Friday 24 November 2017

সামার হলিডে

পাইন গাছের হলুদ রেণু অনেকটা হলুদ আবিরের মতো । ঢাল বেয়ে গ্লেন ভ্যালির রাস্তায় কে যেন  ভিজে   শিফনের ওড়না ফেলে গেছে  । আর সেই পথে  ওরা দুজন হেঁটে গেছে । দুজনের দুজোড়া পায়ের ছাপ সেই ভেজা ওড়নায় । পাশাপাশি । আরো একটু ঢালে নেমে গেলে দেখা যাবে ওরা দুজন বসে আছে , হাত ধরাধরি করে ।দুজনের মুখে মিস্টি হাসি । কোথাও কোনো শব্দ নেই । ঝিমঝিমে সকালের  হালকা রোদ্দুর বিলি কাটছে  ওদের চুলে । ওরা বিএফ জি এফ । বয় ফ্রেন্ড আর গার্ল ফ্রেন্ড । আজকাল বিএফ জিএফ না থাকলে আবার স্ট্যাটাস থাকে না জানো ! তবে স্মিথ আর নাতালি দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসে ।

We're all going on a summer holiday
No more working for a week or two.
Fun and laughter on our summer holiday,
No more worries for me or you,
For a week or two.

হাত ধরাধরি করে ওরা ওপরে উঠে আসতেই স্মিথের বাবা গলা  শোনা গেল “ ব্রেকফাস্ট হয়েছে তোমাদের”?
স্মিথের বাবা নাতালিকে মানে ছেলের গার্ল ফ্রেন্ডকে বেশ স্নেহের চোখেই দেখেন । মেয়েটা নিতান্তই সরল সোজা । তার ছেলের মতো সেয়ানা নয় । আর অত গুছিয়ে গুছিয়ে কথাও বলতে পারে না । অত বাংলাও জানে না ।  স্মিথ টা তো ঝানু । কিভাবে সব কিছু ম্যানুপুলেট করতে হয় সে বিষয়ে তার ছেলে একেবারে তুখোড় ।
নাতালি চড়াই পাখি কে   স্প্যারো বলে । ঝাঁটাকে বলে ব্রুম স্টিক । একবার নর্থ বেঙ্গলের খুঁটি মারি জঙ্গলে বেড়াতে গেছিল তারপর যখন ওকে জিগ্যেস করা হল কোথায় গেছিলে গো  ,নাতালি বলেছিল খুন্ঠিমাঢ়ি আর ছিলাপাটা ।  আর সবকিছুতেই ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে যায় । যেন কথাটা এই প্রথম শুনছে । সেদিক থেকে মেয়েটি ভারি ভালো ,কিন্তু তার ছেলের হাতে এ মেয়েকে অশেষ হ্যাপা পোহাতে হবে, স্মিথের বাবা বেশ ভালোই বুঝছেন ।
স্মিথের বাবা তার ছেলের মতো বকবকে নন । তিনি চুপচাপ মাল্টিটাসকিং করতে ভালোবাসেন তারা সবাই মিলে গরমের   ছুটিতে  পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে । স্মিথের বাবা মিঠে রোদ্দুরে বসে আছেন , পাইন বনের মধ্যিখানে । বাঁ হাতদিয়ে তিনি মোবাইলে অনর্গল কথা বলছেন , ডান হাত দিয়ে ল্যাপটপ চালাচ্ছেন । ডানপায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাঁ পায়ের গোড়ালি চুলকুচ্ছেন আর তার দিদি ঘর থেকে বেরোলো কিনা মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখছেন ।
স্মিথের পিসি আবার এই পাহাড় ভ্রমণের মুখ্য উদ্যোক্তা । কারণ তিনি একসময়ে এখানে থাকতেন । দুদিন আগে  রাত একটার সময় ঠান্ডা ঠান্ডা তারা জ্বলা  চড়াই উৎরাই পথ দিয়ে ওরা  যখন এখানে এলো , স্মিথ আর নাতালি তো ঘুমিয়ে কাদা
সকালের রোদ্দুর  আর চকচকে নীল আকাশ দেখে সব্বার মন খুশ ।
তার মধ্যেও পাকা ছেলে   স্মিথ  বাবাকে জিগ্যেস করল “এই এতদূরে পিসি পড়তে আসতো কেন  বলো তো ”?
স্মিথের বাবা বেশি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মানে বেশি শব্দ খরচা করতে ভালোবাসেন নাউদাস মুখে বললেন , কি জানি । হয়তো ওদিকে চান্স টান্স পায় নি , তাই ।  
হুম । নাতালির সঙ্গে স্মিথ চোখাচোখি করল । পিসির মাথাটা বেশ খারাপ সেটা তো জানা কথাই  । কোন একটা বেখাপ্পা জায়গায় তিনি লাঞ্চ খেতে যাবেন । ওদেরও সঙ্গে যেতে হল । সেখানে গিয়েই স্মিথ বুঝেছিল,জায়গাটা সুবিধের নয় ।  এখানে বেশ  গন্ডগোল আছে । যত রাজ্যের পুরোনো ঝুরঝুরে ম্যাগাজিন জড়ো করা , একটা লম্বা দাড়ি লম্বা চুল দৈত্যের মতো লোক আর তার বুড়ি খুনখুনে মা বসে আছে । তারা নাকি ট্রাউট মাছ খাওয়াবে । শিমলায় কি ট্রাউট পাওয়া যায় ? সেতো পাওয়া মানালিতে । তবু পিসির আদিখ্যেতার শেষ নেই । সেইসব স্মোকড পোচড মাছ দেখেই স্মিথের গা গুলিয়ে উঠছিল । কিন্তু কিছু বলা যাবে না।  কারণ পিসির সেন্টিমেন্ট । শেষে নাতালি আর ও মিলে চিকেন ভাজা , পাস্তা আর কোক খেয়ে পেট ভরালো ।





