পড়ন্ত বিকেলের রোদ ঘন হয়ে বসেছিল কায়রোর
এক অফিসঘরের মধ্যে । সুসান হামুদকে দেখতে একদম গজল গায়িকা ফরিদা খানুমের মত । ওইরকম চোখঝলসানো সুন্দর । মনে হবে
এখখুনি হাত নাড়িয়ে ভেজা ভেজা খসখসে গলায়
গেয়ে উঠবেন “আজ জানে কা জিদ না করো ,ইউঁ হি পহলু মে বৈঠে রহো.. কিতনি মাসুম রঙ্গিন
হ্যাঁয় ইয়ে শমা, হুসনু অর ইশক কা আজ মেয়রাজ হ্যাঁয়...”। না, অতোটা বাড়াবাড়ি নাহলেও সুসান
তার মোম মসৃণ হাত দিয়ে আমার হাতটা ছুঁয়ে বললেন “ইনশাআল্লাহ আবার দেখা হবে , মনে
রেখ ...” আমিও গদগদ হয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই , বলেই ভাবছি ,আবার তোমার সঙ্গে দেখা ?
আর যেন না হয় , যা জ্বালালে এই ক’দিন । তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতেই তো অর্ধেক সময় কেটে গেল । সত্যি সুসান এতো দুঁদে আর তুখোড় কর্মী ,কাজের
ব্যাপারে দারুণ টক্কর দিতে হয়েছিল । কাজের বাইরে আবার তার মধুর আন্তরিকতা সহজে ভোলার নয় । হঠাৎ দেখি
,সুসানের ভুরু দুটো সামান্য কুঁচকে গেছে, মোম মসৃণ হাতের লাল নেলপালিশ লাগানো তর্জনী সামনের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে । সেই আঙুলটা আনন্দী সুন্দরের সামান্য খোলা কোমরে দিল একটা খোঁচা । আনন্দী
মন দিয়ে কাগজ গুছোচ্ছিল , আচমকা খোঁচা খেয়ে “আইও” বলে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই সুসান
বলতে শুরু করল “ বি ভেরি কেয়ারফুল , দিস শুড বি কাভারড “ এরকম খোলা মেলা পোশাক
আবার ওখানে পরো না , ইটস আ ভেরি ডিফারেন্ট প্লেস । আনন্দী বাধ্য মেয়ের মতো সঙ্গে
সঙ্গেই জানিয়ে দিল শাড়ির মত এমন খোলামেলা পোশাক সে আর নতুন জায়গায় পরবে না ।
তার পরের দিন তুতান খামেন, রামেসিস , নীল নদ , স্ফিংস আর পিরামিডকে টা টা
করে, খান এ খলিলি বাজারের আরব্যরজনীর মত
রূপকথা, প্যাপিরাস হায়ারোগ্লিফিক, লাপিসলাজুলি টারকোয়েজ কোয়ারটজ পাথরের উপচে পড়া
প্রলোভন , নক্সাকাটা বোতলে আতরের সুরভি, হুক্কার বুড়বুড়ি কাটা ধোঁয়া, হেলিওপোলিসে আমাদের সেই নির্জন পাড়াটা, কলকাতার
মত গিজগিজে কায়রো,তারই মাঝখানে ট্যাক্সি ড্রাইভারের বেমক্কা গান আফলাতুউউউন আর নঈব
মাহফুজের পদধূলিমাখা মিশর কফি/চা হাউসের মিন্ট চায়ের মোহমায়া কাটিয়ে আমরা চলে এলাম
এয়ারপোর্টে । হঠাৎ শুনি পাড়া কাঁপানো উলুধ্বনি । উলু উলু
উলুউউউউউউ । পিলে চমকে যায় । আমার সঙ্গী দুজন ভারতের লোক হলেও
তাদের উলুর সঙ্গে আলাপ নেই । কি হল কি
হল বলে এদিকে ওদিকে তাকাতে দেখি একদল
ইজিপ্টের মহিলা জবরদস্ত সাজগোজ করে জাঁকিয়ে উলু দিচ্ছেন । সঙ্গে মনে হল নতুন বরবউ
গোছের কেউ । পরিবারের সবাই বিদায় জানাতে
এসেছে । কি আশ্চর্য এরাও উলু দেয় ! Ululation
–high pitched tongue trill,
বাঙালির উলু আন্তর্জাতিক ! বাঙালি এমনিতেই খুব দেশ টপকে আন্তর্জাতিক হতে ভালবাসে ।
বাঙালির উলু আন্তর্জাতিক ! বাঙালি এমনিতেই খুব দেশ টপকে আন্তর্জাতিক হতে ভালবাসে ।
কায়রো ছেড়ে আমরা যাব কাবুলে । যদিও আমাদের যাবার কথা ছিল সুদানে । ছিল সুদান
হয়ে গেল কাবুল । সুদানে সেই সময় দেশজোড়া গন্ডগোল । সেই ডামাডোলের মধ্যে কি সব জটিল
কারণে আমরা ভিসা পেলাম না । তাতে আমরা মনে মনে বেশ খুশি ছিলাম । কেই বা এতো
ঝুট ঝামেলায় পড়তে চায়? আবার বাড়িতেও তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে । কিন্তু এদিকে সেই কথা
আমরা তো বলে ফেলেছি খোদ বড়কর্তার কাছে , কায়রোতে । সে কথা শুনে তিনি তো চটে কাঁই । “এতো বড় সাহস ? ঢুকতে দেবে না বলেছে? দেখি ,কি
করে না দেয়? ফোন লাগাও তো, সেনোরিটা ।“ অমনি সরু মোটা গলায় সমস্বরে আমরা প্রায় চেঁচিয়ে
উঠলাম নাআআআআ । এই সমবেত না নিনাদ শুনে তিনি একটু টলে গেলেন মনে হল । যে চোখ আর
কানের ওপর ভরসা করে এতোদিন হুকুমদারি করছেন তাদের যেন তিনি আর বিশ্বাস করতে পারছেন না । তিন তিনটে
জলজ্যান্ত ভারতীয় তার সামনে বসে যাদের এতোটুকু মান অপমান বোধ নেই ! বড়কর্তা
চেয়ার থেকে পড়ে যাবার আগেই আবার সেই সরু মোটা গলাগুলো জানিয়ে দিল যে আমরা ভারতীয়রা
অন্যের মতামতকে খুবই সম্মান দিয়ে থাকি । তা ছাড়া আমাদের প্রোগ্রাম সব ঠিক হয়ে আছে
, টিকিট হোটেল সব । এখন সুদানকে ঢুকিয়ে দিলে সেগুলো সব বানচাল হয়ে যাবে , ভাবুন
