নরসুন্দর আর সুন্দরীবানো
দিল্লি দাস্তান
দিল্লি দাস্তান
ছেচল্লিশ ডিগ্রি গরমে আমাদের
মাথাই ঠিক থাকছে না তো বেচারি জোনাকিদের মিছে দোষ দিয়ে লাভ নেই । মাথার মধ্যে
জোনাকিদের বাঁদরামি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো সেদিন । কাজেই অফিসের পর কোথায় বাড়ি
গিয়ে ঠান্ডা ঘোল খাব তা না করে সারথিকে বললাম , নীল গুম্বদ নিজামুদ্দিন চলো হে।
নীল গুম্বদের লাপিস লাজুলির মতো নীল টালির
জলুস কমে গেছে । চারদিকে ধুলো ধোঁয়া গাড়ি আর মানুষের হল্লায় আমি স্পষ্ট শুনতে
পেলুম সে রাস্তার পাগলগুলোর মতো বিড়বিড় করছে, আমায় কোথাও একটা রেখে আয় বাবা,
কাবুলে, কান্দাহারে ,ফরঘানায় , সমরখন্দে । ওরে বাবা ,গরমে ধুলোয় ঝালাপালা হয়ে গেলুম ।
জোনাকিরা চিড়বিড়িয়ে ওঠে, প্রত্নস্বর
শুনব...আইসক্রিম খাবো... বলে ঝান্ডা তুল্লে আমি ফা হিয়েন ইবন বতুতা এই সব নমস্য
ব্যক্তিদের একটা নিকৃষ্টতম সুবিধেবাদী সাবধানী হিশেবি সংস্করণ হয়ে উঠি । বেলা ঢলে
আসছে । বাতাসে গরম হলকা । আমি আপিসের ফরমাইশ খাটিয়ে ছেলেটাকে , ওরে চল
তো আমার সঙ্গে যাবি । এই বলে কম্বল তক্তপোষ গুছিয়ে নিয়ে হুমায়ুন মকবারায় ঢুকে
পড়েছি , টিকিটও কেটেছি । এক
গাদা দারোয়ান চেঁচায় , কাঁহা যা রহে হ্যাঁয় ? অভি বন্ধ হোনেওয়ালা হ্যাঁয়,
টিকট
কিউ দিয়া আপকো? । আমি বল্লুম, এই যাবো আর আসবো, সুরজ ঢলনে সে পহলেই । এই
বলে সেই চড়নদারকে সঙ্গে নিয়ে হেই সামালো হেই সামালো করে
হন্টন । দূর তো কম নয় গেট থেকে । হাঁটার জুতো জোড়া পরা নেই । আমি কি জানি ছাই আজ
এখানে আসার বাই চাপবে?
হুমায়ুনের বিশাল মহিমময় মকবারা ছাড়িয়ে এক্কেবারে তার পিছপটে নিশানা লাগিয়ে
চললাম । চড়নদার ভাবছে কি পাগল রে বাবা ? এতো বাহারি জায়গাটায় না ঢুকে কোন বন
বাদাড়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে । আর আমি মনে মনে ভাবছি তোকে কি এমনি এমনি এনেছি বাপ? সন্ধে
হয়ে যাচ্ছে , লোকজন কমে আসছে , বদনামা শহর তোদের । আমাকে ফিরে যেতে হবে সুরজ ঢলনে
সে পহলে ।
নাই কা মকবরা দূরে নীল গুম্বদ |
নিম গাছের পাতায় পাতায় জায়গাটা নিঝুম হয়ে আছে । কতগুলো পাখি ডাকছে, ঝটপট করে
ডেরায় ফিরছে । চড়নদার বলে এগুলো
তোতা পাখি । তোতা নয় , আমার
নিশানা তখন নাপিত মানে নাই । মানে , নাই
কা মকবরা । হুমায়ুনের মকবারার পিছনেই নাপিতের মকবরা । সে ভারি রহস্যময় । নাপিত ছিল
এতো গুরুত্বপূর্ণ যে তার একটা আলাদা
মকবারা ঠিক সম্রাটের মকবারার পেছনেই বানাতে হবে । সম্রাট ছাড়া প্রধান প্রধান
রাজপুরুষ আর প্রভাবশালী দের অনেকেরই
মকবারা আছে দিল্লিতে । সফদরজং , ঈশা খান , আব্দুল রহিম খান এ খানা , মাহাম আনঘা আরো
