Thursday 22 January 2015

রানিমার রাজ্যপাট



মীরা ইসমালুন (১৮৩০-১৯০৯) ছিলেন খুব সুন্দরী আর তেজস্বিনী জন্মেছিলেন কায়রোতে, ইসমালুনদের জমকালো  বংশে । তারা ইজিপ্টের লোক হলেও বংশের আদি  শিকড় ছিল স্পেনে । আবার ইসমালুনরা কোনএকসময় হাঙ্গেরিতে বাস করত ।   তের বছর বয়সে মীরা ইসমালুনের বিয়ে হয়ে গেল  মিশরের এক ব্যাঙ্কারের সঙ্গে , তিনি আদতে  আরব দেশের লোক । কতো ধর্ম আর  সংস্কৃতির নির্যাস বয়ে চলেছিল ইসমালুনদের রক্তে । প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দুই সংস্কৃতির বুননে মীরা ইসমালুন হয়ে উঠেছিলেন  দ্যুতিময় , ধারালো ,স্বতন্ত্র   একটি বিদ্যুৎ রেখা সেই সময়ের সমাজ ও মেয়েদের অবহেলিত জীবনের প্রেক্ষিতে মীরা ইসমালুন  ছিলেন এক জ্বলন্ত ব্যতিক্রম  । সেই সময়ে দুটি মেয়েকে নিয়ে স্বামীকে ছেড়ে তিনি একা প্যারিসে চলে আসেন । কেন ? কারণ স্পষ্ট নয় । অনুমান বলে মনের অমিল মতের অমিল । ইসমালুন আরবি ছাড়া কোন ভাষা জানতেন না । কিছুদিনের মধ্যে  শিখে ফেললেন ফরাসি ভাষা । অসম্ভব স্বাধীনচেতা ছিলেন তো । রূপ গুণ অর্থ তাকে  সহজেই নিয়ে গেল ফরাসি অভিজাত মহলে ,  বহু নামজাদা মানুষের সঙ্গে ছিল তার মেলামেশা । পশ্চিম ইওরোপীয় সমাজে একরকম সেলিব্রিটি হয়ে উঠে ছিলেন ।মহার্ঘ  আরবি পোশাক  আর  অলঙ্কারে তাকে  এক রানির মতই দেখাত । মরিস আলফাসা নামে  আদ্রিয়ানপোলিসের এক তুর্কি ইহুদির  সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে ম্যাথিলডির বিয়ে দেন  মীরা ইসমালুন মরিস আলফাসাও একজন ব্যাঙ্কার । বিয়ের কয়েক বছরের পরেই পাকাপাকি ভাবে প্যারিস চলে আসেন মরিসতিনি ছিলেন এক আশ্চর্য মেয়ের বাবা ।এ মেয়ে আর পাঁচটা বাচ্চার মত লাফায় ঝাঁপায় না ,দস্যিপনা নেই , কোন ছেলেমানুষি নেই । সে শুধু দেখতে পায় , চার পাঁচ বছর থেকেই দেখতে পায় ,মাথার ওপরে ঘুরে ঘুরে নামছে  উজ্জ্বল আলোর বৃত্ত । সে আলো রেণু রেণু হয়ে  ঢুকে যাচ্ছে তার মাথার মধ্যে , সমস্ত শরীরের মধ্যে , চেতনার মধ্যে । এ মেয়ে অন্য জগতের । অলৌকিক ,অতিমানস । ইচ্ছাশক্তি ,সাহস ,স্বাতন্ত্র  সৌন্দর্য একেবারে দিদিমার মত । শরীরটিও মজবুত ,ঋজু , কষ্টসহিষ্ণু  নামটিও মীরা । মীরা আলফাসা । বারো বছর থেকেই শুরু অকাল্ট চর্চা , গুহ্যবিদ্যা এক অতিমানস চেতনা ও দিব্যজীবনের যাত্রার  অস্ফুট সূচনা  ।
ভারতীয় দর্শন আর অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে তার খুব অল্পই পরিচয় তখন । তার চেতনার মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে দেখা দেয় এক  কৃষ্ণকায় পুরুষ । মীরা তাকে কৃষ্ণ বলে ডাকতে শুরু করেন । মীরার   সৃজন শীলতা তখন বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে চিত্রকলায় আর সঙ্গীতে । খুব উঁচু দরের শিল্পী । অরগ্যানে পিয়ানোয় রঙে তুলিতে পারদর্শী এক দীপ্র প্রতিভা



