Sunday 8 November 2015

বাসন্তীর উৎসব


বাসন্তীর জুঁই ফুলের বাসি মালা জড়ানো চুলে উৎসবের ঢল  , উৎসবের আমেজে ভারি তার চোখের ঘন পাতা , উৎসবের স্বপ্নে বিভোর তার দুই কাজলচোখ, আলুথালু মন শুধু নকশা বুনে চলে কাজের ফাঁকে ।

মাঝে মাঝে ভারি বিরক্ত লাগলেও বাসন্তী ওই রকমই । কাজে ঢিলে পড়ে যখনতখন, সব কিছু কেমন  এলোমেলো । ফ্যান চলছে তো চলছেই , বন্ধ করার নাম নেই । কলের জল পড়েই যাচ্ছে , ট্যাঙ্ক প্রায় খালি । কিছুতেই যায় আসে না তার । চোখের পাতা নামিয়ে শুধু বলে, স্যরি ম্যাডাম , ভুল হো গয়া ।
দক্ষিণ দিল্লির এই মাল্টি স্টোরির সবচেয়ে উঁচুতলা বেছে নেওয়া আমার কাছে একদমই “জেনে শুনে বিষ করেছি পান” । খামখেয়ালি  আকাশ,  চিড়বিড়ে  সূর্য,  ডানামেলা  হায় চিল সোনালি ডানার   চিল আর  একলা চলা এরোপ্লেন আমার সঙ্গী ।
মহাভারতে বক রূপী যক্ষ  যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিল , সুখী কে ? উত্তর এসেছিল যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিনের অষ্টম ভাগে  মানে প্রায় সন্ধে বেলা ,শাক আর ভাত রান্না করে  সেই সুখী । ঋণের প্রকারভেদ লেখা নেই । কাজেই সব দিক থেকেই সংজ্ঞা অনুযায়ী  আমি ঘোরতর অসুখী ।
এই নিঃসঙ্গতা এবং প্রবাস যখন আমার প্রায় দম আটকে ফেলেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে এসেছিল বাসন্তী । একা নয় , পুরোদস্তুর সংসার নিয়ে ।
“ আমি সব সামলিয়ে নেব ম্যাডাম , কোন টেনশন নেবেন না” ।
কিছুদিনের মধ্যে বাসন্তী আমার বাড়ির  হাল ধরে নেয় । খাবার পুরো না খেয়ে উঠে গেলে রীতিমত মা মাসির মত ধমক লাগায় । আর বলে এটা আমার দপ্তর , এখানে আমি আপনাকে যা খুশি বলতে পারি ।
কখনো চমকে দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ইডলির প্লেট মুখের সামনে নামিয়ে বলে, “বাড়িতে বানিয়েছিলাম ।  আপনার জন্য নিয়ে এলাম “। স্বজনহীন পরিবেশে আমি গলে গলে কৃতার্থ হয়ে যাই । বাসন্তী চমৎকার রান্না করত  ।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে দরজা খুলে দুটো একটা খুচরো  কথা , খরচ না করলেও চলত, তবু করত বাসন্তী । “আ গয়া । চায়ে পিনা হ্যাঁয়? “ ব্যাপারটা কিছুই না । কিন্তু তুলির ওই হালকা নরম রঙের পোঁচ টুকুতেই সব ভাললাগা মিশে থাকত । দেদার ভুলভ্রান্তি সব মাপ হয়ে যেত ওর স্বভাব মাধুর্যে ।
বাসন্তীর ছোটোবেলা কেটেছিল  পন্ডিচেরি আশ্রমে । প্লে গ্রাউন্ড , ছুটির দিনে সিনেমা দেখা  , ডাইনিং হলের খাওয়া , আশ্রমের ডিসিপ্লিন , বর্ষীয়ান আশ্রমিক অমলকিরণকে দেখা  সবকিছুই কলকল করে আমাকে শোনাত । আর বলত এবারে যখন আশ্রমে যাবেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন ।
আমার ঘর লাগোয়া বাসন্তীর ঘর।  দশ ফুট বাই দশ ফুট। স্বামী আর দুটো ছোট্ট মেয়ে ।  দুটো গুলিয়ে যাওয়া নাম,  দিব্যা আর বিদ্যা । কোনটা যে দিব্যা আর কোনটা যে বিদ্যা আমি আজও জানিনা । বরটা নাকি কোন আই এ এস অফিসারের গাড়ি চালায় । এমনিতে ভদ্র সভ্যই বলেই  মনে হল ।
সাজগোজে বাসন্তীর খুব যত্ন ।সুন্দর সালোয়ার কামিজ, বিনুনিতে বেল জুঁই , পায়ে নক্সাতোলা দিল্লি হাটের জুতি । দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণকলি । এমন মেয়েদেরই মনে হয় সৈরিন্ধ্রী বলা হত ।  বাজারহাট করে ফিরলে দেখতাম বাসন্তী খুব আগ্রহ নিয়ে সব কিছু খুলে খুলে দেখত । বিশেষ করে জামাকাপড় ।  কোত্থেকে কিনেছেন ? কতো দাম ? একটু অস্বস্তি হত । এমনভাবে জানতে চাইত যেন ও খুব অভ্যস্ত এই সব ব্যাপারে । ঠকেছি কিনা, মানাচ্ছে  কিনা, মতামত দিত । দেখতাম বাসন্তীর চোখের তারায় , আনত চোখের ঘন পাতায় মৃদু বেদনা  আবছা কাজলের মত লেগে আছে ।

বাসন্তীর জুঁই ফুলের বাসি মালা জড়ানো চুলে উৎসবের ঢল  , উৎসবের আমেজে ভারি তার চোখের ঘন পাতা , উৎসবের স্বপ্নে বিভোর তার দুই কাজলচোখ, আলুথালু মন শুধু নকশা বুনে চলে কাজের ফাঁকে ।




