Thursday 27 October 2016

দেখা হয় নি



কানু কহে রাই, ধবলী চরাই মুই... আচ্ছা বেশ , দেশ গাঁ য়ের কথা ছেড়ে দিন ,
হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতেও কানু রাধা বিনে গান নেই , কথাটা কিন্তু হক কথা তা গান বাঁধার মতই জুড়ি এরা । জুড়ি নাম্বার ওয়ান ।
একতালে বাঁধা মূলতানী রাগের বিলম্বিত খেয়ালের বন্দিশ গুরুজি নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন এ গোকুল গাঁও কে ছোড়া , বরসনা কি নারী রে/ইন দোনো মনো মোহলিয়ো হ্যাঁয় /রহে সদারঙ্গ নিহারহে ।
গোকুল গ্রামের ছোকরা আর বরসানার ছোকরির মনোমুগ্ধকর জগতপ্লাবী প্রেম । বন্দিশটি রচনা করেছিলেন নিয়ামত খান সদারং । সদারং এবং তার ভাইপো অদারং । মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহের সভায় এনারা গান বাজনা করতেন । মহম্মদ শাহ রঙ্গিলা । এই নাম থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছে সম্রাটের শখ শৌখিনতার বহর অনেক বন্দিশে আবার সদারঙ্গিলে মহম্মদ শাহ এমন ভাবেও দুজনের উল্লেখ আছে । মহম্মদ শাহ নিজেও অনেক বন্দিশ লিখেছিলেন । মজারকথা হল, নিয়ামত খান সদারং এই গানটি বেঁধে ছিলেন হিন্দু দেব দেবীকে নিয়ে । এরকম অগুন্তি উদাহরণ আছে । গঙ্গাযমুনি তেহজিবের ধারা উত্তরভারতে এইভাবেই বয়ে চলেছিল দীর্ঘদিন ,যে পথে মথুরা বৃন্দাবনও ছিল ।


কোন কাজ যদি হাতের নাগালের বাইরে চলে যায় ,সে ক্ষেত্রে প্রথমেই সম্পূর্ণ দায় টা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিতে হবে । এটি জনৈক মনীষীর সুধা বচন ( পড়ুন আমার ভাই) । তারপরেই দেখতে হবে প্ল্যান ছকতে গিয়ে কি কি গ্যাপ আছে বা ভুল ভ্রান্তি রয়েছে, ইনফরমেশন গ্যাপ আছে কিনা , বলাই বাহুল্য, তার দায়ও নিজের ঘাড়ে নিতে হবে । যে দুটো কারণে নিজেকে খুব একটা দায়ী করা যায় না সেটা হল শরীর যদি বিগড়ে যায় হঠাৎ এবং ভারতীয় পরম্পরা কে যথোচিত সম্মান দেখিয়ে শেষ কারণ টি হবে ভাইগ্য/ কপাল/ কর্ম ( অনেকে আজকাল বলে কারমা)।
মথুরা পর্যন্ত যাওয়াটাই ছিল প্ল্যান । খুব সুন্দর বিকেলে মথুরায় কৃষ্ণ জনম ভূমি মন্দিরে পায়ে আলতা , মাথায় সিঁদুর , হারে চুড়ি লাল পেড়ে শাড়ি পরা এক পুরুষকে দেখলাম রাধা ভাবে মজে আছে ,পূর্ব রাগ শেষে একেবারে মাথুর। আবার বাঁকে বিহারী মন্দিরে ঘুরে ঘুরে সামান্য চরাই উঠতে উঠতে দেখি পুরো গলিটা শোভা গুরতুর ভজন হয়ে গেছে । খসখসে নকশাদার গলায় মাহারো প্রণাম , বাঁকে বিহারী “ , মীরার ভজন । সেই গান শুনে গলির দোকানের রাবড়ি ,জলেবি , প্যাঁড়া , লাড্ডু , লসসি কালাকান্দ সক্কলের হাউমাউ করে সে কি কান্না । গলে গলে পড়ছে ইমন কল্যাণ , কোথা থেকে ভুরভুর করে আসছে চন্দন গন্ধ ।
আর কি ,আমারো ধাঁ করে মনে পড়ে গেলো মূলতানী রাগের বন্দিশ । আরে মথুরা থেকে মাত্র চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার তো রাস্তা । গোকুলের ছোড়া আর বরসানা কি নারী ।
বরসানায় সব কিছুই রাধে রাধে ।ঘরের দুলারি বলে কথা । কিন্তু ওই , নানান তথ্য সংক্রান্ত ভুল ভ্রান্তি । নানান লোকের নানান গোলমেলে তথ্য । আমাদেরও যথেষ্ট গদাই লস্করি ভূমিকা ছিল, এই সব গেরো কাটিয়ে জমকালো মন্দিরে একা উপাসিতা রাধাজির কাছে মধ্য গগনে সূর্য মাথায় নিয়ে যখন পৌঁছলাম , মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে । রাধারানি বিশ্রাম নেবেন। সাড়ে চারটের আগে তিনি দেখা দেবেন না । এদিকে আমাদের হাতে সময় নেই কারণ করমা দোষে সঙ্গে এখন অসুস্থ লোক যুক্ত হয়েছে । আমার উসখুসানি দেখে এক এঁচোড়ে পক্ক বালক এসে বলল , “ফিকর মাত কিজিয়ে , রাধারানি নে আপকো দেখ লিয়া । মাঝে মাঝে এই ধরনের ফচকেমি কথা শুনতে মন্দ লাগে না । বরসানায় জন্মেছেন , গোকুলে বড় হয়েছেন , প্রেম এবং বিয়ে থা । রাধারানির কতো কাজ, দম ফেলার সময় নেই । জটিলা কুটিলা দুই শাশুড়ি আর ননদ , আর স্বামীর জ্বালাতন চিড়বিড়ানি কিছুই তার গায়ে লাগত না । কারণ সখী ওই বুঝি বাঁশি বাজে, বন মাঝে কি মনো মাঝে
এঁচোড়ে পাকা আরো বলল , একবার রাধারানিকে যদি দেখেন না , উনি আপনাকে ছাড়বেন না , বলবেন, ইতনা জলদি কিউ ? বোসো না , আরেকটু বোসো পহলু মে বইঠে রহো । আপনিও সে চোখের মায়া কাটাতে পারবেন না গো ।
যেমন কানহাইয়া পারেন নি।

