Monday 30 June 2014

মনে পড়ে, বেতলা?


খনো জঙ্গলে সেগুন গাছগুলোতে  নতুন পাতা আসে নি । এটা পাতা ঝরার  ঠিক পরের সময় । পতঝর। সবে বসন্তের শুরু। একটা  জিপে করে রাঁচি থেকে  ডালটনগঞ্জ লাতেহার হয়ে পালামউ জেলার বেতলা ছিল আমাদের  পাঁচজনের গন্তব্য। 

বেতলা নামটার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাইসন,এলিফ্যান্ট,টাইগার,লেপারড,অ্যাক্সিস অ্যাক্সিস এর সব কটা ইংরেজি নামের  প্রথম অক্ষর গুলো। অর্থাৎ কিনা বেতলায় দেদার পাওয়া যাবে  বাইসন,হাতি,বাঘ,চিতা আর চিতল হরিণের দল। সহাবস্থান, তবে শান্তিপূর্ণ কিনা ওরাই জানে । 



পায়ে হাঁটা মানাএই নিষেধ বাণী দিয়ে জঙ্গলের শুরু জিপের সামনে উড়ে এল একটা নীলকণ্ঠ পাখি ,গায়ে পড়ে পথ চিনিয়ে দিতে থাকল আমাদের। পাতা ঝরে গেছে বলে জঙ্গল কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া । কিন্তু সেই ঠান্ডা ঠান্ডা বুনো গন্ধটা আর ধোঁয়া ধোঁয়া নীলচে আলোটায় কোন ভেজাল ছিল না। যারা জঙ্গলে ঘোরে তারা জানে ঠা ঠা রোদ্দুরে বনের মধ্যে একটা ঝিমঝিমে নীলচে ধোঁয়া দেখা যায়। জিপের চারদিক খোলা,পেছনে দাঁড়িয়ে পড় , গভীর শ্বাস নাও ,জঙ্গলের বুকের ঘ্রাণ । নিবিড় ঘেসো গন্ধ । দেখা যায় পাল পাল হরিণ চিত্রল হরিণ ।আর ছোট আকারের মাউস হরিণ ।অনেকে তাচ্ছিল্য করে বলে ওঃ জঙ্গলের ছাগল আর কি! অজস্র বাঁদর আর লঙ্গুরের আড্ডা । আর গদাম বাবুর মত গাম্বুট পরা বাইসন। আর পাতার ফাঁকে মোর আর মোরনির বিশ্রম্ভালাপ ।

রাতে জ্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে বনবিভাগের ক্যান্টিনে খেতে গেলাম। শুনশান চারধার । কোথাও বিজলি নেই । বছর কুড়ি আগেকার ঘটনা। তখন কারেন্টের বেহাল অবস্থা ছিল ঝাড়খন্ডে। সে দিন ছিল অনাবিল চাঁদনি রাত । আ...উ আ...উ শব্দে হরিণ ডাকছে । এসব ডাকের আবার নানান রকম মানে আছে। প্রথমে অ্যালার্ম বেল বাজায় বাঁদর এবং লঙ্গুর বাহিনী । গাছের টঙে চড়ে চারদিক তাকিয়ে তারা  টহলদারি করে । তিনি বের হলেই  এই তৎপর বাহিনী সিগন্যাল দিতে শুরু করে বাকি সব্বাইকে।  অ্যালার্ম কল।এরপর হরিণের দল তীরবেগে নিরাপদ জায়গার দিকে ছুটতে থাকে ।এবং ওই আ...উ আ...উ ডাকও শোনা যায় সঙ্গে সঙ্গে । তীর বেগে হরিণ যদি ছুট্টে চলে যায় বুঝে নিতে হবে তিনি ধারে কাছেই আছেন । এমনটা দেখেছিলাম তাড়োবার জঙ্গলে । যাই হোক, ওই চাঁদনি রাত, হরিণের ডাক ,বিজলিহীন বনবাংলো ,চারদিকের ঘন অন্ধকারে বেশ একটা শিরশিরে  অপার্থিব অনুভূতি ছিল তা এতো বছর পরেও দিব্বি তাজা আছে দেখছি। টঙের ওপর ছোট্টো খুপরি ঘরে উঠে ওঅ্যারলেসে কথা বলা হল ডাল্টন গঞ্জের বনবিভাগের বড়কর্তা সেন সাহেবের সঙ্গে।

বনবাংলোর ছড়ান চাতালে চেয়ারে গা এলিয়ে সব বসলাম ।
কোন এক মাতাল এক অদ্ভুত মায়াবি গলায় বহুদূর থেকে গানের সুরের মত কী যেন একটা হেঁকে হেঁকে চলে গেল ।তার রেশ তা রয়ে গেল অনেকক্ষণ ।

পরেরদিন সকাল পাঁচটায় ছাব্বিশ বছরের জুহির পিঠে চেপে আবার জঙ্গল। জুহি চলছে আরেকটু গহিন বনে এবড়ো খেবড়ো উঁচু নীচু পথ দিয়ে । জঙ্গলে পরতে হয় পাটকিলে পাঁশুটে রঙের জামা। গাছের পাতা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো মাথায়,মুখে। শাল,শিশু,মহুয়া,কেন্দু ,বাঁশ হৈ হৈ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতির পিঠে দুলতে দুলতে চলেছি । কিন্তু বেশ কষ্টকর এই দুলুনি । জুহির নাম ধরে ডাকলে সে শুঁড় তুলে নমস্তে করে। বিস্কুট খায় । গদাম বাবুর মত দাঁড়িয়ে থাকা বাইসন কে হেলায় পাশ কাটিয়ে চলে যায় । 


দূরে দেখা যাচ্ছে বাঘের গুহা ।বিভিন্ন এলাকায় দুটি করে বাঘ থাকে। এই এলাকায় বাঘিনীর সঙ্গে বাচ্চাও আছে আবার। দেখতে পেলাম সেই পয়দল চলা বারণ পথে কুঠার হাতে দুটো লোক হেঁটেহেঁটে আসছে । আমাদের মাহুত একটু দাঁড়ালো । খুব নরম গলায় ওরা মাহুতের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো তাঁকে নিয়ে । কোথায় তাঁর পদচিহ্ন দেখা গেছে
, কোথায় তিনি জলপান করেছেন । ওইদুটি লোক হলো বাঘের গতিবিধির রিপোর্টার  আমাদের মাহুত জানাল আজ সকাল থেকে তাঁর টিকিটিও দেখা যায় নি। জঙ্গল আর তার বাসিন্দাদের নিয়ে মাহুত আর ওই লোকদুটোর  কী মায়া ! লক্ষ্য  করছিলাম, তারা  অসম্ভব মমতা আর স্নেহ মিশিয়ে কথা বলছিল যেন কোন প্রিয়জনকে নিয়ে কথা বলছে। বাঘ,চিতা এদের খতরনাক বলতে এরা নারাজ । তাদের সাফ কথা ইনসান কি তরহা খতরনাক কোই নহি। পূর্ণ বয়স্ক বাঘ রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁসে চলে।

