Thursday 21 May 2015

রৌদ্রের ভিতরে চিঠি



বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল ...
সত্যি এতো রোদ্দুর ! একেবারে চোখ ঝলসানো । আর আমার প্রাণের ওপর বয়ে গেল অকাল বসন্তের রোদ মাখা মুচমুচে ঠান্ডা  বাতাস । আর কিছুদিন পরেই শীতকাল । তখনো সূর্যের আলো একই রকম ঝলসানো থাকবে । হয়ত একটু আধটু বৃষ্টি নামবে । এখানকার জলবায়ু যে মে-ডি- টে-রা-নি-য়া-ন আর ক্যালিফোরনিয়ান , মানে ঝলমলে গরম আর ভেজা ভেজা নরম শীত । এই শহরকে   ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি , কালিঝুলি ছাইরঙা  উঝুল আকাশ , কনকনে ঠান্ডা আর শনশনে হাওয়ার   খামখেয়ালিপনা খুব একটা  সইতে হয় না । ভারত মহাসাগরের ধারে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ । লোকে বলে আলোর শহর । অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশি আলো মাখা শহর । আর বিশ্বে তিন নম্বর, শিকাগো আর অকল্যান্ডের পর ।  সূর্যদেব তার রোশনিভরা কলসী খানা তেরছা করে পার্থের মাথার ওপর সেই যে ঢালতে শুরু করেছেন  তা আর থামানো যাচ্ছে না । এই উজালা শহরে এসেছি দুদন্ড জিরোতে নয় , ধান ভানতে । বেরসিক কাজে,দুই সঙ্গীকে নিয়ে ।

ভারতীয় দূতাবাস সব প্রায় একই রকম । ছাঁচে ঢালাই । অফিসে এসে  দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লে সেই  মানুষ সমান নটরাজ , নাচ আর থামছেই না ,অথবা কৃষ্ণ ঠাকুর বাঁশি বাজিয়ে চলেছে অথবা সিদ্ধি বিনায়কের মোদক  খাওয়ার বিরাম নেই ।  দেওয়ালে  কাংড়া বা পাহাড়ি  আর্ট , বা অতুল্য ভারতের নানান পর্যটন ছবি , কোনায় কানায় ইতিউতি পেতল কাঠ,পাথর বা অন্য ধাতুর  মালা হাতে যক্ষিণী , অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের আধবোজা চোখে মিটিমিটি হাসি ,মঞ্জুশ্রী, তারা এনাদের সব নানান বিভঙ্গের শো পিস,পেতলের লম্বা প্রদীপ ,একেবারে স্টিরিওটাইপ  ।পা এর তলার কাশ্মিরি গালচে । বুটিক অফিস,বুটিক অফিস ।  সোনালি রোদ মেখে সেখানে ঢুকে দেখলাম কনফারেন্স রুমের মত একটা বড় হল ঘরে রাশি রাশি  ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা গোছের ফাইলপত্তর  আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ।

এই যে আসুন ,এখানে বসুন । আমি আমার বরাদ্দ ঘরে বসলাম । সে ঘর থেকে বাইরেটা দেখা যায় না । ধীরে সুস্থে বসে অভ্যস্ত গলায় একটা হাঁক , “জিতেন্দর , একটা ব্ল্যাক টি ...” বলেই নিজেকে সামলে নিলাম। আরে, এটা তো আমার নিজের অফিস নয় দূতাবাসের  ভারতীয় কর্মীরা তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মনের  আলো আঁধারি অলিগলিতে মজ্জায় মেজাজে  মর্জিতে একটা পুরো ভারতবর্ষ নিয়ে ঘোরাফেরা করেন  । তারা কিচ্ছুটি দেশে ফেলে আসেন না ।কিন্তু এ দেশে  মানুষের শ্রম বড়ই বেশি মহার্ঘ । কাজেই  ওরে চা দে  জল দে তামুক সাজ  গোছের বিলাসিতা এখানে করা নিতান্তই অবাস্তবকাজেই পরিচ্ছন্ন প্যান্ট্রি তে নিজে চা কফি বানিয়ে খাও । সেই চা বানাতে গিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই চোখে লাগল তীব্র নীল । আকাশ এতো নীল , কি ভীষণ নীল । আর আকাশের নীলের তলায় বয়ে যাচ্ছে গভীর নীলরঙা  নদী ।  সোয়ান নদী । দুই নীলের কোথায় শুরু কোথায় শেষ বোঝা যায় না । সোনালি আলো আর নীলো রঙে মিশে সে এক অদ্ভুত ছবি ,জানালার বাইরে । আমার চা বানাতে দেরি হয়ে গেল ।





