Tuesday 23 August 2016

দিল্লি দাস্তান ৪



মুন্ডহীন ধড় গুলি (আহ্লাদে) চিৎকার করে

দেশ জোড়া বিদ্রোহ তখন । ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে  জান কবুল করে লড়ছে সিপাহিরা । অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষও বিদ্রোহে শামিল । আগুন জ্বলছে কোথাও দাউদাউ কোথাও ধিকি ধিকি । সবাই তাকিয়ে দিল্লির দিকে । কিন্তু বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করার দরকার হল না , ফিরিঙ্গি দিল্লি জিত লিয়া,এই খবরটাই দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ছে তখন । তখত থেকে নেমে তাজ খুলে ফেললেন বাহাদুর শাহ জাফর , হিন্দুস্তানের শেষ সম্রাট ।
হুমায়ুনের সমাধি ক্ষেত্রে তার দুই ছেলে আর নাতিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করানো হল ফিরিঙ্গি সেনা ক্যাপটেন উইলিয়াম হডসনের হাতে । পল্টনরা পাহারা দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে রাজ পরিবারের অনেক বন্দীদের নিয়ে চলেছে লাল দরওয়াজার দিকে।লাল দরওয়াজার সামনে সেদিন দারুণ ভিড় ।হাডসন দেখলেন মাথায় সাদা ফেট্টি বেঁধে গাজির দল চারদিক প্রায় ঘিরে ধরেছে । লাল দরওয়াজার এককোণে যে ছোট্ট তথ্য দেওয়া আছে তাতে লেখা আছে ,হাডসন ওই তিন যুবরাজকে ওপরের জামা খুলে ফেলতে বলে তারপর খাপ থেকে তলোয়ারের একটি শানিত ঝলক , আর টুপ টুপ খসে পড়ে তিনটি মাথা , “জমায়েত সব নারী পুরুষ শিশুদের মেরে ফেলা হোক “ এই আদেশ হেঁকে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়ে হাডসন । লাল দরওয়াজা সত্যি রক্তে রক্তে লাল হয়েছিল সেদিন । সবাই বলত খুনি দরওয়াজা । এই খুনি দরওয়াজার গেটেই ঝুলেছে দারা শিকোর দেহহীন মাথা ।তারও আগে জাহাঙ্গীরের আমলেও হত্যালীলার নীরব সাক্ষী এই খুনি দরওয়াজা । কেউ কেউ কলঙ্কের কিসমত নিয়েই জন্মায় । খুনি দরওয়াজাও তাই । শতকের পর শতক কেটে গেলেও তার বদনাম আর ঘোচে নি । ১৯৪৭ এর দাঙ্গায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে এইখানেই । এমনকি ২০০২ সালে এক মেডিক্যাল ছাত্রীকে দিন দুপুরে এখানে গন ধর্ষণ করা হয় । তারপর থেকে এর দরজায় তালা পড়ে যায় । ভুতুড়ে গপ্পো ও শোনা যায় অনেক । এমনও শোনা যায় ভূতদের টার্গেট সাহেব মেম । দেশের লোকদের তারা বিরক্ত করে না ।
ব্যস্ত বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ । একদিকে ফিরোজ শাহ কোটলা , অন্যদিকে মৌলানা আজাদ মেডিক্যাল কলেজ । রাস্তার দুদিক দিয়ে তির বেগে গাড়ি ছুটছে । তার পাশেই  শতকের পর শতক সারা গায়ে কলঙ্ক মেখে বেবাক দাঁড়িয়ে আছে শের শাহ সুরির বানানো খুনি দরওয়াজা । রক্তের গন্ধ , সারা গায়ে । অত্যাচারের কদর্যতা , প্রতিটি রন্ধ্রে । দেখলাম পাথুরে জমির ওপর পড়ে আছে একটা থ্যাঁতলানো লাল ফুল ।