সন্ধেবেলা আবার সেই বনবাংলোর চাতাল ।গা এলানো চেয়ার ।যথারীতি নিয়মমাফিক থালার মত বিশাল চাঁদ। পাতার কাঁপন ,ঠান্ডা হাওয়া সবই মজুত  ছিল। আমরা গোল হয়ে বসেছি। হালকা হাসি ,হালকা কথা। এইসব জায়গা কথা বলার জন্য নয়। দেখলাম দুটো কুকুর এল কোত্থেকে । নিঃশব্দে। নেড়ি  কুকুর নয় মোটেও। মাটির থেকে উচ্চতা কম। শরীরটা ছোটখাট  কিন্তু বাচ্চা কুকুর নয়। কোন হাঁক ডাক নেই। পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানার মত জোছনা রাতে আমাদের চারদিকে খেলতে লাগল । হঠাত ই দেখলাম দুটোর জায়গায় এখন তিনটে কুকুর।  কোত্থেকে এল এরা ? হুটোপুটি করছে,এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে, কোন শব্দ নেই। একি রে বাবা! তিনটে কুকুর চারটে হয়ে গেল । খেলছে ,খেলছে । আবছা আলো আঁধারির মধ্যে । আমাদের আশেপাশেই। কোনও শব্দ নেই। তারপর একসময় তাদের আর দেখা  গেল না।


আমরা কেউ কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। হয়ত বলতে চাইছিলাম না। এখন তাই মনে হয় । অনেকক্ষণ পর যে যার মত উঠে নিজেদের ঘরের দিকে পা ঘষটে ঘষটে যেতে লাগলাম । সঙ্গীদের  কেউ বলে উঠল কুকুরগুলো লক্ষ্য করেছিলি?”


Sunday 29 June 2014

পুরুষতন্ত্রের এজেন্ট

ত্যি কথা বলতে কি কলকাতার বাইরে যাবার আগে  লেডিজ সঙ্গীত পার্টি সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই ছিল না। তখনও হাম আপকে হ্যায় কৌন বক্স অফিস কাঁপায় নি ।কাজেই মাধুরীর  দীক্ষিতের পতলি কোমরের লচক আর ঠুমকাও  আমার  বিশেষ জ্ঞান পরিধির বাইরেই ছিল।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান কিসিমের চিড়িয়ার মত আমরা জড়ো হয়েছিলাম নাগপুরে । নানা ভাষা ,নানা মত, নানা পরিধান লাইনটার  একটা জবরদস্ত প্রমাণ হাতে নাতে পেতে থাকলাম।   জ্ঞানের পরিধি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল ,বাড়তে লাগল পরিচিতির গন্ডি।পরিচিতির গন্ডি পেরিয়ে বন্ধুত্ব ।

বন্ধুত্ব থেকে নিবিড় বন্ধুত্ব ।  বড় বড় গ্রুপ, তার থেকে ছোট ছোট দল। হরেক রকম গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি । ডোবা পরিষ্কার , বেড়া বাঁধা , চড়ুইভাতি, ভিলেজ ভিজিট ,পাঁচমারি সাতপুরায় পিঠে বোঁচকা বেঁধে ট্রেক এইসব কসরতের পর যখন একটু হাঁপ ছাড়ার সময় এসেছে সেই সময় শোনা গেল আমাদেরই একটা মেয়ের সামনেই বিয়ে। সে ঝপ করে বিয়ে সেরেই চলে আসবে এমনটাই ঠিক হয়েছে। কিন্তু তা বললেই তো আর হয় না । নতুন পাতানো বন্ধুর দল প্রায় তেড়ে এসে মৌসুমি কে বলল সে কি? তোমার বিয়েতে সঙ্গীত হবেনা?  কুছ পরোয়া নেই ,আমরা সব অ্যারেঞ্জ করছি খুব মজা করব  হ্যাঁ ? চিরকালের বুদ্ধু  আমি একটু ফাঁপরে পড়লাম । গান বাজনা করবে, এইতো ? তা অতো শুদ্ধ ভাষায় সঙ্গীত সঙ্গীত করার কী দরকার?
আরে বোকা,এটা একটা সেরেমনি  অনুষ্ঠানটার নাম ই তাই।  আর এটা  স্ট্রিক্টলি ফর লেডিস, কাঁহা কাঁহা সে চলে আতে হ্যাঁয় গোছের মুখ করে বন্ধুটি আমাকে বোঝাতে থাকে 

