অফিস যেতে আসতে রাস্তার দুধারে
ডান দিকে বাঁদিকে ওপর দিকে তির চিহ্ন দিয়ে
নানা জায়গার নাম হুশহাশ পেরিয়ে যায় ।
I S B T । আনন্দবিহার I S B T, কাশ্মিরি
গেট I S B T, সরায় কালু খাঁ I S B T । কালু
খাঁ টা আবার কে? মোগল আমলে কোন সরাইখানার মালিক হবে হয়ত । সে যাক গে , দেখছ কান্ড ! এতো গুলো I S B
T ! মানে Inter
state bus terminal ।
আমি তো জানতাম
একটাই আছে এ শহরে । শুধু
এইটুকুই খালি ভেবেছি , অমনি মাথার মধ্যে গুটিকয়েক
ফচকে জোনাকি ফিচেল হেসে চোখ মটকে বলল মনে পড়ছে
? তোমার সেই বোকামির কীর্তি কাহিনীগুলো ?
সেবারে হোল কি আমার আর যশোধরার মনে হল কলকাতা থেকে শিমলা এই মরুতীর্থ হিংলাজের
মত লম্বা জার্নিটাকে একটু কেটে ছেঁটে স্ট্রিমলাইন্ড
করা যাক । উদ্দেশ্য একটাই, যতটা বেশি সময় কলকাতায় থাকা যায় । তখন তো আর
ট্রেনিং থেকে কথায় কথায় ছুটি পেতাম না ।
এমনিতে আমরা চিড়ে গুড় বেঁধে নিয়ে মোটামুটি তিন দিনের জন্য দুগ গা বলে হাওড়া
কালকায় চেপে বসতাম । তারপর কখন
পৌঁছাবে দেখা যাক । কিন্তু সেবারে
ঠিক হল যে আমরা রাজধানীতে করে দিল্লি যাব
,সেখান থেকে বাসে করে শিমলা । রানাঘাট , কলকাতা , তিব্বত ব্যাস ।
এতে আমাদের সময় অনেকটা বাঁচবে ।
দিল্লি নেমে I S B T থেকে বাস ধরে নিলেই হবে । সোজা
ব্যাপার । তখন আমরা খুব ছিমছাম চিন্তা ভাবনা করতাম । এতো যন্ত্রপাতিও ছিল না ,এতো
জটিলতাও ছিল না । আঙ্গুলের ডগায় এতো
ইনফরমেশন ছিল না ।
ঠিকঠাকই এগুচ্ছিল । দিল্লি নেমে একটা
কুলি ধরা গেল । না হলে উপায় নেই । আমরা একটা ব্যাগ নিয়ে বাড়ি যেতাম , ফিরতাম তিনটে
নিয়ে ।
কুলির মাথায় , ঘাড়ে হাতে মাল পত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হল । সবার ওপরে রইল ধুসো রঙের
ভুসকো একটা ব্যাগ । ব্যাগটা কার ছিল এখন আর মনে নেই ।
আমি কুলিটাকে পই পই করে বলে দিলাম আহিস্তা চলিয়ে । জরা আহিস্তা চল । আর ওই বাঁধ
ভাঙা জনসমুদ্রে আমার নিশানা ওই ধুসো রঙের ভুসকো
ব্যাগ , যেটা শাকের আঁটির মত সবার ওপরে দেখা যাচ্ছে । আমরা এগুচ্ছি । চলছি
চলছি । চোখের সামনে কুলি,কুলির মাথায় ব্যাগ ।
হঠাত কী হল জানিনা , কয়েক সেকেন্ডের এদিক ওদিক হবে । আমার চারদিকে শুধু কালো
কালো মাথা , যশোধরা নেই , কুলি নেই , ধুসো রঙের ভুসকো ব্যাগটা ? এবার কী হবে?
আমি অসহায় ভাবে এদিক ওদিক দেখতে থাকি । না কাউকে দেখা যাচ্ছে না । ভিড়ের ঠ্যালায় তখন নাজেহাল অবস্থা । কুলিটা কোন
গেট দিয়ে বের হবে সেটাও তো জানি না । এখানে তো আবার অনেক গুলো গেট আছে । কী আপদ ! এখন কী করি?