একবার কতো টাকা নষ্ট হবে । সেই টাকায় কতো
ভাল ভাল কাজ হতে পারে আমাদের দেশে । তাই
না? উনি অগত্যা হাল ছেড়ে দিলেন আর আমরাও কাবুলের জন্য রওনা দিলাম ।
কাবুল কেন? আর কি জায়গা ছিল না ভূ বিশ্বে ? তার ওপর তুই আবার মেয়ে ? মেয়েদের
পাঠায় নাকি এসব জায়গায়? কোন একটা আক্কেল নেই গা ? এগুলো সব বাড়ির এক সমস্যা । যে সমস্যার কোন সমাধান হয় না । সে
যাক গে , নিজের দেশ ছাড়ার আগে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দেখা করাটা একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে । মনে মনে ভেবে নিলাম আর যাই হোক
কিছুতেই ওই মেয়ে মেয়ে অজুহাতটা যেন মুখ ফস্কেও না বেরোয় । আপ্তবাক্য সদা স্মরণীয় ।
এখানে তা একটি আপ্তরসিকতা ।ইংরেজিতে ।
স্বর্গের দরজায় প্রহরী একটিমাত্র প্রশ্ন করছে নবাগতদের । উত্তর দেবার পরেই
ডান হাত দিয়ে দরজাটা খুলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ।
“বানান করুন রোজ (rose)”। সবাইকে একই প্রশ্ন
R- o – s- e
“সঠিক উত্তর । জাস্ট আ ফরম্যালিটি । ঢুকে পড়ুন ।“
হাঁপাতে হাঁপাতে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো । প্রহরীকে বলল, “জানেন, সারাটা জীবন
এই মেয়ে হবার জন্য কী অপমান অসম্মান আর
বৈষম্যের শিকার হয়েছি । বেঁচে থাকাটা একটা
শাস্তি বলে মনে হোত ।আজ স্বর্গের দরজায় এসে তবে শান্তি ।“
চোখের পাতা একবারও না কাঁপিয়ে প্রহরী বলল ,” বানান করুন ক্রিসেন্থেমাম । “
আরো একটা ঘটনা মনে পড়ছিল । এটা অবশ্য বাবার গল্প । অল্প বয়সে বাবা খুব গাড়ি
চালাতে ভালবাসতেন । তখন গাড়ি বলতে সরকারি জিপ । ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে তিনি নিজেই
বেশির ভাগ সময় গাড়ি চালাতেন । তা সেই রকম একবার চালানোর সময় কিভাবে যেন গাড়িটা
বোল্ডারে লেগে তিস্তা নদীতে পড়ে যায়
।গ্রামের লোকজন বাবাদের উদ্ধার করে কিন্তু গাড়িটা আধা ডুবন্ত অবস্থাতেই পড়ে থাকে । স্টেটসম্যান কাগজের কিছু সাংবাদিক
ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ।গাড়িটা এলাকার পরিচিত । পরেরদিন একটা ছোট্ট খবর বের হয়
তিস্তা নদীতে জিপডুবিতে তরুণ অফিসারের মৃত্যু ।বাবার কাকা সেই খবরটা পড়ে কাগজটা
মুঠো পাকিয়ে ধরে বাবাদের বাড়িতে হাজির । বাড়িতে তখন শুধু মা আর মেয়ে । আমার ঠাকুমা
আর পিসি । খুব স্বাভাবিক সবকিছু । কেটলিতে চায়ের জল ফুটছে , রেডিওতে
রবীন্দ্রসঙ্গীত “এই লভিনু সঙ্গ তব”,বারান্দার রোদে বড়ি শুকুচ্ছে । কাকা বুঝতে পারলেন খবরটা এরা এখনও পায়নি ।উনি
আলিপুরে গিয়ে বড়কর্তাদের কাছে খোঁজ খবর শুরু করেন । তাতে চশমার ফাঁক দিয়ে পাইপ
দাঁতে কামড়ে কমল মিত্রের স্টাইলে একজন বড়কর্তা কাকাকে জানিয়েছিল তার কাছে বি ডিও
সংখ্যাহ্রাসের কোন স্ট্যাটিস্টিক্স নেই । বিডিওরা অত সহজে মরে না ।
আশ্চর্যজনক ভাবে ঠিক এমনটাই হল
কিন্তু । সাধে কি বলেছে History repeats
itself । আমি আলাপ আলোচনার পর সামান্য ইনিয়ে বিনিয়ে কাবুল মানে ইয়ে এইসব বলতে শুরু করা
মাত্র কর্তামশাই বললেন, কতো দুরূহ দুর্গম বিপজ্জনক জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অডিটররা তাদের মহান কর্তব্য পালন করছে । তাদের
পরমবীর চক্রের মত একটা কিছু দেবার প্রস্তাবও নেওয়া যেতে পারে । পরম হিসাবরক্ষক বা
ওই জাতীয় কিছু । না, অডিটর সংখ্যাহ্রাসের কোন খবর এখনো পর্যন্ত তার কাছে নেই । এই
পর্যন্ত বলে মুচকি হাসলেন । আমরাও বুঝে গেলাম
এইবার উঠে পড়তে হবে ।
২
নভেম্বরের ( ২০০৭) এক সকাল আমাদের নিয়ে এল কাবুলে ।বেশ ভালরকম ঠান্ডা । শুকনো খড়খড়ে । খুব ছোট্ট একটা এয়ারপোর্ট । একটু
ন্যাড়া ন্যাড়া ল্যান্ডস্কেপ ,ছাই রঙের পাহাড় সার সার চলে গেছে কতদূর । এদিকে পাঠানজোব্বা পরে বন্দুক
উঁচিয়ে সার সার দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা দাড়িওয়ালা
আফঘান পুলিশ । প্রকৃতি যেমন রঙহীন , নিরাভরণ, তেমনি এয়ারপোর্টটাও । দেখলেই মনটা
কেমন বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে । চারদিক ভয়ানক চুপচাপ ।
কেউ যেন ধমকে রেখেছে । কোথায় সেই পাঠানের দরাজ দিল আর অট্টহাসির গপ্পো ? খোবানি
কিশমিশ আখরোট আর কাজুর খুশবু ? আর সেই গান,
ইয়ারি হ্যাঁয় ইমান মেরা ইয়ার মেরে জিন্দগি ?
