“আজ কি হয়েছে জানো?
“ ফোনের ওধারে তাতাই এর উত্তেজিত গলা ।
“কি হয়েছে বলবি তো?”
“পার্ক স্ট্রিটে বাস থেকে নেমে দেখি রুমুদি হনহনিয়ে আসছে ।আমি তো সোজা রাস্তা
পেরিয়ে উলটো দিকে সটান হাঁটা দিলাম” ।
“হাঁটা দিলাম মানে? ওখানেই তো তোর
ক্লাস !”
“ হ্যাঁ, ক্লাস তো কি হয়েছে? রুমুদি আসছিল না? একবার ভেবে দেখ ওর সামনে পড়লে
আমার অবস্থাটা কী হতে পারত? চুলোয় যাক ক্লাস । জোর বাঁচান বেঁচে গেছি “। এক
নিঃশ্বাসে উত্তেজনার পারা চড়িয়ে চড়িয়ে আমার মামাতো বোন তাতাই কথা শেষ করে ।
এই ছিল আমাদের রুমুদি । মামাতো, পিসতুতো
, মাসতুতো খুড়তুতো মানে আপামর ভাইবোনদের কাছে রুমুদি ছিল শুধু ত্রাস নয় সন্ত্রাস ! কারণ খুব সহজ ।
রুমুদির প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক আর সায়েন্স । সেই সঙ্গে ইংরেজি । আর তার অতিপ্রিয়
কাজটা ছিল ভাইবোনদের মাস্টারি করা । আজ এই
সব পারিবারিক কথা ব্লগে লিখে দিচ্ছি জানলে
আজকের ব্যস্ত গিন্নি আর নীহারিকা বুটিকের মালকিন তাতাই ওরফে সুদেষ্ণা হয়তো
আমার ওপর একটু চটে যেতে পারে কিন্তু
রুমুদির স্কেচ আঁকতে এটা একেবারে জুতসই উদাহরণ । রুমুদির এই স্বেচ্ছায় ভাইবোনদের
মাস্টারি করার ব্যাপারটা সমস্ত অভিভাবকেরাই মানে রুমুদির মাসি , পিসি , মামা কাকার
দল সোৎসাহে মেনে নিয়েছিল । রুমুদি ছিল খুব
কড়া ধাতের । কোন বেয়াদবি সহ্য করা রুমুদির ঠিকুজি কুলুজিতে লেখা ছিল না । আর রুমুদির আবির্ভাবে বিচ্ছু বাঁদরের দল যদি একটু
ডিসিপ্লিন শেখে সে তো এক অর্থে অতি উত্তম । বাবা মা দের খাটুনি দিন কতক একটু কমে । তা এ হেন রুমুদির গুডবুকে আমি কী করে ঢুকে গেলাম তার কারণ হয়ত
আমার ওই ছোটবেলায় গোপাল নামে এক সুবোধ বালক ছিল গোছের ইমেজ । মানুষ কে যাচাই করার আমাদের কতগুলো নিজস্ব
প্যারামিটার আছে । খুব নিজস্ব । এগুলো ভাল কি মন্দ সে কু তর্ক তুলে লাভ নেই । তর্ক
করে কেই বা কবে জিততে পেরেছে ? রুমুদির মত
জাঁদরেল মেয়ের পছন্দ অপছন্দ বোধ খুব জোরালো
থাকবে সেটাই স্বাভাবিক । তাই আজ যখন রিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমুদিকে দেখতে বসেছি তখন খুব
মনে হচ্ছে রুমুদি, নিজস্ব মতামত সম্পন্ন লোকজনদের বেশ পছন্দ করত । আর ভালোবাসত বই
পড়তে । ইংরেজি ফিকশন । একটা পায়ের পাতার ওপর আরেকটা পা তুলে দুটো পা একটু নাড়াতে
নাড়াতে রুমুদি বই পড়ত । ফিকশনের ব্যাপারে রুমুদি এক্কেবারে লেটেস্ট ছিল
। বাবাও রুমুদির মারফৎ এক্কেবারে লেটেস্ট হয়ে থাকতে চাইতেন । “রুমু , বইদুটো রেখে
যাস তো ,পরের বার দিয়ে দেব”। পরের বার সেই বই ফেরত দেওয়া হত কিনা কে জানে ?