আরে ,কত বদলে গেছে জায়গাটা । এখানে একটা প্রিমরোজের ঝাড় ছিল অনেক অনেক ছোট্ট ছোট্ট গোলাপি প্রিমরোজ একদম দোতলা পর্যন্ত দেওয়ালটাকে জড়িয়ে থাকত । আজ আর নেই । একদম হাওয়া । পিসি ভুলেই গেছে মাঝখানে কেটে গেছে কতো কতো দিন । একটা নতুন অচেনা গাছ । সে পিসিকে চেনে না । পিসিও তার নাম জানে না ।
ওই গাছটাকে বলে পোটাটো সেলেনিয়াম । স্মিথ পটর পটর করে কেটে কেটে  বলল ।
ও, তা  তুই কি করে জানলি রে ?
পিসি ভাবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কী স্মার্ট ! সব জানে !
তুমি সেই কাল থেকে এখানকার বিভিন্ন লোককে নানান ভুলভাল নামে ডাকছিলে , টেকচান্দ কে করমচান্দ,রাভিন্দরকে পরশুরাম.. ওরা যখন বলছিল যে ওগুলো ওদের নাম নয় , তখন তুমি এমনভাবে তাকালে যেন ওরাই মিথ্যে বলছে ।  তারপর তোমার দিকে হাসিহাসি মুখে ওই যে লোকটা  এলো, তাকে আবার তুমি চিনতেই পারলেনা ।ওই তাদেরই  মধ্যে একজনকে আজ সকালে জিগ্যেস করেছিলাম । স্মিথ আবার গাছপালা পশুপাখি  খুব ভালোবাসে ।
তাই বলে প্রিমরোজকে তুলে দিয়ে পোটাটো সেলেনিয়াম ?  আর দ্যাখ , গাছটা দেখতেও তেমন ভালো নয় । দোতলার ওই ছোট্ট জানালাটা দেখছিস ওখান থেকে গলা বাড়িয়ে প্রিমরোজের ঝাড়ের মধ্যে মুখ বাড়িয়ে আমার একটা ছবিও আছে । কী সুন্দর ছবি হয়েছিল । ওটা বাথরুমের জানালা ছিল, জানিস । দেখলে কেউ বলবে?
স্মিথ জানে পিসির এই স্মৃতি রোমন্থনের ঝড় টা তাকেই বেশি সামলাতে হবে কারণ পিসেমশাই বা বাবা বা নাতালি কেউই তেমন উৎসাহী শ্রোতা নয় ।