পার্থ শহরকে মনে ধরে যাবার কতগুলো খুব ব্যক্তিগত কারণ আছে । যদিও এয়ার পোর্টে  কুকুর দিয়ে পরীক্ষা  করাটা খুব অপমানজনক মনে হচ্ছিল । আমাকে অবশ্য দূতাবাস প্রধান বললেন এরা এরকমই করে । আপনি যে লিখে দিয়েছেন আপনার সাথে জুতো আছে , ওষুধ আছে ,মায় লবঙ্গ মৌরিটাও বাদ দেন নি, তাই এই হুজ্জুতি ।জানেন আমার দুঃখের কথা? বাংলাদেশ থেকে অত সুন্দর বেতের ফুলদানি স্ট্যান্ডটা ওরা উপহার দিল ,আমার খুব সখের বুঝলেন, জাহাজে করে মাল পত্তর এসে যাবার পর দেখি বাক্স প্যাঁটরা হাটকে খুলে ওই ফুলদানিটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল । কারণ কি ?  নাকি কোয়ারান্টাইন জারি হয়েছে । বিজাতীয় বিদেশী ভিলেন পোকা মাকড় বা কোন রোগ ওদের জল বাতাস উদ্ভিদ প্রাণী সবাইকে নাকি   বিপদে ফেলে দেবে ।  আমি ডিক্লেয়ার করেছিলাম, বেত মানে এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্ট সঙ্গে আছে । ব্যাস, জ্বালিয়ে তো দিলই, খরচটাও আমাকে দিতে হল । এরকমই এদের নিয়ম কানুন ।আবার বাসমতি চাল এনেছিল একজন । আনারই বা কি দরকার? এখানে সবই পাওয়া যায় । কতদিন জাহাজে ভাসতে ভাসতে সেই চালে লেগেছে পোকা । বেশ খানিকটা ডলার গচ্চা দিয়ে সেই অন্ন ধ্বংস করা হল ।
বাগবাজারের ব্যানারজিবাবুরও একই রকম দুখ ভরা কহানি । হাতিবাগান  থেকে দরদাম করে পঞ্চাশটাকার ফুলঝাড়ু পঁয়ত্রিশ টাকায় কিনে মাল পত্র জাহাজে তুলে দিলেন । এদেশে আসার পর ওরা খুঁটিয়ে   খুঁটিয়ে দেখল ফুলঝাড়ুর ডাঁটি টা কেঠো কেঠো লাগতিসে । বলল ,জ্বালিয়ে দেব । আশি ডলার দাম দাও,জ্বালানি খরচ। ব্যানারজি খাবি খেয়ে বলে একি জুলুম নাকি ! আমি এদেশে অমন সরেস ফুলঝাড়ু  পাই কোথায় ? পঁয়ত্রিশ টাকার ফুলঝাড়ু জ্বালাবার  জন্য চার হাজার টাকা গচ্চা দেব?
 রাখতে চাও ? তবে তিনশ চল্লিশ ডলার দাও।দায়িত্ব কিন্তু তোমার ।

ভাই রে ভাই , দুঃখে পরান জ্বলে ,এই হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকা ছাগলে...


