“নয়ন বেটা, কাবাব নেবে না ? কালকেও রেখে দিয়েছিলাম
,আসো নি তুমি ।“
এখন যেন আঁধার বড়
তাড়াতাড়ি নেমে আসে । এমনটা আর কোনোদিন দেখিনি নয়ন
, নিজের শহরকে আজকাল বড্ড অচেনা লাগে তার । চারদিকে থমথমে রাগ আর ঝাঁঝ । ভয় যেন গলা টিপে ধরেছে সকলের । চাওরি বাজারের বাঁক ঘুরতেই গফুর মিয়াঁর আচমকা ডাকে প্রায় চমকিয়েই ওঠে নয়ন ।
গফুরের পুরো শরীর টা
দেখা যাচ্ছে না । কাঁচাপাকা দাড়ি আর ঢলঢলে
কামিজের ভেতর থেকে হাতে ধরা ছোট
একটা পোঁটলা । তাতে গুটিকয় কাবাব বাঁধা ।
গলা ধরে এলো এল
নয়নের ।
“চাচাজান , এই
বিপদের মধ্যেও আপনি আমার কথা ভোলেন নি !
কী দরকার ছিল এসবের ! “
আলো আঁধারই গলির
মধ্যে গফুর ম্লান ভাবে হাসে ।
“চিরটা কাল তোমাকে
এই সাঁঝের বেলা কাবাব খাইয়েছি বাপ, আজ তা কী বলে বাদ দেবো ? হে ভগবান , এমন বদ
নসিবি র দিনও দেখতে হোলো । আর দাঁড়িও না ।
যাও বেটা ঘরে যাও । “
গফুর মিয়াঁর বয়স
হয়েছে । জামা মসজিদের সিঁড়িতে এক কোনায় বসে কাবাব বিক্রি করে । আগের দিন রাত থেকেই তার
তরিবৎ শুরু । এ যেন এক মোহব্বতের
কিসসা । কিমা গোস্ত ,
পিটানো গোস্ত , দই , পুদিনা পাতা কুচি ,
কাশ্মিরি মিরচি , ঘি , জয়িত্রী জায়ফল । কাবাব বানাতে বানাতে গফুরের ঘোর লেগে যেত
। কাবাবের পরতে পরতে নিজের মোহব্বত গুঁড়ো
গুঁড়ো করে মিশিতে দিত ।
কিনারি বাজার , চাওরি বাজার , মীনা বাজারে বাতি জ্বলে উঠতো । চাওরি বাজারের মহল্লায়
মাঘরিবের নমাজের সঙ্গে সঙ্গে সারেঙ্গিতে ছড় পড়ত , তবলার বোল আর ঘুঙরু । ভিস্তি জল
ঢেলে শাহজাহানাবাদের রাস্তা ধুয়ে ফেলত অসরের নমাজের পরেই । সেই
বেলোয়ারি সন্ধেয় গফুর ঢিমিঢিমি
আঁচে বানানো কাবাব বিক্রি করতে
বেরুত ।
সেই এইটুকুন বয়স
থেকে গফুরকে দেখছে নয়ন । নয়ন বরাবরই গফুর মিয়াঁর কিসসার ভক্ত । কাবাব বিক্রির সময়
পাশে বসে থাকে । গফুরের কথা হাঁ করে গিলত ছোট্টবেলায় । গফুর বলত, বাড়ি
যা বাপ , মা পথ চেয়ে বসে আছে ।
আজ দুই হপ্তা হয়ে
গেলো গফুর জামা মসজিদে বসে কাবাব বিক্রি করে না । দিনকাল খুব খারাপ ।
চৈত মাসে চুনারি
রঙ্গাওবে , ও রামা
গরম বিনবিন করে
বাড়ছে । চৈতির বাহার যদিও এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি । শাহজাহানাবাদের সড়কের দু ধারে
শিমূল পলাশের শেষ অস্তরাগ । যমুনা থেকে পুবের হাওয়ায় যেন ভেসে ভেসে আসছে কত আগাম তেওহারের
দাওয়াতের সুগন্ধ । নয়ন সেই সব সুগন্ধ বেশ
বুঝতে পারে ।
আম গাছ গুলো মুকুলে
মুকুলে ভরে যাবে । তারপর উঁন উন কর আয়ি বদরিয়া ,
বরসন লাগে , সদা রঙ্গিলে , মম্মদ শাহ ।
এরপর বর্ষা আসবে । তখন
শুনবে কাজরি । মুঘল সম্রাট মহম্মাদ শাহ রঙ্গিলা কত গানের বন্দিশ লিখেছেন । সদারং , তার রাজ সভার গাইয়ে । বহু গানের বন্দিশ এদের দুজনের নাম আর
ভুলতে দেয় নি ।
আসবে তিজ তেওহার । আম গাছের ডালে ডালে বাঁধা হবে ঝুলা । মেয়েরা ঝুলায় দোল খাবে আর ছেলেরা সেই দোলনা দোলাতে থাকবে । এমনি
করে নয়ন চোখের সামনে কত ভাব ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকল ! দেদার বানানো হবে মোতি চুড় লাড্ডু , বুন্দি আর গেঁহুর
লাড্ডু । হাত লেগে থাকা ঘি এর গন্ধে কখন মিশে
যাবে ঈদ মোবারকের ভুনা গোস্ত
আর শাহি টুকরার খোশবায় । আরে ইয়ার , এ হোলো গঙ্গা জমুনি তেহজিবের কামাল । জাফরানি
পুলাও এর মেহক যেতে না যেতেই গিল কা ইত্তর কেনার হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে ।
