Tuesday 23 December 2014

সব চরিত্র কাল্পনিক নয়

বাড়িতে নতুন বউ এসেছে । ভারি ভুলো  মন । ঠাকুর ঘরে আঁশ বটি রেখে আসছে , রান্নাঘরে চন্দন বাটা । শ্বশুরকে   চানের সময় তেলের বাটির জায়গায় এগিয়ে দিচ্ছে   নস্যির ডিবে । আর শাশুড়িকে ? সে কথায় আর নাই বা গেলাম । মোটের ওপর সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার । তার ওপর জলে জঙ্গলের এই দেশ মানে দ্যাশ । জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ । এই নিয়েই ঘর গেরস্থালি । এক গাদা আত্মীয় স্বজন , কাজের লোক, মুনিষ সব মিলিয়ে দিনে  রাতে  ক’টা পাত পড়ে তার হিশেব রাখা দায় । কেউ একজন যদি ঘরে না থাকে  তাকে কেউ  সারা দিনে মনে করবে এমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না । এমন সংসার সামাল দিতে হিমশিম আমাদের ভুলোমনের বউ । রাতে কুপি বাতির আলোয়  পুকুর ঘাটে  মুখ ধুতে ,বাসন মাজতে এসে তার আচমকা  একটা কথা মনে পড়ে গেল  । শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বউ বলল “ভাল কথা মনে হল আঁচাতে আঁচাতে / ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেছে নাচাতে নাচাতে “ ।   মানে টা হল সক্কালবেলা নদীতে নাইতে যাবার সময় বউ টির ননদকে কুমীরে টেনে নিয়ে গেছে । বেচারার কী দোষ , ঠিক সময় ঠিক কথা মনে পড়লে তো ?
 বার বড় কোবরেজ মশাই শেষ অবধি বলেই ফেললেন , রোগীকে টেংরির জুশ খাওয়াতেই হবে ।  তা নাহলে গায়ে বল আসবে না । কোবরেজ মশাইএর নাতি কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে পড়ে কিনা ।
 বোষটোমের  বাড়ি । মাছ মাংস ঢোকেনা ।  কর্তা মা বাধ্য হয়ে  রেঁধেছেন   তার আদরের মনুর জন্য ।
মনুকে এক চামচ করে  জুশ খাওয়ান আর জিগ্যেস করেন , “অ মনু , বল পাতিস ?”
আরো এক চামচ ,”অ মনু বল পাতিস?”
কাদের ফরাসি বলে বলত? ফ্রেঞ্চ দূর দূর জানিস না । যারা ফর ফর করে রাশি রাশি কথা বলে ।

এইসব ননসেন্স গল্পের ঝুলি ছিল আমার ছোট পিসির কাছে । ঢাকাই কুট্টীর যত  গল্প ওই ওনার কাছেই শোনা ।
ছোটপিসি আমার দেখা একটা ইন্টেরেস্টিং চরিত্র । ইনি বাংলা আর সংস্কৃত দুটো বিষয়ে এম এ করেছিলেন । স্কুলে পড়াতেন এবং হেড মিস্ট্রেস হয়েছিলেন ।   আজকের যুগেও তাদের বাড়িতে তিতো দিয়ে শুরু মিষ্টি দিয়ে শেষ এই কোর্সে প্রতিদিনের খাওয়া চলত স্কুল করে, খাতা দেখে, ছাত্রী ঠেঙিয়ে বাজার করে রান্না করে দুটো অসম্ভব অবাধ্য ডানপিটে ছেলে এবং সামন্ততান্ত্রিক স্বামী নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে খুবই ঘোরতর সংসারী   পিসি র মনের মধ্যে ক’জন বাস করত বা পিসি চিন্তা ভাবনার কোন স্তরে থাকতেন আমি তার হদিশ পাইনি ।    একদিন  রেলস্টেশনে পিসির ছেলে পার্থ  দেখল পিসি দাঁড়িয়ে আছে। পার্থ ডাকল,  মা ওমা ? পিসি শুনতে পেলনা । পার্থ একটু এগিয়ে গিয়ে পিসির কনুই ধরে আবার ডাকল মা , ওমা ?  পিসি এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভুরু  কুঁচকে বলল,” কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না । তখন থেকে মা মা করছেন?”