যথাসময়ে সাজুগুজু করে পৌঁছে গিয়ে দেখি আসর জমজমাট । আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে লাল কার্পেটের ওপর একটি ঢোলক । আর সাজগোজের বহরে তো কাউকে প্রায় চিনতেই পারছি না। কজরা গজরা সলমা চুমকিতে আমি তো দিশেহারা ,কোত্থেকে জোটাল এসব এরা? বুঝলাম সৎ কর্মে সদিচ্ছাটাই সব মুশকিল আসান করে দেয়। আসরে প্রবেশ করলেন মহিমা সিংহ এবং অসাধারণ দক্ষতায় কার্পেটের ওপর বসে ভাঁজ করা হাঁটুর নিচে সেট করে নিলেন ঢোলক ।
শুরু হল গান আর দমকা হাসির ছররা ...হম তেরে গলে কি হার সাঁইয়া, কিউ লাওগে সওতনিয়া । সে কি সতীন আবার আসছে কোত্থেকে? দোজবরে কে বিয়ে করছে  নাকি? তাছাড়া জেনারেল নলেজে ম্যারেজ অ্যাক্ট ফ্যাক্ট  কী সব মুখস্থ করেছিলাম না?  তাহলে? এর মধ্যে সলমা চুমকি কজরা গজরা রা দুলতে শুরু করেছে ঢোলকের তালে তালে। গলা মেলাচ্ছে মেরে গজ গজ লম্বে বাল, মেরে লালি লালি গাল, উমর সোলভা সাল , মেরে গোদ মে হ্যায় লাল ও সাঁইয়া ...।  পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো মুখ চোখের ব্যায়াম । স্বামী যাতে কিছুতেই সতীন না আনে তার বহুত মিনতির সঙ্গে এবারে যোগ হতে শুরু করল আরও চমৎকার সব তথ্য  ঘরের বিভিন্ন কোণ থেকে যোগ হতে থাকল ম্যায় হু এম বিবি এস পাস, ম্যায় হু কম্পুটর এঞ্জিনিয়ার ও সাঁইয়া সতীন এনো না প্লিজ 
এই ঘটনার পর অনেক গুলো ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে গেছে। বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে  মুন্নি  বদনাম হুয়ি,শীলা কি জওয়ানি আর চিকনি চামেলি । পুরুষদের জন্য, তাদের ভালো লাগার জন্য তৈরি । তাদের যেমন যেমন ভালো লাগে তারা তেমন তেমন ভাবে মেয়েদের ব্যাবহার করে । বিনোদন আর বিশ্বায়নের পণ্য সংস্কৃতির উদারনীতির ছদ্মবেশে পুরুষ তন্ত্রের হাত  আরো শক্ত হয়। গ্লোবাল  কনজিউমারিজম আর পুরুষতন্ত্র একই মুদ্রার দুটি দিক। বাজার তৈরি হয়,মিডিয়া নতুন স্ট্র্যাটেজি ভাঁজে । বাজার কায়েম করতে সে বেছে নেয়  সবচেয়ে নরম, সবচেয়ে দুর্বল ,সবচেয়ে প্রান্তিক  শ্রেণী টিকে। পণ্য তো এরা ছিলই তাতে এবার এসে পড়ল পাকাপোক্ত  বিশ্বব্যাপী জাল । এখন তারা শুধু অবজেক্ট । জন্মদিনের পোশাক পরা তাদের ছবি সারি সারি ছাপা হয় কাগজের পাতায় পাতায় । তারা সানন্দে ছাপতে দেয়  নারী দিবসে সংবাদ পত্রে বিশেষ ফিচার বের হয় রম্ভা,মেনকা ,উর্বশীদের নিয়ে।  তাদের মেধা নেই,মন নেই, মনন নেই । তারা শুধু অবজেক্ট । এরই মধ্যে চতুর খেলায় চলতে থাকে নানান ব্র্যান্ডিং । মেয়ে বলে কি তারা পিছিয়ে থাকবে এই দুনিয়ায় ? কভি নহি । বেপরোয়া উদ্দাম  অশালীন লাইফ স্টাইলকে ব্র্যান্ডিং করতে থাকে মিডিয়া। আমরাও বাঁচছি দেখ মা। উফ কী এনজয় করছি। পুরুষ তন্ত্র খুব চালাক এবং নিশ্চিন্ত। কারণ তাদের জন্য নীরবে কাজ করে চলেছে বিশ্বস্ত এজেন্ট বাহিনী । কে না জানে কোন সিস্টেমকে সফল করতে তার এজেন্টরা কতটা জরুরী !

কোথায় বা এরা নেই? চার দেওয়ালের তেল নুন মাখা সংসার থেকে শুরু করে সমাজে, হাটে বাজারে , রাজনীতিতে , মিডিয়ায়,বিনোদনে, নারী পাচারে সর্বত্র কাজ করে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে কিছু তাল ভঙ্গ হয় । কিন্তু   প্রতিবাদীদের চেঁচামেচি এদের বিভ্রান্ত করতে পারেনা । কারণ এরা নিজেদের মানুষ বলে ভাবতেই শেখে নি। আর এই সব সূক্ষ্মভাবে মাপতে পেরেছে বলেই  পুরুষ তন্ত্র এত সাকসেসফুল । ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স থেকে শুরু করে সমাজের সব জায়গায়  তাদেরই সহযোগিতার জন্য তামাম মেয়েদের সহজলভ্য মনে করা হচ্ছে। আর দেখুন সিবি আই কর্তা থেকে শুরু করে বাংলার  হার্টথ্রব   সব কেমন এক সুরে কথা বলে? কেমন করে বলে? কারণ তারা অতটাই হালকা ভাবে  মেয়েদের নেয়।

অতোটাই অসম্মানের সঙ্গে।  কারো কিস্যু যায় আসে না , কারণ এজেন্টদের নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের কোন জবাব নেই । আফটার অল , মায়ের জাত তো !