মায়ের সঙ্গে ভেনিস বেড়াতে গিয়ে পূর্ব জন্মের কথা মনে পড়ে । জন্মান্তরের রহস্যময় মায়াবী ছায়াপথ বেয়ে একাত্ম হয়ে পড়েন মিশরের ফ্যারাও রানি হাটশেপসুটের সঙ্গে । হাটশেপসুট সেই ইতিহাসখ্যাত  ফ্যারাও, এক গনগনে আগুনের   মত দৃপ্ত , তুলনাহীন   সুন্দরী ও মেধাবী নারী   সেই সময়ে কঠোর হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাজদন্ডপূর্ণ রাজকীয় মহিমায় শাসন চালিয়ে গেছেন । এমন কি  নকল দাড়িও পরতেন । এদিকে মীরার মনীষা  ,অধ্যাত্মশক্তি,উপলব্ধি ও প্রজ্ঞা ক্রমশ যেন  ঊর্ধ্বমুখী শিখা ,  তীব্র ,ভাস্বর , ‌ব্যাপ্ত ও মন্দ্র ।
চিত্রশিল্পী  হেনরি মরিসের সঙ্গে বিয়ে, একটি ছেলে হবার পর কিছুদিনের মধ্যে ভেঙে যায় । বিখ্যাত দার্শনিক ও পন্ডিত পল রিশারকে  এরপর জীবনসঙ্গী করেন মীরা রিশার প্রাচ্যের অধ্যাত্মবাদ ,বেদান্ত ও যোগের অনুরাগী ছিলেন । ইতিমধ্যে সেই স্বপ্নে পাওয়া কৃষ্ণ আরও প্রবল হয়ে তার চেতনা জুড়ে বসে থাকে । পাতলা শরীর ,পিতল সোনালি রঙ, উজ্জ্বল কান্তি, এলোমেলো দাড়ি , লম্বা চুল, ,তীক্ষ্ণ চেহারা  , পরনে ধুতি, ধুতির খুঁটে ঢাকা কাঁধ ,খালি হাত পা
১৯১৪ সালের ২৯ শে মার্চ মীরার জীবনে এক মহেন্দ্র ক্ষণ এল । স্বপ্ন পুরুষের সঙ্গে  তার দেখা হল । ভারতবর্ষে ।   সে এক অবিস্মরণীয়  মুহূর্ত  । “একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে ,থামিল কালের চির চঞ্চল গতি “ ।অবিকল তার স্বপ্ন পুরুষ,  তার কৃষ্ণ  সামনে দাঁড়িয়ে ।   কিন্তু এই সঙ্গ স্থায়ী হল না ।  ইওরোপে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । মীরা পরে লিখেছিলেন “তিনি আমাকে থেকে যেতে বললেন না ,কাজেই ফিরে যেতে হল।  কী ই বা করতে পারতাম আমি? কিন্তু আমার চৈত্যপুরুষ  (psychic) তার কাছে রেখে গেলাম।“
রিশারের সঙ্গে তিনি তখন জাপানে । প্রথম মহাযুদ্ধের দাবানল । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখানেই সাক্ষাৎ ।মীরার প্রতিভায় ও জ্ঞানে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হলেন ,বললেন শান্তিনিকেতনে শিশু বিভাগের দায়িত্ব নিতে । মীরা রাজি হন নি । তাঁর পথ অন্য ।
১৯২০ সালের ২৪ শে এপ্রিল ।সমুদ্র চরাচর জুড়ে এক অপার্থিব নীল আলোর পরিধি । আবার ভারতবর্ষের মাটিতে নামলেন মীরা ও রিশার ।
মীরার আর প্যারিস ফিরে যাওয়া হল না ।  এবার তিনি যেতে চাইলেন না । ভারতের অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে পশ্চিমের মনন ও কর্মশক্তির দৈব মিলন । এই তো তার প্রকৃত কর্মভূমি । রিশার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলেন না , ফিরে গেলেন প্যারিসে,একা
পূর্ব উপকূলের সমুদ্রতট তখন স্থিরযোজন সমুদ্রপথ ,নারকেল বীথি ,আকাশের নীলিমা এক অনাগত শুভক্ষণকে স্বাগত জানাবে বলে প্রস্তুত ।   জন্ম জন্মান্তরের রানি মীরা আলফাসা হয়ে উঠলেন মা মীরা । শ্রী অরবিন্দের সাধনসঙ্গী । আশ্রমের প্রাণপ্রতিমা । মাদার ।   শুরু হল  দিব্যজীবনের এক অনবদ্য আলেখ্য । পন্ডিচেরির  দিকচক্রবাল জুড়ে   তখন সূর্যোদয়ের স্নিগ্ধ শান্ত আলো ।  