তুমহারি রাধা অব পুরি ঘরোয়ালি
দুধ নবনী ঘিউ দিনভর খালি
বিরহকে আসু কবকে
হো কবকে পোঁছ ডালি
ফির কাহে দরদ জগাও
মথুরানগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও ।





মুসম্মন বুরজ বা সামান বুরজ । আবার এর আরেক নাম জেসমিন টাওয়ার ।
আগ্রা দুর্গের এই অতি রমনীয় স্থানটি শাহজাহান মুমতাজের জন্য বানিয়ে ছিলেন । এতো সূক্ষ্ম সুন্দর কারুকাজ এর দেয়ালে , অলিন্দে ছাদে । ইয়েমেন থেকে আনা ধূপ ,বেলজিয়াম থেকে আনা সাঁঝবাতির অভিজাত কোমল আলোয় মুসম্মন বুরজের মহার্ঘ শরীর জুড়ে বইতে থাকত যমুনার ওপর দিয়ে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস । আবার এই জেসমিন টাওয়ারই নীরব সাক্ষী হয়ে থেকেছে এক মনফকিরার সুখ দুঃখের গীতিকবিতার ।
বাবা শাহজাহান আগ্রা দুর্গে বন্দী । তিনিও বাবার সেবার জন্য বন্দীত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। দারার শোচনীয় মৃত্যু , ভ্রাতৃ দ্রোহ , ভাগ্যের পরিহাসে নাজেহাল অবস্থায় এই সামান বুরজ জাহানারাকে অনেক শান্তি দিয়েছিল । যে প্রেমে তিনি সারা জীবন একনিষ্ঠ ছিলেন সেই বুন্দেল রাজ ছত্রশালের জন্য তার দুর্দমনীয় প্রেম তিনি লিখে রেখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে । মহতাব বাগ ছেড়ে অঙ্গুরীবাগ ছেড়ে শুধু দুদন্ড শান্তিতে বসে লিখবার জন্য শাহজাহানের সেই অতি বিদুষী কন্যা বেছে নিতেন এই সামান বুরজকে । শামদানের নিভু আলোয় লিখে গেছেন পাতার পর পাতা তাঁর দেখা সময় , পূর্ব পুরুষ , সুফিসাধনা , দর্শন এবং তাঁর ভালোবাসা যা কোনদিনই সফল হল না । ভেবেছিলেন পান্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলবেন । কিছু অংশ হয়তো করেছিলেনও । সেই অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী সামান বুরজের পাথরের তলায় চাপা দিয়ে রেখে যান লিখেছিলেন একদিন জেসমিন প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যাবে , সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে এই জীবনী মানুষের হাতে পৌঁছবে , তারা জানবে সম্রাট শাহজাহানের মেয়ের চেয়ে দীন রিক্ত আর কেউ ছিল না



