Thursday 20 November 2014

প্রিয়সখা চিরসখা



“খুকুমণি ,হোয়াট আর ইউ ডুইং?”
‘খুকুমণি,হোয়াট ইস দা কালার অফ ইওর হেয়ার?”
“খুকুমণি হুইচ ক্লাস ডু ইউ রিড ইন”?
এই পর্যন্ত শুনে যে কেউ মনে করতে পারে আমার বাবা তার খুদে  সুনটুনি মুনটুনি নাতনির সঙ্গে কথা কইছেন বোধহয়  । সেই আড়াই তিনের মেয়েটি মাটিতে থেবড়ে বসে আছে , চুলে দুটো ঝুঁটি । হালকা গোলাপি ফ্রকে নীল বেলুন,আর ভেজা ভেজা করমচার মত দুটো ঠোঁট হাতের সামনে একরাশ রঙ পেন্সিল ,সাদা কাগজে অজস্র হিজিবিজি । আসলে বাবা কথা কইছেন যার সঙ্গে তার নাম  সুনটুনি মুনটুনি নয় আর তার বয়সও আড়াই তিনের অন্তত পাঁচ গুণ । তার নাম শাবানা খাতুন ।
তার মাথার চুল লাল লাল রুখু রুখু । সিন্থেটিক সালোয়ার কামিজ  পরা রোগা কালো মেয়েটা মাটিতে বসে তরকারি কুটছে ।আর বাবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে  খুব হালকা গলায় প্রায়  লুকিয়ে লুকিয়ে  শাবানা বাড়ি বাড়ি কাজ করে আর ইস্কুলে পড়তে যায় । ক্লাস সেভেন । বাবা তাকে ইংরেজি আর ফিজিক্স পড়ান এই দ্বৈত সংলাপ  আমাদের আশাবরী বাড়ির প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা ছিল । শাবানা খাতুন ওরফে খুকুমণির পড়াশোনা যাতে ঠিকমতো চলে সেদিকে বাবার খুব নজর দিতেন ।  একদিক থেকে সে বাবার নাতনি বটে । বাবাকে  সে দাদু বলে ডাকতো
আমার বাবা মেয়েদের প্রগতি উন্নতির একজন সোচ্চার সমর্থক ছিলেন । খুব অবহেলার স্তর থেকে খেটে খুটে দিন গুজরান করে যেসব মেয়েরা ,তাদের প্রতি বাবার অপরিসীম মমতা ছিল । আমার খুব ছোটবেলার স্মৃতিও একই কথা বলে । আমার প্রায় সমবয়সী মল্লিকা বাবার কাছে খুব প্রশ্রয় পেত । বাবাকে সে ডাকতো মেসাসাই (মেসোমশাই) বলে । ঝগড়া খুনসুটি লেগেই থাকত ।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা কিন্তু অন্যপক্ষের দোষ বিশেষ দেখতে পেত না ।  বাবা কেন এমন করত? সেই সময় খুব অভিমান হত । বাবা হয়ত আমাকে ভালবাসে না । আমি  একমাত্র মেয়ে । আমাকে সাপোর্ট করা কি বাবার উচিত নয়  ? মা’র কাছে গিয়ে অনেক অভিযোগ করতাম । আর একটু বড় হলে বাবা বুঝিয়ে বলেছিল “একটু বোঝার চেষ্টা কর । তুই আর ও কি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস? তোর কোন কিছুর অভাব আছে বল? আর ও কী পেয়েছে  ? ওর সঙ্গে তোর তুলনা চলে? ওর থেকে কি আমরা বিরাট কিছু আশা করতে পারি? কিন্তু তোর থেকে তো পারি?” তাই বলে কি তাদের ভুল শুধরে দিতেন না , তবে সেটা অন্য রকম ভাবে । অন্যের অন্যায় আচরণকে  সমর্থন করতেন না বটে,কিন্তু আমৃত্যু ওই মমত্ববোধের জায়গাটায়  স্থির ছিলেন ।
কালী ফুলওয়ালি বাজারে বাবা দিন কয়েক যায় নি খেয়াল করে ছিল । শেষ যে দিন দেখেছিল,তার মনে আছে, বাবার শরীরটা ঠিক ভালো ছিল না ।বাজারে অনেক ফুল ওয়ালা থাকলেও বাবা ওই এক কোনে বসা কালীর কাছ থেকেই ফুল কিনতেন । বাবার নাম না জানলেও খবরটা কালীর কাছে পৌঁছে গেছিল ।  আমাদের বাড়ি সে চিনত না । এক পড়ন্ত দুপুরে এক রাশ ফুলের মালা নিয়ে  কেমন করে যেন এসে  হাজির হয় ।
“আমি কালী । বাবুকে মালা পরিয়ে দিই ?”কালীর সঙ্গে সেদিন আমরাও কেঁদেছিলাম ।  এতো ভালবাসা ছিল তোমার বাবা এই মানুষগুলোর জন্য ?

