Wednesday 24 August 2016

দারাদিল রানাশুকো


 ভোরের আলোয়   গাছের  পাতায় পাতায় জমে  থাকা  শিশির বিন্দুর রামধনুতে  টলটল করে উঠছে   দারাদিল রানাশুকো , প্রথম বৃষ্টির সোঁদা গন্ধের মাটির ভাপে গুমগুমিয়ে উঠছে দারাদিল রানাশুকো , যমুনার ঢেউ এ  অস্তরাগের রঙে রাঙিয়ে গেল দারাদিল রানাশুকো , আগ্রা কেল্লার লাল পাথরে পাথরে নিঃশব্দে খোদাই হল দারাদিল রানাশুকো ,  গুলরুখ বাঈয়ের ঘুঙুরের বোল গেয়ে ওঠে  দারাদিল রানাশুকো , জ্যোস্নার ভেতরে হাসনুহানার ঝোপে জোনাকির জ্বলা নেভায়  দারাদিল রানাশুকো ,মটর গাছের খেতে এক ঝাঁক টিয়াপাখির সবুজ ডানায় উড়ে যায় দারাদিল রানাশুকো ,অপরূপ খিলান আর গম্বুজের বেদনাময় রেখা ধরে রাখে দারাদিল রানাশুকো ,পর্দায় গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ জমা করে রাখে দারাদিল রানাশুকো , কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে সময় সরণি বেয়ে বিস্মৃতির গভীরে তলিয়ে যাওয়া এক আশিক আর তার মাশুকার নাম দারাশুকো রানাদিল



আল্লাহ্‌ কে তিনি বলেছিলেন সচ্চিদানন্দ মির্জা রাজা জয় সিংহ কে লেখা চিঠিতে ফারসিতে লিখেছিলেন সচ্চিদানন্দ আল্লাতালার মুখের দুপাশে দুই গুছি চুলের একটি ইসলাম অন্যটি হিন্দু ধর্ম হাতের আংটিতে দেবনাগরীতে খোদাই করেছেন পরভু (প্রভু) কানের ভেতরে বাজতে থাকে অপরূপ ঘণ্টা ধ্বনি , চোখের সামনে উড়ে বেড়ায় অজস্র আলোর বিন্দু হৃদয়ের গভীরে এক অনন্তের সঙ্গে মিশে যাবার সমুদ্র উচ্ছ্বাস  অনুভব করেন হিন্দুস্তানের শাহজাদা ,নাদিরা বেগমের স্বামী , সলোমন শুকো র আব্বা , সম্রাট শাহজাহানের বড় আদরের ছেলে  , জাহানারার বড় ভালবাসার ছোটে ভাইয়া দারাশুকো তিনি যেন এই দুনিয়ার মানুষ নন , বেহেশ্ত থেকে আসা এক ফরিস্তা মোঘল হারেম তাকে টানে না , তিনি  সাধু সন্ত পীর ফকির দরবেশ আর সুফিয়ানা সিলসিলায় আত্মমগ্ন স্বপ্নাতুর ,যেন এই দুনিয়ায় দুদিনের মেহমান ,কিন্তু তবু শাহী আদবকায়দা মানতে হয়, যুদ্ধে যেতে হয় , তলোয়ার ধরতে হয় বে  শরিয়তি কাফের বলে নিন্দের কাদাও  গায়ে মাখতে হয়


ঘরে জমানো  তরল ঘি , তাতে এক চুটকি সিঁদুর গুলে দিলে যে একটা অদ্ভুত আদুরে রঙ তৈরি হয় রানাদিল ছিল সেই রঙের একটা মেয়ে বেমিসাল তার খুবসুরতি তার চালচুলো নেই ,জাত ধর্মের ঠিক নেই , বাপ মায়ের হদিশ নেই অনাথ মুখের ভাষা ও সেইরকম নেই সহবত , নেই লজ্জা , বেপর্দা বেহুদা আওরৎ খুচরো পয়সা জমিয়ে দিনের শেষে রুটি কাবাব কেনা ই তার বেঁচে থাকা রাক্স অর্থাৎ নাচ তার পেশা না, সে মুজরো জমানো বেল জুঁই মালায় সাজা বাইজি বা তবায়েফ নয় তার জন্য কোন তবলচি কাহারবা দাদরার বোল তুলত না , কোন ঝাড়বাতির রোশনাই এর  নিচে  তার সুর্মা টানা চোখ কথা কইত  না , ছিল না গলায়  ঠুমরির  দানাদানা  নক্সার কাজ , ছিল না গোলাপদান , আতর দান পানদানের বাহার     থাকবে কিকরে ? রানাদিল ছিল রাস্তার নাচিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মান্ডিতে মান্ডিতে ঢোলকের সঙ্গে সে নেচে বেড়াত কাঁকর পাথর ছড়ানো রাস্তায় , সাঁঝের বেলায় , যমুনার ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইত , নানান ব্যাপারী পরদেশি দেহাতির দল জমা হত , ন্যাকড়া জড়ানো সস্তা চর্বি মাখানো  মশাল দাউদাউ করে জ্বলে উঠত আর সেই সময়খোলা আকাশের নিচে এক রাশ লোকের সামনে আলোআঁধারির মধ্যে  লচক আর ঠুমক নিয়ে ঘাগরায় অশান্ত ঘূর্ণি তুলত রানাদিল আমজনতার নাচিয়ে আমজনতার মেহফিল । আমজনতার দিল কি রানি  সবাই তাকে চিনত সব্বাই অফুরান ছিল তার প্রাণশক্তি সমস্ত রক্তবিন্দু দিয়ে নাচত রানা তাকে ঘিরে চলত সাধারণ পথচলতি মানুষের উদ্দাম ফুর্তি আর হাততালি , যে হাত তালিকে দেওয়ানি খাসের দরবারি নাচের শাহী মজলিশে বে সহবত মনে করা হত