পন্ডিচেরির প্রমেনাদ  বিচ শহরের অন্যতম মুখ্য আকর্ষণ । কালো পাথরের বোল্ডারে ভেঙে পড়ছে সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ । দুধের মত ছড়িয়ে পড়ছে তার ফেনা । । সি গালেরা চিৎকার করে ইতিউতি উড়ে যাচ্ছে । এখানে সেই অর্থে কোন তটভূমি নেই । সমুদ্রের পাড় যত্ন করে বাঁধানো ।বড় বড় পাতাওয়ালা বেঁটে গাছ আর সুন্দর বাতিস্তম্ভ । মাঝে মাঝে ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা ।সমুদ্রপাড়ের গান্ধি মূর্তিতে  সূর্যের আলো এসে পড়েছেরৌদ্রস্নাত সমুদ্র প্রান্তর । সুদীর্ঘ প্রমেনাদ ।এই শহরে আছে  ফরাসি গভর্নর দুপ্লে আর জো আন অফ আর্কের সুন্দর স্থাপত্য । প্রমেনাদে দেশি বিদেশি মানুষের ঢল । ভোরের আলো ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের মুখ আর চুল । চারদিক পরিচ্ছন্ন শান্ত  । বিনোদন প্রাচুর্য নেই , নেই অকারণ কোলাহল । নেই ফেরিওয়ালার হাঁক ডাক । নিজেকে মেলে দাও , ছড়িয়ে দাও এই আলো আর হাওয়ায় ।
সুপ্রভাত পন্ডিচেরি ।
১৬৭৪ সালে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পন্ডিচেরিতে তাদের বানিজ্য শুরু করে ।দেশ স্বাধীন হবার পরেও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পন্ডিচেরি ফরাসিদের অধীনেই ছিল । ১৯৬২ সালের ১৬ অগাস্ট ভারত সরকার পূর্ণ সার্বভৌমত্ব লাভ করে পন্ডিচেরি ও অন্যান্য ফরাসি উপনিবেশ গুলির ক্ষেত্রে ।    ফরাসি উত্তরাধিকার পন্ডিচেরিকে অন্যান্য শহর থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে ,যার  নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এই শহরের সর্বত্র , আনাচে কানাচে , পথে ঘাটে , অলিন্দে ,বাতায়নে । অনুচ্চারিত অভিজাত সুরুচি, ফরাসি সুগন্ধির মতো আবেশে জড়িয়ে রেখেছে তাকে । যেন শ্রী মা ছড়িয়ে রেখেছেন তার স্নেহ কণা ।কেউ দেখতে পাচ্ছে না আবার কেউ তাকে এড়িয়েও যেতে পারছে না । এই হল পন্ডিচেরির জাদু ।
ভূমধ্যসাগরীয় শহরের ধাঁচে পন্ডিচেরির পরিকল্পনা । সমুদ্রতীর বরাবর হাঁটলে মনে হয় যেন অন্য একটা দেশ  । একেবারে অন্য রকম একটা অনুভূতি ।