 তোমরা যারা বরের সঙ্গে
পাকা ঘরে পাখার নিচে
রঙ্গে মাতো রঙিন টিভির
তখন আমি ভর দুপুরে
এই পৃথিবীর ছেঁড়া শাড়ি
 খালি ঘড়া একলা বেওয়া
 ঠা ঠা মাঠের  পথ ভেঙে যাই
বাবুর বাড়ি,মনে রেখো

তোমরা যখন ফুলটুসি মউ
সোনামেয়ের হাত ধরে যাও
বাগান ঘেরা পাঠশালাতে
হাতের থেকে গড়িয়ে পড়া
কমলালেবু সকালবেলায়
টিফিন বাকস জলের বোতল
গেটের কাছে কচি হাতের
নিশান দোলে টাটা তখন
আমার মেয়ে জ্বর গায়ে যে
কাপড় কাচে বাসন মাজে
কয়লা ভাঙে কপাল ভাঙে
সকাল সাঁজে ,মনে  রেখো

ভালো থেকো তোমরা সবাই
বউদি মণি
কেবল তাতে একটু খানিক
নুনের মতো থাকুক মিশে
আমাদের এই তেষ্টা খিদে
বুকের অসুখ,পাতের শেষে
আচার চেখো

বাবা মেয়েদের খুব ভাল বুঝতে পারতেন । এবং মেয়েরাও বাবার কাছে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ বোধ করত । সুতপা কাকিমা
তো (কবি মানস রায়চৌধুরীর অকালপ্রয়াতা স্ত্রী)  বাবাকে বাসুদেব সখা বলে ডাকতেন ।বাবার  সমস্ত অণু পরমাণু দিয়ে সকলের জন্য যে অকৃত্রিম শুভকামনা ঝরে পড়ত তার সঙ্গে এক দুর্লভ নারী প্রকৃতির মিশেলে তিনি  ছিলেন সাধারণের থেকে অনেক অনেক ওপরে এখানে মেয়েদের কথা বিশেষ করে বলছি এই কারণে যে আমাদের চারপাশের অনেক মেয়েরই মনের কথা বলার জায়গা নেই । 
আরতি কাকিমা বাবাকে তার  গুরুদেব মেনে নিয়েছিলেন আমাকে একদিন বলেছিলেন, তিনি তার স্বামী ভাই বাপের বাড়ি   কোথাও যে সব কথা বলতে পারতেন না, সেইসব জমানো কথা বাবা কে অকপটে বলে দিতেন ।
আরেকদিন বাবার এক বন্ধুর স্ত্রী আমাকে ফোন করে তার কিছু পারিবারিক সমস্যার কথা বলেন ।  খুব জটিল সমস্যা ।আইন আদালত পুলিশ ইত্যাদি । আমার পরামর্শ আর সাহায্য দরকার । বেজায় মুশকিলে পড়লাম।  ।  চেষ্টা করলেও আমি জানি ওনাকে আমি খুশি করতে পারছিলাম না । ভরসা দিতে পারছিলাম না । একদিন উনি বলেই ফেললেন ,” আসলে কি জানো? বাসুদেব দা চলে যাবার পর এতো অসুবিধেয় পড়ি মাঝে মাঝে । একটা পরামর্শ দেবার লোক পর্যন্ত পাই না । তোমার কাকু টাকুরা তো আবার সেই ধরণের নন । বাসুদেব দা  ছিলেন আলাদা । একটা না একটা পথ উনি বাতলে দিতেনই । আজ যদি উনি থাকতেন একটা কিছু করতেন ,আমি জানি”। তার গলায় ক্ষোভ ঝরে ঝরে পড়লেও আমার কিচ্ছু করার নেই ।
বাবাও যে সব সমস্যার সমাধান করতে পারতেন,তাও নয় । কিন্তু তার কথায় , তার বাচন ভঙ্গিতে ,তার আশ্বাসে কিছু একটা থাকত যাতে সবাই খুব জোর পেত, ভরসা পেত ,সাহস পেত ।মেয়েদের তিনি মেয়েদের মতো করে বুঝতে পারতেন ।
আবার আরেকদিন রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ এক পিসির ফোন । বাবার সহকর্মী । বয়সে ছোট । খুব অশান্ত অস্থিরভাবে প্রায় আধঘণ্টা ধরে বলে চললেন তার নানান সমস্যার কথা । একতরফা । বলে চলেছেন বলেই চলেছেন । তিনি তো এইসব আমার সঙ্গে কোনদিন   আলোচনা করেন  নিতবে আমাকে কেন ফোন করলেন ? আমার মনে হল আসলে  ফোন টা এরা কেউই আমাকে করতে চাননি । করতে চেয়েছেন বাবাকে । আমার ভেতর দিয়ে । একটা ভীষণ অভাববোধ থেকে ।
এরকম কতো মেয়ের  কতো কথা তুমি শুনতে বাবা ?  কতোজনের মন হালকা করতে ? কতো  অস্থিরকে স্থির আর শান্ত করতে , শুশ্রূষার জলের মতো বয়ে গেছ কতো জনের বিভ্রান্ত জীবনে? আমরা তো জানতেও পারিনি কোনদিন ।  তুমি কাউকে জানতে দাও নি ।