পার্থ কে মনে ধরার কারণ হচ্ছে, এই শহরটা আর পাঁচটা ব্যস্ত শহরের মত নয় । সবাই ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে ,সময় নেই সময় নেই , লন্ডন প্যারিস নিউ ইয়র্ক দিল্লি মুম্বাই কলকাতা ।  এখানে সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট (সিবিডি)বা সিটিসেন্টার এলাকায় সব বড় বড় অফিস ব্যাঙ্ক মাইনিং কোম্পানি বহাল তবিয়তে আছে ।  কিন্তু কোন হাঁক ডাক ছুটোছুটি ব্যাস্ততা নেই । হতে পারে এখানকার লোকসংখ্যা খুব কম । কাজের দিনেও মনে হয় যেন বাংলা বন্ধ ডাকা হয়েছে । কিন্তু পথঘাটে যাদেরই দেখেছি কোথাও ছটফটানির ছায়ামাত্র দেখতে পাই নি ।এই গদাই লস্করি ভাবটা বেশ আমার মনের মত । সবাই টুকুস টুকুস করে হাঁটছে , হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছে , গল্প করতে করতে কফি খাচ্ছে ,  বেলা পড়ে এলে সোয়ান নদীর ধার ঘেঁসে দৌড়াচ্ছে, সবুজ মাঠে ফুটবল খেলছে , বাঁই বাঁই সাইকেল চালাচ্ছে । কুকুর নিয়ে দাদু দিদুর দল, দিনের শেষ আলো মেখে নিয়ে বাড়ি ফিরছে । মুখ খানা তৃপ্তিমাখা  । ভারি মনের মত । ঠিক কি ভুল জানিনা সকলের চাল চলনের মধ্যে বেশ একটা হাত পা ছড়ানো ছুটি কাটানোর ভাব । এই ছুটি ছুটি উড়ো উড়ো ভাব টা এখানকার ঝিলিমিলি রোদ্দুর আর নীল জলের অবদান মনে হয় । অভিজাত  ,আয়েসি এবং হুল্লোড়ে  ।  বড় সুন্দর খোলামেলা  আলো বাতাস, সবাই এখানে স্বাভাবিক ভাবে বাইরেই বেশি সময় কাটাতে ভালবাসে  । আবার দূতাবাস প্রধান বলেন “আপনার এসব মনে হচ্ছে বটে, এরা কিন্তু কাজের ব্যাপারে খুব সেয়ানা, মাইনিং বিজনেসের রমরমা, বিশেষ করে সোনার খনি । গোল্ড । সাইটে গিয়ে দেখুন কেমন জোরদার কাজ হচ্ছে। তবে পয়সা কড়ির ব্যাপারে এরা একেবারে ওয়ান পাইস ফাদার মাদার ।“ মনে মনে  ভাবি সে আর বলতে? জিন যাবে কোথায়? তবে মোটের ওপর আমার মনে হয়েছে পার্থ যেন মাঝ বয়সের ভর ভরন্ত গিন্নি । রূপ আছে , তবে তার আদিখ্যেতা বা বাড়াবাড়ি নেই ।অকারণ হাঁক ডাকে ব্যস্ততার ভান নেই । সারাদিনের কাজ তার গুছোনো । হঠাৎ করে আমার  মত  অতিথি দেখলে মাথার ঘোমটাটি টেনে বলে বসে “ও দিদি ওই দাওয়াতে চাটাই পেতে একটু বসুন,মুখ খানা যে একদম তেতে গেছে , কালো গাই এর দুধ জামবাটি ভরে এনে দি,আপনি দুটি মুড়ি নারকোল নাড়ু দিয়ে খেয়ে জারুল গাছের ছায়ার তলা দিয়ে আল পথ ধরে ফিরে যাবেন খন “।

