Thursday 18 May 2017

Fireflies in my head


নরসুন্দর আর সুন্দরীবানো
দিল্লি দাস্তান 

ছেচল্লিশ ডিগ্রি গরমে আমাদের মাথাই ঠিক থাকছে না তো বেচারি জোনাকিদের মিছে দোষ দিয়ে লাভ নেই । মাথার মধ্যে জোনাকিদের বাঁদরামি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো সেদিন । কাজেই অফিসের পর কোথায় বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা ঘোল খাব তা না করে সারথিকে বললাম , নীল গুম্বদ নিজামুদ্দিন চলো হে। নীল গুম্বদের  লাপিস লাজুলির মতো নীল টালির জলুস কমে গেছে । চারদিকে ধুলো ধোঁয়া গাড়ি আর মানুষের হল্লায় আমি স্পষ্ট শুনতে পেলুম সে রাস্তার পাগলগুলোর মতো বিড়বিড় করছে, আমায় কোথাও একটা রেখে আয় বাবা, কাবুলে, কান্দাহারে ,ফরঘানায় , সমরখন্দেওরে বাবা ,গরমে ধুলোয়   ঝালাপালা হয়ে গেলুম ।
জোনাকিরা চিড়বিড়িয়ে ওঠে,  প্রত্নস্বর শুনব...আইসক্রিম খাবো... বলে ঝান্ডা তুল্লে আমি ফা হিয়েন ইবন বতুতা এই সব নমস্য ব্যক্তিদের একটা নিকৃষ্টতম সুবিধেবাদী সাবধানী হিশেবি সংস্করণ হয়ে উঠি । বেলা ঢলে আসছে । বাতাসে  গরম হলকা  । আমি আপিসের ফরমাইশ খাটিয়ে ছেলেটাকে , ওরে চল তো আমার সঙ্গে যাবি । এই বলে কম্বল তক্তপোষ গুছিয়ে নিয়ে হুমায়ুন মকবারায় ঢুকে পড়েছি , টিকিটও কেটেছি এক গাদা দারোয়ান  চেঁচায় , কাঁহা যা রহে হ্যাঁয় ? অভি বন্ধ হোনেওয়ালা হ্যাঁয়,
টিকট কিউ দিয়া  আপকো?  ।  আমি বল্লুম, এই যাবো আর আসবো, সুরজ ঢলনে সে পহলেই । এই বলে  সেই  চড়নদারকে সঙ্গে নিয়ে হেই সামালো হেই সামালো করে হন্টন । দূর তো কম নয় গেট থেকে । হাঁটার জুতো জোড়া পরা নেই । আমি কি জানি ছাই আজ এখানে আসার বাই চাপবে?
হুমায়ুনের বিশাল মহিমময় মকবারা ছাড়িয়ে এক্কেবারে তার পিছপটে নিশানা লাগিয়ে চললাম । চড়নদার ভাবছে কি পাগল রে বাবা ? এতো বাহারি জায়গাটায় না ঢুকে কোন বন বাদাড়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে । আর আমি মনে মনে ভাবছি তোকে কি এমনি এমনি এনেছি বাপ? সন্ধে হয়ে যাচ্ছে , লোকজন কমে  আসছে , বদনামা শহর তোদের । আমাকে ফিরে যেতে হবে সুরজ ঢলনে সে পহলে ।