অনেকেরই । তাবলে নাপিতের ? ছিমছাম লালচে স্যান্ড স্টোনের ছোট্ট মকবারায় একাধিক সমাধি ।কোরানের লিপি আর
তিনটে সঙ্খ্যা ৯৯৯। তার মানে হিজরা অনুযায়ী ১৫৯০- ৯১ সনে তৈরি ।তার মানে হুমায়ুন
মকবারার কাজ শেষ হবার বেশ কয়েক বছর পরে।
এটা কি মিশরীয় ফ্যারাওদের মত ব্যাপার যে প্রিয় মানুষজনকে নিয়ে বেহেস্তে যাব , এমন
ঘটনা। সম্রাটের গলায় খুর ধরে যে লোকটা প্রতিদিন, সে তো যথেষ্টই ক্ষমতাবান । তার
ওপর ষড়যন্ত্র খুন খারাবি তো লেগেই থাকত । জল্পনা কল্পনার কী কোন সীমা আছে । রঙিন
ঘুড়ির মত আকাশে উড়িয়ে দিলেই হল । কায়রোর মিউজিয়ামে এক অল্পবয়সী রাজকুমারীর সঙ্গে তার আদরের
বেবুনের মমিও স্বচক্ষে দেখে এসেছি ।
তবে আমাদের এ এস আই এর ইমরান সাহাব, আসিফ দেহেলভি এরা অনেক সময় বলেছে অনেক নাম
না জানা মকবারার এরকম অদ্ভুত নামকরণ ইতিহাসে দেখা গেছে । সফদর হাশমির ভাই সোহেল হাশমি একজন বিশিষ্ট হেরিটেজ অ্যাক্টিভিস্ট ।
পন্ডিত মানুষ। উনি একবার বলেছিলেন একই রকম
কথা যে , এগুলো গপ্প ছাড়া আর কিছুই নয়। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে আবার রাজা ফিরে
আসবে এবং তার প্রিয় সঙ্গী , জিনিসপত্র সব তার আবার দরকার হবে । এখানে কিন্তু
এমনটা নয় । তা যদি হত তাহলে হুমায়ুনের
আদরের হাতি ঘোড়া গুলোর জন্যও গোরস্থান বানানো হত । তিনি মনে করেন ডোমের গঠন অনেকটা হুমায়ুনের আগের
আমলের। কে জানে, হয়ত মকবারাটা আগে থেকেই ছিল । একটি অল্প বয়সী আর্কিটেক্ট মেয়ে আগা খান
ট্রাস্টে কাজ করে । বিস্তর পড়াশুনো করতে হয় । ইতিহাস ভূগোল বটানি ফ্লোরা ফনা ,কী নেই!
সেই নিকিতা আমাকে বলল বাবরের সময় থেকেই
নাকি ভাবা হয়েছিল , নাপিত যে সবচেয়ে মারাত্মক কাজ টা করে অর্থাৎ প্রতিদিন গলায় খুর
ধরে সে যদি নিজেকে পরম বিশ্বাসভাজন
প্রমানিত করতে পারে তাহলে তার মরার পরে
একটা সমাধি বানিয়ে দেওয়া হবে । সেই রকম অনুগত বিশ্বাসভাজন ইতিহাসে উপেক্ষিত কোন নরসুন্দর
থাকবে হয়তো বাবর হুমায়ুনের আমলে ।
চড়নদার জানতে চায় , এটা কি বটেক ? গল্পটা শোনার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, হাঁ উয়ো তো হোনাই
চাহিয়ে । রাজা এখানে থাকেন তাই নাপিতকে
পাশেই রেখেছেন। দরকার মত ডেকে নেবেন আর কি!
আমিও ভাবলাম সূর্য ঢলছে , পাহারাদারদের বাঁশি ঘনঘন বাজছে । সম্রাট গোসল করার
আগে নাই কে ডাকবেন । আমরা চলে যাই , সেটাই ভালো দেখাবে। সবার সামনে দাড়ি গোঁফ
ছাঁটবেন , মাথায় চাম্পি বা মালিশ করবেন ,হামিদা বানু নবরত্ন তেল এনে রেখেছেন । আমজনতার সামনে এগুলো
কীভাবে করবেন হিন্দোস্তানের বাদশা ?