Saturday 28 June 2014

চিড়িয়াটাপুর ফাঁদে

গাছের পাতাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে চুব্বুস বড় বড় জলের ফোঁটা পাতায় পাতায় ঝুলছে। সরু রাস্তার দু ধারে মাঝে মাঝে লাল জবা ফুটে আছে । আকাশ ছেঁচে বর্ষার পর পড়ন্ত বিকেলের ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলোতে তেমন তেজ ছিল না। দূরে কালো কালো পাহাড় আর ওমনি একটা ঘন সবুজ রাস্তা দিয়েই চিড়িয়াটাপু যেতে হয়। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে এই পঁচিশ তিরিশ কিলোমিটার হবে।
সূর্যাস্ত দেখতে সবাই চিড়িয়াটাপু যায় । আন্দামানের বিখ্যাত সান সেট পয়েন্ট।
লেখাটার নাম চিড়িয়াটাপুর সূর্যাস্ত হতেই পারত ।  তবে এমনি তেই  সে দিন সূর্যাস্তের সেই আড়ম্বরপূর্ণ ব্যাপারটায় অনেকটাই জল ঢেলে দিয়েছিল বৃষ্টি ।
আমরা যখন  ঘন বনের ভেতর দিয়ে সেখানে পৌঁছলাম সমুদ্র তখন অনেকটা দূরে । চারদিক বেড় দিয়ে ঘিরে আছে আন্দামানের ট্রপিকাল রেন ফরেস্ট । প্রায় সন্ধের আলোতে চারদিক কী মায়াবী ! আকাশে গোলাপি ,লাল কমলা রঙের সূর্যের আলো মাখা মেঘ । দূরে কালা পাহাড় , হাত পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বড্ড ভালো লাগছিল । সূর্যাস্ত নাহয়  তেমনভাবে  নাই দেখা হল কিন্তু কী অপার্থিব অলৌকিক সৌন্দর্য !
লোকজনের ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে । সোনায় সোহাগা ।  বৃষ্টির জন্য নাকি? এমনিতেই বেশি ট্যুরিস্ট দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে যেন একমাত্র আমি ই থাকব সেখানে!  দিব্যি হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে গেলাম । আর কতো রকমের ঝিনুক । কী সুন্দর । কতো যে কুড়োলাম । আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে  লাগলাম, এত আন পলিউটেড নেচার , কোথাও কোন কৃত্রিমতার ছাপ নেই, দেখেছ?  একেবারে আদিম প্রকৃতি । শুধু তাই নয় ,  কোথাও  বাদাম, আইসক্রিম, চিপস বিক্রি হচ্ছে না, অকারণ  কেউ ভেঁপু বাজাচ্ছে না, সাবানের ফেনার বুদবুদ তুলছে না ।  মাছ ভাজার আঁশটে গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছে না , সস্তায় কড়ি পুঁতির মালা গছাচ্ছে না,  গলা জড়িয়ে খচাত খচাত করে ছবি তুলছে না । নাহ এ বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির মধ্যে মিশে যাচ্ছি । ইন ফ্যাক্ট এমনি ভাবে একটা  জায়গাকে দেখতে পাব এত টা আমরা ভেবেই আসিনি ।  অথচ  এমনটাই তো আমরা বরাবর প্রাণে মনে চেয়ে এসেছি । আলো আরও কমে আসতে লাগলো ।  সমুদ্র  অনেক দূরে ছিল  তো আমরা তাই  অনেক দূর চলে যেতে লাগলাম ।  পায়ের পাতায় এবারে জল ছুঁয়ে যাচ্ছে । পিছন ফিরে আর দেখছি ই না।
চিড়িয়াটাপু তে শুধু সমুদ্র ,বন আর পাহাড় ই নেই আছে প্রচুর পাখি । পাখির জন্যই জায়গাটার এমন নাম ।

হঠাত মনে হল খুব দূর থেকে কিসের যেন আওয়াজ শোনা  যাচ্ছে ।ঠিক ভালো করে বোঝা  যাচ্ছে না । পেছন ফিরলাম । তারপর যা দেখলাম ! শুধু বুঝতে  পারলাম শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে একটা ঠান্ডা স্রোত । আমরা চলে এসেছি তীর থেকে অনেক দূর ।কখন যে জলে থই থই হয়ে গেছে চারদিক বুঝতেই পারিনি ।  নিঃশব্দে চুপিচুপি জল আমাদের ঘিরে ধরেছে । যে জায়গাটা  ছিল ধূ ধূ বালি বালি ,তা জলে উপচে পড়ছে। একেবারে টইটম্বুর। আর সেই উথলানো জলের ওপারে লিলিপুটের মত কিছু লোক হাত নেড়ে কাউকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছে মনে হচ্ছে । কাউকে আবার কি? আমাদেরই ডাকছে প্রাণপণে । আমরা জলবন্দী । তার চেয়েও বড় কথা যে জল শুধু  পায়ের পাতা ছুঁয়ে ছিল তা এখন হাঁটু ছাড়িয়ে যাচ্ছে । হাল্কা অন্ধকার নেমে আসছে । বালির স্তর কোথায় কেমন জানা নেই। পা দিলেই ভুস করে যাব কিনা জানা নেই । চোরাবালি আছে কিনা, আন্ডার কারেন্ট আছে কিনা জানা নেই , কিচ্ছু জানা নেই । এতটা পথ যাব কি করে? কয়েক মুহূর্ত মাথা একদম কাজ করল না । তারপর ঠাহর করে দেখলাম পারে দাঁড়ানো লোকেরা হাত দিয়ে একটা ডিরেকশন দিচ্ছে,বলতে চাইছে  যে ভাবে আমরা দেখাচ্ছি এইভাবে এস। হাত ধরাধরি করে আমরা সেই ভাবে কিছুদূর এগুলাম । অনেকটা সেমি সারকুলার ভাবে এগিয়ে চললাম । চেহারাগুলো খানিক টা স্পষ্ট হল । দেখলাম একটি দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার ।বাবা মা ভাই বোন । খুব উদ্বিগ্ন । এদিকে তাদের সঙ্গে জুটেছে স্থানীয় একটি লোক। একটা ভাঙা  গাছের ডাল দিয়ে এবার সে পথ বাতলাতে থাকল । সোজা ভাবে নয় আমাদের ঘুর পথে ডাঙায় উঠতে হবে । কারণ সোজা পথে বিপদ আছে । এখানে গভীর নালার মত একটা কিছু আছে, অসতর্কতায় পা ফেললে সিধে সলিল সমাধি  খুব অসহায় লাগছিল। মনে আছে অনেক কসরত করে যখন পারে এসে পৌঁছলাম,কন্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ । সবাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগল আমরা কী কী বিপদ পেরিয়ে এসেছি । ওরা আগে থেকেই স্পটটা সম্মন্ধে জানতেন ।  প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন ,আচমকাই আমাদের দেখতে পান। তারপর তো যাবার প্রশ্নই ওঠেনা । ভাঁটায় জল সরে গেলে আহাম্মকি করে অত দূরে যাবার দুঃসাহস না দেখানোই ভাল কারণ, ইউ নেভার নো,কী হতে পারে ! প্রকৃতি একটা রহস্য । যে রহস্যের তল কেউ পায় নি । তাকে দূর থেকে দেখাই ভালো ।

চিড়িয়াটাপু 

ফিরে আসবার সময় মেঘ কেটে মস্ত চাঁদ উঠেছিল ।  ঝাউ গাছের মাথায় ভেজা হাওয়ার শোঁ  শোঁ  শব্দ । ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল জলের উপর মুখ উঁচিয়ে ছিল ।


আমার আর ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিল না।

নামে কী এসে যায় ?