নাই কা  মকবরা  দূরে নীল গুম্বদ 


নিম গাছের পাতায় পাতায় জায়গাটা নিঝুম হয়ে আছে । কতগুলো পাখি ডাকছে, ঝটপট করে ডেরায় ফিরছে চড়নদার বলে এগুলো তোতা পাখি । তোতা নয় , আমার নিশানা তখন  নাপিত মানে নাই । মানে , নাই কা মকবরা । হুমায়ুনের মকবারার পিছনেই নাপিতের মকবরা । সে ভারি রহস্যময় । নাপিত ছিল এতো  গুরুত্বপূর্ণ যে তার একটা আলাদা মকবারা ঠিক সম্রাটের মকবারার পেছনেই বানাতে হবে । সম্রাট ছাড়া প্রধান প্রধান রাজপুরুষ আর  প্রভাবশালী দের অনেকেরই মকবারা আছে দিল্লিতে । সফদরজং , ঈশা খান , আব্দুল রহিম খান এ খানা , মাহাম আনঘা আরো অনেকেরই । তাবলে নাপিতের ? ছিমছাম লালচে স্যান্ড স্টোনের  ছোট্ট মকবারায় একাধিক সমাধি ।কোরানের লিপি আর তিনটে সঙ্খ্যা ৯৯৯। তার মানে হিজরা অনুযায়ী ১৫৯০- ৯১ সনে তৈরি ।তার মানে হুমায়ুন মকবারার কাজ  শেষ হবার বেশ কয়েক বছর পরে।
এটা কি মিশরীয় ফ্যারাওদের মত ব্যাপার যে প্রিয় মানুষজনকে নিয়ে বেহেস্তে যাব , এমন ঘটনা। সম্রাটের গলায় খুর ধরে যে লোকটা প্রতিদিন, সে তো যথেষ্টই ক্ষমতাবান । তার ওপর ষড়যন্ত্র খুন খারাবি তো লেগেই থাকত । জল্পনা কল্পনার কী কোন সীমা আছে । রঙিন ঘুড়ির মত  আকাশে উড়িয়ে দিলেই হল । কায়রোর  মিউজিয়ামে এক অল্পবয়সী রাজকুমারীর সঙ্গে তার আদরের বেবুনের মমিও স্বচক্ষে দেখে এসেছি ।
তবে আমাদের এ এস আই এর ইমরান সাহাব, আসিফ দেহেলভি এরা অনেক সময় বলেছে অনেক নাম না জানা মকবারার এরকম অদ্ভুত নামকরণ ইতিহাসে দেখা গেছে সফদর হাশমির ভাই সোহেল হাশমি একজন বিশিষ্ট হেরিটেজ  অ্যাক্টিভিস্ট । পন্ডিত মানুষ।  উনি একবার বলেছিলেন একই রকম কথা যে , এগুলো গপ্প ছাড়া আর কিছুই নয়। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে আবার রাজা ফিরে আসবে এবং তার প্রিয় সঙ্গী , জিনিসপত্র সব তার আবার দরকার হবে । এখানে কিন্তু এমনটা  নয় । তা যদি হত তাহলে হুমায়ুনের আদরের হাতি ঘোড়া গুলোর জন্যও গোরস্থান বানানো হত ।  তিনি মনে করেন ডোমের গঠন অনেকটা হুমায়ুনের আগের আমলেরকে জানে, হয়ত মকবারাটা আগে থেকেই ছিল ।  একটি অল্প বয়সী আর্কিটেক্ট মেয়ে আগা খান ট্রাস্টে কাজ করে । বিস্তর পড়াশুনো করতে হয় । ইতিহাস ভূগোল বটানি ফ্লোরা ফনা ,কী নেই! সেই নিকিতা  আমাকে বলল বাবরের সময় থেকেই নাকি ভাবা হয়েছিল , নাপিত যে সবচেয়ে মারাত্মক কাজ টা করে অর্থাৎ প্রতিদিন গলায় খুর ধরে সে যদি নিজেকে  পরম বিশ্বাসভাজন প্রমানিত করতে পারে  তাহলে তার মরার পরে একটা সমাধি বানিয়ে দেওয়া হবে । সেই রকম অনুগত বিশ্বাসভাজন ইতিহাসে উপেক্ষিত কোন নরসুন্দর থাকবে হয়তো বাবর হুমায়ুনের আমলে ।



নীল গুম্বদ 

চড়নদার জানতে চায় , এটা কি বটেক ? গল্পটা শোনার পর  খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, হাঁ উয়ো তো হোনাই চাহিয়ে  । রাজা এখানে থাকেন তাই নাপিতকে পাশেই রেখেছেন। দরকার মত ডেকে নেবেন আর কি!
আমিও ভাবলাম সূর্য ঢলছে , পাহারাদারদের বাঁশি ঘনঘন বাজছে । সম্রাট গোসল করার আগে নাই কে ডাকবেন । আমরা চলে যাই , সেটাই ভালো দেখাবে। সবার সামনে দাড়ি গোঁফ ছাঁটবেন , মাথায় চাম্পি বা মালিশ করবেন ,হামিদা বানু  নবরত্ন তেল এনে রেখেছেন । আমজনতার সামনে এগুলো কীভাবে করবেন হিন্দোস্তানের বাদশা ?





রাস্তায় ফেরার সময় হঠাত ই বেগমসাহেবার আংটি থেকে খসে পড়া খান কতক ছুটকো সুন্দর পাথর নিজামুদ্দিন বস্তির এককোনায় হুমায়ুন মকবারার একদম কাছেই আটকে পড়ে আছে দেখলাম । সুন্দর  ওয়ালা বুরজ , লক্কড় ওয়ালা বুরজ , সুন্দর ওয়ালা মহল । সি পি ডব্লিউ ডি ( এরা আবার এসব কাজও করে নাকি! ) আর আগা খান ট্রাস্টের উদ্যোগে পুরো বাগান মহলটির সংস্কার সাধন হচ্ছে । ভারি মনোরম , ভারি সুন্দর !  নতুন আবিষ্কার ।  যেন দিনের শেষে   হাম্মাম সেরে বাদশাহি মোহর দিলেন  বাদশাহ নামদার হুমায়ুন ,খালি হাতে ফিরিয়ে দিলেন না আম জনতাকে  



সুন্দর ওয়ালা বুর্জ 




লক্কড় ওয়ালা বুর্জ 


সুন্দর ওয়ালা মহল  এখন 
আগে (বই থেকে নেওয়া , নিকিতা দিলো )