বেশ নার্ভাস লাগছে । কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে ক্যাবলামি করলে আরো গন্ডগোল । আমি চারপাশের লোকের পা মাড়িয়ে কনুইয়ের গুঁতো
মেরে নিচে নেমে এলাম । আচ্ছা, আমাদের তো অটো বা ট্যাক্সি নিয়ে I S B T যাবার কথা । সুতরাং
অটো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকেই যাওয়া যাক । এরপর আমি বিভিন্ন গেটের অটো
ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে দফায় দফায় খোঁজ
নিতে থাকি । আচ্ছা ভাইসাব কাউকে এরকম দেখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি এমনকি ওই ভুসকো
ব্যাগের কথাটাও বাদ গেল না । তারপর যখন পাকাপাকি ভাবে বোঝা গেল যে কুম্ভমেলায়
হারিয়ে যাওয়া ভাই বা বোনের মত আমরা দিল্লি স্টেশনের জনারণ্যে সত্যিই হারিয়ে গেছি ,
তখন আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল । কিন্তু মুখের মধ্যে কিছুতেই ফুটিয়ে ওঠা
চলবে না যে আমি ঘাবড়ে গেছি । সঙ্গে হাতব্যাগে টাকা পয়সা তো আছে । অতএব আমি যতদূর সম্ভব স্মার্ট হয়ে একটা
অটোওয়ালাকে খুব শান্তভাবে বলি, I S B T চলিয়ে । দিল্লি
শহরটাকেই তখন ভালোভাবে চিনি না , I S B T তো দূর অস্ত ।
এখন যদি অটোওয়ালা বলে বসতো , কোন I S B T যেতে হবে ?
অটো চলতে শুরু করল । সে আমাকে কোথায় কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে ,ঠিক না ভুল রাস্তায় ? কোন বদ মতলব নেই তো ? আবার বার
বার জিগ্যেস করলে ও তো বুঝেই নেবে যে এ তো
কিছুই চেনে না । তাই মুখচোখে খুব একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বেশ গম্ভীর ভাবে বসে
রইলাম । এদিকে তো বুকের মধ্যে দুম দুম করে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে । আমি কোথায় চলেছি কে
জানে ? আর ওদিকে যশোধরা গুণে গুণে ছ’ পিস লাগেজ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে আর আমাকে নির্ঘাত শাপশাপান্ত করে
চলছে । পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করে শিউরে ওঠা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না । অটোওয়ালা
গোঁগোঁ করে ছুটেই চলছে । দিল্লিতে এর আগে একেবারেই আসিনি তাতো নয় , শহরটাকে
একটুকুও চিনিনা কেন ছাই !
শিমলায় বরফের তলায় চলে গেলে যখন কল খুললে জল পড়ত না , বাজারে সব্জির আকাল দেখা
যেত , আম্বালা না পাটিয়ালা থেকে আনা দুধ জমে কুলফি হয়ে যেত , পড়াশুনো ডকে তুলে
আমরা যখন স্নো ম্যান বানানোর প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম তখন আমাদের ঘাড় ধরে দিল্লিতে
নামিয়ে আনা হত । গালভরা সব নাম ছিল পার্লামেন্টারি অ্যাটাচমেন্ট , ফাইনান্সিয়াল
ম্যানেজমেন্ট এই সব । আবার যখন খবর মিলত যে জলটল পড়ছে , বাজারে কপি , আলু টমাটর
দেখা যাচ্ছে তখন আবার হেড কাউন্ট করে করে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত । দিল্লিতে
যখন নামিয়ে আনা হত ,সেই সময় শনি রবি গুলো আমাদের ওপর নজরদারি ব্যবস্থা কিছু শিথিল
থাকত । অনেকেই মামা কাকা মাসি পিসির বাড়ি যেত, কেউ কেউ যেত পুরনো ইয়ার দোস্ত দের
সঙ্গে গুলতানি করতে । আর যাদের বাড়ি একটা সুবিধেজনক দূরত্বের মধ্যে তাদের তো কথাই
নেই ,ফি হপ্তায় বাড়ি । মুশ কিলে পড়তাম আমরা । কেননা তত দিনে হাঁ করে কুতুব মিনার ,
যন্তর মন্তর লালকেল্লা দেখার দিন অনেকদিন ফুরিয়েছে । কাজেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম ।
একবার গেলাম ভোপাল । এমনিই মাথায় ধাঁ করে আইডিয়া এল,চল ভোপাল দেখে আসি ।
কোথায় উঠব কিভাবে যাব এই সব ভেবে আমরা মাথাটাকে অকারণ জটিল করতাম না । আগেই
বলেছি চিন্তা ভাবনা ছিল খুব ছিমছাম ।
ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল খুব সহজেই । আমরা ছোট্ট একটা করে ব্যাগ নিয়ে গুটি গুটি রওনা দিতে যাব ,অমনি আমাদের ব্যাচমেট
সন্ধ্যা দেখতে পেয়ে বলল ,এই তোমরা চললে কোথায়?