প্রথম বৃষ্টির পর
মাটির সোঁদা গন্ধ । নরম মিহিন পলিমাটির পোড়ানো পাত্রের টুকরো না হলে গিল কা ইত্তর
বানানোই হবে না । এ খুব খাটুনির কাজ । পাতলা পাতলা ভাঙা টুকরো আতর তৈরির তরিবতে লাগে । মীনা বাজারের আশরফ শুনিয়ে ছিল সেই এক কিসসা ।
গিল কা ইত্তর বানানোর কারসাজি ।
“ আরে নয়ন বেটা ,
শরবত তো পীলো ! “ দিলনশী বানো আমার কাঁধে একটা হালকা ধাক্কা দেয় । আর সঙ্গে সঙ্গে ,তার
চুলের মেহেন্দি , সুর্মা আর জর্দার ভরপুর গন্ধে শেষ চৈত্রের দুপুরের নেশায় যেন ধুন্ধুমার আঁধি আছড়ে পড়লো ।
দিলনশী খিলখিলিয়ে
হেসে গড়িয়েই পড়ছে । বাবা লেখে বানিয়ার খাতা , আর ছেলে লেখে শায়েরি । কিসমতদার হো
বেটা । আপনা জিন্দাগি জি রহে হো ।
-তা , ঠিক বলেছো আপা
। বাড়িতে আমাকে কেউ কিছু বলেনা ।
তওয়াফ দের আপা ,
চাচি , দাদি বলে কেউ ডাকে না । কতবার নয়নের ওড়ানো ঘুড়ি আটকে গেছে আপাদের ঝরোখার জালিতে , কবুতর
উড়ে বসেছে ছাদের ওপর, তার কোনো হিশেব নেই । ছোটবেলা থেকে এই অঞ্চলেই বড় হয়েছে সে । এদের আদর ভালোবাসায় কখন যেন সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে , সে
নিজেও জানে না । আপা ঠিকই বলেছে , বাড়িতে তার এই আওয়ারগিতে কেউ কিছু বলেনা । কেউ
বলতে তো বাবা আর মা । পতঙ্গ বাজি কবুতরবাজি আর শায়েরি । আশ্চর্যের কথা , নয়নের বাবার যেন একটা হালকা প্রশ্রয় ও আছে মনে হয় ।
রামলীলায় বাবা রাবণ সাজে আর নয়ন সাজে হনুমান । হিশেব খাতার কাজ থেকে সেদিন বাবার ছুটি !
বাদাম পিস্তার হলুদ
সবুজ সাদা ছিট ছিট সরবতে মিঠে সুবাস । আনোয়ার মিয়াঁ সারেঙ্গি রেখে দিচ্ছে । নয়ন বলে উঠল , আরেকবার গানটা হবে না , আপা? বেশ লাগছিল শুনতে
।
আপা একটু তেরছা চোখে
দেখল ।
গানটা মেয়েটা বড়
ভালো গেয়েছিল । ওকে আগে এখানে দেখেনি নয়ন । নতুন এসেছে ,মনে হয়
।
আপা কিছুটা ঝাঁঝের
সঙ্গেই বলল , এখনো অনেক তালিম বাকি । দু তিন জায়গায় ঠিক মতো স্বর লাগলোই না !
-এ কী আর তোমার
শায়েরি , নয়ন বেটা ! গান গাইতে মেহনত লাগে , রিওয়াজ তালিম ...। এ এক ইবাদতের মতো ।
নয়ন মনে মনে
ভাবে , এটা তুমি কী বললে দিলনশী আপা ?
শায়েরি কি ইবাদত নয় ? ইশক নয়? হুশ্ন নয় ?
নয়ন চোখ তুলে দেখলো , বারান্দার হলুদ লাল সবুজ কাঁচ আর জাফরির নকশার
রঙ্গোলি মেখে মেয়েটা বসে আছে । তার মোমের মত শরীরটা জুড়ে আলোর রোশনাই ।
সরু সরু অন্ধকার সিঁড়ি
বেয়ে ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে রাস্তায় নেমে এলো নয়ন । অজান্তেই তার চোখ দুটো উঠে গেল ওপরের দিকে , খিড়কি বন্ধ করছে সেই আলো সুন্দরী ! নয়ন মনে মনে বলে, “কী নামে
ডাকি তোমায় ? পারিজাত ? কিল্লা
লালকোটে আমি একদিন রাত্তির বেলা তোমাকে
জোনাকি দেখাতে নিয়ে যাবো । কেমন?”
আঁখে খামোশ থী উন কি
, পর বাতেঁ বানাতা থা কাজল ।
নীরব দুটি চোখ
/কাজলরেখা ধরেছিল যত প্রণয় , বিরহ , শোক ।
চাওরি বাজার এখন বেশ
শুনশান । মাঘরিবের আজানের প্রায় সাথে সাথেই একটু একটু করে রঙ বদলে যাবে এই মহল্লার
। বাজার এ হুশ্ন । সৌন্দর্যের হাট ! রূপের হাট । সেই হলো চাওরি বাজার । সন্ধে নামার সাথে সাথে কোঠিতে কোঠিতে
শমাদান আর ঝাড়বাতি শোনাবে মৌসিকি আর মেহবুবের
এর দাস্তান । নেশার মৌতাতের খোশবায় । খোশবায় কি
শুধু ফুল আতর আর রসুইতে থাকে নাকি ?
