমন টানে না বোধহয় । কে জানে!
চোখের সামনে কেমন ঝিরঝির করে বরফ পড়তো । আবার বর্ষার সময় দূরের ছাই রঙা পাহাড় গুলো নরম সবুজ ফেল্টের মত ঘাসে ভরে যেত । অনেক ছত্রাক , লাইকেন ফার্ন পাথরের গায়ে , গাছে গাছে জড়িয়ে থাকত । এমনকি শেষ দিনটা অব্দি পষ্ট মনে আছে ।সেদিন বাগানের মাটি ঢাকা ছিল খড় দিয়ে । বাগানে নেই একছিটে রঙ । শীত আসছে , শীত আসছে । শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট চারা গুলো । আর কিছু ফুল গাছকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে খড়ের টুপি । কাঁচের গ্রিনহাউসে সযত্নে ওম পাচ্ছে ক্যাকটাসের দল । বাতাসে হিম হয়ে আসা শীত । কনকনে । হিংসুটে দত্যির বাগান । এরপর কোন রন্ধ্রপথ দিয়ে বসন্ত ঢুকে পড়বে । আর সে যে কী সমারোহ ! রঙের । জীবনের । তারুণ্যের । প্রজাপতি আর মৌমাছির দল । আমরা আর তা দেখতে আসব না । জুনমাসে যখন হালকা হালকা বাতাস বইবে, চিকন সবুজ পাতা তিরতির করে কাঁপবে, ঝকঝকে আকাশে নক্ষত্ররা বীথিপথ তৈরি করতে আসবে আর দিনের বেলা নরম রোদে ভাসবে চারদিক , প্রিম্রোজের ঢল নামবে লনের দেউড়িতে , গীতালির বাথরুমের দেওয়ালে , সেই বসন্তে আমরা আবার একবার ফিরে এসেছিলাম। রাতে ডিনারের পর পাইন ঝোপের পাশ দিয়ে  ডোমের বাতির আলোয় স্বপ্নমাখা ঢালু জমি দিয়ে গেট অবধি হাঁটা আর আবিদা পরভিনের গান  “অ্যায় দিলনশী তলাশ তেরে কুবকু নহি ।“

স্মিথ বল্ল দেখো পিসি, কত সময় পার হয়েছে খেয়াল আছে?  সবাই এখন মোবাইল ল্যাপটপ কিন্ডল আইপড  হাতে নিয়ে বসে থাকে  । খাবারঘরে দেখলামও তাই । সবটাইতো হাতের মুঠোয় ।  বলো ,  তোমরা কি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ?
আমরা অনেক কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম । অনেক কিছু । এখনকার থেকে ঢের বেশি ।

 “ নম্র নেত্রপাত ছিল তবু—
প্রকৃত ধবলবেশী নারী
প্রকৃতির মতো স্থির
পুকুরের মতো অবসরা
ভালোবাসা দেবে বলে বসে আছে দিকচক্রবাল
জুড়ে, তবু,তবু নিষিদ্ধতা।
সফল স্বপ্নরা ছিল,তবু
কুয়াশা বাষ্পের বাড়াবাড়ি
পুষ্পিত বাগানে বসে
পরস্পর পায়রার মতন
কথাবার্তা হবে বলে শুরু করে হঠাত বিহ্বল
হয়ে,তবু, তবু প্রগলভতা ।“


এই জানিস , পেছনের রাস্তা দিয়ে এক্কেবারে সামার হিল স্টেশনে নেমে যাওয়া যায় ? যাবি ? রাস্তাটা  কী সুন্দর ! ছায়া ছায়া ।পাইনবনের জাফরি কাটা । তারপর একটু টাল খেয়ে গড়িয়ে গেলেই কান্তা আন্টির রান্নাঘর । উইলো গাছের নিচে ।
স্মিথ জানে , তাকে তো যেতেই হবে ,আর কে যাবে এনার সঙ্গে । তো,  পিসি ভাইপো রওয়ানা হল । কী বলবো ! বাপরে , পাইনবনের জাফরি তো দূরস্থান ,ছায়া ছায়া মায়ামায়া তো কষ্ট কল্পনা ! উইলো গাছের নিচে কোথায় কান্তা আন্টির রান্নাঘরে আপেল পাইএর গন্ধ ! কী ধুলো কী ধুলো ! সমানে গাড়ি চলছে ।  পিসি ভারি অপ্রস্তুত ! এমনটা হবার কথা ছিল না , বুঝলি । এ রাস্তায় তো গাড়িই চলত না ।  

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা সব্বাই মলের রাস্তা ধরেছে ।  নাতালি ভারি অবাক হয়ে বলল ,শপিং মলে যাবো এখন ? স্মিথ বলল হ্যাঁ হ্যাঁ শপিং মল , চলো জলদি ।