তামিল ভাষায় পন্ডিচেরির  মানে নতুন শহর । এখন আবার একে পুদুচেরি বলে ডাকা হয় ।এই শহরের দুটি ভাগ  ফ্রেঞ্চ আর  তামিল  হোয়াইট টাউন আর ব্ল্যাক টাউন ।  না, কোন বর্ণ বৈষম্য  উপনিবেশিকতার গন্ধ এনো না প্লিজ । শুধু দেখ কেমন ছবির মতো জায়গাটা ।  ফ্রেঞ্চ অংশটি  চমৎকার ।  সমুদ্রের দিকে মুখ , প্রমেনাদ বিচ বরাবর । বাড়িঘর  রাস্তার নাম সবই ফরাসি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে   ।  পুলিশও এখানে ফরাসি স্টাইলে লাল টুপি পরে । পূর্ব উপকূলের ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা ।
ফরাসি প্যাটার্নের বাড়ি ,  হলুদ, ছাইনীল ,আকাশি  রঙ , সাদা বর্ডার, আর্চ দেওয়া ,  ভেতরেটা  গাছ পালায় ঢাকা  একরাশ নিরিবিলি, বোগেনভিলিয়ার উদ্ধত বেগুনি ফুলে ফুলে  ছাওয়া ফরাসি ভিলার গেট , ঝুলন্ত একফালি বারান্দায় অদ্ভুত টবে সিড়িঙ্গে গাছে বড়বড় পাতা ,   কার লাল স্কার্ফ  ঝুলে আছে, কার সাইকেল অপেক্ষা করছে ,কার রান্নাঘর থেকে উড়ে আসছে জলপাইতেল আর চিজের গন্ধ । কমলালেবু রঙের রোদরঙিন । প্রাণবন্ত । যেন ক্লদ মনে (Claude Monet) ছবি এঁকে রেখেছেন পথের বাঁকে বাঁকে ।  




















না কোন তাড়া হুড়ো নেই । যারা যেখানে যাবার চলে গেছে । রোদ চশমা খুলে তুমি শান্ত হয়ে বসো । কপালের ঘাম মুছে এক গ্লাস জল খাও , রাখো নীল ছাতাটা গুটিয়ে ।   আমাদের হাতে টিক মেরে মেরে জায়গা দেখার কোন লিস্ট নেই তামিলনাড়ু ট্যুরিজম কতটুকু সময় রাখে পন্ডিচেরির জন্য ? কয়েকঘন্টা বা একদিন । আমরা তো সে দলে পড়িনা । পন্ডিচেরি আমাদের কাছে প্রাণের আরাম ,মনের আনন্দ । আত্মার শান্তি ।  তিনদিন পাঁচ দিন সাত দিন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি । এ আমাদের কম্ফরট জোন । মেয়েদের যেমনি বাপের বাড়ি । একবার বেতের চেয়ারে বারান্দায় বসে , একবার ছাদে ওঠে, একবার জানালার ধারে পা ঝুলিয়ে বসে , রান্নাঘরে মায়ের লুচি ভাজা দেখে, পুরোনো বইগুলো ঘাঁটে, হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খায় সময়টাকে  তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে ।   এটাও আমাদের মায়ের বাড়ি । আমরা  ঠিক এইরকম সময় কাটাতেই এসেছি ।এখন লাঞ্চ  খেতে যাব । সেদিক থেকে পুদুচেরিকে  খাদ্যরসিকদের স্বর্গ রাজ্য বললে খুব বেশি বলা হয় না ।ওই তো একরত্তি শহর । কিন্তু সবকিছুর জমজমাটি আয়োজন । শহর ভর্তি ক্যাফে আর রেস্তোরাঁ । ফরাসি ইটালিয়ান কন্টিনেন্টাল  মেডিটারেনিয়ান তামিল । Le club ,Le dupleix , Le Terrasse , Rendezvous ,আরো অনেক । 
 আশ্রম ছাড়িয়ে একটু ভিড়ভাট্টার রাস্তা মিশন  স্ট্রিট এখানে আমরা যাব রুফটপ রেস্তোরাঁ ডন জিওভানিতে ।
ওয়াইন আর ফলের রসে মজানো একগ্লাস সাংগ্রিয়া (sangria) আর  গরমাগরম সদ্য বানানো আভেনফ্রেশ পাতলা মুচমুচে পিৎজা  তার ওপর গলানো চিজ নিয়ে বেতের চেয়ারটায় বসা যাক ।