মাদের বাড়িতে ইলেকট্রিকের যাবতীয় কাজ করত জগা । এখনও করে । হামেশাই তার আবির্ভাব ঘটে আমাদের বাড়িতে । বাবা  একদিন তাকে জিগ্যেস করেন ,হ্যাঁরে জগা ? তোর কোন ভাল নাম নেই? 
হ্যাঁ জ্যাঠামশাই ,আছে।  আমার নাম আসলে জগন্নাথ 
একদিন জগা মন দিয়ে  বারান্দায় দেওয়ালির টুনি বাল্ব লাগাচ্ছে মায়ের ফরমাইশ মতো। বাবা জগন্নাথ জগন্নাথ বলে ডাকছে ,জগা সাড়া দিচ্ছে না । বাবা কাছে গিয়ে খুব জোরে ডাকায় জগা খুব লজ্জা পেয়ে বলেছিল “আসলে ওই নামটা শোনার তেমন ওব্যেস নেই তো । আপনি আমার পাড়াতে গিয়ে ওই নামে খোঁজ করলে কেউ কিচ্ছু বুঝতেই পারবে না।

 আমাদের চারপাশের লোকজনদের অনেকের নাম আমরা অনেক সময় জানতেই পারি না বা জানার চেষ্টাও বড় একটা করি না  যেমন কেউ  হয়ত সারাজীবন মুখারজিদা,মুখারজি বাবু, ওহে মুখুজ্জে এইসব শুনেই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তার যে একটা কিংশুকবরণ বা অমিতকিরণ গোছের সুমধুর নাম থাকতে পারে সেটা আর কেই বা ভেবে দেখছে? সে রকমই মেয়েদের ক্ষেত্রে মিস বা মিসেস । আবার অমুকের মা তমুকের মা বলে ডাকবার রেওয়াজ আছে । অথবা  আবার কিছু কিছু পেশা যেমন ড্রাইভার, দারোয়ান যাদের সঙ্গে  প্রায় প্রতিদিনের সম্পর্ক, তাদেরও নাম অনেকে জানেই না  বা জানতেও চায় না    মোট কথা  যাদের সঙ্গে প্রতিদিনের লেনদেন তাদের তার নাম না ধরে ডাকার ব্যাপারটা আমার বাবা পছন্দ করতেন না।

সে যাই হোক না কেন , বাবার এই ব্যাপারটা আমার বেশ ভাল লাগত।  কারুর আসল নাম খোঁজার মধ্যে যেন তার অস্তিত্ব, তার সত্তা টুকু কে খুঁজে নেবার চেষ্টা । আমি নকল করতে চাইতাম এবং নাকালও  হতাম অনেকসময় ।
একবার আমাদের আপিসে আমার এক সহকর্মীর গাড়িটা আমার দরকার হয়েছিল । ফিরে এসে  তাকে জানিয়ে দিই , “বিট্টুকে ছেড়ে দিয়েছি।

কে?  বিট্টুটা আবার কে? তাকে তুমি ছাড়তেই বা গেলে কেন? আর তাতে আমিই বা কী করতে পারি?”

বললাম, “তোমার ড্রাইভারটাকে ছেড়ে দিয়েছি ।আমার কাজ হয়ে গেছে।

ওঃ তাই বল ! তা ওর নাম বিট্টু নাকি?”

ভুবনেশ্বরে বদলির সময় বাবা সঙ্গে গেছিলেন  বাড়ি পেতে কিছুটা দেরি হবে। আমরা গেস্ট হাউসে আছি আপিসের লোকেরা বলে গেছে এখানকার কেয়ারটেকার কাম কুক কাম চৌকিদার ঘড়াই আপনার দেখভাল করবে। আমি কাজ টাজ বুঝে নিয়ে গেস্ট হাউসে ফিরে বুঝতে পারলাম বাবা এর মধ্যে ঘড়াই এর আর্থ সামাজিক অবস্থানের একটা হিশেব নিয়ে ফেলেছেন অর্থাৎ বাড়িতে কে কে আছে? কটি ছেলে মেয়ে? তারা পড়াশুনো করে কিনা ? স্ত্রীর ঠিকমতো যত্ন সে নেয় কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি । কিন্তু আমাকে দেখেই বাবার প্রথম কথা হল জানিস ওর একটা ভাল নাম আছে । যোগিন্দর মানে যোগীন্দ্র আর কি!
আমরা ওকে যোগিন্দর বলে ডাকা শুরু করলাম । প্রবল মুখচোরা যোগিন্দর একদিন জানাল রান্নাঘরে কয়েকটা জিনিশ না কিনলেই নয় , আমি যেন অফিসে একটু বলে দিই ।
ঠিক আছে ।বলে দেওয়া যাবে।

আমি বড় বাবুকে ডেকে বলি শুনুন,যোগিন্দর বলছিল কতগুলো জিনিশ তাড়াতাড়ি কিনতে হবে।

যোগিন্দর? গেস্ট হাউসে?  ম্যাডাম আপনি নতুন এসেছেন,কার সঙ্গে কথা বলেছেন কি জানি? একা একা 


থাকেন। অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে এত কথা বলবেন না । ওখানে যোগিন্দর বলে কেউ থাকে না । 



ওখানে ঘড়াই থাকে ,ঘড়াই।


বাড়ি পাবার পর আমার   সাহায্যকারী হিসেবে পেলাম রেড্ডিকে ।  আশ্চর্য ! এরও আসল নাম কেউ জানে না । ওকে সব্বাই রেড্ডি বলেই জানে । রেড্ডি কর্মপটুত্বে নয়, হৃদয় গুণে আমাদের সকলের মন জয় করেছিল। বাবা পরে বেড়াতে এসে জেনে নিয়ে ছিলেন ওর নাম পি কৃষ্ণ মোহন রেড্ডি । বাবা যখন কৃষ্ণ মোওও হঅন বলে দূর থেকে লম্বা ডাক দিতেন আমি পষ্ট দেখছি রেড্ডির বডি ল্যাঙ্গুএজ বদলে যেত ।তার চোখদুটো চকচক করে উঠত, কান পর্যন্ত  টানা হাসি নিয়ে সে দৌড়ে চলে যেত বাবার কাছে ।

বাবা  আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর টেলিফোনের ওপাশ থেকে কান্না মাখা গলায় রেড্ডি বলেছিল ,’সাবজি মুঝে কৃষ্ণ মোহন বুলাতে থে । অ্যায়সা কোই নহি বুলায়া আজ তক

Friday 27 June 2014

আঙুর বাগানের লোক


পেত্রা আজ সকাল থেকে ব্যস্ত। আজ সে দোলমা বানাবে । কুচি কুচি চুল উড়ে যাচ্ছে তার কপালের
চারদিকে । নাকে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম । গরম পড়েছে। ঈজিয়ন সাগর থেকে একটা নোনা হাওয়া

দিচ্ছে ।চারদিকে নীল সমুদ্র, বালু ভূমি আর রোদ্দুর । পেত্রার বাড়িটা পাহাড়ের খাঁজে। সাদা রঙের ।
পেত্রার বাড়ি /উৎস ঃ গুগল