নয়ন তো সব কিছুর
মধ্যে খুশবু পায় ,সবেতেই সে রঙ দেখে , আলো দেখে , কিসসা
শোনে , শায়েরি বোনে ।
হজরত এ দিল্লি তে এর
কোনোটারই অভাব নেই । নেশার খোরাক ছড়িয়ে আছে এই শহরের পরতে পরতে, আগা পাশতলা পাঁচিল দিয়ে ঢাকা এই শাহজাহানাবাদে । চাওরি বাজারে এই যে এতো কোঠেওয়ালি , তবায়েফ , অদায়েওয়ালি , ওরে বাবা , এদের যা বোলবোলাও ।
আরে, নাচ গানের কথা ছেড়েই দিলাম। তেহজিব
আদব কায়দা শেখানোর জন্য খোদ কিলা এ মোবারকে এদের ডাক পড়ে । কী পেশ কশ, কী তমিজ । নয়ন
তো হাঁ হয়ে যায় । কথা এমন করে বলে
যেন সুরবাহার , হাঁটে চলে যেন কাফি ঠুমরি
, হেসে উঠলে মনে আকাশ থেকে রাগ কলাবতী তুবড়ি হয়ে ঝরে পড়ছে । অনেকেই আবার কবিতাও লেখে ! ওহ , সে যেন
জলতরঙ্গের নয়নসুখ চাদর । নয়নসুখের কথায় মনে পড়লো নয়নের , মাঝে
মাঝে সন্ধে জমাট হলে এক নয়নসুখ জোব্বা মাথায় কলাহ পপাহ টুপি পরে কোন এক মেঘলা রঙা সুন্দরীর কাছে আসেন । তাকে দূর
থেকে দেখে নয়ন ।
নয়নের এক অকালপক্ব ইয়ার আছে । মিরাত । মিরাত
দেহল্ভি। সে বলেছিল আইন ই আকবরিতে নাকি
কাঞ্জারি বা কাঞ্চানি দের কথা লেখা আছে । নাচে গানে পারদর্শী তবায়েফরাই , আর কী !
মিরাত বলেছিল দিল্লির প্রথম গোরা সাহেব ডেভিড অক্টারলোনির নাকি এই অঞ্চলে এক
মাশুকা ছিল ।মুবারাক বেগম । তিনি একটা মসজিদও বানিয়েছিলেন ।
জামা মসজিদের কাছেই,নওঘরায়
নয়নদের ঘর । নওঘরায় জৈন রা বেশি থাকে । সোনা চাঁদির ব্যাবসা । রমরমিয়ে ব্যাবসা । ওর বাবা এরকমই এক বানিয়ার কাছে কাজ করে , হিশেব নিকেশ
রাখে । ঐ যাকে বলে মুন্সীজি।
নওঘরার হাভেলিগুলো
চমৎকার । নয়নদের অবিশ্যি অতবড় বাড়ি নয় ।
তবে জৈন দের হাভেলিগুলো দেখার মতো । সম্রাট শাহজাহান আর মেয়ে জাহানারা বেগমের
খোয়াবনামা যদি শাহজাহানাবাদের এই পাঁচিল ঘেরা শান ও শওকত হয় তবে নওঘরার ছোট্ট
মহল্লা একটা অদ্ভুত এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকা
কুঁজোর জলের মত । নিরালা । শান্ত । কী বাহারি নকশা করা দরজা । লাল হলুদ নীল
গোলাপি সাদা দিয়ে নকশা করা । অগুরু
চন্দনের গন্ধ ধুনোর গন্ধ , পুজোর ফুল
শাকাহারী জৈনদের ঘরে অড়হর ডালে তরকার গন্ধ , ঘন্ট বাজছে , প্রদীপ জ্বলছে । রামকথা
পাঠ হচ্ছে ।
নওঘড়ার নিরালা থেকে বেরিয়ে দারিবা কালানের জৌলুশ । দু ধারে সোনা চাঁদির দোকান । এই দারিবা কালানের একদিকে কিনারি বাজার ।চাঁদনি চওক আর মীনা বাজার । হুরি
পরীদের ভিড় মীনা বাজারে । বাজারের নাম তাই কুহস রুস , খুশিয়াল দিন ।
বাজারে বাজারে ঘুরে বেড়াতে নয়নের বেশ লাগে
। এতে যে কত কিসিমের আতরের মেহক , নয়ন তা
নিজেও ভালো করে জানে না । তবে
হ্যাঁ , এই রওনকের পেছনে সেই জমানার পাদশা বেগমের অবদান প্রায় পুরোটাই । এসব কিসসা
নয়ন শুনেছে গফুর মিয়াঁর কাছ থেকে । কাঠ কয়লার আঁচে ধোঁয়ায় গফুরের কালো চুলে কখন পাক ধরে গেছে নয়নকে কিসসা শোনাতে শোনাতে! আর নয়নও কখন ছোট থেকে বড় হয়ে গেলো এই মহল্লার গলি তে গলিতে ঘুরতে জানতেই পারলো না । জামা মাসজিদের সিঁড়িতে গফুর
প্রতিদিন কাবাব বিক্রি করে । খদ্দের অনেক
। টিমটিমে বাতি জ্বেলে গল্পের জাম্বিল খুলে
বসে গফুর । ঐ গল্পের গন্ধে গন্ধে একটু একটু করে তার চারপাশে ভিড় জমতে থাকে ।