জবা রঙ্গন কাঠগোলাপের ছড়াছড়ি


                                                                           গেরস্থ গিন্নির বাড়ি




বাসলটন জেটি ।সমুদ্রের বুক চিরে প্রায় দু কিলোমিটার চলে গেছে এই জেটি । দক্ষিণ গোলার্ধের সব চেয়ে লম্বা কাঠের   জেটি ।  নরম  রোদ্দুরেরে আলোয় ভিজতে ভিজতে আকাশ আর সমুদ্রের নীল মাখতে মাখতে ছুটির দিনে বাসলটন জেটির সঙ্গে আলাপ করতে এলাম । যে কোন  সাধারণ সুন্দর জায়গাকে সুন্দরতম কী করে বানানো যায় সে টা আমাদের বার বার  যেন নতুন করে শিখতে হয় । নইলে আমাদের দেশে সুন্দর জায়গার তো কখনো কমতি পড়ে নাই । ওরা এমন ভাবে সব কিছু বানায় এবং লেখে যেন ভূবিশ্বে এর চেয়ে ভাল জায়গা হতেই পারে না । 






বাসল্টনের দুই খুদে



  সেই কাঠের জেটির ওপর দিয়ে চলছি । এখন রোদ আর মোটেই আদর করছে না , চিড়বিড় করছে , চিমটি কাটছে ,রোদ চশমা ছাড়া চলে না মোটেই ।



নীল  টারকোয়েজ  আর ময়ূরকন্ঠী   সমুদ্রের জল জেটির তলায় ছলাৎছল । দুদ্দাড় করে ছুটে এল এক পাল কুচোর দল । ছেলেমেয়ে মেশানো । দশ বারো বছরের বেশি কেউই নয় । “তোমরা কি জলে নামবে”? হ্যাঁ নামতেও পারি । দার্শনিক ভাবে উদাস উত্তর ছুঁড়ে দেয় সোনালিচুল । জেটির গা বেয়ে সরু খাড়াই সিঁড়ি নেমে গেছে সমুদ্রে । চার পাশে কোন বাবা মায়ের টিকি দেখা যাচ্ছে না । তরতর নেমে গেল মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে  ,  মৎস্যকন্যার মত, নীল জলে সোনালিচুল । একে একে সব্বাই ।ঝপাং ঝপাং জলে । ছোট থাকতেই জলের সঙ্গে ভাব পাতিয়ে থাকতে শিখিয়েছে বাবা মা ।নইলে বাসলটনকে , এই নোনা জলকে ভালবাসবে কেমন করে?







ওদিকে শুরু হয়েছে আরেক হুল্লোড় । ছিপখান তিন দাঁড় ছয়জন মাল্লা চৌপর দিনভর দেয় দূর পাল্লা । বাইচ খেলা । জোর কম্পিটিশন চলছে । শক্ত হাতে  দাঁড় বাইছে ,এগিয়ে চলেছে মেয়ে মাল্লা , ছেলেদের সঙ্গে সমান টক্কর দিয়ে । চারদিক থেকে জোর উৎসাহ ।নীল সাগরের ঢেউ এ রাজহাঁসের মত তরতরিয়ে চলছে সাদা , লাল, নীল নৌকো । সেই খেলা দেখলাম কিছুসময় ।