নিচে বয়ে চলেছে পন্ডিচেরির ব্যস্ত জীবন । এখানকার অন্দরসজ্জা একেবারেই পন্ডিচেরি টাইপ । আড়ম্বর নেই , আরামদায়ক , শান্ত ,মনজুড়োনো । কুল ক্যাজুয়াল স্টাইলিশ । মোতজারটের সুরের মায়াজাদুতে  তৈরি হয়েছিল ডন  জিওভানি অপেরা আর এইখানে ম্যাজিক দেখাতে আসছেন ইটালির খাঁটি বোলোনিজ রাঁধুনি  মাসিমিলানো মুরলী মরসিয়ানিসেই কবে ইটালি থেকে চলে এসে অরোভিলে বাস করছেন তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে । কিন্তু বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন ইটালির বোলোনা কে (Bologna)হাসি খুশি মোটা সোটা  গায়ে উল্কি আঁকা মাসিমিলানো যত্ন করে পাশে বসে অতিথিদের বিশুদ্ধ বোলোনিজ রান্না পরিবেশন করেন দাম একেবারে ঠিকঠাক। কোন কোন ডিশ নিজেই রান্না করে নিয়ে আসেন । আমরা বাঙালি কলকাতার লোক  জানতে পেরে গোলগাল চকচকে হাসি হাসি মুখে বলে ওঠেন মাছের ঝোল । সেকি তুমি স্প্যাঘেটি বোলোনিজ ছেড়ে মাছের ঝোল খাওয়াবে নাকি? আরে না না আমার বউ বাঙালি  
মাসিমিলানোর রেস্তোরাঁয় সবকিছু অরগ্যানিক । তাজা ।   পাস্তা পিৎজা স্প্যাঘেটি লাসানে । মাসিমিলানো জানিয়ে দিতে ভোলেন না  পাস্তা আসে খোদ ইটালি থেকে । নিজেই বানান জেলাতো আর তিরামিসু ।দেশের জন্য গভীর দরদ আর অসম্ভব ভাল রসবোধ মিশিয়ে খাবার বানান তিনি । তাই এটা নিছক খাবারের দোকান নয়, আরো অনেক বেশি কিছু ।