পার্থ প্রায় ভিরমি খেয়ে পড়ে যায় কিন্তু এটাও বুঝতে পারে যে তার কৌতুকপ্রিয় মা কিন্তু এখন মজা   করছে না । পিসি  চিনতেই ই পারছে  না তার ছেলেকে ।  পার্থ আমাকে বলেছিল লোকের মারধোর খাবার ভয়ে ওখান থেকে সরে এলাম জীবনে এত বেইজ্জতি আর কখনো হয় নি ।
আবার এই পিসি ই একদিন আমাকে বলেছিল ওই ছেলেটাকে দেখ । ওই যে রাস্তার ওধারে ।  খুব চেনা চেনা লাগছে । তী র্থর মত দেখতে না?
অসহায় ভাবে অবাক হয়ে  পিসির দিকে তাকিয়েই ছিলাম । বলতে পারিনি ওটা তো তীর্থই ।
 ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ পাকা করতে যাবার দিন পিসি বেশ তসরের শাড়ি মটকা সিল্কের শাল  বটুয়া দিয়ে সেজে গুজে গেলেন । কিন্তু এবারেও পিসির কর্মোদ্যোগে জল ঢেলে দিল  একজোড়া হাওয়াই চটি বা কখনো দুপায়ে দুরকম চটি । লোকজন হেসে গড়িয়ে পড়ল । কোন জগতে থাক তুমি মঞ্জুদি? ইস্কুলের মেয়েরা কথা শোনে তোমার? পিসি সারা জীবন অসংখ্য বার চেষ্টা করেছেন সবাইকে বোঝাতে যে তিনি কী কড়া দিদিমণি ছিলেন । কেউ বিশ্বাস করত না ।
পিসি আমাদের কলকাতায় বাড়িতে ছুটিছাটায় আসত । কিন্তু কোনবার ই একবারে আমাদের বাড়িতে আসতে পারত না । রাস্তা ভুলে যেত । প্রত্যেকবার । নিয়ম করে । আমাদের ঠিকানা সোজা সাপটাই ছিল । অথচ  কোন একটা পয়েন্টে এসে কিনু গোয়ালার গলির মত পিসির কাছে সব কিছু গুলিয়ে  যেত ,পিসি মফস্বলের হেড দিদিমণি থেকে মোগল রাজকুমারী  গুলবদন বেগম হয়ে যেত ।



আমার বড় পিশেমশাই খবরের কাগজ পড়তেন, সঙ্গে থাকত একটা লাল আর নীল কালির পেন ।  তিনি প্রত্যেকটা লাইনের তলায় দাগ দিয়ে কাগজ পড়তেন , নীল কালি দিয়ে । আর যে সব ব্যাপারে তার মন্তব্য থাকত সেখানে দিতেন লাল কালির দাগ । কখনো প্রশ্নবোধক, বিস্ময় সূচক চিহ্ন । কাগজগুলো প্রায় আর্কাইভের মত করে তারিখ মাস অনুযায়ী একট তাকের ওপর পাট পাট করে সাজানো থাকত । পিশেমশাই কাগজের ঠোঙা পলিথিনের ব্যাগ সব ই পাটপাট করে ভাঁজ করে রাখতেন । আজকের ট্যাঁসেরা বলবে তাও জান না ? ওটা তো OCD কাগজগুলো নিশ্চয় একটা সময়ে বিক্রি হত । মনে হয় সেটা উনি নিজেই করতেন । রেফারেন্স হিশেবে কোনো কোনো কাগজ ওনার দরকার পড়ত । কোন নেতা দুদিন আগেই হয়ত অন্য কথা বলেছিলেন , সেটা ভেরিফাই করা দরকার ।  অর্থ নীতির নানান সূচক কয়েকদিন ধরে কী চলছে এই সব নানান তথ্য তিনি নিজেই একা একা প্যানেল ডিসকাশনের মত করতেন । এবিপি আনন্দ ছিল না তো । তাই নিজেদের মাথার ধার টা  নিজেরাই বাড়াতেন ।
একবার হল কি পিশেমশাই খেয়াল করলেন ১৭ ই মার্চের কাগজ খানার কয়েকটা পাতা নেই ।  এখানে বলে রাখা ভাল  ইনি আমার বাবার থেকে অনেকটা বড় ছিলেন এবং ভাষায় ও স্বভাবে কট্টর বরিশালিয়া ।  খানিকটা দাদু ঠাকুরদা বলেই মনে হত ওনাকে । পিশেমশাই হুঙ্কার ছাড়লেন,” কাগস খান গেল কই?”  বাড়িতে কিছুক্ষণের পিনপতন নৈঃশব্দ । কোন উত্তর না  পেয়ে আবার হুঙ্কার, কি হইল? কাগস খান কি উইড়্যা  গেল?  এবার ছেলের বউ মিনমিন বলতে থাকল কি জানি , শিখা বোধহয় কয়েকটা শাড়ি মুড়ে নেবার জন্য...।  
