Wednesday 24 August 2016

দারাদিল রানাশুকো


 ভোরের আলোয়   গাছের  পাতায় পাতায় জমে  থাকা  শিশির বিন্দুর রামধনুতে  টলটল করে উঠছে   দারাদিল রানাশুকো , প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধের মাটির ভাপে গুমগুমিয়ে উঠছে দারাদিল রানাশুকো , যমুনার ঢেউ এ  অস্তরাগের রঙে রাঙিয়ে গেল দারাদিল রানাশুকো , আগ্রা কেল্লার লাল পাথরে পাথরে নিঃশব্দে খোদাই হল দারাদিল রানাশুকো ,  গুলরুখ বাঈয়ের ঘুঙুরের বোল গেয়ে ওঠে  দারাদিল রানাশুকো , জ্যোস্নার ভেতরে হাসনুহানার ঝোপে জোনাকির জ্বলা নেভায়  দারাদিল রানাশুকো ,মটর গাছের খেতে এক ঝাঁক টিয়াপাখির সবুজ ডানায় উড়ে যায় দারাদিল রানাশুকো ,অপরূপ খিলান আর গম্বুজের বেদনাময় রেখা ধরে রাখে দারাদিল রানাশুকো ,পর্দায় গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ জমা করে রাখে দারাদিল রানাশুকো , কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে সময় সরণি বেয়ে বিস্মৃতির গভীরে তলিয়ে যাওয়া এক আশিক আর তার মাশুকার নাম দারাশুকো রানাদিল



আল্লাহ্‌ কে তিনি বলেছিলেন সচ্চিদানন্দ মির্জা রাজা জয় সিংহ কে লেখা চিঠিতে ফারসিতে লিখেছিলেন সচ্চিদানন্দ আল্লাতালার মুখের দুপাশে দুই গুছি চুলের একটি ইসলাম অন্যটি হিন্দু ধর্ম হাতের আংটিতে দেবনাগরীতে খোদাই করেছেন পরভু (প্রভু) কানের ভেতরে বাজতে থাকে অপরূপ ঘণ্টা ধ্বনি , চোখের সামনে উড়ে বেড়ায় অজস্র আলোর বিন্দু হৃদয়ের গভীরে এক অনন্তের সঙ্গে মিশে যাবার সমুদ্র উচ্ছ্বাস  অনুভব করেন হিন্দুস্তানের শাহজাদা ,নাদিরা বেগমের স্বামী , সলোমন শুকো র আব্বা , সম্রাট শাহজাহানের বড় আদরের ছেলে  , জাহানারার বড় ভালবাসার ছোটে ভাইয়া দারাশুকো তিনি যেন এই দুনিয়ার মানুষ নন , বেহেশ্ত থেকে আসা এক ফরিস্তা মোঘল হারেম তাকে টানে না , তিনি  সাধু সন্ত পীর ফকির দরবেশ আর সুফিয়ানা সিলসিলায় আত্মমগ্ন স্বপ্নাতুর ,যেন এই দুনিয়ায় দুদিনের মেহমান ,কিন্তু তবু শাহী আদবকায়দা মানতে হয়, যুদ্ধে যেতে হয় , তলোয়ার ধরতে হয় বে  শরিয়তি কাফের বলে নিন্দের কাদাও  গায়ে মাখতে হয়


