Friday 24 June 2016

আয়েশা


ধীরেন্দ্র এস জাফা ভারতীয় বায়ু সেনার ফাইটার পাইলট এবং উইং কমান্ডার ছিলেন । ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়  তিনি পাকিস্তানের হাতে যুদ্ধবন্দী হন । পরে মুক্তি পাবার পর তাঁকে বীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয় । বন্দীদশার সেই কাহিনি তিনি লিখছেন তাঁর  Death Wasn’t Painful  বইটিতে । এই বইটির  ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদ টির নাম   
 ” আয়েশা” ।
তাঁর পরিবারের সম্মতি নিয়ে সেই পরিচ্ছেদটির কিছু অংশ অনুবাদ করা হল ।
য়েকমাস পরের কথা খুব গরম ছিল সেদিন   একেবারে ভোরবেলায়  ধীরেন্দ্রর জেলকুঠরির  লোহার গ্রিল দরজাটা গার্ড এসে খু লে দিল অথচ এমনটা হবার কথা নয় শুধুমাত্র বাথরুমে যাবার দরকার হলেই দরজাটা খোলা হয়    ধী রেন্দ্র তাই একটু সতর্ক হয়ে বসলো   ভোরবেলার আলো আঁধারির মধ্যে ভুতুড়ে একটা চেহারা কুঠরির মধ্যে সেঁধিয়ে এলো কে এটা ? ওহ সেই অফিসার ,মুমতাজ ।
“দূর ছাই,যাচ্ছেতাই একেবারে ”, রাগে গরগর  করতে করতে নিজের মনেই বলতে থাকে মুমতাজ , এদিকে গলা চড়িয়ে হাঁক ছাড়ে ,  “সুপ্রভাত” ও পাশ থেকে কোনও উত্তরই এলো না এক মিনিট ধী রেন্দ্রর  চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে , তারপর হিসহিসিয়ে বলে ওঠে “আমি তোমার নাড়ি নক্ষত্র জানি ”
খুব মৃদু গলায় ধী রেন্দ্র বলে “এ কথা তো আগেও বলেছেন “
“হ্যাঁ , আমাদের বড়কর্তারা জানেন না বটে , কিন্তু আমি জানি , সব জানি “ ক্ষোভ গলায় ঝরে পড়ছে মুমতাজের   “ তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে গেছিলে যখন কয়েদ এ আজম , ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে র ডাক দিলেন তোমরা সবাই বিরুদ্ধে ছিলে, আমাদের জমি  বাড়ি  বেচা , আমাদের সব কিছুতে বাধা দিয়েছিলে কিন্তু বন্ধ করতে পেরেছ কিছু ? দেখো , ভালো করে দেখো , আমরা কত ভালো আছি বাড়ি আর জমি বেচে ভালো দাম পেয়েছি আর নিজেদের মুলুকে চলে আসতে পেরেছি তোমরা কিসসু করতে পারো নি ইনশা আল্লাহ্‌ “
ধী রেন্দ্র মনের গভীরে তলিয়ে ভাবতে থাকে এ কে ? এ কে হতে পারে? তার শহরের ওপর তলার মুসলমানেরা বেশির ভাগই পাকিস্তানে চলে গেছিল ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে , লুঠ তরাজ , মারামারি দাঙ্গা , দুই ধর্ম গোষ্ঠীর বিরোধ শুরু হয়েছিল  সম্ভ্রান্ত লোকেরা সম্পত্তি জমি বেচে ভালোরকম পয়সা নিয়ে নতুন দেশে চলে গিয়ে বেশ জমিয়ে বসেছিল এরা সবাই প্রায় সমাজের উঁচু তলার লোক  , আর এইসব দাঙ্গা হাঙ্গামায়  লুঠপাটে যাদের ব্যাবহার করা হয়েছিল সেই নিচুতলার লোকগুলো তাদের পুরনো মহল্লাতেই রয়ে গেছিল মুমতাজ ওইরকমই বড়লোক বাড়ির কেউ হবে হয়তো ধী রেন্দ্র খুব করে ভাবতে থাকে , যদি কোনও সূত্র পাওয়া যায় , যদি সেও একদিন তার চোখে চোখ রেখে বলতে পারে ,” আমি তোমার নাড়ি নক্ষত্র সব জানি “