ভোপাল ।
ভোপাল ? কেন ?
এমনই ।
আমাকে বললে না তো ?
আমাদের মনেই ছিল না সন্ধ্যার বাড়ি ভোপালে ।
তুমি যেতে চাও?
হ্যাঁ , অফকোর্স ।
দশ মিনিট টাইম পাবে ,মাত্র দশ মিনিট ।
সন্ধ্যা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল ।
আমাদের সঙ্গে চলল বিনা টিকিটে । আমরা ঠিকঠাক ভোপাল পৌঁছেছিলাম । টিকিটের ব্যবস্থাও
হয়ে গেছিল । একটা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা
শহরে একটা বেশ সাধারণ মানের হোটেলে রাত কাটিয়েছিলাম , কাবাব খেয়েছিলাম , সন্ধ্যা
ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে ভোপাল লেক, ভারত ভবন ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল । কোন সমস্যা হয় নি । কোন
ভয় গলা টিপে ধরে নি । কেন ধরেনি ? এখন ভাবলে
খুব অবাক হয়ে যাই ।
আর এক উইকেন্ডে আমাদের গন্তব্য হল জয়পুর । সেবার জে এন এউ হোস্টেলে যশোধরার এক
বন্ধু কাকলির সঙ্গে এক রাত্তির থেকে পরের
দিন কাকডাকা ভোরে ট্যুরিজমের বাসে জয়পুর রওনা দিলাম । যথারীতি কোথায় থাকা হবে ঠিক নেই । এবারে আমাকে আর পায় কে? কারণ জয়পুর
আমার দেখা শহর । বাবার সঙ্গে লেজুড় হয়ে দিল্লি এসেছিলাম । ঝাড়া দুদিন হৌজ খাসের
গেস্ট হাউসে বসে থাকার পরে বাবার আপিসের
কাজ সারা হলে পরে আমরা বাবা আর আমি জয়পুর ঘুরতে গেলাম । গাংগৌর নামে কী সুন্দর
একটা থাকবার জায়গা ! ফোক সং হচ্ছে, বিশাল
পাগড়ি বাঁধা রাজস্থানি লোক কাঠপুতলি
নাচাচ্ছে । সুতরাং ওদের খুব মুরুব্বিয়ানার সঙ্গে বললাম আরে আমি খুব ভাল থাকার
জায়গা জানি । কোন অসুবিধে তো হবেই না ,ওখানে
জায়গা না পেলে সিধে চলে যাব
সার্কিট হাউস । হ্যাঁ, সোনার কেল্লার শ্যুটিং হয়েছিল । ওই বিছে ধরার সিন টা তো ওখানেই ।
ওরাও আমার এই জ্ঞানগম্যিতে বেশ খুশিই হল দেখা গেল । বুকিং টুকিং কিচ্ছু করা
নেই ,চিন্তার মধ্যেও নেই ।
চমৎকার বাস জার্নি । শকিল সাহাব নামে আপাদমস্তক শরিফ এক বয়স্ক উর্দু কবি খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলছিলেন
। কে না জানে কবিরা বানিয়ে বানিয়ে সুন্দর কথা বলতে ওস্তাদ । আমরা বললাম, কিছু
শোনান দেখি । উনি বললেন
“এক পরিন্দা উড়া
আঁখে নম হুই
সমঝা, ম্যায় তুমহে ভুলা নহি “
আবার বললেন
"বড়হে শওক সে সুন রহা থা জমানা /হম হি সো গয়ে দাস্তান কহতে কহতে"
নামবার সময় বললেন, আপনারা একলা একলা ঘুরতে বেড়িয়েছেন ? উনি কি বোঝাতে চাইছিলেন
সঙ্গে কোন পুরুষ সঙ্গী নেই কেন?