অনেক সময় জিনিশপত্র কিনে আলমারির মধ্যে লুকিয়ে ফেলতাম । কিন্তু যদি একবার দেখে যে আমি নতুন কিছু পরেছি , সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন,  ইয়ে কব লিয়া ? মুঝে দিখায়া ভি নহি?
আবার চোখের তারায় তিরতিরে মৃদু অভিমান ।
কিন্তু এই প্রবাসে সেই ছিল আমার পরম স্বজন । সুখদুঃখের সঙ্গী । আমার ঘুম ভরা রাত ।
প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত  বড় বাড়িতে  রাত গভীর হলে ঘুম আসতে চাইত না । ঘরগুলো হা হা করে যেন গিলতে আসে ।বাসন্তীর দশফুটিয়া ঘর থেকে বেগুন ভর্তা আর আলু পরোটার সুঘ্রাণ দরজার ফাঁক ফোকড় দিয়ে আমার নাকে এসে ঢুকত । বাসন্তীর গলা , কাচ্চাবাচ্চার হৈ হল্লা , টিভির শব্দ  দূর থেকে ভেসে এসে আমার শূন্য ঘরের চারদিকে নিবিড় শান্তির মত, ওমের গরমের  মত,মায়ের স্নেহের মত  আমাকে ঘিরে ধরত । আর এক টুকরো ঘরে বাসন্তীর  গেরস্থালির সমুদ্র সফেনের মধ্যে  আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম ।
শীত আসে । বাসন্তী জানায় একটা নয়, দুটো কম্বল গায়ে দিন । আমারও আপনার মতই কম্বল আছে।
ভাল কথা, হতেই পারে । সমাজ সবসময়ই আপওয়ারডলি মোবাইল ,পণ্যের বাজারে হিলহিল করে উপরের দিকে উঠছে লতানে গাছের মত । কিন্তু কোথায় কখন মাচা বাঁধতে হবে সেটা আর কে বলে দেবে? বাসন্তী বাচ্চাদের টোম্যাটোর স্যুপ বানিয়ে দেয় আর আমাকে বলে আমি সবসময় ওদের স্পুন দিয়ে ভাত খেতে দি । হাথ সে কভভি নহি ।
আমি আমার ভাত ডাল ঝোল  মাখা হাতের দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকি ।
বাসন্তী মাঝে মাঝেই  ওদের ফোটো দেখায় , গল্প শোনায় ওর বিয়ের , রাজু ওর বর , কতো ভালবাসে ওকে ,উঁচু গলায় কথা বলে না । নিজের পছন্দে বাড়ির অমতে বিয়ে, কিন্তু না, ও পস্তায় নি । ভালোই লাগত শুনতে  । এসবের মধ্যে আরো শোনাত ,খুব বড় করে পার্টি দেবে , মেয়েদের জন্মদিনে । প্রচুর লোক খাওয়াবে । আবার জেনে নিত, আপনি থাকবেন তো ওইসময় ? কখনো কখনো মিষ্টি বা কেক নিয়ে আসত । তবে  বলতে ভুলত না, খা লিজিয়ে ম্যাডাম, বড়া দুকান সে লায়া হু ।
ফ্রিজের খাবার দাবার এক দুদিনের পুরোনো হলেই ফেলে দিত,  অর নিজস্ব ভঙ্গিতে বলত, ইয়ে ফ্র্যাশ নহি হ্যাঁয় ।
মাঝে মাঝে বেশ রাগ হত । দিব্যি সব  ভাল রয়েছে । যতোসব বড়লোকি চাল ।
কখনো কখনো  বাসন্তীকে সময় মত পাওয়া যেত না । একদিন বাসন্তী  নিজে থেকেই বলল,  আপনাকে একটা কথা বলা হয় নি। আমি কাছেই একটা বাড়িতে কাজে যাই ।
খুব বড়লোক বাড়ি । বিজনেস । এক বয়স্ক ম্যাডামের কাজ করে দেয় । ভাল পয়সা পায় ।
আমার তো কোন গতিই নেই মেনে নেওয়া ছাড়া ।
ধীরে ধীরে বাসন্তী  একে একে তার ঝাঁপি খুলতে থাকে ,  রাজুটা  প্রচন্ড নেশুড়ে , মাতাল, রগচটা ।
আমি ভেবে খুব অবাক হই এইতো আমার ঘরের মধ্যেই ঘর , তবু তো জানতে পারিনা এত কথা, আন্দাজও করে নিতে পারি না । সবই যে বাসন্তী  কেমন করে যেন উৎসবের স্বপ্ন দিয়ে রঙ দিয়ে  আড়াল করে দেয় , কিছুই বুঝতে দেয় না ।



খুব তোড়জোড় চলতে থাকে কোথায় হবে সেই পার্টি । বাসন্তী গড়গড় করে অনেক অনেক খাবারের নাম বলে, সেদিনের মেনু । আমার নেমন্তন্ন । নিচের লনে হবে না ছাদের ওপরে এই নিয়ে অনেক অনেক আলোচনা বার বার শুনিয়ে যায় । জামাকাপড় কেনাকাটি হবে ,সবাই মিলে বাজার যাবে । দেড়শ মতো লোক হবে ।
কলকাতা থেকে বাড়ির লোকজন মাঝে মধ্যে আনাগোনা করে । অফিসে বেরোনোর আগে  বাসন্তীকে বলি, লাল চা একটু বেশি করে করে রাখো । দাদাবাবু অনেকবার চা খান তো। বাসন্তী বলে বসে দাদাবাবুর চা আর আমাদের রাজুর ওই মদ , এদের যে কী নেশা  বুঝতে পারিনা বাপু ! আমি এই অনায়াস কথনে একেবারে তাজ্জব বনে যাই ।
বুঝতে পারতাম ওর  অনেক পয়সার দরকার । রাজুর ওপর ভরসা নেই ,আবার দু চোখের স্বপ্নের রঙও ফিকে হতে দেওয়া যাবে না । উৎসবের দিন  এগিয়ে আসে , বাসন্তীর হাঁকডাক আর আগের মত শোনা যাচ্ছে না যে । একদিন জিগ্যেস করি, কি ব্যাপার? কদ্দুর হল তোমার কাজ ?
“না ম্যাডাম, অত বড় করে হচ্ছে না “
“সে কি ? কেন?”
“সেদিন অনেকের খুব অসুবিধে, অনেকে  আবার আসতে পারবে না” ।
সেইদিনটা অবশেষে এল । বাসন্তী আর তার মেয়েরা সাজগোজ করেই দেখা করতে এল । শুধু বাসন্তী বলল, রাতের খাবারটা পাঠিয়ে দেবে । এই দশফুটিয়াতেই ছোটোমোটো আয়োজন । চিকেন বিরিয়ানি । বাড়িতেই বানাবে  । মাত্র কুড়ি তিরিশ জনের খাবার তো , ও সেটা নিজেই খুব পারবে ।
হঠাৎ আমার নিজেরই ভীষণ খারাপ লাগল , বাসন্তীর জন্য , ওর অপূর্ণ সাধ আলহাদ গুলোর জন্য ।
রাত না পোহাতেই  বাসন্তী  আবার জানিয়ে দিল সামনেই বিরাট পুজো আচ্চা । মন্দিরে খুব জাঁকিয়ে ধুমধাম করে পুজো দেবে ওরা । খুব শিগগিরি । সেদিন দারুণ সব ভোজ খাওয়া হবে ।
আপনি থাকবেন তো ?

বাসন্তীর জুঁই ফুলের বাসি মালা জড়ানো চুলে উৎসবের ঢল  , উৎসবের আমেজে ভারি তার চোখের ঘন পাতা , উৎসবের স্বপ্নে বিভোর তার দুই কাজলচোখ, আলুথালু মন শুধু নকশা বুনে চলে কাজের ফাঁকে ।



আমি ছিলাম না অনেক দিন । বাড়ি ফিরে দেখেছিলাম আমার ঘর তালাবন্ধ কিন্তু বাসন্তীর ঘরে  কেউ  কোত্থাও নেই । বুকটা ধক করে উঠল । অনেকক্ষণ কেটে গেল। কেউ ফিরে এল না । শুধু একটা ফোন এল ওর দিদির কাছ থেকে ।  বাসন্তীর কোন খোঁজ নেই । বাচ্চাদুটো নিয়ে কোথায় গেছে কেউ জানে না । রাজুও নেই । উৎকণ্ঠা উত্তেজনা রাগ বিরক্তি কমে এলে ধীরে ধীরে জানতে পারি রাজুর হাতে বেধড়ক মার খেত বাসন্তী,বেধড়ক ।রাজু খালি পয়সা চাইত  । সেদিন রাতে নেশার পারদ বেশি চড়ে গেলে মারামারি শুরু হয়ে যায় । কিল চড় লাথি খেয়ে প্রায় বেহুঁশ বাসন্তী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে কোনমতে । রাজু ওর মোবাইলটা অবধি কেড়ে নেয় । । সেই বড়লোক মহিলার  বাপের বাড়ি জয়পুরে তার আস্তানা এখন । আরো জানতে পারি এরকমই ছিল নাকি ওর প্রতিদিনের জীবন । সেদিন শুধু সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল ।  আবার আমার ভয়ানক  আশ্চর্য হবার পালা । এইতো হাতের নাগালের মধ্যেই থাকত ওরা । এত নরক হয়েছিল দশফুট বাই দশফুট! কই কোনদিন জানতে পারি নি তো , জানতে দেয়নি বাসন্তী । প্রত্যেকটা দুঃখের কাঁটার মধ্যে একটা করে লাল গোলাপ ফুটিয়ে দিত সে।  কারণ সে কালো হরিণ চোখের  মেয়ের জুঁই ফুলের বাসি মালা জড়ানো চুলে উৎসবের ঢল  , উৎসবের আমেজে ভারি তার চোখের ঘন পাতা , উৎসবের স্বপ্নে বিভোর তার দুই কাজলচোখ, আলুথালু মন শুধু নকশা বুনে চলে কাজের ফাঁকে ।
যার ভরসায় বাড়ি ছেড়ে গেছি তার এতটুকু দায়িত্ববোধ থাকবে না ? আমাকে একবার জানালো না পর্যন্ত ! সত্যি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম । বাসন্তীর দিদি এসে সব জিনিশপত্র সরিয়ে ঘর খালি করে দেয় । সেই ঘর থেকে বের হয় বাসন্তীর সাত গাঁঠরি জামাকাপড় । সলমা চুমকি জরি শিশা বান্ধনি ।