“ক্যান বাড়িতে কেউ কিসু কয় নাই? “
শেষ পর্যন্ত পিশেমশাই ফরমান জারি করেছিলেন যে ওই কয়েকটা পাতা মেয়ের বন্ধু শিখার বাড়ি থেকে যে ভাবে হোক নিয়ে আসতে হবে । এরপর তাদের বন্ধুত্ব টিকে ছিল কিনা জানা নেই আমার ।
তবে একটা কথা । পিশেমশাই আমাকে খুব ট্রাস্ট করতেন । তার সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই । রচনাবলীর পর রচনাবলী । তাদের মধ্যে গোছা গোছা নিম পাতা দেওয়া থাকত । তিনি শুধুমাত্র আমাকে বই পড়তে দিতেন আর কাউ কে না । নিজের ছেলে মেয়েকেও না । দুমড়ে মুচড়ে বই পড়া, শুয়ে শুয়ে বই পড়া এসব উনি বরদাস্ত করতেন না । শুধু তাই  নয় ,আমাকে তিনি প্রায় অন্ধের মত স্নেহ করতেন । তার জন্য আমার গোবেচারা স্বভাবটাই যে একমাত্র দায়ী সেটা আমি এখন বেশ বুঝতে পারি । পিশেমশাই পার্থকে একদম দেখতে পারতেন না । পার্থ ভয়ঙ্কর রকমের দুষ্টু ছেলে । এই নিয়ে ছোট পিসির মনে কত ক্ষোভ ছিল ।     
আমার পরিষ্কার মনে আছে একদিন আমি বসে বসে ছবি আঁকছিরঙ তুলি দিয়ে পার্থ আমার হাত টা নাড়িয়ে দিচ্ছে , নয়ত রঙের প্লেট টা টেনে নিচ্ছে , নয়ত জল ছিটিয়ে দিচ্ছে । আর আমি অসহায়ের মত অত্যাচারিত হচ্ছি কারণ ওর সঙ্গে দস্যিপনায় আমি পেরে উঠব না । আমরা পিঠোপিঠি ভাইবোন ।
এমন সময় রঙ্গমঞ্চে পিশেমশাইএর প্রবেশ ।    এসেই পার্থর দিকে তাকিয়ে  গলার স্বর উঁচু নিচু করে এক খানা নাটকীয় সংলাপ  দিলেন “ ও কী করত্যাসে কও । ছবি আঁক তাসে । কী করত্যাসে ? সৃষ্টি । তুমি কী করত্যাস?    ছবিটা নষ্ট করত্যাস । কী করত্যাস? ধ্বংস ।“
সেই অবোধ বালকটিকে  সৃষ্টি লয়ের জটিল তত্ত্বের হাত থেকে ছোটপিসি  উদ্ধার করে  নিয়ে যান,  “জামাইবাবু আমার ছেলেটাকে একদম দেখতে পারে না “
কথাটা পার্থও জানত । সেই বালক মনের সুপ্ত প্রতিহিংসা নেবার সুযোগ এল কিশোর বয়সে । আমরা বড়পিসির বাড়ি গেছিলাম।  শীতের একটা পড়ন্ত দুপুর । মা আর ছোটপিসি দু জনে কলেজ জীবনের সখী ছিল । তারা সেদিন রাশি রাশি হোম ওয়ার্ক দিয়ে আমাকে আর পার্থকে রেখে কোথাও গেছিল । পার্থ ষড়যন্ত্রের প্ল্যান টা ছিল আমরা একটা কোন প্রশ্ন উত্তর নিয়ে খুব ঝগড়া করব যে কার উত্তরটা ঠিক । চেঁচামেচি শুনে পিশেমশাই আসবেন । তারপর প্ল্যান মাফিক কাজ ।
এমন সাবজেক্ট নিতে হবে যেটা পিশেমশাই ভাল জানেন না ।  অঙ্ক, ইংরেজি , ইতিহাস এসব নিলে হবে না ।অতএব সংস্কৃত বেছে নেওয়া হল ।
যথারীতি পিশেমশাই এসেই জানতে চাইলেন এত সোরগোল কেন । পার্থ ভালমানুষের মত মুখ করে বলল না মানে কার উত্তর টা ঠিক এটা বুঝতে পারছি না তো , তাই ।
তা প্রশ্নটা কী ?