চৌরা ময়দানের মাথায় উঠেই পিসি আবার শুরু করল , গুপ্তাজির দোকানটা গেল কোথায় রে ?
স্মিথ বল্ল আমি তার কি জানি ! এই বলে নাতালির হাত ধরে গটগট করে হেঁটে চলে গেল । পিসি কিন্তু হাল ছাড়লো না । দোকান দোকান ঘুরে গুপ্তাজির খবর নিতে থাকল ।  নানান রকমের দোকান । পিসি জিগ্যেস করেই চলেছে আচ্ছা ভাইসাব, গুপ্তাজি কোথায় গেলেন ? আরে ওর দোকান থেকে টুকিটাকি কত জিনিস কিনতাম । আমাদের সব্বাইকে উনি চিনতেন । আর ইয়ারোজে টেলিফোন গন্ডগোল করলে ওই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে এই চৌরা ময়দানে গুপ্তাজির দোকান থেকে আমরা এস টি ডি করতাম । গুপ্তাজি সবসময় নেশায় টং হয়ে থাকত কিন্তু কী ভদ্র সভ্য ছিল । কোথায় গেলেন বলুন তো ? বেঁচে আছেন তো ?
নতুন নতুন সব মুখ বলল , পতা নহি । কহি চলা গয়া হোগা দুকান বেচ দিয়া হোগা ।
স্মিথের বাবা এবার পেছন ফিরে তাকালো । মুখে একটা অদ্ভুত হাসি । কিছু বলল না অবিশ্যি ।
এ হাসির  একটা মারাত্মক কারণ আছে । তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল ছিল না । কত দূরে একটা ফোনের জন্য কারা যেন সব অপেক্ষা করত । তারা তো জানে না সেই কত দূরে বরফ পড়ছে ,না বৃষ্টি পড়ছে , না মন ভালো নেই !

“অনেক দূরে সাজিয়ে বাগান সাতপুরা
হাতছানি দেয় স্বপ্ন দেখে এক বালক
দিদি তাকে পাঠায় আতর অক্ষরে
ঘুমের ভেতর ছড়ায় সে তা শখ করে
দিনের পরে দিন কেটে যায় পথ চেয়ে
দূরভাষের শব্দ রাতে রোমাঞ্চক “




মলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে  পিসির চোখে পড়লো অনেক কিছুই বদলেছে বেশ  ।  পুরোনো দোকানগুলো আর কিছুই প্রায় নেই ।স্যানিটোরিয়াম থেকে ডক্টর অ্যালেন আর গুড মর্নিং বললেন না । হিম বুনকর নাকি কবেই বন্ধ হয়ে গেছে । লোয়ার মলে রঙ তুলি কাগজের দোকানের সেই সৌম্য দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ,দেখা হলেই মাথা নুইয়ে হাসতেন ! বাতিশ নামের দোকানটাও নেই ।

আমরা আইসক্রিম খাব এখন । নাতালি আর স্মিথ । হিহিহিহি করে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছে । জম্পেশ করে ওরা আইসক্রিম খাচ্ছে । আর পিসির চোখ কাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে কে জানে! নাতালি আর স্মিথ হুশ হুশ করে হাঁটছে ।

ক্যান্ডিফ্লস ক্যান্ডিফ্লস

আমরা ক্যান্ডিফ্লস খাবো ।

ওরা বুড়ির গোলাপি চুল খাচ্ছে । আবার ছবির তোলার পোজ দিচ্ছে ।
বুড়ির চুল খেয়ে বলে কি , এবার ঘোড়ায় চাপবো ।

পিসি আর তাল রেখে পারে না ।
চল যাই , কোথাও বসে সুপ টুপ  খাই ।
হ্যাঁ হ্যাঁ সুপ খাবো , সুপ খাবো ।

পিসি কিন্তু চয়েস আর আন্টিস দুটোর একটাকেও খুঁজে পায় নি । গেইটি থিয়েটারের পাশে ভারি সুন্দর গোল আকারের রেস্তোরাঁ । তখনও ছিল । তবে তখন আমরা আন্টিস বা চয়েসেই যেতাম । লোয়ার মলে । ঘুপচি ঘুপচি ।
রেস্তরাঁর ভেতর টা গমগমে । কাঁচের জানালার বাইরে জমকালো সন্ধে ।
পাইনবনের আড়ালে সূর্য ডুবে গেছে কখন!  তার লাল আভার সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে আলো জ্বলে উঠছে ।
স্মিথ বল্ল কী সুন্দর না? যেন হিরের বাক্স উলটে গেছে ।
একটু বেশি বেশি হিরে দেখছি এখন ! তখনও ছিল তবে এতো টা না ।
আবার শুরু করলে তুমি? এখন আর তখন । কি করছ বলো তো  সেই তখন থেকে ?
শোন , বেশি বেশি হিরের মানে কি বলতো ? অনেক অনেক নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে । রাস্তাঘাট হয়েছে । আর অনেক অনেক গাছ কাটাও হয়েছে । তাই বলছিলাম । শহরটা বদলেছে না ?
আবার  লম্বা পাহাড়ি পথ । ওরা ফেরত যাচ্ছে সারাদিন বেড়িয়ে । একটা জায়গায় এসে আবার পিসি থামে । দ্যাখ , এখানে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের একটা বাড়ি ছিল, পাইনবনের এক্কেবারে নিচে । সেটা নেই রে ! রামকৃষ্ণ মন্দির হয়ে গেছে ।
স্মিথ বলল , ভালো করে তাকাও , গেটের পাশে এখনো ব্রাহ্ম সমাজ লেখা টা পড়া যাচ্ছে, ভালো করে দেখো ।