আমাদের বইএর আলমারি ,র্যাকের গায়ে যদিও লেখা থাকত এই বইগুলো বেড়াতে ভাল বাসে না ।
এদের বিরক্ত করবেন না ।
যে কথা বলছিলাম, রুমুদির কাউকে ভাল
লাগার আরেকটা মাপকাঠি ছিল বই পড়া । সেখানেও আমি ফুল মার্কস । পড়ার
বইএর বাইরে তখন সারাক্ষণই গল্পের বই । ডাইরিতে অল রেডি দুটো গোয়েন্দা গল্প । ক্লাস থ্রি ফোরে তুমি এর থেকে বেশি কি চাও হে?
এরপর বাকি রইল ওপিনিয়ন বা স্পষ্ট মতামত ।সুবোধ বালিকা হয়েও আমার নিজস্ব তেজালো
মতামতের সব কটা বৃত্তান্ত আমি কয়েকশ বার রুমুদির মুখ থেকেই শুনেছি । আমার নিজের কিছু মনে নেই । সেগুলো মোটামুটি
এইরকম ।
আমার ঠাকুমা ডালের বড়ি দিতেন । ঝকঝকে থালায় বা ধপধপে সাদা কাপড়ে । আমি নাকি
সেগুলো মুখে পুরে দিতাম আর রুমুকে দেখলে খুব গম্ভীর হয়ে বলতাম “উমু কাঁচা বড়ি খায়
না” । রুমু আমার গাল টিপে আদর করলে আমি ততোধিক গম্ভীর হয়ে বলতাম “উমুউউউউ, গালে
দেয় না” । একজন বিখ্যাত শিশুচিকিৎসক নাকি ভারি বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছিলেন “তোমার
নাম মিঠু কে রেখেছে অ্যাঁ ? তোমার নাম
রাখা উচিত তিতু “ । বিয়ে বাড়িতে কোন এক
মহিলা ‘মীরাদির মেয়ে না? কী মিস্টি ! “ এই বলাতে আমি চোখ পাকিয়ে বলেছিলাম “মিস্টি
? তুমি খেয়ে দেখেছ?”আমার এই স্বভাবের জন্য মামা রা আমাকে ধানি লঙ্কা বলে ডাকত ।
সাইজে ছোট কিন্তু বেজায় ঝাল ! আর এইসব
কারণেই আমি রুমুদির খুব পছন্দের ছিলাম । আমাকে রুমু দি মিঠি বলে ডাকত ।
রুমুদির রেজাল্ট যে সোনা বাঁধানো ছিল তা নয় । তবে সে বরাবরের ভাল ছাত্রী ।
মাথা খুব সাফ । এত পড়াতে ভালবাসলেও রুমু কিন্তু টিচার ছিল না । ব্যাঙ্কে চাকরি করত
। কেমন দীঘল ছিল তার চেহারা । কী লম্বা ঘন
চুল । কেমন মোম রঙা শরীর ,হাত পা দেখলে মনে হত
ভগবান ছাঁচি পান মুখে দিয়ে আয়েশ করে পারিজাত গাছে ঠেস দিয়ে বসে নিপুন ভাবে
রুমুর হাত পা তৈরি করেছে । যেন কোন তাড়াহুড়ো নেই । একগাদা ডেলিভারি দিতে হবে না ।
রুমু দাঁড়িয়ে থাকলে মাথাটা বাঁ দিকে
সামান্য হেলে থাকত , ছবিতে সেটা খুব বোঝা যেত । বিচ্ছু ভাই বোন গুলো বলত ছটা পাঁচ
। তার চলন বলন হাবে ভাবে আমার মনে হত শাবানা আজমিকে দেখছি যেন । রুমুদি অফিস ফেরত
আমাদের বাড়ি চলে আসত মাঝে মাঝে । কতো নিবিড় সন্ধ্যেবেলা ঘন হয়ে আসছে এই সব লিখতে
লিখতে ,কফির গন্ধ , ফুলকপির শিঙারা , মাংসের চপ । হাসি আড্ডা গান । এবং একটি
ত্রস্ত বালক । বার বারই সে ঘুরে ঘুরে দেখে যাচ্ছে, কখনও পর্দার ফাঁক দিয়ে নজর
রাখছে আড্ডার আর কতদূর? কারণ এরপরেই রুমু তাকে নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসবে । অঙ্ক কষাবে একের পর এক । এই শনি রবি রুমু থেকে যাবে মনে হচ্ছে । আর মাসি
যদি আবদার করে বলে, রুমু এখান থেকে ক’টা দিন অফিস কর না রে । তাহলে আরো দিন তিনেক
। ত্রস্ত বালক এক সময় ব্যাকুল ভাবে বলেইফেলে ,”রুমুদি তুই কবে যাবি?”