শুনেই উনি বুঝলেন এটা উনি একেবারেই জানেন না । পিশেমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “তুমি কী কইত্যাস?”
আমি আমার উত্তরটা বললাম । একটুও সময় নষ্ট   না করে পিশেমশাইএর ঝটিতি জবাব “অর টাই ঠিক । এত কথা কওনের কি আসে?’’
আবার একপ্রস্থ নাটক । অনেক বই টই ঘেঁটে পার্থ জানাল “না , দেখছি আমারটাই ঠিক, এই যে এইখানে লেখা আছে
এবারেও একটুও সময় নষ্ট   না করে পিশেমশাইএর ঝটিতি জবাব “ভুল হইতেই পারে । আর এমন কিছু ভুলও নয় । এত কথা কওনের কি আসে?”
পার্থ র একেবারে নাককান কাটা অবস্থা । প্ল্যান একরকম ভন্ডুল ।

আমার মেজো পিশেমশাই ছিলেন একেবারে উল্টো মেজাজের । মিষ্টি স্বভাব । একেবারেই অ বাঙাল সুলভ মানুষ কে ফাঁসির খাওয়া খাওয়াতে উনি খুব ভাল বাসতেন এটাই একটু আপত্তির ছিল । তাছাড়া পরিবারটি ছিল খুব মানব দরদী । এখনও তাই । পিসতুতো দাদাদের ভাতের থালা ভিখিরির হাতে তুলে দিতেও দেখেছি মেজো পিশেমশাই ভাগলপুরে মেয়ের  বাড়ি বেড়াতে গেছেন । রিকশা নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়ে গেছেন । ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়ায় প্রায় ।
পিশেমশাই জিগ্যেস করেন কত ভাড়া হল ভাই ? সেই সকাল থেকেই ঘুরছেন । রিকশাওলার ভাড়া শুনে তিনি চমকে উঠলেন । এতো কম ? চোখের সামনে রিকশাওলার ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর । মাথার ওপর গনগনে রোদ । পিশেমশাই ভাড়ার টাকা হাতে নিয়ে কাতর ভাবে তার নিজস্ব হিন্দি তে বলে ওঠেন “আচ্ছা রিকশাওলা ,তুমকো ইস ভাড়ামে পোষায় গা তো ?”

কোথায় গেল সেই সব ভেজালহীন ভানহীন নিজস্ব ভাবনা চিন্তার অদ্ভুত মজার মানুষগুলো । যাদের মস্ত পাখার ওমের তলায় আমরা ছানারা কেমন গুটিশুটি মেরে বসে থাকতাম । সেই পাখাগুলো আর নেইতাই আমাদের   আজকাল বড় শীত করে ।
তারা কেমন অনাবিল আনন্দ দিতেন । উপকরণ তেমন ছিলনা কিন্তু অন্তঃকরণের কোন অভাব ঘটেনি । ঠিক এখনকার উল্টোটা । কত কৌতুক , বিস্ময় ,কত বোকা বোকা স্বপ্ন । সেগুলো কুড়িয়ে নেবার মত কেউ নেই আর এখন ।

বৃষ্টি ভেজা রাতে যেন কোথাও ফোটে হাস্নুহেনা
মুঠো তোমার আলগা কর
কেউ থাকে না কেউ থাকে না  (বাসুদেব দেব)


 হাওয়া ফিসফাস । হাওয়া ফিসফাস ।  কিন্তু ওরা বলে ,সে কি কথা ? আমরা আবার গেলাম কোথায় ? বুঝতে পারিস না কেমন হাওয়া হয়ে চুলে বিলি কেটে দিই, রোদ্দুর হয়ে জড়িয়ে ধরি , বৃষ্টি হয়ে তোর বারান্দার ফুল গাছগুলোকে ভিজিয়ে দিই , একটুকরো জ্যোৎস্না হয়ে তোর বিছানায় পড়ে থাকি । কাক হয়ে বিস্কুট খেয়ে যাই , কাঠবিড়ালি হয়ে বাদাম মুড়ি খেয়ে যাই । বুঝতে পারিস না?  