মালপত্র বহু দেরিতে এল , বেল্ট চলতে চলতে আচমকা ঝপ করে আলো নিভে গেল । লাগেজ
তো হাতে পেলাম । কিন্তু কোন ট্রলি পাওয়া যাচ্ছে
না । ধীরে ধীরে বোঝা গেল অমনিভাবে ট্রলি পাওয়া যাবেক নাই ।
সেগুলো ঠেলবার জন্য লোক আছে এবং তাকে পয়সা দিতে হবে । ভাঁড়ে মা ভবানী । মানুষের
হাতে কাজ নেই । পেটে খাবার নেই । স্পষ্ট গন্ধ পেলাম দারিদ্র্য ,সন্ত্রাস আর বিপন্নতার ।
বাইরে বেরিয়ে এসে এদিকে ওদিকে
তাকাচ্ছি । কে নিতে এসেছেন ভাইজান, মেহেরবানি করে ? হাত পা যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে । ওই যে দেখতে পেয়েছি এক ছোটোখাটো
আফঘান , প্ল্যাকার্ড হাতে ।প্রোটোকল অফিসার । জাহির মোহম্মদ । মৌখিক খাতিরদারিতে তুখোড় । যেন মেহমানদের সামনে ফুটোফাটা তাপ্পি লুকোনোর গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তাকে দেওয়া হয়েছে ।
এয়ারপোর্টের চারদিকে এখানে পয়সা দাও ওখানে পয়সা দাও । খুব অসহায়ের মত একসময় বলে
ফেলে, আমরা খুব গরিব তো ! আমার এমন হাসি পেল, যেন আমরা কতো বড়লোক । ইমিগ্রেশনের
লম্বা লাইন । জাহিদ ফর্ম তুলে এনে আমাদের নাম একে একে জিগ্যেস করে । আরে না না,
তুমি কেন? আমরাই ফর্ম ভর্তি করছি ।
সে কি করে হয় ? আপনারা মেহমান । এতো আমার কর্তব্য , আমাকে করতে দিন ,মোহতরমা
।
মনে মনে ভাবছি করতে তো দেব
ভাইজান,কিন্তু আমাদের নাম তো নয় , নামাবলী ।তুমি মনে রাখতে পারবে কি?
জাহিদ তিন জনের নাম জেনে নিল ।ফর্ম নিয়ে চলে গেল, আর আসে না । বেশ কিছুটা
সময় কেটে যাবার পর আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ি । এতো সময় লাগছে কেন? তিনজনে মিলে গুটি
গুটি গিয়ে দেখি প্রথম নামটিতেই তার ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে অবস্থা ।
বিমলেন্দ্র আনন্দ পট্টবরধন । জাহিদের কলম প্রায় ভেঙে যাবার জোগাড় । শেষমেশ
আমরাই চটপট কাজ সেরে বেরিয়ে এলাম ।
গাড়ির বনেট জুড়ে লেখা UN । ইউনাইটেড নেশনস
। সে গাড়ির দরজা এইটুকু ফাঁক হয় । সে কিরে
বাবা ? অই অত্তটুকু জায়গা দিয়ে এই লটবহর নিয়ে গলে যাব কেমন করে ? জানলাম এটা
বুলেটপ্রুফ গাড়ি । দরজা হাট করে অমনি খুলবে না । আর ভেতরেও দেখলাম কতো রকমের
যন্ত্রপাতি । তার মানে এই গাড়ি হামলার শিকার হতে পারে তাই এই বাড়াবাড়ি সাজগোজ । পেটের ভেতরটা একটু গুড়গুড় করে উঠল, অঙ্ক
পরীক্ষার সময় যেটা হত এককালে ।ড্রাইভারের নাম আনোয়ার । চলেছি হোটেলের দিকে । কিছুই
এখানে স্বাভাবিক ঠেকছে না জানান দিচ্ছে ষষ্ঠেন্দ্রিয় । দূরে ধূসর ন্যাড়া পাহাড়ের
নীল রেখা । গাছে গাছে ধুলো জমে সাদা হয়ে আছে ।শীত এসেছে তাই একটাও পাতা নেই ।
বাড়ির ছাদে স্লেট পাথর । রাস্তায় তেমন লোকজন নেই । মহিলা তো নেই বললেই চলে । যে দু একটি মহিলা চোখে
পড়ল তারা সে দেশের নয় ,এই আমাদেরই মত বাপে খ্যাদানো মায়ে তাড়ানো গোছের । সেই ছাই
রঙে আঁকা ছবির মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল । কাবুলে আমাদের স্বাগত জানাল বন্ধ দরজা জানালা । উঁচু উঁচু পাঁচিল । ঝাঁক
ঝাঁক নিরাপত্তারক্ষী । ফুটপাথ জুড়ে বালির বস্তা । সাঁজোয়া গাড়ির টহল আর বুলেটে ঝাঁঝরা করা দেওয়াল
। একটা হিংসুটে দত্যির শহর । সে শহর হয়ত অপেক্ষা করে আছে কবে ওই ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেওয়াল ফুঁড়ে একদিন একরাশ হলদে বেগনি লাল
ফুল ফুটে উঠবে ! কবে কে জানে!
