Friday 28 February 2020

বিনি পয়সার ভোজ


পুবের মিঠে রোদ গাছপালার মাথায় আলতো ভাবে ঝিলমিলিয়ে ওঠার পর মহারাজ সেদিকে মাথা নুইয়ে প্রণাম করেন । মহারাজ নামটা অবশ্য আমিই দিয়েছি । সকালের পর সকাল, দিনের পর দিন , ওনার জীবনযাপনের ঝলক দেখে আমার মহারাজ নামটাই মনে ধরেছে  । শুধু সূর্যদেব নয় , আমার সঙ্গে  চোখা চোখি হলেও মহারাজের হাতদুটো জড়ো হয়ে যায় । পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি গরমের তন্দুর   শুরু হবার আগে সময়টা বেশ কিছুক্ষণ মনোরম থাকে ।  সকালবেলায়  চারপাশে যে সব ছবি দেখা যায় সাঁঝের বেলা তারা কোথায় উবে যায় , সব কেমন অচেনা লাগে । বাড়ি থেকে বেরিয়েই প্রথমেই মহারাজের দর্শন । বিরাট এক বুড়ো পিপুল গাছের তলায় মহারাজের ডেরা । গাছের নিচে ছোট একখানা সাধুর মূর্তি বসানো মহারাজের গুরু ।  মহারাজ সবসময় সাদা জামা কাপড় পরেন । টেনিসকোরটের রেলিং ঘেঁসে  ওনার প্রাসাদ ।  এক খানা ছোট্ট চৌকি নিয়ে এক রত্তি জায়গা কোনমতে ঘেরা । পিপুল গাছের তলায় গৌতম বুদ্ধকে সুজাতা যেমন পায়েস খাইয়েছিল মহারাজকেও তেমনি কেউ না কেউ খাবার জোটায় বলে আমার ধারনা । আমি চায়ের কাপ আর ফ্লাস্ক দেখতে পেয়েছি ।
মহারাজ সাদা পাগড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে রাখেন । আর সামনে হুঁকোটি পরিপাটি সাজানো  থাকে । মহারাজ আর টেনিসবলের ঠোকাঠুকি আর তাদের বিচিত্র উল্লাসধ্বনিকে কে পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করি । দিল্লি দুধ সাপ্লাই এর দোকানের ঝাঁপ সবে খুলেছে । ভৃত্যের দল বিচিত্র দর্শন  রাজকীয় সারমেয়দের প্রাত ভ্রমণ এবং কৃত্যাদির জন্য নিয়ে বেরিয়েছে আর তাদের দেখে  নানান কটু কাটব্য,  মন্তব্য ছুঁড়ে মারছে রাস্তার যত অসভ্য লোফার কুকুরের দল ।
কুকুর থেকে বরাবরই আমি নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পছন্দ করি । রাস্তা এখনো ভারি শান্ত , ঝিরঝিরে হাওয়া আর তিরতিরে রোদ , অমলতাস ফুল ঝরে ঝরে রাস্তা হলুদ হয়ে গেছে , নাকে নিমফুলের গন্ধ আসছে , একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে বাবা আর ছোট্টখোকা । বাবার পিঠে খোকার বোঁচকা , বাবা পুরোদস্তুর তৈরি, হাঁটবার জন্য । খোকার চোখে ঘুমের এঁটুলি পোকা । খোকার স্কুলবাস এখোনো আসে নি । পাশ কাটিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলাম , বাবা বলছে ঘুমের এঁটুলিকে, “তুমহারে পাস তিন রুপিয়া, মুন্নিকে পাস পাঁচ আউর পাপ্পুকে পাস চার , তো বোলো বেটা কিতনা হুয়া?” আমার এইসা রাগ হোল । পাশ দিয়ে কাঠবিড়ালি ছুট মারছে , বাতাস চুলে বিলি কাটছে,  নিম আর আমলতাস পর্যন্ত টুপটাপ ফুল ঝরিয়ে দিচ্ছে আদর করে, আর এই তোর শুভঙ্করীর আঁক শেখানোর সময় ? পাশ কাটিয়ে বাঁক ঘুরে দেখি আরেক তামাশা । এখানে মা আর মেয়ে । দুজনেই ছোটো বড়  দুটো বারবি ডল । আজকাল মায়েরা এরকমই । হুশ করে একটা গাড়ি চলে গেলো । শুনি, বড় বারবি ছোট জনাকে বলছে ,” টেল মি দ্য নাম্বার অফ দ্য কার?” কী ভয়ানক পরিস্থিতি এই সব ভাবতে ভাবতে দেখি, ওই দেখা যায় আমার  বাড়ি , মালঞ্চেরই বেড়া ঘেরা । আমার পার্ক এসে গেছে । পুরো পার্ক টাই অজস্র মাধবীলতার ঝাড় দিয়ে ঘেরা । তাতে অঢেল  অঢেল ফুল পুব হাওয়ায় দোলা খাচ্ছে আর হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে ।  ঢোকার পরেই প্রতিদিনের সেই কমেডি টা আরেকবার শুরু  হবে । কমেডি কুইন বলাই বাহুল্য আমি নিজে । একটি মেয়েকে(থুড়ি এখন মহিলা বলাই ঠিক ,মানুষ কিছুতে বুড়ো হতে চায় না দেখছি!) দেখে আমি  মুন্নাভাই ফিল্মের বিদ্যা বালানের মতো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলবো “গুড  মঅ অ অ র্নিং , ভিনীতা   ইয়ে... মানে ভীনাকশি”  প্রতিদিন মানুষের একই ভুল কী করে হয়? ভীনাকশি( নামের মানে জানি না, মীনাক্ষী হলেও না হয়   বুঝতাম) পালটা হাসি দিয়ে নির্ঘাত ভাবে “ প্রথম দিনেই যে রকম গবেট দেখেছিলাম ,এতোগুলো বছর পার করেও একটুও বদলায় নি । আশ্চর্য !”  আমরা ব্যাচমেট ছিলাম, যদিও  ও অন্য সার্ভিসের । পার্কে হাঁটার সময় আমাকে ধরে ফেলবেন আরো একজন । ইনি কিছুটা বয়সে বড় বলে মনে হলেও ওনার এঞ্জিন কিন্তু আমার মডেলের চেয়ে ভালো । আমাকে পেরিয়ে যাবার সময় খুব অস্ফুট একটা হ্যালো বলে টপ করে এগিয়ে যান বা এড়িয়ে যান তার  একটা কারণ আছে । প্রথমে উনি একদিন নিজে থেকেই আলাপ শুরু করেছিলেন, আমরা একই ব্লকে থাকি, চলতে চলতেই কথা হচ্ছিল ,কথা হতে হতেই আমি লক্ষ করলাম উনি একটু বেশিমাত্রায় কৌতূহলী ,কাজেই প্রশ্নপত্র বেশ লম্বা আর ওনার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমার এগারো নম্বরের গিয়ার চার থেকে পাঁচছয় করতে হচ্ছে । লাগাতার পাঁচ ছয় করতে করতে আমি যাকে বলে দড়াম করে সটান পাথুরে ট্র্যাকে ক্রিকেটের ক্যাচ মিস করার কায়দায় পড়ে গেলাম । মোবাইল ছিটকে পড়ে গেলো , ভালো এঞ্জিন বেশ ঘাবড়ে গেলেন । হাঁটু আর থুতনির দফা রফা হয়ে যেতে পারত কিন্তু গেলো না । ভালো এঞ্জিন কিন্তু খুব ভালো করেই বুঝে গেছিলেন এই পতনে তার কিছুটা অবদান আছে । তারপর থেকেই উনি আধোস্বরে হ্যালো বলে এগিয়ে যান । ঝিরঝিরে হাওয়া আর টুপটাপ ফুল ঝরার মধ্যে হন্টন শেষ করে ফেরার পথে বাঁ দিকে মন্দিরে টং টং ঘন্টা বাজে । কোনদিন যাই না । একদিন এমনি  মনে হল চলে গেলাম । ঘন্টা বাজালাম । সে আওয়াজ চারদিকে রিনরিনে প্রতিধ্বনি তুলল। কেউ কোথাও  নেই । পরিচ্ছন্ন মন্দির । প্রদীপ জ্বলছে,  লাল শাড়ি পরা শেরাওয়ালি মায়ের সামনে । ভারি শান্ত নিরালা স্নিগ্ধ । এবারে ডানদিকে ঘুরি, বাড়ির পথে । সূর্য দেব এখোনো চুল্লি ধরান  নি । 



ফুটপাথে গাছের তলায় টাটকা সবজি সাজাচ্ছে পুনম আন্টি । পুনম আন্টির পুরো শরীরটাই হাসে । নমস্তে টমস্তে  সারা হয় । সবজিগুলো দেখবার জন্য একবার দাঁড়াই । আমি জানি পছন্দ মতই সবজি আন্টির বউমার হাত দিয়ে আমার বাড়ি চলে যাবে । কাছেই মস্ত বড় গাড়ির বাজারে ওদের খাবারের ব্যাবসা ছিল । দু চারজন রোগা পটকা ছেলেও খাটত । কিন্তু এতো ঝক্কি কত্তা গিন্নি নিতে পারলেন না , তাই নিরিবিলি ছায়ায় বসে দুজনে সবজি বেচেন । সঙ্গে থাকে ফ্লাস্কে চা। বিস্কুট।  আন্টির হাতের রান্নার  জবাব নেই । লছমি মানে বউমার হাত দিয়ে আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে কিছু কিছু আসে । আমি একদিন বলেছিলাম এতো দোকানকে ফেল করিয়ে দেবে । তখনই লছমির কাছ থেকে ওদের পুরোনো কথা জানতে পারি ।
দেশি তোড়ি মানে ঝিঙে  দেখে একটু খুশি খুশি ।  দানা দানা করে পোস্ত, কাঁচালঙ্কা দিয়ে বাটা (শিলে বাটা, গীতাজির শিল আমার রান্নাঘরে প্রায় জবর দখল) ঝিঙে আলু পোস্ত । কতদিন খাইনি । এখানকার সবজি বাজারে দেশি তোড়ি বড্ড কম দেখা যায় । গরবা মে সংগ লাগিরে, লাগিরে ও মিত বিহরবা , আনন্দ ভইলবা , মেরে অঙ্গন বা ।। মাস্টারমশাই সেই কতকাল আগে শিখিয়েছিলেন । রাগ টোড়ি  । সক্কালবেলা পুনম আন্টির ঝিঙে কতো সুর মনে পড়িয়ে দিল ।   সরেস ঝিঙেকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি মহারাজের  হুঁকোর টিকেতে আগুন ধরেছে , গ্লাসে চা , সামনে তিন চারটে লোক, জমছে জুতোর পাহাড়, মহারাজের সারাদিনের কাজ , জুতো মেরামতি । সময় গড়াচ্ছে  গোলাপি শাড়ির আঁচল ধরে,  রঙ্গ  সারি গুলাবি চুনরিয়ারে, মোহে লাগে নজরিয়া সাঁবরিয়ারে।।। পেটানো রাজস্থানী শরীরে গুলাবি কোটা শাড়ি , মাথায় ইস্তিরির কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে টান টান হয়ে হাঁটছে বিমলা ।  এর কাটাকাটা নাক মুখ ছিপছিপে  আত্মবিশ্বাসী চেহারা দেখলে কেন জানিনা আমার মনে হয় হুড খোলা জিপে হাতে লাল হলুদ একগাছি সুতো বেঁধে  কোমরে রুপোর চাবি ঝমঝম, নাকছাবি ঝিকিয়ে বিমলা রুখু ধুলো উড়িয়ে ভোটের প্রচার করছে। ওর বর বয়সে তিনগুণ বড়ো  রামস্বরূপ ধোবির সঙ্গে বিমলাকে দেখলে তাই আমার ভারি বিরক্তি লাগে ।


বাড়ি ফিরে বাবা মায়ের সঙ্গে বসে শান্ত সকালে চা বিস্কুট খাই  ওরা ছবির মধ্যে হাসে । গ্রিল আর পর্দার ফাঁক দিয়ে তেরছা করে রোদ রঙ পাল্টায় । সময় আরো এগোয় ।
বাবার কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে মায়ের কথা
কুঞ্জোর ঠান্ডা জলের কাছে
দু হাত পাতে নীরবতা

গীতা জি ঘর মুছতে মুঝতে  দিনের এইসময় টাতে খুব গভীর কিছু দর্শনের কথা বলতে থাকে ।বাইরে কোকিলের ডাকে কান  ঝালাপালা  গীতাজি বলতে থাকে,  কতো রকম যে ইমতেহান নেয় ভগবান , আগে থেকে  কোশ্চেন পেপার কেউ জানতে পারে না ।আমি টিপ্পনি কেটে বলি রেজাল্ট কেমন হয় ?  ভালো হয়  ?
-- হাঁ হাঁ কিউ নহি ? কভি কভি আপ সোচ ভি নহি সকেঙ্গে । ইতনা আচ্ছা ।
গীতার সামাজিক অবস্থান , পয়সার টানাটানি , সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ বসে গভীর রাত অবধি পড়াশুনো এসব জানার আর ওইসব কথা শোনার পর আমার লজ্জায় ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে ।  
তারপর আর কি ?  অফিস যাবার জন্য দ্রুত তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে চেঁচিয়ে  গীতাকে বলতে  থাকি,   খিড়কিআঁআআ । মানে  জানালা বন্ধ করতে ভুলো  না কারণ তা না হলে বিকেলের ধুলো ঝড়ে আঁধি তে  পুরো বাড়ি জুড়ে আবিদা পরভিন হয়ে থাকবে।। আঁধি চলি তো নকশে  ,কাফে পা নহি মিলা ।। দিল জিসে মিল গয়া হো ,দুবারা নহি মিলা ।
বাইরে তখনো মন্দ মন্দ হাওয়া । আশ্চর্য । সুরজজির  চুলা তখনো ভালভাবে ধরে নি কিন্তু । এই পর্যন্ত একটা খোশমেজাজ বেশ ধরে রাখা গেছিল । কিন্তু যাত্রাপথের দু ধারে বৃক্ষরাজি ও পুষ্পরাজির অপরূপ রূপ লাবণ্য পুরো কিসসার মাত্রাটাই ঘুরিয়ে দিল । সে মায়াবী পথে সুপর্ণা অডিটরের  সঙ্গে রাজিয়া সুলতানের তেমন কোনো  তফাত  নেই । একেবারে হরিপদ কেরানির কেস!   আমার চোখে ঘোর লাগে  । মনে হল যেন সিরাজির ঘোর । আমি নিম চিতবন( ছাতিম)  পিপুল জারুল গুলমোহরের অমলতাসের  রঙে পাগল হয়ে যাচ্ছি , পুরো রাস্তা জুড়ে প্রাচীন নিম যেন ঝরোখার  আড়ালে দাঁড়িয়ে   ঘুঙ্গটের ফাঁক দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে বলছে বলছে,  সুলতান সুলতান  । সলামত রহে সুলতান ।  আকাশ দেখা যায় না কোনও কোনও জায়গায় । সবুজের চাঁদোয়া  ঢেকে দিয়েছে সূর্য । সারি সারি গাছ  যেন হাজার হাজার জনতা , বৃক্ষ ,  মহীরূহ ,তরু , প্রাচীন  , আমির গরিব ,সব্বাই আশীর্বাদ  করছে সুলতানকে
বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ পৃথিবী শান্তিঃ