পোট্যাটো সেলেনিয়াম 



যোগেশ জিইইই, পিসি ডাকলো । যোগেশ না মহেশ কেউ একজন এলো । পিসি বল্ল লাউঞ্জ টা খুলে দিন , আমার ভাইপোকে দেখাবো । লাউঞ্জটা এমন বন্ধ রাখেন কেন? আমাদের সময় আমরা এখানে বসে ইংরেজি হিন্দি বাংলা মারাঠি তামিল স্প্যানিশ গোয়ান কত  গান শুনতাম , কত ফাংশান করতাম , কত পারটি হত । পার্টির দিন পালিশ করে করে কাঠের মেঝে এমন চকচকে করে তোলা হত যে পা পিছলে যেত । নরম আলো , সাদা লেসের পর্দা , চকচকে পিয়ানো , কত পেইন্টিং ।
আপকা জমানে  মে হোতা হোগা । এখন তো বন্ধই থাকে । মহেশ অথবা যোগেশ উত্তর দিল ।
সে কি ছেলেমেয়েরা সব কোথায় আড্ডা দেয়? গান বাজনা কোথায় হয় ? পার্টি শারটি ?
আজকাল তো অনেক নতুন জায়গা বানানো হয়েছে । কেমন খোলামেলা ঝাঁ চকচকে ।  দেখেন নি ? সেখানেই হয় ।
কিন্তু কোনো ছেলেমেয়েকেই তো দেখা যাচ্ছে না । আমরা সবাই ঘাসের ওপর বসে রঙিন ছাতার নিচে পড়তে বসতুম ।
পায়ের কাছে এই এতো টুকুন টুকুন ব্যাঙের ছাতা , লালের ওপর কালো ছিটছিটে পোকারা ঘুরঘুর করতো ।
 এত নীল এত সবুজ এত রঙ , এদের তেমন টানে না বোধহয় । কে জানে!
চোখের সামনে কেমন ঝিরঝির করে বরফ পড়তো । আবার বর্ষার সময় দূরের ছাই রঙা পাহাড় গুলো নরম সবুজ ফেল্টের মত ঘাসে ভরে যেত । অনেক ছত্রাক , লাইকেন ফার্ন পাথরের গায়ে , গাছে গাছে জড়িয়ে থাকত । এমনকি শেষ দিনটা অব্দি পষ্ট মনে আছে ।সেদিন বাগানের মাটি ঢাকা ছিল খড় দিয়ে । বাগানে নেই একছিটে রঙ । শীত আসছে , শীত আসছে । শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট চারা গুলো । আর কিছু ফুল গাছকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে খড়ের টুপি । কাঁচের গ্রিনহাউসে সযত্নে ওম পাচ্ছে ক্যাকটাসের দল । বাতাসে হিম হয়ে আসা শীত । কনকনে । হিংসুটে দত্যির বাগান । এরপর কোন রন্ধ্রপথ দিয়ে বসন্ত ঢুকে পড়বে । আর সে যে কী সমারোহ ! রঙের । জীবনের । তারুণ্যের । প্রজাপতি আর মৌমাছির দল । আমরা আর তা দেখতে আসব না । জুনমাসে যখন হালকা হালকা বাতাস বইবে, চিকন সবুজ পাতা তিরতির করে কাঁপবে, ঝকঝকে আকাশে নক্ষত্ররা বীথিপথ তৈরি করতে আসবে আর দিনের বেলা নরম রোদে ভাসবে চারদিক , প্রিম্রোজের ঢল নামবে লনের দেউড়িতে , গীতালির বাথরুমের দেওয়ালে , সেই বসন্তে আমরা আবার একবার ফিরে এসেছিলাম। রাতে ডিনারের পর পাইন ঝোপের পাশ দিয়ে  ডোমের বাতির আলোয় স্বপ্নমাখা ঢালু জমি দিয়ে গেট অবধি হাঁটা আর আবিদা পরভিনের গান  “অ্যায় দিলনশী তলাশ তেরে কুবকু নহি ।“

স্মিথ বল্ল দেখো পিসি, কত সময় পার হয়েছে খেয়াল আছে?  সবাই এখন মোবাইল ল্যাপটপ কিন্ডল আইপড  হাতে নিয়ে বসে থাকে  । খাবারঘরে দেখলামও তাই । সবটাইতো হাতের মুঠোয় ।  বলো ,  তোমরা কি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ?
আমরা অনেক কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম । অনেক কিছু । এখনকার থেকে ঢের বেশি ।