হোটেলে পৌছোনো গেল ।
ইউনাইটেড নেশন্সের নিত্তি মাপা হিশেবনিকেশে নিরাপত্তার মাপকাঠির চুলচেরা
বিচারে এই হোটেলটাকে নিরাপদ তকমা দেওয়া হয়েছে । এই রকম আরো কিছু “নিরাপদ” জায়গা কাবুলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে
। পাহারাদারদের কড়া নজরদারি । নাক উঁচিয়ে আছে বন্দুক । নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা । ভাবছি এ আবার কোথায় এলাম ! এগিয়ে
চলেছি ,কিন্তু জামা ধরে কে টানে? তাকিয়ে দেখি
গোলাপ ফুলের মত কচি কচি মুখ আমাদের চারদিকে । গাল আর ঠোঁট লাল লাল, ঠান্ডায়
ফেটে ফুটিফাটা । খালি পা , দু হাতে সস্তার কিছু জিনিশ ,ডট পেন , রুমাল ,লজেন্স । ভাষা
জানে না । খালি চোখের ইঙ্গিতে বলছে
কিছু কেনো না আমার কাছ থেকে । দুটো
পয়সা পাবো তাহলে । জানো না দাঙ্গা হামলায় আমার বাবা মরে গেছে আর ওই দেখ মা দাঁড়িয়ে আছে । পেছনে তাকিয়ে দেখি খানিকটা দূরে ঘুরঘুর
করছে কয়েকটা আশমানি বোরখা । পুরো মুখ ঢাকা
। বেশ লম্বা । বোরখার মধ্যে হয়ত কিছু ব্যাকুল মুখ । বাচ্চাদের
হাতে সামান্য পসরা দিয়ে হোটেলের সামনে
পাঠিয়ে দিয়েছে আর দূর থেকে নজর রাখছে ।
হয়ত সেদিনের রোজগার ওই বাচ্চাদের হাত দিয়ে ।
“ কেবল অবিরাম ক্ষয় আর মৃত্যুর ছোবলের কথাই মনে রাখিনি
করবী গাছের ছায়া, আমি তোমাকেও মনে রেখেছি
রাস্তা জুড়ে খানা খন্দ ভাঙা কাচের কথাই নয়
আমি মনে রেখেছি ধুলোমাখা ন্যাড়া গাছটার মাথায়
ঘনিয়ে ওঠা মেঘের কথাও”
৩
নানান চেকিং এর অলিগলি পেরিয়ে
অবশেষে যে যার ঘরে ঢুকলাম । বুঝতে পারলাম মনের ওপর একটা ভয়ঙ্কর চাপ এসে পড়েছে ।
খুব ক্লান্ত লাগছে । দমবন্ধ করা পরিবেশ । ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে । কিন্তু উপায়
নেই । জাহিদ এসে জানাল এখনো অনেক নিয়ম কানুন পালন করতে বাকি আছে । প্রায় সারাদিন
লেগে যাবে । মানে আমাদের কাজের একটা দিন নষ্ট । জাহির আমাদের নিয়ে চলল এবারে
হোম ডিপার্টমেন্টে , স্বরাষ্ট্র দপ্তর ।এরা বলে মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেরিওর ।
সমস্ত অফিস চত্বর মিলিটারিতে ছয়লাপ । পুরুষে পুরুষে ছয়লাপ । তার মধ্যে
আনন্দী এবং আমি । সব্বাই আমাদের দেখছে । চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে ।চোখে অদ্ভুত কৌতূহল। বিশ্রি
অস্বস্তিকর পরিস্থিতি । ভেতরে ঢুকে একটা ধুলোভরা
প্রায় অন্ধকার করিডর পেরিয়ে চলছি,দুদিকে ফাইলের পাহাড় । ঢুকলাম অফিসারের
ঘরে । বেশ বড় ঘর । লম্বালম্বা জানালার ভেতর দিয়ে ঝিলমিলে রোদ্দুর এসে পড়েছে ,সেই
আলোর মধ্যে বিজ বিজ করে ধুলো উড়ছে । একটি টিভি চলছে গাঁক গাঁক করে । সেখানে অমিতাভ বচ্চন ভিলেনকে যারপরনাই পেটাচ্ছে ঢিসুম ঢিসুম । সমস্ত কথা
বার্তা চলল দলের একমাত্র পুরুষ প্রতিনিধি পট্টবরধনের সঙ্গে । ওকে চা খেতেও অনুরোধ
করা হল । অথচ দুটি মহিলা যে বসে আছে তাদের
তিনি একেবারেই গ্রাহ্য করলেন না ।
যেন আমরা ঘরেই নেই । কোন অস্তিত্বই নেই আমাদের । কাজ কর্ম কিন্তু মিটে গেল খুব
তাড়াতাড়ি । জাহিদ বলল আপনারা ইন্ডিয়ার লোক বলেই এটা সম্ভব হল ,নইলে ঝাড়া চার পাঁচ
ঘন্টা অপেক্ষা করতে হত ।
ইউনাইটেড নেশনসের সিকিউরিটি অফিস । আমাদের পরের গন্তব্য । দমবন্ধ করা পরিবেশ