এই সেদিন এক মনোরম শীতের সন্ধ্যায় ডাকসাইটে প্রোফেসর গোপাদি (গোপা দত্তভৌমিক) সন্দেশ পত্রিকায় তার প্রিয় ইন্তাবিলের স্রষ্টা রজনীগন্ধা ফুলের  মত শিবানী  রায়চৌধুরীকে  এতদিন পর প্রথম চাক্ষুষ দেখে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন চলে গেলেন । দেশ কাল সময়  থিওরি অফ রিলেটিভিটি সব ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল ।
আমি ভাবি সত্যিই তাই । এ যেন পূষন দেবের “অনন্ত টানেল”  ।

 হারায় নাই  কিসু ,খুঁজিয়া পাইতাসি না ।  


Sunday 7 December 2014

হলদে পাখির পালক

  
“আজ কি হয়েছে জানো? “ ফোনের ওধারে তাতাই এর উত্তেজিত গলা ।
“কি হয়েছে বলবি তো?”
“পার্ক স্ট্রিটে বাস থেকে নেমে দেখি রুমুদি হনহনিয়ে আসছে ।আমি তো সোজা রাস্তা পেরিয়ে উলটো দিকে সটান হাঁটা দিলাম” ।
“হাঁটা  দিলাম মানে? ওখানেই তো তোর ক্লাস !”
“ হ্যাঁ, ক্লাস তো কি হয়েছে? রুমুদি আসছিল না? একবার ভেবে দেখ ওর সামনে পড়লে আমার অবস্থাটা কী হতে পারত? চুলোয় যাক ক্লাস । জোর বাঁচান বেঁচে গেছি “। এক নিঃশ্বাসে উত্তেজনার পারা চড়িয়ে চড়িয়ে  আমার মামাতো বোন তাতাই কথা শেষ করে ।
এই ছিল আমাদের রুমুদি ।  মামাতো, পিসতুতো , মাসতুতো খুড়তুতো মানে আপামর ভাইবোনদের কাছে রুমুদি ছিল  শুধু ত্রাস নয় সন্ত্রাস ! কারণ খুব সহজ । রুমুদির প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক আর সায়েন্স । সেই সঙ্গে ইংরেজি । আর তার অতিপ্রিয় কাজটা ছিল  ভাইবোনদের মাস্টারি করা । আজ এই সব পারিবারিক কথা ব্লগে লিখে দিচ্ছি জানলে  আজকের ব্যস্ত গিন্নি আর নীহারিকা বুটিকের মালকিন তাতাই ওরফে সুদেষ্ণা হয়তো আমার ওপর একটু চটে যেতে পারে  কিন্তু রুমুদির স্কেচ আঁকতে এটা একেবারে জুতসই উদাহরণ । রুমুদির এই স্বেচ্ছায় ভাইবোনদের মাস্টারি করার ব্যাপারটা সমস্ত অভিভাবকেরাই মানে রুমুদির মাসি , পিসি , মামা কাকার দল সোৎসাহে মেনে নিয়েছিল । রুমুদি  ছিল খুব কড়া  ধাতেরকোন বেয়াদবি সহ্য করা রুমুদির ঠিকুজি কুলুজিতে লেখা ছিল না আর রুমুদির আবির্ভাবে বিচ্ছু বাঁদরের দল যদি একটু ডিসিপ্লিন শেখে সে তো এক অর্থে অতি উত্তম ।  বাবা মা দের খাটুনি  দিন কতক একটু কমে । তা এ হেন রুমুদির  গুডবুকে আমি কী করে ঢুকে গেলাম তার কারণ হয়ত আমার ওই ছোটবেলায় গোপাল নামে এক সুবোধ বালক ছিল গোছের ইমেজ ।  