ঘরে জমানো  তরল ঘি , তাতে এক চুটকি সিঁদুর গুলে দিলে যে একটা অদ্ভুত আদুরে রঙ তৈরি হয় রানাদিল ছিল সেই রঙের একটা মেয়ে বেমিসাল তার খুবসুরতি তার চালচুলো নেই ,জাত ধর্মের ঠিক নেই , বাপ মায়ের হদিশ নেই অনাথ মুখের ভাষা ও সেইরকম নেই সহবত , নেই লজ্জা , বেপর্দা বেহুদা আওরৎ খুচরো পয়সা জমিয়ে দিনের শেষে রুটি কাবাব কেনা ই তার বেঁচে থাকা রাক্স অর্থাৎ নাচ তার পেশা না, সে মুজরো জমানো বেল জুঁই মালায় সাজা বাইজি বা তবায়েফ নয় তার জন্য কোন তবলচি কাহারবা দাদরার বোল তুলত না , কোন ঝাড়বাতির রোশনাই এর  নিচে  তার সুর্মা টানা চোখ কথা কইত  না , ছিল না গলায়  ঠুমরির  দানাদানা  নক্সার কাজ , ছিল না গোলাপদান , আতর দান পানদানের বাহার     থাকবে কিকরে ? রানাদিল ছিল রাস্তার নাচিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মান্ডিতে মান্ডিতে ঢোলকের সঙ্গে সে নেচে বেড়াত কাঁকর পাথর ছড়ানো রাস্তায় , সাঁঝের বেলায় , যমুনার ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইত , নানান ব্যাপারী পরদেশি দেহাতির দল জমা হত , ন্যাকড়া জড়ানো সস্তা চর্বি মাখানো  মশাল দাউদাউ করে জ্বলে উঠত আর সেই সময়খোলা আকাশের নিচে এক রাশ লোকের সামনে আলোআঁধারির মধ্যে  লচক আর ঠুমক নিয়ে ঘাগরায় অশান্ত ঘূর্ণি তুলত রানাদিল আমজনতার নাচিয়ে আমজনতার মেহফিল । আমজনতার দিল কি রানি  সবাই তাকে চিনত সব্বাই অফুরান ছিল তার প্রাণশক্তি সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে নাচত রানা তাকে ঘিরে চলত সাধারণ পথচলতি মানুষের উদ্দাম ফুর্তি আর হাততালি , যে হাত তালিকে দেওয়ানি খাসের দরবারি নাচের শাহী মজলিশে বে সহবত মনে করা হত


দারাশুকোর শান্ত গেরস্থালি  ছিল নাদিরা বেগমকে নিয়ে  তাতে মাধুর্য থাকলেও    উচ্ছ্বাস ছিল না শাহী সহবতের বাইরে কোনোদিনই যায় নি নাদিরা নাদিরা নাজুক শরমিলি আওরৎ দারা ছিলেন তার কাছে হজরত , শরতাজ , বা কখনো বন্দেগান বরং দারার অতিরিক্ত ধর্ম চর্চা সাধুসঙ্গ আর পড়াশুনো তাকে ভাবিয়ে তুলত এর থেকে বন্দেগান যদি আরেকটা বিবি আনত বা হারেম নিয়ে ব্যস্ত থাকত তাহলে সে
 বেচারা  খানিকটা স্বস্তি পেত যে তার খসম একজন স্বাভাবিক মানুষ


শাহী মহল ছেড়ে ছদ্মবেশ পরে দারা মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে এমনই একদিনে রানাদিলের সঙ্গে তার দেখা হয় সেদিনও রানা কে ঘিরে চলছিল হই চই আর হুল্লোড় ঘটনাচক্রে দুজনের সাক্ষাৎ হয় অসম্ভব সাবলীল তার কথা , বাজার চলতি ভাষা , নেই কোন কুরনিশ , তসলিম , কদমবোসি , সিজদা
কিন্তু সস্তার নাচুনি রানাদিলের মধ্যে  এমন একটা উষ্ণতা ছিল যা শাহজাদার কাছে ছিল একদম অন্য রকম, ভানহীন , আন্তরিক, একদম স্বাভাবিক   রাজধানী আগ্রায় মরদের কঠিন দুনিয়ায় গায়ের ঘাম  ঝরিয়ে রুটি কামায় যে মেয়ে এতো প্রাণশক্তি কোথা থেকে পায় সে? শাহজাদা দারার অন্তরের মহব্বতের পাত্রটি পূর্ণ হয়ে উপচে পড়েছিল , সেই ভালবাসার স্রোত রানাদিলকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় রাস্তার সেই ধুলোকে হৃদয়ে মেখে নিলেন দারা রানাদিলের নতুন আস্তানা হল যমুনা পারের রানি হাভেলি মরদ আর আওরৎ যে সমানে  সমানে ভালবাসতে পারে একথা নতুন করে শিখলেন দারা  
কিন্তু রানি হাভেলি, রানাদিলের মতো মুক্ত আজাদ পঞ্ছির কাছে কয়েদখানার মতো মনে হত দরজায় পাহারা ফৌজদারি মনসবদারির কাজ সেরে ছদ্মবেশ পরে  মাপা সময়ের জন্য শাহজাদার তার কাছে আসা এসবই না পসন্দ ছিল রানাদিলের উপরন্তু নেই কোন রাখঢাক ভান ভণিতা , কোনোদিন শেখে নিও সে টানাপোড়েনে  বিভ্রান্ত দারা কে সে বলেই বসে , “আমার সঙ্গে রাস্তায় নেমে এসো , চলো হাত ধরাধরি করে শাহী সড়কে মিশে যাই , গোয়ালিয়রের রাস্তা ধরে বাগোয়ানের জঙ্গলে গিয়ে উঠি
মোঘল খানদানে আটপৌরে  জীবনের এই স্বাদ শাহজাদা আগে কখনো পান নি রানাদিলের বিয়ের প্রস্তাব বারবার পিছিয়ে যায় শাহী দায়িত্ব সামলানোর কাজে , কান্দাহার যুদ্ধ , রাজধানী জাহানাবাদের বিপুল কাজ ,আব্বাহুজুর  শাহজাহানের শখ মিনার মসজিদ কেল্লা সমাধি , নকশা , পাথর রানাদিল অমন শাহীর মুখে রোজই  ঝাঁটা মারে , শাহীর পাথুরে খোয়াবে তার দম আটকে আসে
দারা তাকে জিজ্ঞেস করেন , তুমি হিন্দু না মুসলমান, রানা  ?
“তা তো জানি না তবে আমি ইনসান , এইটুকু জানি
“আমিও  তাই ,রানাদিল