দারাশুকোর শান্ত গেরস্থালি  ছিল নাদিরা বেগমকে নিয়ে  তাতে মাধুর্য থাকলেও    উচ্ছ্বাস ছিল না শাহী সহবতের বাইরে কোনোদিনই যায় নি নাদিরা নাদিরা নাজুক শরমিলি আওরৎ দারা ছিলেন তার কাছে হজরত , শরতাজ , বা কখনো বন্দেগান বরং দারার অতিরিক্ত ধর্ম চর্চা সাধুসঙ্গ আর পড়াশুনো তাকে ভাবিয়ে তুলত এর থেকে বন্দেগান যদি আরেকটা বিবি আনত বা হারেম নিয়ে ব্যস্ত থাকত তাহলে সে
 বেচারা  খানিকটা স্বস্তি পেত যে তার খসম একজন স্বাভাবিক মানুষ


শাহী মহল ছেড়ে ছদ্মবেশ পরে দারা মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে এমনই একদিনে রানাদিলের সঙ্গে তার দেখা হয় সেদিনও রানা কে ঘিরে চলছিল হই চই আর হুল্লোড় ঘটনাচক্রে দুজনের সাক্ষাৎ হয় অসম্ভব সাবলীল তার কথা , বাজার চলতি ভাষা , নেই কোন কুরনিশ , তসলিম , কদমবোসি , সিজদা
কিন্তু সস্তার নাচুনি রানাদিলের মধ্যে  এমন একটা উষ্ণতা ছিল যা শাহজাদার কাছে ছিল একদম অন্য রকম, ভানহীন , আন্তরিক, একদম স্বাভাবিক   রাজধানী আগ্রায় মরদের কঠিন দুনিয়ায় গায়ের ঘাম  ঝরিয়ে রুটি কামায় যে মেয়ে এতো প্রাণশক্তি কোথা থেকে পায় সে? শাহজাদা দারার অন্তরের মহব্বতের পাত্রটি পূর্ণ হয়ে উপচে পড়েছিল , সেই ভালবাসার স্রোত রানাদিলকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় রাস্তার সেই ধুলোকে হৃদয়ে মেখে নিলেন দারা রানাদিলের নতুন আস্তানা হল যমুনা পারের রানি হাভেলি মরদ আর আওরৎ যে সমানে  সমানে ভালবাসতে পারে একথা নতুন করে শিখলেন দারা  
কিন্তু রানি হাভেলি, রানাদিলের মতো মুক্ত আজাদ পঞ্ছির কাছে কয়েদখানার মতো মনে হত দরজায় পাহারা ফৌজদারি মনসবদারির কাজ সেরে ছদ্মবেশ পরে  মাপা সময়ের জন্য শাহজাদার তার কাছে আসা এসবই না পসন্দ ছিল রানাদিলের উপরন্তু নেই কোন রাখঢাক ভান ভণিতা , কোনোদিন শেখে নিও সে টানাপোড়েনে  বিভ্রান্ত দারা কে সে বলেই বসে , “আমার সঙ্গে রাস্তায় নেমে এসো , চলো হাত ধরাধরি করে শাহী সড়কে মিশে যাই , গোয়ালিয়রের রাস্তা ধরে বাগোয়ানের জঙ্গলে গিয়ে উঠি
মোঘল খানদানে আটপৌরে  জীবনের এই স্বাদ শাহজাদা আগে কখনো পান নি রানাদিলের বিয়ের প্রস্তাব বারবার পিছিয়ে যায় শাহী দায়িত্ব সামলানোর কাজে , কান্দাহার যুদ্ধ , রাজধানী জাহানাবাদের বিপুল কাজ ,আব্বাহুজুর  শাহজাহানের শখ মিনার মসজিদ কেল্লা সমাধি , নকশা , পাথর রানাদিল অমন শাহীর মুখে রোজই  ঝাঁটা মারে , শাহীর পাথুরে খোয়াবে তার দম আটকে আসে
দারা তাকে জিজ্ঞেস করেন , তুমি হিন্দু না মুসলমান, রানা  ?
“তা তো জানি না তবে আমি ইনসান , এইটুকু জানি
“আমিও  তাই ,রানাদিল