মানুষ কে যাচাই করার আমাদের কতগুলো নিজস্ব প্যারামিটার আছে । খুব নিজস্ব । এগুলো ভাল কি মন্দ সে কু তর্ক তুলে লাভ নেই । তর্ক করে কেই বা  কবে জিততে পেরেছে ? রুমুদির মত জাঁদরেল মেয়ের পছন্দ অপছন্দ বোধ  খুব জোরালো থাকবে সেটাই স্বাভাবিক  । তাই আজ যখন রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমুদিকে দেখতে বসেছি তখন খুব মনে হচ্ছে রুমুদি, নিজস্ব মতামত সম্পন্ন লোকজনদের বেশ পছন্দ করত । আর ভালোবাসত বই পড়তে । ইংরেজি ফিকশন । একটা পায়ের পাতার ওপর আরেকটা পা তুলে দুটো পা একটু নাড়াতে নাড়াতে রুমুদি বই পড়ত ।   ফিকশনের ব্যাপারে রুমুদি এক্কেবারে লেটেস্ট ছিল । বাবাও রুমুদির মারফৎ এক্কেবারে লেটেস্ট হয়ে থাকতে চাইতেন । “রুমু , বইদুটো রেখে যাস তো ,পরের বার দিয়ে  দেব”।  পরের বার সেই বই ফেরত দেওয়া হত কিনা কে জানে ? আমাদের বইএর আলমারি ,র‍্যাকের গায়ে যদিও লেখা থাকত এই বইগুলো বেড়াতে ভাল বাসে না । এদের বিরক্ত করবেন না ।
যে কথা বলছিলাম, রুমুদির  কাউকে ভাল লাগার  আরেকটা মাপকাঠি  ছিল বই পড়া । সেখানেও আমি ফুল মার্কস । পড়ার বইএর বাইরে তখন সারাক্ষণই গল্পের বই । ডাইরিতে অল রেডি দুটো গোয়েন্দা গল্প ।  ক্লাস থ্রি ফোরে তুমি এর থেকে বেশি কি চাও হে? এরপর বাকি রইল ওপিনিয়ন বা স্পষ্ট মতামত ।সুবোধ বালিকা হয়েও আমার নিজস্ব তেজালো মতামতের সব কটা বৃত্তান্ত আমি কয়েকশ বার রুমুদির মুখ থেকেই শুনেছি ।  আমার নিজের কিছু মনে নেই । সেগুলো মোটামুটি এইরকম ।
আমার ঠাকুমা ডালের বড়ি দিতেন । ঝকঝকে থালায় বা ধপধপে সাদা কাপড়ে । আমি নাকি সেগুলো মুখে পুরে দিতাম আর রুমুকে দেখলে খুব গম্ভীর হয়ে বলতাম “উমু কাঁচা বড়ি খায় না” । রুমু আমার গাল টিপে আদর করলে আমি ততোধিক গম্ভীর হয়ে বলতাম “উমুউউউউ, গালে দেয় না” । একজন বিখ্যাত শিশুচিকিৎসক নাকি ভারি বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছিলেন “তোমার নাম মিঠু কে রেখেছে  অ্যাঁ ? তোমার নাম রাখা উচিত তিতু  “ । বিয়ে বাড়িতে কোন এক মহিলা ‘মীরাদির মেয়ে না? কী মিস্টি ! “ এই বলাতে আমি চোখ পাকিয়ে বলেছিলাম “মিস্টি ? তুমি খেয়ে দেখেছ?”আমার এই স্বভাবের জন্য মামা রা আমাকে ধানি লঙ্কা বলে ডাকত । সাইজে ছোট কিন্তু  বেজায় ঝাল ! আর এইসব কারণেই আমি রুমুদির খুব পছন্দের ছিলাম । আমাকে রুমু দি মিঠি বলে ডাকত ।
রুমুদির রেজাল্ট যে সোনা বাঁধানো ছিল তা নয় । তবে সে বরাবরের ভাল ছাত্রী । মাথা খুব সাফ । এত পড়াতে ভালবাসলেও রুমু কিন্তু টিচার ছিল না । ব্যাঙ্কে চাকরি করত । কেমন দীঘল ছিল  তার চেহারা । কী লম্বা ঘন চুল । কেমন মোম রঙা শরীর ,হাত পা দেখলে মনে হত  ভগবান ছাঁচি পান মুখে দিয়ে আয়েশ করে পারিজাত গাছে ঠেস দিয়ে বসে নিপুন ভাবে রুমুর হাত পা তৈরি করেছে । যেন কোন তাড়াহুড়ো নেই । একগাদা ডেলিভারি দিতে হবে না