“দারুণ হার-বাত-এ জান-ইস্ত পিনহান
বা-জের-ই কুফার ইমান-ইস পিনহান
সাধনায় প্রতিটি মূর্তি সজীব হতে পারে। অবিশ্বাসের নিচেই লুকিয়ে আছে বিশ্বাসের ফল্গু । রুবাইটি ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো লিখে রাখতে রাখতে দারা মনে মনে বলে উঠলেন কাবা আর সোমনাথ আমার একই লাগে। আমি না হিন্দু—না মুসলমান । তাহলে আমি কী? “


শেষমেশ রানাদিলের সঙ্গে বিয়ে হয় দারা শুকোর অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কারোরই পছন্দ ছিল না , না শাহজাহানের , না জাহানারার রানাদিল , দারার তৃতীয় এবং শেষতম বেগম নাদিরা ছাড়া জর্জিয়ার স্বেতলানা বা উদিপুরিকে দারা বিয়ে করেন সেলিম আনারকলি , জাহাঙ্গীর নুরজাহান , শাহজাহান মুমতাজের নক্ষত্র খচিত অতিরঞ্জিত প্রেম কাহিনীতে কোথায় চাপা  পড়ে  গেছে রানাদিল অথচ ওইসব জাঁক জমক প্রেমের মধ্যে মিশে  মিশেআছে  ক্ষমতার লোভ , স্বার্থ , পরনারীতে আসক্তি কিন্তু ঘুঁটে কুড়ুনি আর রাজার দুলালের এই আশ্চর্য ভালবাসা কোথায় গুম হয়ে গেছে তার হদিশ কেউ রাখে নি

আওরঙ্গজেবের হাতে দারার হত্যার পরে নাদিরা বিষ খায় , উদিপুরি চলে যায় মোঘল  হারেমে কিন্তু বাগ মানানো যায়নি রাস্তার সেই জিদ্দি নাচনেওয়ালিকে বড় মজবুত ছিল তার ইশক আওরঙ্গজেব রানাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন সেখানে বসে রানা চোখের জলে ভেসে ভেসে গান বাঁধত আর গাইত সেই গানে আওরঙ্গজেবের যত কুকীর্তি আর অত্যাচারের  কথাই মনে করাতো সে শাহী হুকুমে গানবাজনা বন্ধ হয়ে যায় এইসময় রানাকে মেরে কুকুর দিয়ে খাওয়াবার ভয় দেখানো হয় কিন্তু রানা ছিল এক রোখা , বেপরোয়া দারার সঙ্গে ভালবাসার যে জিদ সে বজায় রেখে ছিল , দারাহীন জীবনেও সেই জিদ থেকে একচুল সরে আসেনি  
আওরঙ্গজেব খবর পাঠালেন তিনি রানার অন্ধকার বিদিশার নিশার  মতো চুল নিয়ে খেলা করতে চান রানা তার সব চুল কেটে মাথা ন্যাড়া করে সেই রেশমের  মতো চুল বাদশাকে পাঠিয়ে দিয়ে বলে এই নাও শাহী , সেই চুল যা তুমি বড্ড ভালবেসেছিলে আওরঙ্গজেব এবারে বলে পাঠালেন ওই শ্রাবস্তীর কারুকার্য মুখ তিনি দেখতে চান , রানা যেন তার কাছে এসে থাকে
ছোরা দিয়ে মুখ ক্ষত বিক্ষত করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত একটা পাত্রে জমা করে রানা ছোরাখানাকে ভালো করে রক্ত মাখিয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে এবারও বলল এই নাও শাহী সেই চাঁদমুখ ,যা তুমি দেখতে চেয়েছিলে
দারা , রানার জন্য কোন তাজমহল বানান নি , রানার কোন সন্তান ও ছিল না