ততোক্ষণে ঘাড়ের ওপর চেপে বসছে । চারপাশে ভয় আর আতঙ্কের চোখরাঙানি । খুট করে একটা পেল্লাই গেট খুলে
গেল। আমরা একটা খোলা চাতালে এসে পড়লাম । সেখান থেকে সরু সুড়ঙ্গের মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে
হাজির হলাম একটা গম্ভীর ঠান্ডা ঘরে । দেখলাম আমদের মত আরো দু’জন হতভাগা বোবা চোখে
বসে আছে । এমন সময় দেখি যোদ্ধা বেশে আবির্ভূত হলেন স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট । একজন বেলজিয়ান মিলিটারিম্যান,
দেখতে অবিকল যিশুর মত । যুদ্ধ আর শান্তি কেমন পাশাপাশি । তা সেই কড়াধাতের যিশু
কম্পিউটার খুলে প্রেজেন্টেশন দিতে বসে গেলেন । সেটা হল সতর্ক থাকার সহজপাঠ । মানে
উনি সহজ করে বানিয়েছেন আমাদের জন্য । প্রথমেই মেয়েদের জন্য এক নম্বর
সতর্কবাণী । শরীর ঢাকা পোশাক পরবেন । মাথা ঢেকে রাখবেন । হিল পরবেন না । আবার
সুসান হামুদের চাঁদপানা মুখটা মনে পড়ে গেল । আনন্দীর মনে পড়ে গেল কোমরের খোঁচাটা ।
যিশু খ্রিস্ট বলে চলেছেন ,খুব সাবধানে
থাকবেন । আপনাদের গতিবিধি জঙ্গিরা অনুসরণ করছে । কখন কোথায় কী হবে আমরা নিজেরাই
কিচ্ছু বলতে পারব না । এই এলাকায় ঢুকবেন না । ওই দোকানে যাবেন না । এই এলাকাটা
দুদিন আগেও ঠিক ছিল এখন আর নেই । হ্যাঁ অবশ্যই মনে রাখবেন সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য
ইউ এন এর অফিস , ইউ এন এর লোকজন , ইউ এন এর গাড়ি , ইউ এন যাবার রাস্তা ...।
এবারে আর পেট গুড় গুড় নয়, শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে ঠান্ডা স্রোত , ওই শীতেও আমাদের কপালে
জমছে ঘাম ।
পরম হিশেবরক্ষক পুরস্কারটা চালু হবে তো?
৪
সব গেরো কাটতে কাটতে দিন প্রায় কাবার ।একটু যে অফিসে যেতে হয় নইলে
নিয়মরক্ষা হয় না । জাহিদ জানাল এই সময়ে অফিসে কেউ প্রায় থাকেই না । কাবুল
অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন মিস্টার আবদাল্লা । উনি আপনাদের জন্য থাকবেন বলেছেন । অফিসটা যেতে হয়
জালালাবাদ রোড দিয়ে । উইকিপিডিয়া বলছে জালালাবাদ রোড
বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক শহরের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা । দিনের আলো প্রায় নিভে
আসছে । শিরশিরে ঠান্ডার মধ্যে আমরা হাজির
হলাম অফিসে । খুব সাধারণ বাড়িঘর । এই পরিস্থিতিতে এর বেশি আশাও করা যায় না ।
আবদাল্লা সাহেব হাসিমুখে অতিথিদের ঘরে তুললেন । খুব আমতা আমতা করে জানালেন ,অডিটরদের প্রথম এই
অফিসে পদার্পণ । অডিট ব্যাপারটা যে ঠিক কী
তাই তারা কেউ প্রায় জানে না । তার ওপরে বারবার জঙ্গি হামলায় জেরবার হয়ে গেছে এই
অফিস । ফাইলপত্র কাগজ সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে , চুরিও হয়েছে প্রচুর । এর আগে পাকিস্তান
আর আফঘানিস্তানের তিন জায়গায় অফিসকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে । তাই তাদের সমস্যা অনেক । এটা নতুন আস্তানা । সব কিছু তারা
সাজিয়ে গুছিয়ে আমাদের হয়ত দিতে পারবে না ।
ও হ্যাঁ, কাজের কথাটা সেরে নিই । এই
বলে আবদাল্লা সাহেব আমাদের তিনজনকে তিনটে সিমকার্ড দিলেন।বললেন “প্লিজ রিমেমবার , দিস ইস ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট ।
ইফ ইউ পিপল আর অ্যাবডাক্টেড “..
আবার সেই সরু মোটা তিনটে গলার ঐকতান
“মানে?”