খুচখাচ করে বিক্রি হতে শুরু করে কাবাব । আমি ইবনে বতুতাআআআআ এই বলে লম্বা এক হাঁক
ছাড়ে । সঙ্গে সঙ্গেই
পাঁচ ছটা লোক প্রায় দৌড়ে আসে । মাঝে
মাঝে কোতাওয়ালির লোকেরাও দাঁড়িয়ে পড়ে । নয়ন পাতায় মুড়ে মুড়ে কাবাব বাঁধতে গফুর চাচাকে
সাহায্য করে । কোতোয়ালিদের হাতে এমনই এমনই কাবাব তুলে দেয় ,পয়সা টয়সা দেয় না ওরা ।
মুটে মজুর , দোকানি , পরদেশি দেহাতির দল গল্পের মৌতাতে বুঁদ ততক্ষণে । ইবনে বতুতা
থেকে হামজানামা , হামজানামা থেকে হাতেমতাই , হাতেমতাই থেকে আলাদিন
, আলাদিন থেকে রায় পিথোরা ,কীই নেই তার ঝুলিতে । রাজা পৃথ্বী রাজ চৌহানকে অন্ধ করে
দিয়েছে মহম্মদ ঘোরী । অন্ধ রাজার হাতে তির ধনুক তুলে দিয়ে মজা দেখছে ঘোরী । রাজাকে
ঘিরে রয়েছে তার অসহায় অনুচরেরা । তারা রাজাকে নির্দেশ দিচ্ছে , চার বাঁশ , চব্বিশটি হাতি আট আঙুলের ব্যাবধান মাত্র । তির চালাও রায় পিঠোরা ।
- শাবাশ শাবাশ । আবার
গফুর আবার । আবার বল ।
-তির চালাও রায়
পিঠোরা । গফুর আবার গলা তুলে বলে ।
যুদ্ধের গল্প শুনতে
লোক খুব আমোদ পায় ।ভেতরে ভেতরে এতো
যুদ্ধবাজ লুকিয়ে আছে দেখে ভারি অবাক লাগে নয়নের । আর ফরমায়েশ করে মোহব্বতের কিসসা । মোহব্বত আর জঙ্গ
। কোথায় না জঙ্গ নেই ! মোহব্বতেও আছে ।
-আচ্ছা , গফুর চাচা
, এতো যে কাহানি বলে যাও। শিখলে কী করে ?
-শুনে শুনে বেটা
সিরফ শুনে শুনে ,।এই যেমন তুমি আমার কিসসা
শুনতে ভালোবাসো তেমনই ভাবেই , বুজুর্গ দের কাছ থেকে ।
- আরে , গফুর মিয়াঁ
, আমার কাবাবগুলো দাও , আর মোহব্বতে জঙ্গ এর কিসসা শোনাও জলদি । লোকজনেরা তাড়া লাগায় ।
-আচ্ছা আচ্ছা ,
পাদশা বেগমের দাস্তান শোনো তবে ।
-জলদি শোনাও । ঈশার
আজান শুরু হবার আগেই শেষ করো ভাই ।নইলে বিবিজানের মুখ ঝামটা খেতে হবে । তওবা ।
তওবা।
গফুর নৌটঙ্কি করে
করে পাদশা বেগমের গল্প শোনায় । রাত ঘন হতে থাকে । গফুর মিয়াঁ গল্পের রঙ চড়ায় আর নয়ন
দেখতে থাকে জামা মসজিদের ওপরে যে বাতিগুলো জ্বলছে তার থেকে একটা ছায়া পথ এঁকে
বেঁকে চলে গেছে আকাশের দিকে । সেই আশমানি তারা পথে নয়ন যেন জান্নি বেগম সাহিবাকে
দেখতে পেলো ।
চকের মধ্যিখানে একটা
বড় জলাধার , তার থেকে বেরিয়েছে ছোট ছোট খাল । চাঁদনি রাত, ঝিকমিকিয়ে
উঠবে খালের জলে, যেন বিবিজানের মাথার হিরের তাজ ।মহতাব ।
লাগানো হবে সারি সারি গাছ । তার .মধ্যে মধ্যে অর্ধচন্দ্রাকারে দোকান বসবে নানান
পশরা সাজিয়ে । শাহজাহানাবাদের সবচেয়ে বড় বাজার । চাঁদনি চক । বাদশা বেগম সাহিবা
জাহনারার স্বপ্ন । জান্নি শুধু চাঁদনি চক করেই থেমে থাকেন নি ।শাহজাহানাবাদের অনেক
সুন্দর প্রাসাদ আর স্থাপত্য তার কল্পনা থেকে জন্ম নিয়েছে । অসম্ভব সুন্দর একটা
বাগান বানিয়েছিলেন , বেগম কা বাগ । সেখানে রাজপরিবার আর বড়বড় আমির
পরিবারের মহিলা আর শিশুরা গাছপালা ফুল ঝর্নার মধ্যে হেসেখেলে বেড়াত ,ঝুলায়
দোল খেত, গান গাইত ।মেয়েদের জন্য হাতের কাজের রকমারি
জিনিশ নিয়ে মেলা বসত, পাঙ্খো কা মেলা । জামা কাপড় খাবার দাবার
শৌখিন জিনিশের রকমারি সম্ভার সাজিয়ে বসা পুরোদস্তুর মেলা শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য ।
সাহিবি নামের একটা জাহাজের পুরো নক্সা করেছিলেন জাহানারা । সেই সময়ে ভাবা যায়!