অমনি বড়দের হাসির ফোয়ারা । পূষন ওরফে
জয়ের সেই ছেলেবেলার বিপজ্জনক দিনগুলো সে নিশ্চয় ভুলতে পারে নি ।
রুমুদির বিয়ে হয়েছিল তার ছোটবোনের পরে । প্রেম ট্রেমের ব্যাপারে হা পিত্তেশ
করতে কখনো তাকে দেখিনি । সে ছিল আদ্যন্ত ন্যাকামি বর্জিত । ছেলেরা তার বন্ধু হলেও কাছাকাছি আসার চেষ্টা
করার দুঃসাহস দেখাত না মনে হয় ।
রুমুর মা লীলা , লীলার মা পুষ্প । লীলা আর পুষ্পর কথা মনে হলেই আমি একসঙ্গে
জবাকুসুম আর বসন্তমালতীর গন্ধ পাই । দুটি স্নিগ্ধ নারী , ভারি কোমল , শান্ত স্থির
। পটে আঁকা চোখ জুড়োনো সুন্দর ।রুমু যদি শাবানা আজমি হয় লীলা তবে অরুন্ধতী দেবী । পুষ্পর তো জীবনের অনেকটাই কেটেছে বর্মা মুলুকে ।আমার
বাবা, লীলা আর পুষ্পর খুব অনুরাগী ছিলেন । বাবা মুগ্ধ ছিলেন তাঁদের স্বভাবের
মাধুর্যে । তারা উঁচু গলায় কথা বলতেন না । নিন্দে করতেন না । তাদের অভিজাত ব্যক্তিত্ব চারদিকে একটা নরম আলো আর
সুগন্ধ ছড়িয়ে রাখত । তারা দুজনেই
অসময়ে অকালে চলে গেছেন ।
লীলা সিল্কের শাড়ি পরতেন আর মাখতেন গুঁড়ো গুঁড়ো ফেস পাউডার । সেই সব সিল্কের
শাড়ি এখন আর পাওয়া যায় না । মাখনের মত নরম, যেন মুঠোর মধ্যে ধরা যাবে। অসম্ভব সুন্দর
সুন্দর ডিজাইন । খুব ফ্যাশানেবল । তিনি ও
চাকরি করতেন । খুব স্মার্ট সাজগোজ ছিল । নিউ মার্কেট থেকে রুপুলি ঘুন্টি দেওয়া,
লেস ফ্রিল দেওয়া হানি কম্ব করা কি সব দারুণ ফ্রক কিনতেন নিজের মেয়েদের জন্য আর আমার
জন্যেও । একই রকম দেখতে । রুমু সোমার ছোট হয়ে যাওয়া জামা পরে পরেই মানুষ হলাম আমি
।
রুমুর জীবনদর্শনে বেশ জাঁক জমক ছিল । সে সাজতে ভাল বাসত । সেও তার মায়ের মত সিল্কের শাড়িই পরত । বেড়াতে যেতে
ভাল বাসত । রান্না করতে ভাল বাসত । ভাল খাবার দাবার উপভোগ করত । সব মিলিয়ে বেশ জম
জমাট একটা ব্যাপার । যেন এখুনি সব ফুরিয়ে যাবে তাই সময়টার শেষ বিন্দু পর্যন্ত শুষে
নাও । যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ । ঋণ করে ঘি
খাবার দরকার তার কোনদিনই হয় নি কিন্তু কোথায় যেন একটা তাড়া ছিল । ভাই বোন দের বেশ
কিছুর হিল্লে তার হাতেই হয়েছিল । ভাল
রেজাল্ট , ভাল চাকরি ।
রুমুর বিয়ে হল । দেদার বেড়ানো ,নতুন ফ্ল্যাট , সাজাও , খাও দাও জিও । বেড়াও । দুটি ছেলে । আস্তে আস্তে যোগাযোগ