 “ নম্র নেত্রপাত ছিল তবু—
প্রকৃত ধবলবেশী নারী
প্রকৃতির মতো স্থির
পুকুরের মতো অবসরা
ভালোবাসা দেবে বলে বসে আছে দিকচক্রবাল
জুড়ে, তবু,তবু নিষিদ্ধতা।
সফল স্বপ্নরা ছিল,তবু
কুয়াশা বাষ্পের বাড়াবাড়ি
পুষ্পিত বাগানে বসে
পরস্পর পায়রার মতন
কথাবার্তা হবে বলে শুরু করে হঠাত বিহ্বল
হয়ে,তবু, তবু প্রগলভতা ।“


এই জানিস , পেছনের রাস্তা দিয়ে এক্কেবারে সামার হিল স্টেশনে নেমে যাওয়া যায় ? যাবি ? রাস্তাটা  কী সুন্দর ! ছায়া ছায়া ।পাইনবনের জাফরি কাটা । তারপর একটু টাল খেয়ে গড়িয়ে গেলেই কান্তা আন্টির রান্নাঘর । উইলো গাছের নিচে ।
স্মিথ জানে , তাকে তো যেতেই হবে ,আর কে যাবে এনার সঙ্গে । তো,  পিসি ভাইপো রওয়ানা হল । কী বলবো ! বাপরে , পাইনবনের জাফরি তো দূরস্থান ,ছায়া ছায়া মায়ামায়া তো কষ্ট কল্পনা ! উইলো গাছের নিচে কোথায় কান্তা আন্টির রান্নাঘরে আপেল পাইএর গন্ধ ! কী ধুলো কী ধুলো ! সমানে গাড়ি চলছে ।  পিসি ভারি অপ্রস্তুত ! এমনটা হবার কথা ছিল না , বুঝলি । এ রাস্তায় তো গাড়িই চলত না ।  

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা সব্বাই মলের রাস্তা ধরেছে ।  নাতালি ভারি অবাক হয়ে বলল ,শপিং মলে যাবো এখন ? স্মিথ বলল হ্যাঁ হ্যাঁ শপিং মল , চলো জলদি ।

চৌরা ময়দানের মাথায় উঠেই পিসি আবার শুরু করল , গুপ্তাজির দোকানটা গেল কোথায় রে ?
স্মিথ বল্ল আমি তার কি জানি ! এই বলে নাতালির হাত ধরে গটগট করে হেঁটে চলে গেল । পিসি কিন্তু হাল ছাড়লো না । দোকান দোকান ঘুরে গুপ্তাজির খবর নিতে থাকল ।  নানান রকমের দোকান । পিসি জিগ্যেস করেই চলেছে আচ্ছা ভাইসাব, গুপ্তাজি কোথায় গেলেন ? আরে ওর দোকান থেকে টুকিটাকি কত জিনিস কিনতাম । আমাদের সব্বাইকে উনি চিনতেন । আর ইয়ারোজে টেলিফোন গন্ডগোল করলে ওই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে এই চৌরা ময়দানে গুপ্তাজির দোকান থেকে আমরা এস টি ডি করতাম । গুপ্তাজি সবসময় নেশায় টং হয়ে থাকত কিন্তু কী ভদ্র সভ্য ছিল । কোথায় গেলেন বলুন তো ? বেঁচে আছেন তো ?
নতুন নতুন সব মুখ বলল , পতা নহি । কহি চলা গয়া হোগা দুকান বেচ দিয়া হোগা ।
স্মিথের বাবা এবার পেছন ফিরে তাকালো । মুখে একটা অদ্ভুত হাসি । কিছু বলল না অবিশ্যি ।
এ হাসির  একটা মারাত্মক কারণ আছে । তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল ছিল না । কত দূরে একটা ফোনের জন্য কারা যেন সব অপেক্ষা করত । তারা তো জানে না সেই কত দূরে বরফ পড়ছে ,না বৃষ্টি পড়ছে , না মন ভালো নেই !