কোন এক সূত্র থেকে জানা যায় একদিন যমুনার কিনারে এক কোনে একটা  জ্বলন্ত চিতায় কোন এক ফকিরকে দেখা গিয়েছিল ,সে  বসেছিল  চিতার ওপর ,তার মাথা ন্যাড়া , ক্ষত বিক্ষত তার মুখ ময়লা চাদর ।
সেদিন সন্ধের মুখে বেহেস্তের সুগন্ধ মেখে একরাশ নক্ষত্রের কাঁপনে সে শেষ বারের মতো শুনেছিল দারাদিল রানাশুকো

সেই কথা ভালো ,তুমি চলে এসো একা ,
বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে -
স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা ,
সন্ধ্যা তারাটি শিরীষ ডালের  ফাঁকে


ঋণ স্বীকার ঃশাহজাদা দারাশুকো -শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ,আসিফ খান দেহেলভি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন নেওয়া হয়েছে

ছবির উত্স : গুগল , শিরিন শাহবা , আসিফ খান দেহলভি 





Tuesday 23 August 2016

দিল্লি দাস্তান ৪



মুন্ডহীন ধড় গুলি (আহ্লাদে) চিৎকার করে

দেশ জোড়া বিদ্রোহ তখন । ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে  জান কবুল করে লড়ছে সিপাহিরা । অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষও বিদ্রোহে শামিল । আগুন জ্বলছে কোথাও দাউদাউ কোথাও ধিকি ধিকি । সবাই তাকিয়ে দিল্লির দিকে । কিন্তু বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করার দরকার হল না , ফিরিঙ্গি দিল্লি জিত লিয়া,এই খবরটাই দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে তখন । তখত থেকে নেমে তাজ খুলে ফেললেন বাহাদুর শাহ জাফর , হিন্দুস্তানের শেষ সম্রাট ।
হুমায়ুনের সমাধি ক্ষেত্রে তার দুই ছেলে আর নাতিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করানো হল ফিরিঙ্গি সেনা ক্যাপটেন উইলিয়াম হডসনের হাতে । পল্টনরা পাহারা দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে রাজ পরিবারের অনেক বন্দীদের নিয়ে চলেছে লাল দরওয়াজার দিকে।লাল দরওয়াজার সামনে সেদিন দারুণ ভিড় ।হাডসন দেখলেন মাথায় সাদা ফেট্টি বেঁধে গাজির দল চারদিক প্রায় ঘিরে ধরেছে । লাল দরওয়াজার এককোণে যে ছোট্ট তথ্য দেওয়া আছে তাতে লেখা আছে ,হাডসন ওই তিন যুবরাজকে ওপরের জামা খুলে ফেলতে বলে তারপর খাপ থেকে তলোয়ারের একটি শানিত ঝলক , আর টুপ টুপ খসে পড়ে তিনটি মাথা , “জমায়েত সব নারী পুরুষ শিশুদের মেরে ফেলা হোক “ এই আদেশ হেঁকে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়ে হাডসন । লাল দরওয়াজা সত্যি রক্তে রক্তে লাল হয়েছিল সেদিন । সবাই বলত খুনি দরওয়াজা । এই খুনি দরওয়াজার গেটেই ঝুলেছে দারা শিকোর দেহহীন মাথা ।তারও আগে জাহাঙ্গীরের আমলেও হত্যালীলার নীরব সাক্ষী এই খুনি দরওয়াজা । কেউ কেউ কলঙ্কের কিসমত নিয়েই জন্মায় । খুনি দরওয়াজাও তাই । শতকের পর শতক কেটে গেলেও তার বদনাম আর ঘোচে নি । ১৯৪৭ এর দাঙ্গায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে এইখানেই । এমনকি ২০০২ সালে এক মেডিক্যাল ছাত্রীকে দিন দুপুরে এখানে গন ধর্ষণ করা হয় । তারপর থেকে এর দরজায় তালা পড়ে যায় । ভুতুড়ে গপ্পো ও শোনা যায় অনেক । এমনও শোনা যায় ভূতদের টার্গেট সাহেব মেম । দেশের লোকদের তারা বিরক্ত করে না ।
ব্যস্ত বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ । একদিকে ফিরোজ শাহ কোটলা , অন্যদিকে মৌলানা আজাদ মেডিক্যাল কলেজ । রাস্তার দুদিক দিয়ে তির বেগে গাড়ি ছুটছে । তার পাশেই  শতকের পর শতক সারা গায়ে কলঙ্ক মেখে বেবাক দাঁড়িয়ে আছে শের শাহ সুরির বানানো খুনি দরওয়াজা । রক্তের গন্ধ , সারা গায়ে । অত্যাচারের কদর্যতা , প্রতিটি রন্ধ্রে । দেখলাম পাথুরে জমির ওপর পড়ে আছে একটা থ্যাঁতলানো লাল ফুল ।











