কানু কহে রাই, ধবলী চরাই মুই... আচ্ছা বেশ , দেশ গাঁ য়ের কথা ছেড়ে দিন ,
হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীতেও কানু রাধা বিনে গান নেই , কথাটা
কিন্তু হক কথা । তা গান বাঁধার মতই জুড়ি এরা । জুড়ি নাম্বার ওয়ান
।
একতালে বাঁধা মূলতানী রাগের বিলম্বিত খেয়ালের বন্দিশ গুরুজি নিজের
হাতে লিখে দিয়েছিলেন ‘এ গোকুল গাঁও কে ছোড়া , বরসনা
কি নারী রে/ইন দোনো মনো মোহলিয়ো হ্যাঁয় /রহে সদারঙ্গ নিহারহে ।
গোকুল গ্রামের ছোকরা আর বরসানার ছোকরির মনোমুগ্ধকর জগতপ্লাবী প্রেম
। বন্দিশটি রচনা করেছিলেন নিয়ামত খান সদারং । সদারং এবং তার ভাইপো অদারং । মুঘল
সম্রাট মহম্মদ শাহের সভায় এনারা গান বাজনা করতেন । মহম্মদ শাহ রঙ্গিলা । এই নাম
থেকেই আন্দাজ করা যাচ্ছে সম্রাটের শখ শৌখিনতার বহর ।
অনেক বন্দিশে আবার
সদারঙ্গিলে মহম্মদ শাহ এমন ভাবেও দুজনের উল্লেখ আছে । মহম্মদ শাহ নিজেও অনেক
বন্দিশ লিখেছিলেন । মজারকথা হল, নিয়ামত খান সদারং এই গানটি বেঁধে ছিলেন হিন্দু দেব
দেবীকে নিয়ে । এরকম অগুন্তি উদাহরণ আছে । গঙ্গাযমুনি তেহজিবের ধারা উত্তরভারতে
এইভাবেই বয়ে চলেছিল দীর্ঘদিন ,যে পথে মথুরা বৃন্দাবনও ছিল ।
কোন কাজ যদি হাতের নাগালের বাইরে চলে যায় ,সে
ক্ষেত্রে প্রথমেই সম্পূর্ণ দায় টা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিতে হবে । এটি জনৈক মনীষীর
সুধা বচন ( পড়ুন আমার ভাই) । তারপরেই দেখতে হবে প্ল্যান ছকতে গিয়ে কি কি গ্যাপ আছে
বা ভুল ভ্রান্তি রয়েছে, ইনফরমেশন গ্যাপ আছে কিনা , বলাই বাহুল্য, তার দায়ও নিজের ঘাড়ে নিতে হবে । যে
দুটো কারণে নিজেকে খুব একটা দায়ী করা যায় না সেটা হল শরীর যদি বিগড়ে যায় হঠাৎ এবং
ভারতীয় পরম্পরা কে যথোচিত সম্মান দেখিয়ে শেষ কারণ টি হবে ভাইগ্য/ কপাল/ কর্ম (
অনেকে আজকাল বলে কারমা)।
মথুরা পর্যন্ত যাওয়াটাই ছিল প্ল্যান । খুব সুন্দর বিকেলে মথুরায়
কৃষ্ণ জনম ভূমি মন্দিরে পায়ে আলতা , মাথায় সিঁদুর , হারে চুড়ি লাল পেড়ে শাড়ি পরা এক পুরুষকে দেখলাম রাধা ভাবে মজে আছে ,পূর্ব রাগ শেষে একেবারে মাথুর। আবার বাঁকে বিহারী মন্দিরে ঘুরে ঘুরে
সামান্য চরাই উঠতে উঠতে দেখি পুরো গলিটা শোভা গুরতুর ভজন হয়ে গেছে । খসখসে নকশাদার
গলায় “ মাহারো প্রণাম , বাঁকে বিহারী “
, মীরার ভজন । সেই গান শুনে গলির দোকানের রাবড়ি ,জলেবি , প্যাঁড়া , লাড্ডু ,
লসসি কালাকান্দ সক্কলের হাউমাউ করে সে কি কান্না । গলে গলে পড়ছে ইমন
কল্যাণ , কোথা থেকে ভুরভুর করে আসছে চন্দন গন্ধ ।
আর কি ,আমারো ধাঁ করে মনে পড়ে গেলো মূলতানী রাগের বন্দিশ ।
আরে মথুরা থেকে মাত্র চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার তো রাস্তা । গোকুলের ছোড়া আর
বরসানা কি নারী ।
বরসানায় সব কিছুই রাধে রাধে ।ঘরের দুলারি বলে কথা । কিন্তু ওই , নানান
তথ্য সংক্রান্ত ভুল ভ্রান্তি । নানান লোকের নানান গোলমেলে তথ্য । আমাদেরও যথেষ্ট
গদাই লস্করি ভূমিকা ছিল, এই সব গেরো কাটিয়ে জমকালো মন্দিরে
একা উপাসিতা রাধাজির কাছে মধ্য গগনে সূর্য মাথায় নিয়ে যখন পৌঁছলাম , মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে । রাধারানি বিশ্রাম নেবেন। সাড়ে চারটের আগে
তিনি দেখা দেবেন না । এদিকে আমাদের হাতে সময় নেই কারণ করমা দোষে সঙ্গে এখন অসুস্থ
লোক যুক্ত হয়েছে । আমার উসখুসানি দেখে এক এঁচোড়ে পক্ক বালক এসে বলল , “ফিকর মাত কিজিয়ে , রাধারানি নে আপকো দেখ লিয়া “। মাঝে মাঝে এই ধরনের ফচকেমি কথা শুনতে মন্দ লাগে না । বরসানায় জন্মেছেন ,
গোকুলে বড় হয়েছেন , প্রেম এবং বিয়ে থা ।
রাধারানির কতো কাজ, দম ফেলার সময় নেই । জটিলা কুটিলা দুই