Tuesday 11 February 2020

আচাভুয়ার বোম্বাচাক


সেই দিঘিটার  চারধারে  হিজলের ঘন বন । হিজলের অনেক ডালপালা । অনেক । যেন ডাগর মেয়েটির মাথায় ঠাসা ঘন কোঁকড়ানো চুল । সে গাছের   শিকড় যায় কতদূর !  যেন নদী থেকে সমুদ্রে । 
হিজলের বনের মধ্যে মস্ত এক  দিঘি । হিজল দিদিরা  দিঘির জলের আরশিতে মুখ দেখে আর দুলে দুলে   ভালোবেসে একে অন্যের  আঁচল জড়িয়ে হাত ধরে আরো ঘন হয়ে বসে । হিজলের বনে পৃথিবীর সব ঘু ঘু পাখি কোথা থেকে ডেকে ওঠে সে খবর  কুসুমকুমারী দাশের ছেলে ছাড়া  আর কেউ কোনোদিন  রাখেনি । সেই যে দিঘি , তার নাম গজাল দিঘি । নামটা এসেছে গজার মাছ থেকে । গজার মাছ জানো ?
হীরামন গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লো । সে জানে না ।
তখন পিসি বলল , সে এক রাখখুসে মাছ । গজাল দিঘির কোন গহিনে অতলে কাদা পাঁকের  মধ্যে থাকত । অমাবস্যার রাতে হিজলদিদিদের  চুলের ফাঁকে ফাঁকে জোনাকি জ্বলত ।  সেই অন্ধকার ঝুপসি দিঘির জলে হঠাত ঘাই মেরে ফুঁড়ে উঠত গজাল মাছ ।
হীরামন দম আটকিয়ে বসে আছে । ডানা বন্ধ ।  ঠোঁট বন্ধ ।
-তারপর কী  হল পিসি ?
- তারপর ? তারপর বন থেকে বেরুল বাঘ । আর এদিকে দিঘির  থেকে পাড়ের দিকে সটান উঠছে গজাল মাছ ।
-তারপর
-“কী ভয়ানক লড়াই  হল মা যে  , শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা !”
পিসির মুখে মা ডাক শুনে হীরামন  আকুল হয়ে বলে উঠল
-তারপর কী হল , বাছা ?
- তারপর সকালে উঠে গ্রামের লোকেরা দেখল এই বড় বড় কুলোর মত গজাল মাছের আঁশ , চারদিকে ছড়িয়ে আছে । হিজলের গায়ে বাঘের নখের আঁচড় ।  এই হল আমাদের গজাল দিঘি । খুব পয়মন্ত দিঘি । মেয়ে বৌ রা এসে সেইখানে সিঁদুর লেপে দিল । মাঘী পূর্ণিমার রাতে পাড়ের কাছে ভেসে উঠত ঠাকুরের বাসন কোসন । আর তার জল কীরকম ছিল জানিস ? আমার মা বলতেন , একেবারে যেন ডালিম !
- ডালিম ? জলের রঙ লালপানা ছিল বুঝি ?
- তুমি বাপু একটু কম কথা বল । ডালিম মানে ওর লাল রঙ বলিনি , সেই দিঘির জল ছিল স্বচ্ছ । কাচের মত ।  ডালিমের দানা যেমন । দিঘির বাঁধানো ঘাটে হিজলের ছায়ায়  বড় মা ,মেজমা , রাঙা মা , আমার মাবাড়ির খুকিরা কত দুপুর বিকেল কাটিয়েছে । বসার জায়গা বানিয়েছিল কাকারা । আর ছিল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো দাবার ছক । বাড়ির ছেলেরা এসে বিকেল বেলায় খেলত । জ্যাঠামনি , কুট্টি কাকা সবাই ।  
-জানো , আমাদের হল  মাস্টারের গুষ্টি । চল্লিশজন ছাত্র থাকত এবং খেত ।
হীরামন তো বিশ্ব কুঁড়ে । কাজকর্মের কথায় খুব উশ খুশ করে বলল , ওরে বাবা , তা , এতো কাজ কে সামলাতো বাছা ?
পিসি বলল , চার বউ  মিলেই রান্না করত । কিন্তু তার মধ্যেও  রকমফের  ছিল । এই যেমন মেজ মা , মেজমার একটা আলাদা পজিশন ছিল সংসারে । কর্তারা তার সঙ্গে  সবকিছু আলোচনা করতেন । তিনি বাড়ির সবকিছু দেখভাল করতেন । কার কখন কী দরকার , অসুখ করলে কী পথ্যি , সেরে উঠলে  কী পথ্যি । আর বাড়ির সমস্ত বাচ্চাদের লেখাপড়ার দায়িত্ব  মেজমার । কাগজ কেটে কেটে বড় বড়  অ আ ক খ বানিয়ে ছোটদের উঠোনের মাঝখানে বসিয়ে পড়াতেন  । রবিঠাকুরই বল আর আশাপূর্ণা দেবীই বল না  কেন , মেজ বউরা একটু বেশি ডাকাবুকো ।  রাঙা মা আর আমার মা সমস্ত কাজেই ছিল । আমার মায়ের লেখাপড়া তখনো শেষ হয় নি । সংসার ঠেলে তাকে পড়তেও হতো ।
-ওহ তাহলে ওই বড়মাই একটু আরাম আয়েশ করতে পারতেন । বুঝলাম ।
- হ্যাঁ তা তো বটেই ! খুব আরামই করতেন কি না !  কাজ শেষ করে উব্দো খোঁপা বেঁধে আলতো করে গায়ে একটা চাদর ফেলে বড়মা বেরিয়ে যেতেন গ্রামে ,একেবারে ঘুঘু ডাকা ঘন দুপুর শেষ হবার আগেই , যখন সূর্য কাছারিবাড়ির নারকেল গাছের মাথা থেকে নেমে গেছে ,বড়মা সমিতির কাজে বেড়িয়ে পড়তেন ।
হীরামন খুব খুশিটুশি হয়ে বলল , হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি । সখী সমিতি । আচার দেয়, বড়ি দেয়ধূপ  বানায় ।
পিসি বলল , কী যাতা বকছ ?  তোমার শোনার  ইচ্ছে হলে শোনো নয়তো উড়ে পালাও । আমি আমার ভাইঝিকে তার বাড়ির এসব না জানা কথা বলছি  । তুমি মাঝখান থেকে কথা বল না  যেন । আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে । বুড়ো হয়েছি , কথার খেই হারিয়ে গেলে তুমি ধরে দেবে
-গ্রামের মধ্যে বড়মার অনেক কাজ থাকত , জানিস
স্কুল বাড়ি , কাছাড়িবাড়ি তে চরকায়  তখন সুতো কাটা হচ্ছে । সে সুতোর প্রতিটি টানায় বোনা হচ্ছে কত ইতিহাস । বাড়ির ছেলে মেয়ে বউ সব্বাই খদ্দর পরে ।  গ্রামে গ্রামে মেয়েদের সংঠনের কাজটি করতেন বড় মা । 
-শুধু তাই নয় বড়মা আরো কী কী করতেন জানিস , মেয়েদের লাঠিখেলা শেখাতেন , ছোরা খেলা শেখাতেন । কোমরে কাপড় গুঁজে উঠোনে সব কসরত চলত । আবার ওই উঠোনটাই কখন  মেজমায়ের পাঠশালা হয়ে যেত । বড়মা , যখন গ্রাম থেকে ঘুরে বাড়ি ফিরতেন তখন উঠোন জুড়ে  শাঁখ বাজছে আর ধুনোর গন্ধে প্রার্থনা উঠছে আকাশের  দিকে  , নম  নারায়ণ পরাবেদা /নারায়ণ পরাক্ষরা /নারায়ণ পরামুক্তি /নারায়ণ  পরাগতি। সমস্ত পরিবার একসঙ্গে ।

তখন দেশজুড়ে গান্ধিজির অসহযোগ আন্দোলন । বালগঙ্গাধর তিলক মারা যাবার পরের বছর ১৯২১ সালে গান্ধিজি চাঁদা তোলার জন্য খুললেন তিলক স্বরাজ ফান্ড । সেই তিলক স্বরাজ ফান্ডে বাংলা থেকে  অনেক অবদান এসেছিল । সেই যে হিজলের বন , গজাল দিঘি , কীর্তন খোলা নদী , বরিশালের হিজলতলার সেই বউরাও প্রায় সব গয়না তিলক স্বরাজ ফান্ডে দিয়েছিল । স্বদেশীর তকমা আঁটা বাড়ি । দেশ বরেণ্যদের পদধূলি সিঞ্চিত । পুলিনবিহারী দাস  ,অশ্বিনী  দত্ত , সূর্য সেন । মুকুন্দ দাস সবাই সেখানে পায়ের  ধুলো রেখেছেন । উঠোনের দরজা ফাঁক করে কেউ আওয়াজ দিত পিকেটিং এ বসতে হবে । বড়মা  রান্না শিকেয় তুলে  তাঁর বাহিনী নিয়ে  পুলিশের সামনে পিকেটিং এ বসে পড়তো । আরো ফিসফাস গুজগুজ যখন ঘন হতে থাকত  ,দু একটা সেপাই পল্টন  ইতি উতি তাকিয়ে  মাস্টারদের উঠোনে ঢুকব   ঢুকব করতে থাকত  , ঠিক তখখুনি   পাঁজা করা ছাই মাখানো বাসনের গুঁতো মেরে মেয়েরা বেরিয়ে যেত গজাল দিঘির দিকে । ছাই মাখানো বাসনভরতি ছোরা । সেই বাসন চুবিয়ে দিয়ে আসত দিঘির জলে ,গজাল মাছের জিম্মায় । আবার রাতের বেলায় জোনাক পোকা মেয়েদের   পথ দেখিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিত ।
পুজোর সময় এই বাড়ির ছেলেরাই প্রতিমা গড়ত । নাটক লিখত । এস্রাজ বাঁশি বেহালা , সব বাড়িতেই । এমনকি বাড়ির দেউড়িতে যে সব মূর্তি ছিল যেমন ধর প্রদীপ হাতে মেয়ে , এরম বুঝলিসবই বাবা কাকা কুট্টি কাকাদের হাতে গড়া ।
হীরামন আর কথা কয় না । চুপ করে শোনে ।

দেশভাগের অরুন্তুদ স্মৃতি যে পরিবারে নেই তারা সেই  কষ্ট কখনোই বুঝবে না । ১৯৪৮ সালের শেষ জানুয়ারি । হিজলতলায় খবর এসে পৌঁছল গান্ধিজিকে গুলি করা হয়েছে । সেদিন অরন্ধন । আগুন জ্বলবে না বাড়িতে । শৈশব কৈশোর যৌবন উপড়ে ফেলা সেই দিনে ভিটেমাটি হারানো সেই বউরা  গয়নার শেষটুকরোটাও ফেলে দিয়েছিল কীর্তনখোলার জলে ।
গান্ধিজি ,আপনি কি আমাকে মেঘ করে দিতে পারেন ?
এই শরতেই তাহলে বর্ডার ফাঁকি দিয়ে হিজলতলা গ্রামে
আমাদের বাড়ির বাগানের ওপর মুখ বাড়িয়ে দেখতাম
আকন্দ ফুলে ফুলে ঢেকে আছে আমার বিষাদ অভিমান ...”(বাসুদেব দেব)