                                                                                                 
 জামি বিবির খসম রাতে বাড়ি ফেরেনি , সাকিনারও তাই । তারা ঠগ জোচ্চুরি করে খায় । এখন কোতোয়ালি ভারি  উগ্রচন্ডা । সপাট মার আর মুখের রক্ত তোলা ছাড়া কোন কথা নেই বিবিদের চোখে রাতের ঘুম নেই অনেকদিন  ।মনটা কু গায় । সুলতানের প্রাণে তো মায়া দয়া নেই । কাক ভোর হতেই দু জনায় দৌড়ায় । ঘুরে ঘুরে মিনারটাকে দেখে , বুক দুরদুর করে । আর বাঁক ঘুরতেই বল্লমের খোঁচার মুখে ঝুলছে তাদের  মরদের কাটা মুন্ডু । চোর মিনারের ২২৫ টা গর্ত দিয়ে বল্লমের মুখে একটা করে মুন্ডু ঝুলে আছে । চোর মিনার বানিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি । আজ হজ খাসের যে অভিজাত পল্লিতে এই মিনার সেই জায়গাটা সেই সময় চোর ছ্যাঁচোড় ঠগ ডাকাতের  মহল্লা ছিল । লোকে দিনমানে চলাফেরা করতে ভয় পেত ।    
আলাউদ্দিন খিলজির আমলে সেনাবাহিনীর দারুণ রমরমা । হিন্দ নয় সমস্ত মধ্য এশিয়াতে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল । সুলতানের ছিল একটা তুখোড় গুপ্তচরবাহিনী , তৎপর আর অনুগতকোতোয়ালি গুলো ছিল খুবই তাগড়া , বলশালী  ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান । অন্যায়ের শাস্তি  পেতেই হবে ।  বাইরের শত্রু মোকাবিলা করা তখন সুলতানের প্রধানতম কঠিন কাজ । তাই ঘরের ভেতরটাকেও পোক্ত করতে চেয়েছিলেন যাতে উটকো উৎপাত না আসতে পারে । চোর ডাকাতদের চোর মিনারে ঢুকিয়ে মাথা কেটে ,এমন আড়ং ধোলাই দিয়েছিলেন যে  আমির খুসরো লিখছেন, যে চোর আগে গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিত , সে এখন বাতি জ্বেলে বড় রাস্তা পাহারা দেয় । যদি কোন পর্যটকের একটা সুতোও হারিয়ে যায় তাহলে কাছাকাছি লোকজনেরা হয় সেটা খুঁজেই দেবে নয়ত তার দাম মিটিয়ে দেবে ।  খুসরো আরো লিখছেন এইসব কড়া ব্যাবস্থার জন্য রাস্তাঘাট নিরাপদ থাকত ,শুধু তাই নয় সিন্ধুনদের মুখ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত চোর ঠগ ডাকাতের নাম আর শোনা যেত না ।
আলাউদ্দিনের বাইরের বিপদটা ছিল মোঙ্গল অভিযান । আট হাজার মোঙ্গল বাহিনীকে  তিনি মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন চোর মিনারে । যাদের জায়গা হয় নি সেই দেহগুলোকে পাঁজা করে ঢিবি করে রাখা থাকত । এই ভাবে সুলতান দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তার ভয়ঙ্কর কঠিন  রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতেন লড়াক্কু মোঙ্গলদের কাছে ।   মোঙ্গলদের মোকাবিলার জন্যই বানিয়েছিলেন সিরি ফোরট ।
এককালের হাড় হিম করা চোর মিনার দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে হজ খাসের সাজানো পাড়ার মধ্যে । ২২৫ তা ঘুলঘুলির মধ্যে এখন চড়াই কাক লুকোচুরি খেলে, আঁশটে নোনতা  চটচটে  লাল রক্তে ভেজা জমিতে এখন সবুজ ঘাস । সেখানে লাল জামা পরে পরীর মতো একটা মেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে , আরও দেখি স্টিলের বাটিতে নুন লঙ্কা দিয়ে ডুমোদুমো কালচে লাল জাম মেখে গোল হয়ে বসে খাচ্ছে একদল বাঙালি বউ । তাদের পেছন দিকে কতো মেয়ের মায়ের বোনের হাসি স্বপ্ন মুছে নেওয়া মিনার হতাশ ভাবে তাকিয়ে আছে । বউগুলোর মুখ জামের রসে টইটুম্বুর , সিঁথির লালে পলার লালে কি নিবিড় শান্তি ! 