দিল্লি শহরে দশফুটিয়ারা খালি থাকে না । নতুন উমেদার জুটে যায় সঙ্গে সঙ্গে  । পাতা হয় নতুন সংসার । কুলার টিভি ফ্রিজ সাঁইবাবা । হাজির হয় বি এ পরীক্ষা দেওয়া  সবসময় হাতে ঘড়ি পরা গীতা । কেজো মানুষ কেজো কথা । কোন একটা অফিসে কাজও করে । সময়ের খুব অভাব । স্বপ্ন দেখে না । নেই খুচরো কথা খরচ করার ফুরসৎ ।
আবহসঙ্গীতের মত বাসন্তীর ঘরকন্নার তরঙ্গ আমাকে আর ঘিরে রাখে না । বাড়িটা আবার হাঁ করে গিলতে আসে । আবার ঘুম আসতে চায় না । গীতার ঘড়ি ধরা কাজ । এমন সময়ে একদিন হঠাৎ মোবাইলে বাসন্তীর গলা । শান্ত এবং নিস্তেজ । বল্ল ,পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি ছিল না সেদিন । “আপনা খয়াল রাখনা ,ম্যাডাম“।
বেশ কিছুদিন পর একদিন দুম করে ঝিমঝিমে ভরদুপুরে বাসন্তী এল । এখন সে দিল্লিতেই থাকে । রাজুর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই । রাখতেও চায় না । সেই  বড়লোক ম্যাডামের বাড়িতেই আছে । চেহারা দেখে মনে হল ভালোই আছে । ওইটুকু সময়ের মধ্যে বাসন্তী কলকল করে জানিয়ে দিল তার জন্য আলাদা ঘর, কুলার আর টি ভি আছে । সে মোটেও কাজের লোকের মত থাকে না । ড্রাইভার ছাড়া ম্যাডাম ওকে বেরোতেই  দেয় না । বাচ্চারা স্কুলে পড়ছে । প্রাইভেট স্কুল , কর্পোরেশনের নয় ।
আমার অনেক কথা কুশল সংবাদ জিগ্যেস করল । যেমনটা ছিল ওর স্বভাব । স্নিগ্ধ বসন্ত বাতাসের মত, সব জ্বালা সব দুঃখ জুড়নো, নিজে পুড়ে ছারখার ,অথচ তার আঁচ কাউকে বুঝতে দিত না এতটুকু ।বড় একটা কাগজের বাক্স থেকে একটা ঢাউস পেস্ট্রি বের করে আমাকে দিল । “আমি তো এসব খাই না বাসন্তী” ।
“লিজিয়ে না ম্যাডাম, বড়া দুকান সে লায়া ।“
যাবার সময় একবার আলগা নজর পড়ে গীতার সুস্থির সংসারের ওপর । মেয়েদুটো চেঁচায় , আমাদের ঘর,আমাদের ঘর ।
বাসন্তী  ওদের হাত ধরে টানে ,বলে,না বেটা ।এখন এটা আমাদের ঘর নয় । আমি স্পষ্ট দেখি ওর আনত চোখে হালকা কাজলের মত বিষণ্ণতা লেগে আছে । মুহূর্তেই তা মুছে ফেলে আবার ঝকঝকে হাসি নিয়ে লিফটের  দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বাসন্তী বলে, আবার আসব । যখন দরকার হবে, ডাকবেন ম্যাডাম । আমি আসব । আপনি আমার হাতের রাজমা খেতে ভালবাসেন, একদিন বানাবো। সেদিন রাতেও থাকবো । কেমন?
অনেকদিন পর বড্ড মিস্টি লাগল এই কথাগুলো শুনতে ।
দুপুরের গনগনে রোদে  ফুলে ফুলে  ছাওয়া অমলতাসের হলুদ রঙ মেখে  গাছের তলা দিয়ে চলে যেতে যেতে নতুন করে উৎসবের স্বপ্ন দেখে বাসন্তী । আবার ।



Thursday 1 October 2015

আপ রুচি খানা


“আজকে  কি রাঁধলে বেস্পতিদি? “

দেওয়ালে সরু  রোগা পিঠটা ঠেকিয়ে মেঝের ওপর বসে বেস্পতিদি  আয়েস করে একটা কড়া চায়ে লম্বা  চুমুক দিয়ে বলত “ আজ আলু দে (দিয়ে) বেগুন দে কুচো চিংড়ি দে একটা গা মাখা গা মাখা তরকারি করিচি , বাড়ি গে (গিয়ে)ভাত চাপিয়ে দোবো, গরম গরম ভাত আর...”এই পর্যন্ত বলা হয়েছে কি হয়নি আমার মনে হচ্ছে একছুট্টে বেস্পতির বাড়ির দাওয়ায়  থালা নিয়ে বসে পড়ি আবার কখনো বলত, ” আজ আর বেশি কিছু করার সময় পাইনিকো ,বিউলির ডাল, ঝাল ঝাল পোস্ত এট্টু করিচি, ব্যাসন গুলে রেখে এইচি , গরম গরম কুমড়োফুলের বড়া ভেজে নেবো’খন ।“





বেস্পতিদি তার  দিন আনি দিন খাই  সংসারের  খাবারের কথা যখনই  বলত আমার দর্শনেন্দ্রিয় ঘ্রাণেন্দ্রিয় আর স্বাদেন্দ্রিয় ,আমার মধ্যে  একযোগে একটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয় তৈরি করত । আমি ভাবতাম ,ইস বেস্পতিদিরা  কী সব ভাল ভাল খাবার খায় ! আমি মানসচোখে দেখতে পেতাম বেস্পতিদি আর তার বর পুতুলদা তাদের ছানাপোনা সবাই মিলে মাটিতে বসে হুশহাশ খাচ্ছে । চেটেপুটে থালা বাটি সাফ হয়ে যাচ্ছে , মাটির দালানে রোদ ভাসছে , হাওয়ায় ভাসছে সেই অকিঞ্চিতকর  আয়োজনের সুঘ্রাণ । বেস্পতিদি আমাদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত । আমার ছোটবেলায় মফস্বলের কোন একটা জায়গায় ।এমন নয় যে সেই নিতান্ত খুদে বয়সে আমি বেজায় খাদ্যরসিক বা পেটুক ছিলাম । বরং ঠিক তার উল্টোটা । কিন্তু কিভাবে বেস্পতিদিকে তার হাঁড়ির খবর জিগ্যেস করা আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়ালো তা আমি নিজেই  ঠিক জানি না ।

ভূগোল জল হাওয়া পরিবেশ রুচি সামর্থ্য  যে খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে দেয় তাতেই  আমাদের প্রাণের আরাম,মনের আনন্দ আত্মার শান্তি , সে  আবার সহজে  কোন আপোষও মানতে চায় না একটা পুরো অঞ্চল বা জাতির মেজাজ মর্জি নিয়ে সে  দিব্যি সময়ের  ভেতর দিয়ে বয়ে যায় ।

আমাকে সবজিরুটি গোত্রের অনেকে জিগ্যেস করতেন ,এখনো করেন,  তোমরা প্রতিদিন মাছ খাও ? প্রতিদিন? কেন?

আমি কি তাকে উলটে জিগাইব, আপনি   রোজ রোজ রুটি ভাজি খাইয়া কি আমোদ পাইতাসেন?