মানেটা হল, যদি আপনাদের অপহরণ করা
হয় এই সিমটাই তখন আমাদের হেল্প লাইন । সিম্পল ।
এই সিম্পল কথাটা আমাদের তিনজনের বুকে তিনটে কমপ্লেক্স গুলির মত বিঁধে গেল । তপন রায়চৌধুরীর
লেখা “ওই ইন্ডায়রেক্টলি কইয়া দিলাম আরকি” মনে পড়ে গেল । আমাদের সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে
। গীতায় বলেছে বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি ।
৫
আবার সেই হোটেল । । চারদিক বিজলি বিহীন অতল অন্ধকারের
সমুদ্র । শুধু হোটেলটা একটা আলোর জাহাজের
মত জেগে আছে । জানলাম এগারোটার পর হোটেলেরও
অনেক আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে ।
পরের দিন থেকে একটা নতুন কর্মসূচি আমাদের শুরু হতে চলেছে । চাপা উত্তেজনা তো
ছিলই ।সকাল বেলায় দুগগা দুগগা বলে বেরিয়ে পড়লাম ।এই যে এত টানাপোড়েন , আতঙ্কের
রক্তচক্ষু , উৎকণ্ঠা উদ্বেগের যন্ত্রণা, এসবের
মধ্যে ব্রেকফাস্ট খেতে ডাইনিং হলে গিয়ে আমার মন বেশ ভাল হয়ে গেল । বেশ একটা প্রাণের স্পন্দন
চারদিকে । কফির কড়া গন্ধ , কাপ প্লেট চামচে টুং টাং , সদ্য বানানো নরম প্যানকেকের ওপর গলে গলে পড়ছে
স্বচ্ছ সোনালি মধু , পাতলা পাতলা লাচ্ছা পরোটার পাশে আয়েশ করে বসে আছে লা জবাব
উমদা কিমাকারি । একটু একটু হাসি , টুকরো টুকরো কথা । মনের ভার ভার ভাবটা অনেকটাই
কেটে যাচ্ছিল ।
অফিসেও লোকজনদের মুখে নানা রোমহর্ষক গল্প শুনতাম । জালালাবাদ রোড ধরে আসা
যাওয়ার সময় বুক ঢিব ঢিব করত না বললে চরম মিথ্যে বলা হবে । সন্ধের কুয়াশার মধ্যে দেখতাম
সেইসব আশমানি বোরখাদের । দেখতাম শুধু বাচ্চাদের দিয়েই নয় নিজেরাও বাধ্য হয়ে পয়সার
জন্য হাত পাতে । বিপর্যয় সে অবয়বেই আসুক না কেন
সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হয় মেয়েদের । তছনছ লন্ডভন্ড হয়ে যায় তার জীবন স্বপ্ন ঘর
সংসার । Poverty has a feminine face। দারিদ্র্যের মানবীমুখ । সবদেশে,সবকালে ।
ইউ এন এর ক্যাম্পাস একটা ছোটোখাটো পৃথিবী । অফিসের লোকজনদের কারুর বাড়ি হেরাটে , গজনীতে ,
কান্দাহারে । ইতিহাস ইতিহাস গন্ধ ।মহম্মদ খুরির আদতে কায়রোর লোক । ।বিশাল ভারি চেহারা ঘন খয়েরি চোখ কোঁচকানো থাক
থাক চুল, যেন কোন অপেরার কমেডি চরিত্র ।
ইনি হাসি মস্করায় পরিবেশটাকে হালকা করে রাখতে চাইতেন ।বেশ হ্যাপি গো লাকি গোছের । আমরা
সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি , এইসব দেখে একদিন খুরি বলে
ফেলে ,চোখের সামনে যা দেখা যায় সবটাই পুরোপুরি সঠিক নয় । ভয় আতঙ্ক যেমন আছে
তেমনি আবার পালাবার পথ ও আছে । এই যেমন
আমি অফিসের পর সন্ধের অন্ধকারে শহরে চলে যাই , আমোদ আহ্লাদের জায়গা আছে, সবই আছে
ভায়া, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ফুর্তি ফারতা করে আবার ভোর রাতে ডেরায় ফিরে আসি । কী
করে বলো তো? লক্ষ্য করা দেখবে রাতে কোন অঘটন ঘটে না ।
বহত খুব ! আমরা খুরির সাহসের তারিফ
না করে পারি না। আবদাল্লা সাহেবের মনে অবশ্য তেমন শান্তি ছিল না । তিনি সুদানের
লোক –সব সময় বলতেন উই হ্যাভ লত অফ ব্রবলেমস । একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি
আফ্রিকানরা “প” কে” ব” উচ্চারণ করে । যেমন ব্রবলেম , বেন (pen) , বিবল (people) এইরকম । কায়রো এয়ারপোর্টে আমাদের
ড্রাইভারটি বলেছিল আয়াম গোইং টু বার্ক ( to park the car) । পট্টবরধন টা এমন পাজি ফস করে
বলে বসল ইয়েস বার্ক লাউডলি ।
প্রথম দিন অফিসে এসে দেখেছিলাম সারা অফিস জুড়ে তির চিহ্ন দিয়ে কিছু পোস্টার
লাগানো আছে । কেন লাগানো আছে ? কি মানে ঐ