 
উৎস ঃ গুগল 

নারী বললেই আমার মার কথা মনে পড়ে। সমস্ত সৃষ্টি তার পায়ের কাছে নিচু হয়ে আছে । আর মনে পড়ে পুব বাংলার সেই নদীটির কথা ।আমাদের বারান্দা ঘেঁসে বয়ে যেত সে। আর এক কল্পনাপ্রবণ বালককে শোনাতো আবহমানের রূপকথা ।
নারী বললেই আমার দিদি আর বোনদের কথা মনে হয়।কেমন ক্যারমের গুটির মতো ছিটকে দূরে চলে গেল সবাই । মোম বাতির মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে তারা আলো দিয়ে যাচ্ছে কতো না সংসারে ।
নারী বললেই আমার মনে পড়ে আমার স্ত্রীর কথা নানা সুখদুঃখের টানাপোড়েনে বুনে চলেছে এক সংসার ।
আমাদের প্রদীপ টিকে মেজে ঘসে স্নেহ সিঞ্চনে জ্বালিয়ে রাখতে তার সকাল থেকে রাত উৎসর্গ করা ।আমাদের খাদ্যকে স্বাদু রাখে সে, আমাদের জীবনকে গতিময় । নারী বললেই আমাদের সমস্ত ব্যবহার আর ভাবনার নেপথ্যে ঝুঁকে পড়া সেই প্রকৃতির আনত মুখ আমার মনে পড়ে।
মেয়েদের নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে অনেক কিন্তু সত্যিকারের তাদের কথা পুরুষ কবিরা কেউ জানতে চায় নি । তাদের মুক্ত হাসির জন্য তৈরি হয়েছে অনবদ্য পদ্য কিন্তু দাঁতের ব্যথার কথা তারা কখনো বলার সুযোগ পায় নি
নারী বললেই আমার মার কথাই মনে পড়ে(বাবার লেখা )