দলে দলে আসছে মাছুড়ের দল । ছিপ হাতে । ঢেউ খেলানো বড় টুপি । রোদে মুখ পুড়ে ঝামা । কখনো পুরো পরিবার । বাবা মা ছেলে তিন খানা ছিপ হাতে হনহনিয়ে চলছে । সি গাল পাখির উড়োউড়ি , হুড়োহুড়ি,চিৎকার । মাছ ধরা পড়ছে । এবার সেই মাছ মাপা হবে । বাসলটন জেটির মধ্যেই নানান জায়গায় মাছ মাপবার স্কেল লাগানো আছে । মাছ ছোট হলে মনে হয় জলে ছেড়ে দিতে হবে । সেই ধরা মাছ কেটে কুটে সাফ করে নুন তেল মাখিয়ে গ্রিল করে খাবার ব্যাবস্থাও করা আছে । সেঁকা মাছ, কোক পেপসি বিয়ার দিয়ে খেয়ে উইকেন্ড লাঞ্চ সারে অনেক পরিবার ।বাসল টন,পার্থ এই সব জায়গার উইকেন্ড আমোদ হল মাছ ধরা, বাইচ খেলা , রোয়িং ,সাঁতার কাটা ,জল আর মাছ নিয়ে যতো রাজ্যের কারবার । আমাদের বাড়িতে যেমন সাইকেল,স্কুটার থাকে তেমনি এদের থাকে  নানান  মোটর বোট ,স্পিড বোট  । নৌকো ,স্পিড বোট গাড়ির মাথায় বেঁধে বেরিয়ে পড়ে , নীল জলের সঙ্গে দিনভর আশনাই সেরে দিনের শেষে ঘরমুখো ।

আরেক রকমের মাছুড়েদের গল্প শুনিয়েছিল দূতাবাসের একটি অল্প বয়সী ছেলে । তার প্রথম পোস্টিং ছিল ভ্লাডিভোস্টক । সেখানে  শীতকালে সমুদ্রের জল জমে বরফ হয়ে থাকে । সেই বরফের ওপর দিয়ে গাড়িও চালানো যায় । ছেলেটি বলছিল , জানেন,  কি মজার ব্যাপার ? ওই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় অনেকে বরফের মধ্যে মাথার টাকের সাইজের একটা গর্ত করত । তারপর বরফের ওপর চেয়ার পেতে বসে সেই গর্তের মধ্যে ছিপ ফেলে মাছ ধরত । সেই মাছ কেটে  পোর্টেবল চুলায় সেঁকে ওইখানে বসে বসেই হি হি হাওয়ার মধ্যে ওরা খেয়ে নিত। তাতে নাকি দারুণ মজা ।

জেটির মাঝ বরাবর রেল লাইন পাতা । দু কিলোমিটার রাস্তা , ছোট্ট লাল টয় ট্রেন দুদিকে সমুদ্দুরকে পাশে রেখে আসা যাওয়া করছে । ফানলাভিং লোকজনদের নিয়ে ।



জেটি ,নোনা জল , স্বপ্নের মত নীল রঙ  আর লোকজনের আনন্দ কলতান দেখে একটা দিন শেষ করে  মান্ডুরার লেকে  বিকেলের স্নিগ্ধ আলো জলের ওপর "একমাইল শান্তি কল্যাণ" হয়ে আছে দেখতে পেলাম ।

মান্ডুরা






সূর্য দেব আলো ঢালছেন বটে এদিকে হয়েছে আরেক ফ্যাসাদ । অ্যান্টার্কটিকার দূরত্ব কিন্তু বেশি নয় । তার ওজোন স্তর পাতলা হয়ে গেছে । রোদ্দুরে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি এত বেড়ে গেছে । সূর্য স্নাত শহর তো হল কিন্তু তার হ্যাপা তো কম নয়। ভাল সানগ্লাস কেনো , মাথা ঢাকো , মুখে হাতে সান ব্লক ক্রিম লোশন লাগাও । এছাড়া বাড়ছে স্কিন ক্যান্সার । সাধে কি বলেছে সর্বম অত্যন্ত গর্হিতম । কোনকিছুরই বেশি বাড়াবাড়ি ভাল নয়, রোদ্দুরেরও না ।এইসব লিখে চলেছি আর ভাবছি , আমি তো ঠিক ট্যুরিস্ট নই , ভ্রমণে তো আসিনি । সেখানে অনেক স্বাধীনতা অনেক অবসর অনেক অনেক বর্ণনা।  এসেছি কাজে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেড়াবার  তেমন সুযোগ কই?  এই শহর তার মেজাজ আর মানুষ জনকেই বেশি করে দেখছি ।সব তো পাঁচটা বাজতে না বাজতেই শুনশান ।সেই শনি রোববারের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকো ।সেই রকম একটি শনিরবির ঘুরে বেড়ানোর কয়েকটা টুকরো, শহর আর শহরের বাইরের