জল যেমন তার স্তর সমান  রাখে , সমাজটাও তেমনি মেলামেশা সব   সমানে সমানে হিন্দু জমিদার আর মুসলমান জমিদার , দুই ধর্মের কবি লেখক শিল্পী ,আবার দুই গোষ্ঠীর আমুদে আয়েসি শৌখিন  আবার খেটে খাওয়া বিড়ি ফোঁকার দল একসঙ্গে  বসে মহাজনের চড় থাপ্পড় , ফসল , জল বৃষ্টি নিয়ে গুলতানি করত পণ্ডিত আর মোল্লার দল গোল হয়ে বসে লোকজন সব উচ্ছন্নে গেল , কারুর কিছু বিশ্বাস , ধম্ম কম্ম নেই ,এই নিয়েই আলোচনা করে চলত এইসব মিলেজুলে থাকতে থাকতেই সাম্প্রদায়িক উষ্মা বা মন কষাকষি খুব মাথা চাড়া দিতে পারত না কিন্তু সব ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করল ,ভিন্ন দেশের প্রস্তাব এলো , একটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের হাওয়া যেন সব কিছুকে ঘিরে ফেলতে লাগল
ছোটবেলায় ,ধীরেন্দ্রর  বেশ মনে আছে ,তারা প্রতিবেশী  মুসলিম ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশত মাসুদদের বাড়িতে ভালোই যাতায়াত ছিল নানান ছলছুতোর মধ্যে একটা ছিল দূর থেকে ঘারারার ঢেউ তোলা সেই মেয়েটিকে একবার শুধু একবারের জন্য দেখা
তারপরে আচমকা সেই খবরটা এলো  মাসুদরা রাতের অন্ধকারে শহর ছেড়ে চলে গেছে কেউ বলল আলি গড় কেউ বলল পাকিস্তান কিছুদিন পরে ওদের আত্মীয়দের,   যাদের খুব বেশি পয়সার জোর ছিল না  তাদের কাছ থেকে জানা গেল ওরা করাচি   চলে গেছে  এরপর থেকে ধীরেন্দ্র ওদের প্রতিটি খবর জানবার জন্য  একরকম মুখিয়ে থাকত , বিশেষ করে একজনের খবর  বছর ঘুরতে খবর পেল মাসুদদের বড় মেয়ের পাকিস্তান এয়ার ফোরসের কোন এক অফিসারের সঙ্গে নিকাহ হয়ে গেছে তারপর থেকে ওদের কোন খবর আর রাখত না সে  
আজ চকিতেই  তার  চোখ সরু হয়ে এলো , মুমতাজের দিকে সটান তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল , “আয়েশা  ?”
মুমতাজ কিছুই না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল

  ৩                                
আয়েশা   , ঘারারার ঢেউ তোলা সেই মেয়ে ,কালো মিশমিশে চুলে হালকা করে বাঁধা  মোটা বিনুনি ,মাখন আর পিচ রঙা সেই মেয়ে মিশন স্কুল আলো করে থাকত
সবাই হাঁ করে সেই সুন্দর মুখ খানার দিকে তাকিয়ে থাকত , বড় বড় কাজল টানা চোখ কখনো সখনো ধীরেন্দ্রর ওপর এসে পড়ত ,আবার অনেকটাই ধী রেন্দ্র নিজে থেকে ভেবে নিতেও  ভালোবাসতো
মিশন স্কুলে নানা রকমের ফাংশান হত কবিতা নাটক গান কিন্তু সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ছেলেমেয়েদের বিতর্ক সেবারে বিষয় ছিল “মেয়েদের স্থান গৃহকোণে “