পোস্টারগুলোর ? ওরা বলল ও হো ,আপনাদের বলে রাখা উচিত ছিল । ওগুলো দিয়ে বাঙ্কারে যাবার রাস্তা দেখানো আছে । মানে ওই বোমাবাজি শুরু হলে আমরা যে যেখানে থাকি
সব ফেলে দিয়ে ছুট্টে বাঙ্কারে সেঁধিয়ে যাই । ভালোই হয়েছে আপনারা জেনে গেলেন বেশ ।
বাহ যেন খুব একটা মজার খেলা । বাঙ্কার বাঙ্কার লুকোচুরি ।
৬
কাজকর্মের মধ্যে কোন ছিরিছাঁদ নেই । একে হাতে সময় কম তার মধ্যে চারটে বাজতে
না বাজতেই দরজার সামনে এসে অফিসের লোকেরা দাঁড়িয়ে থাকে ।এবার উঠুন । আর কতো? গোলা
বারুদ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে তো ? সত্যি ওদের দোষ দেওয়া যায় না । আবার সেই
ভুতুড়ে কুয়াশার মধ্যে হোটেলে ফিরে আসা । বাকি কাজ শেষ করা ।
পরদিন সকালে আবার সেই খাবার ঘরে পেয়ালার ঠুনঠুন , ভাপানো ডিমের ওপর মোজারেলা
চিজের আলতো চাদর,গোলমরিচ আর টমেটো কুচির জম্পেশ ভালবাসাবাসি ,আভেন ফ্রেশ রুটির
সুঘ্রাণ । সবে সেই সুখাদ্য মুখে তুলতে যাব এমন সময় কান ফাটানো পিলে চমকানো বিকট একটা আওয়াজ । আমার হাতের কাঁটা চামচ ঠাঁই করে মেমসাহেবের ফরসা পায়ে ঠুকে গেল । ঝনঝন
করে কেঁপে উঠল জানালার কাঁচ ।কাপ থেকে চলকে পড়ল চা । সব কিছু তোলপাড় । হইচই । চেঁচামেচি । সব ছুটছে
জানালার দিকে। এ ওর পা মাড়িয়ে দিচ্ছে । আমরা তড়িঘড়ি করে চশমা কোট
ব্যাগ সামলে উঠে পড়ি । কী হল ? কী হল ? ও
দাদা , বলুন না । চোখ গোল গোল করে লালমুখো সাহেব কোনরকমে জিভ জড়িয়ে দম আটকিয়ে বলল
ব্লাস্ট ।
খুব বড় একটা বোমা পড়েছে হোটেলের কাছেই হয়তো , অন্তত শব্দ শুনে তাই মনে
হয় ।আমরাও ছুটে জানালার কাছে গেলাম । কিছু দেখতে পেলাম না । সেদিন ড্রাইভার এলো
অনেক পরে , এসে বলল ইউ এন যাবার রাস্তায় একটা বড় ব্লাস্ট হয়েছে । অনেক লোক মারা গেছে । আজ আমরা একটা অন্য রাস্তা দিয়ে
যাব ।
অফিসে যাবার পর সবাই একে একে খোঁজ খবর নিতে এলো । কতটা ক্ষতি হয়েছে ,কতজন
মারা গেছে সারাদিন দফায় দফায় তাই শুনতে থাকলাম । আমাদের হোটেলটা যাকে ইউ এন
নিরাপদ হোটেলের তকমা পরিয়েছিল, পরবর্তী সময়ে
এর ওপর জঙ্গিরা বারবার হামলা চালায় একেবারে মানব বোমা নিয়ে । কাবুলে আমরা
ছিলাম সাত দিন ,সে দিক থেকে দেখলে খুব কম সময় । কিন্তু সাত দিনকে আমাদের সত্তর দিন
বলে মনে হত । আর এই সাত দিনে ঠাসা প্যাকেজের মত এতোগুলো উথালপাতাল অভিজ্ঞতা আমাদের
চোদ্দ পুরুষে তো কারুর হয় নি । কাবুল নিয়ে
লিখছি বটে , কিন্তু সন্ত্রাস আর সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কি কোন সীমানা আছে ? পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের মত এই ভয় দেখানোর
খেলা আমাদের পঙ্গু করে রাখে, রেখেই দেয় । আমার মনে পড়ল আমি একবার সরকারি কাজে মণিপুর
গেছিলাম ,মাত্র তিনদিনের জন্য । আমার সহকর্মী বন্ধুর অফিসে কোন সাইনবোর্ড বা
নেমপ্লেট লাগানো ছিল না । বালির বস্তার
আড়ালে যত্রতত্র পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল মনে আছে । রাতে ওর বাড়িতে খেতে ডেকেছিল,
দেখেছিলাম তার ঘরে বসত করে বাইশজনা কমান্ডো । রাত একটু বেশি হলে ওই কমান্ডোরা
গেস্ট হাউসে পৌঁছে দেয় । অষ্টপ্রহর ওইরকম উঁচু পাঁচিল আর রক্ষীবাহিনীর মধ্যে কি ভাবে থাকো ? বন্ধুটি
ম্লান হেসে বলেছিল বলতে পারো কোন জায়গা দেখলে আমি সবচেয়ে খুশি হই? এয়ারপোর্ট ।
মানে এখান থেকে ছুটি ।
ছুটি ছুটিইইইই। শুন্ডি রাজার হাত তুলে দৌড়নোর দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল।
কাজ সারা হলে আমার যা স্বভাব, বলেই
ফেলি, “দোকান বাজার একটু ঘুরে দেখা যাবে কি ? যাবে না বোধহয়, না?”