Thursday 13 November 2014

প্রেম বিবাহ পরকীয়া

ঘটন টা শেষ মেস ঘটেই গেল । দিল্লিতে এসে আমি ঝপাৎ করে প্রেমে পড়ে গেলাম । হ্যাঁ ,একেবারে প্রথম দর্শনেই । কোন বুদ্ধি যুক্তির ধার ধারলো না। আমি পান্ডারার দিওয়ানা হয়ে গেলাম । আমার সেই প্রেমিকের নাম পান্ডারা । কয়েকমাস আগেও আমার জীবনের মানচিত্রে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না ইন ফ্যাক্ট তাকে আমি চিনতামই না । তার শান্ত ক্যাজুয়াল অথচ স্মার্ট চেহারা আমার মন  ভরিয়ে দিচ্ছে ।   প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আমি পান্ডারার অলি গলি পথে পথে প্রায় প্রতিদিনই ঘুরতে থাকি । তার চারদিক জুড়ে ব্যাস্ত দিল্লির গাড়ি ঘোড়া । কিন্তু সে কেমন অবিচল । কী ভীষণ উদাসীন , হ্যান্ডসাম আন্ড কুল ।   তার সবুজ রঙ করা বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় মাধবীলতার অজস্র  উপচে পড়া ফুল । আমি যেন দু চারটে ভোমরাও দেখতে পেলাম । আর আমার প্রিয় ফ্র্যাঙ্গিপানি কাঠগোলাপ জায়গাটাকে ছায়াময় করে রেখেছে ।  ভেজা শিউলি তার অলিন্দে কেমন ঝরে ঝরে পড়ছে । মনে মনে কঠিন সঙ্কল্প নিলাম যে  এর গলাতেই মালা পরাতে হবে , নইলে দিল্লির এই পরবাস বৃথা , একেবারেই বৃথা ।   মনের কথা জানাজানি হতেই অমনি হিংসুটের দল বলতে শুরু করল পান্ডারার ফ্যানক্লাব নাকি জবরদস্ত । তার পেছনে  লম্বা লাইন । সে লাইনে বড় বড় সব রাঘব বোয়াল । আমার মত চুনো পুঁটি পাত্তাই পাবে না । সে কি কথা ! হোমড়া চোমড়াদের জন্য তো কত্ত বড় বড় পেল্লাই সব বাড়ি আছে । তারা সেখানেই যাক না । কিন্তু প্রেমের পথ কি কোনোদিন  ফুল বিছানো ছিল ? বন্ধুর দল  বলল, আরে বেজায় কম্পিটিশনের খেলায় নেমেছ! পান্ডারার পাণি প্রার্থী হতে হলে কলজের জোর লাগে ।  আমি তখন গভীর প্রেমে হাবুডুবু । দেখি ,সে আমাকে কতটা চায়?
পান্ডারার সবুজ জমিতে আলোছায়ার আলপনায় আমি তখন অলরেডি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি । একটা লতানো জুঁই লাগালে কেমন হয়? নেশার মত আমার মন তার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে  যাচ্ছে কখনো । আমি দেখতে পাচ্ছি সেমি  সার্কুলার   ছোট্ট কাঁচ ঢাকা বারান্দায় আমি জ্বেলে দিয়েছি ডোম ঢাকা নরম আলো । আর সেই লাল কালো কিলিমের ওপর বাহারি সুজনি আর কুশন । কল্পনার গোরু তত ক্ষণে  মগডালে   চড়ে বসেছে।