খুব অদ্ভুতভাবেই ভারত পর্যটনে আসা এক লেখিকা আন্দ্রিয়া বুটেনশনের হাতে এই পান্ডুলিপি এসে পড়ে । নড়বড়ে মার্বেল টালির মধ্যে চাপা পড়ে ছিল সেই পান্ডুলিপি । জেসমিন টাওয়ার দেখার সময় ঘটেছিল এই বিস্ময়কর ঘটনা । আন্দ্রিয়া অনুবাদ করেন সেই আত্মজীবনী , অসামান্য এক ঐতিহাসিক দলিল, যা জাহানারা হৃদয় দিয়ে লিখেছিলেন।
এখন জেসমিন টাওয়ার আর সাধারনের জন্য খুলে রাখা হয় না । আরকিওলজিকাল দপ্তর থেকে বিশেষ পারমিশন নিতে হয় । কোনো কোনো জায়গা আবার সেনাবাহিনীর দখলে , সেখানে আরো গেরো । এই সব কাজকর্ম ঠিক ভাবে করতে হলে সময় চাই । ধাঁ করে চলো সামান বুরজ বললে হবে না । আমাদেরও তাই হল । অধরা অদেখা থেকে গেলো সামান বুরজ , তার খিলান অলিন্দ , ছাদ মেঝের অপরূপ নকশা , জাহানারার মৃদু সৌরভ রয়ে গেলো চেতনার বাইরে ।
আফশোস !

উয়ো বাত সারে ফসানে মে জিসকা জিকর না থা
উয়ো বাত উনকো বহত না গবার গুজরি হৈ ।
************************************************
কর রহা থা ঘম এ জহাঁ কা হিসাব
আজ তুম ইয়াদ বেহিসাব আয়ে


কবিতাঃ ঋতু পর্ণ ঘোষ
ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ।


 সামান বুর্জ ছবিঃ গুগল 

দিল্লি দাস্তান ৬

জিন ও পীর


মার প্রার্থনা এর আগেও আপনাকে জানিয়েছি , আবার জানাচ্ছি। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আমি বারবার আপনার কাছে ফিরে আসছি। আপনার তো কিছুই অজানা নয় । কয়েক বছর হল দোকান টা আর চালাতে পারছি না । প্রচুর মালপত্র চুরি হয়ে গেছে , ধার দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছি ।জিনিশপত্র বিক্রি করা শুরু করেছি । তার ওপর শরীরের অবস্থাও ভালো নয় । এই সময়ে যদি কিছু সুরাহা না করেন তাহলে তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে । আমার অগাধ বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবেন। আমার নাম অমুক ঠিকানা তমুক , ফোন নম্বর...।
এ ফোর সাইজের কাগজটায় গোটা গোটা পরিষ্কার ছাঁদে লেখা একখানা চিঠি । মনে হতে পারে কোন বড়লোক হোমরা চোমড়া কেউ বা রাজনৈতিক দাদা , যারা দান খয়রাতি করে থাকে আমাদের গরিবগুরবোদের ,তাদেরই কারুর উদ্দেশে এই পত্র ।
এই চিঠিটা যখন চোখে পড়ল, তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে । একটা কমলাটে আলো প্রায় অন্ধকার কুঠরিটার মধ্যে তেরছা হয়ে ঢুকেছে । কুঠরিটার ছাদে ঝুলে আছে অজস্র বাদুর । নিচের পাথুরে মেঝে কালো হয়ে গেছে প্রদীপের পোড়া তেলে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের পাপড়ি, ধূপের ছাই । না, কোনো পীরের মাজার বা দরগা নয় । চিঠিটা লেখা হয়েছে জিন কে উদ্দেশ্য করে। জায়গাটার নাম কোটলা ফিরোজ শাহ। এককালে ফিরোজশাহ তুঘলকের প্রাসাদ । তার চারদিক ঘিরে ঝাঁ চকচকে শহরের তুমুল ব্যস্ততা , সরগরম রাজধানী ।
William Dalrymple এর সিটি অফ জিনস এর পর বিশেষ কিছু লিখলাম না, শুধু নিজে যে টুকু দেখেছি তাই লিখলাম ।