আবার কী হল ? এবার পা চালাও । অনেকটা যেতে হবে যে পিসি  ।
এখানটায় বুঝলি , একটা ছোট্ট দোকান ছিল । হিমাচলি পোষাকে একজন মা আর তার ছা । একটু মলিন মলিন । কিন্তু কি জানিস ,আমরা ওই দোকান থেকে বাড়ি যাবার আগে একটা দারুণ সুন্দর  খাবার জিনিশ অর্ডার করতাম । একদিন আগে বলতে হত । ওরা একদম ফ্রেশ বানিয়ে দিত । আহা , নাম টা বল না ? মনে আসছে না রে ! বড্ড ভালো খেতে । ওপরটা মুচমুচে । ভেতরে নরম নারকেলের পুর । বাড়িতে সবাই খুব খুশি হত । এত গাদাগুচ্ছের কুকি ফুকি তখন তো ছিল না ।
নামটা বলনা ? সেই যে খুব সুন্দর নরম নরম অথব মুচমুচে ।
আচ্ছা , পিসি আমি কী করে জানব বলো তো ? তুমি কবে কী খেয়ে ছিলে,  কী বাড়ি নিয়ে যেতে ?
নাতালি আর স্মিথ পিসির পেছনে লাগে । সারা রাস্তা ।
আহা, কি জানিস , কোনো জিনিশের নাম মনে না পড়লে কি রকম যেন একটা অস্বস্তি হয় ।


“সেই দিনটা ছিল বছরের শেষ দিন
আর আমাদের সফরের শুরু
নিদ্রাহীনতা এবং দীর্ঘ  যাত্রায়
শ্রান্ত আমাদের শরীরে
ছিল শুধু স্নানের স্বপ্ন “।
  
যাক , সবাই তাহলে রেডি । চল রওনা হই । স্মিথের বাবার  গলা তুলে সব্বাইকে ডাকল ।
আবহাওয়া অতি মনোরম । গরমের ছুটি শেষ । এবার পাহাড় থেকে নামো ।
নাতালি আদুরে আদুরে গলায় বলল , আমাদের ট্রেনে চাপা হয় নি তো ,  কিন্তু স্টেশনটা একবার দেখব । পাহাড়ের স্টেশন গুলো খুব সুইট সুইট দেখতে হয় ।একেবারে স্টোরিবুকের মতো ।
হিল কার্ট রোডে উঠে ড্রাইভার বলল, বাঁয়ে দেখিয়ে স্টেশন । স্মিথ চেঁচিয়ে উঠে নাতালিকে ডেকে বলল , মা , মা দেখো ছোট্ট ট্রেন । আমার খেলনার মতো ।

আর কী বলব ? অমনি পিসি চিল চিৎকার দিয়ে উঠল, আরে আরে মনে পড়ে গেছে ,মনে পড়ে গেছে , ম্যাকারুন ম্যাকারুন । ওপরটা মুচমুচে, ভেতরে নরম নরম নারকেলের পুর । মাথায় বসানো আধখানা লাল চেরি ।
পিসি দৌড়চ্ছে , কাঁধে ব্যাগ , ব্যাগে ম্যাকারুন । শিবালিক এক্সপ্রেসের শেষ কামরা । ঝপাৎ করে পিসির ল্যান্ডিং । পরনে জিন্স,খাদির পাঞ্জাবি । ক্লাস সেরে দৌড়ে আসছে । স্টেশনে লতা সিং টা টা করছে । পাইনগাছের ফাঁকে সূর্য ডুবে গেছে ।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । আরে কান্তা আন্টি যে ! কান্তা আন্টি হামেশাই দিল্লি যায় মেয়ের কাছে ।  আও বেটা ব্যায়ঠো । সঙ্গে আছে আলুর পরোটা । পন্ডিতজি ফয়েল দিয়ে  যত্ন করে মুড়ে  দিয়েছে । জানো ,কান্তা আন্টির প্রতিবেশি কে ছিল ! প্রীতি জিন্টা ! নেক্সট ডোর নেবারকান্তা আন্টি অনুপম খেরকেও চেনে । পাড়ার লোক ! কামরার ভেতরে গপ্প বাইরে রাত ঘন । সামারহিল, তারাদেবী, বারোগ, জাতোগ । সোলান  । একের পর এক স্টেশন চলে যাচ্ছে ।  কান্তা আন্টি আপেল পাই খেতে দিচ্ছে । ফ্লাস্ক থেকে কফি । আরামে চোখ বুজে আসছে যে ।  ছুটি ছুটি ।  বাড়ি আসছে । বাড়ি আসছে । বাড়ি আসছে ।


