(নববর্ষে দিল্লির প্রবাসী পত্রিকা দিগঙ্গনে প্রকাশিত একটি
লেখা “সেই সাবেকি গান”
ধন্যবাদ সৌরাংশু সিনহা )
খরচ করে ফেলেছি সেই কবে
নলেনগুড়ের গন্ধ মাখা রোদ
শিউলি শিশির নীবার উৎসবে
কতকাল যে হয় না দেওয়া যোগ
মায়ের দেনা কখনো হয় শোধ?
এখনো
চোখ বুজলে সেইসব ছবিগুলো স্পষ্ট দেখতে পাই । বাতাসে তখনো ছিল বসন্তের
মালতীগন্ধ , একটানা কোকিলের ডাক , গেটের
ওপর মাধবীলতার ঝাড়, সন্ধে বেলার সতরঞ্চি পাতা বসার ঘর ,
রান্নাঘরে
আম পোড়া শরবৎ তৈরির তোড়জোড় , একে একে এসে হাজির হচ্ছে হারমোনিয়াম তবলা , তানপুরা । দরজার বাইরে জড়ো হচ্ছে চটি । একটু
পরেই তাঁতের শাড়ির খসখস , পাঞ্জাবিতে ধোপাবাড়ির রোদের গন্ধ মেখে সবাই এসে বসবে ।
পাটভাঙা ধুতি ফতুয়া পরে নিখিল বাবু সুর লাগাবেন,বলবেন “নিন, একসাথে ধরুন আআআআমরা
নুতন যৌবনরই দূত... “। ব্যস শুরু হয়ে যেত নববর্ষের রিহার্সাল । যত্ন করে লেখা গীতি
আলেখ্য । বাছাই করা কবিতা গান । এইসব
গীতি আলেখ্যর দুটো পাকাপাকি সময় ছিল একটা নববর্ষ আরেকটা রবীন্দ্র জয়ন্তী । প্রথমটা
ছোট , পরেরটা বড় । ছবির রিলে ধরে রাখা আছে
সেইসব সিপিয়া রঙের সুখস্মৃতি । তখনো তার
একটাই ব্র্যান্ড নিখাদ বাঙালিয়ানা । ছিল না এত আয়োজন ,উপকরণ , ছিল না পণ্য সম্ভার
, বিশ্ব বাজার । প্রলোভন প্রতিযোগিতা । রবিবারে আলু দেওয়া পাঁঠার মাংস ছিল
নিয়মবাঁধা রুটিন । প্রেসার কুকারে সিটি আর সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়া সুগন্ধ । স্মৃতির
মধ্যে সেই গন্ধ আজও ধরা আছে । জন্মদিনে
মাছের চপ , রাধাবল্লভী , মাংসের
ঘুগনি বাড়িতেই তৈরি হত সারাদিন ধরে । জলখাবারে চিঁড়ের পোলাউ আর লুচি আলুর সাদা তরকারি ।
বিজয়ার সময় নাড়ু , নিমকি গজা । গান বলতে আমাদের
বাড়িতে সেই সময় ছিল রবিবাবুর একচ্ছত্র আধিপত্য । শুধু শুনে শুনে গানগুলো মুখস্থ হয়ে গেছিল ।সেই
সময় যতদূর দেখেছি মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে বেশির ভাগ বাংলা গানই শোনা হত । শোনা হত অতুল প্রসাদ , দ্বিজেন্দ্রলাল,
রজনীকান্ত , নজরুল । বিনোদনের বাড়াবাড়ি
ছিল না । সেই জায়গা জুড়ে ছিল বই , বই আর বই । স্মৃতির দেওয়ালে আটকে আছে দুটি বই
,এক্কেবারে ছোট্টবেলায় , শৈলেন ঘোষের “মিতুল নামে পুতুলটি” আর লীলা মজুমদারের “হলদে
পাখির পালক” । আটকে আছে কয়েকদানা ভাতও । বাচ্চাদের ওগুলো পড়ে ভাত খাওয়ানো হত । “ছোটা
ভীম” তো তখন কল্পনার শত যোজন ওপারে । দক্ষিণা
রঞ্জন মিত্রমজুমদার , উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী , সুকুমার রায় , লীলা মজুমদার আমাদের ছোটোবেলাকে চিরকালীন করে খেছেন । আমাদের অবসরের আরো সঙ্গী ছিল ঘনাদা , টেনিদা , কিকিরা,
হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গোয়েন্দা সিরিজ । পুজোর সময়
দেব সাহিত্য কুটির,
সন্দেশ , আনন্দমেলা । আরো ছিল , যেন খনি গর্ভ থেকে উঠে আসা একেকটা রত্ন - ভোম্বোল সর্দার ,বাংলার ডাকাত ,পথের
পাঁচালী , চাঁদের পাহাড় , যখেরধন । আজকাল এই বই গুলো কেউ কি পড়ে? ভয় বিস্ময় রহস্য রোমাঞ্চের কল্পনার
রঙ আর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত
আমাদের আটপৌরে ছোটবেলা । আরেকটু বড় হতেই হাতে এল ছোটগল্পের সম্ভার । বাংলা ছোট
গল্প আর কবিতার ঐশ্বর্য বাঙালির আত্মশ্লাঘা বললে বেশি বলা হয় না ।
কালজয়ী
সব উপন্যাস ।
বাংলা কবিতা
বাঙালির পৈতে , বাঙালির
সনাক্তকরণ চিহ্ন ।এত কবি আর কবিতার কাগজ,লিটল ম্যাগাজিন
দেশের আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই । পকেটে রেস্ত নেই অথচ পত্রিকা বের করে
চলেছে নিয়মিত । কে পড়ুক ছাই না পড়ুক তাতে কী এসে গেল?