যাকগে , কাজের কথায় আসি ।  ট্রেনিং পর্বে আমরা একবার  সদলবলে শিমলা থেকে কলকাতায় এসেছিলাম । এখানে নামা মাত্রই  আমাদের দলের একজনের মনে হল আকাশে বাতাসে জলে স্থলে সর্বত্র মৎস্যগন্ধ বিচ্ছুরিত হইতেছে । তার পক্ষে নিঃশ্বাস নেওয়াই নাকি কষ্টকর । আর এদিকে যত জায়গায় আমাদের খাওয়া দাওয়া হচ্ছিল সেখানে তো  আমিষের মোচ্ছব , বরিশালের বাঙালরা যাকে বলে জোতাপট্টি

আয়োজন কর্তারা সক্কলে  শশব্যস্ত হয়ে  ধোঁকার ডালনা পটলের দোলমা ছানার কোপ্তা , দই আর হরেকরকম মিস্টিতে  অতিথিসৎকারে লেগে পড়েছিলেন আর বলছিলেন, ইস এ হে হে , আপনার তো কিছুই খাওয়া হল না দেখছি   সে ভারি অবাক হয়ে আমাদের বলেছিল, আচ্ছা এই এতো এতো খেতে দিয়ে, কিছুই খান নি কিছুই খান নি বলছেন কেন এনারা?

আসলে নিরামিষ খেলে এখানকার লোকেরা মনে করে যে কিছুই খাওয়া হল না । তাই আর কি...। শুনে সে ভারি তাজ্জব হয়ে গেছিল । আমাদের পরের গন্তব্যে , মনে আছে, রাত্তিরবেলা  কোন একটা হোটেলে অনেকক্ষণ   মেনুকার্ড খুঁটিয়ে দেখার  পর  তার  সাবধানী কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম , “রোটি , অড়হর ডাল ,পাঁপড়” ।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ...।

তবে অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই , আমরা স্বধর্মের ব্যাপারে  সেই সময় খুবই কট্টরপন্থী ছিলাম ।  পন্ডিতজির হেঁশেলে দিব্যি সবার জন্য দরাজ খাবার ব্যাবস্থা ছিল । ছুটির দিনে  ভরন্ত দুপুরে চারদিক  মিঠে ঠান্ডায় ঝিম মেরে থাকত, রোদ্দুর আর প্রজাপতির দল বাগানে লুটোপুটি   খেলত , সব্বাই সোনা সোনা মুখ করে খেতে বসত, ডাইনিং হল জুড়ে পন্ডিতজি অ্যান্ড কোং এর  হাতে বানানো কালি ডাল , গোবি মটর , পালক পনীর ,ভিন্ডি মশালা, পুর ভরা করেলা আর শিমলা মিরচি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকত , সেই সময় আমরা,  ছ্যা ছ্যা ,এসব আবার ছুটির দিনে খেতে আছে নাকি এই সব বলে  নিজেদের ঘরে হিটার জ্বালিয়ে কার্পেটের ওপর থেবড়ে বসে ভাত , মুসুর ডাল সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ , আলু সেদ্ধ কাঁচা লঙ্কা ও কলকাতা থেকে আনা ঝর্না ঘি দিয়ে সে যা খাওয়া হত না , যখন খাওয়া দাওয়া শেষ  করে  জাতধর্ম রক্ষা করতাম বিকেলের টয় ট্রেন হুইসল বাজিয়ে পাকদন্ডী বেয়ে নেমে যেত ।

দেখতে গেলে তো সেটা একধরনের বে আইনি ছিলোই আর রসদপত্র যোগাড় করাও কিছু কম ঝামেলার ছিল না ।

শিমলায় আরো কতগুলো ঘটনা ঘটেছিল । আমাদের সবাইকে পালা করে প্রতিদিন খাবারের দায়িত্ব নিতে হত । মেস ডিউটি অফিসার । সেদিনের মেনু বাজার ভাঁড়ার পন্ডিতজির সঙ্গে আলাপ বিলাপ প্রলাপ  সব এর মধ্যে পড়বে । বঙ্গ সন্তানদের হাতে দায়িত্ব এলেই মাছ রান্না করতেই হবে । সেই সব মাছেদের  জাতি কুল গোত্র খুবই সন্দেহজনক । অজ্ঞাতকুলশীল মাছ অনেকেই খুব পছন্দ করত না । তাতে কট্টপন্থীদের আরো ভাল । তবে মাঝে  মাঝে বদখৎ গন্ধও পাওয়া যেতো আবার একদিন খিচুড়ি বেগুনি মেনু করাতে সবার কী রাগ ! কে আজকের  মেস ডিউটি অফিসার?  পাঠাও তলব , বসাও পঞ্চায়েত ।  কেন ? কি সমস্যা?

খিচুড়ি কেন ? আমাদের তো জ্বর পেটখারাপ হয় নি ।তাহলে খিচুড়ি কেন খাব?

আমরাও তেড়েফুঁড়ে উঠি । আরে এতো আমাদের ডেলিকেসি । ভুনি খিচুড়ি জানিস? খেয়েছিস কোনদিন?

ডে-লি-কে-সি । হাসালে । খাওয়াটা দিলে  তো বরবাদ করে ।








এরপর  ভুবনেশ্বরে থাকার সময় একদিন হাতে এল গালা সিল লাগানো গোপনীয় খাম । চিঠিতে লেখা আছে এই অফিসের জনা তিনেক কর্মী চেন্নাইতে ট্রেনিং এ গিয়ে সেখানকার আইন লঙ্ঘন করে হোস্টেলের ঘরে স্টোভ জ্বালিয়ে  কিসব রান্নাবান্না করে খেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন যথোচিত ব্যাবস্থা নেওয়া হয় । ব্যাপারটা কি ? খোঁজ নিতে হয় । ট্রেনিং সেন্টারে খাবারের  ভালমত ব্যাবস্থা আছে , তা সত্ত্বেও মাত্র দিন সাতেকের ট্রেনিং এ এত বড় ঝুঁকি কেন নেওয়া হল? গন্ধটা বড় সন্দেহজনক ।কেমন যেন শিমলার গন্ধ পাচ্ছি ।

আমি সুলুকসন্ধান করতে শুরু করি । প্রথমেই জানতে হবে তারা কী রান্না করেছিল যেটা ছাড়া আর থাকতে পারা  যাচ্ছিল না । উত্তর এল

“ডালমা রসুই করিথিলে, ” অর্থাৎ তারা ডালমা রান্না করেছিল ।

দলমা পাহাড়ের নাম শুনেছি । ডালমার সঙ্গে পরিচয় হয় নি তখনো । পরে ডালের মধ্যে মাতৃস্থানীয়া ডালমার স্নেহধন্য হয়েছি তবে খুব মুগ্ধ হই নি কারণ এনার মা দিদিমা জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা  আমাদের পাকশালে অনেকদিন ধরেই জমিয়ে রাজত্ব করছেনআরো জেনেছি উৎকলবাসী এই ডালমার জন্য পারে না হেন কাজ নেই । এ একেবারে  তাদের প্রাণের রসদ । সোল ফুড ।

হড়দ (অড়হর) বা মুগ  ডালি ,কচ্চা কদলী( কাঁচ কলা), সারু (কচু) বাইগন , কখারু( কুমড়ো) ,আলু (ল এর উচ্চারণ খুব কঠিন, মূর্ধা তালু , দন্ত তিনটেই ব্যাবহার হবে, খুব শক্ত ), টমেটো,সজিনা ছুঁই (সজনে ডাঁটা)  অমৃতভান্ড (পেঁপে, পপিতা , পাপায়া, অথচ কী সুন্দর নাম এরা দিয়েছে)  তেজপত্র, শুখিলা লঙ্কা ,পঞ্চফুটন ,লু্‌ন (অ) , জিরা , সরিষা, হলুদ ,পেঁয়াজ (অ)  তেল (অ) এবং আরো নানা সবজি সহযোগে রান্না হয় ডালমা ।এর মধ্যে যদি একটু নড়িয়া কোড়া (নারকেল কোড়া) ফেলে দেওয়া যায় তবে তো আর কোন কথা হবে না , সোজা দারুব্রহ্মের ভোগে ।

একবার কি একটা বড়সড় কাজ নির্বিঘ্নে মিটে যাবার পর কয়েকজন  এসে বলল আমরা  একটু  ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া করব । এরকমটা অফিস কাছারিতে হয়েই থাকে । বেশ তো , ভাল কথা ।

আমি ছিলাম না । পরে ফিরে এলে খুব খুশি হয়ে ওরা সব বলল, দারুণ ফিস্ট হয়েছে । বেস্পতির রান্নাঘরে উঁকি মারা স্বভাব আমার যাবে কোথায় ? তা কি কি আইটেম ছিল ?  ভাত ,ডালমা আর খটা । খটা হল টমেটোর টক । আমাদের চাটনির মত বাহারি নয় মোটেও ।  সত্যি কথা বলতে কি এই  সামান্য আয়োজনে এত খুশি হতে পারে লোকজন ভেবে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম আপ রুচি খানার  পেছনে কতো  যে সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস অর্থনীতি কাজ করে !