কোটস্লো সমুদ্রবেলা








ফ্রিম্যান্টল পোর্ট 




ফ্রিম্যান্টল  পোর্ট


রোদে জলে নীলে




দোয়াত ভরা সবুজ কালি




পার্থ মিন্ট





 বেড়াতে  বেড়াতে খিদে পায় । খাবারের সন্ধানে ঘুরে দেখেছি ভারতসন্তানের দল রেস্তোরাঁ ব্যাবসা ভালই চালাচ্ছেন । বালতি ,কড়াই, রেড চিলি , গ্রিন চিলি এইসব নামের দোকানগুলো সবই তাদের একচেটে । একটা নিঝুম  দোকানে আমাদের সামনে তখন মেনুকারড এসে গেছে ।


 মেনু দেখে টান টান হয়ে বসি । ক্যাঙ্গারুর ভিন্দালু ? তাতে আবার আলু দেওয়া ? সেকি ক্যাঙ্গারু এদের জাতীয় প্রাণী , সরকারি মোহরে তার ছবি , তার উড়ন্ত ভঙ্গি উড়োজাহাজের পাখায় , তাকে কিনা ধরে কেটেকুটে রাতভোর মশল্লায় জারিয়ে রান্না করে তারিয়ে তারিয়ে খায় এরা । খুব অবাক হলাম । উত্তরও এলো । এদের খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি । সংখ্যায় কিছু কম পড়ার ভয় নেই । উপরন্তু কোলেস্টরেল নেই ,খুব ভাল সোয়াদ । আমার রসনা ক্যাঙ্গারু , খরগোশ , হরিণ কোনটারই স্বাদ নিতে চাইল না । সবসময় চারদিকে গোমাংস বরাহ মাংসের বড় আয়োজন ।অবিশ্যি  যে যাই বলুক, রকমারি মাংস আস্বাদনে আমাদের তো  পৌরাণিক ঐতিহাসিক নানান উত্তরাধিকার আছে । রামায়ণ বলে রামচন্দ্র নাকি স্বর্ণ গোধিকার মাংস বড়ই ভালোবাসিতেন ।  বেদের যুগে অতিথি  এলে গোশালার নধর গোরুটি নানান উখ্য বা শূল্য মাংসে পরিণত হত বলে অতিথির আরেক নাম গোঘ্ন । কিন্তু অতো পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই । মোদ্দা কথা, আমার দুজন সঙ্গী দেশের দুই প্রান্তের বাসিন্দা , কোথাও তাদের কিচ্ছুটি মিল নেই , কিন্তু দুজনেই যেখানেই গেছে ভেজিটেরিয়ান ভেজিটেরিয়ান বলে এমন  গোলমাল হই চই লাগিয়ে দিত যে আমি খুব একপেশে  হয়ে পড়তাম ।







 এই নিরিমিষ খাবার খুঁজতে গিয়ে দেখা পেলাম অন্নলক্ষ্মীর । কেউ পয়সা কড়ি চাইছে না । যা খুশি দাও । তাই বলে লঙ্গরখানা নয় । ভারি সুন্দর পোর্ট এলাকায় সারি সারি স্টিমার ঘেরা বাড়ির দোতলায় দক্ষিণ ভারতের এক ট্রাস্ট এই খাবার দুবেলা পরিবেশন করে । যেটা ভাল লাগলো ,দেখি প্রচুর বিদেশি সোনা মুখ করে দক্ষিণ ভারতের নিরামিষ রান্না খাচ্ছেন। ঠান্ডা জলের ওপর দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া হলঘরে ঢুকছে । দূতাবাসের লোকেরা জানালো প্রাক্তন হাই কমিশনার সুজাতা সিংহ ম্যাডাম এখানে আসতে খুব ভালবাসতেন । রকম সকম দেখে আমিও থালা হাতে লাইনে দাঁড়ালাম । ফিরতি পথে  প্রায় গায়ে পড়ে দেশের এক ছাত্রকে অন্ন লক্ষ্মীর ঠিকানা দিলাম । বিদেশ বিভূঁইয়ে  বেচারা দুটো খেয়ে পরে বাঁচুক ।