এমন নাজনিন কবি , বিদুষী , গুণবতী দিলদরাজ ও দিলনশী বেগম সাহিবা , তার প্রণয় প্রার্থী থাকবে না তাও কি হয়? বেচারা শিবা আবাদ পারভেজ পারস্য থেকে এসেছিলেন শাহজাহানের সভায় । রাজকুমারীকে এক ঝলক দেখবার জন্য বোরখা পরে ঢুকে গেলেন বেগম কা বাগে । জাহানারার রূপ মাধুরী বর্ণনা করে একখানা শায়েরিও নামিয়ে ফেলেছিলেন ,কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন খোদ বেগম সাহিবার হাতেই । তাকে কিছু সোনার মুদ্রা দিয়ে তখনই চলে যেতে বলেন জাহানারা । কিন্তু তার বাপের কানে কথাটা ঢুকতে কতক্ষণ? আর তার ফলে পারভেজ পাত্তারি গুটিয়ে আবার পারস্যে ।
প্রেমিকেরা সব লুকিয়ে চুরিয়ে আসত , মেহফিল মৌসিকি আশিকি সিরাজি সবই ছিল অফুরান ভরা পেয়ালা ।এক প্রেমিককে তো শাহজাহান বিষ মেশানো খাবার দিয়ে তার ইহলীলা সাঙ্গ করান , আরেক প্রেমিক তো ভয়ের চোটে চৌবাচ্চার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে , কিন্তু বাপের ঝানু চোখ এড়ানো অত সহজ হয়নি । জাঁদরেল আব্বু হুকুম দিলেন ফুটন্ত গরম জল ঢেলে দাও । আবার ইহলীলা সাঙ্গ । ।মেয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত কট্টর ছিলেন। তবে মদিরামোহ ছিলো বিবিসাহিবার । উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতেন না , টলে টলে পরে যেতেন । জীবনের সফেন সমুদ্র আকন্ঠ পান করতে এসেছিলেন তিনি , তাতে নানা রঙের মিশেল ছিল ,বিষাদ ছিল , প্রেম ছিল , রাজনীতি ছিল , ছিল দরিয়ার মতো হৃদয় ,আকাশের মতো ব্যাপ্ত ঔদার্য ।
সে যাই হোক , এরকমই এক প্রেমিকের সঙ্গে ছদ্মবেশে ঘুরছিলেন বেগম সাহিবা । পর্যটকদের , ভিনদেশীদের এই শহরে থাকা খাওয়ার হাল হকিকত খানিকটা মালুম হল তার । জাহানারা যাই করেছেন সারা জীবনে, সকলের ভালোর জন্যই করেছেন । গড়ে উঠল সরাইখানা , জাহানারা সরাই । এমন ভাবেই তৈরি করেছিলেন অনেক মাদ্রাসা , চালচুলোহীন লোকদের জন্য আশ্রয় । জান্নির বেইনতাহা ইশক আর মোহব্বতের ছায়ার তলায় ছিল অনেক অনেক মানুষ ।
এমন নাজনিন কবি , বিদুষী , গুণবতী দিলদরাজ ও দিলনশী বেগম সাহিবা , তার প্রণয় প্রার্থী থাকবে না তাও কি হয়? বেচারা শিবা আবাদ পারভেজ পারস্য থেকে এসেছিলেন শাহজাহানের সভায় । রাজকুমারীকে এক ঝলক দেখবার জন্য বোরখা পরে ঢুকে গেলেন বেগম কা বাগে । জাহানারার রূপ মাধুরী বর্ণনা করে একখানা শায়েরিও নামিয়ে ফেলেছিলেন ,কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন খোদ বেগম সাহিবার হাতেই । তাকে কিছু সোনার মুদ্রা দিয়ে তখনই চলে যেতে বলেন জাহানারা । কিন্তু তার বাপের কানে কথাটা ঢুকতে কতক্ষণ? আর তার ফলে পারভেজ পাত্তারি গুটিয়ে আবার পারস্যে ।
