Sunday 29 June 2014

পুরুষতন্ত্রের এজেন্ট

ত্যি কথা বলতে কি কলকাতার বাইরে যাবার আগে  লেডিজ সঙ্গীত পার্টি সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই ছিল না। তখনও হাম আপকে হ্যায় কৌন বক্স অফিস কাঁপায় নি ।কাজেই মাধুরীর  দীক্ষিতের পতলি কোমরের লচক আর ঠুমকাও  আমার  বিশেষ জ্ঞান পরিধির বাইরেই ছিল।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানান কিসিমের চিড়িয়ার মত আমরা জড়ো হয়েছিলাম নাগপুরে । নানা ভাষা ,নানা মত, নানা পরিধান লাইনটার  একটা জবরদস্ত প্রমাণ হাতে নাতে পেতে থাকলাম।   জ্ঞানের পরিধি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল ,বাড়তে লাগল পরিচিতির গন্ডি।পরিচিতির গন্ডি পেরিয়ে বন্ধুত্ব ।

বন্ধুত্ব থেকে নিবিড় বন্ধুত্ব ।  বড় বড় গ্রুপ, তার থেকে ছোট ছোট দল। হরেক রকম গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি । ডোবা পরিষ্কার , বেড়া বাঁধা , চড়ুইভাতি, ভিলেজ ভিজিট ,পাঁচমারি সাতপুরায় পিঠে বোঁচকা বেঁধে ট্রেক এইসব কসরতের পর যখন একটু হাঁপ ছাড়ার সময় এসেছে সেই সময় শোনা গেল আমাদেরই একটা মেয়ের সামনেই বিয়ে। সে ঝপ করে বিয়ে সেরেই চলে আসবে এমনটাই ঠিক হয়েছে। কিন্তু তা বললেই তো আর হয় না । নতুন পাতানো বন্ধুর দল প্রায় তেড়ে এসে মৌসুমি কে বলল সে কি? তোমার বিয়েতে সঙ্গীত হবেনা?  কুছ পরোয়া নেই ,আমরা সব অ্যারেঞ্জ করছি খুব মজা করব  হ্যাঁ ? চিরকালের বুদ্ধু  আমি একটু ফাঁপরে পড়লাম । গান বাজনা করবে, এইতো ? তা অতো শুদ্ধ ভাষায় সঙ্গীত সঙ্গীত করার কী দরকার?
আরে বোকা,এটা একটা সেরেমনি  অনুষ্ঠানটার নাম ই তাই।  আর এটা  স্ট্রিক্টলি ফর লেডিস, কাঁহা কাঁহা সে চলে আতে হ্যাঁয় গোছের মুখ করে বন্ধুটি আমাকে বোঝাতে থাকে 