Monday 22 August 2016

বেজে গেছে কখন, সে টেলিফোন

ঞ্চ কাঁপিয়ে আলো আর শব্দের তোলাবাজির দাপট তখন প্রায় সহ্যসীমার বাইরে । কোনাকুনি ডান দিক বাঁ দিক ওপর সব দিক থেকে নানান আলোর চরকি ঘুরপাক খাচ্ছে । সেই সঙ্গে বাজনদারদের শব্দঝঙ্কার । আলো বলে আমাকে দ্যাখ , শব্দ বলে আমাকে শোন । ডুয়েট না হয়ে এ যেন ডুয়েল হচ্ছে ।
 এখনো গায়িকা প্রবেশ করেন নি । তিনি স্টেজে আবির্ভূত হবার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে । যাত্রাপালা শুরুর আগে যেমন জগঝম্প হয় শ্রেয়া ঘোষাল দৃষ্টিনন্দন এবং শ্রুতি নন্দন দুটোই । কিন্তু হলে হবে  কি, এতো নন্দনতত্ত্বের চাপ আমি নিতে পারলাম না । সারাদিন অফিস করার পর এই আলো আর আওয়াজ আরো যেন ক্লান্ত করে দিল ।  সিরি ফোরট অডিটোরিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে এসে  রাজীবকে ডাকতে যাব , দেখি সে প্রচন্ড জোরে টার্ন নিয়ে ঘ্যাঁচ করে আমার সামনে গাড়ি থামিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে আমার দিকে আসছে । আমি তো হতবাক । সে কি , এখনো তো ওকে ডাকিই নি । রাজীব এসেই ওর ঘেমো চিটচিটে মোবাইলটা আমার সামনে তুলে ধরে  দম টম আটকিয়ে  কতগুলো শব্দ বের করল , বাত কিজিয়ে, জলদি জলদি , মা জি, মা জি কলকত্তা । “ এমনিতেই “মা জি কলকত্তা” শুনলেই আমার মূলাধার থেকে সহস্রার পর্যন্ত উৎকণ্ঠার  কুলকুণ্ডলিনী তড়াক করে ফনা তুলে ওঠে । ফোনটা ধরা মাত্রই আমার মায়ের গলা খুব বিরক্তির সঙ্গে  বেজে উঠলো , কি ব্যাপার? তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন? আমি এতোবার ফোন করলাম , ফোন না ধরলে কি রকম দুশ্চিন্তা হয়, দিল্লির মতন শহরে একা একা ইত্যাদি ইত্যাদি বলে মা তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন । আমিও দেখলাম গোটা দশ বারো মিসড কল ।  আর এদিকে শব্দের অত্যাচারে প্রায় বিকল স্নায়ু , মোবাইলের ভাইব্রেশনও বুঝতে পারে নি ।  অগত্যা এই বিপর্যয় ।
কিন্তু রাজীবের কাছে মায়ের ফোন গেল কি করে? আমাকে ফোনে না পেয়ে মা প্রথমে ঠিক করেন তাঁর পুত্রকেই জিজ্ঞেস করবেন। কেন মেয়েটা ফোন ধরছে না ?  সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মাথায় এলো তাঁর অতি ঠান্ডা মেজাজের পুত্র  কোন স্বর কম্পন না করে যে নিমপাতা বা কালমেঘের বড়ির মত উত্তর দেবে (যেমন –একটু পরে করব মা? অথবা আমি কলকাতায় বসে কি করে বলি বলতো?) সেটা তাঁর সেই মুহূর্তের উত্তেজনার পারদকে নামাবে তো না বরং আরো বাড়িয়ে দিতেও পারে ।  সব ভেবে চিন্তে তিনি তাঁর জামাতাকে ফোন করলেন। এ যেমন রসগোল্লা রাবড়ি দেবে না আবার নিম পাতাও দেবে না । সে হল মঝঝিম পন্থা । এর কাছে কিছু আশ্রয় প্রশ্রয় পাবার চান্স আছে ।  সে শুনে বলল “ কোথাও গেছে বোধহয় , বাজার হাট । ফোনটা শুনতে পাচ্ছে না । আপনি চিন্তা করবেন না।“ কাজ হল না । মা বললেন, বলো কি? দশ বারো বারও শুনতে পেল না ? দিল্লির মতো শহরে একা একা । মঝঝিম পন্থা বলে ওঠে, না মানে, হয়তো  কোনো কারণে শুনতে  পাচ্ছে না । এতো  বেশি ভাববেন না । “ ব্যাস এই কথাতেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল । মা এবার তাঁর অসুস্থ শরীরে যত টুকু তেজ ছিল তাই নিয়ে বেশ জোরেই বলে ফেললেন “ তুমি না ওর স্বামী ? কোন চিন্তা নেই ,হেলদোল নেই , কোন দায়িত্ববোধ নেই তোমার ?