সারাদিন ধরে চোখে আঙুল দাদাগিরি করে পোকা বেছে অডিট করে হোটেলে ব্যাগ ধপাস করে ফেলে আবার বেরিয়ে পড়তাম । ফাঁকা রাস্তা ধরে এই পার্ক সেই পার্ক করে তবে ফিরতাম । এখানে সবই হয় রাজার বাগান নয় রানিমার , কিংস পার্ক বা কুইন্স গার্ডেন । পড়ন্ত বেলায়  এসে দেখতাম পাখিদের হাঁসদের পোকা বাছা ।





 এমন স্বচ্ছন্দ হাঁটার সুযোগ তো সবসময় পাওয়া যায় না । তবে সবচেয়ে ভাল লাগত সন্ধে নামার মুখে সোয়ান নদীর ধারে এসে বসতে । গাছের তলায় শান্ত বেঞ্চ । অস্তরাগের আলো মেখে তখন নদীর জল বড় বড় ঢেউ তুলছে ।  ছলাৎ ছলাৎ সেই ঢেউ , জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে  পায়ে চলার পথটাকে।







 আবার ওই হেলমেটে আলো জ্বেলে সাইকেল শন শন , হনহনিয়ে  তরুণ তরুণী, টুকটুকিয়ে দাদু দিদু, হাতে হাত ।আমি বসে আছি শান্ত বেঞ্চে , পায়ের নিচে ফেল্টের মত সবুজ ঘাস ,মাথার ওপর আশ্রয়ের মত গাছের ঘন পাতা । এখন অন্ধকার নেমে এসেছে । জলের ধারে  ঠান্ডা হাওয়া । বাবার কথা মনে পড়ছে । বাবা মোটেও ভ্রমণ প্রিয় ছিলেন না । কিন্তু বহুবার বলেছেন , নদীর ধারে , জলের পাশে , একটা  গাছের নিচে ছায়ার মধ্যে বসে থাকব , ভালো চা থাকবে সঙ্গে , একটার পর একটা কবিতা পড়া হবে আর একটার পর একটা রবীন্দ্রনাথের গান ।সেটাই ছিল তাঁর খুব আরামের বিলাসি চিন্তা । আমি তাই নির্জন সুন্দর কবিতার মত জায়গায়  বেঞ্চ পাতা থাকলে সেখানে খানিকটা সময় বসি । এখন জল এসে ছিটিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে মাথার চুল, পায়ের পাতা । উঠে পড়ি । হাঁটা দি হোটেলের দিকে ।



জলে নামছে সিঁড়ি
কয়েকটা তো বাকি
সান্ধ্য উদাস আমলকি গাছ
বাতাস ঝিরিঝিরি
ঘরে ফেরার পাখি
শান্তি করে ফিরি
ঘাটের কাছে আলো আছে
স্নিগ্ধ মাঙ্গিলিকী
জ্যোৎস্না ধোওয়া
সিঁড়ির ওপর ভিজে পায়ের ছাপে
দেওয়া নেওয়া সাঙ্গ হল
এই কথাটি লিখি
সিঁড়ির শেষ ধাপে
জোয়ার জলে ছলছলানো
তারার আলো কাঁপে


বাসুদেব দেবের কবিতা