যথাসময়ে সাজুগুজু করে পৌঁছে গিয়ে দেখি আসর জমজমাট । আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে লাল কার্পেটের ওপর একটি ঢোলক । আর সাজগোজের বহরে তো কাউকে প্রায় চিনতেই পারছি না। কজরা গজরা সলমা চুমকিতে আমি তো দিশেহারা ,কোত্থেকে জোটাল এসব এরা? বুঝলাম সৎ কর্মে সদিচ্ছাটাই সব মুশকিল আসান করে দেয়। আসরে প্রবেশ করলেন মহিমা সিংহ এবং অসাধারণ দক্ষতায় কার্পেটের ওপর বসে ভাঁজ করা হাঁটুর নিচে সেট করে নিলেন ঢোলক ।
শুরু হল গান আর দমকা হাসির ছররা ...হম তেরে গলে কি হার সাঁইয়া, কিউ লাওগে সওতনিয়া । সে কি সতীন আবার আসছে কোত্থেকে? দোজবরে কে বিয়ে করছে  নাকি? তাছাড়া জেনারেল নলেজে ম্যারেজ অ্যাক্ট ফ্যাক্ট  কী সব মুখস্থ করেছিলাম না?  তাহলে? এর মধ্যে সলমা চুমকি কজরা গজরা রা দুলতে শুরু করেছে ঢোলকের তালে তালে। গলা মেলাচ্ছে মেরে গজ গজ লম্বে বাল, মেরে লালি লালি গাল, উমর সোলভা সাল , মেরে গোদ মে হ্যায় লাল ও সাঁইয়া ...।  পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো মুখ চোখের ব্যায়াম । স্বামী যাতে কিছুতেই সতীন না আনে তার বহুত মিনতির সঙ্গে এবারে যোগ হতে শুরু করল আরও চমৎকার সব তথ্য  ঘরের বিভিন্ন কোণ থেকে যোগ হতে থাকল ম্যায় হু এম বিবি এস পাস, ম্যায় হু কম্পুটর এঞ্জিনিয়ার ও সাঁইয়া সতীন এনো না প্লিজ 
এই ঘটনার পর অনেক গুলো ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে গেছে। বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে  মুন্নি  বদনাম হুয়ি,শীলা কি জওয়ানি আর চিকনি চামেলি । পুরুষদের জন্য, তাদের ভালো লাগার জন্য তৈরি । তাদের যেমন যেমন ভালো লাগে তারা তেমন তেমন ভাবে মেয়েদের ব্যাবহার করে । বিনোদন আর বিশ্বায়নের পণ্য সংস্কৃতির উদারনীতির ছদ্মবেশে পুরুষ তন্ত্রের হাত  আরো শক্ত হয়। গ্লোবাল  কনজিউমারিজম আর পুরুষতন্ত্র একই মুদ্রার দুটি দিক। বাজার তৈরি হয়,মিডিয়া নতুন স্ট্র্যাটেজি ভাঁজে । বাজার কায়েম করতে সে বেছে নেয়  সবচেয়ে নরম, সবচেয়ে দুর্বল ,সবচেয়ে প্রান্তিক  শ্রেণী টিকে। পণ্য তো এরা ছিলই তাতে এবার এসে পড়ল পাকাপোক্ত  বিশ্বব্যাপী জাল । এখন তারা শুধু অবজেক্ট । জন্মদিনের পোশাক পরা তাদের ছবি সারি সারি ছাপা হয় কাগজের পাতায় পাতায় । তারা সানন্দে ছাপতে দেয়  নারী দিবসে সংবাদ পত্রে বিশেষ ফিচার বের হয় রম্ভা,মেনকা ,উর্বশীদের নিয়ে।  তাদের মেধা নেই,মন নেই, মনন নেই । তারা শুধু অবজেক্ট । এরই মধ্যে চতুর খেলায় চলতে থাকে নানান ব্র্যান্ডিং । মেয়ে বলে কি তারা পিছিয়ে থাকবে এই দুনিয়ায় ? কভি নহি । বেপরোয়া উদ্দাম  অশালীন লাইফ স্টাইলকে ব্র্যান্ডিং করতে থাকে মিডিয়া। আমরাও বাঁচছি দেখ মা। উফ কী এনজয় করছি। পুরুষ তন্ত্র খুব চালাক এবং নিশ্চিন্ত। কারণ তাদের জন্য নীরবে কাজ করে চলেছে বিশ্বস্ত এজেন্ট বাহিনী । কে না জানে কোন সিস্টেমকে সফল করতে তার এজেন্টরা কতটা জরুরী !

কোথায় বা এরা নেই? চার দেওয়ালের তেল নুন মাখা সংসার থেকে শুরু করে সমাজে, হাটে বাজারে , রাজনীতিতে , মিডিয়ায়,বিনোদনে, নারী পাচারে সর্বত্র কাজ করে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে কিছু তাল ভঙ্গ হয় । কিন্তু   প্রতিবাদীদের চেঁচামেচি এদের বিভ্রান্ত করতে পারেনা । কারণ এরা নিজেদের মানুষ বলে ভাবতেই শেখে নি। আর এই সব সূক্ষ্মভাবে মাপতে পেরেছে বলেই  পুরুষ তন্ত্র এত সাকসেসফুল । ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স থেকে শুরু করে সমাজের সব জায়গায়  তাদেরই সহযোগিতার জন্য তামাম মেয়েদের সহজলভ্য মনে করা হচ্ছে। আর দেখুন সিবি আই কর্তা থেকে শুরু করে বাংলার  হার্টথ্রব   সব কেমন এক সুরে কথা বলে? কেমন করে বলে? কারণ তারা অতটাই হালকা ভাবে  মেয়েদের নেয়।

অতোটাই অসম্মানের সঙ্গে।  কারো কিস্যু যায় আসে না , কারণ এজেন্টদের নিষ্ঠা আর পরিশ্রমের কোন জবাব নেই । আফটার অল , মায়ের জাত তো !





6 comments:

  1. বড় সত্যি কথা লিখেছেন।

    ReplyDelete
  2. হুম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

    ReplyDelete
  3. মোক্ষম। সমাজে অর্থনৈতিক অসাম্য দুর হোক।
    মহিলা আর রমণী এই দুটি শব্দ বাংলা ভাষা থেকে বিদায় নিক।

    ReplyDelete
  4. অক্ষরে অক্ষরে সত‍্য।

    ReplyDelete