একে অনেক
সময় অনায়াস পটুত্বের ক্ষুদ্র কুটীর শিল্প বলে মনে হতে পারে কিন্তু এটাও সত্যি,কবিতা লেখে নি এমন বাঙালি খুঁজে
পাওয়া দস্তুরমত কঠিন । এই দেওয়াল পত্রিকা লিখতে লিখতে, কবিতা লিখতে লিখতে একটা বড়
উপকার হয়েছে বলে মনে হয় । পরবর্তী কালে আমি দেখেছি বাঙালির হাতের লেখা অনেক
ভিনভাষীর থেকে ভাল । এটাও একটা
স্বাজাত্য লক্ষণ বৈকি । শুধুই রবীন্দ্রনাথ পড়তাম না আমরা ।
ছোটো বেলায় আধোগলায় বীরপুরুষ আবৃত্তি করার সঙ্গে সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “আমরা
যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা” ও শোনাতে হত । বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে পাশে পাশে
থেকেছেন জীবনানন্দ দাশ , সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় , মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়
, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ ।
“কে
হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে” “আমরা
ক’জন সৌরোলোকের বামন কয়েকটা রাত বাঁশির মত বাজি” বা “এক যে জোয়ান ছেলে কই সে ছেলে
মা ? ঘর যে তোমার ঘরে ঘরে জননী যন্ত্রণা” , “অমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা “ বা “ অনন্ত
কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে” বাংলা কবিতায় কীর্ণ হয়ে আছে এইসব অজস্র অবস্মরনীয় পঙক্তি ।
আর
ছিল সূর্যের রৌদ্রের উদ্দাম উল্লাসে মেতে ওঠা এক ঝাঁক পায়রার মত উজ্জ্বল সব
বাংলা গান ।
এই
তো আমাদের উত্তরাধিকার । এই তো আমাদের শিকড় । “ জল দাও আমার শিকড়ে” উত্তরসূরিদের
কাছে বাঙলার এই ভালোবাসার দাবী ।
২
আমি
যত দূরেই যাই
আমার
সঙ্গে যায় ঢেউ এর মালা গাঁথা
এক
নদীর নাম,আমি যত দূরেই যাই
আমার
চোখের পাতায় লেগে থাকে নিকনো উঠোনে
সারি
সারি লক্ষ্মীর পা
আমি
যত দূরেই যাই
সেদিন
মাথার ওপরে ছিল কোজগরী লক্ষ্মীপুজোর চাঁদ । কলসি উপুড় করা জ্যোৎস্না । বাড়ি ছেড়ে
বহু দূর ,অন্য রাজ্যে । বদলে যাচ্ছে তার চার পাশের চেনা জগত । বড় হচ্ছে অভিজ্ঞতার পরিধি । বাঙালি গুটিপোকা তার খোলস ছেড়ে মিশে যাচ্ছে ক্রমশ এক ভিন্ন জীবন
স্রোতের সঙ্গে । সবাই বলেছিল কালচার
শক খেতে হবে । বাঙালি বড় কালচার নিয়ে বড়াই করে । শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির অবস্থান একটা
অদ্ভুত জায়গায় । ইংরেজ আধিপত্য ও বাংলা রেনেসাঁ র (রেনেসাঁ বলা যাবে কিনা তা নিয়েও
ঐতিহাসিক কূট কচালি আছে) ক্ষীণ উত্তরাধিকার , রবীন্দ্রনাথের দুর্লঙ্ঘ্য প্রভাব ,রাজনৈতিক
চরমপন্থা , কমিউনিজমের প্রগতিশীল প্রতিবাদী তরঙ্গ , দেশভাগ এইসব যুগান্তকারী