বন্ধুটি বলে আচ্ছা যাও ।ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি । আমিও মহানন্দে বেরিয়ে পড়লাম
। “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে , কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে
পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?” কে লিখেছিলেন? হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । মাঝে মাঝে স্কুলে পড়া লাইন গুলো
এমন মোক্ষম সময় মনে পড়ে যায় না ! সত্যি কী
দেখলাম ! দেখলাম কমান্ডো বোঝাই একটা গাড়ি
আমাদের আগে পিছে চলছে । চলুক ।তাতে আমার কি? আমরা চার পাঁচটা জায়গায় থেমেছিলাম মনে
আছে । কিছু হ্যান্ডিক্রাফটসের দোকান , মন্দির এইসব । একটা ঘিঞ্জি বাজার । যতবারই
নামছি অমনি দেখছি ওই কমান্ডোগুলো তড়াক করে জিপ থেকে নেমে বন্দুকগুলো বাগিয়ে
ধরে আমাকে সেমি সার্কুলার ভাবে ঘিরে ধরছে
। পুতুলের দোকান থেকে মন্দির, মন্দির থেকে মণিপুরি চাদর সব জায়গায় । অন্যভাবে
দেখলে মনে হবে যেন কাউকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে । আমার তখন ওই বন্ধুটির দশা ।
এয়ারপোর্টে গেলে সবচেয়ে খুশি হই ।সরকারি রিপোর্টে একটা গ্রেডিং এর ব্যাপার ছিল । সেটা আমি দিই নি । এমন অশান্ত
পরিস্থিতে কাজ করে এরা , তার আবার গ্রেডিং কি ? কিন্তু আমাকে বড় অফিস থেকে বলা হয়েছিল গ্রেডিং দিতেই হবে । চল নিয়ম মতে ।দূরে
তাকিও নাকো ঘাড় বাঁকিও নাকো ।
কাবুলে ওই ক’দিনেই মন যেন বিদ্রোহ করে উঠছিল । একটা অস্বাভাবিক জায়গায় সরকারি হিশেব নিকেশ নিয়ম কানুনের, প্যাঁচ
পয়জারের একটা সীমা আছে । শুধু পথে দেখা ওই মহিলারাই নয় আমরাও যেন এ ক’দিন বোরখা
পরেই কাটিয়ে দিলাম । কিছুই দেখা হল না । জানা হল না । খুব নিরাপত্তার ভেতর দিয়ে একটা
কিলিম কার্পেটের আড়তে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল । তাও প্রায় শেষ সময়ে । ফাঁকা ভিড়ভাট্টা নেই । একটু গলিগুঁজির মধ্যে ।
সবই খুব বেশি বেশি দামের । বিদেশিরাই এর প্রধান খরিদ্দার । শুধু কাবুল সফর কে স্মরণীয় করে রাখবার জন্য তিনজনেই কিলিম কিনে
ফেললাম ।
৭
আমাদের কাজ শেষ হয়ে আসছিল । সব
গুটিয়ে নেব শুক্কুরবার । ওদের জুম্মাবার । ছুটি । কিন্তু সব্বাই আসতে রাজি হল শুধু
আমাদের জন্য ।পাখতুনি সালোয়ার আর মাথায় ফেজ পরেই অনেকে অফিসে এল । আফঘানদের
আন্তরিকতা, বন্ধুত্ব আর আতিথেয়তা প্রবাদের মত । দিনকাল খারাপ । ওয়ক্ত সহি নহি
হ্যাঁয় । নইলে সবাই নাকি আমাদের বাড়িতে নিয়ে খাওয়াতো । এমনকি ড্রাইভার আনোয়ারও। এটাই দস্তুর । খুব
আফশোস তারা ভাল খাতিরদারি করতে পারল না । গুনাহ মাফ কিজিয়ে ।
“কোথাও দেওয়াল নেই,কাঁটাতার নেই,পর্দা নেই ,সীমানা
নেই
এমন একটা বাড়ি একটা দেশের কথা ভাবত সে
তার চারদিকে ঝুঁকে পড়ত বিষণ্ণ অন্ধকার, মানুষের তৈরি
সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একরাশ জোনাকি তুলে এনে
ছুঁড়ে দিত চুমকির মতো, ঢুকে পড়ত তারা
মানুষ জনের ঘর সংসারে চিন্তা ভাবনায়...”
কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে যেমন এসেছিলাম সেই হাওয়ার মধ্যেই বিদায় নিলাম । মালপত্র
বুঝে নিচ্ছি এমন সময়ে দেখলাম দীর্ঘকায় ড্রাইভারটি সামনে ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে । হাতে হাত মেলাবার জন্য নয় । “মেরা বখশিশ” ।
ওকে কিছু দেব বলে আমরা ঠিক করেই রেখেছিলাম। কিন্তু সাত দিন ছায়াসঙ্গীর মত লেগে থাকা অমায়িক ভদ্র
আনোয়ারের ওই অসহায়ের মত হাত বাড়ানো দেখে
একটা ধাক্কা খেলাম সবাই । বুঝলাম কঠিন সময় কখন যেন চুরি করে নিয়ে গেছে ওকে।
“ইনশা আল্লাহ আবার দেখা হবে” ।
খুদা হাফিজ , কাবুল ।
“প্রতিটি বাস স্টপে যেখানে মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা
কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে রোজ সকালে সন্ধে,
কংক্রিট খুঁড়ে খুঁড়ে গ্রাম থেকে তুলে আনা
এক একটা ফুলের গাছ লাগাতো সে, গন্ধরাজ ,টগর , কাঞ্চন, কতো কি
এবং সে নিজে একখন্ড বেসরকারি মেঘের মতো
গাছের মাথায় ঢালত জল, দিত ছায়া...
তার ঠিকানা সবাই জানে,মুচকি হেসে চলে যায় সবাই
তার নারী ও বন্ধুরা, উটকো হাওয়ার মতো
সে সর্বদা ঘুরে বেড়ায়, বড় ব্যস্ত সে এখন
একটা পাগলা ষাঁড় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পথঘাট , বেরুতে পারছে না কেউ
খাড়া উঁচোনো শিং এর ওপর রক্তাক্ত ঝুলত ঝুলতে
সে এখন ঘন্টা পরাচ্ছে তার গলায়,বড় ব্যস্ত সে এখন
কবি বাসুদেব দেবের কবিতা “সময়
দুঃসময়” এর অংশ এবং “মানুষের ঠিকানা”
ছবির উত্স গুগল