বেস্পতি আর শুক্কুরবারে খুব ভিড় হয় । খুব জাগ্রত পীর বাবা । মানত পুরো হলে বাবাকে দিতে হয় আস্ত একটা মটকা । মটকা পীরের(THE SAINT OF EARTHEN POT) দরগায় গাছে গাছে মাটিতে মাটিতে সর্বত্র মটকা ।বারো শতকের সুফি সন্ত খুশি হবেন যদি মটকার সঙ্গে ছোলা , গুড় আর দুধ দেওয়া হয় । হজরত শেখ আবু বকর তুসি হাইদরি কালান্দরি এসেছিলেন ইরানের তুসি জেলা থেকে আর নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কালান্দরি গোষ্ঠীর ছিলেন । শান্তির বাণী ছড়াতে ছড়াতে সুদূর ইরান থেকে তাঁর আগমন । আজ প্রগতি ময়দানের কাছে উঁচু টিলার ওপর যেখানে তাঁর দরগা সেটা আগে জঙ্গল ছিল,যমুনা বয়ে যেত পাশ দিয়ে । পীর বাবা একদিন দেখলেন একটা লোক জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে চলেছে । অসুখ আর সারে না তাই । বাবা তাকে শান্ত করলেন , তারপর মটকা থেকে জল খেতে দিলেন। লোকটা সেরে গেলো । এবং বাবার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল । এদিকে হয়েছে কি , গিয়াসুদ্দিন বলবন তখন সুলতান , তিনি স্বভাবতই দাম্ভিক । বাবাকে পরীক্ষা করার জন্য ছোলা আর গুড়ের জায়গায় ছোট ছোট লোহার বল আর খানিকটা কাদার তাল খুব জাঁক করে পাঠিয়ে দিলেন । বাবার চেলারা সুলতানি জাঁক দেখে খুব খুশি , না জানি কি এসেছে । কিন্তু ঢাকা খুলে দেখেই তো তারা চটে লাল ।পীর বুঝলেন সুলতান তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছে । তিনি প্রার্থনায় বসলেন , সেই লোহার বলগুলো হয়ে উঠল ভাজা ছোলা আর কাদার তাল হয়ে গেলো গুড় । বাবা তখন গ্রাম থেকে কিছু দুধ আনালেন। দুধে গুড় মিশিয়ে ছোলার সঙ্গে সবাই কে খাওয়ালেন । সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে । সব ধর্মের লোকেরা এখানে আসে । বলবন আবার পরে শ্বে তপাথর টাথর দিয়ে জায়গাটা বাঁধিয়ে দেয় । বাবার নাম লেখা জায়গাটায় খোঁচাখোঁচা বাংলা হরফ চোখে পড়ল ।
কিন্তু এজায়গাটার স্থান মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তো শুধু ধর্মে আটকে থাকলে চলবে না ।একটু বাসনা প্রবণ হতে হবে । বাসনার সেরা বাসা রসনার সঙ্গে বাবু খানকেও স্মরণ করতে হবে । ইনি হলেন শাহী বাবুর্চির বংশধর । বাবু শাহী বাবুর্চির পূর্ব পুরুষ রা ছিল খোদ সম্রাট শাহজাহানের শাহী রসুই আর দস্তরখানের দায়িত্বে । আর শাহজাহানের রইসি তো প্রবাদের মতো । দিল্লির সেরা বিরিয়ানি আর কোর্মা খেতে হলে এই মটকা পীর দরগায় মাথা ঠুকতে আসতে হবে । যারা জোমাটো খুঁজে দেখতে ভালোবাসে দেখুক তারা । সারা রাত্তির ধরে শীতকালে নেড়ে নেড়ে ঘুঁটে ঘুঁটে তৈরি হয় শাবদাগ ,মাংসের কিমা দিয়ে বানানো আরেকটার নাম তারকালিয়া । সব রেসিপিগুলো বংশানুক্রমে বয়ে চলেছে । বাবু খানের দোকানের চারটে ছেলে মৌর্য শেরাটনে রাঁধে । এদের এখানে একসময় কে না খেয়ে গেছেন শাহনাজ হুসেন, জেনারেল মানেকশ, মনসুর আলি পতৌদি ।
গাছের শুকনো ডালে ডালে রাশি রাশি মটকা , তার নিচে বড় বড় ডেকচিতে গরম গরম বিরিয়ানি আর কোর্মা । না কোন সাজ সাজাওট । না কোন বনাওট , মেহেন্দি , চুনুরি, আসল সুন্দরীকে আবার সাজতে হয় নাকি !