এখানেই দেখা হল নিকিতার সঙ্গে । রেস্টোরেশনের কাজ খানা যে কী ভীষণ পরিশ্রমের সেই গল্পই শোনাচ্ছিল । মাটি চাপা পড়া পাঁচশো বছরের পুরোনো  পদ্ম পুকুর খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনল । মাটি কাঁকর বালি ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে সরিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকাজ আবার ফুটিয়ে তুলল । আমাকে বলল একটু এগিয়ে চলুন না, আরেকটা জিনিশ দেখাবো । আর যে পথ দিয়ে সে আমায় নিয়ে যাচ্ছিল সে এক গাছে গাছে ভরা মায়াবী পথ, কতো অজস্র পাখির ডাক , কতো রঙের প্রজাপতির বাহার । নিকিতা বলেছিল অনেক অনেক প্রজাতির পাখি আর প্রজাপতি এখানে দেখা যায় । ফুলগুলোর নামও সে গড়্গড়িয়ে বলে যাচ্ছিল। কোনটার কি রঙ, কখন ফোটে , কেমন গন্ধ । ওমা , পথের শেষে কী চমৎকার একখানা ছোট্ট চারকোনা ঘর । প্রায় জঙ্গলের মধ্যে । কতো শতাব্দী পেরিয়ে এলাম যেন । কাঠ চাঁপা ফুলে ছেয়ে আছে ছোট্ট ঘর । ধানি  রঙের শাড়ি  এসে বলবে এতো দেরি? কখন থেকে জল বাতাসা নিয়ে বসে আছি। 

 নিকিতা বলল , কোথাও আপনি এই ঘরটার উল্লেখ পাবেন না । এটাকে আমরা মুঘল প্যাভিলিয়ান বলি । ঘরখানা অনেকটা জামাল কামালির সমাধি ঘরের মতো দেখতে ।






এক পাথরের জালি 








নিকিতা বলতে থাকে , এখানে রেস্টোরেশনের কাজ যখন শুরু হল জায়গাটা ঘোর জঙ্গুলে ছিল । সাপ খোপ , পোকা মাকড় । কাজ করার জন্য জঙ্গল কিছুটা সাফাই করতে গিয়েই এই ছোট্ট সুন্দর ঘরটা খুঁজে পান আগা খান ট্রাস্টের সি ই ও রতীশ নন্দা । গাছে গাছে ডাল পাতায় ঢেকে ছিল সবটা ।চুবড়ির মতো ।  তারপরই রেস্টোরেশনের কথা ভাবা হয়  । চলুন সিপিডব্লিউ ডির বনশাই বাগান দেখবেন । আমি বললাম , না ভাই , যে মানুষের হাত দিয়ে এই স্বপ্নের মত মায়াবী  দুনিয়া পাঁচশো ছশো  বছর পর কোন জিয়ন কাঠির  মন্ত্রে ধীরে ধীরে  জেগে উঠছে সেই হাতে সৃষ্টির বিরুদ্ধে গিয়ে বেঁটে বেঁটে গাছ বানানোর কেরামতি আর দেখে কাজ নেই । চললাম । ভালো থেকো ।
ছবি সুপর্ণা দেব 

Wednesday 17 May 2017

গল্প নয় কিন্তু

  কাল খান  মার্কেট থেকে কী মিস্টি রঙের ওই বল টা কিনলাম , পছন্দ হল না মেয়ের । শোনো , তোমার ছেলেকে দিয়ে দেবো ।  কিচ্ছু কিনব না ওর জন্য আর  । “
“ ও তাই ?  সে ও লুফে নেবে , যা হ্যাংলা “।
“ তোমার ছেলেকে ডাক্তার দেখালে ? অসুখটা সারছে না কিন্তু। স্পেশালিস্ট দেখাও “।
“ হ্যাঁ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। ছুটিও নিচ্ছি কাল। সারাদিন ওর পেছনেই যাবে “। অতসী   চশমা মুছতে মুছতে বলে ।
“ এদিকে কি হয়েছে জানো ? আয়াটা এত্ত পাজি , ভালো করে খাওয়াচ্ছেই না । আমি কোন টা সামলাবো বল তো । বাড়ি না অফিস? এদিকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে । মিড টার্ম রিভিউ ।  বসের মুখ ভার । কোথায় যাই বলতো ? “ নন্দিতা বোধহয় কেঁদেই ফেলবে ।
“ আমারো সেই হাল । কাকে আর বলছ?  কলকাতার মাসি মণির তো মতিগতি বোঝাই দায় , এক কাঁড়ি টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছি । এই তুমি রাঁচি থেকে একটা লোক আনবে বলছিলে ? তার কি হল? তোমার মেয়েটা যা রোগা । ইশ , খুব যত্নের দরকার গো  “
“সত্যি, আমার না আজকাল আর কিচ্ছু ভালো লাগে না , উফ কবে যে একটা ঠিকমত কাজের লোক পাবো ? তোমার রনি তো দিব্যি ভালো ছেলে ।  কুটুস টা  যদি একটু  ভালো করে খাওয়া দাওয়া করত !  আবার এতো মা নেওটা না ? ঠিক বুঝতে পেরে যায় আমি বেরুবো , ব্যাস শুরু হয়ে যাবে নাকি  কান্না “।