 রুমু দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাটা বাঁ দিকে সামান্য হেলে থাকত , ছবিতে সেটা খুব বোঝা যেত । বিচ্ছু ভাই বোন গুলো বলত ছটা পাঁচ । তার চলন বলন হাবে ভাবে আমার মনে হত শাবানা আজমিকে দেখছি যেন । রুমুদি অফিস ফেরত আমাদের বাড়ি চলে আসত মাঝে মাঝে । কতো নিবিড় সন্ধ্যেবেলা ঘন হয়ে আসছে এই সব লিখতে লিখতে ,কফির গন্ধ , ফুলকপির শিঙারা , মাংসের চপ । হাসি আড্ডা গান । এবং একটি ত্রস্ত বালক । বার বারই সে ঘুরে ঘুরে দেখে যাচ্ছে, কখনও পর্দার ফাঁক দিয়ে নজর রাখছে আড্ডার আর কতদূর? কারণ এরপরেই রুমু তাকে নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসবে । অঙ্ক কষাবে  একের পর এক ।  এই শনি রবি রুমু থেকে যাবে মনে হচ্ছে । আর মাসি যদি আবদার করে বলে, রুমু এখান থেকে ক’টা দিন অফিস কর না রে । তাহলে আরো দিন তিনেক । ত্রস্ত বালক এক সময় ব্যাকুল ভাবে বলেইফেলে ,”রুমুদি তুই কবে যাবি?”
অমনি  বড়দের হাসির ফোয়ারা । পূষন ওরফে জয়ের সেই ছেলেবেলার বিপজ্জনক দিনগুলো সে নিশ্চয় ভুলতে পারে নি ।
রুমুদির বিয়ে হয়েছিল তার ছোটবোনের পরে । প্রেম ট্রেমের ব্যাপারে হা পিত্তেশ করতে কখনো তাকে দেখিনি । সে ছিল আদ্যন্ত ন্যাকামি বর্জিত  । ছেলেরা তার বন্ধু হলেও কাছাকাছি আসার চেষ্টা করার দুঃসাহস দেখাত না মনে হয় ।
রুমুর মা লীলা , লীলার মা পুষ্প । লীলা আর পুষ্পর কথা মনে হলেই আমি একসঙ্গে জবাকুসুম আর বসন্তমালতীর গন্ধ পাই । দুটি স্নিগ্ধ নারী , ভারি কোমল , শান্ত স্থির । পটে আঁকা চোখ জুড়োনো সুন্দর ।রুমু যদি শাবানা আজমি হয় লীলা তবে অরুন্ধতী দেবী ।  পুষ্পর তো জীবনের অনেকটাই কেটেছে বর্মা মুলুকে ।আমার বাবা, লীলা আর পুষ্পর খুব অনুরাগী ছিলেন । বাবা মুগ্ধ ছিলেন তাঁদের স্বভাবের মাধুর্যে । তারা উঁচু গলায় কথা বলতেন না । নিন্দে করতেন না ।  তাদের  অভিজাত ব্যক্তিত্ব চারদিকে একটা নরম আলো আর সুগন্ধ ছড়িয়ে রাখত তারা দুজনেই অসময়ে অকালে চলে গেছেন ।     
লীলা সিল্কের শাড়ি পরতেন আর মাখতেন গুঁড়ো গুঁড়ো ফেস পাউডার । সেই সব সিল্কের শাড়ি এখন আর পাওয়া যায় নামাখনের মত নরম, যেন মুঠোর মধ্যে ধরা যাবে। অসম্ভব সুন্দর সুন্দর ডিজাইন ।  খুব ফ্যাশানেবল । তিনি ও চাকরি করতেন । খুব স্মার্ট সাজগোজ ছিল । নিউ মার্কেট থেকে রুপুলি ঘুন্টি দেওয়া, লেস ফ্রিল দেওয়া হানি কম্ব করা কি সব  দারুণ ফ্রক কিনতেন নিজের মেয়েদের জন্য আর আমার জন্যেও । একই রকম দেখতে । রুমু সোমার ছোট হয়ে যাওয়া জামা পরে পরেই মানুষ হলাম আমি ।