আলতাফি কিসসা/২


 রা অক্টোবর । গান্ধিজি ছাড়া আমার এক বন্ধুর জন্মদিন । সেদিন আমার খুব তাড়া । বাড়ি থেকে বেরুব । এমন সময় শিবানীর ফিনফিনে ফোন ,”ম্যাডাম ,আজ আমার জন্মদিন
আমিও একটা জন্মদিনের নেমন্তন্ন তেই যাচ্ছি কিনা , বললাম খুব ভালো কথা , ভালো থেকো , সুখে থেকো ..মেনি মেনি হ্যাপি রিটারন্স
কিন্তু সে তখন হু হু করে কাঁদছে । কেন গো ? গান্ধিজির সঙ্গে কেমন মিলিয়ে দেওয়া জন্মদিন । আরও আরও হু হু । , তাই বল ? গান্ধিজি না হয়ে ঋত্বিক রোশন হলে ভালো হত বলছ ? তবে এখন তো লেটেস্ট হার্ট থ্রব ফাওয়াদ খান , সেখানে আবার নানান পোলিটিকাল ঝামেলা , সে যাক গে , তুমি দুঃখ কর না ।
আমি খুব অসুস্থ , খুব শরীর খারাপ , “ঝমঝমিয়ে কান্না ,হু হু হু ।
একেবারেই বাচ্চা মেয়ে , বাড়ি থেকে বহুদূরে দিল্লিতে একা থাকে , চাকরিতে ঢুকেছে সবে পড়াশোনা শেষ করে ।
বললাম , আমার এখানে চলে এসো , আমি থাকছিনা , কিন্তু কোন অসুবিধে হবে না ।
ও বোধহয় সেটাই চাইছিল । বলল , ঠিকানা টা একবার বলে দিন , আমি ক্যাব নিয়ে চলে যাচ্ছি ।
আচ্ছা আচ্ছা ,বলছি ।
সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হল , আরে , আরও একজনের গলা শুনতে পাবার কথা ছিল যেন , সেই পরোপকারী দিলদরিয়া আজ অনুপস্থিত কেন ?
কথার রেশ তখনো মিলিয়ে যায় নি , মোবাইল টা আবার বেজে উঠল , “ম্যাডাম , বাড়ির ঠিকানাটা বলুন প্লিজ , শিবানী যাচ্ছে তো , আমি যেতে পারছি না , আব্বু খুব অসুস্থ
হ্যাঁ , ঠিক । আমার ক্যালকুলেশন একেবারে ঠিক । জনাব আলতাফের গলা ।
এরপরই শিবানীর ঝটিকা আগমন এবং আমার নির্গমন ।
দিনটা কিন্তু ভয়ানক বাজে ছিল । অসম্ভব গরম । আমি ঝরঝর করে ঘামছি । ক্লান্ত হয়ে পড়ছি দ্রুত । ইশ , শিবানীর জন্য একটা কেক কিনলে হত । দেখেছ কেকের দোকান টা বন্ধ । শুধু কেক নয় , বহু দোকান বন্ধ । চিড়বিড়ে গরমে দেখতে পাচ্ছি না একটাও ফুলের দোকান । যাক গে , আমি আর পারছি না । মাথা ঘুরছে , বাড়ি যাই ।
বাড়ি ফিরে দেখি মুঙ্গ ডাল কি খিচড়ি খেয়ে শিবানী ঘুমিয়ে পড়েছে । আমি ধড়াম করে শুয়ে পড়লাম ।
ঘুম যখন ভাঙল , একটা অস্পষ্ট গলার শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি । সন্ধে হয়েছে । গীতাজি খুচরো কাজ করছে , বসার ঘরে একটা মস্ত ফুলের তোড়া ।
আলতাফ ভাই লায়া ,ওই ঘরে বসে আছে তো
ঘরে ঢুকে দেখি শিবানী উঠে বসে বেশ হাসি হাসি মুখে আলতাফের সঙ্গে কথা কইছে , আর আলতাফের বিখ্যাত কফি আর মারি গোল্ড বিস্কুট খাচ্ছে । বললাম , আরে আলতাফ , ফুলের বুকে টা ওকে দাও ।