পন্ডিচেরি  শুধু খাদ্যররিক নয় ফ্যাশন পাগলদেরও  স্বর্গ রাজ্য শহরের প্রায় সব জায়গায়  বিশেষ করে হোয়াইট টাউনে ছোট বড় বুটিক ছড়িয়ে আছেগেলেই যে কিনতে হবে তার কোন মানে নেই । চোখের আরামও তো বটে । ফ্রেঞ্চরা প্রচুর বুটিক চালায় । তাদের মধ্যে  Cane lab design আর La maison rose  বেশ নাম করা   ফার্নিচার , জামা কাপড় , ঘর সাজানোর রকমারি  ,সুগন্ধি মোম , ধূপ সাবান শৌখিন কত সম্ভার হাই ডিজাইন ব্র্যান্ড তো এখানকার  রাস্তার ওপরেই  অরবিন্দ আশ্রমের অরোশিখা ধূপ  সুগন্ধি মোমবাতির  সুগন্ধি লন্ঠনের স্বপ্নজগত আশ্রমেরকটেজবাড়িতে তৈরি হয় অনেক  রকমের ধূপ  পাশ দিয়ে   যাবার সময় মাট্টিপাল , কেতকী ,পারিজাত , অম্বর   চন্দন ,নির্বাণ,অদিতি  সমস্ত ধূপের গন্ধ মিলেমিশে  একটা একটা ঝিমধরানো সুগন্ধ নাকে লেগে থাকে  অনেকক্ষণ   কটেজে একটা ছোট  ছাদ খোলা রেস্তোরাঁ আছে ।   এখানকার মিষ্টি খুব চমৎকার । বিশেষ করে কটেজের গোলাপজাম ।আর কাজুবাদামের টফি ।
পন্ডিচেরির সবকিছু কেমন যেন বেশি বেশি সুন্দর । যেন সুরুচি আর সৌন্দর্য দিয়ে একটা প্যাকেজিং করা হয়েছে ।  ছোট ছোট  ডিটেইল গুলো বাদ যাচ্ছে না । আর অর্কেস্ট্রা মাস্টারের মত কার অদৃশ্য আঙুল হেলানোয় এই মেলোডি দিনের পর দিন বছরের পর বছর এক ভাবে চলছে ? যিনি আড়ালে থেকেও  ভীষণ ভাবে স্পষ্ট “Friction de Foucaud” এই লোশনটি ব্যবহার করতেন তিনি ।  ইওরোপের গোলমেলে পরিস্থিতিতে ফ্রান্স থেকে সেটা আনানো মুশকিল হয়ে পড়ল । আশ্রমের Senteurs ল্যাবরেটরিতে প্যারিস থেকে রসদ পত্র নিয়ে অল্প অল্প করে কাজ শুরু হল । নিষ্ঠা আর শক্তি জোগালেন তিনি । আজ এই ল্যাবরেটরির “Fluers en flacon “বিপণন কেন্দ্রটি না ঘুরে এলে পন্ডিচেরির ভাল লাগা ষোলো আনা পাওয়া যাবে না কতো রকমের পারফিউম , কোলনলোশন, এসেন্সিয়াল অয়েল  , সাবান কতো রকমের প্রসাধনী সবটাই নিজেদের তৈরি গুণগত উৎকর্ষ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই    আর এতো রকমের সুগন্ধ যে হতে পারে তার কোন ধারনাই ছিল না এতো দিন  প্রত্যেকটি সুগন্ধির সঙ্গে নিবিড় যোগ শরীরের মনের এবং চেতনার   ওপিয়াম অর্থাৎ কিনা  আফিম মারাত্মক সুগন্ধ ডিফিউজারে গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে খালি সুইচটা টিপে দাও ঘরের মধ্যে আলো আঁধারি আর তুমি গন্ধ বিধুর সমীরণে মাথার জট খুলছ একটার পর একটা , কুন্ডলী পাকানো স্নায়ু গুলো স্নিগ্ধ হচ্ছে ,শান্ত হচ্ছে একটার পর একটা
আশ্রমের প্রত্যেকটি বিভাগ ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে । বাটিক, সিল্ক , হ্যান্ড মেড পেপার  ,তাঁত , সেলাই , ডেয়ারি ,আর্ট গ্যালারি , পাব্লিকেশন সেন্টার যার নাম “শব্দ”, ব্যুরো সেন্ট্রাল  সবই সবগুলোতেই সেই তিনটে সিল এসে পড়েছে –নিষ্ঠা নিপুণতা সৌন্দর্য ।
ইতিমধ্যে প্রমেনাদ বিচে সূর্য গলে পড়ে বিশাল ইম্প্রেশনিস্ট ক্যানভাস বানিয়ে ফেলেছে । প্লে গ্রাউন্ডের দিকে হেঁটে চলি ।
ক্যাফের টুনি বাতি গুলো জ্বলে উঠছে , ভেসে আসছে কফির কড়া গন্ধ । বাতাস উষ্ণ আর্দ্র । ঠান্ডা প্রায় পড়েই না ।গরমে অবশ্য জ্বালিয়ে মারে ।  সে দিক থেকে শীতকাল এখানে আসার ঠিক সময় । শীতে এখানে ফুরফুরে বসন্ত ।