“দারুণ হার-বাত-এ জান-ইস্ত পিনহান
বা-জের-ই কুফার ইমান-ইস পিনহান
সাধনায় প্রতিটি মূর্তি সজীব হতে পারে। অবিশ্বাসের নিচেই লুকিয়ে আছে বিশ্বাসের ফল্গু । রুবাইটি ঘোরে পাওয়া মানুষের মতো লিখে রাখতে রাখতে দারা মনে মনে বলে উঠলেন কাবা আর সোমনাথ আমার একই লাগে। আমি না হিন্দু—না মুসলমান । তাহলে আমি কী? “


শেষমেশ রানাদিলের সঙ্গে বিয়ে হয় দারা শুকোর অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কারোরই পছন্দ ছিল না , না শাহজাহানের , না জাহানারার রানাদিল , দারার তৃতীয় এবং শেষতম বেগম নাদিরা ছাড়া জর্জিয়ার স্বেতলানা বা উদিপুরিকে দারা বিয়ে করেন সেলিম আনারকলি , জাহাঙ্গীর নুরজাহান , শাহজাহান মুমতাজের নক্ষত্র খচিত অতিরঞ্জিত প্রেম কাহিনীতে কোথায় চাপা  পড়ে  গেছে রানাদিল অথচ ওইসব জাঁক জমক প্রেমের মধ্যে মিশে  মিশেআছে  ক্ষমতার লোভ , স্বার্থ , পরনারীতে আসক্তি কিন্তু ঘুঁটে কুড়ুনি আর রাজার দুলালের এই আশ্চর্য ভালবাসা কোথায় গুম হয়ে গেছে তার হদিশ কেউ রাখে নি

আওরঙ্গজেবের হাতে দারার হত্যার পরে নাদিরা বিষ খায় , উদিপুরি চলে যায় মোঘল  হারেমে কিন্তু বাগ মানানো যায়নি রাস্তার সেই জিদ্দি নাচনেওয়ালিকে বড় মজবুত ছিল তার ইশক আওরঙ্গজেব রানাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন সেখানে বসে রানা চোখের জলে ভেসে ভেসে গান বাঁধত আর গাইত সেই গানে আওরঙ্গজেবের যত কুকীর্তি আর অত্যাচারের  কথাই মনে করাতো সে শাহী হুকুমে গানবাজনা বন্ধ হয়ে যায় এইসময় রানাকে মেরে কুকুর দিয়ে খাওয়াবার ভয় দেখানো হয় কিন্তু রানা ছিল এক রোখা , বেপরোয়া দারার সঙ্গে ভালবাসার যে জিদ সে বজায় রেখে ছিল , দারাহীন জীবনেও সেই জিদ থেকে একচুল সরে আসেনি  
আওরঙ্গজেব খবর পাঠালেন তিনি রানার অন্ধকার বিদিশার নিশার  মতো চুল নিয়ে খেলা করতে চান রানা তার সব চুল কেটে মাথা ন্যাড়া করে সেই রেশমের  মতো চুল বাদশাকে পাঠিয়ে দিয়ে বলে এই নাও শাহী , সেই চুল যা তুমি বড্ড ভালবেসেছিলে আওরঙ্গজেব এবারে বলে পাঠালেন ওই শ্রাবস্তীর কারুকার্য মুখ তিনি দেখতে চান , রানা যেন তার কাছে এসে থাকে
ছোরা দিয়ে মুখ ক্ষত বিক্ষত করে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত একটা পাত্রে জমা করে রানা ছোরাখানাকে ভালো করে রক্ত মাখিয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে এবারও বলল এই নাও শাহী সেই চাঁদমুখ ,যা তুমি দেখতে চেয়েছিলে
দারা , রানার জন্য কোন তাজমহল বানান নি , রানার কোন সন্তান ও ছিল না

কোন এক সূত্র থেকে জানা যায় একদিন যমুনার কিনারে এক কোনে একটা  জ্বলন্ত চিতায় কোন এক ফকিরকে দেখা গিয়েছিল ,সে  বসেছিল  চিতার ওপর ,তার মাথা ন্যাড়া , ক্ষত বিক্ষত তার মুখ ময়লা চাদর ।
সেদিন সন্ধের মুখে বেহেস্তের সুগন্ধ মেখে একরাশ নক্ষত্রের কাঁপনে সে শেষ বারের মতো শুনেছিল দারাদিল রানাশুকো

সেই কথা ভালো ,তুমি চলে এসো একা ,
বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে -
স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা ,
সন্ধ্যা তারাটি শিরীষ ডালের  ফাঁকে


ঋণ স্বীকার ঃশাহজাদা দারাশুকো -শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ,আসিফ খান দেহেলভি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন নেওয়া হয়েছে

ছবির উত্স : গুগল , শিরিন শাহবা , আসিফ খান দেহলভি 





3 comments:

  1. আহা!প্রেমের ইতিহাস এমনি কাঁটার আঘাতে আহত! রানাদিলের গল্প জানতাম না!সে তো দেখছি দিব্যি ফেমিনিস্ট ছিল!

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete