তখনো জঙ্গলে সেগুন গাছগুলোতে নতুন পাতা আসে নি । এটা পাতা ঝরার ঠিক পরের সময় । পতঝর। সবে বসন্তের শুরু। একটা জিপে করে রাঁচি থেকে ডালটনগঞ্জ লাতেহার হয়ে পালামউ জেলার বেতলা ছিল আমাদের পাঁচজনের গন্তব্য।
বেতলা নামটার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাইসন,এলিফ্যান্ট,টাইগার,লেপারড,অ্যাক্সিস
অ্যাক্সিস এর সব কটা ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর গুলো। অর্থাৎ কিনা বেতলায় দেদার পাওয়া যাবে বাইসন,হাতি,বাঘ,চিতা আর চিতল হরিণের
দল। সহাবস্থান, তবে শান্তিপূর্ণ কিনা ওরাই জানে ।
“পায়ে হাঁটা মানা”এই নিষেধ বাণী দিয়ে জঙ্গলের শুরু। জিপের সামনে উড়ে এল একটা নীলকণ্ঠ পাখি ,গায়ে পড়ে পথ চিনিয়ে দিতে থাকল আমাদের। পাতা ঝরে গেছে বলে জঙ্গল কেমন যেন
ন্যাড়া ন্যাড়া । কিন্তু সেই ঠান্ডা ঠান্ডা বুনো গন্ধটা আর ধোঁয়া ধোঁয়া নীলচে
আলোটায় কোন ভেজাল ছিল না। যারা জঙ্গলে ঘোরে তারা জানে ঠা ঠা রোদ্দুরে বনের মধ্যে
একটা ঝিমঝিমে নীলচে ধোঁয়া দেখা যায়। জিপের চারদিক খোলা,পেছনে
দাঁড়িয়ে পড় , গভীর শ্বাস নাও ,জঙ্গলের
বুকের ঘ্রাণ । নিবিড় ঘেসো গন্ধ । দেখা যায় পাল পাল হরিণ –চিত্রল
হরিণ ।আর ছোট আকারের মাউস হরিণ ।অনেকে তাচ্ছিল্য করে বলে ওঃ জঙ্গলের ছাগল আর কি!
অজস্র বাঁদর আর লঙ্গুরের আড্ডা । আর গদাম বাবুর মত গাম্বুট পরা বাইসন। আর পাতার
ফাঁকে মোর আর মোরনির বিশ্রম্ভালাপ ।
রাতে জ্যোৎস্নায় ভিজতে ভিজতে বনবিভাগের ক্যান্টিনে খেতে গেলাম। শুনশান
চারধার । কোথাও বিজলি নেই । বছর কুড়ি আগেকার ঘটনা। তখন কারেন্টের বেহাল অবস্থা ছিল ঝাড়খন্ডে। সে
দিন ছিল অনাবিল চাঁদনি রাত । আ...উ আ...উ শব্দে হরিণ ডাকছে । এসব ডাকের আবার নানান
রকম মানে আছে। প্রথমে অ্যালার্ম বেল বাজায় বাঁদর এবং লঙ্গুর বাহিনী । গাছের টঙে
চড়ে চারদিক তাকিয়ে তারা টহলদারি করে । তিনি বের হলেই এই তৎপর বাহিনী সিগন্যাল দিতে শুরু করে বাকি সব্বাইকে। অ্যালার্ম
কল।এরপর হরিণের দল তীরবেগে নিরাপদ জায়গার দিকে ছুটতে থাকে ।এবং ওই আ...উ আ...উ
ডাকও শোনা যায় সঙ্গে সঙ্গে । তীর বেগে হরিণ যদি ছুট্টে চলে যায় বুঝে নিতে হবে তিনি
ধারে কাছেই আছেন । এমনটা দেখেছিলাম তাড়োবার জঙ্গলে । যাই হোক,
ওই চাঁদনি রাত, হরিণের ডাক ,বিজলিহীন বনবাংলো ,চারদিকের ঘন অন্ধকারে বেশ একটা
শিরশিরে অপার্থিব অনুভূতি ছিল তা এতো বছর পরেও দিব্বি তাজা
আছে দেখছি। টঙের ওপর ছোট্টো খুপরি ঘরে উঠে ওঅ্যারলেসে কথা বলা হল ডাল্টন গঞ্জের
বনবিভাগের বড়কর্তা সেন সাহেবের সঙ্গে।
বনবাংলোর ছড়ান চাতালে চেয়ারে গা এলিয়ে সব বসলাম ।
কোন এক মাতাল এক
অদ্ভুত মায়াবি গলায় বহুদূর থেকে গানের সুরের মত কী যেন একটা হেঁকে হেঁকে চলে গেল ।তার রেশ তা রয়ে গেল অনেকক্ষণ ।
পরেরদিন সকাল পাঁচটায় ছাব্বিশ বছরের জুহির পিঠে চেপে আবার জঙ্গল।
জুহি চলছে আরেকটু গহিন বনে এবড়ো খেবড়ো উঁচু নীচু পথ দিয়ে । জঙ্গলে পরতে হয় পাটকিলে
পাঁশুটে রঙের জামা। গাছের পাতা হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো মাথায়,মুখে। শাল,শিশু,মহুয়া,কেন্দু ,বাঁশ হৈ হৈ করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতির পিঠে
দুলতে দুলতে চলেছি । কিন্তু বেশ কষ্টকর এই দুলুনি । জুহির নাম ধরে ডাকলে সে শুঁড়
তুলে নমস্তে করে। বিস্কুট খায় । গদাম বাবুর মত দাঁড়িয়ে থাকা বাইসন কে হেলায় পাশ
কাটিয়ে চলে যায় ।
দূরে দেখা যাচ্ছে বাঘের গুহা ।বিভিন্ন এলাকায় দুটি করে বাঘ থাকে। এই এলাকায় বাঘিনীর সঙ্গে বাচ্চাও আছে আবার। দেখতে পেলাম সেই পয়দল চলা বারণ পথে কুঠার হাতে দুটো লোক হেঁটেহেঁটে আসছে । আমাদের মাহুত একটু দাঁড়ালো । খুব নরম গলায় ওরা মাহুতের সঙ্গে কথা বলতে লাগলো তাঁকে নিয়ে । কোথায় তাঁর পদচিহ্ন দেখা গেছে, কোথায় তিনি জলপান করেছেন । ওইদুটি লোক হলো বাঘের গতিবিধির রিপোর্টার । আমাদের মাহুত জানাল আজ সকাল থেকে তাঁর টিকিটিও দেখা যায় নি। জঙ্গল আর তার বাসিন্দাদের নিয়ে মাহুত আর ওই লোকদুটোর কী মায়া ! লক্ষ্য করছিলাম, তারা অসম্ভব মমতা আর স্নেহ মিশিয়ে কথা বলছিল যেন কোন প্রিয়জনকে নিয়ে কথা বলছে। বাঘ,চিতা এদের খতরনাক বলতে এরা নারাজ । তাদের সাফ কথা “ইনসান কি তরহা খতরনাক কোই নহি” । পূর্ণ বয়স্ক বাঘ রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁসে চলে।
সন্ধেবেলা আবার সেই বনবাংলোর চাতাল ।গা এলানো চেয়ার ।যথারীতি
নিয়মমাফিক থালার মত বিশাল চাঁদ। পাতার কাঁপন ,ঠান্ডা
হাওয়া সবই মজুত ছিল। আমরা গোল হয়ে বসেছি। হালকা হাসি ,হালকা
কথা। এইসব জায়গা কথা বলার জন্য নয়। দেখলাম দুটো কুকুর এল কোত্থেকে । নিঃশব্দে।
নেড়ি কুকুর নয় মোটেও। মাটির থেকে উচ্চতা কম। শরীরটা ছোটখাট। কিন্তু
বাচ্চা কুকুর নয়। কোন হাঁক ডাক নেই। পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানার মত জোছনা রাতে
আমাদের চারদিকে খেলতে লাগল । হঠাত ই দেখলাম দুটোর জায়গায় এখন তিনটে কুকুর। কোত্থেকে এল এরা ? হুটোপুটি করছে,এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে, কোন শব্দ নেই। একি রে বাবা!
তিনটে কুকুর চারটে হয়ে গেল । খেলছে ,খেলছে । আবছা আলো
আঁধারির মধ্যে । আমাদের আশেপাশেই। কোনও শব্দ নেই। তারপর একসময় তাদের আর দেখা গেল
না।
আমরা কেউ কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। হয়ত বলতে চাইছিলাম না। এখন তাই
মনে হয় । অনেকক্ষণ পর যে যার মত উঠে নিজেদের ঘরের দিকে পা ঘষটে ঘষটে যেতে লাগলাম
। সঙ্গীদের কেউ বলে উঠল “কুকুরগুলো লক্ষ্য করেছিলি?”