আমাদের তিনজনকে আপনার একলা একলা লাগছে ?
এরপর আমার থাকার জায়গা খোঁজার পালা ।
সামনেই কিছু ঘোড়ার গাড়ি , হালকা ভিড় ,জটলা । আমি এগিয়ে যাই ।
হাম লোগোকো গাংগৌর জানা হ্যায় । ক্যায়সে জায়েঙ্গে ?
গাংগৌর জানা হ্যাঁয় ? কিন্তু গাংগৌর তো একটা তেওহার । হামলোগ মনাতে হ্যাঁয় । জ্যায়সে
তিজ, হোলি । তবে আপনি যদি খুব বেশি আগ্রহী হন তবে সিধা বিকানের চলে যাইয়ে ।
কী বলে লোকটা ? পাগল নাকি ? কিসসু জানে না দেখছি । আরে আমি নিজে থেকেছি
ইত্যাদি ইত্যাদি । এইসব বলতে বলতে সামনে তাকিয়ে দেখি বড়বড় করে লেখা আছে গাংগৌর, রাজস্থান ট্যুরিজম , পধারো মাহরে দেশ ।
জয়পুর ট্রিপ তো ভালো হয়েইছিল । থাকার জায়গাও একটু দামি হলেও পাওয়া গেছিল ওই
গাংগৌরেই মানে ট্যুরিস্ট লজে।
এদিকে অটো অবশেষে থামল । I S B T এসে গেছে । আমার সঙ্গে প্রথম তার পরিচয় । বাস অড্ডা ।
নানান রাজ্যের গুমটি । শিমলার বাস যেখান থেকে ছাড়বে সেখানে ধুপ করে বসে পড়ি । ভারি
মনখারাপ লাগছে । যশোধরাকে তো I S B
T আসতেই হবে । ঠিক আসবে তো? এইসব চিন্তাই করছি । বেশ কিছুক্ষণ ।
হঠাত
আমার চোখ আটকে গেল ,আরে দেখতে পেয়েছি ! ওই তো ধুসো রঙের ভুসকো ব্যাগ ! কুলির মাথায়
। আর আমাকে পায় কে । রাগে গিরগির করতে করতে
এক ছুটে কুলিটার সামনে গিয়ে ঝামড়ে পড়ে বলতে
থাকি ,সেই ইস্তক বলে আসছি আহিস্তা চলিয়ে , আহিস্তা চলিয়ে, সুনতাই নহি । কি ভেবেছ কি
তুমি,অ্যাঁ ?
আমার গলা ছাপিয়ে যশোধরা
বলে ওঠে, মাথাটা না হয় গেছে ।চোখটাও গেছে তোর? এটা কি সেই স্টেশনের কুলি?
তাকে আমি ট্যাঁকে নিয়ে এতোক্ষণ ঘুরে
বেড়াচ্ছি ? এটা I S B T র কুলি ।
ওঃ তাই তো!