শর্টস টি শার্ট ,বেশির ভাগ আশ্রমিকরা ছেলে  বুড়ো মেয়ে সবাই এই পোশাকই পরে । মেয়েরা অবশ্য  শাড়ি সালোয়ার কামিজও পরে বিশেষ বড়রা ,বয়স্করা ।প্লে গ্রাউন্ডে তিনি অনেকটা সময় কাটাতে ভাল বাসতেন । রীতিমত টেনিস খেলতেন ,তখন তাঁর বয়স প্রায় নব্বই ।শরীরকে সতেজ সুন্দর সুদৃঢ় করা ,তাকে সচেতন করা ,তার মধ্যে দিব্যচেতনাকে নামিয়ে আনা ।তাই শরীরচর্চার দিকে আশ্রমের এতটাই মনোযোগ । সত্তর আশি নব্বই এর বৃদ্ধদের শরীর চর্চা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয় ।  তিনি বলতেন বৃদ্ধ না হবার একমাত্র উপায় আন্তর চেতনাকে সমৃদ্ধ কর ।এখানকার দুটি বিশাল জিমনাসিয়াম ,তার সাজ সরঞ্জাম , আর যাকে বলে ডকুমেন্টেশন দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত । এত বড় ব্যায়ামাগার  আমি জানিনা আর কোথাও আছে কিনা ।ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও সমান তালে তৈরি হচ্ছে । জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশনের কোন বালাই নেই । তুমিও হাঁটতে শুরু কর সমুদ্রকে পাশে রেখে । ওদিকে আশ্রমের ডাইনিং হলে তখন ডিনার লাগল বলে । এত তাড়াতাড়ি? না ইচ্ছে হলে যাবার দরকার নেই । এ খাবার বড় বেশি স্বাস্থ্য সম্মত । পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন উচ্চ মানের  । কিন্তু ওই , একদিন খাবার পরেই মন বিদ্রোহ করতে পারে ।পন্ডিচেরিতে থাকার জায়গার কোন অভাব নেই । বিলাসবহুল থেকে সাধারণ সব রকম হোটেল গেস্ট হাউস , কোন কোন ফ্রেঞ্চ বাড়িতে হোম স্টে । আমার পছন্দ আশ্রমের গেস্টহাউস । অনেকগুলো গেস্ট হাউস এদের আছে । ভারি সুন্দর । তবে টিভি থাকবে না ।  খুব বিলাসিতা কিছু থাকবে না  আর রাত্রে নির্দিষ্ট সময়ে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে ।  কিন্তু আশ্রমের চৌহদ্দির মধ্যে থাকা যাবে । হেঁটে হেঁটেই সবকিছু দেখা হয়ে যাবে ।
শোনা যাবে সমুদ্রের গান ,বাতাসের সঙ্গত আর তারাদের করতালি ।আসরের মধ্যমণি হয়ে বসবে চাঁদ ,ভাগ্য ভাল থাকলে ।জলের গভীরে অনেক গভীরে নানকৌড়ি শঙ্খের দল নড়ে চড়ে বসবে ।আর তুমি সেই সিম্ফনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে ।
তবে হ্যাঁ ,পন্ডিচেরির জলে তো নামা যায় না । স্নান করা যায় না । তাতে কিন্তু জায়গাটার পরিচ্ছন্নতা অনেক বেশি রাখা গেছে বলে আমার ধারণা । পন্ডিচেরির কাছেই আছে চুন্নাম্বার বোট হাউস । তির বেগে বোট, ব্যাক ওয়াটারের জল ছিটিয়ে নামিয়ে দেবে প্যারাডাইস বিচে । সুন্দর পরিষ্কার  শান্ত তটভূমি ।  আনন্দ উচ্ছল ।এখানে স্নান করা যায় ।আর দশ কিলোমিটার দূরেই আছে অরোভিল ।বিশ্বমানবিকতার মহামিলন ক্ষেত্র ।