দশটা ফোনকলের একটাও সে ধরেনি ।  একটা মেয়ে দিল্লির মতন শহরে একা একা”এই হুমকি শুনে মঝঝিম পন্থা আরো গুরুতর বিপদ এড়াবার জন্য রাজীবের নম্বর মাকে দেয় , রাজীবও মায়ের প্রচন্ড দাপটে অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা  না করে সোজা আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে ।
আমি ভাই মা বাবা এই চারজনের মধ্যে ফোন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল । এমনো অনেক সময় গেছে যখন দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে ওই টেলিফোনটুকুই ভরসা ছিল । মা আরো দুর্বল হলেন গৃহবন্দী হলেন, আরো বেশি করে  মোবাইল আঁকড়ে ধরলেন ।  অফিসেও ভাই সবসময় ফোন ধরত,হয়ত বেশি কথা বলার সময় থাকত না । এমনই একদিন প্রচন্ড ব্যাস্ততার মধ্যে মায়ের ফোন । ভাই বলতে যাবে একটু পরে করছি, তার আগেই মা বলতে শুরু করল শোন জয় , আজ আমার মনটা  ভীষণ খারাপ । সকালের চা টা ভালো হয় নি । তুই খেতে পারলি না , দেখতে পেলাম ।
ওগুলোতো শুধুই নিছক ফোন কল নয়, মাইলের পর মাইল  পাড়ি  দেওয়া সাতটা রঙের তরঙ্গ । কোনো তরঙ্গ নিয়ে আসছে মায়ের গন্ধ, উত্তাপ, রাগ অভিমান , ছেলেমানুষি, অসম্ভব উৎকণ্ঠাঅলস দুপুর ঘুঘুর ডাক লেবুর শরবত, লালশাক চিংড়ি , নারকেলপোস্ত বাটা। সন্ধেবেলার পুজোর ঘন্টা, লক্ষ্মীপুজোর গুজিয়া ,শীতকালের পালং সুপ, বিট মাটন রোল,মায়ের প্রিয় গান মহাবিশ্বে মহাকাশে,  বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ...। সঅঅব ভেসে ভেসে আসত ।
ওই ফোনটা নিয়েই মা তাঁর জবরদস্ত পাবলিক রিলেশন চালাতোকলের মিস্ত্রি , রঙের মিস্ত্রি কাঠের মিস্ত্রি, ইস্তিরিওয়ালা , জগা ইলেকট্রিশিয়ান , বাদল জমাদার , বিশ্বনাথ মুদি ,রিনা দরজি   চালওয়ালা, গ্যাস , মুচি মুটে মজুর সব্বাই হাতের মুঠোর মধ্যে জো হুকুম হুজুর  হয়ে থাকত । তবে মা তো মোটেও  কড়া মানুষ ছিলেন না, সব্বাই তাই মাসিমা জ্যাঠাইমা কাকিমা বলে বলে আসত, সব্বাই জল চা মিস্টি খেত আর মাকে বিস্তর ঠকাতো ।
  একবার পুজোর সময় আমরা সব একসঙ্গে আছি ক’টা দিন ভাই গেছে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে । রাত হয়েছে । আমি মায়ের সঙ্গে শুয়ে পড়েছি। মা জানেন জয় এখনো বাড়ি আসেনি । অথচ মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে সেই নিমপাতা উত্তর পেতে হবে , মা মঝঝিম পন্থাকে মোবাইলে ফোন করলেন, সে পাশের ঘরেই  টিভি দেখছে । ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হলসান্ত্বনা দিল ,পুজোর সময় তো একটু এরকম হবেই মা । মা সেখানেই শান্ত হলেন না , তিনি এবার ছেলেকে ফোন করতে শুরু করলেন, সে একসময়  জানালো শ্রীভূমি স্পোর্টিং এর ঠাকুরের জন্য গাড়ি প্রায় চালাতেই পারছি না , তুমি এভাবে ফোন করলে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব কিন্তু । একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পর ছেলে ফিরছে না দেখে মা তাঁর অসুস্থ শরীর টেনে  নিয়ে সোজা মঝঝিম পন্থার দোরগোড়ায় । আদেশ হল,শোনো, আমাদের এখখুনি পুলিশে খবর দিতে হবে কারণ...।