ওপরের  এই টুকরো টাকরা কথাবার্তা দুই নারীর। দুই কর্মরতা নারীর । এদের দুজনেরি বদলির চাকরি । তাদের বরেরা  কেউই কোনরকম হ্যাপা পোহানোর জন্য দৃশ্যমানতার মধ্যে নেই  অর্থাৎ তাদের কর্মস্থল আলাদা আলাদা  । এই দুই নারী নিজের বাড়ি থেকে বহুদূর ।  ঊনকোটি পঞ্চাশ ঝামেলা নিয়ে তারা কালাতিপাত করে । দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিঃশ্বাস । ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর দেহ এবং মন । তবু তারই মধ্যে দুজনে একসঙ্গে বসে কোনো  একজনের ঘরে বসে  লাঞ্চ খায় ।  আনে ঝিঙে পোস্ত ,  সরোজিনী নগর থেকে বেছে বুছে কিনে আনা চুনো মাছের ঝাল , প্রচুর ধনে পাতা দেওয়া লাউ ঘন্ট , ছেঁচকি , আমের টক । শেষ পাতে পায়েস পায়েস না থাকলে  তারা বাটার স্কচ আইসক্রিম আনিয়ে  খায় ।  এখানে মিস্টি খেয়েও সুখ নেই  । দূর দূর , খেতেও শেখে নি ভালো করে  । আইস ক্রিম খেতে খেতেই আবার তারা  ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে  দুঃখের পাঁচালি শুরু করে । চারপাশের লোকজনের পাষাণ হৃদয় বেয়াক্কেলে হাবভাব বা অদ্ভুত হাস্যকর আচরণ তাদের ঘনঘন শিহরিত  করে । কি করে মানুষ এমন ধারা হয়? এইসব ভেবে টেবে  আইস ক্রিম শেষ হলে পরে দু কাপ দার্জিলিং চা খেয়ে তারা নিজের নিজের ঘরে চালান হয়ে যায় ।
আবার পরের দিন দইমাছ , কালোজিরে দিয়ে চচ্চড়ি , এঁচোড়ের ডালনা , সুজির পায়েস । আবার রনি আর কুটুসের গল্প ।রনি আর কুটুস । কুটুস আর রনি । একই  চাকা ঘুরে ঘুরে চলে । কুটুসের চোখ ছলছল , তো রনির বাঁদরামি । হোয়াটস অ্যাপে ছবি বদল । কখনো রনি ডিগবাজি খাচ্ছে, কখনো কুটুসের গলা জড়িয়ে নন্দিতা হামি খাচ্ছে ।



আমিও এই দলে আছি বটে । তবে খানিকটা গ্রিন রুমের মধ্যে ।  খাওয়া দাওয়াও করি  বটে তবে খুব একটা  পারটিসিপেট করতে পারিনা । মানে ওই রনি কুটুসের গপ্পে আমার কিছুই অবদান থাকে না । নন্দিতা  এবং অতসী  দুজনেই মাতৃত্বের কর্তব্যে হিমশিম । এই জায়গাটা তো তাদের নিজের জায়গা নয় । প্রতিদিন ই নতুন নতুন ঝামেলা লেগেই আছে । ছেলেপুলেরা তো মায়ের সঙ্গেই থাকবে । সেটাই স্বাভাবিক । এরই মধ্যে আজ বেসিনের কল দিয়ে জল পড়ছে না তো কাল রান্নাঘর ভেসে গেলো , পাইপের গ্যাস সাপ্লাই দুম করে বন্ধ হয়ে গেলো ,অত সাধের ট্যাঙরা মাছ গুলো  আয়াদিদি এক কাঁড়ি জল দিয়ে ফুটিয়ে ঘন্ট পাকিয়ে দিল এদিকে কুনাল দর্জি কিছুতেই  কামিজের  গলা ঠিক করে বানাতে পারে না । এখন নতুন দর্জি পাই কোথায় ? সমস্যা কি একটা ।  তার মধ্যে সব কটা লোক চূড়ান্ত  বিরক্তিকর । ড্রাইভারটার প্রত্যেকটা ছুটির দিনে বিয়ে বাড়ি থাকে । বিশ্বাস হয় ? প্যাট্রিয়ারকি,  প্যাট্রিয়ারকি  ঘোরতর পিতৃ তন্ত্র । আমরা ছেলে  হলে পারতিস এই ত্যাঁদড়ামি গুলো করতে ? বাচ্চাগুলোকে ছুটির দিন লোধি গার্ডেনে একটু বেড়াতে নিয়ে যাবো , তার উপায় নেই । 
কুটুস একটু লাজুক লাজুক। মুখচোরা । মানে ইন্ট্রোভারট আর কি । আমি দু একবার ওকে  বাড়ির সামনের পার্কে আয়ার সঙ্গে দেখেছি । একটু মিনমিনে টাইপ ।  সে তুলনায় রনি তো দামাল বিচ্ছু । এই সোফায় উঠছে , এই মেঝেতে গড়াচ্ছে , এই  ধুম করে পড়ে গেলো । এইসব লেগেই আছে । তারপর কনভেন্টে পড়েছে , কেতা দুরস্ত ।
কুটুসের হল কি, ওই বদলির চাকরির ঝকমারিতে মাদার ল্যাঙ্গয়েজ স্কুল রয়ে গেলো । এই বদলির ঝামেলার জন্যই   নন্দিতা  কুটুসের দাদা কাটুস কে মামাবাড়ি রেখে এসেছে । এছাড়া নন্দিতার  আর কোন উপায় ছিল না । কলকাতায় বাবা আপিসে বেরিয়ে গেলে কে দেখবে কাটুসকে ? আবার দুটো  বাচ্চার দায়িত্ব  এই নতুন জায়গায় কি ভাবে নন্দিতা  করবে ?একা একা ?  অগত্যা মামাবাড়ি ।