“অনেক দূরে সাজিয়ে বাগান সাতপুরা
হাতছানি দেয় স্বপ্ন দেখে এক বালক
দিদি তাকে পাঠায় আতর অক্ষরে
ঘুমের ভেতর ছড়ায় সে তা শখ করে
দিনের পরে দিন কেটে যায় পথ চেয়ে
দূরভাষের শব্দ রাতে রোমাঞ্চক “




মলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে  পিসির চোখে পড়লো অনেক কিছুই বদলেছে বেশ  ।  পুরোনো দোকানগুলো আর কিছুই প্রায় নেই ।স্যানিটোরিয়াম থেকে ডক্টর অ্যালেন আর গুড মর্নিং বললেন না । হিম বুনকর নাকি কবেই বন্ধ হয়ে গেছে । লোয়ার মলে রঙ তুলি কাগজের দোকানের সেই সৌম্য দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ,দেখা হলেই মাথা নুইয়ে হাসতেন ! বাতিশ নামের দোকানটাও নেই ।

আমরা আইসক্রিম খাব এখন । নাতালি আর স্মিথ । হিহিহিহি করে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ছে । জম্পেশ করে ওরা আইসক্রিম খাচ্ছে । আর পিসির চোখ কাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে কে জানে! নাতালি আর স্মিথ হুশ হুশ করে হাঁটছে ।

ক্যান্ডিফ্লস ক্যান্ডিফ্লস

আমরা ক্যান্ডিফ্লস খাবো ।

ওরা বুড়ির গোলাপি চুল খাচ্ছে । আবার ছবির তোলার পোজ দিচ্ছে ।
বুড়ির চুল খেয়ে বলে কি , এবার ঘোড়ায় চাপবো ।

পিসি আর তাল রেখে পারে না ।
চল যাই , কোথাও বসে সুপ টুপ  খাই ।
হ্যাঁ হ্যাঁ সুপ খাবো , সুপ খাবো ।

পিসি কিন্তু চয়েস আর আন্টিস দুটোর একটাকেও খুঁজে পায় নি । গেইটি থিয়েটারের পাশে ভারি সুন্দর গোল আকারের রেস্তোরাঁ । তখনও ছিল । তবে তখন আমরা আন্টিস বা চয়েসেই যেতাম । লোয়ার মলে । ঘুপচি ঘুপচি ।
রেস্তরাঁর ভেতর টা গমগমে । কাঁচের জানালার বাইরে জমকালো সন্ধে ।
পাইনবনের আড়ালে সূর্য ডুবে গেছে কখন!  তার লাল আভার সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে আলো জ্বলে উঠছে ।
স্মিথ বল্ল কী সুন্দর না? যেন হিরের বাক্স উলটে গেছে ।
একটু বেশি বেশি হিরে দেখছি এখন ! তখনও ছিল তবে এতো টা না ।
আবার শুরু করলে তুমি? এখন আর তখন । কি করছ বলো তো  সেই তখন থেকে ?
শোন , বেশি বেশি হিরের মানে কি বলতো ? অনেক অনেক নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে । রাস্তাঘাট হয়েছে । আর অনেক অনেক গাছ কাটাও হয়েছে । তাই বলছিলাম । শহরটা বদলেছে না ?
আবার  লম্বা পাহাড়ি পথ । ওরা ফেরত যাচ্ছে সারাদিন বেড়িয়ে । একটা জায়গায় এসে আবার পিসি থামে । দ্যাখ , এখানে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের একটা বাড়ি ছিল, পাইনবনের এক্কেবারে নিচে । সেটা নেই রে ! রামকৃষ্ণ মন্দির হয়ে গেছে ।
স্মিথ বলল , ভালো করে তাকাও , গেটের পাশে এখনো ব্রাহ্ম সমাজ লেখা টা পড়া যাচ্ছে, ভালো করে দেখো ।






আবার কী হল ? এবার পা চালাও । অনেকটা যেতে হবে যে পিসি  ।
এখানটায় বুঝলি , একটা ছোট্ট দোকান ছিল । হিমাচলি পোষাকে একজন মা আর তার ছা । একটু মলিন মলিন । কিন্তু কি জানিস ,আমরা ওই দোকান থেকে বাড়ি যাবার আগে একটা দারুণ সুন্দর  খাবার জিনিশ অর্ডার করতাম । একদিন আগে বলতে হত । ওরা একদম ফ্রেশ বানিয়ে দিত । আহা , নাম টা বল না ? মনে আসছে না রে ! বড্ড ভালো খেতে । ওপরটা মুচমুচে । ভেতরে নরম নারকেলের পুর । বাড়িতে সবাই খুব খুশি হত । এত গাদাগুচ্ছের কুকি ফুকি তখন তো ছিল না ।
নামটা বলনা ? সেই যে খুব সুন্দর নরম নরম অথব মুচমুচে ।
আচ্ছা , পিসি আমি কী করে জানব বলো তো ? তুমি কবে কী খেয়ে ছিলে,  কী বাড়ি নিয়ে যেতে ?
নাতালি আর স্মিথ পিসির পেছনে লাগে । সারা রাস্তা ।
আহা, কি জানিস , কোনো জিনিশের নাম মনে না পড়লে কি রকম যেন একটা অস্বস্তি হয় ।