প্রেমিকেরা সব লুকিয়ে চুরিয়ে আসত , মেহফিল মৌসিকি আশিকি সিরাজি সবই ছিল অফুরান ভরা পেয়ালা ।এক প্রেমিককে তো শাহজাহান বিষ মেশানো খাবার দিয়ে তার ইহলীলা সাঙ্গ করান , আরেক প্রেমিক তো ভয়ের চোটে চৌবাচ্চার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে , কিন্তু বাপের ঝানু চোখ এড়ানো অত সহজ হয়নি । জাঁদরেল আব্বু হুকুম দিলেন ফুটন্ত গরম জল ঢেলে দাও । আবার ইহলীলা সাঙ্গ । ।মেয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত কট্টর ছিলেন। তবে মদিরামোহ ছিলো বিবিসাহিবার । উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারতেন না , টলে টলে পরে যেতেন । জীবনের সফেন সমুদ্র আকন্ঠ পান করতে এসেছিলেন তিনি , তাতে নানা রঙের মিশেল ছিল ,বিষাদ ছিল , প্রেম ছিল , রাজনীতি ছিল , ছিল দরিয়ার মতো হৃদয় ,আকাশের মতো ব্যাপ্ত ঔদার্য ।
সে যাই হোক , এরকমই এক প্রেমিকের সঙ্গে ছদ্মবেশে ঘুরছিলেন বেগম সাহিবা । পর্যটকদের , ভিনদেশীদের এই শহরে থাকা খাওয়ার হাল হকিকত খানিকটা মালুম হল তার । জাহানারা যাই করেছেন সারা জীবনে, সকলের ভালোর জন্যই করেছেন । গড়ে উঠল সরাইখানা , জাহানারা সরাই । এমন ভাবেই তৈরি করেছিলেন অনেক মাদ্রাসা , চালচুলোহীন লোকদের জন্য আশ্রয় । জান্নির বেইনতাহা ইশক আর মোহব্বতের ছায়ার তলায় ছিল অনেক অনেক মানুষ ।
মুঘল শাহজাদিরা অনেকেই
শায়েরা ছিলেন । জেব উন্নিসা , জীবনের বেশির ভাগ সময় সেলিমগড় দুর্গে বন্দী ছিলেন ।
সেই বন্দী দশাতেও
কবিতা লিখেছেন ।
কেন জানিনা জাহানারা
বেগমের কথা ভাবতে ভাবতে নয়নের সেই পারিজাত
মেয়েটির মুখ মনে পড়ছিল । ও কি জানে জান্নি বেগমের গল্প ? নয়ন মনে মনে বলে , কিল্লা লালকোটের জঙ্গলে জোনাকির মধ্যে বসে একদিন
আমি ওকে সেই গল্প শোনাবো ।
ঈশক পর জোর নহী, হ্যাঁয় ইয়ে উয়ো আতশ গালিব
কে লগায়ে নও লাগে আউর
বুঝায়ে ন বনে ।
ভালোবাসায় জোর
চলেনা এ সেই আগুন,গালিব্
যা লাগালে লাগে না,
নেভালে নেভে না।
নয়নসুখ চাদর পরা সেই
শায়র নয়নকে আর সুখে থাকতে দিল কই ?
শায়েরি লেখার নেশা কখন
মাথায় চেপেছিল , নয়নের মনে নেই । নয়নের এক দোস্ত আছে মিরাত
দেহল্ভি । নয়নকে সে টেনে নিয়ে যায় অনেক মুশায়েরায়
। লোকে যে যাই বলুক , ঐ নয়নসুখের চাদর নয়নের মন
জুড়ে বসে থাকে । কাছা কাছি যাবার সাহস কোনো দিন হয় নি তার ।
বল্লিমারো বহল্লার গলি
কাসিম জানে বাড়ির সামনে বসে তিনি চওসর খেলেন , ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে । কতদিন পা
ঘষটে ঘষটে হেঁটে গেছে নয়ন । সাহস
হয় নি সামনে গিয়ে কথা বলার ।
কী সুপুরুষ । মেয়েরা
ফিদা হবে নাই বা ওকেন ।
“পিছে বন্ধ হ্যাঁয় হাথ
অউর শর্ত হ্যায় সফর কি
ম্যায় ক্যায়সে কহু কে পাওকে কাঁটা নিকল দো “
আমার হাত যে পিছমোড়া
করে বাঁধা , তুমি দিলে সখী দূরান্তরের ডাক
পায়ে যে কাঁটা বিঁধে
আছে অবিরত , কেমন করে তুলবে তাকে আজ ?
আহাহাহাহা, কী লিখেছিস
নয়ন , যা যা মির্জা সাহাবকে দেখিয়ে আয় । মিরাত দেহল্ভি বলতেই থাকে ।
-কী যা তা বলছিস । ওনাকে দেখলেই আমার বুক ধুকপুক করে !
কিছুদিন আগেই ইন্তে
কাল হয়েছে গালিবের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মোহম্মদ জওক সাহেবের ।
এই ভাবেই ঢিমেতালে
গড়িয়ে চলে দিল্লির জীবন । বাদশা
সলামত নামেই বাদশা । আসলে ফিরঙ্গিদের হাতের পুতুল ।
তাতে কী খুব কিছু যায়
আসে তাঁর ?