এরই মধ্যে আবার  ঢুকে পড়ে নতুন নতুন জামা খেলনা , মোবাইলে দুষ্টুমির নানা ছবি দুই মা বসেবসে দেখে আর বেগুন ভরতায় কলকাতা থেকে আনা রাঁধুনি মাসি কী আক্কেলে  চিনি মিশিয়ে দিল বলে খুব অবাক হয়ে যায় । বাইরে কার্নিশে দুটো পায়রা মজা দেখে আর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি গরমকে আরো তাতিয়ে দেয় জারুলের বেগনি রঙ । ভেতরের ঠান্ডা ঘরে তখন রনি আর  কুটুসের কথা সাবানের ফেনার বুদবুদের মতো দুই মায়ের মনকে স্বপ্নাবিষ্ট করে রাখে । গালে কপালে শাড়ির আঁচলে  পিছলে পিছলে পড়ে সন্তান স্নেহ ।
সেদিন নন্দিতা  খুব ব্যাজার মুখে আলুর দম খেতে খেতে বলল , কাটুসের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে । কত্তদিন ছেলেটাকে দেখি না । অতসী  বলল, একবার সময় করে দেখে এসো। ফোন তো করছই রোজ ।
না গো , খুব মনে হচ্ছে ক’দিন ধরে । দেখেই আসি ।
এই গরমে যাবে? তোমার এতো কাজের চাপ ?ভুবনেশ্বরে এখন খুব গরম কিন্তু ।
না চলেই যাই । আজকেই ফ্লাইট বুক করে ফেলি ।পয়সা বেশি লাগলেও কিচ্ছু করার নেই ।
পরের দিন আবার সেই ঘন্ট শাক ছেঁচকি বাটার স্কচ চা এবং রনি কুটুস পালাগান শেষ হলে নন্দিতা  বলল ‘আমি শনিবার যাচ্ছি , রোববার ফিরে আসব । ছেলেটাকে জাস্ট দেখেই ফিরে আসব । আয়াটার হাতে কুটুসকে   কি ভাবে রেখে যাবো বেশিদিন ? কাজেই যাবো আর আসব । আর তুমি খবর নেবে কিন্তু, অতসী তোমাকে কুটুস খুব পছন্দ করে ।
অতসী  আশ্বস্ত করল , কোন চিন্তা নেই । সাবধানে যেও । মারাত্মক গরম , জল টল বেশি করে খেও । চিন্তা করো না একদম ।আমি তো রইলামই ।  চিকেন স্টু রেঁধে দেবো ।


আমি সত্যিই ভাবি , কি রকম এই রকম ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এই মায়েদের জীবন ! চাকরি বদলি বাচ্চা তাদের হাজারো বায়না ,অসুখ । বর নামধারী সাপোর্ট সিস্টেম এখানে নাগালের বাইরে । এইসব ভেবে ভারি বিমর্ষ   মনে আমিও আমার ঘরে ফিরে আসি । আর ভাবি  বাড়ির পেছনের বারান্দার জাল টা ঠিক করতে হবে । পায়রা ঢুকে পড়ছে যখন তখন ।
নন্দিতার  ঝটিকা সফর শেষ হল । সোমবার খাবার সময় আমি বললাম, এবার শান্তি তো ? দেখা হল ? ছেলে কী বলল ?
“ আরে আর বলিস না ? দেখামাত্রই দুড়দাড় করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল । আর সে কি আদর !” নন্দিতার  চোখ চিক চিক , গলায় খুশির জল তরঙ্গ  
চলে আসার সময় কি করলি? কাঁদল না ?
লুকিয়ে এসেছি , বলতে পারিস পালিয়ে এসেছি । ল্যাংচা নিয়ে গেছিলাম। কাটুস খুব ভালবাসে । তোদের জন্যও ছানাপোড়া এনেছি ।
ছানাপোড়া প্লেটে তুলতে তুলতে নন্দিতা  বলল , ওদের মায়ের সঙ্গেও দেখা হল । ওই যে,  তুই যে বাড়িটায় থাকতিস তার পাশের  এক আই পি এস এর বাড়িতে  থাকে । বাড়িতে কেউ ছিল না ,বুঝলি আমি গেটের বাইরে থেকে ডাকলাম রকি রকি রকি   লক্ষ করলাম নন্দিতার  আওয়াজ টা তার সপ্তকের নি সা, নি সা , নি সা র  মতো শুনতে লাগলো ।
দৌড়ে এলো জানিস ? তারপর লনের মধ্যে লুটোপুটি , হুটোপুটি আদর দেখাচ্ছিল আমাকে ।  কি খুশি !কি খুশি!
ততোক্ষণে ন ন্দিতার  গলায় আমির খান সাহেবের পাল্টা মাপাধনি , নিধাপামা ,ধামাপানি, নিপামাধা পামাধানি
তারপরই গলা মন্দ্রস্বরে নামিয়ে বলল , তবে যত্ন খুব একটা হয় বলে মনে হয় না । ওই একটু সেফ থাকে , এই যা মনোরঞ্জন তো আমাকে সবই জানায় । কাটুসকে তো ভালই দেখভাল করছে ।  সেবার কি ভাবে ওকে রেখে এলাম  বল? ল্যাংচার মধ্যে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পাঁচশো কিলোমিটার গাড়িতে করে...।  
আমরা সবাই ছানাপোড়া শেষ করি ।  চা শেষ করি ।  আবার দেহ তুলে যে যার ঘরে ফিরে যাই । সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি  ভাবতে থাকি     The more you know people the more you love your dog