ডায়াসের ওপর ছেলেমেয়েদের  আলাদা আলাদা  লাইন করে দাঁড়াতে হত   সেই দিন কয়েকজনের পরে এলো আয়েশার ডাক   আলো ছড়িয়ে এসে দাঁড়ালো সেই মাখন পিচ ফল রঙা মেয়ে সবাই তাকিয়ে আছে হাঁ করে হাঁটু থেকে কপাল পর্যন্ত হাত তুলে অভিজাত ভঙ্গিতে কোমর ঝুঁকিয়ে লম্বা বিনুনি দুলিয়ে কোহল মাখা দুটি চোখ তুলে  দর্শকদের বলল “আ-দা- ব “ তারপর তার ঝঙ্কারময় সুন্দর গলায় তার বক্তব্য রাখল  , শুনেই মনে হল খুব যত্ন করে অনেক খেটে নিজেকে এই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করেছে কে জিতবে তার ফয়সালা যেন হয়েই আছে , শুধু নাম ঘোষণার অপেক্ষায় ধীরেন্দ্র চোখ ফেরাতে পারছিল না যেন তার ঘোর লেগেছে , জাদু করেছে কেউ তাকে
 এবারে ধীরেন্দ্রর পালা আসে ডায়াসে উঠে সে  বলতে  শুরু করে “ মাননীয় বিচারপতিগণ , অভিভাবক “এবং    ‌,” বলতে বলতে ডানদিকে চোরা চাউনি দেয়  আর কোহল চোখ তার সব শক্তি শুষে নেয় গলা শুকিয়ে কাঠ দর্শকদের মধ্যে ততক্ষণে গুনগুনানি শুরু হয়ে গেছে , টিচাররা কঠিন ভাবে তাকিয়ে আছে , লজ্জায় লাল হয়ে তোতলাতে তোতলাতে ধীরেন্দ্র বলে “আমার   ‌,আমার  আর  কিছু  মনে পড়ছে না “ ধুপধাপ করে স্টেজ থেকে নেমে অন্ধকারে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে লজ্জায়  ধিক্কারে নাস্তানাবুদ অল্প কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা ধীরেন্দ্রর  পাশ দিয়ে হেঁটে গেল সেই রানি সাহিবা , হাতে ঝকঝক করছে বিজেতার পুরস্কার মস্ত বড় একটা কাপ ।
এর পর থেকে আয়েশার ভাই এর সঙ্গে ভাব পাতায় ধী রেন্দ্র নানান ছলছুতোয় ও বাড়িতে যায় , হোলি আর ঈদ এর জন্য অধীর অপেক্ষা কারণ এই দুটো পার্বণে খুব মেলামেশা হত আর ছিল তিজ হিন্দু মুসলিম মেয়েরা নিজেদের বাড়ির বাগানে আমগাছে ঝুলায় দোল খেতো আর ছেলেদের কাজ ছিল গাছে দড়ি বাঁধা , আর পেছন থেকে দোলনা ঠেলে দোল দেওয়া
তারপর যে কথা থেকে কি হয়ে হেল একটা উদ্ভ্রান্ত সময় গিলে নিলো সব কিছু এলো নতুন দেশের দাবি, দেশ ভাগ জীবন যাপন , সংস্কৃতি, সমাজ জীবনে সম্ভ্রমবোধের যে একটা পারস্পরিক মেলবন্ধন ছিল সে টা কেমন যেন ঘোঁট পাকিয়ে গেল আর   মানবিকতার ঘোরতর  পচনের মধ্যে একদিন হঠাৎ  মাসুদরা চলে গেল
 ৪
কিছুদিন বাদে মুমতাজ জেলখানায়  এলো বেশ অস্থির এবং বিরক্ত এসেই ধীরেন্দ্রর দিকে সেই নিয়ম মাফিক চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকল তারপর শুরু করল একটা বিরাট স্বগতোক্তি “মগজ বুদ্ধি কল্পনা সবই আমাদের আছে ‌   , পাটনা থেকে লখনউ , ইলাহাবাদ থেকে আলিগড় , বেরিলি  থেকে ভোপাল সর্বত্র  , ইত্যাদি ইত্যাদি  
ধীরেন্দ্র বিমর্ষ ভাবে বলে ওঠে “ আপনি এভাবে বলছেন কেন? এভাবে ভাবছেনই বা কেন? আপনারা তো দেশ পেয়েছেন , সবকিছুই পেয়েছেন তাহলে আর সমস্যা কোথায়? “
“তুমি বুঝবে না “, দুম করে উঠে দাঁড়ালো মুমতাজ ধী রেন্দ্র তার পথ আটকে দাঁড়াল ,জিজ্ঞেস করল ,”আয়েশা কেমন আছে?”