শাশুড়ি আর ননদ , আর স্বামীর জ্বালাতন চিড়বিড়ানি কিছুই তার
গায়ে লাগত না । কারণ “সখী ওই বুঝি বাঁশি বাজে, বন মাঝে কি মনো মাঝে “।
এঁচোড়ে পাকা আরো বলল , একবার রাধারানিকে যদি দেখেন না ,
উনি আপনাকে ছাড়বেন না , বলবেন, ইতনা জলদি কিউ ? বোসো না , আরেকটু
বোসো । পহলু মে বইঠে রহো । আপনিও সে চোখের মায়া কাটাতে
পারবেন না গো ।
যেমন কানহাইয়া পারেন নি।
“ তুমহারি
রাধা অব পুরি ঘরোয়ালি
দুধ নবনী ঘিউ দিনভর খালি
বিরহকে আসু কবকে
হো কবকে পোঁছ ডালি
ফির কাহে দরদ জগাও
মথুরানগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও ।“
২
মুসম্মন বুরজ বা সামান বুরজ । আবার এর আরেক নাম জেসমিন টাওয়ার ।
আগ্রা দুর্গের এই অতি রমনীয় স্থানটি শাহজাহান মুমতাজের জন্য বানিয়ে
ছিলেন । এতো সূক্ষ্ম সুন্দর কারুকাজ এর দেয়ালে , অলিন্দে ছাদে । ইয়েমেন থেকে আনা
ধূপ ,বেলজিয়াম থেকে আনা সাঁঝবাতির অভিজাত কোমল আলোয় মুসম্মন
বুরজের মহার্ঘ শরীর জুড়ে বইতে থাকত যমুনার ওপর দিয়ে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস । আবার
এই জেসমিন টাওয়ারই নীরব সাক্ষী হয়ে থেকেছে এক মনফকিরার সুখ দুঃখের গীতিকবিতার ।
বাবা শাহজাহান আগ্রা দুর্গে বন্দী । তিনিও বাবার সেবার জন্য
বন্দীত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। দারার শোচনীয় মৃত্যু , ভ্রাতৃ
দ্রোহ , ভাগ্যের পরিহাসে নাজেহাল অবস্থায় এই সামান বুরজ
জাহানারাকে অনেক শান্তি দিয়েছিল । যে প্রেমে তিনি সারা জীবন একনিষ্ঠ ছিলেন সেই
বুন্দেল রাজ ছত্রশালের জন্য তার দুর্দমনীয় প্রেম তিনি লিখে রেখে গেছেন তাঁর
আত্মজীবনীতে । মহতাব বাগ ছেড়ে অঙ্গুরীবাগ ছেড়ে শুধু দুদন্ড শান্তিতে বসে লিখবার
জন্য শাহজাহানের সেই অতি বিদুষী কন্যা বেছে নিতেন এই সামান বুরজকে । শামদানের নিভু
আলোয় লিখে গেছেন পাতার পর পাতা তাঁর দেখা সময় , পূর্ব পুরুষ ,
সুফিসাধনা , দর্শন এবং তাঁর ভালোবাসা যা
কোনদিনই সফল হল না । ভেবেছিলেন পান্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলবেন । কিছু অংশ হয়তো
করেছিলেনও । সেই অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী সামান বুরজের পাথরের তলায় চাপা দিয়ে রেখে যান
লিখেছিলেন ” একদিন জেসমিন প্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যাবে , সেই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে এই জীবনী মানুষের হাতে পৌঁছবে , তারা জানবে সম্রাট শাহজাহানের মেয়ের চেয়ে দীন রিক্ত আর কেউ ছিল না “।
খুব অদ্ভুতভাবেই ভারত পর্যটনে আসা এক লেখিকা আন্দ্রিয়া বুটেনশনের
হাতে এই পান্ডুলিপি এসে পড়ে । নড়বড়ে মার্বেল টালির মধ্যে চাপা পড়ে ছিল সেই
পান্ডুলিপি । জেসমিন টাওয়ার দেখার সময় ঘটেছিল এই বিস্ময়কর ঘটনা । আন্দ্রিয়া অনুবাদ
করেন সেই আত্মজীবনী , অসামান্য এক ঐতিহাসিক দলিল, যা
জাহানারা হৃদয় দিয়ে লিখেছিলেন।
এখন জেসমিন টাওয়ার আর সাধারনের জন্য খুলে রাখা হয় না । আরকিওলজিকাল
দপ্তর থেকে বিশেষ পারমিশন নিতে হয় । কোনো কোনো জায়গা আবার সেনাবাহিনীর দখলে , সেখানে
আরো গেরো । এই সব কাজকর্ম ঠিক ভাবে করতে হলে সময় চাই । ধাঁ করে চলো সামান বুরজ
বললে হবে না । আমাদেরও তাই হল । অধরা অদেখা থেকে গেলো সামান বুরজ , তার খিলান অলিন্দ , ছাদ মেঝের অপরূপ নকশা , জাহানারার মৃদু সৌরভ রয়ে গেলো চেতনার বাইরে ।
আফশোস !
উয়ো বাত সারে ফসানে মে জিসকা জিকর না থা
উয়ো বাত উনকো বহত না গবার গুজরি হৈ ।
************************************************
কর রহা থা ঘম এ জহাঁ কা হিসাব
আজ তুম ইয়াদ বেহিসাব আয়ে
কবিতাঃ ঋতু পর্ণ ঘোষ
ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ।
সামান বুর্জ ছবিঃ গুগল