মনে পড়ছিল কলকাতার অফিসগুলোর কথা । ভাদ্রমাসের তালপাকা গরমে একটি তাঁতের শাড়ি , লম্বা বিনুনি হাসি হাসি মুখে বলেছিল , “আমরা না কাল একটু খাওয়াদাওয়া করব “।

তা বেশ তো করুন ।

 মনেমনে ভাবছিলাম  উপলক্ষের তো অভাব নেই । লাগিয়ে দিলেই হল । ইনক্রিমেন্ট, প্রোমোশন ছেলেমেয়ের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ,জয়েন্ট এন্ট্রান্স , ছেলেমেয়ের চাকরি, বিয়ে, বিদেশ যাত্রা , অ্যাকসিডেন্টের ফাঁড়া কাটা , অসুখ বিসুখ সেরে যাওয়া এমন সাড়ে বত্রিশ রকম উপলক্ষ সারা বছর ধরেই ঘোরাঘুরি করে ।

“আমরা না কাল ইলিশ মাছ খাব” ।

অফিসের এতোগুলো লোক মিলে ইলিশ মাছ খাবে ? এই গরমে? এই বন্ধ এয়ার কন্ডিশন্ড অফিসে? তাকে কিছু মৃদু মধুর কথা বলেছিলাম মনে আছে এবং ঠিক তাই আমার সমস্ত আশঙ্কাকে ঘোরতর সত্যি করে পুরো অফিসটা বিয়েবাড়ির আইবুড়ো ভাতের ফাংশান হয়ে উঠল । ওরে জল দে রে , লেবু নুন দে , হাঁক ডাক , গোপাল কোথায় গেলি , পেটিগাদাগুলো মিশিয়ে ফেললি কেন , মাছের ডিমভাজা গুলো আগে দে.. বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে  শুনতেই থাকলাম ।  এ সি ঘরে সেই দম আটকানো গন্ধে তখন পালাতে পারলে বাঁচি ।

আরেকবার একজনের অবসর গ্রহণ । তিনি সবাইকে খাওয়াবেন । সাধু প্রস্তাব । কিন্তু তিনি পাত পেড়ে খাওয়াবেন ।  সেকশনের সব চেয়ার টেবিল জোড়া দিয়ে তুমুলহর্ষে পঙক্তি ভোজন চলছে , যেন অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে এসেছি
এমন একটা পাবদা মাছ খেতে দিল দেখতে ঠিক ছোটখাট কুমির ছানা । দেখলাম সবার পাতেই ওই রকম কুমির ছানা , আরো কতগুলো গামলার মধ্যে রয়েছে । বিস্ময় প্রকাশ করতে ভদ্রলোক বললেন, “আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম এইরকম মাছই খাওয়াবো , নয় তো খাওয়াবোই না”


ভুবনেশ্বরের গল্প এখনও  কিছুটা বাকি আছে । এদের খাওয়াদাওয়া কিছুটা সরলীকৃত হলেও পুবের দেশের লোকদের মত এরাও বেশ ভালই খাদ্যরসিক । এ হেন পুবের কলিঙ্গকন্যাকে বিয়ে করে ফেলল পশ্চিমের পট্টবর্ধন । চিৎপাবন  ব্রাহ্মণ । মারাঠা  পেশোয়া বালাজি বাজিরাও এর বংশধর । সারাদিন ধরে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা সকালে দুপুরে বিকেলে রাতে কী কী খাবে তাই নিয়ে আলোচনা করে । খাবার নিয়ে এত আলোচনার কি আছে সে ভেবেই পায় না । তাদের তো পাও দিয়েই খাওয়া সারা হয়ে যায় । বড়া পাও, মিসাল পাও , পাও ভাজি, বয়দা (ডিম) পাও।  পাও দিয়েই খাওয়া সারা হয়ে যাচ্ছে ,খামোকা হাতের আর কি দরকার ! দুপুর বেলায় সবাই যত্ন করে নতুন জামাইকে খেতে বসায় ।  জামাই আদর । ভালো ভালো মাছ , নানান সুখাদ্য । পট্টবর্ধন খেতে টেতে ভালোই বাসে । কিন্তু সেদিন তার হাত আর কিছুতেই সরছে না ।গল্পটা অবশ্য ওর মুখ থেকেই শোনা ।

খেতে পারছিলে না কেন?

 “কি করে পারব ম্যাডাম? মছলিকা আঁখ দিখতা হ্যাঁয়” । অর্থাৎ মাছমুন্ড মানে মাছের মুড়ো জামাইকে  খেতে দেওয়া হয়েছিল  আর সে ব্যাটা চোখ প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকলে চিৎপাবন  ব্রাহ্মণ  খায় কেমন করে?   

তবে দেশের পুব পশ্চিম কে হারিয়ে দেবে বাংলার পু্ব পশ্চিমের রান্না নিয়ে কাজিয়া ।ওই সব দেখেই তো কিপলিং সাহেব চুরুট খেতে খেতে লিখলেন
East is East and West is West, and never the twain shall meet





রান্নাপুজো গোটাষষ্ঠী নবান্ন পোঙ্গল রাইসের মত  ওড়িশাতেও তেমনি একটা বিশেষ রান্নাকেন্দ্রিক উৎসব হল ঘ্যাঁট(অ) বা ঘন্ট । একটা পুরো দিন ঘ্যাঁট কে উৎসর্গ করা । মরসুমি সবজি দিয়ে অতি উপাদেয়  ,বাদাম ছোলা এবং নড়ির (বড়ির লম্বা আত্মীয়,অনেকটা কুড়কুড়ের মত দেখতে) সঙ্গতে  আরো সুস্বাদু মাখোমাখো ঘ্যাঁট নানান ছোটো বড় বাক্সে করে অফিসে আসত , এমনকি ঊর্ধ্বতনদের খুশি করবার জন্যও ।

ভুবনেশ্বর থেকে  তো হামেশাই বাড়ি যাওয়া হত । সে রকমই একবার ট্রেনে সামনের বার্থ এ মা আর মেয়ে যাচ্ছে, ওরাও কলকাতারই  । কথায় কথায় আলাপ জমে ওঠে । ভদ্রমহিলা জানান তার স্বামী চাকরিসূত্রে এখানেই থাকেন ।  প্রথম দিকে খাবার  নিয়ে খুব  কষ্ট পেয়েছেন । ভাল রান্নার বা কাজের লোক ছিল না । এদিকে নিজেও রাঁধতে বাড়তে জানেন না । দিনের পর দিন বেজার মুখে থাকার পর, একদিন কাজের ছোকরাটি জানাল , বাবু কাল  দুপুরে আপনাকে খুব ভাল কিছু  খাওয়াব । তখন প্রচন্ড গরম পড়েছে বাবুর তো খুশি আর ধরে না । ছুটির দিন , বাবু সক্কাল সক্কাল চিরতার জলটল  খেয়ে রেডি । কখন দুপুর হবে , কখন খেতে বসবেন । কিন্তু রান্নাঘর থেকে কোন সাড়া শব্দ আসছে না কেন? ছ্যাঁক ছোঁক চটর পটর । তার গিন্নি তো ঘেমে নেয়ে জল হয়ে যান । এইসব ভাবনাচিন্তার  মধ্যেই কাজের লোক টি ডাকতে আসে । বাবু কোনরকমে প্রায় ছুটেই খাবার টেবিলে যান ।কিন্তু খাবার কোথায় ? “কই রে ? কোথায় দিয়েছিস” ?