ধীরেন্দ্রকে আর কিচ্ছু বলার সুযোগ না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুমতাজ
পরের দিন এসে ধীরেন্দ্রকে হতবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ,”আমির চাঁদ রা এখনো আছে ? আর সেই জজ সাহেব , ব্রিজ নারায়ণ ?”
ধীরেন্দ্রর কাছে ব্যাপারটা এবারে পরিষ্কার হল এতদিনের এই রাগ টা মুমতাজ বেশ মাথা খাটিয়ে ভেবেচিন্তে দেখিয়ে এসেছে ,তাতে হৃদয়ের সমর্থন ছিল না হয়তো সেই ভেজা  শৈশব , নরম কৈশোর , সেই সব বড় হওয়ার দিনের মন ভালো  করা স্মৃতির ঝাঁপি , তার ফেলে আসা দিন তাকে বীরেন্দ্রর কাছে টেনে এনেছিল , ভালবাসা এবং তাচ্ছিল্য দুটোই মেশানো ছিল তাতে কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো মুমতাজ আবার শুরু করে দিল তার রাগ ঝাঁঝ মেশানো কথাগুলো ধী রেন্দ্রর মন আর এসবের মধ্যে ছিল না এই সব অর্থহীন এবং অন্তহীন  তর্ক বিতর্কে  তার আর কোন সায় নেই এতদিন ধরে যে কথাটা বলি বলি করে বলা হয়ে ওঠেনি এবারে সে বলেই ফেলল ,” আমি আয়েশার সঙ্গে দেখা করতে পারি?  একবার মাত্র একবারের জন্য?”
মুমতাজ তাকিয়ে রইল তারপর কি যেন ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ধী রেন্দ্রর মন তোলপাড় মুমতাজ কি রেগে গেল? তার অনুরোধটা কি ও ভালো মনে নিতে পারল? কি জানি? হয়তো হ্যাঁ , হয়তো  বা ,না


মুমতাজ তার রুটিন ভাঙল একদিন এলো বিকেলবেলা শুধু তাই নয় , জেলকুঠরির বাইরে অফিসঘরে তাকে ডেকে পাঠাল মুমতাজ চেয়ারে বসে      ধী রেন্দ্রকে একটা চেয়ার দেখিয়ে ইশারায় বসতে বলল মুমতাজ কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়ে একটা পুলিশ দুমদাম করে ঘরে ঢুকে মুমতাজের কানে কানে কি সব ফিসফিস করে বলতে শুরু করল   মুমতাজ ব্যাস্তভাবে উঠে দাঁড়াল, যেন এখখুনি বেরিয়ে যাবে
“একজন সিনিয়র অফিসর এসেছেন এখানকার আরেঞ্জমেন্ট দেখতে ,আমি আর এক মিনিট ও এখানে থাকতে পারব না “ মুমতাজ দৌড়ে বেরিয়ে গেল পুলিশটা ধীরেন্দ্রকে কুঠরিতে ফিরে যেতে বলল ঘর থেকে বেরিয়েই সে  শুনতে পেল একটা গাড়ির  স্টার্ট দেবার শব্দ  , একটা বাঁক নিতেই গাড়িটাকে সে পরিষ্কার দেখতে পেল গাড়িটা চলে যাচ্ছে  ,‌গাড়ির জানালাটা ,  জানালার ওপাশে সেই মাখন পিচ রঙা মুখ , কাঁধ বেয়ে নেমে আসা মোটা বিনুনি , কোহল কালো দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্ত , হতচকিত ,স্মৃতি মেদুর
হতভম্ব ধী রেন্দ্র হাত তুলে বলতে চাইল থামো থামো ,একটু দাঁড়াও ,আমি আসছি
গাড়ি স্পিড নিয়ে বেরিয়ে গেল আবার আয়েশা হারিয়ে গেল তার কাছ থেকে