ধান্নো কি আঁ খো মে হ্যাঁয় রাত কা সুরমা
অউর চাঁদ কা চুমাআআআআ

 
স্মিথ আর নাতালি 


পিসি আর স্মিথ



কবিতা  ক্রমান্বয়ে ঃ যশোধরা রায়চৌধুরী , বাসুদেব দেব , আয়ান রশীদ খান

ছবি  লেখক 

Thursday 2 November 2017

খম্মা ঘানি সা


 বেঁচে তো আছি , কিন্তু জীবনের সে আনন্দ কই”?
তারপর?
না মিল নে কা খুশি  , না জানে কা ঘম । ভেতর থেকে যেন শুকিয়ে যাচ্ছিলাম ।
তারপর?
তারপর আর কী ? তার আর পর নেই। নেই কোনো ঠিকানা । একদিন দুম করে ঠিক করলাম যে দিকে দু চোখ যায় চলে যাব । যাবার আগে কোন রিস্তেদার নয়, হাজির হলাম এক বন্ধুর বাড়ি । বললাম, এই ঘষটে ঘষটে চলা আর পোষাচ্ছে না, শহর ছেড়ে চলে যাব , আজ রাতেই ।
সে বলল, কোথায় যাবে, কিছু ঠিক করেছ
না ।
এক কাজ কর, যখন শহর ছাড়বে মনস্থির  করেই ফেলেছ আমাদের গ্রামটা একবার ঘুরে  এসো । ওখানে আমার বাড়িতে দু তিনদিন থাকো, তারপর ভেবে দেখো ।
বাড়ি গিয়ে চন্দাকে বললাম আজ বেরিয়ে যাব , দরকারি জিনিশপত্র গুছিয়ে ফেলো  । বাচ্চাদের খাইয়ে দাও । আর হ্যাঁ, তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো?
সে বলল ,যেখানে তুমি আর বাচ্চারা , সেটাই আমার ঘর ।
মোবাইল থেকে তিনশোটা নম্বর ডিলিট করে ,বাক্স গুছিয়ে খাবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লাম ।    গাড়ি চালাবো কি ? হু হু করে দু চোখ ছাপিয়ে জল পড়ছে । এতো দিনের নিজের শহর জয়পুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ।
চন্দা বলল , চোখের জলের সঙ্গে জয়পুর বেরিয়ে যাচ্ছে তোমার ।
নিকল নে দে ।
সেই থেকে আজ সাত বছর হয়ে গেল এখান থেকে নড়তে পারিনি ।
ঝাল ঝাল লঙ্কা মাখা ডালমুট ,মিরচি পকোড়াসামোসা , বুঁদির লাড্ডু । আদা দেওয়া চা । পাওয়ানা হাভেলির টেরাসে ঢিমি ঢিমি আলো । পাশেই রঘুনাথ মন্দিরে আরতির ঘন্টা ।
রাজিন্দর সিং জির একটা ফোন এলো ।
হাঁ হুকুম , বোলো , আভি যা রহা হু । কুছ লানা হ্যাঁয় ?
রাজিন্দর জি উঠে পড়লেন ।
গায়ে পড়েই জিগ্যেস করলাম, এতো মিস্টি করে কার সঙ্গে কথা কইছিলেন ?
আমার বউ, চন্দা ।
হুকুম বলে ডাকেন ?
আমরা রাজপুতরা সম্মান দিয়ে হুকুম বলি, সব্বাইকে । মিচকি হেসে রাজিন্দর উঠে পড়লেন ।
শেখাবতীর মান্ডাবায় রাত ঢলে এসেছে । আমরাও ক্লান্ত ।দিল্লি থেকে ছঘন্টার পথ।   পাওয়ানা হাভেলি । পাওয়ানা মানে অতিথি । একটা হাভেলিকে হোটেল বানানো হয়েছে । রাজিন্দর এর লিজ নিয়েছেন । বাবাকে সাহায্য করে সদ্য যুবক অনুরাগ । দিল্লি পাবলিক স্কুল ছেড়ে জয়পুরের মস্ত মকান ছেড়ে টিমটিমে গ্রাম মান্ডাবায় যখন এসেছিল তখন নেহাত বালক । বাবার খামখেয়ালিপনায় মদত জুগিয়েছে গোটা পরিবার । তখন ছিল  ছোট্ট কুঠরি । কেঠো চারপাই । কোনো ফুটুনি নেই । দিনের পর দিন এভাবেই কেটেছে । মান্ডাবাতেই পড়াশুনো করেছে । সেই সব  কথা বলতে কোনো জড়তা নেই তাদের ।  আর আজ ?
দিল লগ গয়া । আব আচ্ছা লগতা হ্যাঁয় । ইতনা সুকুন এতো শান্তি এখানে ।
আমি হাঁ করে ওইটুকু ছেলের  কথা শুনি । আর্টিস্ট হতে চেয়েছিল কিন্তু বাবার জম্পেশ ট্যুর ও হোটেল ব্যাবসায় হাল ধরা তার  ভবিষ্যৎ, সে  কথা সে বেশ জেনে গেছে  ।
আজ ঘুমন্ত টিমটিমে মান্ডাবার একপ্রান্তে তাদের পেল্লাই বাড়ি , গাড়ি , এনফিল্ড বুলেট সেই বাড়ির খোলা বারান্দাছাদে রাজিন্দর তার বউ এর সঙ্গে  মনের আনন্দে চা খায় আর ভীমসেন জোশির জো ভজে হরি কো সদা , ভজন শোনে । আর জীবনের আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে মৌজ করে আকাশে সপ্তর্ষি মন্ডল দেখায় মেয়েকে   ।