কমতে থাকে । আমরাও তখন নিজেদের বৃত্তে
জড়িয়ে পড়ছি ।
এরপর যখন রুমুকে দেখি তখন সে হাসপাতালে শুয়ে । সেই মোম শরীর জুড়ে ছেয়ে আছে
অজস্র নল । রক্ত ঘুরপাক খাচ্ছে সেই নলে । ডায়ালিসিস । কিন্তু ম্লান হয়নি
ব্যক্তিত্ব । তেমনি সজাগ টনটনে । রুমু নিয়মিত ডায়ালিসিস নিত । পঞ্চাশ পেরিয়েছিল
মাত্র ।
এরি মধ্যে এক বিয়ে বাড়িতে গিয়েও হাজির । হাতের শিরা ফুলে উঠেছে । গায়ের রঙের
আলো নিভে গেছে । মাথার চুল উঠে গেছে ।তবু
পরে এসেছে দামি বোমকাই , উৎসবের রোশনাই থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে নি।
এর পর যখন তাকে দেখি সে বিছানায় শুয়ে । এবং সে তখন ওই ভাবেই থাকে । সারাটা দিন রাত বছরের পর বছর
একই ভাবে । চোখ দুটো প্রায় নষ্ট । শীর্ণ কালো কাঠের মত চেহারা ।অথচ টেলিফোনে চনমনে
গলা । কী অদম্য প্রাণশক্তি । নিজের জানা নিয়তিকে নিয়েও ঠাট্টা পরিহাস । সেই
যে কেউ লিখেছিল
“জীবন জীবন করছ কেন? জীবন কোথায় দেখতে পেলে?
নিছক নেহাত মিথ্যে গুজব রটিয়ে গেছে বেয়াক্কেলে”।
জীবনকে সত্যিই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল রুমু । তার জেদের কাছে জীবন কিছুটা হার
মেনে নিয়েছিল বটে।
“মেসো , Tuesdays with
Morris পড়ব । এনে দাও “ সে পড়তে পেরেছিল কিনা জানি না ।
ওই বিছানায় শুয়েই রান্নার নজরদারি । রান্নার লোককে একের পর এক রান্না শিখিয়েছে
। আর করে গেছে তার সেই প্রিয় কাজ । পড়ানো । হাল ছাড়েনি । চোখের দৃষ্টি তখন প্রায়
নেই কিন্তু দুই ছেলের মনিটারিং এ কোন খামতি ছিল না । তারাও জানত মায়ের হাত থেকে
রেহাই পাওয়া কঠিন । মা সব সব সব জানে । কী করে রুমুদি এটা করত আমি ভাবলে অবাক হয়ে
যাই । দুই ছেলে একজন এঞ্জিনিয়ার হল, আরেকজন যাদবপুরে ঢুকল ।
রুমুদি বলল, আমি তবে এবার যেতে পারি ।
রাত কতো হয়েছিল কেউ জানে না । দেড় টা বা দুটো । কাউকে কিছু না বলে অজস্র
জোনাকিজ্বলা রাতে ভিজে ঘাসে ঘাসে পা ফেলে রুমুদি চলে গেল । সে পথের শেষে শান্ত ভোরের আলোয় রুমুর জন্য বসন্ত মালতীর গন্ধ
মেখে দাঁড়িয়ে ছিল লীলা আর পুষ্প ।
জবাকুসুম।বসন্তমালতী।আহা।
ReplyDeleteঅনুরাধা ভাল থাকুন , ব্লগে এসে দুদন্ড বসুন ।
ReplyDeleteঅনুরাধা ভাল থাকুন , ব্লগে এসে দুদন্ড বসুন ।
ReplyDelete