“পুব বাগানে স্মৃতির আনাগোনা “ সেই স্মৃতি বিধুর একটি অন্য দুপুর । দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় যারা , তারা স্মৃতি বিধুর নদী হয়ে কেবলই শিকড় ছুঁতে চায় । সেই দুপুরের কথা হীরামনই মনে করিয়ে দিল লিখতে । নইলে ভুলেই যাচ্ছিলাম ।
 বাইরে তুমুল যান জট আর কান ফাটানো হর্ন , লোকের গুঁতোগুঁতি । কিন্তু যেই গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম আমি আর মৌসুমি,  সে এক বিস্ময়কর এক টুকরো  শান্তি । পারস্য থেকে চলে আসা আরমানিরা এই শহরে একসময় কিং মেকারের ভূমিকা নিয়ে ছিল । তারা না থাকলে ইংরেজদের হালে পানি পাওয়া মুশকিল তো হতই । আরমানিদের অগাধ পয়সা । অঢেল । ইংরেজদের সাহায্য করে মোঘলদের সঙ্গে  ইংরেজদের দোস্তালি মজবুত করে টুক করে আড়ালে সরে গেছে । একসময়  কলকাতার অর্ধেক আকাশ জুড়ে  ছিল তারাই  । চিৎকার করে নিজেদের কথা বলার জাত এরা নয় ।   বেদানার রসে ভরা দেশ আরমেনিয়া । সেই রসের স্বচ্ছ অথচ নির্লিপ্ত আস্বাদ পেলাম । একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে । রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলেছিলেন বাতাস হও , গন্ধ বহন কর কিন্তু গন্ধে লিপ্ত হোয় না । আশ্চর্য ভাবে  এটাই আরমানিদের বীজমন্ত্র ।   সেই দুপুরে আমাদের টেম্পারেচার মাপা হল , হাত দুখানি স্যানিটাইজারে ধুয়ে আরমানি কলেজে ঢুকেই দেখি  দেওয়ালে মাউন্ট আরারাতের ছবি । সেই তুষার ধবল আরারাত । যেখানে মহা প্লাবনের পর নোয়াহ প্রথম ভিড়িয়েছিলেন তাঁর জাহাজ , পৃথিবীর প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল । সেই আরারাত পাহাড়ের ছবি আরমানিয়ার সর্বত্র । তারা এখোনো সেই পাহাড়ে পৌছনোর স্বপ্ন কাপাশ বোনে  । কিন্তু সেই পাহাড় তো তাদের দেশে নেই । সে আছে  তুরস্কের সীমানার  মধ্যে । আর রয়েছে তুরস্কের হাতে গণ হত্যার রক্তের ধারাপাত ।  সেই নির্মম রক্তপাতের পথ ধরেই মনে পড়ে বুদাপেস্টের বাড়িতে বাড়িতে ইহুদি হলোকাস্টের মর্মান্তিক বিষাদ গাথা  শোনাতে চায় কত পরিবার । বুদাপেস্টের যে বাড়িটিতে থাকতাম সেখানে এক মস্ত সিন্দুকের মত কাঠের বাক্স । একটা নক্সাদার বিশাল চাবি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদ্গন্ধ মাখা সেই বাড়িতে বসে মনে হত ওই চাবি ঘোরালেই বাকশ থেকে হুড় হুড় করে সব চরিত্রগুলো বেরিয়ে আসবে ।
রোমের ট্রামে বসে এক উথাল পাথাল চশমা সুন্দরীকে  ঘাবড়ে টাবড়ে গিয়ে রাস্তা জিজ্ঞেস করেছিলাম ।সে বললে , ভেব না , আমিও ওখানেই নামবো ।
-          তুমি রোমে থাকো ? ( কী বোকা বোকা প্রশ্ন !)
-          হ্যাঁ , কিন্তু আমি মন্টেনিগ্রো থেকে এসেছি । তুমি নাম শুনেছো আমার দেশের ?
মেলবোর্নের  আমাদের সঙ্গে ছিলেন নিক । বয়স্ক বাবা ধরনের । গাড়ি চালাতেন।
-আমার দেশ ?  এখানে না । গ্রিসে । কেন এখানে এসেছি ? তিরিশের গ্রেট ডিপ্রেশন নিয়ে এসেছে ।
তারপর গাড়ি থামিয়ে নেট খুলে কবি স্যাপহোর দেশ লেসবস খুলে দেখিয়ে দিচ্ছে যখন ,তখন দেখি প্রশান্ত মহাসাগরে  মিশে যাচ্ছে ইজিয়ন সাগরের দু ফোঁটা চোখের জল ।
এই পথা চলার সঙ্গে মার্কিনি মেল্টিং পটের তফাৎ আছে ।


আমার ভাইপো , অরোদের স্কুলে ইতিহাস অন্যরকম ভাবে পড়ানো হয়  । কী করে কনফ্লিক্ট দানা বাঁধে , সেখান থেকে একেবারে শেষ মাইলস্টোন, মাইগ্রেশন ।  সাত বছরের বাচ্চা সুইডেনের স্কুলে ইতিহাসের বিজ্ঞান পড়ে । নীল আকাশে মস্ত মস্ত তারার ছবি আঁকে । বাহ কী সুন্দর এঁকেছিস ! অত বড় বড় তারা কেন রে ?
হীরামন বলে ওঠে , ওহো আসল জিনিশটাই দেখোনি , ছবির শেষে দ্যাখো , একটা ছোট্ট ছেলে হাঁটু মুড়ে বসে আছে । আকাশের দিকে চেয়ে ।
অরো বলে ওটা আমি !!ওটা আমি !!
এখন গরম কাল । সামনের সবুজ লনে বল দাপায় আইমন  আর  সুলেইমান ।  অরোর বয়সী । কিন্তু ঠিক অরোর মত নয় । কোথাও আলাদা । ভীষণ ভাবে  আলাদা । কারণ ওরা বয়সে শিশু কিন্তু মনে শিশু নয় । শৈশব খুইয়েছে কখন, অজান্তে  । ঘুম ভেঙে দেখেছে অন্য দেশ । অন্য যাপন । এখানে জায়গা পেতে হলে লড়াই করতে হবে ।
এইসব ভাবতে ভাবতেই  শ্রেয়ার ফোন বাজে , দিদি বাড়ি থেকে বেরিও না । জি(গি)য়াটরগে মার্ডার হয়েছে । চার্চের সামনে
মাইগ্রেশনের পরে কী হয় ? অরো হয়তো নিজেই বুঝে যাবে একদিন !  তবে সেই তারাগুলো যেন তখনও জ্বলজ্বল করে !



















শীতও জাঁকিয়ে পড়েছে । হীরামনের পাগলামিও ততোধিক । তিনি এখন বালাপোষের ওম ছেড়ে বেরুতেই চান না । ডানা ঝাপ্টানোও বন্ধ । খালি চোখ বুজে আয়েশ করা এবং আজগুবি বকা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করছেন না । জানালার ওপর পুরু পর্দা । টুপটাপ শিশিরের হিম জমা হচ্ছে কাচের পাল্লায় । বেগুনি পিটুনিয়ার সেই হিম আবার ভালো লাগে । অন্ধকার বারান্দায় আমি ঠিক জানি দোয়েল দম্পতি এসে জম্পেশ করে হীরামনের নিন্দে করছে । হীরামন যা ঝগরুটে !

কুমড়ো বিচি ভাজা আর গয়না বড়ি ভাজা ,খোলায় ভাজা শুকনো চিঁড়ে , আর কলার চিপস । বেশ গুছিয়ে বসেছি, বুঝলেন ।ইবন বতুতা লিখছেন , বঙ্গদেশ বড় সুন্দর । শস্যদানা উপচে পড়ছে । আর সব জিনিশের দাম নাকি অবিশ্বাস্য রকমের শস্তা !
কম্বলে পা ডুবিয়ে চামচে করে গুঁড়ো দুধে নলেন গুড় মাখিয়ে মাখিয়ে খাচ্ছি বেশ , একদম ক্যাডবেরি । মনে হয় কোম্পানিগুলো এভাবেই বানায় ! আবার বই এ চোখ রেখে বললুম, ইবন বতুতা কী সুন্দর লিখেছে হীরামন, তোকে পড়ে শোনাই ।
-পার্সিয়ান ক্যান্ডি , পার্সিয়ান ক্যান্ডির কথা ওই ইবন লেখেনি ?
-সে আবার কী ?আর ইবন বতুতা তোর ইয়ার দোস্ত নাকি?
-ওহ , তুমি এটাই জানো না ? এইটুকুন টুকুন মিষ্টি মিষ্টি ছোট্ট ছোট্ট দানা , জিভে জড়িয়ে যায় , হিহিহিহি।।
-আমি বললুম , তুরকিশ ডিলাইট খেয়েছি , বড্ড কিটকিটে মিষ্টি । ভালো না ।
-পার্সিয়ান ক্যান্ডি কিটকিটে না গো ।ওই গুঁড়ো দুধে নলেন গুড়ের মত মোলায়েম । হিহিহিহি ।
-বল না রে ব্যাপার খানা কী ? হিহিহিহি মানে তো তোর হেঁয়ালি বকা ।
-তাহলে তো শিরাজির কথা বলতে হয় ।
-শিরাজি মানে তো মদ! তুই শেষকালে আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস হীরামন !
-এ শিরাজি সেই শিরাজি নয় , এ হল হাফিজ এ শিরাজ । পারস্যের শিরাজ শহরে হাফেজ নামে এক কবি ছিলেন ।
- হীরামন!! আমি কি হাফিজের নাম জানিনা ? তুমি বড্ড বেড়েছ কিন্তু ! কী মনে আছে বলে ফেলো চটপট ।এখখুনি ফুলকপির বড়া আসবে ! তার আগেই শেষ করবি কিন্তু ।
বকুনি খেয়ে হীরামন এই প্রথমবার ডানা ঝাপটিয়ে ফড়ড়ড়ড় করে উঠে বসে । বলে শোনো তবে , তোমায় শুনিয়েই ছাড়ব আজ! শোনো ,
সাকি ! গোলাপ , টিউলিপ , সাইপ্রাসের বাগানে কী হিল্লোল ।ভারতের তোতা পাখিদের কী মিস্টি বোল
পারস্যের মধুস্বাদ ,কে করিবে আস্বাদ ?

আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলি , তোর ওই বোকা বোকা কবিতাগুলো বলে এই আরামের সন্ধেবেলাটা মাটি না করলে চলছে না। না?
-হীরামন ক্যাঁক ক্যাঁক করে বলল , বোকা বোকা ?শোনো তবে , এগুলোকে বলে মেটাফোর !
-চুপ ! মেটাফোর শিখতে হবে একটা টিয়া পাখির কাছে? মাথা কিনে নিয়েছিস নাকি?
- হ্যাঁরে বাবা , শোনোই না ! সুলতান গিয়াসুদ্দিন তিনটে লাইন লিখে আটকে গেলেন । কিছুতেই আর মনের মত করে লিখতে পারেন না । সব ভাব ,আবেগ ছন্দ আটকে যাচ্ছে । কিছুতেই খুলছে না ।
- তা এতো ভাব আবেগ কার জন্য?
-কার নয় , বল কাদের জন্য ? গিয়াসুদ্দিন ছিলেন ইলিয়াস শাহি সুলতান । এই গৌড় বাঙলার । তিনি খুব করিতকর্মা । অনেক দূর দূর দেশের সঙ্গে মেলামেশা করতেন যেমন চিন দেশ , পারস্য । তা ইনি আবার শের শায়েরিও করতেন । একদিন সুলতান ভয়ানক অসুখে পড়লেন । ঘা , পাঁচড়া এইধরনের , বুঝলে?
-তারপর?
- সুলতান হলে কীই হবে ? সেবার ভাগ নিতে সবাই কিন্তু হই হই করে এগিয়ে এলোনা । এগিয়ে এলো তার হারেমের তিনটি মেয়ে । দিনরাত এক করে সুলতানকে তারা পরম মমতায় , সেবা, যত্নে সারিয়ে তুলল । এই নিয়েও নাকি অনেক হারেম পলিটিকস হয়েছিল , জানো ?
- সে যাক গে , মরুক গে । তুই গল্পটা শেষ কর ।
- সুলতান তো এই সেবা যত্ন পেয়ে কৃতজ্ঞতায় গলে গেলেন ! ভাবো একবার , সুলতানদেরও জীবনে এমন সময় আসে! তিনি ভাবলেন এই সেবাযত্নের প্রতিদানে তিনি নানান উপহার এসব তো দেবেনই , এর ওপর একটা কবিতাও লিখে দেবেন সেই তিন মেয়ের জন্যে । কবিতায় তিনটি ফুল সেই তিনটি মেয়ে । বুঝলে তো মেটাফোর !
- উফ , তার পরে কী হল ?
- তার পরেই হোল গন্ডগোল । সুলতান আর কিছুতেই কবিতাটা শেষ করতে পারছেন না । ভাষা , ছন্দ, ভাব সব গুলিয়ে ফেলছেন । কিছুতেই মনের মতো হচ্ছে না । হিন্দোস্তানের তোতা মানে কবিরা নাজেহাল ।খালি বকা খাচ্ছে সবাই । দেখেছ , কবি বোঝাতে তোতা শব্দ ব্যাবহার করেছেন হাফেজ । একমাত্র তুমিই শুধু আমাকে সবসময় খিচখিচ কর অথচ ইতিহাসে দ্যাকো ….
- কিসসা টা আগে শেষ কর ।
- শোনো , হিন্দোস্তানের তোতাদের মানে কবির দলের যখন কালঘাম ছুটে গেছে সে সময় সুলতান গিয়াসুদ্দিন মসলিন সমেত আরো নানান উপহার দিয়ে তার খাস দূতকে পাঠিয়ে দিলেন পারস্যে । কার কাছে জানো ? খোদ কবি হাফেজের কাছে । বিনীত অনুরোধ , কবিতাটি সম্পূর্ণ করুন আর আমার দেশে এসে থাকুন ।
-তারপর ?তারপর ?
- হাফেজ চিঠিখানা পড়লেন । দূতকে বললেন কবিতটি তিনি সম্পূর্ণ করবেন কিন্তু পারস্য ছেড়ে এই বয়সে সুদূর বঙ্গদেশ যাওয়া তার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব । সেই শায়েরিটাই হল পার্সিয়ান ক্যান্ডি । হিন্দোস্তানের তোতাদের ঠুকরে ঠুকরে খাবার জন্য কবি হাফেজ পাঠিয়েছিলেন পারস্যের শিরাজ শহর থেকে, তার কবিতার মধু মাখিয়ে মাখিয়ে । ভালো না ? গল্পটা ?
-ওহ, ভারি গল্প ! হাফেজকে নিয়ে আমি আরো আরো গল্প জানি । তিনি খুব বেশি করেই আমাদের দেশে এসেছিলেন ।
- এসেছিলেন মানে ?
-মানে মেটাফোর ! মেটাফোর ।
- এই প্লিজ বল , আমি বিরক্ত করব না , বল না প্লিজ ।
-যে পার্সিয়ান ক্যান্ডির কথা খুব করে শোনালি সেই ক্যান্ডি খেয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আনন্দে নেচে উঠতেন । অনেকে ভাবত তাঁর মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে ।!
- এই শোনাও শোনাও আমি এই চুপ করে বসলুম । ঠোঁট বন্ধ করে , ডানা বন্ধ করে ।
- কী আর বলব ? দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাফেজ প্রীতি সবাই জানে । হাফেজের কবিতায় তিনি মগ্ন হয়ে পড়ে থাকতেন । হিমালয় ভ্রমণের সময় সারাটা পথ উঁচু গলায় হাফেজ পড়তে পড়তে চলেছেন । মধ্যরাতে নিদ্রাহীন চোখ তাঁর হাফেজকেই খুঁজেছে ।

আমি তো কেবল প্রার্থনা করেছি তোমার দৃষ্টির বিদ্যুতের আলো ।এ ছাড়া আর কোনো প্রার্থনা ছিল না আমার । বিদ্যুৎ পড়ে যদি সব ছারখার হয়ে যায় তো যাক । বিদ্যুৎ পড়ুক বিদ্যুৎ পড়ুক বলতে বলতে সব কিছু যদি জ্বলে যায় তাতে আর আশ্চর্য কী ?”