২
রাস্তায় ফেরার সময় হঠাত ই বেগমসাহেবার আংটি থেকে খসে পড়া খান কতক ছুটকো সুন্দর
পাথর নিজামুদ্দিন বস্তির এককোনায় হুমায়ুন মকবারার একদম কাছেই আটকে পড়ে আছে দেখলাম
। সুন্দর ওয়ালা বুরজ , লক্কড় ওয়ালা বুরজ ,
সুন্দর ওয়ালা মহল । সি পি ডব্লিউ ডি ( এরা আবার এসব কাজও করে নাকি! ) আর আগা খান ট্রাস্টের উদ্যোগে
পুরো বাগান মহলটির সংস্কার সাধন হচ্ছে । ভারি মনোরম , ভারি সুন্দর ! নতুন আবিষ্কার । যেন দিনের শেষে
হাম্মাম সেরে বাদশাহি মোহর দিলেন বাদশাহ নামদার হুমায়ুন ,খালি
হাতে ফিরিয়ে দিলেন না আম জনতাকে ।
৩
এখানেই দেখা হল নিকিতার সঙ্গে । রেস্টোরেশনের কাজ খানা যে কী ভীষণ পরিশ্রমের সেই
গল্পই শোনাচ্ছিল । মাটি চাপা পড়া পাঁচশো বছরের পুরোনো পদ্ম পুকুর খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনল । মাটি
কাঁকর বালি ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে সরিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকাজ আবার ফুটিয়ে তুলল । আমাকে
বলল একটু এগিয়ে চলুন না, আরেকটা জিনিশ দেখাবো । আর যে পথ দিয়ে সে আমায় নিয়ে
যাচ্ছিল সে এক গাছে গাছে ভরা মায়াবী পথ, কতো অজস্র পাখির ডাক , কতো রঙের প্রজাপতির
বাহার । নিকিতা বলেছিল অনেক অনেক প্রজাতির পাখি আর প্রজাপতি এখানে দেখা যায় ।
ফুলগুলোর নামও সে গড়্গড়িয়ে বলে যাচ্ছিল। কোনটার কি রঙ, কখন ফোটে , কেমন গন্ধ । ওমা
, পথের শেষে কী চমৎকার একখানা ছোট্ট চারকোনা ঘর । প্রায় জঙ্গলের মধ্যে । কতো
শতাব্দী পেরিয়ে এলাম যেন । কাঠ চাঁপা ফুলে ছেয়ে আছে ছোট্ট ঘর । ধানি রঙের শাড়ি এসে বলবে এতো দেরি? কখন থেকে জল বাতাসা নিয়ে বসে আছি।
নিকিতা বলল , কোথাও আপনি এই ঘরটার উল্লেখ পাবেন না । এটাকে আমরা মুঘল প্যাভিলিয়ান বলি । ঘরখানা অনেকটা জামাল কামালির সমাধি ঘরের মতো দেখতে ।
নিকিতা বলল , কোথাও আপনি এই ঘরটার উল্লেখ পাবেন না । এটাকে আমরা মুঘল প্যাভিলিয়ান বলি । ঘরখানা অনেকটা জামাল কামালির সমাধি ঘরের মতো দেখতে ।
নিকিতা বলতে থাকে , এখানে রেস্টোরেশনের কাজ যখন শুরু হল জায়গাটা ঘোর জঙ্গুলে
ছিল । সাপ খোপ , পোকা মাকড় । কাজ করার জন্য জঙ্গল কিছুটা সাফাই করতে গিয়েই এই ছোট্ট
সুন্দর ঘরটা খুঁজে পান আগা খান ট্রাস্টের সি ই ও রতীশ নন্দা । গাছে গাছে ডাল পাতায়
ঢেকে ছিল সবটা ।চুবড়ির মতো । তারপরই
রেস্টোরেশনের কথা ভাবা হয় । চলুন সিপিডব্লিউ
ডির বনশাই বাগান দেখবেন । আমি বললাম , না ভাই , যে মানুষের হাত দিয়ে এই স্বপ্নের
মত মায়াবী দুনিয়া পাঁচশো ছশো বছর পর কোন জিয়ন কাঠির মন্ত্রে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে সেই হাতে সৃষ্টির বিরুদ্ধে গিয়ে বেঁটে
বেঁটে গাছ বানানোর কেরামতি আর দেখে কাজ নেই । চললাম । ভালো থেকো ।
ছবি সুপর্ণা দেব
ছবি সুপর্ণা দেব