                                                                                                 
 জামি বিবির খসম রাতে বাড়ি ফেরেনি , সাকিনারও তাই । তারা ঠগ জোচ্চুরি করে খায় । এখন কোতোয়ালি ভারি  উগ্রচন্ডা । সপাট মার আর মুখের রক্ত তোলা ছাড়া কোন কথা নেই বিবিদের চোখে রাতের ঘুম নেই অনেকদিন  ।মনটা কু গায় । সুলতানের প্রাণে তো মায়া দয়া নেই । কাক ভোর হতেই দু জনায় দৌড়ায় । ঘুরে ঘুরে মিনারটাকে দেখে , বুক দুরদুর করে । আর বাঁক ঘুরতেই বল্লমের খোঁচার মুখে ঝুলছে তাদের  মরদের কাটা মুন্ডু । চোর মিনারের ২২৫ টা গর্ত দিয়ে বল্লমের মুখে একটা করে মুন্ডু ঝুলে আছে । চোর মিনার বানিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খিলজি । আজ হজ খাসের যে অভিজাত পল্লিতে এই মিনার সেই জায়গাটা সেই সময় চোর ছ্যাঁচোড় ঠগ ডাকাতের  মহল্লা ছিল । লোকে দিনমানে চলাফেরা করতে ভয় পেত ।    
আলাউদ্দিন খিলজির আমলে সেনাবাহিনীর দারুণ রমরমা । হিন্দ নয় সমস্ত মধ্য এশিয়াতে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল । সুলতানের ছিল একটা তুখোড় গুপ্তচরবাহিনী , তৎপর আর অনুগতকোতোয়ালি গুলো ছিল খুবই তাগড়া , বলশালী  ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান । অন্যায়ের শাস্তি  পেতেই হবে ।  বাইরের শত্রু মোকাবিলা করা তখন সুলতানের প্রধানতম কঠিন কাজ । তাই ঘরের ভেতরটাকেও পোক্ত করতে চেয়েছিলেন যাতে উটকো উৎপাত না আসতে পারে । চোর ডাকাতদের চোর মিনারে ঢুকিয়ে মাথা কেটে ,এমন আড়ং ধোলাই দিয়েছিলেন যে  আমির খুসরো লিখছেন, যে চোর আগে গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিত , সে এখন বাতি জ্বেলে বড় রাস্তা পাহারা দেয় । যদি কোন পর্যটকের একটা সুতোও হারিয়ে যায় তাহলে কাছাকাছি লোকজনেরা হয় সেটা খুঁজেই দেবে নয়ত তার দাম মিটিয়ে দেবে ।  খুসরো আরো লিখছেন এইসব কড়া ব্যাবস্থার জন্য রাস্তাঘাট নিরাপদ থাকত ,শুধু তাই নয় সিন্ধুনদের মুখ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত চোর ঠগ ডাকাতের নাম আর শোনা যেত না ।
আলাউদ্দিনের বাইরের বিপদটা ছিল মোঙ্গল অভিযান । আট হাজার মোঙ্গল বাহিনীকে  তিনি মেরে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন চোর মিনারে । যাদের জায়গা হয় নি সেই দেহগুলোকে পাঁজা করে ঢিবি করে রাখা থাকত । এই ভাবে সুলতান দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তার ভয়ঙ্কর কঠিন  রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতেন লড়াক্কু মোঙ্গলদের কাছে ।   মোঙ্গলদের মোকাবিলার জন্যই বানিয়েছিলেন সিরি ফোরট ।
এককালের হাড় হিম করা চোর মিনার দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে হজ খাসের সাজানো পাড়ার মধ্যে । ২২৫ তা ঘুলঘুলির মধ্যে এখন চড়াই কাক লুকোচুরি খেলে, আঁশটে নোনতা  চটচটে  লাল রক্তে ভেজা জমিতে এখন সবুজ ঘাস । সেখানে লাল জামা পরে পরীর মতো একটা মেয়ে খেলে বেড়াচ্ছে , আরও দেখি স্টিলের বাটিতে নুন লঙ্কা দিয়ে ডুমোদুমো কালচে লাল জাম মেখে গোল হয়ে বসে খাচ্ছে একদল বাঙালি বউ । তাদের পেছন দিকে কতো মেয়ের মায়ের বোনের হাসি স্বপ্ন মুছে নেওয়া মিনার হতাশ ভাবে তাকিয়ে আছে । বউগুলোর মুখ জামের রসে টইটুম্বুর , সিঁথির লালে পলার লালে কি নিবিড় শান্তি ! 





No comments:

Post a Comment