এমন হাফেজপ্রেমিক দেবেন ঠাকুরের ছেলে তাঁর সত্তর বছর বয়সে এসে বসলেন কবি হাফেজের পাশে । পারস্যে হাফেজের সমাধির পাশে বসে রবীন্দ্রনাথের মনে হল কোন ভুলে যাওয়া বসন্ত থেকে কোনো এক মুসাফির এসেছে যেন ।

এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, আজকে এই বসন্তের সকালে মনে হোল যেন দেখতে পেলাম দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারে নি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।“









নুরাধা নাম্নী গবেষক , বারাণসী থেকে স্বগৃহে ফিরে এসে দীর্ঘ অদর্শনের পর সারমেয় শাবকদুটিকে কোলে তুলে আদর করার সময় অকস্মাৎ লক্ষ করলেন, সেই দুর্লভ পুঁথিটি তাঁর ঝোলা থেকে লোপাট হয়েছে । পুঁথিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম বলে তাঁর ধারণা । এই ধারণার সপক্ষে সর্ব প্রথম যুক্তি এই যে , পুঁথিটি পালি ভাষায় একজন ভিক্ষুণীর লেখা ।অর্থাৎ একজন মহিলা আনুমানিক তৃতীয় খ্রিষ্ট পূরবাব্দ নাগাদ এই অতি ক্ষীণকায় পুঁথিটির রচয়িতা । একজন নারীবাদী গবেষকের কাছে এই তথ্যের মূল্য কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় । তার ওপর এর সময়কাল ! এ এক অতি অভূতপূর্ব গবেষণার বিষয় ! উপরন্তু লেখাটির মধ্যে ওড্র দেশীয় ও পূর্বমাগধী এমনকি দু চারটে অদ্ভূত অপভ্রংশও ছিল যা খুবই কৌতূহলোদ্দীপক । অনুরাধা, চলভাষে এই দুঃসংবাদ টি আমাকে দিয়েছিলেন । আমি বলাই বাহুল্য আমার নিজস্ব মেধাগত কারণে কোনো জটিল বিষয়ে মনোনিবেশ করতে নিতান্ত অসমর্থ । শুধু লেখিকার নাম আর পুঁথির মধ্যে কিছু আপাত লঘু তথ্য আমার কর্ণ আকর্ষণ করেছিল । লেখিকার নামের সঙ্গে আমার নামের মিল ছিল বা আমরা একই নামের অধিকারিণী হতে পারি । ভিক্ষুণীর নাম ছিল সুপ্পন্না । আর গোতমচন্দ্রমার দুই পাশে দুই শিষ্ট হরিণ , অনিমিখ আর অভিলিখ , এই দুজনের কথাও পরম স্নেহভরে লেখা ছিল । হরিণ দুটির সঙ্গে ভিক্ষুণীর মধুর সখ্য ছিল । “হলা সউন্দলে” বলে যেমন মৃগ পরিবেষ্টিত শকুন্তলাকে তাঁর সখীরা প্রাকৃত ভাষায় ডাকাডাকি করত , তেমনই হলা সুপ্পন্নে বলে ঐ ভিক্ষুণী টিকেও ডাকা হতো । তবে অনুমান , গোষ্ঠীর মধ্যে এ ছিল অল্প বয়স্ক , নিতান্তই ফাই ফরমায়েশ খাটত বা তল্পি বাহক বলে অনুমান করা হচ্ছে । এ ছাড়া পুঁথিটির মধ্যে কিঞ্চিত অস্পষ্ট করে উল্লেখ ছিল যে গোতমচন্দ্রমা দেহত্যাগের পর অনিমিখ আর অভিলিখ আহার নিদ্রা ত্যাগ করে স্থাণুবৎ বসে থাকত । এরপর নাকি পুঁথিটিতে, একাকী অভিলিখ , বিষণ্ণ অভিলিখ , এই সব লেখা থেকে ধারণা করা হয় যে ,অন্য মৃগটি অর্থাৎ অনিমিখ আর ইহলোকে ছিল না । আমার কেবল এই টুকুমাত্রই স্মরণে ছিল । গবেষক অনুরাধা কীভাবে এই পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন এসব সবিস্তার তথ্য আমার মস্তিষ্ক ধারণ করে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল ।

কিছুদিন অতিক্রান্ত হবার পর আমি অধুনা ওড়িশার রাজধানীতে এক প্রভাবশালিনী উচ্চপদস্থার তাম্বুল করঙ্ক বাহিনীর একজন হয়ে নতুন কর্ম স্থলে গমন করি । সেই প্রভাবশালিনী উচ্চপদস্থা যেখানেই যেতেন আমি তাঁর তাম্বুল করঙ্ক বহন করে নিয়ে যেতাম । উনি এক গভীর মেঘাচ্ছন্ন দিনে এক প্রত্যন্ত গন্ড গ্রামে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন । দুয়ারে শকট তৈরিই ছিল এইসব প্রমোদ ভ্রমণ তিনি সপার্ষদ পছন্দ করতেন না । শুধু আমিই সঙ্গে ছিলাম ।
বেশ কিছু দূর চলার পর , এক অতিঘন অতিহরিত প্রান্তরে তিনি শকট থামাতে বললেন ।

আমি তাঁর সঙ্গে নামলাম । লোহিত বর্ণ মৃত্তিকার কর্দমে ঈষৎ পিচ্ছিল সেই পথের দুইধারে নিবিড় অরণ্য । সিক্ত শষ্প বীথিকা । কামিনী পুষ্পের সুবাস । ধারাজল স্নিগ্ধ পর্বত মালা । যে দিকেই দৃষ্টি যায় , যত দূর দৃষ্টি যায় হরিত বর্ণের চীনাংশুক যেন কেউ প্রসারিত করে রেখেছে । আকাশ মেঘ পূর্ণ । নীল ধূসর পিঙ্গল । কোনো গ্রামবাসীর গৃহ সম্মুখে ভুঁই চাঁপা আর রক্ত জবা উল্লসিত ভাবে প্রস্ফুটিত । এহেন মনোরম বাতাবরণে আমি তাঁর দিকে একটি তাম্বুল এগিয়ে দিতে তিনি ইঙ্গিতে না করলেন ।
আমার দুই কর্ণ কুহরে তখন আকস্মিক ভাবেই সঙ্ঘারামের প্রার্থনা ধ্বনি । সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি । কেন এমন হোলো আমার ? কোথা থেকে আসছে এই গুঞ্জন ? প্রভাবশালিনী কতিপয় পথচারীদের জিজ্ঞাসা করলেন ,” লাঙ্গুডি বৌদ্ধ স্তূপটি কোথায় ? কেউ কি অনুগ্রহ করে জানাবেন ? আমি অনেকদূর থেকে এই স্থানটি দেখব বলে এসেছি । এখানে বুদ্ধমূর্তি টি কোথায় আছে , তা জানতেই এসেছি কেবল । “
আমি মোহাবিষ্টের মত বলে উঠলাম , “লাঙ্গুডি কী ? “
তিনি একটু হাসলেন মাত্র । তারপর বললেন ,” এর সন্ধান তো কারোরই জানা ছিল না । এককালে পুষ্প গিরি বিহার নামে খ্যাত এই অঞ্চলের বিশেষ পরিচিতি ছিল । হিউ এন সাং এসেছিলেন । এমনকি সম্রাট আশোক এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষু দের সঙ্গে একটি সমাবেশে মিলিত হয়েছিলেন শোনা যায় । “

সেই নির্জন বর্ষার দ্বিপ্রহরে দুইএক জন পথিক ভিন্ন কাউকেই দেখা গেলো না । উপরন্তু, তাদের জিজ্ঞাসা করার পর তারা যৎপরোনাস্তি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলো অকারণ । সেই সিক্ত তৃণাঞ্চল পেরিয়ে কতো কতো দূর চলে গেলাম তাঁর সঙ্গে । মনে হল যেন কপিলাবস্তু নগরে রাজবধূ যশোধরার সঙ্গে চলেছি আমি , মন্দির অভিমুখে , তাঁর তাম্বুল করঙ্ক আর পূজা উপাচার বহন করে । চারদিকে বাজছে ঘন্টা , কাঁসর , শঙ্খ । বধূমাতা যশোধরা , পট্টবস্ত্র পরিহিতা , কুঙ্কুম চন্দন শোভিতা , চূর্ণ কুন্তলে চঞ্চল বাতাস । আমি তাঁর দিকে পূজার সামগ্রী এগিয়ে দিচ্ছি ।

এদিকে কতিপয় গ্রাম্য বালক সেই বর্ষণ সিক্ত দিনে নিজেরা আমোদ আহ্লাদ করছিল । আমাদের কথা শুনে সোৎসাহে হাস্যমুখে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হল । আমাদের মন থেকে সন্দেহ তখনো দূর হয় নি , আবার ভুল পথে নিয়ে যাবে নাতো এরা ? ঢালু মসৃণ তৃণাচ্ছাদিত পাহাড়ে তরতর করে চঞ্চল মৃগ বাহিনীর মতন চলছিল তারা । দেখলাম তাদের একটি সর্দার আছে । সে কিন্তু একেবারেই বালক । কিন্তু সেইই মোড়ল ।
সেই দিগন্ত প্রসারিত সবুজ প্রান্তরে তখন বিন্দু বিন্দু বর্ষণ । ধূমল মেঘের আবরণের মধ্যে শাক্যসিংহ অমিতাভ সিদ্ধার্থ দেখা দিলেন । পাথরে খোদিত । একাধিক ।

সেই প্রভাবশালিনী উচ্চপদস্থা অবশেষে প্রীত হলেন । আর আমি দেখলাম সেই সর্দার বালকটির মুখে তৃপ্তির হাসি , নাম বলল , তুফান । ওর গলায় অপূর্ব সুন্দর একটি কালো সুতোয় গাঁথা হার ।

মুখখানির দিকে তাকিয়ে আমি স্তব্ধবাক ।
দুটি বিহ্বল চোখ কী গভীর , কী ঘন আঁখি পল্লব !
অনিমিখে চেয়েছিল পথের দিকে , সেই চাহনি এলো ফিরে , কালো মেঘের ছায়ার সনে ।
বহুযুগের ওপার থেকে তখন আষাঢ় এসে গেছে ।







নিমিস , নিমেষেই শেষ হয়ে যায় । স্বাদে একেবারে স্বর্গ সুধা । এর আরেকটা নাম মাখখান মালাই পুরোনো দিল্লিতে উহুহুহুহু ঠান্ডায় যে দৌলত কি চাট পাওয়া যায় তার লখনভি সংস্করণ এই নিমিস । গল্পে বলে, মাটির পাত্রে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর , কাঁচা দুধ রেখে দিতে হবে । যে সে দিনে নয় মোটেও , পুন্নিমের চাঁদের দিনে । তারপর হুরিপরীরা নেমে কী করে আমার অত কথা জানা নেই । মোটের ওপর কয়েক ঘন্টা পরে সেই দুধ কে ভালো করে ঘুঁটতে হবে । ঘুঁটতে ঘুঁটতে ঘুঁটতে ঘুঁটতে যে আলতো আদুরে নবনীত জমা হবে তাকে আরেকটু চাঁদির তবক টবকের গয়না পরিয়ে হাজির করা হবে নিমিস। কিন্তু মুশকিল হল লখনউ তে এখন নিমিস বানানো যাবে না । বানানো যাবে না সোহন হালুয়াও । এসবের জন্য দরকার জমজমাটি ঠান্ডা । এখন মোটেই ঠান্ডা পড়েনি ।

রাম আস্রের দোকান থেকে মালাই গিলৌরি খেয়ে মনের দুঃখ একটু ভুলে আবার বেরিয়ে পড়লাম । লখনৌ এর কোনো মিষ্টি একেবারেই স্বাদে কিটকিটে নয় । কী অভিজাত মিষ্টির স্বাদ ! একেবারে মাপা । মালাই গিলৌরি লখনৌ এর সিগনেচার আইটেম । এতো হালকা এতো নরম এতো ঠিকঠাক মিষ্টির পরিমাণ ! গিলৌরি অর্থাৎ পানের মতন তিনকোণা করে মুড়ে দেওয়া হয় । সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ন্ত বিকেলের ম্লান আলোয় এলাম রেসিডেন্সি ।

রেসিডেন্সির গেট পেরিয়ে ঢুকেই আমার গায়ের রোম খাড়া খাড়া হয়ে গেল । সত্যি ! বাতাসে যে ভাইব্রেশনটি ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে তার গন্ধ টা যেন সন্দেহ জনক । বাইরে রাস্তায় যথেষ্ট লোকজন , খাবার দাবারের দোকান । কিন্তু সেই পেল্লাই ফটক টা পেরিয়ে যেই ভেতরে ঢুকে গেলাম মনে হল কারা যেন আসে পাশে , কারা যেন আশে পাশে । এই কারা রে তোরা ?

প্রচুর গাছপালা , ঘন সবুজ । হেমন্তের পড়ন্ত বিকেল । এই ম্লান আলোয় গাছ পালার মধ্যে রেসিডেন্সির ভাঙা বাড়ি গুলো ।
গেটের দারওয়ান বলেই দিয়েছিল ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ করে দেব । কোনোটা রেসিডেন্ট সাহেবের বাংলো , কোনোটা গেস্ট হাউস , কোনোটা ব্যাঙ্কোয়েট হল , অফিস , কামান, পেয়াদা বরকন্দাজ , ফোয়ারা ফানুস । নবাবের দরবারে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট সাহেব মজুত থাকত । তার খাস জমিদারি এই বিশাল এলাকা । এই সব রেসিডেন্ট সাহেব আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ দের শতরঞ্জ কে খিলাড়িতে দেখেছি আমরা ।

জমি জিরেত সবই , নবাবের কাছ থেকেই পাওয়া । মোদ্দা কথা রেসিডেন্সি বানাতে দিয়ে নবাবরা খাল কেটে কুমীর এনেছিল। আর সেই কুমীরেরা প্রবল ভাবে জাঁকিয়ে বসে এলাহি কাজ কারবার শুরু করে দেয় রেসিডেন্সির মধ্যে । সিপাহি বিদ্রোহের সময় রেসিডেন্সি ঘেরাও করে রাখা হয় প্রায় ছ’মাস আর ভেতরে চলে নির্বিচার ব্রিটিশ হত্যা । কেউ বাদ যায়নি । শিশু , মহিলা কেউই । প্রায় আড়াই হাজার মানুষ এর ভেতরে মারা গেছিল ।
লাশের পাঁজা চারদিকে ছড়ানো থাকতো । সবাইকে প্রথা মাফিক কবর দেওয়া সম্ভব হয় নি ।

এই রেসিডেন্সি , আমাদের দেশের হন্টেড হেরিটেজ জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম । অন্যতম ভুতুড়ে জায়গা ।
লোকজন বলে , রাতের বেলায় একটা শাদা চামড়ার বাচ্চা নাকি লোকজনকে বলে আমাকে বাড়ি নিয়ে চল । তারপর মিলিয়ে যায় । একটি মহিলা শাদা শাড়ি পরা , গেটের ওধারে অদৃশ্য হয়ে যায় । লখনৌ ইউনিভার্সিটির তিনটি ছেলে বাজি ধরেছিল । একজন ওখানে রাত কাটাবে বলে বাজি ধরে । পরের দিন তার মৃত দেহ পাওয়া যায় । মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক
রেসিডেন্সি নিয়ে গল্পের শেষ নেই । সাড়ে পাঁচটার পর জায়গাটা শুনশান

আমাদের ঘড়িতেও প্রায় সাড়ে পাঁচটা । ছাতিম ফুল গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে । সে কী জমাট গন্ধ রে বাবা !
খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসি । সামনেই দেখি পানি বাতাসা । এটা যদিও ভালো পানি বাতাসা খাবার জায়গা নয় তবুও আমি এগিয়ে গেলাম । পানি বাতাসা বিক্রি করছে একটা ছোট্ট খাট্টো দেহাতি মানুষ । এতো কোনোমতেই গোরা সাহেব হতেই পারে না !

- আচ্ছা ভাইসাব , এখানে মানে ওই যে , মানে ভূত টুত আছে , লোকে যে বলে ?
- কী বলবো মেমসাহেব , কেন যে লোকে ভূত ভূত করে চেঁচায় আজো অবধি বুঝতেই পারলাম না । এই তো সেদিন কী দাঙ্গাটাই না বাধলো ! আমি উট্রাম সাহেবের মিশিবাবাকে খাওয়াচ্ছিলাম । একটা গুলি এসে সাহেবের মাথা এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিল । আমি মিশিবাবাকে নিয়ে পেছনের বাগান দিয়ে দে দৌড় দে দৌড় । তারপর থেকে তো দিব্বি আছি । মিশিবাবাও আছে । একটা জোয়ান ছেলে একদিন বেশ রাতে বাংলোর বারান্দায় বসেছিল একা একা । উট্রাম সাহেব আর আরো ক’জন সাহেব বেরিয়ে এলেন । ছেলেটা দেখি
-
ও মেমসাহেব , পানি বাতাসা নিন , আরে আরে আরে ভাগতে কিউ হ্যাঁয় ?








পুব আকাশে সিঁদুরে লালের ছোট্ট একটু আলতো ছোপ । অন্ধকার সরিয়ে সেই লাল আলো যেই দেখা দিল দুটো আঙুল দিয়ে টুক করে সেই লাল রঙ তুলে নিয়ে দুই ভুরুর মাঝখানে বসিয়ে দেন নর্মদা । তারপর ঠিক দক্ষিণ মুখে সাঁতরে চলেন ।
বড় দীঘল তিনি । তার থেকেও দীর্ঘ তার চুল । সেই কুন্তল রাশি এলিয়ে বিহানের নরম আলোয় তিনি ভেসেভেসে চলছেন ।
নদীর পাশে ধর্ম পুরী গ্রাম । নদীর কিনার ঘেঁসে ব্রাহ্মণের কুঁড়েঘর । নর্মদা সেখানে আসতে আসতেই শুনতে পান গায়ত্রী মন্ত্র । তৎ সবিতুরবরেণ্যং । সবিতার স্নিগ্ধ রঙ , নর্মদার বরতনুকে একটু একটু করে সাজিয়ে দিচ্ছে । কী অপরূপ এই সাজ ! কিন্তু নর্মদা জানেন , এ সাজ সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ না সে আসছে । ব্রাহ্মণের কুটিরের কাছে তাই একটু ধীরে ধীরে চলেন তিনি । পারের কাছে একটু থামেন । উৎকর্ণ হয়ে আছে তার কান । সে আসছে । তার পায়ের ছন্দে একটি একটি করে পদ্ম ফুটে উঠছে । এক অপার্থিব সুধাকন্ঠ বিবশ করে দিচ্ছে সমস্ত প্রকৃতিকে সেই সুধাকন্ঠের পায়ে গোন্দ উপজাতির রুপোর নূপুর । তার দুইহাতে ঝকঝকে তামার থালায় সুগন্ধি ফুল, ফুলের মালা । তার পিঠ ছাপানো চুলে শিশির বিন্দুর মত জল । ফলসা পারের শাড়ি পরা সেই স্বর্গের কিন্নরী এবার দুইহাতে ফুলের অর্ঘ তুলে নর্মদাকে পুজো করতে লাগলো । নমামি দেবী নর্মদে , ত্বদীয় পাদ পঙ্কজম । নর্মদা সেই সুগন্ধি ফুলের মালা জড়িয়ে নিলেন তার চুলে , কয়েকটি ফুলে আটকে রইলো তার আঁচলে । নর্মদা দু চোখ ভরে সেই মেয়েকে দেখেন আর তার পুজো সমস্ত হৃদয় পেতে আঁজলা করে তুলে নেন । শান্ত নদীকূলে রাগ ললিত তখন ভোর ভাসিয়ে দিচ্ছে । আর নর্মদার সারাদিনের সাজও শেষ হল ।
ঘাটে বসে সেই মেয়ে পটদীপ গায় । গাইতে গাইতে রাগ হামীর ধরে , সাঁঝের বেলা প্রদীপ জ্বলে , আকাশে তারা ফোটে ,
নর্মদার পায়ের আলতা ধুয়ে যায় । সন্ধে নামে । সেই মেয়ের জ্বালানো প্রদীপের আলো দুইহাতে আলতো করে তুলে নর্মদা তাঁর সিঁথির মাঝখানে রেখে দেন । তাঁর কালো চুলে টায়রার মত ঝিকঝিক করে সেই আলো । নর্মদার সন্ধের সাজ শেষ হয় । অন্ধকারে জোনাকি জ্বলে । মেয়ে গায় মারু বেহাগ । রাত নামে ।
ধর্মপুরীর ঘাটে অন্ধকার বিলি কাটে ।
ধর্মপুরীর ব্রাহ্মণের মেয়ে রূপমতী কি শুধুই ঘাটে বসে গান গায় ? মোটেই না । সে চুলা জ্বালায় । বাজরার রুটি বানায় । আঙিনা নিকোয় । গোন্দ মেয়েদের কাছ থেকে রঙ নিয়ে রঙ্গোলি বানায় আর মা নর্মদা কে পুজো করে

তাদের মালবদেশে বর্ষা এসেছে । মালবের বর্ষায় মেঘদূত লেখা হয় । চিরবিরহের গান লেখা হয় । বিরহী কারুর মিলন চায় না । সে বিরহেই পুড়ে মরে । বিরহ মেঘ জমায় , বর্ষা হয়ে ঝরে পড়ে ।
গান গাইতে গাইতে রূপমতী ছাগল চড়ায় । যতদূর চোখ যায় সবুজে ছাওয়া পাহাড় আর উপত্যকা । রূপমতী চেয়ে দেখে প্রাবৃটের মেঘ উড়ে যাচ্ছে রস তীর্থ অলকাপুরীর দিকে । এবার ঝমঝমিয়ে নেমে আসবে । বরখা ঋতু আয়ি গাইতে গাইতে নিজেকে বাঁচাতে গাছের আড়ালে লুকোনোর বৃথা চেষ্টা করে । হাওয়ার শনশন শব্দে ভেসে আসছে , নিখুঁত সুর লাগিয়ে কে গাইছে অপূর্ব দেবকন্ঠে , কব আওগে বালমা মোরে ,বিরহন বিরহ সতায়ে । রূপমতী চমকে ওঠে । অবাক হয়ে কান পেতে শুনতে থাকে । এই জঙ্গলে কে এমন গায় ?
সেই ঘন ঘোর বর্ষায় বাজ বাহাদুর দেখলেন রূপমতীকে । আর রূপমতী, বাজ বাহাদুরকে । মিয়াঁ বাজিদ বাজবাহাদুর খান ।
এই আমাদের মালবের রাজা ? রূপমতী অবাক হয়ে যায় । ঢাল নেই, তলোয়ার নেই , সেপাই সামন্ত নেই । এ কেমন রাজা ?

--মা নর্মদা কে পুজো না করে আমি জলটুকু পর্যন্ত ছুঁই না রাজা । তোমার সঙ্গে কেমন করে যাবো ?
--তোমাকে আমি এমন জায়গায় রাখবো রূপমতী, সেখান থেকে নর্মদা দেখতে পাবে ।
সেনাদের জন্য উঁচু পাহাড়ে যে নজরদারির ব্যাবস্থা ছিল সেখানে রূপমতীর থাকার ব্যাবস্থা হল । আর তার থেকে কয়েকধাপ নিচে বাজবাহাদুরের প্রাসাদ । প্রাসাদ না ছাই ! মধ্যিখানে টলটলে জলাশয় আর চারদিক জুড়ে ছড়ানো জায়গা । শুধু গান গাওয়ার জন্যি তৈরি করা । কেমন সুন্দর শব্দ ছড়িয়ে পড়ে । গুমগুমগুমগুম । রিন রিন রিন রিন । বাজবাহাদুর বলেন ,তুমি এখানে বসে আস্তে করে সুর লাগাও , দ্যাখো আমি ওইখানে বসে কেমন শুনতে পাই !
--তাই তো রাজা ! এ কেমন করে করলে ! গাঁয়ের মেয়ের ঘোর আর কাটেনা
যেখানে বসেই গাও না কেন মনে হবে সুর তোমার পাশে এসে বসেছে । একের পর এক রাগ , মিহিন তানকারি , সুরের বিস্তার কোমল গান্ধার তীব্র মধ্যম , মন্দ্র মধ্য তার সপ্তকে ঘুরে ঘুরে প্রেম হল নিবিড় ।
রূপমতীর প্রাসাদের পাশে নর্মদা বয়ে যায় ।কিন্তু সেই আগের মতন আর হয় না । নর্মদা মুখ তুলে দেখেন সেই মেয়ে প্রাসাদের ঐ উঁচুতে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে তাঁর পুজো করছে । কই আর কাছে আসে ? বর্ষায় যখন চারদিক ঝাপসা হয়ে যায় , তখন তো আরোই তাকে দেখা যায় না ।
--রাজা , আমি জলের ধারে থাকতুম । সেই জল কোথায় পাই ?
তাই বানানো হল রেওয়া কুন্ড । প্রাসাদের কোল ঘেঁসে সেই জলে মালা ভাসিয়ে দেয় , প্রদীপ ভাসিয়ে দেয় রূপমতী । রেওয়া তো মা নর্মদারই আরেকটা নাম । নর্মদা , অতলান্ত জলের গভীরে ঘাই মেরে কুণ্ডের জলে ভেসে উঠে সেই মালা পরে নেন , প্রদীপের আলো দিয়ে বানিয়ে নেন সিঁথির টিকলি ।

পাহাড়ের কোলে এলিয়ে আছে সবুজ মালবদেশ । তার খাঁজে খাঁজে আটকে পড়ে থাকে মেঘকোনো তলোয়ার ঝনঝনিয়ে ওঠে না । বীণার তন্ত্রীতে সুর বেজে ওঠে কেবল । সে দেশ মুগ্ধ হয়ে শোনে দুই প্রণয়ীর যুগলবন্দী। “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে “ । বাজ বাহাদুর মধুবন্তী রাগ গাইতে গাইতে রূপমতীকে সাজিয়ে দেন হিরের গয়নায় । মালবসন্ধ্যায় অন্ধকারে জোনাকি জ্বলে । মল্লিকার গন্ধ মাখা রূপমতীর বরাঙ্গে হিরের অলঙ্কারের বিভোর দ্যুতিময় সঙ্গীত । অতি সুদর্শন সঙ্গীতজ্ঞ রাজা , যুদ্ধে তার মন নেই । সেনা বাহিনী নিতান্তই ক্ষুদ্র । রূপমতীকে নিয়ে মালবের সবুজ মলমলের মত জমিতে ঘোড়া নিয়ে দুলকি চালে বেড়াতে যান , হিন্দোল রাগ গাইতে গাইতে ।

এমন মধুময় মালবদেশ আর তার রাজধানী মান্ডু যার আরেকনাম প্রেম নগরী বা সাদিয়াবাদ তার ওপর কব্জা না করলে কি চলে ? মোঘল সম্রাট আকবর পাঠালেন সিপাহসালার আধম খাঁ কে ।
আধম খাঁ , আকবরের ধাইমা মাহাম আনঘার ছেলে । ইতিহাসের একটি বদ চরিত্র । উপরন্তু রূপমতীর রূপের আগুনে পতঙ্গের মতো পুড়তে চায় । বাজ বাহাদুর যে বিক্রমে পরাঙ্মুখ ছিলেন তা একেবারেই নয় । যোদ্ধা তিনি বটেই । কিন্তু ধাত টি ছিল প্রেমিকের । যুদ্ধ তিনি করলেন বটে । দফায় দফায় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত পালিয়ে গেলেন । পালিয়ে যাবার সময় তার একবারও রূপমতীর কথা মনে হল না কেন ?