আলতাফ চলে যাবার সময় আমাকে খুব করে থ্যাংকস জানালো , আমি শিবানীর খুব ভালো দেখভাল করেছি বলে । ও যেন শিবানীর বাবা , কাকা , দাদা ।
শিবানী বলল , জানেন , আলতাফ ভাই না একটা পাঁচশ টাকার নোট আমার মাথায় ছুঁইয়ে আমার হাতে দিল , আমি বললাম , এ এবার কি? আমরা তো বন্ধু , একই বয়স , একসঙ্গে কাজও করি । আলতাফ ভাই বলল তুমি আমার মেয়ে । কি অদ্ভুত বলুন তো?”
আমি খুব লজ্জা পেলাম ।চুপ করেই থাকলাম । গান্ডে পিণ্ডে নেমন্তন্ন খেয়ে দোকানপাট বন্ধ , উফ কি অসভ্যের মতো গরম এইসব ফাঁকা অজুহাত দিয়ে বাড়িতে এসে ধপাস করে শুয়ে পড়লাম । আর একটা ছেলে বাবার খুব খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও সহকর্মী বন্ধুর দেখভাল করল , ফুলের দোকান ও খুঁজে পেল , আবার টাকা দিয়ে আশীর্বাদ জানিয়ে সন্ধে বেলা
তাকে দেখেও গেল ।
নিস্তব্ধতা ভাঙল শিবানী । আলতাফভাই এর সেই গল্পটা জানেন আপনি। ?”
কোনটা?
জানেন তো , আলতাফভাই না একজনকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল । ওদের ধর্মেরই । কিন্তু কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারেনি , অনেক চেষ্টা করেছিল । কিন্তু পারেনি । একদিন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে , হঠাত দেখে ওই মেয়েটা একটা দামি গাড়িতে করে পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল , আর আলতাফভাইও হুঁশ ফিরে হঠাত ই যেন বুঝল দুজনের সমাজে অনেক অনেক ফারাক ।
গল্পটা কেমন হিন্দি ফিল্ম মার্কা হয়ে গেল না?”
তবে হ্যাঁ , Life is more interesting than fiction .
তারপর শুনুন না , আলতাফভাই এর আম্মি তো আমাদের দেখলেই বলেন আমার বেটার সাদির জন্য মেয়ে দেখ না , ওর জন্য মেয়ে পাওয়া তো খুব শক্ত ।
একদিন হয়েছে কি , আলতাফ আমার বাড়িতে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে হাজির।
মিষ্টি কেন? তোমার সালগিরাহ নাকি ? না অন্য কোন খুশ খবর ?”
আলতাফ বলল , আগে একটা মিঠাই খাও । তারপর বলব ।
শিবানী মিঠাই খেল এবং মুখ তুলে দেখল আলতাফের চোখদুটো চিকচিক করছে
আজ উসকি ডোলি নিকাল গয়া ... নিকাহ হো গয়া । ওর এই খুশি আমি বাঁটতে এসেছি , মিঠাই নাও
না , আলতাফভাই , এমন ভাবছ কেন? তুমিও কাউকে খুঁজে পাবে , দেখো ।
না মুমকিন
কেন? এরকম ভাবতে নেই , ভাই
এই রকম দিন আমার জীবনে আসবে না । কেন জান?
ম্যায় দিলপে তালা লগাকে চাবি বহত দূর ফেক দিয়া
দূরত্বটা বোঝাবার জন্য শিবানী ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গি করে দেখিয়েছিল , আলতাফকে নকল করে ।

আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো ?

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো
লিখিও উহা ফিরত চাহো কিনা

কবিতাঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়




দিল্লি দাস্তান ৫


শিকারগাহ
বেশ ঘুসঘুসে ঠান্ডা পড়ত , জম্পেশ করে আংরাখা পশমিনা গায়ে দিয়ে সুলতান আমির দের দল শিকারগাহ তে( হান্টিং লজ)  গিয়ে উঠতেন । শিকারগাহ এর চারদিক খোলা , প্রচুর রোদ হাওয়া , অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে  খোলা চত্বরটায় উঠতে হয়। আবার গর্মির দিনেও কোন অসুবিধে নেই , চারদিকে সুন্দর গাছ গাছালির ফুরফুরে মিঠে হাওয়া , পাখিরা না চাইতেই শিস দিত , শীতকালে আগনগারের ধিকিধিকি আগুন , অম্বুরি তামাকের বুড়বুড়ি , আর গরমে আম পান্নার সরবত , ইস্পাহানি কার্পেটে দাবার ঘুঁটি , শের শায়েরি ।
পুরাকালে শরতকালে রাজারা মৃগয়ায় বের হতেন । সে রকমই শখের শিকার নবাব সুলতানরা হামেশাই করতেন হয়তো এবং সবচেয়ে বড় কথা এই শিকারের জন্য খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতেন না বলে মনে হয় কারণ দিল্লির মধ্যেই প্রায় গোটা চারেক শিকারগাহ দেখতে পাচ্ছি ।
নিচে অনেকগুলো কুঠুরি আর জল নিকাশের ব্যবস্থা দেখে মনে হয় এগুলোতে  শিকার করে আনা পশু পাখি জবাই করে রান্না করা হত, কাবাব বানানো হত , আর উঁচু সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে খানসামার  দল সেই ধোঁয়া ওঠা খুশবুদার খানা পরিবেশন করে আসত । এইসব করতে করতে রাত কাবার । কয়েক পাত্তর সিরাজি ।  কখনো দুএক দিন থেকেও যাওয়া হত । ব্রিটিশ আমলের ইন্সপেকশন বাংলোর প্রথম সরলীকৃত চেহারা বোধহয় শিকারগাহ ।
ফিরোজ শাহ তুঘলক শিকারপ্রিয় ছিলেন কিনা জানি না । তার নিজের লেখা ফুতুহাত এ ফিরোজশাহিতেও এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি তিনি । একটা হালকা সূত্র ছেড়ে গেছেন , তিনি আমির ওমরাহদের চটাতে চাইতেন না । তার আমলে তৈরি তিনটি চারটি হান্টিং লজ দিল্লিতে আছে । এখানে হয়তো ওমরাহ্‌রা মাঝে মাঝেই দিলখুশ করতে , গুলতানি করতে আসত
তিনমূরতি ভবনের চৌহদ্দির মধ্যে আছে কুশক মহলওই লম্বা খা ড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে বসে পড় । শেষ ধাপে উঠেই মনে হল আরে এটা তো আমার  জায়গা সাদাসিধে গড়ন এবং বেশ ছড়ানো ছিটানো মজলিশি ধরনের ।   বেশ জায়গাটা , ল্যাপটপ , কফি স্যান্ডউইচ নিয়ে ঘন্টা কয়েক দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় । কেউ বিরক্ত করবে না , ট্যুরিস্ট যদিও আসে, তিন মিনিটের বেশি থাকবে না , সেলফিও তুলবে না । অথচ আমি জানি আমার সামনে এখনি খসে খসে  পড়বে ওই লতানে গাছটার হলুদ ফুল, লেজ নাচিয়ে পাখিরা আসবে , শ্যাওলা ধরা খোলা চাতালে আমার সঙ্গে আমি থাকব, আর কেউ না ।




কুশক মহল ছেড়ে এবার যেদিকে চললাম সেটা কিছুটা চমকপ্রদ । হান্টিং ছাড়াও এটা আবার দিল্লির অন্যতম হন্টেড হাউস ও বটে । ভুলিভাটিয়ারি কি মহল । ঘন ঠাসা  জঙ্গলের মধ্যে যখন ঢুকলাম মনে হল লম্বাপানা  কেউ তার লম্বা  চুল খুলে সাদা শিফনের সাড়ি পরে একখানা মোমবাতি জ্বালিয়ে একটু একটু করে দেখা দিচ্ছে আর গাইছে ,”ও ভুলি দাস্তান , লো ফির ইয়াদ আ গয়ি” ।।
কেউ বলে বু আলি বাখতিয়ারি নামে এক সাধুর নাম থেকে ভেঙেই এই নাম । আবার শোনা যায় ভাটিয়ারিন বা রাজস্থানের আদিবাসী মেয়ে পথ হারিয়ে এই খানে আস্তানা গেড়ে ছিল । আবার  বু আলি ভাট্টি নাকি এখানকার মহিলা কেয়ার টেকার ছিল , আর আত্মা নাকি আজও ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে । এখন ভুলি ভাটিয়ারিতে দিনমানে একা যাওয়া যায় না , বেশ গা ছমছমে , খন্ডহর আর জঙ্গল ।  মজবুত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা , অনেক ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরি , কি হত কে জানে, দারোয়ান রান্নার বাবুর্চি খানসামা এরা সব থাকত বোধহয় ।  মচমচ করে আমাদের পায়ের শব্দ হচ্ছে । ও হরি , মূল দরজার সামনে দাঁড়ানো মাত্র দেখলাম স্কুল পালানো এক দঙ্গল বখাটে ছেলেমেয়ে কোন খান থেকে বেড়িয়ে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেলো আর আমাদের সঙ্গীর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ,  তওবা , কেয়া জমানা।