 ছোকরা সব কটা দাঁত বের করে ইশারায় দেখিয়ে দেয় । বাবু দেখেন টেবিলের ওপর একটা মাঝারি সাইজের স্টিলের বাটি ,থালা দিয়ে চাপা । আর কিছু নেই । রাগে দুঃখে বিস্ময়ে হতাশায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে  বাবু দেখেন স্টিলের বাটির সাদাটে  শান্ত ঘোলা জলে ঘুমিয়ে আছে একরাশ মোটা মোটা ফুলো ফুলো ভাতের দানা, বোধহয় রাত থেকেই , আর তার চার পাশে ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে নানান অনুপান আলুসেদ্ধ ,বড়িভাজাগুঁড়ো , টক দই , লঙ্কা পেঁয়াজ ।

“এটা কী ? ইয়ার্কি পেয়েছো “?

“আজ্ঞা ,পখাল ।এই গরমে পখাল ছাড়া আর কীই বা খাবেন বাবু ? আমাদের ছেলে বুড়ো মেয়ে মদ্দ সবাই পখাল পেলে আর কিছু চায় না । তাই ভাবলাম আপনিও যদি...।“

কথাটা একশ ভাগ সত্যি । ওড়িশার গরমে পান্তাভাত একটা দারুণ উপকারী খাবার । ডাক্তারদের বিবেচনাতেও    গ্রীষ্মকালে রাস্তার পাইস হোটেল থেকে তারকা খচিত হোটেল সর্বত্র পখাল পাওয়া যায় ।ঘরে ঘরে তো বটেই ।






আমরাও শখের পান্তা খেতাম । ভাতের মধ্যে সামান্য ঠান্ডা জল দিয়ে আলুসেদ্ধ  শুকনো লঙ্কা পোড়া পেঁয়াজ কুচি সরষের তেলের ঝাঁজ দিয়ে  যে লোভনীয় খাদ্যটি তৈরি হত তার কাছে কোথায় লাগে পোলাও কালিয়া ।

 “বউঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভাল, খাওয়াতে ভালবাসতেন, এই খাওয়াবার সখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন।ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তাঁর আপন হাতের প্রসাদ । চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পান্তা ভাত যেদিন মেখে দিতেন, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কথা ছিল না “ (ছেলেবেলা রবীন্দ্রনাথ)

দিল্লিতে গীতাজি আমার ঘরদোর  দেখাশোনা  করে ।  নাগপুরের ওই দিকে বাড়ি । দেশ থেকে ফিরে এলে  আমার আবার খুব জানতে ইচ্ছে করে কি কি খেয়েছে  বাপের বাড়ি গিয়ে ।
“সীতাফল , খুব খায়া ” ।  
সীতাফল মানে কাঁড়ি কাঁড়ি আতা খেয়েছে দশ দিন ধরে । বাপরে !  কি বেরসিক রে বাবা ! দূর , এর চেয়ে বেস্পতি ভালো ছিল ।

তবে নিতান্তই ফলাহারের দুটো বর্ণনা  , যেন দুটো ছবি

“খাদ্যের আয়োজন দেখে পুরঞ্জয় বললেন , বাঃ কি সুন্দর! সাত্ত্বিক ভোজন একেই বলে । সাদা কম্বলের আসন , সাদা পাথরের থালায় ধপধপে সাদা চিঁড়ে , সাদা কলা , সাদা সন্দেশ , সাদা বরফি, সাদা নারকেল কোরা , পাথর বাটিতে সাদা দই । আবার সামনে একটি সাদা বেরাল বসে আছে। যশো ,তোমার রুচির তুলনা নেই “।(যশোমতী,রাজশেখর বসু)

দ্বিতীয়টা

“বৌঠাকরুন ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন নিজের হাতের মিষ্টান্ন কিছু কিছু থাকত তার সঙ্গে, আর তার উপরে ছড়ানো হত গোলাপের পাপড়ি গেলাসে থাকত ডাবের জল কিংবা ফলের রস কিংবা কচি তালশাঁস বরফে ঠাণ্ডা করা সমস্তটার উপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদি খুঞ্চেতে করে জলখাবার বেলা একটা দুটোর সময় রওনা করে দিতেন কাছারিতে “(ছেলেবেলা,রবীন্দ্রনাথ)

সাতারায় গান্ধিজির সেবাগ্রামের পাশে খুব সুন্দরএকটা  খাবার দোকান আছে  , মটকায় জল রাখা , নিচু নিচু টেবিল , চারপায়া , নিচে ফরাসের ওপর বসার ব্যাবস্থা । পুরন পোলি , সাবুদানা খিচড়ি ,আমরস পুরী (অমরেশ পুরী খেতে ভালোবাসতেন কিনা জানা নেই অবিশ্যি), ধোকলা , খান্ডভি , শ্রীখন্ড নানা রকম মারাঠি গুজরাটি খাবার ।  ড্রাইভার আর সঙ্গের লোকটি  একটু দূরে বসে খাচ্ছে । অমনি আমার জানতে ইচ্ছে করল ওরা কি খাচ্ছে ।

চোখে মুখে হাসি নিয়ে তারা জানাল জুঙ্কা আর ভাকরির রোটি ।  জুঙ্কা মানে  শুকনো শুকনো ব্যাসন ভাজা । এমন সুযোগ ওরা হাতছাড়া করতে চায় না কারণ আজকাল এইসব খাবার বাড়িতে প্রায় বানানোই বন্ধ হয়ে গেছে । দেশ গাঁয়ে  কেউ  কেউ বানায় । আমার মনে পরে গেল একবার ট্রেনে দুজন রাজস্থানিকে কড়কড়ে দুটো রুটি ঝুরিভাজা দিয়ে খেতে দেখেছিলাম ।




পন্ডিচেরি আশ্রমের খাবার নিয়েও বেশ সরেস গল্প চালু আছে ।  কবি  ও  শিল্পী আশ্রমিক  নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর  বাড়ি থেকে আশ্রমের ডাইনিং হলে যাবার শর্টকাট রাস্তাটাকে ওনারা বলতেন খাইবার পাস । সেখানে খাবারের গুণগত উৎকর্ষ নিয়ে তো কোন প্রশ্নই নেই । কিন্তু খাবারটা বড় সাদামাটা । লক্ষ করেছিলাম অনেক আশ্রমিক ডাইনিং হলে না খেয়ে টিফিন বাক্সতে খাবার ভরে নিয়ে যাচ্ছেন । সত্যিমিথ্যে জানি না আমাকে একজন বলেছিলেন ওমা তাও জানেন না , খাবারটা নিয়ে বাড়ি গিয়ে যে যার মত ফোড়ন টোরন দিয়ে নেয় । কেউ পাঁচ ফোড়ন , কেউ মেথি , ধনেপাতা , সরষে কারিপাতা একটু হলুদ একটু লঙ্কা জিরে  –যার যার স্বাদ মুকুলের চাহিদা মেনে ।

স্বাদ মুকুলের চাহিদা বড় সাঙ্ঘাতিক । লীলা মজুমদার যখন  শান্তিনিকেতনে পড়াতেন, একবার সাঁওতাল  ছেলেমেয়েদের শিঙাড়া জিলিপি খাইয়েছিলেন । সবাই খুব আনন্দ করে খেল । উনি জিগ্যেস করলেন, কিরে কেমন লাগল ?

ভালো, কিন্তুক মেঠো ইঁদুর এর চেয়েও ভালো 

আবার একটা গল্প মনে পড়ল । সোফিয়াদি আর রেজাউলদা কোন এক জংলা জায়গায় আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করত । এটাও ওড়িশাতে, যোশিপুরে । সোফিয়াদিকে ওরা খুব ভালবেসে পাতায় মুড়ে কিছু খেতে দিল । পাতা খুলে তো চোখ ছানাবড়া । কিলবিল করছে পোকা । সোফিয়াদি আর কি করে ? যদি না খায়  ওরা খুব অপমানিত হবে । সোফিয়াদিদের কাজকর্ম শিকেয় উঠবে । তখন বুদ্ধি খাটিয়ে বলেছিল , “শোন তোদের যেমন খাবার ধরাবাঁধা সময় আছে । আমাদেরও তাই । এই খাবারটা বাড়িতেই নিয়ে যাই , সময় মত খেয়ে নেব । কি বলিস?”