আর তখখুনি কাঁচের বাইরে  জারুলের ঘোর বেগনি রঙ আর পায়রা দুটো ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী পাখির মতো যেন বলে উঠলো , আরে ও দুটো তো  সামান্য কুকুর , গোটা বিশ্ব সংসার তালগোল পাকিয়ে যেত যদি ভালোবাসার এই নদীগুলো না থাকতো ! স্যালুট !




Saturday 6 May 2017

মৃগনয়নী


জু ,সখি ,মুহু মুহু গাহে পিক কুহুকুহু ,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু দোঁহার পানে চায় ...
অলকে ফুল কাঁপয়ি কপোলে পড়ে  ঝাঁপয়ি...

রাই নদীর ধারে গ্রাম । রুখাশুখা ।  বেশির ভাগ মানুষ   খেতখামারে কোনরকমে  চাষ বাস করে দিন কাটায় । বাকিরা যায় বনের রসদ জোগাড় করতে । ফল মূল কাঠ জড়িবুটি মধু মোম । জন্তু জানোয়ারও । সেই ছোটবেলা থেকেই জঙ্গলে জঙ্গলে মিশে আছে নিন্নি । বাপ মা নেই ।  আহা রে ,  কি বেচারা  হতভাগা রে , এই সব শোনার বাতিক নেই তার । নিন্নি জঙ্গলের মেয়ে । রাই নদীর জল আর গ্রামের মাটি  মেখে মেখে বড় হয়েছে সে । হরিণের পিছনে পিছনে ছোটে , ময়ুরের সঙ্গে নাচে । তার খোলা চুলে বুনো ফুল উড়ে উড়ে এসে পড়ে ,ঘামে লেপটে গিয়ে মুখে আটকে যায় । কানের কাছে ভোমরা ডাকে । প্রজাপতি খোঁপার বাহার হয়ে বসে ।  নিন্নির নিশানা চোস্ত । এক তিরে ঘায়েল করে দেয় দুষ্টু জন্তুকে ।  খ্যাপা মোষের শিং ধরে  তাকে থামিয়ে দেয় । রাই নদীর ধারে গ্রাম । রুখা শুখা । সেই গ্রামের মাটি জলে তেতে পুড়ে হরিণের মতো চোখের সেই ডাগর মেয়ে ভয় কাকে বলে জানেই না ।
গ্রামের কিনারে যেখান দিয়ে নদী বয়ে গেছে সেদিক বরাবর পুব আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় আকাশ ফুঁড়ে এক বিশাল দৈত্যের মতো , না,  না এক অতি সুন্দর বলিষ্ঠ রাজার মতো দুই হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের রাজার কেল্লা । রোদ্দুর পড়লে যেন চোখ ঝলসে যায় , এতো তার দেমাক  । হোলিতে ফাগ ওড়ে , দেওয়ালিতে সারা কেল্লা আলোয় আলোয় ঝলমল । নিন্নি তার হরিণ চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখে । শুধুই দেখে । আর দেখে ঘোড়সওয়ার ধুলো উড়িয়ে  পতাকা দুলিয়ে খটখট করে তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যায় । রাজার রানিরা সব মহলের মধ্যেই থাকে । তারা বেরোয় না । কেউ তাদের দেখেও নি কোনোদিন ।
গ্রামের বড়রা সবাই বলাবলি করে , সময়টা নাকি ভালো নয় । ম্লেচ্ছ রাজারা নাকি সব লুটে নিতে চায় । এই কেল্লার ওপরে তাদের নাকি বেজায় লোভ । তবে তোমর রাজার হিম্মত আছে । তিনি কিছুতেই মাথা নোয়াতে রাজি নন ।  রাজাকে যদিও নিন্নি কোনদিন দেখে নি , তবে সবাই বলে দারুণ তাদের রাজা । শুধুই তলোয়ার চালান না , গান বাজনাও করেন ।
বাইরে থেকে আসা ওই লোকগুলো তাদের গ্রামের চারদিকেও ঘুরঘুর করে ।অদ্ভুত পোশাক, মুখের ভাষাও আলাদা ।  এই গ্রামের তার বয়সী অনেক মেয়ে , অনেকে আবার তার সখিও , ঝপাঝপ বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে গেল ।  সময়টা নাকি ভালো নয় । তারা গুজ্জর জাত । নিচু জাত বলে সবাই ।  পেটানো সুন্দর চেহারা তাদের  । নিন্নিকে সবাই বলে সে নাকি ভয়ানক সুন্দর । সে অতশত জানেনা ।   শুধু একদিন বিকেলের শেষ আলোয় রাই নদীর স্থির জলে নিন্নি নিজের ছায়া দেখেছিল , জলে ছায়া পড়েছিল দুটো দীঘল কালো চোখের , সেটা তার না   তার  পোষা বনের ওই হরিণ টার , নিন্নি বোঝেনি ।
গ্রামের মাতব্বর রাও বাপ মা মরা এই মেয়েটাকে বলে  “,ওরে নিন্নি একটু বুঝে শুনে চলিস । সময়টা বেশ খারাপ ।গ্রামের সুন্দরী ডাগর মেয়েদের খবর সব কোথায় কোথায় চলে যায়, জানিস তো ? এই তো সেদিন...“এমন কতো কথা কানে আসে ।
তবে তাকে সবাই একটু সমীহও করে । নিন্নিতো ডাকাবুকো , ভয় কাকে বলে জানেই না । এক তিরে ঘায়েল করে দেয় বুনো জন্তুকে । দামাল ষাঁড়ের শিং ধরে থামিয়ে দেয় । রাই নদীর ধারে গ্রাম । রুখাশুখা ।
কেমন করে সেই দামালপনার খবর পৌঁছে গেলো রাজার কেল্লায় ।  মানসিং তোমর সত্যই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন সেই মেয়েকে দেখতে যে “ মাথার পরে দেয় নি তুলে বাস/ লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ “ ।




পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয়ে  প্রণয় কুসুম রাশ,
হরিণ নেত্রে বিমল হাস, কুঞ্জবনমে আও লো।।

অবকাশ জুটেই গেলো । ওইরকমই এক মহিষ মর্দিনী অবস্থায় বনের ধারে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে নিন্নির সঙ্গে দেখা হল রাজার । রাজা মুগ্ধ হয়ে গেলেন শক্তি সাহস আর সৌন্দর্যের এক অনুপম মিশেল দেখে । বললেন , মৃগনয়নী ,তুমি আমার রানি হবে?
নিন্নি ভারি অবাক হয়ে  গেলো । রাজা বলে কি ? তারা গুজ্জর , ছোটো জাত ।  কিন্তু ঘাবড়ে যেতে সে রাজি নয় । মুখে বলল
“থাকবো কোথায় ?”
“কেন ? আমার প্রাসাদে ? ওই যে দেখা যাচ্ছে আমার কেল্লা , ওই যে নিশান উড়ছে । সেখানে তোমার মহল হবে “
“ না , না ওই অত দূরে আমি যাবোই না শুনেছি ওখানে বড়ই কড়াকড়ি । আমার দম আটকে যাবে যে

কেল্লার ভেতর 

হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে ,কন্ঠে শুখাওল  মালা ।
বিরহ বিষে দহি বহি গল রয়নি ...।

রাজার মন ভেঙে গেলো । এতো দূর ছুটে এসেছেন  মৃগনয়নীর জন্য। অনেক মান ভঞ্জনের পর নিন্নি বলে ,
“ বিয়ে করবো তোমায় । কিন্তু আমার তিনটে শর্ত আছে ।“
“বলে দেখোই না আমাকে , কী তোমার শর্ত “।
“রাজা , আমি তোমার বাকি রানিদের সঙ্গে থাকতে পারবো না । শুনেছি তারা সব কোন অন্দরমহলে থাকে । তারা বাইরে আসে না । জালের ভেতর দিয়ে যেটুকু দেখা যায় , দেখে । গাঁয়ের কেউ কেউ বলে তারা কেশর জলে চান করে, দোলনায় দোলে , সবই কোন গোপন মহলে , কেউ তা জানতে পারে না । আমার খোলা মহল চাই , যার আঙিনায় রোদ ঝলসে উঠবে , মেঘ  বৃষ্টি ঝামড়ে পড়বে , শিশির জমে থাকবে , আমের বোল খসে খসে পড়বে , ময়ূর উড়ে বেড়াবে , এমনটাই চাই । দেবে?”
‘’দেবো , আর দুটো  বলে ফেলো”।
“ এই যে নদী দেখছ, এর জল খেয়ে আমি বড় হয়েছি । তাইতো এতো তাকত আমার । এই নদীর জল আমার মহল অবধি আসবে । আর শেষের টা   হল , আমি ওইসব ঘোমটা পরে আড়ালে আবডালে জালের পেছনে লুকিয়ে  থাকতে পারবো না । দেখছই তো আমরা গাঁয়ের  মানুষ রা কেমন থাকি ! রাজা, আমি তোমার সঙ্গে সব জায়গায় যাবো , এমনকি যুদ্ধেও , এবার  বল , রাজি ?”
রাজা একটু দোনোমনা দোনোমনা করে রাজি হয়ে গেলেন ।কারণ ততক্ষণে মৃগ নয়নী  রসিকমোহিনী,  তার হৃদয় হরনী হয়ে গেছে ।