এরপর চল্লাম আরেক শিকারগাহ দেখতে । সেটাও ওই ফিরোজশাহ বানিয়েছেন । এটা আবার দোতলা, সিলিন্ড্রিকাল । এখানে নাকি অবসারভেটরিও  ছিল ।  খুব সাদামাটা গঠন । শিকারগাহ তে কারিকুরি নকশা করে  লাভ কিছু নেই । প্রত্যেকটাই খুব কাঠখোট্টা , ফাংশানাল । এবারেরটা বেশ মজার । এটার নাম পীর গায়েব ।সত্যি  একজন পীর এখানে তার সাধনার জায়গা বানিয়েছিলেন আর একদিন নাকি হঠাত রহস্য জনকভাবে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান , কেউ আর তাকে দেখতে পায়নি । আজও প্রচুর লোকসমাগম হয় ,দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে , প্রার্থনা করে, একটা দমবন্ধ ঘুপচি সরু অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখি অপ্রশস্ত ঘরে জ্বলছে একটা প্রদীপ । আর নিচ থেকে এখানকার দেখভাল করেন  এক হিন্দু মহিলা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন  জুতা খোলকে, জুতা খোলকে ।




কোথা থেকে কে কখন সুতোয় টান দেয় বোঝা  মুশকিল । শিকারগাহ কুশক মহল যে আমাদের ভালবেসে ফেলেছে সেটা বুঝলাম ওই টান থেকে । আহা রে, সুলতান মুঘল এমনকি সাহেবরা চলে যাবার কেউ বিশেষ আড্ডা মজলিশ বসায় নি বোধহয় ।
“মাস আলা যব ভি চিরাগোঁ কা উঠা
ফ্যায়সালা সিরফ হাওয়া করতি হ্যাঁয়”(পরভিন শাকির)
তা এখানে শুধু হাওয়া নয় , শ্যাওলা ধরা  চওড়া ছাদটা , ছাদ ছুঁয়ে নেমে আসা নিম গাছটা, বুড়ো অশ্বত্থ গাছ ,   সবুজ পাতা আর রোদের ঝিলিমিলি সবাই ঠিক করে দিল যে আমাদের একবার ওখানে বসে গুলতানি করাটা খুব দরকার। বেশ শরত কালের আবহাওয়া । নিমগাছের ছাতার তলায় সেই তুঘলকি চাতালে বসে ছাদের আলসেতে মাথা ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে ভারি একটা আমোদ পেলাম । হঠাত দেখি একদল লোক এসেছে , তাদের সঙ্গে যেন অরুণা চলের  জঙ্গল থেকে ধনেশ পাখি এসে হাজির হয়েছে । তার একটা ছবি নিলাম । কতকালের শিকার গাহ , কতো কাহিনির পটভূমি । বাড়িটারও মনে হল আমাদের পেয়ে সে খুশি বেশ  হয়েছে । চা , স্যান্ডউইচ খাওয়া হয়ে গেলো, দেদার কবিতা পড়া হয়ে গেলো , ঝিমনোও হয়ে গেলো । এবারে যেতে হয় । ইয়া বড় বড় পাথুরে সিঁড়ি একটু এবড়ো খেবড়ো ।
সিঁড়িটাও যেন বলে উঠল, ধীরে ধীরে চলো , বাছা । এখন তো আর সে মানুষ নেই , আর বড় বড় পাও নেই । সাবধানে আস্তে আস্তে নামো ।

ধীরে ধীরে চল চাঁদ গগনমে
কহিঁ ঢল না যায়ে রাত,টুট না যায়ে সপনে...।