টানা পোড়েনে বাঙালি পেয়েছিল একটা শানিত , স্বতন্ত্র ,মুক্ত সচেতন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি । তাতে যুক্তিবাদ থাকলেও , সঙ্গে সঙ্গে ছিল
রোমান্টিসিজম , আবেগ ও ভাবালুতার প্রতি তার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ।
আর এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশের বৃহত্তর অংশের সামন্ততান্ত্রিক বা আধা সামন্ততান্ত্রিক বা
প্রতিক্রিয়াশীল মূল্যবোধের সঙ্গে তার প্রধান বিভাজন রেখা । সেই বিভাজনরেখার
মূল স্তম্ভ তার ভাষা , সংস্কৃতি আর
মূল্যবোধ ।
চলমান
পাথরের গায়ে শ্যাওলা পড়ে না । বাংলা ভাষাও
সেরকমই চলিষ্ণু । অসম্ভব ব্যাপ্ত তার গ্রহণ ক্ষমতা,
প্রকাশ ক্ষমতা । নিজেকে
কতো ভাবে সে বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত । আজ সে একটি অন্যতম বলিষ্ঠ আধুনিক ভাষা ।
আত্তীকরণ করেছে কতো ভাব ,কতো অর্থ ।
ভুবনেশ্বরে
থাকবার সময় সেখানকার ভাষার চলন লক্ষ করছিলাম । ভাষাটি মিষ্টি । একদিন কানে এসে বাজল, মুন্ড
ঢাকি নিও ,পবন পশিব নি । মনে হল যেন অন্নদামঙ্গল কাব্য শুনছি ।
শুধোনো , কদলী ,পনস প্রচুর তৎসম শব্দের ছড়াছড়ি । তার পাশাপাশি বাংলা ভাষা চূড়ান্ত রকমের আধুনিক ।
নানা সংস্কৃতির মিশেলে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে এবং করে চলছে । অথচ তার স্বকীয়তা এতটুকু মলিন হয়ে যায় নি । এসেছে কথোপকথনের চলতি ভাষা , অর্বাচীন শব্দ । ভাষার প্রকাশভঙ্গিমায় ক্রমশ বিম্বিত হয়ে চলেছে আজকের চলমান জীবন।
এই ভাষার কাছে বার বার নতজানু হয়ে ফিরে আসি।
মায়ের মত আশ্রয় , মায়ের মত শান্তি । ঘুড়ি
হয়ে যতই ওপরে উড়ে যাই না কেন লাটাই এর মত এই ভাষা আবার আমাকে নামিয়ে আনে তার কোলের
উষ্ণতার মধ্যে
।
৩
বুকের ভেতর থাকে তো
সেই দিন
পুব বাগানে স্মৃতির
আনাগোনা
বদলে গেছে জগত, আলাদিন
এক লহমায় পিতল করে
সোনা
কোনকিছুই একরকম থাকে
না । বর্তমান অতীত হয়ে যায় । খাদ্য, পোশাক, রীতিনীতি , আচার বিচার উৎসব,
পুজো পালা পার্বণ , সাহিত্য সংস্কৃতি ভাষা
সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে এই যে জমকালো
বাঙালিয়ানার বিশাল
চালচিত্র তাতে সময়ে সময়ে কতবার কতরকম ভাবে বদল এসেছে । কতো নতুন বাঁক এসেছে । আর কতো আসবে ভবিষ্যতে । এই ঐতিহ্য পরম্পরার প্রাণপ্রতিমাটি তৈরি হয় সে দেশের জল আলো হাওয়া মাটির স্নিগ্ধতা দিয়ে ।
কতো কতো শতাব্দী,প্রজন্ম ধরে নদী মাতৃক
বাঙলার সরস পলি উর্বর মাটি , তার সবুজ প্রান্তর , বর্ষার জলধারা ,ঠান্ডা হাওয়া ,ক্ষেতের ধান ,
পুকুর নদীর মাছ, নারকেল নলেন গুড়ের সুঘ্রাণ, কোকিলের কুহুতান তার সুখী, পেলব
, মধুর ,আয়েশি অন্তঃকরণটি গড়ে
দিয়েছে । বাঙালির জীবনে তিন ঠাকুর ,চৈতন্য