সুন্দরি সিন্দুর দেকে সীঁথি করহ রাঙিয়া..
সহচরি সব নাচ নাচ মিলনগীত গাও রে
চঞ্চল মঞ্জীররাব কুঞ্জ গগন ছাও রে
মল্লিকা চামেলি বেলি কুসুম তুলহ বালিকা
গাঁথ যূথি ,গাঁথ জাতি, গাঁথ বকুলমালিকা

মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেলো । মাটি থেকে তিনশো মিটার উঁচুতে যদি গোয়ালিওর দুর্গ হয় তবে তার সানুদেশে বানানো হল  গুর্জর মহল । গুর্জর কন্যা মৃগনয়নীর জন্য । কৌশলী কারিগরিতে  নদীর জল বয়ে এলো মহলে । সত্যই  সেই মহলে কোন ঘোমটা নেই । আঙিনায় ময়ূর চরে বেড়ায় , ফুল পাতা খসে খসে এসে পড়ে । সকালে রোদের আলোয় ঝলমল করে, সারাদিন তেতে পুড়ে আবার সন্ধে বেলায় ঠান্ডা হয় । সব উড়িয়ে ধুলো ঝড় মাখে । সকালে পুব আকাশে জ্বল জ্বল করে শুকতারা তার মাথার ওপর । মৃগনয়নীর জীবনেও এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় । রুখাশুখা গ্রামের মেয়ে সে । বেঁচে থাকার মানে সে জানে ।  রাজাকে তার কর্তব্য মনে করিয়ে দেয় । শর্তই ছিল যে সবসময় রাজার পাশে পাশে থাকবে । অন্দরমহলে নয় ।
ইতিহাসে কতো জল মিশে যায়  । অনেকেই বলে সে ছিল নিচু জাতের । তোমর বংশের সঙ্গে এই বিয়ে সমাজ তো মেনে নেয় নি । তাই তাকে এক ঘর করে কেল্লার বাইরে রাখা হয়ে ছিল । রাজার বাকি আট জন রানি তার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখত না ।
মৃগনয়নী খুব মন দিয়ে গান শিখে ছিল । খুব ভালো গাইত সে ।  তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামীর কাছে তার তালিম । ওদিকে দুর্গ প্রাসাদে রানিরাও জাফরির মধ্যে বসে গান শিখত ।  আর মৃগ নয়নী এক পিঠ খোলা চুল নিয়ে  উঠোনে বসে গান ধরতো, তখন অমল তাসের হলুদ ফুল তার চুল পোশাক সব রাঙিয়ে দিত ।
ঢালে কুসুম সুরভভার,ঢালে বিহগসুরবসার
ঢালে ইন্দু অমৃতধার বিমল রজতভাতি রে ...


খোলামেলা গুর্জর মহল , এখন এ এস আই এর মিউজিয়াম , কেল্লা থেকে তোলা 


রানিদের ঘুলঘুলি 



আরো ঘুলঘুলি 

তিন তিন দুই মোট আট টা জাফরির মধ্যে বসে আট রানি গান শিখত  

 ৫

সুজনক পীরিতি নৌতুন নিতি নিতি,নহি টুটে জীবনমরণে ।।

মানসিং আর মৃগ নয়নীর প্রেমগাথা ইতিহাস খ্যাত । দেশে কালে এমন অনেক অনেক কাহিনি আছে ।
তখনও মুঘল শাসন শুরু হয় নি । ইব্রাহিম লোধি দিল্লির তখতে । গোয়ালিওর দুর্গ দখল করতে জান লড়িয়ে দিচ্ছেন ।
এদের প্রেম কথা আভাস নিয়ে আসে রানাদিল আর দারা শিকোহ র মোহব্বতের । রানাদিল , যে  অনাথ মেয়েটি তানসেনের ছেলে বিলাস খানের স্নেহ ধন্য ছিল ভাগ্য বিপাকে  হয়ে পড়ে  স্রেফ  রাস্তার নাচিয়ে ।  মহলের আদবকায়দায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো । দারার সঙ্গে বিয়ের পর রানাদিলও আলাদা মহলেই থাকত , আগ্রায় । তারা ভরা  খোলা আকাশের  নিচে আশিকের হাত ধরে উধাও হতে চেয়েছে কতবার ।
কেল্লা রক্ষা করতে পারেন নি  মানসিং তোমর । তার আট রানি চন্দন কাঠের চিতায় আত্মাহুতি দিয়ে জহর ব্রত পালন করেছিল । তখন কেল্লা থেকে দূরে যুদ্ধ ভূমির রক্তে মৃগনয়নী নিন্নি আর মানসিংহের নিথর দেহে  কোনো এক ভানুসিংহ সুর ঝরিয়েছিলেন
“কতো নরনারীক মিলন টুটাওত , ডারত বিরহ হুতাশে” ।