মেহরাউলির জাফর মহলে
এই গরমের সময়টা কাটান বাদশা বাহাদুর শাহ জাফর । কবিতা লেখেন , গজল শোনেন । আফিম
খান । বুড়ো হয়েছেন । তাকে ফিরঙ্গিরা যেমন
চালায় , তেমন চলেন ।
বাহাদুর
শাহ জাফর , মেহরাউলিতে জাফরমহল বানিয়েছিলেন । তখন আলোর রোশনাই কমে এসেছে , আতরের
খুশবু ফিকে হয়েছে , রঙের জেল্লা গেছে । একেই
অপদার্থ, বেচারা কবি মানুষ। ফিরঙ্গিরা তো সব লুটে নিয়ে গেলো ।বাহাদুর শাহ গরম কালে
জাফরমহলে মেহরাউলির সবুজের মধ্যে প্রাণ জুড়োতে আসতেন । এই
মেহরাউলিতেই আছে কুলিখানের সমাধি । কুলি খান তেমন কোন মনে রাখার মতো চরিত্র নয় ।
কিন্তু কুলিখানের মা ছিলেন ভয়ানক জাঁদরেল । আকবরের ধাই মা । মাহাম আনঘা । তার এক
ছেলে হল এই কুলি খান । ইতিহাসে উপেক্ষিত হলেও তার গোরস্থানটি কিন্তু
খাসা । আটকোনা ছিমছাম , বড় সুন্দর । ভেতরে চমৎকার কারুকাজ । চত্বর থেকে দেখা যায়
কুতুব মিনার ।
মুঘল
দরবারের শেষ ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ছিলেন টমাস মেটকাফ । সব লুটে পুটে খেয়ে খুব
আরামে গা ভাসিয়ে থাকতেন । তিনি এবার করলেন কি কুলিখানের সমাধিটাকে বেশ খানিক মেজে
ঘসে সেখানে একটা আয়েশ আরামের জায়গা বানিয়ে
ফেললেন । । চারদিকে প্রচুর গাছপালা লাগানো হল । লোদি আমলে বানানো একটা মান্ধাতা তালাও
কে নৌকাবিহারের কাজে লাগিয়ে দিলেন ।ব্যাবসা বুদ্ধি বলে কথা! মনের
মতো করে পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে নাম দিলেন “দিলখুশা” । কুলি খানের মকবারার ওপর
দিলখুশায় শুরু হল সাহেবি মোচ্ছবের ঢালাও কারবার । তার ওপর আবার নব
বিবাহিতদের মধুচন্দ্রিমা যাপনও শুরু হয়ে
গেলো । মেটকাফ আসলে দিলখুশা কে ভাড়া দিতেন মধুচন্দ্রিমা
করার জন্য । একের পর এক নতুন বরবউ হাতে
হাত দিয়ে কুলিখানের হাড়গোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে শরাবের বোতল খুলে ফোয়ারা ছোটাচ্ছে ,
ভেতরে সাঁঝবাতির নরম আলো। বাইরে ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে মস্ত বড় চাঁদ
উঠেছে কুতুব মিনারের পেছনে। মকবারা
ভাড়া খাটিয়ে পকেটে আসছে দেদার চাঁদি ।
মেহফিল আর মুশায়েরার
শামদানি সন্ধ্যা , আমপান্নার সরবতি মেজাজ , দিলনশীর বানোদের ঠুমরি আর দাদরার মধ্যেই দিল্লি চলত গড়িয়ে গড়িয়ে । আর ছিল সাধারণ মানুষের একঘেয়ে সালতামামি ।
গোরা সেনা খটখট ঘোড়া হাঁকিয়ে লাহোরি দরওয়াজা থেকে ফাতেপুরি মসজিদ
পর্যন্ত রাস্তা টহল দিত ।
ঘরের খেয়ে বনের মোষ
তাড়ানোই যখন নয়নের কাজ তাই ফুরসত কে রাত
দিন খোঁজার দরকার তার হতো না ।
সেদিন রাতে খেতে
বসেছেন বাবা । মা বানিয়ে দিচ্ছে গরম গরম রুটি , ঘি মাখানো । একটু মুলির আচার ,
মাখো মাখো অড়হর ডাল । নয়ন খেতে বসবে মায়ের সঙ্গে । জৈন মন্দিরের ঠকুরমশাই ঘটাং করে
দরজায় শেকল তুলবেন, ঠিক তখন ।
নয়নের বাবা বললেন ,
দিনকাল যে কোনদিকে যাচ্ছে , বুঝছি না । শুনছি পূরবি লোকেরা নাকি কী সব ঝামেলা পাকাচ্ছে
। ব্যাপারীরা বলছিল । ওরাও ঠিক জানেনা কি হচ্ছে তবে শুনছি নাকি গোরা সেনাদের সঙ্গে
কী সব ঝামেলা হচ্ছে । ব্যাবসার কাজে আসা পুব মুলুকের লোকজনেরা বলাবলি
করছিল ।
- আদার ব্যাপারীর আর
জাহাজের খোঁজের দরকার কি ? সামনের জন্মাষ্টমীতে কানাহাইয়াকে রুপোর নূপুর দেব , আগে
ভাগে বলে রাখলাম । এই বলে নয়নের মা একের
পর এক গোল গোল নিখুঁত গমের রুটি বেলতে থাকে , গরম আঁচে ফুলে ফুলে ঢোল সেই রুটির
আগুন জ্বলা সেঁকো গন্ধে ঘি এর ছটাক মাখা আমোদে নয়নের চোখ ঢুলে আসে ।
রাত গভীর হয় । নয়ন খোলা খিড়কির পাশে চারপাইতে শুয়ে ভাবতে থাকে মিরাত তাকে নানহা ই সফেদ রুটির গল্প বলবে বলেছে । নিমাতনামা
নামে এক আশ্চর্য কিতাবের গল্পও বলবে । নয়ন তার থেকে কিছু কিছু কিসসা গফুর চাচাকে বলবো । বেচারি এক হাতেমতাই আর
হামজানামা বলে বলে আর কতদিন বলবে ?