ঠাকুর, রামকৃষ্ণ ঠাকুর আর রবি ঠাকুর তার
রক্তে আবহমান কাল ধরে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে রেখেছেন । সময়ের সরণী পথে কতো
স্মৃতিকাতরতা আমাদের দাদু ঠাকুরদা করে
গেছেন , বাবা কাকারা করে গেছেন , এখন আমাদের পালা । প্রত্যেকটা সময়ের সন্ধিক্ষণে সেই গেল গেল রব । আবার
একপ্রস্থ নস্ট্যালজিয়া ।
৪
স্নায়ুর
ভিতর নানান রঙের বুদবুদ ফাটে শব্দে
প্রবল
বৃষ্টি আবেগমন্দ্র ভালোবাসা দাও বাঙলা
উড্ডীন
নীলে উৎসব হোক ভাঙা এ বুকের পাত্র
ভরে
দিক ঘন মেঘের বৃষ্টি আছি বড় পিপাসার্ত
বস্তুতন্ত্র ও
ঐতিহ্য পরম্পরা এই দুটির মধ্যে একটা বিরোধ
আছে । একটি বাড়লে অন্যটি কমে । এ কোন কল্পনাপ্রসূত মতামত নয় । ইতিহাস সাক্ষী । যতো বস্তুতান্ত্রিক উৎকর্ষ বাড়ছে মেধা মনন
সৃজনশীলতা এবং ঐতিহ্য আনুগত্য, আনুপাতিক হারে নামতে থাকে । মধ্যমেধার হাতে
দোলাচল তার সংস্কৃতি। সমবেত প্রতিভার যুগ , কবি নয় যেন কবিসম্মেলন । গজভুক্ত
কপিত্থ । বাঙালি জীবনের সর্বস্তরে অন্তঃসার শূন্য পল্লব গ্রাহিতা ,উন্নাসিকতা আর বাক সর্বস্বতা আজ যেন বড় প্রকট । বাংলা বলতে না পারা , পড়তে না পারা আজ তো সোচ্চার
অহমিকা। অহমিকার মধ্যে লুকিয়ে আছে কোথাও একটা চাপা হীনমন্যতা । মুখেন মারিতং জগত আর সংস্কৃতির শূন্যগর্ভ
আস্ফালন ।
বাঙালির চিরকালীন
ম্যাটিনি আইডল রবীন্দ্রনাথ বরং আরব বেদুইন হতে চেয়েছেন । মুগ্ধ জননীর
মানুষ না হওয়া বাঙালি সন্তান হতে চাননি । আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বাংলার ঐতিহ্য
ও সংস্কৃতি যে স্তরে পৌঁছতে পারত আমরা তাকে সে জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি । আজকের
চটুল বিনোদন ও বিজ্ঞাপন বানিজ্যকেন্দ্রিক লঘু সংস্কৃতিতে বাঙলার প্রাণ প্রতিমা আজ বিষাদ প্রতিমা । হিন্দি বলয়ের দৌরাত্মে লুঠ
হয়ে যাচ্ছে তার সত্তা ও সম্পদ । কথায় বলে,যে অনুকরণ করে সে সবচেয়ে খারাপটাই অনুকরণ
করে । এত যে কর্তাভজার মত করে সেই কবে থেকে ইংরেজদের তোষামোদ করে আসছে , অথচ সময়
জ্ঞানটাই শেখা হল না ।
তাদের কাছ থেকে
স্বাজাত্য প্রীতিও শেখা হল না । আর্থ
সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নানান বর্গীআক্রমণের মুখে দেখিয়েছে চূড়ান্ত উদাসীনতা ।
“জাগো বাঙালি “, শ্লোগানের পাশে মস্করা করে লেখা হত “কাঁচা ঘুম ভাঙাইও না”।
এই যে আমরা এত
সংস্কৃতি সংস্কৃতি করে চলছি এই বঙ্গ সংস্কৃতি কি জাত ধর্ম শহর গ্রাম নির্বিশেষে সব বাঙালির ? না কি তার
চরিত্র শুধু নাগরিক শীলিত মধ্যবিত্ত ? এটা ভেবে দেখার বিষয় । সংগীত সাহিত্য ফিল্ম ,থিয়েটার এসবের যারা প্রতিনিধি স্থানীয়
ব্যক্তি তারা সবাই মূলত শহর কেন্দ্রিক উচ্চ বর্ণের । আজও । সমস্ত সামাজিক স্তর বা শ্রেনী