পনেরো শতাব্দীর রাজপুত রাজা মহারাও শেখার  দেশ , শেখাবতী । শেখাবত রাজপুতদের দেশ ।  ঝুনঝুনু চুরু আর সিকার জেলা নিয়ে আজকের শেখাবতী । মান্ডাবা নওল গড় রাম গড় ফতেপুরের জমি  রুখা সুখা । বৃষ্টি বিরল সেই ধুলো প্রান্তরে আছে খেজরি গাছ ।সেই গাছের ফলের নাম সাংরি । খুব দাম নাকি । খেতে টকটক । আনাজপত্তর বেশি হয় না তাই ব্যাসনের গাট্টে , ডাল ,আচার এই সব দিয়েই রকমারি খাবার বানায় । কটকটে লাল শাড়ি লম্বা ঘুঙ্ঘট । মাথায় ঘড়া । বিশাল পাগড়ি । উটের গাড়ি । গাধার গাড়ি । ধুলো উড়ছে বিন বিন । মুগ ডালের হালুয়া সদ্য বানানো হয়েছে । তার ওপরে সরু সরু করে কাটা আমন্ড বাদাম ছড়িয়ে দিচ্ছে । গরম লাড্ডু , প্যাঁড়া ।

এখানেই সব  মিস্টি শেষ হয়ে  যায় ?

না না এইসব মিস্টি আমরা দিল্লি জয়পুর আমেদাবাদ মুম্বাই কলকত্তা সব জায়গায় পাঠাই । হুম । চেখে দেখুন ।

পাওয়ানা হাভেলি মান্ডাবার বাজার এলাকায় । ওইটুকুনই বাজার । বাজার ছাড়িয়ে কয়েক পা এগুলেই শুনশান । আর চারদিকে আরো শুনশান হাভেলি । ইয়া বড় বড় দরজায় বিশাল বিশাল তালা ঝুলছে ।  ছোট্ট ছোট্ট খুপরি খুপরি বন্ধ জানালা আর তারপর ?
সারা হাভেলির শরীর জুড়ে ছবির পর ছবি । রঙের জাদু । নকশার নেশা । রঙ আর নকশা যখন ঘোর ধরাচ্ছে  ভাবছি এখখুনি ওই ঘুলঘুলি জানালার  একটা পাল্লা  একটু ফাঁক হবে আর গোলাপি  ঘোমটার ভেতর থেকে কেউ আমাকে মিছরিদানা গলায় ডাকবে ,
খম্মা ঘানি সা । পধারো মাহরে হাভেলি সা । গলা সুখ গয়ে, থোড়া পানি ফরমাইয়ে সা । কচৌরি খাওগে সা ? মিরচি অচার কে সাথ ।
এখন তো আর কেউ থাকে না । আমার ভারি একা লাগে । আর কতদিন এই হাভেলি আগলে বসে থাকব ? এসো না , দুটো কথা কই, সা ?
আমিও অমনি যাচ্ছি , গুলাবিইইইই বলে  এগিয়ে যাব , ওমা ! সেই শুনশান পাড়ায় এক দঙ্গল ট্যুরিস্ট । হক্কলে বিদেশি । আর গাইড ! সে একবার স্প্যানিশ একবার ফ্রেঞ্চ একবার স্প্যানিশ একবার ফ্রেঞ্চ ,ঝড়ের মতো বলছে কানে মাকড়ি মাতব্বর খচাখচ ছবি উঠছে । তাতা সুখা ভাপে সাদা চামড়া লাল । আর কি ! গুলাবি হাওয়া হয়ে গেল ।
আমিও হাভেলি দেখায় মন দিলাম । দেশের লোক বলতে শুধু আমরাই । শেখাবতী টেনে আনে বিদেশিদের । তাও নাকি ফ্রেঞ্চ আর স্প্যানিশ ভাষাভাষীরাই দলে ভারি । কানে মাকড়ি গাইড গুলো ফরফর করে ওদের ভাষা শিখে যায় । অনুরাগ বলে অনেকে নাকি স্কুলেও পড়েনি । ইশ যে কোন একটা ভাষা জানলে মান্ডাবায় গাইড হয়ে থেকে যেতাম !
দেশের লোকও আসে তবে অত আদিখ্যতা তাদের নেই । বেশির ভাগই জাঁকালো শীতে উইকএন্ড কাটাতে আসে দিল্লি জয়পুর থেকে।  আর সেইসব ফ্রেস্কো মুরালের মধ্যে  খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তন্নু লাভস মন্নু লিখে টিখে ধুলো উড়িয়ে চলে যায়
দেখলাম গোয়েঙ্কাদের হাভেলি লাডিয়া হাভেলি ।মুরমুরিয়া হাভেলি ।  ঝুনঝুনয়ালা , পোদ্দার , শরাফ । কোন হাভেলির নেমপ্লেটে লেখা কলকাতা , মানে বংশের বাতিরা কলকত্তায় থাকে সল্টলেক বা আলিপুরে বা চিত্তরঞ্জন এভিনিউ এ  ।  কোন কোন হাভেলির মধ্যে আবার  বংশের  ঝড়তি পড়তি লোকেরা থাকে, দিব্যি সংসার পেতে  চুলা জ্বালিয়ে  রান্নার কালিতে সেই সব মহার্ঘ শিল্পকলার গুষ্টির তুষ্টি  । কোন হাভেলি এক্কেবারে বন্ধ । কোথাও বা একটা উদাসীন কেয়ারটেকার । অল্প কিছু টাকা নেবে । আর সাঙ্খ্য দর্শনের মতো মুখ করে সেই বর্ণময় তিজোরির দরজা খুলে দেবে । একটা তিজোরির মধ্যে আমি ঢুকে যাবো । আমার মাথাটা আবার টাল খেয়ে যাবে ।
গুলাবি আবার ডাকবে, থোড়া ঘিউ নাও না, সা ? ডাল বাটি চুরমা?