মাথাটা গোল, নীল রঙের । আর পাঁচটা বাড়ির মতই।গ্রিসে যেমন হয় তেমনই । তাদের বাড়ির দেয়ালে লতিয়ে উঠছে আইভি লতা আর প্রিমরোজ । পেত্রার স্বামী কাজ করে এথেন্সে । সে ছুটি পেয়ে বাড়ি আসছে । তাই পেত্রার কাজের আর শেষ নেই । 
এমনিতে সে খুব একটা লম্বা নয় ,তাই একটা আঁকশি দিয়ে আঙুর পাতা পাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে । ওদিকে চুলায় ধিকিধিকি সিদ্ধ হচ্ছে বেঁটে দানার ভাত আর গোরুর মাংসের কিমা ।
অনেক আঙুর পাতা পাড়া হয়েছে । কাঠের বালতিতে জল নিয়ে পেত্রা গলা সপ্তমে তোলে 
“...অরেস্টিস‌,কোথায় গেলি ,বাঁদর ছেলে? এদিকে আয় ,পাতাগুলো জল দিয়ে ধুয়ে দে।অরেস্টিসের 
কোন পাত্তা নেই । এদিক ওদিক তাকিয়ে পেত্রা নিজেই ধুতে শুরু করে। গোরুর মাংসের কিমার মধ্যে খানিকটা ওয়াইন ঢেলে দেয়। ওয়াইন তাদের বাড়িতেই বানানো হয় । আঙুরবাগিচা তাদের আছে মোট
তিনটে । তাদের দেখভাল কি কম হ্যাপার কাজ । এ কাজ টা সে ক্রিস্তফারকে ঠেকা দিয়েছে। ওয়াইনের পিপেগুলো অন্ধকার কুঠরিতে থাকে । যত পুরনো হয় তত দাম চড়ে। পেত্রার ব্যবসায়িক 
বুদ্ধির তারিফ করতে হয় ।
আঙুর পাতার মধ্যে ভাত মাংসের পুর ভরে চটপট দোলমা বানানোর কাজ টা সেরে ফেলে সে । আর হ্যাঁ, পেত্রার বাড়িতে তৈরি হয় দই আর চীজ, ফেতা চীজ। আঙুর আর দই চীজের একটা অদ্ভুত গন্ধে
তার ঘর উঠোন ভরে থাকে । তাদের একটা অলিভ বাগিচাও ছিল একসময় । এখন অলিভ তেল আর অলিভ বাইরে থেকেই জোগাড় করে সে । পেত্রা তার সাদা নীল চৌখুপি কাটা এপ্রনে হাত মুছে
নেয় । তার মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা । ক্রিট দ্বীপে তার বাপের বাড়ি হবার সুবাদে মাছ ধরা কাটায় সে ওস্তাদ । অরেস্টিসের বাবার জন্য পেত্রা বানাচ্ছে দোলমা, টাটকা ফেতা চীজ আর ঝলসানো 
বেগুন আর টোম্যাটো, রসুন আর গোল মরিচ মাখানো ,তার ওপর ঢালবে অলিভ তেল । পিটা ব্রেড সদ্য আভেন থেকে বের করে আনবে । ক্রিট দ্বীপের খাবার আপাকি বানাতে চায় সে । শুয়োরের
মাংসের। এর সঙ্গে দেবে দই এর মধ্যে কুচি করে শশা,অলিভ তেল ,অরেগানো, পারস্লে, দিল, থাইম আর সেজ । এর নাম জাতজিকি । সামুদ্রিক মাছের ফিলে দিয়ে বানাবে মাছের সুপ কাকাভিয়া ।
মিস্টির মধ্যে বানাচ্ছে আমন্ড বাদামের কেক ওপরে ঘরে বানানো তাজা ক্রিম আর বাকলাভা ।বাকলাভাতে একটু ঝামেলা আছে । কিন্তু সেটা বানাতে হবেই অরেস্টিসের জন্য । নইলে সে বিচ্ছুকে 
কে সামলাবে? 
এ সব কথা ভাবতে ভাবতে পেত্রার নীল চোখ হাসিতে ঝিকিয়ে ওঠে । কিন্তু কথায় সেই দস্যিটা ? অনেকক্ষণ দেখছি না তো ! অরেস্টিস একটা মিস্টি ছেলে আবার বিচ্ছুও । এরই মধ্যে চার্চের কয়ারে 
বেহালায় ছড় টানে । আবার আঙুর জলপাই পায়ের তলায় চেপে চেপে উঠোন নোংরা করে । কাঠ বিড়ালির লেজ কেটে দেয় । অলিভপাতার মুকুট বানিয়ে রাজা রাজা খেলে । আর সুযোগ পেলেই 
সমুদ্রের ধারে চলে যায় । দুই নীল চোখ দিয়ে মাপতে চায় ওই সুদূর নীলিমার গভীরতা । সমুদ্রের ফ্যানা জমে কত রকমের আকার নেয়। অরেস্টিস সেগুলো জমায় । আর নানারকম শঙ্খ,নুড়ি, ঝিনুক
সন্ধে নামার সময় তাদের এই এভিয়া দ্বীপের নোনা হাওয়ায় মিশে যায় বুনো ল্যাভেন্ডার আর আইরিসের গন্ধ । সন্ধের আকাশ ভরে ওঠে অজস্র তারায়। ওই দুই চোখ দিয়ে সে পড়বার চেষ্টা
করে তারার প্রদীপে লেখা কোন সঙ্কেত বাণী । যতক্ষণ না পর্যন্ত পেত্রা এসে তাকে টেনে নিয়ে না যায় সে বসেই থাকে আর ভাবে ।