তারপর পাক্কা আধ ঘন্টা ধরে একে অন্যকে দোষারোপ করার পর আমরা একটু ঠান্ডা হয়ে বসলাম
। তারপর শিমলা যাবার একটা লম্বা ডিলাক্স বাসে চেপে বসি । কিন্তু কী আশ্চর্য বাস টা
অদ্ভুত রকমের খালি । পথে লোকজন তুলতে তুলতে যাবে বোধহয় । কিন্তু না । সবমিলিয়ে সাত
জনের বেশি লোক দেখা গেল না । আমাদের সামনেই বসে ছিলেন এক বয়স্ক দম্পতি । ভদ্রমহিলা
আলাপ করলেন । আমরা ছাড়া উনিই একমাত্র
মহিলা যাত্রী ।দু একটা লোক মাঝপথে নেমেও যেতে লাগলো । একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল
শিমলায় কেউই যাবে না । এমনকি ওই ভদ্রমহিলারাও না । এরমধ্যে বাসটার নানা রকম ঝামেলা
শুরু হল । এই বন্ধ হয়ে যায় , এই চলতে শুরু করে । শিমলা প্রায় ছ’সাত ঘণ্টার পথ ।
ক্রমশ একটা অনিশ্চিতির দানা জমাট বাঁধতে শুরু করে । তখনও ভয় বা সন্দেহ মনের মধ্যে
আসেনি । তখন একটাই চিন্তা । রাতের মধ্যে যে ভাবেই হোক শিমলা পৌঁছুতেই হবে । কারণ
পরের দিন সকালে আমাদের টানা সাত দিন
তিব্বত বর্ডারে এক্সকারশন আর ট্রেকিং শুরু হয়ে যাবে । সময় মত হাজিরা না দিলে যে
ঠ্যালা সামলাতে হবে সেই চিন্তাই আমাদের পাগল করে মারছিল । সন্দেহের বীজটা বুনতে
শুরু করলেন ওই ভদ্রমহিলা । উনি বললেন তোমরা ভাই কী করবে ? ভেবে দেখ । শিমলায় কেউ যাবে
না । রাত কতো হবে কে জানে ? তার ওপর এই বাস টার তো কোন ভরসাই নেই । তোমরা দুজন
মেয়ে । একলা একলা ।
তত ক্ষণে পানিপথ কুরুক্ষেত্র ঐতিহাসিক পৌরাণিক যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে এসেছি । চন্ডীগড়ের প্রায় কাছে এসে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার মুখে বাস জবাব দিয়ে দিল
যে সে পাদমেকং ন গচ্ছামি । এখন কী কর্তব্য
? আবার ওই লটবহর নিয়ে কোথায় যাব ? একটু দিশেহারা দুজনেই ।
এরপর আমাদের চমকে যাবার পালা । যে
ড্রাইভার আর তার হেল্পারকে সারা রাস্তা অকথ্য কুকথ্য গালিগালাজ করতে করতে আমরা এসেছি তারাই এগিয়ে এসে বলল আমরা আপনাদের চন্ডীগড় পৌঁছে
দেব । হেল্পারটি একটা অটো করে বাস স্টপে নিয়ে গেল এবং একটা ভিড় থিকথিকে শিমলার
বাসে তুলে দিল ।
আমাদের সেই রোমাঞ্চকর দিনটি এখানেই শেষ হয়ে গেল না । প্রায় মাঝরাতে আমাদের
নামিয়ে দেওয়া হল শিমলার টানেল নম্বর ১০৩ এ
।
এই টানেল থেকে আমাদের মই এর মত খাড়াই পথ বেয়ে চৌরা ময়দানে উঠতে হবে সেখান থেকে
উৎরাই । আমাদের একাডেমি । জোগাড় করতে হবে আবার সেই একটি কুলি । যশোধরা কুলির খোঁজ
নিতে ওই পাহাড়ি মই এর মত রাস্তায় উঠতে শুরু করল । আমি এক রাশ মালপত্র নিয়ে চারপাশ
দেখতে লাগলাম । রাত প্রায় বারোটা । দুটো শিমলা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে । তাদের মধ্যে
কোন হেলদোল দেখা গেল না । কোন কৌতূহলও নেই আবার সাহায্যের ইচ্ছেও নেই । বিধি বাম । কার মুখ দেখে সকালে উঠে ছিলাম কী
জানি । অত রাতে কুলি পাওয়া গেল না ।
তারপর একটি করুণ, মর্মান্তিক ও অভাবনীয় দৃশ্য । ওই খাড়াই পথে ছ’পিস ব্যাগ নিয়ে
আমাদের অভিযান । নাওয়া নেই খাওয়া নেই ক্লান্ত অবসন্ন দুটি দেহ যেন পাপের বোঝা নিয়ে ধুঁকতেধুঁকতে এক পা এক পা
করে চলছে । এর সঙ্গে একমাত্র প্রভু যিশুর ক্রুশ নিয়ে চলার তুলনা দেওয়া যেতে পারে ।
ক্লাসিক । সাক্ষী হয়েছিল শুধু পাইন গাছ ,রাতের
তারা আর হিমেল হাওয়া ।
যদি সেদিন মোবাইল থাকত তাহলে পথের বাঁকে বাঁকে এই অকিঞ্চিৎকর রোমাঞ্চ ,রহস্য
আর বিস্ময়ের তুচ্ছ গল্পটা আজ আর বলা হত না ।