মান্ডাবার জল হাওয়ায় কিছু একটা আছে । মনটা একদম শান্ত । চা নিয়ে হোটেলের ছাদ বারান্দায় বসে আছি তো আছিই । চারদিকে যে খুব নয়নাভিরাম পারকিতিক দিরিশ্য, তাও নয় । তবু কেমন জানি একটা ভারি ভালো লাগা । অকারণ । সময় যেন কতদূর পিছিয়ে গেছে । এটাই বোধহয় রাজিন্দর কে টেনেছিল

 রাজস্থানী মারোয়াড়ি ভাষায় খম্মা  মানে ক্ষমা আর ঘানি মানে অনেক । কাউকে সম্মান জানিয়ে নমস্কার , হ্যালো বলার জায়গায় ওরা বলে খম্মা ঘানি ।বহুত মেহেরবানি  আর সা , যেমন জি বলা হয় হিন্দিতে । আও সা , বসো সা । খাও সা । এইসব । পালটা বলতে হবে ঘানি ঘানি খম্মা সা   

তামাম রাজস্থানে গোটা দশেক প্রধান  চিত্র শৈলী আছে । তার মধ্যে ঢুন্ডহার ঘরানার শেখাবতী কিশানগড় জয়পুর আর আমের শৈলী । শেখাবতী হাভেলির ছবিগুলোকে কয়েকটা  ভাগে ফেলে দেওয়া দেওয়া যায় । ফুল লতা পাতা,শুধুই অলঙ্করণ , এইসব অলঙ্করণ রাজস্থানী প্রিন্টে খুব দেখা যায় , বেডকভার , ড্রেস মেটেরিয়াল , পর্দা । পশু পাখি । যুদ্ধের ছবি ।  ঠাকুর দেবতা ।লোকগাথা । ইতিহাস। দৈনন্দিন জীবন । শেঠ শেঠানি । যানবাহনের ছবি । ব্রিটিশ দের ছবি । যিশু খ্রিস্টের ছবি । রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি । এমনকি শিল্পী  ফ্রিদা কাহলোর ছবি । সত্যি ! গাইডদের মুখে মুখে নাম ফেরে । হয়তো এমনো হতে পারে এই আঁকা জোকায় বিদেশী শিল্পীরাও তুলি ধরতো কখনো কখনো  ।

সমাজ ও রাজনীতি যেমন খাতে বয়ে গেছে ফ্রেস্কো মুরালের মধ্যে নতুন নতুন ভাবনা ঠিক সেই ভাবেই এসেছে । এই অলঙ্করণের কাজ প্রথম দিকে রাজপুতদের মন্দির এবং দুর্গেই দেখা যেত । ব্রিটিশদের প্রধানত ব্যাবসা করতে আসা  , রাজপুতদের  দুর্বল ক্ষমতা আর তার পাশাপাশি দেশি বানিয়াদের রমরমা । 