কি এর সঙ্গে একাত্মতা বা সাযুজ্য বোধ করে ? কিন্তু দেখা যায় লোকায়ত ধর্ম সংস্কৃতি সমাজ তার সমস্ত উপকরণ ও
বর্ণাঢ্যতা নিয়ে সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলে । ভাটিয়ালি, জারি গান ,আলকাপ , ভাদু টুসু বাউল , মুরশিদ্যা , যাত্রার সহজিয়া
মরমিয়া সুর ধরে রাখে সংখ্যাগরিষ্ঠ মাটির সন্তানদের অনুভূতি ও যাপন ।
কেবলমাত্র বাংলা সংস্কৃতি নয় সমস্ত দেশীয় ভাষাসংস্কৃতি আজ কঠিন সময়ের মুখে । সারা বিশ্বে জাল বিছোনো পণ্যসংস্কৃতি এবং তার
এক ছাঁচে ঢালাই করার নিরন্তর পদ্ধতি ও বাজারু প্রলোভন আজ স্বাতন্ত্র স্বকীয়তা কে
যেন ছিনিয়ে নিতে চায়। প্রযুক্তি আজ হাতের
মুঠোয় । বাঙালি জীবনের পরিধি আজ অনেক ব্যাপ্ত । শিকড় ছাড়িয়ে অনেক দূর ।অনেকে সেই
শিকড় আবার নিজে হাতেই উপড়ে দিয়েছে ।
৫
নিজের বৃত্তে নতুন
জীবন
খেলছে খেলুক
ছেলেমেয়ে
আমরা চিরকালের খেলা
জানলা দিয়ে দেখি
চেয়ে
বাইরে থেকে মেঘের
ছায়া
পড়ছে এসে ঘর বিছানায়
গাছের পাতায় বিকেল
হাওয়া
সেই সাবেকি গানই
শোনায়
গ্রাম , গ্রাম থেকে
শহর , শহর থেকে শহরান্তর, দেশ থেকে দেশান্তর । ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালি । বদলে যাচ্ছে
তার মুখের ভাষা , জীবন যাপন , মূল্যবোধ ।
আগের থেকে তার মলাট অনেক বেশি
বহির্মুখী , সাহসী ঝকঝকে ,অনেক বেশি গ্রহণশীল । কিন্তু সূচিপত্রে সেই পুরনো বাড়ির ঠিকানা ঠিক যত্ন করা রেখে দিয়েছে ।
বনেদি বাড়ির রোশনাই
। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসেছে , নতুন লোকেরা নিজেদের সুবিধে মত বাড়িটিকে সাজিয়েছে , কেউ
দালানে পুরোনো টালি বদলে দিয়েছে , ঝুল ঝেড়ে দিয়েছে কেউ , পুবের ঘরগুলো ভেঙ্গেই
ফেলেছে একদল , দক্ষিণের গাড়িবারান্দার শার্সি গুলোর ডিজাইন বদলে দিয়েছে কেউ ,
বৈঠকখানায় নিয়ে এসেছে নতুন আসবাব , নতুন রঙ, হাট করে খুলে দিয়েছে কতদিনের বন্ধ
জানালা ,কতো অন্ধকার কুঠুরিতে নিয়ে এসেছে আলো, কোন কোন ঘর আবার একই রকম রেখে দিয়েছে ,কেউ ঘন ঘন আসে, কেউ হয়ত
বা আসেই না , কিন্তু বাড়িটাকে কেউ আজও ছেড়ে যেতে পারে নি । জীবনের বিভিন্ন
ক্ষেত্রে যতই ঝড়ঝাপ্টা , ফিউশন , বাউন্ডুলে পনার এলোমেলো ঘূর্ণি আসুক না কেন, যত
দূরেই যাক না কেন নতুন বোতলে পুরোনো মদের
মত সে বাড়ির আকর্ষণ আজও অমলিন ।
বাঙালির ভৌগোলিক
পরিসর যত বাড়বে সেই প্রবাসীদের ভিতর দিয়ে আরও ব্যাপ্ত হবে বাংলা সংস্কৃতি আর
ঐতিহ্যের আকাশ । পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে নয়, নতুন চোখে ,নতুন মনে নতুন হয়ে সেজে উঠুক আমাদের ভালোবাসার ধন ।
আমি যত দূরেই যাই , সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা
বাকি কবিতা কবি বাসুদেব দেবের।