নাহ,আর তো বসে থাকলে চলে না । পেত্রা ছেলেকে খুঁজতে বের হয় । খুঁজতে খুঁজতে আঙুর বাগানের রাস্তায় ঢোকে । তার স্বামীরা ছিল দেলফি এলাকার লোক । দেলফির সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর
নামে তার নাম । আঙুর বাগানে আলোছায়ার নক্সা বুনছে দুপুরের রোদ্দুর । সী গালের চিলচিতকার দূর থেকে শুধু শোনা যাচ্ছে । এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই । শুধু পাতার ঝিরঝির । 
বাগানের যে পথ টা ঢালু হয়ে বেলাভূমিতে মিশেছে, পেত্রা দেখতে পায় সে পথ দিয়ে আঙুর বাগানের দিকে উঠে আসছে বাবা আর ছেলে। অরেস্টিসের খালি পা।সারা শরীর বালি মাখা, তার পরনের সাদা 
পাতলা ঢলঢলে জামা হাওয়ায় ফুলে ফুলে উঠছে । তার লাল লাল চুলে ঝিকঝিক করছে অভ্রকুচি,ঠোঁট দুটো করমচার মত টুকটুকে ।আর দুই নীল চোখ জুড়ে দুষ্টুমি ।সে যেন এই পৃথিবীর
নয়, যেন সিস্তিন চ্যাপেলের ফ্রেসকো নেমে এসেছে মাটিতে ।তড়িঘড়ি এগিয়ে যায় পেত্রা। ওমা, ওকি ?বাবা আর ছেলের হাত ভর্তি কালামারি । এই শেষ বেলায় ? 
তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনে বলে ওঠে, আজ রান্না হবে কালামারি দিয়ে রিসত্তো ।
পিয়ালি আর অরো
কয়েক শতাব্দী বাদে আবার ফিরে এসেছে সেই আঙুর বাগানের মা ও ছেলে ।
সময়ের জোনাকিমেলায় তারা রূপ বদলে নিয়েছে। হয়েছে পিয়ালি আর অরো । কিন্তু সব কিছু কি

বদলানো যায়? বদলানো কি যায় সেই লাল লাল চুল আর নীল নীল চোখ?

Thursday 26 June 2014

আঁখো দেখি

যা চোখে দেখিনি কানে শুনিনি তা বাপু বিশ্বাস করছিনা , এই নড়বড়ে ভাঙাচোরা ডোবাপুকুরের মত  জীবনে এর থেকে বড় আহাম্মকি আর কিছু  আছে কি?
সেবারে লিঙ্গরাজের জিম্মায় আমাকে রেখে  বাবা ভুবনেশ্বর ছাড়বার পর থেকে  আমার নতুন বাড়িটাকে কীভাবে বাসযোগ্য করা  যায় সেটা আমার প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়ালো । বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরমে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ওই আশ শ্যাওড়া ,কালকাসুন্দি আর যজ্ঞি ডুমুর গাছের ঘন জঙ্গলে ঢাকা এক তলা বাড়িটা  দেখে মেয়ের মনের ভাব কী হতে পারে সেটা তো বাবার জানাই ছিল তাই আর কা্লক্ষেপ না করে  বলে ওঠেন,’’আরে এত তপোবন । বাঃ,তার ওপর আবার পঞ্চবটী , স্থান মাহাত্ম্য আছে বলতেই হবে । একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে এই আর কি
বাবা পঞ্চবটীর গাছগুলো কী করে এতো তাড়াতাড়ি আইডেন্টিফাই করল এসব প্রশ্ন তখন আমার মনে আসেনি । সাজিয়ে গুছিয়ে নেবার কাজটা কি রকম চলছে দেখার জন্য একদিন  দুপুরবেলা গেছিলাম ,দেখলাম চারদিকে প্রবল ঘুঘু ডাকছে আর দুটো রঙের মিস্ত্রি হাঁ করে ঘুমোচ্ছে । এক চুল কাজও এগোয় নি। মনটা বেজায় মুষড়ে পড়ল । অবশেষে এক দিন সত্যি সত্যি বাড়িটায় গিয়ে উঠলাম । জঙ্গল পরিষ্কার  করতে কিছুলোকের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল । শুঁয়ো পোকা, জোঁক আর চড়াই পাখির সাইজের মশা তাদের প্রায় প্রায় মেরেই ফেলেছিল আর কি ।  মনে আছে একজনের ধুম জ্বর এসে গেছিল । কিন্তু আসল রহস্যের তখনো বাকি ছিল।

অফিসের বড়বাবু কান টান চুল কে বলল, “চারদিকে একটু কার্বলিক অ্যাসিড দেবেন। একটু গাছ টাছ  আছে তো? আর ওই যে... যাক গে সে পরে হবে খোন ।তার মানে? সাপ আছে? আর কি কি আছে?”
হ্যাঁ রে নন্দনা এরা কি বলে গেল রে?”। নন্দনা আমার বন্ধু  সে  ভুবনেশ্বরে   ছিল । অন্য অফিসে।
আমার এ হেন অজ্ঞতায় ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে নন্দনা বলে ডোন্ট ইউ নো ? ভুবনেশ্বর ইস দ্য  ল্যান্ড অফ কোবরাস । আই থট ইউ অলরেডি নো “,এই বলে সে তার বিস্তারিত অভিজ্ঞতা ,”হোয়েন মাই মম ইন  ল কেম ,দ্যাট ডে ইন দ্য কিচেন... দ্যাট ডে হোয়েন ছোটু  ওপেন্ড দ্য  লেটার বক্স.”.. ...আমার কাছে একের পর ধারাবিবরণী দিতে থাকে আর আমি নিজের ক্ষমাহীন অজ্ঞতায় জর্জরিত হতে থাকি। নন্দনার পরামর্শ মত সারা বাড়ি বাইরে এবং ভেতরে রাখা হল কার্বলিক অ্যাসিড ভরা ছোট ছোট কাঁচের শিশি ,ছিপিতে ফুটো করে 
নতুন জীবন শুরু হল। দেদার টেনশন মাথায় নিয়ে ।
অফিসে আমার সহকারী একটি মেয়ে ছিল এমলিন খালকো ।সম্বল পুরের মেয়ে , বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে একা একা থাকে আর ভারি ঠাণ্ডা চুপচাপ । আমি তারিফ করে বললাম এমলিন ,তোমার তো খুব সাহস ,বাচ্চা নিয়ে কেমন একা একা থাকো 
এমলিন তার ঠান্ডা চোখদুটো  বড় বড় করে বলল , ম্যাডাম আপনি আমাকে কী বলছেন! আমরা তো আপনাকে নিয়ে আলোচনা করি, সত্যি আপনার সাহসের জবাব নেই,ক্যায়সে রহতে হ্যাঁয় আপ উয়ো ভূত বাংলা মে? বলে কি মেয়েটা? নিজের সীমাহীন অজ্ঞতা তো বটেই সেই সঙ্গে নিজের বোকা স্বভাব টার জন্য গা জ্বলে যেতে  লাগল আমার । কি দরকার ছিল এমলিনের সঙ্গে অত সুখদু:খের কথা বলার? চোখের সামনে ভাসতে লাগল ঘোর জঙ্গলে ঢাকা ইউনিট ওয়ানের ১১ নম্বর একতলা বাড়ি ,সাপ  আর...
এলাকা টা এমনিতেই খুব নিঝঝুম । একেকটা বাড়ির মধ্যে দূরত্ব অনেক । টিমটিমে আলো জ্বলে ।
ঝোপঝাড় বলে আরো ম্লান দেখায় । আর আমার কল্পনাশক্তি আমাকে  কখনোই রেহাই দেয়না। রাতে ঘুমোতেও দেয় না ।