আধম খাঁ র লুব্ধতায় ধিক্কার জানিয়ে রূপমতী বলেছিল তোমার কবরে কোনো মেয়ে ঢুকবে না । অভিশাপ । সেই অভিশাপ নিয়ে দিল্লির মেহরাউলিতে আধম খাঁ কবর আজও মেয়েদের কাছে অশুভ ।
রূপমতী মরেছিল । হীরক ভস্ম চূর্ণ খেয়ে । বাদশা বাজবাহাদুরও পালাতে পালাতে একদিন ধরা পড়েছিল। চিরবিরহী দুই আত্মা নর্মদার জলে ভেসে আছে আজো । এসো , ছুঁয়ে যাও তাদের একবার ।






এখন সন্ধে তাড়াতাড়ি নেমে আসে। আমার পড়ার ঘরে কোন আওয়াজ আসে না। শান্ত। ছোট্ট ছোট্ট তারার মতো আলো শখ করে জ্বালিয়ে ছিলাম।ঘন 
সন্ধেবেলা, বাতি র নরম আলো আর ধূপের ধোঁয়া লম্বা সোজা মোটা সুতোর মত উঠে গিয়ে প্রায় ছাদে গিয়ে ঠেকছে।

হীরামন বলল, জানো, আমার না ধূপদান থেকে মবখারা ভালো লাগে। ধোঁয়া টা কেমন কুলকুল করে ছোট ছোট ফুটো দিয়ে এঁকে বেঁকে বেরুতে থাকে। ওইটে আমার বেশি ভালো লাগে। যেন গলে গলে জীবনের আনন্দ বেরিয়ে আসছে। নেচে নেচে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে।

বলেই ডানা দুটো অকারণে ঝটপট করে ভুট্টার দানাগুলো ছড়িয়ে ফেলল।

আমি বললাম, মবখারা তো আমার নেই।
সেবারে সিকিমের বুদ্ধ মন্দিরে দেখেছিলাম। রাজকীয়। ওরা অবিশ্যি মবখারা বলে কী না , জানিনা।

হীরামন তার পুঁতি র মতো চোখ দুটো যতদূর সম্ভব গোল করে বলল, তোমার ছিল তো? পার্সেপোলিসের বাড়িতে আমরা কী জ্বালাতুম? মবখারাই তো? কত সুন্দর নকশা করা পাথর বসানো মবখারা ছিল তোমার।
তোমার ঘরে টাঙিয়ে দেওয়া হতো সন্ধেবেলা।
আমি বলি, অ্যাতো অ্যাতো জীবনের কথা আমার মনে থাকবে কী করে বল্ দিকি?
মবখারার মধ্যে কী জ্বালাতুম হীরামন? তোর মনে আছে?

হীরামন ঝট করে বলল, কেন? লোবান, ম্যর আর ফ্রাঙ্কইনসেন্স।
আমি বললাম, ওগুলো সব গাছের জমাট চোখের জল, জানিস? পুড়িয়ে দিলে সুগন্ধ বের হয়।
ওরা নিজেরা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে আনন্দ বিলোয়, অন্যের জন্য।

পুবের আকাশে জ্বলজ্বলে তারার মধ্যে আমাদের অরো তার ঠামিকে আর দাদুকে দেখতে পায়।
পুবের তারা আরো কিছু দেখিয়েছিল একদিন।
সেই ঝকঝকে তারা বলেছিল, সে এসে গেছে। তোমরা তাঁকে বরণ করবে না?
সেই নক্ষত্র সংকেত সামনে রেখে পুবের তিন প্রাজ্ঞ এক সফরে বেরিয়ে ছিলেন।
তাঁকে বরণ করার জন্য তাঁরা সঙ্গে নিয়ে ছিলেন, সোনা, ফ্র্যাঙ্কইনসেন্স আর ম্যর।

সোনা দিয়ে রাজাকে সম্মান জানাতে হয়। যে আসছে , সে তো রাজাই, মানুষের হৃদয়ে র রাজা।মুক্তির রাজা।

ফ্র্যঙ্ক ইনসেন্সের সুগন্ধের মতো রাজার মহিমা ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। সেই মহিমায় দম্ভ নেই ,আছে নিবিড় শান্তি, শুশ্রূষা, প্রেম, আশ্রয়।

ম্যরের স্পর্শে নিরাময়,জীবন, বেঁচে থাকার শক্তি,যা সেই রাজার কাছ থেকে সবাই, সক্কলে পেয়েছিল।

কাঁটার মুকুট পরা রাজার হাতে পায়ে পেরেকের আঘাতে রক্ত ঝরছিল। তখনো কেউ কেউ ম্যর লাগিয়ে দিচ্ছিল, যদি ব্যথা একটু কমে! একটু যদি হৃদয়ের রাজা স্বস্তি পায়!
ম্যাথু লিখিত সমাচার, বাইবেলে ধরে রেখেছে সেইসব আখ্যান।
রাজার পুনরুত্থান হয়েছিল,ওই ম্যরের মৃত সঞ্জীবনী সুধাশক্তির মতো!

⭐⭐⭐

"প্রভাতের একটি রবিরশ্মি রুদ্ধদ্বারের নিম্নপ্রান্তে তির্যক্‌ হয়ে পড়েছে। সম্মিলিত জনসংঘ আপন নাড়ীতে নাড়ীতে যেন শুনতে পেলে সৃষ্টির সেই প্রথম পরমবাণী– মাতা, দ্বার খোলো। দ্বার খুলে গেলমা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু, উষার কোলে যেন শুকতারা। দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল। কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে– জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের। সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মূঢ়; উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে– জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।"





সেই কাকভোরে নর্মদার ঘাটে এসেছি। একটু আবডালে তুলোট কাগজ আর ভুষো খড়ি নিয়ে বসেছি। মা নর্মদার একখানা ছবি আঁকব, ভোরের আলোয়। 



বেশিক্ষণ তো বসা যাবে না। রানি মা আসবেন ঘাটে। আমাদের রানি মা, অহল্যাবাঈ। অহল্যাবাঈ হোলকার।আমাদের আকাশ, আমাদের আশ্রয়।

হীরামনকে দুটো দানা ছড়িয়ে কাঁধ থেকে নামিয়েছি। ভোরের আলো। শান্ত। নর্মদাও শান্ত। মন্থর। বাঁশি র সুরের মত মগ্ন উদাস হয়ে গেলাম। আমার অমন অবাধ্য হীরামন ও অদ্ভুত চুপচাপ।

হঠাৎই সরু গলার চিৎকার, রানিমার সাতনরী হার , ভেসে গেল, ভেসে গেল, ভেসে গেল। বিঠ্ঠল, অ্যাই বিঠ্ঠল, এদিকে আয় শিগগির।

আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। হীরামন শোঁ করে উড়ে দেখতে গেল কী হচ্ছে সেখানে!
রানিমা তাহলে ঘাটে এসে গেছেন! জানতেও পারিনি।
বিঠ্ঠলকে বিলক্ষণ চিনি। রানি মার ছত্রধারী। সাঁতার ডুব সাঁতার ওর কাছে নস্যি।

রানি মার সেবিকারা সব ডাকছে, বিঠ্ঠল জলদি আয় , জলে নাম এক্ষুনি।
ছাতা হাতে বিঠ্ঠল দৌড়ে আসছে।
আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা পা তুলে ছাতা সামলিয়ে আরেকটা হাত দিয়ে পায়ের কাছে কী যেন করছে!
মেয়েরা বলে, ওরে করিস কী?
বিঠ্ঠল বলে , বেলকাঁটা ফুটেছে পায়ে।

হীরামন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল!
আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বিঠ্ঠলের অদ্ভুত ভঙ্গি টা ছবি করে নিলাম।

তারপর একদিন ভরা বর্ষায় নর্মদা ফুঁসছে।
আমি ভিজে চুব্বুস। দেখি, মাহেশ্বরের মন্দিরের গায়ে ছাঁচে আটকে আছে আমার দেখা আমার আঁকা,বিঠ্ঠল।
বিশ্বাস না হয়, দেখে আসুন। আমার হীরামনের দিব্যি!



এই কিসসা খোদ ইবন বতুতার মুখ থেকেই শোনা । বাইরে জাঁকিয়ে শীত । পরিষ্কার আকাশে তারাগুলো এতো কাছে , মনে হচ্ছে হাত দিয়ে টুপ করে পেড়ে নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজে ফেলি । এতো সহজে যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন এ সুযোগ ছাড়া কি উচিত ? রাতের জন্য আস্তানা গেড়েছি ক্যারাভান সরাইতে । কীকরে জানব এখানে ইবন বতুতাও এসে বসেছেন ? ইবন , দস্যুদের হাতে নাকাল হয়েছেন অনেক বার । সেই ভয়ে আমাদের মতই দিনের শেষে ক্যারাভান সরাই তার মতন কেউকেটারও ভরসা । ভেতরে ঝিম মেরে বসেছে অন্ধকার , কালো আদুরে বেড়ালের মত । একটা আঙটায় ধিক ধিক তুষ । ইবন বসেছেন দুটো তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে । মাটির এবড়ো খেবড়ো দেওয়ালে ধিকি ধিকি আগুন নকশা কাটছে ,সেই নকশাই আবার রঙিন পশমে বুনে বুনে আমাদের জড়িয়ে ধরেছে শাল আর বালাপোষ হয়ে । কটকটে গরম কফি, তিতকুটে ,সঙ্গে কুমড়ো বিচি ভাজা কাঠ বাদাম । আমাকে আবার কুমড়ো বিচি আর কাঠ বাদাম ডান হাত দিয়ে নিয়ে বাঁ কাঁধের ওপরে নিয়ে যেতে হচ্ছে । উফ , হীরামন বসে আছে আমার বাঁ কাঁধে , অমন সাধের পশমিনা আংরাখা একেবারে দশ নখে আঁকড়ে । ব্যাটা গল্প শুনতে পেলে আর কিছুই চায় না । আবার ফোড়ন কাটবে কানের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে । দিহিলিতে ছেড়ে এসেছে তার দুই স্যাঙাৎ রুমি আর চিনার কে । কাজেই আমাকে জ্বালিয়ে মারছে আর কী ।

ইবন শোনাচ্ছিলেন মালাবারের দারুচিনি বনে ঘনিয়ে ওঠা বিকেলের গল্প । সেখান থেকে ইবন ভেসে যান সিলোনে । সিলোনে গিয়ে তিনি তাজ্জব বনে যান । সেই দেশের চারিদিকে চুনি , লাল টকটকে চুনি । মেয়েদের গায়ে গলায় হাতে চুনির গয়না । একটা শাদা হাতির মাথায় চুনি, একটা নয় , সাতটা বড় বড় চুনি , মুরগির ডিমের মত বড় । সুলতানের হাতে একটা চুনি দিয়ে বানানো বাটি । তার মধ্যে ঘৃতকুমারীর তেল । উরিব্বাবা ! সুলতান বললেন , এ আর কী ? আমাদের এরম কত আছে !

আমরা সবাই ইবন বতুতার চারদিকে ঘন হয়ে গুছিয়ে বসলাম । ইবন ইশারায় আরও কফি আনতে বললেন । ক্যারাভান সরাই এর ফরমাশ খাটা ছেলেরা জালি দেওয়া মবখারা টাঙিয়ে দিয়ে গেলো । জালির ভেতর দিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে জ্বলন্ত লবানের ধোঁয়া । আঙটার তুষের ওম । এ কোণে ও কোণে একটা দুটো কালো পাঁশুটে বেড়াল । বেড়াল দেখলেই হীরামন আরো নখ দিয়ে আমার পশমিনা আংরাখা চেপে বসছে । অবশ্য হীরামন যা ঝগড়ুটে !

গলা খাঁকড়িয়ে ইবন , মুখে দুটো লবঙ্গ ফেলে বললেন , সে এক আশ্চর্য ব্যাপার দেখলাম , বুঝলেন ! সবে চিন দেশ ছেড়েছি । সমুদ্রের কোন অজানা অঞ্চল দিয়ে চলেছি মাঝিমাল্লার দল বুঝতেই পারছে না । শোঁ শোঁ হাওয়া । আকাশ কালো অন্ধকার । দশ দিন সূর্যের মুখ দেখিনিবেঁচে থাকবো কি না বুঝতেই পারছি না !জাহাজের সবাই আবার চিন দেশে ফিরে যেতে চাইলো কিন্তু তখন তা আর সম্ভব নয় । বিয়াল্লিশ দিন সমুদ্রে আমাদের এইভাবেই কাটল । অনিশ্চিত । কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হতে চলেছে । তেতাল্লিশ দিনে দূর থেকে একটা পাহাড় দেখা গেল । পাহাড় ! মানে ডাঙা ! বাতাসের বেগ আমাদের সেই দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল । জলের মধ্যে পাহাড় ! অভিজ্ঞ নাবিকের দল বলাবলি করতে লাগলো, এরম কোনো ধারণাই তাদের নেই । কোথাও মস্ত বড় কিছু ভুল হচ্ছে !
বললে বিশ্বাস করবেন না , সবাই ইষ্টনাম জপতে শুরু করলো । বিপদে একমাত্র ঈশ্বরই ভরসা ! আমি সেসব কথা আমার রিহলাতে লিখে রেখেছি ।
যাইহোক , কিছুক্ষণ পর বাতাস একটু শান্ত হল । তারপর হালকা রোদ্দুর ফুটে উঠল । পাহাড়টা আরো স্পষ্ট হল আমাদের কাছে । আমরা সবাই কী দেখলাম জানেন ?
পাহাড়টা একটু একটু করে ওপরে উঠছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমরা তো বাক্যিহারা । মুখে কারো কথা সরছে নাআবার ও দিকে মাঝিমাল্লার দল একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কী কান্না কী কান্না !

গল্পের মাঝখানেই আমরা সবাই প্রায় দমবন্ধ করে বলে উঠলাম , কেন ? কেন ?
ইবন বললেন, আমি মাল্লাদের শুধোলাম , ওহে তোমরা অমন করছ কেন ?
ওরা কী বলল জানেন ? আজ্ঞে হুজুর , ওটা রক পাখি , রক পাখি । পাহাড় নয় । একবার যদি আমাদের দেখতে পায় আমরা তাহলে আজ বেঁচে ফিরবো না ।
তখন সেই পাখি মাত্র দশ মাইল দূরে । কী বিশাল ,কী বিশাল ! একটা প্রকান্ড পাহাড়ের মত দেখতে । ঈশ্বরের কী করুণা জানিনা , বাতাস আমাদের অন্যদিকে দ্রুত ভাসিয়ে নিয়ে গেল ।
সে পাখির আসল চেহারা কী ,তা জানার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনোটাই হয় নি সেদিন ! খুব জোর বেঁচে গেলাম আমরা !

আমরা সবাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলাম , আরব্য রজনীর সিন্দবাদ সওদাগরের গল্পে রক পাখির কথা শুনেছি বটে !সিন্দবাদ ও ওরকম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল । আমরা ভাবতাম সেটা নেহাতই গল্প । রকের আবার দুটো মাথাও দেখা যায় । দুই পায়ে মস্ত হাতি নিয়ে আকাশে উড়ছে ।
হীরামন টা বেশি পাকা ! আমার কানের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে বলল , জটায়ু আর গড়ুর , এরাও তাহলে সত্যি সত্যি আছে , অ্যাঁ? আমাদের পাখিদের বংশ খুব সম্ভ্রান্ত , জানো !
আমি তাড়াতাড়ি বললুম , চুপ চুপ একদম । এতো বড় একজন ভূ পর্যটক সমানে বসে আছেন । এনার সামনে একদম মুখ খুলবি না !
আমাদের অবিশ্যি মুখ খুলতে হল কারণ ভেড়ার মাংসের গরমাগরম সোবরা এসে গেছে । লবানের ধোঁয়ার সঙ্গে সোবরার হালকা হালকা ধোঁয়ায় গন্ধের আরামে একেবারে চোখ বুজে আসছে । শীতটা যা পড়েছে !

তারপর কবে জনিনা , সেই ধোঁয়া গলে গলে গলে গলে হঠাত দেখি ফনফনে সমুদ্রের ফ্যানা হয়ে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিচ্ছে । গরম গরম রসমের সঙ্গে মুচমুচে সুরমাই মাছ ভাজা খাচ্ছি । এমন সময় হীরামন একটা কাগজ এনে কোলের ওপর ফেলে বলল পড়ো দিকিনি ! সেই মনে পড়ে , সেদিন তো আমায় খুব চুপ করিয়ে দিয়েছিলে । এই দ্যাকো , ওই রক পাখি আমাদের এই দেশেও ছিল । ষষ্টি চরণের মতো হাতি নিয়েও লোফালুফি করত ।
পড়লাম , গণ্ডবেরুন্ড পাখি । এক রাজ্যের সরকারি সিম্বলও ছিল এককালে । কখনো দুই বা একমাথা । বেশির ভাগই দুই মাথা । বিশাল পায়ের নখে লুতুপুতু করছে পুতুলের মত হাতি । আরে এযে এক্কেবারে রক পাখি!

হীরামন বড্ড পাকা ! বলে কী , এতে অদ্ভুত কী আছে ? এতোদিন ধরে তোমার সঙ্গে দেশে দেশে কালে কালে তো কম ঘুরছি না । কোথায় হকিকত শেষ হয়ে আজগুবি শুরু হচ্ছে সে টা বোঝাও আমায় ! সব সত্যি ! একেবারে জিলিপির প্যাঁচের মত সত্যি ! হকিকত আর আজগুবিতে আসলে কোনও ফারাক নেই । এ মজার শেষ নেই ! নাও নাও ওঠো , এরা খুব ভালো কলার চিপস বানাও । আমাকে কিনে দাও দেখি !
আমি ওর মাথায় একটা টোকা মেরে বললাম , হীরামন, ইউ রক !!!


তথ্য সূত্র ঃ The travels of Ibn Batuttah













বাড়িটার নাম প্রসন্ন কুটির । বেশ নকশা করা পেল্লাই ফটক । শুধু দুটো গুঁফো দারোয়ানের অভাব ছিল । সেই বাড়িতে মানানসই ভাবে যথেষ্টই গাছপালা ছিল । ছোট্ট চৌকো সবুজ জমি । আর ফটকের পাশে একটা লম্বা ঝাউগাছ । সেই ঝাউ গাছ জড়িয়ে জড়িয়ে ওপরে উঠেছে একটা বনমালতী । সেই বাড়ির এক তলায় মিঠুরা থাকত । কখনো কখনো মফস্বল শহরে হাকিম সাহেবদের জন্য কোনো বেসরকারি বাড়ি নির্দিষ্ট করা থাকতো । মিঠু দেবের বাবার বদলির চাকরি ছিল । মিঠু দেবকেও তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হতো । অনেক পরে মিঠু দেব যখন চাকরি পেল দেখা গেল সেটিও ভয়ানক রকমের বদলির চাকরি । তবে বদলির চাকরির একটা ভালো দিক আছে । জীবনটা বেশ নদীর মত হয়ে যায় । আজ এই শহর ,কাল ওই মুলুক , পরশু সেই গঞ্জ । আজ কারুর বাগানে দুটো চাঁপা ফুল এক মুঠি শিউলি , কাল কারুর রান্নাঘরে মাছের কচুরি , পরশু অডিটোরিয়ামে সেই নাটকে অমল সেজেছিলো মিঠু দেব । রাজ বৈদ্য বলছে , এলো এলো ওর ঘুম এলো , আমি বালকের শিয়রের কাছে বসবো ,প্রদীপের আলো নিভিয়ে দাও, এখন আকাশের তারাটি থেকে আলো আসুক...”

দর্শকের আসনে মিঠু দেবের মায়ের চোখে জল এসে যায় । এখখুনি অমল মরে যাবে । মিঠুদেবের মাও গান গাইতো। রিহার্সালে নিখিল বাবু বলতেন আমি প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে শুনবো । সবাই খুব ভয় পেয়ে যেত । এইভাবে নদীর মত কত ঘাটে ঘাটে থামতে থামতে , ইয়ে মানে কত ঘাটের জল খেতে খেতে চলা , কত নতুন বন্ধু হল , আবার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ! এই মানিয়ে নেওয়া, সইয়ে নেওয়া , বিচ্ছেদ ও বিস্মৃতি এক ধরনের দর্শনের জন্ম দেয় । কত কিছু কুড়িয়ে নিয়ে আবার কত কিছু ফেলে দিয়ে চলা । স্মৃতি তোরঙ্গটি কেবল সঙ্গে সঙ্গে চলে ।

এদিকে হল কী সেই বাড়িতে মিঠু দেবের সখী হল একটি মেয়ে । মেয়েটির নাম সুরঞ্জনা । না, তখনো মিঠু দেব জীবনানন্দ পড়েনি । অথচ সে সুভাষ মুখুজ্জে শিখেছে মানে তাকে শেখানো হয়েছে । মঙ্গলাচরণের “ ক্ষুদি রামের মা আমার, কানাইলালের মা , জননী যন্ত্রণা আমার জননী যন্ত্রণা “ পর্যন্তও সে বলতে পারত কিন্তু !
সেরকমি এক সময়ে নতুন ইস্কুল নতুন বন্ধু , তাদের কিঞ্চিৎ বোকা বোকা র ্যা গিং এ আজন্ম গোবেচারা মিঠু দেব শুনতে পেল তার বাবা , মাকে বলছেন , মিঠুদের স্কুলের হেড মিস্ট্রেস সুচরিতা দাশ , জীবনানন্দ দাশের বোন , জানলাম আজকে ।
মিঠু দেব সুচরিতা দাশ কে ইস্কুলে প্রত্যেকদিন দেখে থাকে । উনি পাটে পাটে শাড়ি পরেন , খুড় ওয়ালা কালো জুতো পরেন , মাথার কোঁচকানো চুলে খোঁপা করা থাকে । তিনি অরগ্যানের পাশে এসে ছবির মত দাঁড়িয়ে থাকেন ।
মিঠু দেবের বাবার সঙ্গে সুচরিতা দাশের অচিরেই ভালো সখ্য হয় । ইস্কুলের বড়দিদিমনি হলেও মিঠু দেবকে তার বাবা মায়ের সঙ্গে সুচরিতা দাশের বাড়ি যেতে হতো । কারণ তিনি ঘন ঘন নেমতন্ন করতেন । সেখানে অতি উত্তম খাওয়া দাওয়া থাকত । রসগোল্লার পায়েস খুব চমৎকার বানাতেন উনি । তবে মিঠু দেবের বাবা খুব প্রশংসা করতেন সুচরিতাদির বাড়ির চা এর । উৎকৃষ্ট দার্জিলিং চা , সেই মফস্বলেও ওনার বাড়ি পাওয়া যেত । অত্যন্ত অভিজাত ও পরিশীলিত ছিলেন তিনি । সেখানেই মিঠু দেব দেখেছিল লাবণ্য দাশকে । তিনি জীবনানন্দের স্ত্রী । অনেক অনেক পরে মিঠু দেব জানতে পারে সুচরিতাদি ক্যান্সারে মারা গেছেন ।

স্মৃতি ছবির রঙ সবসময় এক থাকে না । কখনো কখনো ফিকে হয় , ফ্যাকাশে হয় ।জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে যায় । সেরকমই এই সুরঞ্জনার দেখা আর পাওয়া গেলনা । সে আজো পৃথিবীতে কোনো বয়সিনী মেয়ের মত আছে নিশ্চয়ই কিন্তু সে ছবি আর উজ্জ্বলতর না হয়ে প্রায় ছবি রেস্টোরেশনের সেকশনে ঢুকে গেছে । সেই যে লম্বা ঝাউ আর তার লতানে বনমালতী তলায় দুটি বালিকা খেলে বেড়াত তাদের নিয়ে মিঠু দেবের বাবা এক খানা ছড়া লিখেছিলেন । সুরঞ্জনার রঙ ফিকে হলেও সেই ছড়া টি মিঠু দেব দিব্যি মনে রেখেছেন । এই বহমান নদীর বাঁকে বাঁকে শুধু রহস্য !

বন মালতী লতার সঙ্গে আজকে ঝাউ এর বিয়ে
তাই দেখতে ছুটে এলো চুলবুলে দুই টিয়ে
প্রসন্ন এই কুটিরে তোমরা এই দুটিরে
আশীর্বাদ করো কিন্তু রুপোর টাকা দিয়ে “

মজার কথা কথা হল মিঠু দেবের বাবা পড়াতে পড়াতে কবিতা দিব্যি লিখে ফেলতেন। এমনি ভাবে কত কবিতার অনুবাদ হয়ে গেছে । কখনো লিখে রাখা হয়েছে , কখনো হয়নি । কখনো স্মৃতি শুধু ধরে রেখেছে ।
মিঠু দেবের বাবা একবার টেনিসন পড়াচ্ছিলেন ,

Break break break
At the foot of thy crags, O Sea!
But the tender grace of a day that is dead
Will never come back to me

মুখেই মুখেই মিঠু দেবের বাবা বললেন

ভেঙে ভেঙে পড়ো ঊর্মিরা উদাসীন
খাড়া পাহাড়ের পাদ মূলে বারবার
স্নিগ্ধ মধুর আমার সেসব দিন
জানি চলে গেছে , ফিরবে না কভু আর “

কিছুই আর আগের মতন নেই, থাকে না । তবু কখনো কখনো স্মৃতি তোরঙ্গের ঢাকার ভেতর দিয়ে কীভাবে বেরিয়ে পড়ে এলোমেলো এসব লাইন , মিঠু দেব ভেবেই পায় না !





































বিধাতার পিঙ্গল কেশ রাশিতে জট লেগেছে ।উত্তুরে হাওয়ায় খড়খড়ে হয়ে গেছে গায়ের চামড়া । মুখে অজস্র বলিরেখা , চোখ দুটো ঘোলাটে আর চোখের তলায় পুরু কালি বলে দিচ্ছে তিনি ইদানিং বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন । হনহন করে এসে খুব বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলেন ,

শোনো , আমি আর দেরি করতে পারব না । কালই আমি মহা প্লাবন আনব । তুমি এই বেলা পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে নাও ।

যাকে উদ্দেশ্য করে তিনি এই কথাগুলো বলছিলেন সেই নোয়াহ তখন একটা পাথরের ওপর বসে একটা লম্বা লতানে গাছ পাকিয়ে পাকিয়ে তাঁর নতুন বল্কলের দড়ি বানাচ্ছিলেন । খুব অবাক হয়ে মুখ তুলে বললেন ,

সে কী ! আপনি তিন দিন পরে প্লাবন আনবেন বলেছিলেন । এখনো কত কাজ বাকি । জাহাজটার পাটাতন মেরামত করতে হবে । পাল টার গায়ে বেশ কিছু তাপ্পি লাগাতে হবে । অমন পেল্লাই তিন থাক জাহাজ ! সব ঘর গেরস্থালি গুছিয়ে তুলে নিয়ে ভেসে পড়তে হবে । বাঁচবো কি মরবো ঠিক নেই , আর আপনি হুট করে এসে বলছেন কালকেই প্লাবন আনবেন ! তাছাড়া আমার বল্কল টাও বানানো শেষ হয় নি ।

বিধাতা খুবই রাগের সঙ্গে বলে উঠলেন , পাপের ভার আর আমি বইতে পাচ্ছিনা ! এতো পাপ আর পাপের বিষে আমার ভালো করে নিঃশ্বাস নেওয়া হচ্ছে না । আমি ঘুমুতে পারি না । আদম আর ইভের বংশধরেরা আমার কালঘাম ছুটিয়ে দেবে জানলে আমি কখখনো মানুষ বানাতুমই না । শোনো হে নোয়াহ , আমি তোমাকে আর সময় দিতে পারব না । যা যা করবার এখখুনি কর । আমি কাল ঘোর প্লাবন নিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করে দেব । তোমাকে যেমন যেমন বলে রেখেছি , যাও করে ফেলো চটপট ।

এই বলে বিধাতা একটা পাঁশুটে মেঘের আড়ালে হাওয়া হয়ে গেলেন ।

নোয়াহ আর যাই হোক , বিধাতার মুখে মুখে কী করে তক্কো করেন? উপরন্তু তিনি বিধাতার বিশেষ প্রিয়পাত্র । তাঁর ওপর বিধাতা একটি অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব দিতে চলেছেন । নোয়াহ পড়িমরি করে ছুটে বউ কে ডেকে বললেন , গিন্নি , প্রভু বেজায় চটে আছেন । যা যা গোছাবার , এই বেলা গুছিয়ে নাও । মনে আছে তো কী কী নিতে হবে সঙ্গে ? আমি যাই জাহাজ টার পাটাতন ,পাল এইসব ঠিক করিগে ।

বিধাতা প্লাবন তুললেন । সে এক কীর্তিনাশা মহাপ্লাবন । ফুলে উঠলো সমুদ্র । প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে গেলো । সব । জীবনের কোন চিহ্নই রইলো না । শুধু তোলপাড় জলরাশির মধ্যে গর্জনশীল চল্লিশার ঢেউ এর মধ্যে আছাড়িবিছাড়ি খেতে লাগল মোচার খোলার মতো একটা জাহাজ । হ্যাঁ , ওটাই নোয়াহর তিনতলা জাহাজ । প্রলয়পয়োধি জলে তখন কেশব বিষ্ণু , নৌকার মতো মৎস্য অবতার হয়ে ডুবন্ত প্রাণকে রক্ষা করছিলেন কোথাও বা ।
নোয়াহর তিনতলা জাহাজও বাঁচালো , ঐ মৎস্য অবতারের মতই সমস্ত প্রাণ কেও বাঁচালো । নোয়াহ তাঁর বৌকে বলেছিলেন সব প্রাণীদের ভেতর থেকে একটি নারী আর একটি পুরুষ বেছে নিয়ে ভেসে পড়ি চল । আবার যদি কোথাও গিয়ে ঘর গেরস্থালী বাঁধতে পারি । জীবন রুইতে পারি কোনদিন !

এই ভাবে জলের প্লাবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে ভাসন্ত ডুবন্ত নোয়াহ একদিন দেখলেন , নাহ ,অতটা উথাল পাথাল মনে হচ্ছে না আজ ! তিনি জাহাজের কুঠরি থেকে বেরিয়ে দেখলেন দিগন্তে এক পাহাড়ের আবছা ছায়া ।

আবার এদিকে কোথায় যেন মন্দার পর্বতকে দণ্ড করে ক্ষীর সমুদ্র মন্থন হচ্ছিল । কেশব বিষ্ণু কচ্ছপ হয়ে তাঁর পিঠের শক্ত খোলের ওপর সেই পাহাড়কে তুলে নিলেন । মন্থন হল শেষ , উঠল অমৃত । প্রাণ কে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খাবার চাই ।

নোয়াহর জাহাজও এতোদিন পর যেন জিরোতে চাইছে । সেই পাহাড় দুধেল গাইয়ের মতো তুলতুলে বরফে মোড়া । নোয়াহর মুখে বিজয়ীর হাসি । চিৎকার করে বলে উঠলেন , গিন্নি ও গিন্নি বাইরে এসে দ্যাখো একবার । এই পাহাড়ের গায়ে জাহাজটাকে ভিড়িয়ে দি । চল একটু ডাঙায় নামি । মনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে গেলুম গো !

নোয়াহর জাহাজ থামল ।সেই পাহাড়ের তলায় । জাহাজ বাঁধা হল পাহাড়ের গায়ে । নোয়াহ , সেই প্লাবন পূর্ব যুগের আদিপিতা , আদি মাতাকে ডাক দিয়ে বললেন , ভাঁড়ারে কী কী আছে দ্যাখো একবার । কিছু একটা রাঁধতে ভারি ইচ্ছে করছে । গিন্নি ভাঁড়ার হাটকে বললেন এই যা আছে নাও । নোয়াহ জুলজুল করে দেখলেন কয়েক দানা গম । কিছু যব , একটু আধটু দানা এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটনো, ফলের দানা , দুটো বাদাম । তাই নিয়ে নোয়াহ পুডিং রাঁধতে বসে গেলেন । পুডিং বা পিষ্টক সে যাই হোক না কেন , তিনি মহানন্দে সেই পুডিং বানিয়ে গিন্নি আর যত কটি প্রাণী তাদের সঙ্গে ছিল সব্বাইকে নিয়ে খেতে বসলেন । এর নাম আশুরে । মধুসূদনের ভাঁড়ের মত সেই খাবারে বেশ কুলিয়ে গেল সব্বার । খেয়েদেয়ে সেই বরফ তুলতুলে পাহাড়ের কোলে বসে খানিক বিশ্রাম নিলেন তিনি ।
এই আরারত পাহাড় , আর্মেনিয়া আর তুরস্কের সীমানায় । হিব্রু বাইবেলের জেনেসিসে এইসব গল্প লেখা হয়েছে । আরমানি তুর্কিতে একেবারে সাপে নেউলে সম্পর্ক । এখন দু দেশের সীমান্ত বন্ধ । এদিকে মহরম মাসের দশ তারিখে মানে আশুরের দিন তুরস্কে বানানো হয় নোয়াহর আশুরে পুডিং । পরিমানে অনেকটা করে । সবার মধ্যে ভাগ করে খাওয়া হয় । প্যাকেটে প্যাকেটে বাক্সে বাক্সে বাড়িবাড়ি পাঠানো হয় । ইহুদি ,আদি খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মের গোলোক ধাঁধায় দুই দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে আরারাত পাহাড় মুচকি মুচকি হাসে । সে তুরস্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে ।অথচ আরমানির জাতীয় প্রতীকে দিব্যি রয়ে গেছেন !
বড় পবিত্র এই আশুরে । এই দিনে নাকি বিধাতা আদমের রাশি রাশি পাপ ক্ষমা করে দেন , নোয়াহর জাহাজ মহাপ্লাবনের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পায় , নোয়াহ মিস্টি মিস্টি আশুরে রাঁধেন আর জীবকুল আবার বাঁচতে শুরু করে । আবার আকাশ হেসে ওঠে , ফুল ফোটে চাঁদ ওঠে । ছেলেটি বাঁশি বাজায় , মেয়েটি সুর তোলে । ছেলেটির কাঁধে টিয়া পাখি শিস দিয়ে ডেকে ওঠে । জীবন রোপিত হয় আবার!

সেই যে সব প্রাণ একটি একটি করে বেঁচে গেল , তারমধ্যে আমিও বাঁচলাম , বেঁচে রইলো আমার হীরামনও । সে এখন বেশ ডাগর ডোগর । বাঁকানো লাল ঠোঁট , চকচকে সবুজ পালক । আমার কাঁধে বসে থাকে । এখোনো বসে আছে । তাকে কাঁধে নিয়েই আমি চলেছি । মেহরাউলির পথে । শুধু আমি একা নই । গোটা শাহজাহানাবাদ আমার সঙ্গে চলেছে । আমার সঙ্গে চলেছে বললে ভুল বলা হবে । চলেছে সব বাদশার সঙ্গে । বলতে গেলে শাহজাহানাবাদ আজ ফাঁকা । বাদশা সাজগোজ করে চতুর্দোলা সাজিয়ে মেহরাউলির পথে চলেছেনবাদশা চলেছেন তাঁর প্রিয় উৎসবে । শুধু বাদশার নয় ,তামাম শাহজাহানাবাদের বড় খুশির তেওহার । ফুলওয়ালো কি সয়ের । সয়ের এ গুল ফারো শাঁ । ফুল ব্যাবসায়ীদের মোচ্ছব । চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙ । এই ফুলগুলো দিয়ে বড় বড় ঝালর দেওয়া লম্বা লম্বা পাখা বানানো হয় । লাল হলুদ গোলাপি কমলা রঙের ফুলের বাহারে চোখ ঝলসে ওঠেপাখার চারদিকে সোনালি রুপুলি জরির ঝালর । শোভাযাত্রা করে এই রঙিন পথচলা । বাদশা আর শাহজাদা শাহজাদিদের দোলা সবার আগে ।

হীরামন বলল , না নাআ , ঠিক বলছ না , সবার আগে নফিরিওয়ালা । তারা চলত তাদের নাকাড়া বা ডঙ্কা বাজিয়ে ।

তারপর ?

হীরামন বলে , ভুলে গেছ সব ? তারপর থাকত গাইয়ের দল আর সানাই । কী রাগ বাজত মনে আছে ? নাকি তাও ভুলে বসে আছো ?

আমি বললাম , নানা মনে আছে, মনে আছে মল্লার , মল্লার ।

আকাশে তখন শাওন ভাদোর নখরা । এই ঝিরঝিরে বৃষ্টি , এই রোদ উঠে গেলো । ভেজা পথে লটকে পড়ে থাকে অকাল গুলমোহর । আর বাতাস পাগল করে উড়ে বেড়ায় গোলাপের পাপড়ির সুগন্ধ । তার সঙ্গে রংমিশালি পতঙ্গ , ঘুড়ি ।
বাদশা জাফরের খুব প্রিয় উৎসব । আমি মুখিয়ে থাকতাম কখন দেখব সেই প্যায়জনিয়া পরা টুকটুকে গোলাপি পা , মাটিতে তার নাজুক বুড়ো আঙুলের চাপ । অমনি মাথায় হীরামন ঠুকরে দেয় , খুব লায়েক হয়েছ না ? সব বুঝি আমি

হীরামন এক দন্ড দাঁড়াতে দেয় না । তাকে চারদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে হয় । মেহরাউলির বাড়িগুলো একেবারে চম কাচ্ছে । ঝকঝক করছে সরাই খানা । কোথাও ফাঁকা নেই । ছন ছনানানা , ঘুঙরু বাজে । হুঁকোর গলায় ফুলের মালা জড়ানো ।
পান খেয়ে মুখ লাল । মিঠাইওয়ালা মিঠাই বানায় । তন্দুর ভরতি খমিরি রুটি । বড় বড় মটকা ভর্তি ঠান্ডা জল ।

মিয়াঁ , আব এ হায়াত পিলাউ ?

আব এ হায়াত , জীবনের জল । বয়েই চলেছে , বয়েই চলেছে কত ঘাটে ঘাটে থামছে , কত গন্ধ মাখছে , কত রকম পাত্রে ঢুকছে , আবার মেঘ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে ।
আমি আর হীরামন কেওড়া দেওয়া ঠান্ডা জল খাই । আবার হাঁটি । সন্ধে বেলা বড় তালাও এ আতশ বাজি জ্বলবে । হীরামন আবার বাজি দেখলে ভয় পায় !
বাদশা জাফর প্রথমে থামবেন মা যোগমায়ার মন্দিরে । সেখানে ফুলের চাদর পেতে দেবেন । সক্কলে চাদর পেতে দেবে । সেখানে প্রসাদ খাওয়া হবে সবাই মিলে । আমরাও খাবো ।

তিনদিন ধরে সারা মেহরাউলিতে আনন্দলহরী । মা যোগমায়া মন্দিরের পরে ফুলের চাদর বিছিয়ে দেওয়া হবে কুতুবুদ্দিন বাখতিয়ার কাকি বা কুতুব সাহাবের দরগায় । সুফিসন্ত কুতুব সাহাব আর মা যোগমায়ার প্রেমের আলোর সুতো গেঁথে তুলছে এক অপূর্ব ফুলের মালা । হীরামন বলে তুমি জানো এই মালার নাম কী ?
আমি বললুম ,তুই বল না ! তুই তো খুব ওস্তাদ ! সব জানিস ।
এর নাম গঙ্গা জমুনি তেহজিব । এই মালা লম্বা হয়ে হয়ে গাঁথা হয়েই যাচ্ছে ।
আমি বললুম , এতো ভারি ভারি কথা বুঝতে পারি না । চল ওইখানে যাই , রেশমি দড়ির ঝুলায় ফুলের দোলনায় পরিরা কেমন দোল খাচ্ছে , একটু দেখি গে যাই । হীরামন , আমার মাথায় আলতো ঠোক্কর বলল , যার যেদিকে ধান্দা!

নবাব লখনউ ছাড়ার আগে তার মহল , ঝরোখা , দরজা , জলভরা চোখ নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন আর তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এলো
যব ছোড় চলে লখনউ নগরি
তব হাল আদম পর ক্যা গুজরি ...।।

চলে তো এলেন । কিন্তু এমন এক শহরে এলেন যে তার হৃদয় উৎসারিত সেই নজম সেই শহরের এক অতি মনোরম কবির হাতে পড়ে কী হাল হল , সেই কবি লিখলেন তাঁর এক নাটকের জন্য ।

কত কাল রবে বল’ ভারত রে
শুধু ডাল ভাত জল পথ্য ক’রে ।
দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন—
ধর’ হুইস্কি-সোডা আর মুর্গি-মটন ।
যাও ঠাকুর চৈতন-চুট্‌কি নিয়া—
এস’ দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিয়া ।“

এখন আমার আর সব কথা ভালো মনে পড়ে না । ঐ হীরামন মাঝে মাঝে সুতোয় মাঞ্জা লাগিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় , তখন হাওয়ায় হাওয়ায় বিজলি, মেঘ আর রাতের জোনাকি আর আমার দশ ইঞ্চি টবের দুটো অকালে ফোঁটা বেল ফুল সেইসব কথা মনে পড়িয়ে দেয় ।





এমিলের সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হয়ে যাবে, কোনোদিন ই ভাবিনি । স্টকহোমের এই পুরোনো পাড়ার চার্চে ঢুকেছি। অসাধারণ একটি পাইপ অর্গান। চকচকে ঝকঝকে বিরাট। সুন্দর নকশা। সোনালি রঙের।একজন গাইড, ওই চার্চের ই একজন, অনেক তথ্য বলে বলে দিচ্ছিলেন। আমাদের চোখ পাইপ অর্গানের দিকে। উনি হঠাৎ বললেন, চলুন আপনাদের ওপরে নিয়ে যাই। অর্গানের ঘরে।
আমরা খুব ই খুশি। এমন যেচে দেখাতে চাইছেন যখন! বিদেশ বিভুঁইয়ে আশাই করা যায় না। সেই মধ্যযুগীয় সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ওপরে।
ওপরে দেখি, সে এক কর্ম যজ্ঞ। নানান ধরনের যন্ত্রপাতি, এই তার, ওই তার। নানান রকম রিড।
এর ই মধ্যে আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে
আমাকে কেউ দেখছে! আমি মাথা ঘোরাতেই এমিলকে দেখতে পেলাম।
তুমি? এখানে?
এমিলের চোখদুটো চিকচিক করছে।
গোঁফের সরু সবুজ রেখা।
ওর একটা অসুখ ছিল। কোনো বিচ্ছেদ, মানে তা যদি বাড়ি থেকে কোন অতিথির চলে যাওয়াও হয়, ও মানতে পারতো না।
যে কোনো ধরনের সেপারেশন ওকে কষ্ট দিত। আবার এই কষ্টটা , ও বুঝিয়ে বলতেও পারতোনা।

এমিলকে এভাবে দেখব, ভাবতেই পারছিলাম না।
চার্চের ভদ্রলোক কে জিজ্ঞেস করলাম, একে কোথায় পেলেন?
উনি খুব হকচকিয়ে গেলেন।
তাইতো! কী করে, কী ভাবে অর্গান রুমে এলো, আমার তো জানা নেই।
এমিল আস্তে আস্তে বলল, সন্ধেবেলা এসো কিন্তু।এরা বাখ বাজাবে।
আমি ওই ভদ্রলোক কে বললাম, কনসার্ট আছে আজ , না? বাখের সিম্ফনি বাজানো হবে?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
বললাম ,ওই ঢোকার মুখে লেখা দেখলাম, তাই।
সন্ধেবেলা অপূর্ব সুন্দর পাইপ অর্গান বেজে উঠলো। গমগম করছে।
আর সেই মধ্যযুগীয় চার্চে, মোমবাতির আলতো আলোয় এমিলের প্রিয় সিম্ফনি আলোর ডোম বেয়ে, মা মেরির চুল ছুঁয়ে যিশুর চোখের পাতা ,পায়ের পাতা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে আমার হাতের তালুতে একটা জোনাকি হয়ে জ্বলতে লাগলো!