লীলা মজুমদারের সেই গল্পটাও একেবারে মোক্ষম । ওনার বাবা জরিপের কাজে ঘুরে বেড়াতেন ,বর্মা মুলুকের  কোন এক জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছেন । একদিন  গ্রামের লোকেরা ঙ াপ্পি তুলছে । পোকা পচানো মাটি দুর্গন্ধে টেকা দায় । প্রায় বমি উঠে আসে আর কি ।  গন্ধ টন্ধ কমে গেলে চান টান করে খেতে  বসেছেন , ঠাকুর গাওয়া ঘি দিয়ে লুচি ভাজছে । এমন সময় একদল লোক নিয়ে মোড়ল এসে হাজির । হাত জোর করে করুণ মিনতি, “ও সাহেব তোমরা কি খাচ্ছ? আমরা যে  গন্ধে আর টিকতে পারছি না “।

 আরেকটা বাজে গল্প আমাদের ডিপার্টমেন্টের  দুই কর্তাদের নিয়ে শুনেছিলাম । দুই জনায় এক জায়গায় বদলি হয়েছিলেন । দুই পরিবারে খুব মিলমিশ । বদলির চাকরিতে যেমনটা হয়ে থাকে । একদিন ক এর বাড়িতে খ গিয়ে হাজির হল এক বারকোশ কাঁঠাল নিয়ে । ক এর আবার কাঁঠাল দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে । এদিকে ক গিন্নি কচুর কোপ্তা সুন্দর করে ধনেপাতা দিয়ে  সাজিয়ে  খ গিন্নিকে দুপুরবেলায় দিয়ে এলেন । দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল  থেকে সন্ধে থেকে রাত থেকে গভীর রাত হল । ক বাবু এদিক ওদিক দেখে একটা কাগজে কাঁঠাল গুলো ভালো করে মুড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সটান ডাস্টবিনের সামনে এসে  ফেলতে গিয়ে দেখেন চারদিকে ছড়িয়ে আছে তাদের অত সাধের  কচুর কোপ্তা । সেই ইস্তক খ বাবুর সঙ্গে তার বনিবনা নেই । দুজনে একজন আরেকজনকে দেখলেই সুরুত করে পালিয়ে যান । ডিপার্টমেন্টের সবাই জানত  ওদের সম্পর্ক ভাল নয় কিন্তু  আসল কারণটা কারুরই জানা ছিল না  ।

আপ রুচি খানা শেষ করব একেবারে হালের একটা গল্প দিয়ে । এবারে দীর্ঘ দিন দেশের বাইরে কাজে গিয়ে দুই চরমপন্থী কট্টর নিরামিষাশীর পাল্লায় পড়ে  প্রথম দিকে বেশ অশান্তির মধ্যে কাটিয়েছিলাম । যেখানেই যাই না কেন হোটেলে গিয়ে শেফদের দিয়ে নিজেদের মত খাবার বানিয়ে নিত । তা সে শেফ হনলুলু , উলানবাটোর, গুয়াতেমালা , আদ্দিস আবাবা ,মাসাইমারা  যেখানকারই হোক না কেন ওই দুজনের পছন্দমাফিক খাবার তাদের বানাতেই হত । এমনি ভাবে দিন কাটতে কাটতে একদিন মেলবোর্নে গিয়ে জানা গেল হোটেলের শেফ একজন ভারতীয় । আর যায় কোথায় ? ঝটপট কাজ হয়ে গেলশুধু ওরা বলল আপনারা নিজেদের ঘরেই খাবেন কেমন?

মিথ্যে বোলব না , অনেকদিন পরে দেখলাম রাত আটটায় দরজার ঘন্টি বাজলেই মনটা কেমন আনচান করে উঠত ।   একটা ফিনফিনে মেয়ে বিশাল ট্রলিতে করে খাবার নিয়ে আসতো  , সঙ্গে আমের চাটনি। 



 এরপর ,  open seasame open seasame .

খুলজা সিম সিম ।

 চিচিং ফাঁক ।
স্বধর্মে  নিধনং শ্রেয়:




ছবির উত্স :গুগল  /নিজের তোলা

Saturday 5 September 2015

এই আসা যাওয়া

 রাগ বিভাস তখন সকালের আলোর সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছে তার  কোমল ঋষভ আর  ধৈবতের  মন্দ্র সুর । সেই শান্ত সকালে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম । সে এক স্নিগ্ধ বনপথ । গাছপালার ভেতর দিয়ে সকালের নরম আলোর  ছড়িয়ে পড়ছে ঘাসে , ফুলে ,পাতায়, শিশিরে ।  আমরা হাঁটছিলাম আর সেই ঢালু বনবীথির মধ্যে  আর আমাদের সঙ্গে সারা  পথ  ভৈরবী বাজিয়ে চলছিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া । ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে  আসছি ঢালু পাহাড়ি পথে, রাগ বিভাসের সঙ্গে তখন মিশে গেছে রামকেলির সঙ্গত, সুরের সেই মধুরিমা লেগে আছে নাম না জানা ফুলের রঙে,  পাতার শোভায়,শিশিরের জলে প্রকৃতির দরাজ আতিথ্য ।  সবুজ গালচের ওপর খেলা  করছে শ্রুতি শাডোলিকরের  আহির ভৈরব । কখনো নির্জন পথের বাঁকে বাঁকে মানুষের আনন্দ আয়োজন । বাচ্চারা খেলা করছে ,নরম রোদে  রঙ বেরঙের উলের গোলা । নিস্তব্ধতার মধ্যে টুকরো টুকরো প্রাণের হিন্দোল , তীব্র মধ্যম আর ধৈবতের গমকে সন্তুর বাজনার মত । সবুজের ঘেরাটোপে হাতে হাত রেখে বসে আছে বৃদ্ধ দম্পতি । মুখে  কোন কথা নেই । সেই না বলা কথা যেন আমির খানের বিলাসখানি টোড়ি । বড় বেদনার মত মধুর । আরো এগিয়ে চলি চরাই উৎরাই বেয়ে । বেলা বাড়তে থাকেবদলে যাচ্ছে রোদ্দুরের রঙ । আলো ছায়া মাখা একা আশাবরী পথ । বড় মোলায়েম ,আপন জনের মত   এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে কেউ যেন  অপেক্ষা করে আছে পথের শেষে ।









আরো কিছু দূরে  যাবার পর সুগন্ধবহ বাতাস এসে হাত ধরে ,কপাল ছুঁয়ে যায় । ল্যাভেন্ডারের বেগুনি ফুলের ভারি গন্ধে ঝিম ধরে আছে চারপাশ । আমরা চলে এসেছি সুগন্ধিবীথিতে । ছোট্ট ছোট্ট ফুলে ভরা গাছে পাতার ঠাস বুনোন ,সবুজ বাদামি রুপুলি , আর একটার পর একটা নাম না জানা সৌরভ । মহার্ঘ সুরভির আঁতুড় ঘর ।



মাথার ভেতর ঝামরে পড়ছে  বৃন্দাবনী সারঙের জলতরঙ্গ । শেষ দুপুরের কমলালেবু রঙের রোদ সেই জলতরঙ্গ নিয়ে গাছে গাছে ঝরে পড়ছে ,  এদিকে রোজমেরি  দিল পারস্লে থাইমের ঘন ঝোপে ঝাড়ে  ঝলসানো অঙ্গারে চিজ গলে গলে যেন রোদ্দুরে শুকোনো চেরি টমেটোর সঙ্গে পেনে পাস্তা রান্নার গন্ধ পাচ্ছি  । জলতরঙ্গের বাজনা ফিকে হয়ে আসছে যেন ।  অমনি ওয়েলিংটনের এই বোটানিক্যাল গার্ডেন,  চারপাশের পাহাড়টা , আকাশটা , গাছপালা সব কেমন বদলে বদলে ঝাপসা ঝাপসা হয়ে গেলআমি দেখতে পেলাম  গ্রামের মেয়ে পুরুষেরা সাজগোজ করে মেলায় চলেছে , ভুট্টা খেতের পাশ দিয়ে , সঙ্গে চলেছে লোম ঝুলঝুলে কুকুর , কোলে কাঁখে লাল লাল গালফুলো বাচ্চা , আলপাইন বনের শনশনে হাওয়ায়  ঘুরছে  উইন্ডমিলের চাকা, উড়ছে গলার রঙিন স্কার্ফ আজ রাতে ভেড়ার তুলতুলে মাংসের রোস্ট হবে অথবা সদ্য ধরা ট্রাউট মাছ , পারস্লে থাইম রোজমেরি মাখানো,সঙ্গে কুড়মুড়ে হেজলনাট  । ইয়র্কশায়ারের স্কারবোরো গ্রামের মেলায় দেদার ফুর্তির বেলুন লোকজনদের পথ আটকে দাঁড়ায় উস্কোখুস্কো চুল ,এক ছোকরা ,নীল চোখদুটো তুলে ,বলে-
Are you going to Scarborough Fair?
Parsley, sage, rosemary, and thyme
Remember me to one who lives there
She once was a true love of mine