শেখাবতী মাড়োয়ারি বানিয়াদের দেশ । বিড়লা ডালমিয়া সরাফ ঝুনঝুন ওয়ালা , পোদ্দার । নামগুলো কি চেনা চেনা না ? চেনা চেনা মানে ? হাড়ে হাড়ে চেনা । হাড়ে হাড়ে কেন চেনা তার আর্থ সামাজিক ব্যাখ্যার দরকার অন্তত এই লেখার জন্য নেই । মেধা পরিশ্রম  কৌশল দিয়ে যে যা অর্জন করতে পেরেছে তা তো স্বীকার করে নিতেই হয় ।    ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে শেখাবতীর ছোট গন্ডি ছেড়ে  ব্যাবসা বাড়াতে বিভিন্ন শহরে এই মাড়োয়ারিরা ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে কলকাতায়ব্যাবসার ফেঁপে ওঠা টাকার একটা অংশ যেত দেশে,  মানে এই শেখাবতী অঞ্চলে । ব্যবসা যত বাড়ে তত বেশি রুপিয়া দেশে পাঠানো হয় । জেত্তা রুপিয়া তেত্তা জিগদারি । শেখাবতী ভরে ওঠে ঠাটবাটে । জেল্লাদার হাভেলি, মন্দির , ছত্রী , বিয়ে ,পুজো আচ্চা আর ভিটের টানে শহরিয়া বাবু বানিয়ারা শেখাবতীমুখো হতেন । দানছত্র চলত । দেমাক জাঁক জমক দেখিয়ে পড়শিদের জানানো হত দ্যাখ কত পয়সা কামাচ্ছি । যত পয়সা তত জেল্লা । হাভেলির দেওয়াল মাখন মসৃণ । মিহিন পলেস্তারা ।হাত পিছলে যায় । শেখাবতীর উন্নয়নে মাড়োয়ারিদের  বিরাট ভূমিকা । দেশের বড়বড় রাঘব বোয়াল মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ী শিল্পপতির ভিটে এই শেখাবতী । এখনো কালেভদ্রে কেউ গিয়ে কখনো বা হাজির হয় , বাপ পিতেমোর ভিটেয় ধুলো ঝেড়ে প্রদীপ  জ্বালিয়ে আসে ।
  হাভেলির আনাচ কানাচ  উঁচু ছাদ দেওয়াল ভরিয়ে এই ফ্রেস্কো আঁকা খুব সোজা কাজ ছিল বলে তো মনে হয় না ।
কলকাতায় বসে থাকা এই সম্প্রদায়কে দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে এদের আপনজমিতে কী ফুল টাই ফুটিয়েছেন এরা , তার সুগন্ধ নিয়ে কত গুলাবি আজো ঘুরে বেড়াচ্ছে হাভেলির মধ্যে ।





মান্ডাবা থেকে ফতেপুর মাত্র কুড়ি কিলোমিটার । এখানে এক মাঝারি মাপের হাভেলি কিনে সেখানে হোটেল বানিয়েছেন ফরাসি আর্টিস্ট নাদিন লেপ্রিন্স । মহিলা । তার একটা ওয়ার্কশপও আছে । ফ্রেস্কোগুলোর পুনরুদ্ধারে তার অনেক খাটুনি গেছে । ছবি নিয়ে অনেক কাজ সেখানে চলছে । উনি এখন প্যারিসেই থাকেন তবে  কয়েকটি অল্পবয়সী ফরাসি মেয়ে কেউ লেখে কেউ আঁকে কেউ ছবি তোলে ,এখানে কাজ করছে । এই খাঁ খাঁ গরমে ধুরধুরে গ্রামে কিসের নেশায় পড়ে আছে । হাভেলির ফ্রেস্কো দেখে দেখে আশ আর  মেটে না
বলে নাকি নওল গড়ের হাভেলিগুলোই সব থেকে বেশি ঠিকঠাক রাখা হয়েছে । তাই চললাম নওল গড় । প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা । পোদ্দার হাভেলি মুরারকা হাভেলি ভগত হাভেলি ।  পুরো শেখাবতী একটা ওপেন আর্ট গ্যালারি
শেঠের হাভেলির তিনটে ভাগ । মর্দানা । জেনানা । নোহরা  ।
মর্দানা , বাইরের ভাগ । গদ্দি তাকিয়া । টানা পাখা ।  হিশেবের খাতা । মেয়েরা এখানে আসবে না । শেঠের দল  ব্যাবসা বচসা নিয়ে থাকবে  এখানে । এ হল বৈঠক খানা ।  তারপর ভেতর মহল , রসুই ঘর , ভাঁড়ার ঘর , শোবার ঘর,ঠাকুর ঘর  আর পায়রাকে খাওয়ানোর জন্য  দানাপানি রাখার  ঘর । এরপর একেবারে পেছনের দিকে নোহরা  । খোলা চাতাল , চারদিকে পাঁচিল সেখানে থাকত উট ,হাতি  ঘোড়া , ভেড়া গরু ছাগলখোলা ছাদে  উঁচু পাঁচিলের আবডালে সাঁঝের বেলা বসত জেনানা মহল । মোটামুটি এইরকমই সব হাভেলির গড়ন ।
রঙদার জেল্লাদার কাজ নিয়ে শেঠেদের মধ্যে টক্কর চলত । মেটে লাল নীল হলুদ সবুজ এই বেসিক রংগুলোই বানিয়ে নেওয়া হত । তারপর এক রঙ কে  অন্যের সঙ্গে মিশিয়ে আরো  নতুন রঙ তৈরি হত ।  ভাগ্যিস বৃষ্টি হয় না । তাহলে কবেই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতো । ধুলোট পটভূমিতে এই রঙিন প্রাসাদ চিত্রমালা কেউ আর দেখতে আসত না ।
এই বর্ণিল জাদুরেখা আর  মায়াবী হাভেলির  জন্য কত হিন্দি সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে এখানে ।