“তোমার কুকুর আছে? খিদমৎ খাটার জন্য  গুটিচারেক বান্দা?  নেই তো? একা একা থাকবে? তাহলে পান্ডারার স্বপ্ন ছাড়ো । কোন মাল্টি স্টোরিডের দ্বারস্থ হও ।“
এত সহজে হার মানার  পাত্রী আমি নই । আমি জানি এ বিবাহ সম্পন্ন হবে অনলাইনে । বরপক্ষ খোদ সরকারি দপ্তর । চুপিচুপি লিস্ট খুলে দেখি আরে, কি আশ্চর্য  ! পান্ডারায়  মাল্টিস্টোরিড ! তার মানে পান্ডারাও আমাকে চায় ! আমি হ্যাংলার মত প্রেম নিবেদন করতে ছুটে চলে যাই তার কাছে । কিন্তু এ কী ! সর্বাঙ্গ পোড়া আমার প্রেমিক ! চারদিকে শুধু পোড়া কালো দাগ । জানতে পারলাম এ সি ফেটে গিয়ে নাকি এমনটা হয়েছে । আহা রে ,তাতে কী ? আমি তোমাকে ছাড়ব না । সে তুমি যতই কালো হও ।
ওর সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে । লাগুক । দুটো সুটকেসে বন্ধ জীবনের  যন্ত্রণা নাহয় আরো কিছু দিন মেনে নেব ।
পাত্রী স্বয়ম্বরা । বিবাহের দিন ফাইনাল লিস্ট খোলা হল । নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না । সে নেই ।   কোথাও নে ই । সে চলে গেল , বলে গেল না , সে কোথায় গেল ফিরে এল না ।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বরপক্ষ কে ফোন করি ।
পালিয়ে গেছে মশাই । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে । ইলোপ । বুঝলেন না । এরকম কতো হয় । কতলোকের বুক ভাঙ্গে । কতো চোখের জল বয়ে যায় ,কে তার হিশেব কবেই বা রেখেছে ? দুঃখ করবেন না ।  আরো কতো ভাল ভাল পাত্র আছে ।
এমন নির্লিপ্ত বাবা মা আমি চোদ্দ পুরুষে দেখিনি ।
স্তোকবাক্য যাই দিক না কেন , লিস্টের মধ্যে আরো  একটা পান্ডারা ছিল । সোনামণিটা !
দিলাম বোতাম টিপে । তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা ।
তারপর বসন্তের বাতাসের মতো আমাকে হাহাকারে ডুবিয়ে দিয়ে সেও কার হাত ধরে চলে গেল আমার সামনে দিয়ে ।
অভিভাবকের দল,বন্ধুর দল এবারে হই হই করে উঠল , অনেক হয়েছে , ঢের হয়েছে  প্রেমের কাঁদুনি পনা । কেন,বাকি পাত্রগুলো কী দোষ করেছে ?   তারা তো ওরই তুতো ভাই  । না হয় কারুর মাথায় টাক , একটু ভুঁড়ি , বা একটু বদমেজাজ । তোমাকে একটু মানিয়ে চলতে হবে বাপু । বিয়ে টা অ্যা ডজাস্টমেন্ট ছাড়া আর কি !
আবার আমি গৃহহীন । আমি আর দু টো সুটকেস ।
আবার একটা মাসের অপেক্ষা । আমার পান্ডারাপ্রেম কিন্তু অমলিন ,অবিচল একনিষ্ঠ । সব উপদেশ পরামর্শ আমি পূর্ব রাগের রাধার মত এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছি ।
আবার লিস্টি খোলা হল । একটা নয় এবার দু দুটো পান্ডারা নাহ এও আমাকে বড্ডো ভালবাসে
 এবারে  গুরুজনের দল এমনকি খোদ বরপক্ষ আমার এই পাগলপনে রীতিমত ঘাবড়ে গেল । পাত্রপক্ষ তো বলেই বসল, শুনো বেটা, অ্যায়সা   মত কর । পান্ডারার দিওয়ানাপন ছাড় । ও তোকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেবে না । বেটা শাদিমে সবসে ইম্পরট্যান্ট হ্যাঁয় সিকিওরিটি ।
এমন পাত্রকে বেছে নে যে তোকে সেফটি সিকিওরিটি দেবে । এই দ্যাখ একটা জবরদস্ত পাত্র তোরই অপেক্ষায় বসে আছে । টল ডার্ক হ্যান্ডসাম  । আর স্ট্যাটাস ? পান্ডারার চেয়ে অনেক বেশি । পান্ডারার আছে টা কি? মিস্টি মিস্টি কথা বলে লোক পটায় আওয়ারাগিরি করে খালি তু যাকে একবার দেখ লে তো সহি ।
সবাই ঠেলেঠুলে পাঠাল । আবাহন ও নেই । বিসর্জন ও নেই । বড়লোক পাত্র । পয়সার জোর আছে । এমনই লম্বা যে চোখ কপালে তুলতে হয় । ইয়া বড় ছাতি । নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ।   কেঠো চাল । মিষ্টত্বের নাম গন্ধ নেই । ভেরি ম্যাটার অফ ফ্যাক্টলি । তবে এমন পাত্র হাতছাড়া করলে পস্তাবে । শেষে প্রেম জানালা দিয়ে পালাবে ।  বড় মাপের দিল দরাজ অথচ কতো গুছোনো সাবধানী দেখেছ আমাদের পাত্র । এমন হাতে তুমি পড়লে আমাদের শান্তি ।