এখন আর সেই ফোন গুলো আসে না, যেগুলোকে অনেক সময় মনে হত, উফ মা পারেও বটে, জানো আজ একটু হলেই শান্টু অ্যাকসিডেন্ট করছিল তোমার ফোনের গুঁতোয় ।
  সকালে না, দুপুরে না , সন্ধেয়  না, রাতে না । কেউ পথ চেয়ে বসে থাকে না ।
  কখন ফিরলাম, কি খেলাম ,মন খারাপ করছে কি না, গলাটা খুস খুস করছে কিনা  কেউ খবর নেয় না । কলকাতায় ফিরলে যত রাত্তিরই হোক সেই মিস্টি গলায় “ওয়েলকাম হোম”  কেউ বলে না । আমাদেরও তড়িঘড়ি কাউকে কিছু  জানানোর কোন প্রয়োজন নেই । এস এম এস এ একটা দুটো ছুঁড়ে দেওয়াই   যথেষ্ট ।
এখন তো কেবল “বুকের মধ্যে ধূ ধূ মরু ঢুকে পড়ে হঠাৎ দুপুর/তখন শুধু আকুল বিকুল দিখির জলের কাঁপন শুনি...”

মোবাইলটা ছিল শেষদিকে মায়ের একমাত্র খোলা জানালা । ওই মোবাইলটা দিয়েই ঠিক তিনবছর আগে মা প্রথম আঁচ করে ফোন করেছিল “এই শোন, একটু আয় তো, তোর বাবার শরীর টা মনে হয় ভালো নেই”
ভেবেছিলাম মার সঙ্গে মোবাইলটা দিয়ে দেব । অন্যরা রাজি হল না । তবে মা এখনো ফোন করে, ফোনগুলো বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায় । আমরাই শুনতে পাই না ।

কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ
কিছু মিছু রাত পিছু পিছু টান অবিকল
আলো আলো রঙ জমকালো চাঁদ ঝলমল
আজও আছে গোপন ফেরারি মন
বেজে গেছে কখন সে টেলিফোন
গুঁড়ো গুঁড়ো নীল রঙ পেন্সিল জোছনার জল
ঝুরো ঝুরো কাঁচ আগুন ছোঁয়া আজ ঢেকেছে আঁচল
আহা ফুটপাথ এ ভিড় জাহাজের ডাক ফিরে চলে যায়
আহা হা আহাহা
কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