Tell her to make me a cambric shirt
   (On the side of a hill in the deep forest green)
Parsley, sage, rosemary, and thyme
   (Tracing a sparrow on snow-crested ground)
Without no seams nor needlework
   (Blankets and bedclothes the child of the mountain)
Then she'll be a true love of mine
   (Sleeps unaware of the clarion call)


Are you going to Scarborough Fair?
Parsley, sage, rosemary, and thyme
Remember me to one who lives there
She once was a true love of mine

রোজমেরির বাগান জুড়ে তখন গান গাইছে সাইমন আর গারফাঙ্কেল । তাদের গিটারের ঝঙ্কারে বুকের ভেতরটা যেন হুহু করে উঠছে । পারস্লে সেজ রোজমেরি থাইম...।
সেই নেশার ঘোর কেটে যেতে দেখি পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেছি । পা  টনটন করছে , একটু বসলে হয় না ? অনেকটা ওপরে ঠান্ডা হাওয়া পাচ্ছি , নিচে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান । সামনে একটা  কাঠের বেঞ্চ । বসলাম । কী অদ্ভুত শান্তি । কেউ কোথাও নেই । কোন শব্দ নেই ,নেই আমার সঙ্গীরাও  কিন্তু আমি কি  এখানে একা বসে আছি? আমার চারপাশে কারা যেন ভিড় করে এসেছে । গোলাপের সুগন্ধ নিয়ে হাওয়ার সঙ্গে তারা সব এসেছে আজ । everything happens for a reason.
বিনা কারণে কিছুই ঘটে না । আমার এখানে আসাটাও নয় । বেটি স্মিথ ডিক স্মিথ আর তাদের নাতি যেন আমাকে বলছে , আর একটু বিশ্রাম নাও, কেমন? তুমি আজ এখানে বসবে বলে আমরা অপেক্ষা করে আছি যে ! আমরা এখানে রোজ আসি । সবার মধ্যে সকলের সঙ্গে এই হাওয়ায় ঘাসে রোদে  মিশে আছি ।  



গোলাপ বাগানের ক্যাফেটারিয়ায় ছুটির দিনের ভিড়ে  উপচে পড়ছে আমোদ । ভেসে আসছে মাছভাজা আর কফির গন্ধ ।   ফোয়ারার জলে খেলে বেড়াচ্ছে আদুরে হাঁস তাদের সবুজ নীল বাদামি পালক নিয়ে , পোষা কুকুরগুলো তেড়ে যাচ্ছে ওদের দিকে । প্রেমিক প্রেমিকা বাবা মা দাদু দিদু কাচ্চা বাচ্চা , জম্পেশ গুলতানি । নিমেষে ফুরিয়ে যাচ্ছে কোকের বোতল ,ফুরিয়ে যাচ্ছে সময় , ফুরিয়ে যাচ্ছে আনন্দহাট ...জীবন ।


 আর তার একটু দূরে একটু ওপরে  নিকলসন আর কলিন হাত ধরাধরি করে বসে আছে । দেখতে পাচ্ছেন না ?ওই যে সবুজ ঘাসের ঢালু জমিটা ,ওইখানে ।  কেমন দুজনে বসে আছে । তাকিয়ে আছে দূরের গোলাপ বাগানের দিকে ।  সেখানে খুশির আতস বাজি জ্বালিয়েছে সবাই ।
কলিনের হাতের মধ্যমায় হিরের আংটি,  সেই কবে নিকলসন উপহার দিয়েছিল । হালকা গোলাপি স্কারট আর সাদা ব্লাউস , তাতে মুক্তোর মত ছোট ছোট বল লাগানো , নিকলসন পুরোদস্তুর সাহেব সেজে আছে । লম্বা কালো ছাতাটা হাতের কাছে । কলিনের হাতে বাস্কেট ঝুরির মত ব্যাগ । সাদা গোলাপি খোপকাটা টুপি আলতো করে ধরে আছে তার রুপুলি পাক ধরা বাদামি চুল । হাসছে ওরা । চোখের দুপাশে চামড়া কুঁচকে কুঁচকে  যাচ্ছে ।



“ক্রিম লাগাচ্ছো না ?” নিকলসন জিজ্ঞেস করে ।
“ওসব তো লাগে না এখন” ।
দুজনে চোখে চোখ রেখে নীরবে হাসে আর বাতাসে খেলা করে বিঠোফেনের মুনলাইট সোনাটা । শুধু নিকলসন আর কলিনই নয়  আরো অনেক ভালবাসা ও উত্তাপ  এই ঘাসের ওপরে পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে আছে , তুমি শুধু শ্রান্ত হয়ে তাদের আশ্রয়ে এসে বোসো ,দেখো  এই সুগন্ধি  বনবীথির মধ্যে কী অর্থপূর্ণ করে ওরা রেখে  গেছে ওদের জীবন । “কতো  স্মৃতি কতো কথা কতো দীর্ঘশ্বাস আর হাসি কতো গান আর অভিমান আমাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অশরীরী , অনবয়ব “
এই শান্ত সকালে তারা যেন ছুঁতে চায় আমাদের । বিছিয়ে রেখেছে  সমৃতি মাখা  আরাম  কেদারা  
 “কী দেখছো অত বাছা? “
পেছন ফিরে দেখি দুই মাসি দাঁড়িয়ে আছে ।  ধরা যাক অ্যানি আর ক্যাথি মাসি । যদিও এখানে কেউ গায়ে পড়ে কথা বলেনা । এরা কিন্তু বললেন ।
আমি বললাম , খুব ভালো লাগছে , দেখুন কতো ভালোবেসে স্মৃতিকে আগলে রেখেছে । যারা লিখেছে তারাও হয়তো অনেকেই নেই , কিন্তু খুব বেশি করে আছে , আমাদের থেকেও অনেক বেশি করে । তাদের ভালবাসার উত্তাপ স্নেহের স্পর্শ আমার মত ভিনদেশিকেও কেমন ছুঁয়ে যাচ্ছে ।

দেখলাম ওদের চোখ একটু চিকচিক করছে ।
বলল , “তোমার ভাল লেগেছে”?
চুপ করে রইলাম ।
 প্রকৃতির এই নিবিড় ব্যাপ্তির মধ্যে একদিকে  খন্ড জীবনের নশ্বর  কলতান আর একদিকে  স্মৃতিকীর্ণ পথে অনন্ত জীবনের উদাস স্নিগ্ধতার মধ্যে দিয়ে দুজনে চলে গেলেন ।
কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে দেখি ওপরে পাহাড়ের কিনারে ওরা নিচে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, হাসছেন  । হাত নাড়লাম ।
ভালো থেকো , অ্যানি মাসি ক্যাথি মাসি ।

“অস্থায়ী তাঁবুর নিচে এই তো কজন
কিছুদিন থাকা কাছাকাছি
ঘরোয়া বাগানটুকু যেন তাঁর খেলাঘর
খোঁজ নিতে পাঠান মৌমাছি
পাঠান রোদ ও জ্যোৎস্না ঝড় ও বৃষ্টি
মাঝে মাঝে উড়ো চিঠি
“আছি, আমি আছি “


কবিতাঃ বাসুদেব দেব