মনে হতে লাগল পান্ডারা যদি এবারো আমাকে ফাঁকি দেয় । তার মিথ্যে আশ্বাসে এতদিন ধরে দুটো সুটকেসে বন্দী আমার জীবন যে হাঁপিয়ে উঠেছে । আশা নিরাশায় নানান দোটানায় রামকৃষ্ণ পুরম কে একটা টিক লাগালাম ।
প্রতিদিন    লিস্টি খুলে খুলে দেখি । আর মনে মনে শিহরিত হই । আমি এক নম্বরে । পান্ডারা আমাকে চায় । রেখনা বেঁধে আমায় ...।।
বিয়ের দিন সমাগত ।  ঘোষণা করল বরপক্ষ, রামকৃষ্ণপুরমের হাতে তোমাকে আমরা সঁপে দিলাম । সুখী হও মা ।
কেন? কেন ? কেন ? পান্ডারা নয় কেন? সে তো আমাকে এবারে  খুবই চেয়েছিল । কিন্তু তুমি তো তার প্রেমে ভরসা পুরোপুরি রাখতে পারনি ।
আমি ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে ওদের বলি প্লিজ আমাকে পান্ডারার হাতে তুলে দিন । আমার এতদিনের কতো স্বপ্ন কল্পনা । মাধবীলতাবিতান , সবুজ গালচের মত ঘাস , হাতের মুঠোয় ইন্ডিয়া গেট , কানের পাশে খান মার্কেট , ঢিল ছুঁড়লেই অফিস ।
এত বড়লোক পাত্রের হাতে তুলে দিলাম ।তাও মন উঠছে না । ওই ভ্যাগাবন্ড টাকে নিয়েই পড়ে আছো? এবার ঘরে গিয়ে ওঠো । শুরু কর সংসার । পান্ডারাকে বাকি সময়ের জন্য ভুলে যাও।    
সংসার তো শুরু করলাম । মনের মিল হল কই । প্রথম রাত বিনিদ্র রজনী । প্রেমালাপে নয় । রাতভোর ইয়া বড় বড় লরি আর ট্রাকের আওয়াজে ।   বাড়ির সামনে দিয়ে দিনভোর রাতভোর যান বাহনের স্রোত । আর তাদের পিলে চমকানো আওয়াজ । অনেক সম্বন্ধ করা বিয়ের মত এই বিয়েতেও অনেক কিছু খবরাখবর নেওয়াই হয় নি ।
ও একটু আধটু দোষ থেকেই থাকে । হিরের আংটির আবার বাঁকা ট্যারা কি? আর কোন অসুবিধে হচ্ছে কি ? সুখ সুবিধের ? নাহ ,আর কোন অভিযোগ নেই আমার । কোন কিছুর অভাব সে রাখেনি । তবুও, বুড়ো তুমি লোকটি ভাল চেহারাও নয় তো কালো , তবু কেন তোমায় ভালবাসছিনে?  সেই প্রেম আর ফিরে এল না ।
প্রতিদিনের জীবন গতানুগতিক বয়ে যায় । আমার প্রেমহীন সুখের জীবন যন্ত্রের মত এগিয়ে চলে । আমার ঘুমহীন রাতে তার কিছু যায় আসে না । সে শুধু জানে আমার কোন অভাব সে রাখেনি । মনের ধার ধারতে তার বয়েই গেছে । 
কিন্তু আবার বসন্তের বাতাস বয় । মাধবীলতার গন্ধ আর ভোমরার দল আবার ফিরে ফিরে আসে । আমি আবার প্রেমে পড়ি ।
সোজা পথে বাড়ি ফিরি না ।জেনেশুনেই । একটু বেঁকে মিটমিটে আলো জ্বলা পথ, যত্ন করে বাঁধানো  মসৃণ রাস্তা ।    কোন শব্দ নেই , চারদিক চুপচাপ ।   ভারি শান্ত । পরিপাটি  সাজানো গাছের সারি ।   ।চৌকস  সুন্দর কেতাদুরস্ত নিউ মোতি বাগ আমাকে হয়ত চেনেই না । চেনার কথাও নয় । তাকে পাবার আশাকে দুরাশাই বলা যেতে পারে । কিন্তু ভালবাসতে বাধা কই? যদি কখনও আমাকে সে চিনে নেয় কোনো এক ফাল্গুনের দিনে? কে বলতে পারে? শব্দহীন রাতের স্বপ্নভরা ঘুম যদি আবার ফিরিয়ে দেয় ? 



এই হল আমার প্রেম বিবাহ পরকীয়া।
 সেই অর্থে ননাসুদুর গল্প নয়  ( নরনারীর সুখ দুঃখ –পূষন দেব উবাচ)
হতাশ হলেন?
জানতাম !