“সেই দিনটা ছিল বছরের শেষ দিন
আর আমাদের সফরের শুরু
নিদ্রাহীনতা এবং দীর্ঘ  যাত্রায়
শ্রান্ত আমাদের শরীরে
ছিল শুধু স্নানের স্বপ্ন “।
  
যাক , সবাই তাহলে রেডি । চল রওনা হই । স্মিথের বাবার  গলা তুলে সব্বাইকে ডাকল ।
আবহাওয়া অতি মনোরম । গরমের ছুটি শেষ । এবার পাহাড় থেকে নামো ।
নাতালি আদুরে আদুরে গলায় বলল , আমাদের ট্রেনে চাপা হয় নি তো ,  কিন্তু স্টেশনটা একবার দেখব । পাহাড়ের স্টেশন গুলো খুব সুইট সুইট দেখতে হয় ।একেবারে স্টোরিবুকের মতো ।
হিল কার্ট রোডে উঠে ড্রাইভার বলল, বাঁয়ে দেখিয়ে স্টেশন । স্মিথ চেঁচিয়ে উঠে নাতালিকে ডেকে বলল , মা , মা দেখো ছোট্ট ট্রেন । আমার খেলনার মতো ।

আর কী বলব ? অমনি পিসি চিল চিৎকার দিয়ে উঠল, আরে আরে মনে পড়ে গেছে ,মনে পড়ে গেছে , ম্যাকারুন ম্যাকারুন । ওপরটা মুচমুচে, ভেতরে নরম নরম নারকেলের পুর । মাথায় বসানো আধখানা লাল চেরি ।
পিসি দৌড়চ্ছে , কাঁধে ব্যাগ , ব্যাগে ম্যাকারুন । শিবালিক এক্সপ্রেসের শেষ কামরা । ঝপাৎ করে পিসির ল্যান্ডিং । পরনে জিন্স,খাদির পাঞ্জাবি । ক্লাস সেরে দৌড়ে আসছে । স্টেশনে লতা সিং টা টা করছে । পাইনগাছের ফাঁকে সূর্য ডুবে গেছে ।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । আরে কান্তা আন্টি যে ! কান্তা আন্টি হামেশাই দিল্লি যায় মেয়ের কাছে ।  আও বেটা ব্যায়ঠো । সঙ্গে আছে আলুর পরোটা । পন্ডিতজি ফয়েল দিয়ে  যত্ন করে মুড়ে  দিয়েছে । জানো ,কান্তা আন্টির প্রতিবেশি কে ছিল ! প্রীতি জিন্টা ! নেক্সট ডোর নেবারকান্তা আন্টি অনুপম খেরকেও চেনে । পাড়ার লোক ! কামরার ভেতরে গপ্প বাইরে রাত ঘন । সামারহিল, তারাদেবী, বারোগ, জাতোগ । সোলান  । একের পর এক স্টেশন চলে যাচ্ছে ।  কান্তা আন্টি আপেল পাই খেতে দিচ্ছে । ফ্লাস্ক থেকে কফি । আরামে চোখ বুজে আসছে যে ।  ছুটি ছুটি ।  বাড়ি আসছে । বাড়ি আসছে । বাড়ি আসছে ।


ধান্নো কি আঁ খো মে হ্যাঁয় রাত কা সুরমা
অউর চাঁদ কা চুমাআআআআ

 
স্মিথ আর নাতালি 


পিসি আর স্মিথ



কবিতা  ক্রমান্বয়ে ঃ যশোধরা রায়চৌধুরী , বাসুদেব দেব , আয়ান রশীদ খান

ছবি  লেখক 

2 comments:

  1. বাহ, বেড়ানো হোল আর গল্পও হোল। ছবিগুলোও কথা বলছে লেখিকার সাথে। দারুণ লাগল।

    ReplyDelete
  2. ও মা ! আপনি ! কী যে ভালো লাগল ।

    ReplyDelete