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে
নয়ন , পারিজাত আর সে, কিলা লালকোটের ঘন জঙ্গলে হেঁটে চলেছে । মাথার
ওপর নিকশ কালো আকাশ । এক ঝাঁক জোনাকি সামনে সামনে চলেছে পথ দেখিয়ে ।
সেই জোনাক জ্বলা পথ
যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে
এক অপরূপ নক্ষত্র বীথি । সে পথ গেছে কোথায় , কে জানে !
“ নয়ন যা বাবা , তোর পিতাজি দোকানে বেরিয়ে গেছে , এই কয়েকটা রসুই
ঘরের জিনিস এনে দে বাবা , তাড়াতাড়ি ফিরিস । আবার কারুর সঙ্গে কোথাও চলে যাস না যেন
“
মান্ডিতে সামন্যই কাজ
ছিল নয়নের , মায়ের ফরমায়েশ মতো । ভাবছিল,
মিরাতের সঙ্গে দেখা করতেই হবে । ভাবছিল, - নানহা
ই সফেদ রুটি খাবে কী দিয়ে ? সোহান হালুয়া দিয়ে ? ও তো গালিব সাহাবের প্রিয় খাবার ।সোহন হালুয়া , ভুনা
গোস্ত আর আম । সেই আম আসতে এখনো দেরি আছে ।
এই ভাবতে ভাবতে কিনারি
বাজারের গিরধারীমলের দোকানে সামোসা কিনলো । সম্বুসা
। কত পথ পাড়ি দিয়ে তুমি এদেশে এসেছ সম্বুসা !
-এই বাচ্চা , সামোসা
নিয়ে আবার শায়েরি করতে বস না , ঠাণ্ডা হবার আগে খেয়ে ফেলো শায়ের সাহাব ।
ছোট্ট বেলা থেকে এক
জায়গায় থাকার এই এক ঝামেলা । সবাই সব্বাইকে চেনে , জানে, তেওহার পরব পালন করে ।
খুশি ভাগ করে নেয় । দুঃখে পাশে এসে দাঁড়ায় ।
সকাল থেকেই বাজারে ভিড়
উপচে পড়ছে । এসেছে হরেক সবজি , এসেছে তরমুজ , কাঁচা আম ফুটি ,। উপুড় হয়ে আছে
বাতাসা , মঠ, তিলের মিঠাই । বেদানা ,খেজুর , কিশমিশ্ আখরোট । এখন রমজানের মাস । রোজার মাস । সন্ধে বেলা গফুর
মিয়াঁর কাবাব হুহু করে শেষ হয়ে যাবে ।
হঠাত শনশন বেগে কেউ
একজন ছুটে এলো ।ছুটছে , ছুটছে , ছুটছে , কী দ্রুত ।দোকান বাজার ভিড় ভাট্টা ঠেলে
ঠুলে লাট্টুর মত, উড়ন্ত তুবড়ির মতো একটা মানুষ ছুটছে ।
ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে
যাবার আগে, নয়নের দৃষ্টির বাইরে যাবার আগে নয়ন চকিতে দেখতে পেল , এক গোছা রুটি ওর জামার কোঁচড় থেকে মাটিতে পড়ে গেলো । কাল রাতে সেই নয়নের মায়ের হাতের বানানো রুটি মতো গোল গোল , নিটোল , মিরাতের নানহা ই সফেদ । বাজারে তুমুল সোরগোল উঠলো । সব্বাই
হকচকিয়ে গেছে ।
- আরে আরে একী ? এ ই
লোকটা কে ? এই গোছা গোছা রুটি কোত্থেকে এলো ? কেনই বা এলো?
এদিকে নয়ন শুনতে পেলো মুয়াজ্জাম বলছে গিরধারীমল কে ।
- আজই শুনলাম
কোতোয়ালিতে কে বা কারা এক তাল রুটি রেখে গেছে ! কাশ্মিরি ফটকের দিকে এই নিয়ে তো দারুণ হইচই ।
-আরে ! তাই নাকি !
তাজ্জব কি বাত !
নয়নের মাথায় উঠল বাড়ি ফেরা । মাকে রসুইঘরের জিনিশ
পৌঁছে দেওয়ার কথা শিকেয় তুলে নয়ন কাশ্মিরি গেটের দিকে ছুটলো ।
কালকেই বাবার মুখ থেকে কী সব
হুজুগ গণ্ডগোলের কথা শুনছিল , রান্নাঘরে বসে ।
গরম একটু একটু করে
বাড়ছে । এখনই গলা শুকিয়ে আসছে কেমন ।
পীপল গাছের শুকনো পাতা সর সর করে গরম হাওয়ায়
মাটিতে ঘসা খেয়ে খেয়ে ছোট্ট ছোট্ট ঘূর্ণি তুলছে । রোদের গন্ধ, বাতাসের গন্ধ , মাটির গন্ধ যেন কেমন বদলে বদলে যাচ্ছে । নয়ন বেশ বুঝতে পারছে । পিঁপড়ে
যেমন টের পায় কখন বৃষ্টি হবে , সেরকম কোনো এক আগাম ঝড়ের আভাস নয়নের মনে ধরা পড়লো ।
ঘূর্ণির মধ্যে, পাতার শরশরানির মধ্যে নয়ন যেন শুনতে পেলো - পূরবিরা আসছে পূরবিরা আসছে
পূরবিরা আসছে ।
হিন্দি/উরদু কবিতা –
মির্জা গালিব । আসিফ খান দেহল্ভি