ধীরে ধীরে একে একে অনেক শুভানুধ্যায়ীর দল নানান রকম ভাবে আমাকে বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন যে ১২ নম্বর বাড়িটা অর্থাৎ জোড়া বাংলোর একদিক টা যাকে বলে হন্টেড হাউস । ১২ নম্বরে কেউ থাকতেই পারে না । ওনাদের তো গতিবিধির কোন বাধা নেই।। ১২ থেকে ১১ নম্বরে এসে পড়লেই হল। আপন এঠারে  কেমিতি রহিবে? রসিয়ে খেলিয়ে একটি রোম হর্ষক গপ্পো আমাকে শোনাতে আসতো অনেকে । যেন  মজা দেখতে এসেছে । শেষে এমনটা হল যে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে   আমাকে  অনেককে  এড়িয়ে চলতে শিখতে হল ।
এর মধ্যে মিত্তুন এসে বাড়ির সদস্য সংখ্যা বাড়াল ।  বাড়ি থেকে বলল, “বনবাদাড়ে থাকিস, যেতে চাইছে যখন সঙ্গে নিয়ে যা  স্বেচ্ছায় এই বনবাস বেছে নিয়ে সে যে খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় নি সেটা সে আসা মাত্রই বুঝতে পেরেছিল । মিত্তুন কলকাতায় আমার ঝরঝরে ফিয়াট টা অসীম দক্ষতায় চালাত । কী করে তা সেই ভাল বলতে পারবে।  সে বাঘের বাচ্চা । ভয়ডর নেই । ডাকাবুকো । তখন তার কৈশোর কাটেনি বললেই চলে । আমার মা তাকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসেন।

দিন চলতে লাগলো । ফি হপ্তায় মিত্তুনের হাতে বাড়ি ভূতবাংলা সবকিছু  ছেড়ে  দিয়ে আমি কলকাতায় কেটে পড়তাম। মিত্তুন আমার মুন্ডপাত করত ।একে একে রেড্ডি এল, আমাদের অন্নসংস্থানের দায়িত্ব নিয়ে,এল বদন মালি । কতো মাস কেটে গেল ।

১১ নং  বাড়ির  বাগান  

বাগানে জিনিয়া,সূর্য মুখী ফুটল । মাঝখানে মা এলো । বাড়ি আরো  পরিষ্কার হল , রেড্ডি মায়ের জাদুমন্ত্রবলে আলুপোস্ত , মুসুরির পাতলা ডাল, মাছের ঝোল ,আমের টক বানাতে শিখে গেল,আমাদের বাধ্যতা মূলক ঝুরুঙ্গা ভাজি(বরবটি ভাজা)খাবার দিন শেষ হল ,পেছনের আউট হাউসে গোপী আর লছমি সংসার পাতলো,উইকেন্ডে পুরী যাওয়া শুরু হল ,ভাল ভাল বন্ধু হল , কোকিল , পিউ কাঁহা ,বোউ কথা কও সঙ্গ দিতে লাগলো , শিশু  ভুর্সুঙ্গা পত্র (কা রি পাতা ) তরুণী হল ,এমনকি গাছের আম পেড়ে আচার বানিয়ে কলকাতায় সাপ্লাই দেওয়াও শুরু হল।
এর পর একটা লম্বা ছুটিতে কলকাতা গেলাম মিত্তুন সহ । বাড়িতে দিব্যি আড্ডা চলছে । আমি বললাম ,”তাহলে দেখলে? বেশ ভালোই তো কাটাচ্ছি ওখানে । সাপ ভূত কিছুই তো চোখে পড়লো না।
সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম মা আর মিত্তুনের মধ্যে যেন চোখাচোখি হল এবং হঠাত ই মিত্তুন উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায়  বলতে শুরু করল ,ওঃ বললেই হল?  আপনাকে যেন সবকথা জানানো হত? সাপ আর নেই বুঝি ? আমি আর রেড্ডি কি কম মেরেছি? বাড়ির গেট জুড়ে তো সাপ শুয়ে থাকে ,আমার বাথরুমে প্রায় প্রতিদিন চিতি সাপ ঢুকে থাকে , আর কামিনী গাছের ঝোপে ?ওই যে সেদিন জিজ্ঞেস করছিলেন তোরা ওখানে কি করছিস ? ওখানে কেউটের বাচ্চা ঢুকে গেছিল। আর বদন মালি ত হামেশাই ঘাস কাটতে গিয়ে সাপ ধরে ফেলত । মা কে সব জানাতাম টেলিফোনে ,আপনি অফিস চলে গেলে  । মা বলে দিয়েছিলেন খবরদার, দিদির কানে ওসব তুলিস না । পাঁচ ব্যাটারির টর্চ আর লাঠিটা কি এমনি এমনি রাখতাম? আরো শুনুন , আপনি তো দিব্যি চলে যেতেন কলকাতা। একদিন রাতে গোপী বলল চল আজ একসাথে খাই,খিচুড়ি বানাই ।রাত একটু বেশি হয়ে গেছিল ।আপনার বেড রুম লাগোয়া ঢাকা বারান্দায় খেতে বসলাম ।বললে বিশ্বাস করবেন নি দিদি , হঠাত বারান্দার সামনের বট গাছ টা প্রচণ্ড জোড়ে দুলে উঠল যেন ঝড় এসেছে ।কিন্তু চারদিকে ঝড়ের নামগন্ধ নেই ,হাওয়াও দিচ্ছিল না সেদিন ।  গোপী তো  দে ছুট ।আমাকেও বলল চলে যেতে একটা খুব জোরে ঝুপ করে আওয়াজ । গোপী চেঁচাল মিত্তুন বিলকুল পিছে মত দেখনা এই দেখুন গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে...
ভু ব নে শ্ব রের  বা ড়ি