পন্ডিচেরির প্রাণকেন্দ্র শ্রী অরবিন্দ আশ্রম । শ্রীমা সেই রহস্যময়ী ঈশ্বরী এখানকার মূল চালিকা শক্তি । আশ্রমের নয় যেন পুরো শহরের ।আলিপুর বোমার মামলা এক বিপ্লবীকে রূপান্তরিত করেছিল ঋষিতে। গোপনে এখানে চলে আসেন অরবিন্দ ,শুরু হয় তার যোগ সাধনা ।তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক অনুগামী শিষ্য মন্ডলী ,এরা প্রায় সবাই ছিলেন এক একটি উজ্জ্বল রত্ন । নীরদবরণ ,দিলীপকুমার রায় ,অমলকিরণ ,নিশিকান্ত রায়চৌধুরী,চম্পকলাল , মাধব পন্ডিত বিদগ্ধ ,গুণী , প্রতিভাবান সব ব্যক্তিত্ব নিবিড় অধ্যাত্মসাধনায় মগ্ন ছিলেন তখন । অতিমানস সাধনায় শ্রী অরবিন্দ যখন সকলের অন্তরালে চলে গেলেন তখন বিপুল কর্মভার মাথায় তুলে নিলেন মা ।  মধুময়ী মা তখন সকলের হৃদয়ের রানি । কর্মব্যস্ত তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত ।  মায়ের অমিতশক্তি আশ্রমকে নিয়ে গেল আন্তর্জাতিক স্তরে ।
তুচ্ছতম কাজটির মধ্য দিয়েও বয়ে যাবে দৈব মাধ্বীধারা । দেবতা নেমে আসবেন প্রতিদিনের জীবনে । চেতনার রূপান্তর ।
মানুষের ঢল নামে আশ্রমে , প্রতিদিন ,সমাধিবেদীতে প্রণাম জানাতে আসে । এখানেই শায়িত আছেন শ্রী অরবিন্দ আর মা । Without him, I exist not; without me he is unmanifest .
এতটুকু তালভঙ্গ নেই , নেই কোন শব্দ । নীরবে ধূপ পুড়তে থাকে । গাছের ছায়ায় ঢাকা বেদী ঘিরে অগুন্তি মানুষ নীরবে বসে ।  সন্ধ্যা তখন গাঢ় হয়েছে ।  প্রার্থনা ধ্যান আত্মনিবেদনের নম্র উচ্চারণে স্নিগ্ধ পরিবেশ সব ক্লান্তি মুছে দেয় , সব ক্ষত ধুয়ে দেয় , সব বিষণ্ণতা মিলিয়ে গিয়ে জড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত ভাল লাগার রেশ  । মাথার ওপর ধূপের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠে , পাতা উড়ে  উড়ে এসে পড়ে সমাধির ওপর ।

“আসক্তি ও বৈরাগ্যের মাঝখানে এসে বসে

অচিন পাখিটি

সুখ আর দুঃখের সমদূরে,রোদ্দুরে ছায়ায়

সমুদ্রের চিঠি”


Au Revoir, Pondi. 


কবিতার লাইন নেওয়া হয়েছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং বাসুদেব দেবের থেকে