রুমুর জীবনদর্শনে   বেশ জাঁক জমক  ছিল । সে সাজতে ভাল বাসত । সেও  তার মায়ের মত সিল্কের শাড়িই পরত । বেড়াতে যেতে ভাল বাসত । রান্না করতে ভাল বাসত । ভাল খাবার দাবার উপভোগ করত । সব মিলিয়ে বেশ জম জমাট একটা ব্যাপার । যেন এখুনি সব ফুরিয়ে যাবে তাই সময়টার শেষ বিন্দু পর্যন্ত শুষে নাও । যাবৎ জীবেৎ  সুখং জীবেৎ । ঋণ করে ঘি খাবার দরকার তার কোনদিনই হয় নি কিন্তু কোথায় যেন একটা তাড়া ছিল । ভাই বোন দের বেশ কিছুর  হিল্লে তার হাতেই হয়েছিল । ভাল রেজাল্ট , ভাল চাকরি ।
রুমুর বিয়ে হল । দেদার বেড়ানো ,নতুন ফ্ল্যাট , সাজাও ,  খাও দাও  জিও । বেড়াও । দুটি ছেলে । আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমতে থাকে । আমরাও  তখন নিজেদের বৃত্তে জড়িয়ে পড়ছি ।
এরপর যখন রুমুকে দেখি তখন সে হাসপাতালে শুয়ে । সেই মোম শরীর জুড়ে ছেয়ে আছে অজস্র নল । রক্ত ঘুরপাক খাচ্ছে সেই নলে । ডায়ালিসিস । কিন্তু ম্লান হয়নি ব্যক্তিত্ব । তেমনি সজাগ টনটনে । রুমু নিয়মিত ডায়ালিসিস নিত । পঞ্চাশ পেরিয়েছিল মাত্র ।
এরি মধ্যে এক বিয়ে বাড়িতে গিয়েও হাজির । হাতের শিরা ফুলে উঠেছে । গায়ের রঙের আলো নিভে গেছে ।  মাথার চুল উঠে গেছে ।তবু পরে এসেছে দামি বোমকাই , উৎসবের রোশনাই থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে নি।
এর পর যখন তাকে দেখি সে বিছানায় শুয়ে । এবং সে তখন  ওই ভাবেই থাকে । সারাটা দিন রাত বছরের পর বছর একই ভাবে ।  চোখ দুটো প্রায় নষ্ট ।  শীর্ণ কালো কাঠের মত চেহারা ।অথচ টেলিফোনে চনমনে গলা । কী অদম্য প্রাণশক্তি । নিজের জানা নিয়তিকে নিয়েও ঠাট্টা পরিহাস । সেই যে  কেউ লিখেছিল
“জীবন জীবন করছ কেন? জীবন কোথায় দেখতে পেলে?
নিছক নেহাত মিথ্যে গুজব রটিয়ে গেছে বেয়াক্কেলে”
জীবনকে সত্যিই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল রুমু । তার জেদের কাছে জীবন কিছুটা হার মেনে নিয়েছিল বটে
“মেসো , Tuesdays with Morris পড়ব । এনে দাও “ সে পড়তে পেরেছিল কিনা জানি না ।
ওই বিছানায় শুয়েই রান্নার নজরদারি । রান্নার লোককে একের পর এক রান্না শিখিয়েছে । আর করে গেছে তার সেই প্রিয় কাজ । পড়ানো । হাল ছাড়েনি । চোখের দৃষ্টি তখন প্রায় নেই কিন্তু দুই ছেলের মনিটারিং এ কোন খামতি ছিল না । তারাও জানত মায়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন । মা সব সব সব জানে । কী করে রুমুদি এটা করত আমি ভাবলে অবাক হয়ে যাই ।  দুই ছেলে  একজন এঞ্জিনিয়ার হল, আরেকজন যাদবপুরে ঢুকল । রুমুদি বলল, আমি তবে এবার যেতে পারি ।

রাত কতো হয়েছিল কেউ জানে না । দেড় টা বা দুটো । কাউকে কিছু না বলে অজস্র জোনাকিজ্বলা রাতে ভিজে ঘাসে ঘাসে পা ফেলে রুমুদি চলে গেল । সে পথের শেষে  শান্ত ভোরের আলোয় রুমুর জন্য বসন্ত মালতীর গন্ধ মেখে  দাঁড়িয়ে ছিল  লীলা আর পুষ্প ।