রাজিন্দরজি ট্যুর আর হোটেল ব্যাবসায় চুল পাকিয়েছেন । জীবনে ঝুঁকি নিয়েছেন বিস্তর ।  ট্যুরিস্ট ঘেঁটে ঘেঁটে দেশ বিদেশ ঘুরে ঘুরে  তাদের মুখ দেখেই গোত্র বলে দিতে পারেন । মালয়েশিয়ার একটা দলকে দেখভাল করতে করতেই  জানিয়ে দিলেন বিকেলবেলা আমাদের নিয়ে রাম গড় যাবেন । রামগড়ের শেঠরা খুব বিখ্যাত ছিল । ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে একেবারে বেমক্কা সপাটে গাড়ি চালিয়ে দিলেন ।
বিকেল প্রায় শেষ হয়ে আসছে । আমরা একটা অদ্ভুত সুন্দর মন্দিরের মধ্যে ঢুকেছি । শনিমন্দির । সন্ধের অস্তরাগ রাঙিয়ে দিচ্ছে মন্দিরের কারুকাজ ।  মন্দিরের মধ্যে মধ্যে  শিশার কাজ । এক কুচি আলোতে হাজার জোনাকি জ্বলে উঠছে । অনুরাগ একটা বাচ্চা ছেলে । বলে উঠল একবার ভাবুন তো , সেই পুরোনো সময়টার কথা । যখন এই হাভেলিগুলো এই মন্দিরটা নতুন ছিল, এতো লোক ছিলোনা , গাড়ি ছিল না । সন্ধের মুখে হাজার জোনাকি জ্বলে উঠতো,আরতির ঘন্টার সঙ্গে  । সেই জোনাকি জ্বলা সন্ধেকে মুঠোয় নিয়ে মান্ডবা ফিরে এলাম ।



দিল্লিহাটের রাজস্থানের ফুড স্টলে বসে আছি তার কারণ আসিফ is obsessed with Rajasthan . মুগ ডালের হালুয়া হাতে দিয়ে বললাম মান্ডবা থেকে এনেছি ।
বাজি (দিদি) মান্ডবা কেন গেছিলে ?
আরে শেখাবতী দেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের, তাই চলে গেছি ।
আমিও গেছি । কেউ একজন নিয়ে গেছিল ।
কে?
কাত্যায়নী ।

মেহরাউলির কোন এক প্রত্ন চত্বরে কোন এক হিমহিমে শীতের সন্ধে বেলা কোন এক বাউন্ডুলে দাস্তানগো গল্প বলছিল । সামনে সব নুক্কড় দল বসেছিল । পয়সা ফয়সার ধার দিয়ে যাবে বলে মনে হয় না । হঠাত সেই বাউন্ডুলে দেখে এক লম্বা সুন্দর কোঙ্কড়া চুলো মেয়ে পশমি কুর্তা আর বুট পায়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছে । তারপর ঠিক বিদেশি কায়দায় সেই মেয়ে মাথার টুপি খুলে সবার সামনে ধরে আর যে যা পারে দিতে থাকে । গল্প বলা তখনও শেষ হয়নি, তার আগেই মেয়েটি টুপিসমেত  টাকা আসিফের সামনে রেখে হাওয়া হয়ে যায় । এই সেই কাত্যায়নী । রাজপুত মেয়ে । রাজকুমারী সা ।
খুব ভালোবাসা তাদের  । কিন্তু যা হয় । ভিন ধরমী বাউন্ডুলে ছেলে । পরিনতি যা হবার হল ।

উসকো আতা নহি থা মানানা
হম জব ভি নারাজ হোতে থে
উয়ো চুপচাপ পিছে সে আ কর আপনা সর
হমারে কাঁধে পর রখ দেতি থী...
উয়ো অ্যা য়সি মোহব্বত করতী থী


প্রসঙ্গ খানিক হালকা করার জন্য আমি বললাম আরে জানো তো সেখানে এক ট্র্যাভেল পাগল লোকের সঙ্গে আমাদের আলাপ হয়েছে । এই বলে আমি রাজিন্দরের ছবি দেখাই ।
রাজু ভাইয়া , আরে ইয়ে তো রাজু ভাইয়া হ্যাঁয় । আমি ওকে খুব ভাল করে চিনি ।
অ্যাঁ ?বলো কি ?
হ্যাঁ, বাজি । আমরা তো ওর হাভেলিতেই ছিলাম ।
আমরাও তো  সেখানেই ছিলাম কি আশ্চর্য !
আমি ওখানে বসেই টপাটপ মেসেজ টাইপ করলাম । আপনি কি আমার ভাই আসিফ খান দেহেলভি কে চেনেন? ও আপনার কথা বলছিল ।



কিছুক্ষণ পর টাইপ ফুটে উঠতে লাগল

হাহাহাহাহা , আমি ওকে খুব ভাল করে চিনি । তাহলে কাত্যায়নী রাঠোরকেও চেনেন নিশ্চয়ই । হাভেলিতে হাভেলিতে একজোড়া কবুতরের মতো ঘুরে বেড়াতো ওরা । ঢোলা মারু , হির রাঞ্ঝা , মুমাল মহেন্দ্র আর আসিফ কাত্যায়নী ।

আমি লিখলাম , ওই আসিফের কাছে যে টুকু শুনেছি ।

সত্যি পৃথিবীটা খুব ছোট । there is no meeting without reason . সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করা  আছে যে  আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি ।

দু সেকেন্ড চুপ থেকে  ইংরেজিতে টাইপ করলাম
আমিও ।




ছবি লেখক