Saturday 5 September 2015

এই আসা যাওয়া

 রাগ বিভাস তখন সকালের আলোর সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছে তার  কোমল ঋষভ আর  ধৈবতের  মন্দ্র সুর । সেই শান্ত সকালে আমরাও বেরিয়ে পড়লাম । সে এক স্নিগ্ধ বনপথ । গাছপালার ভেতর দিয়ে সকালের নরম আলোর  ছড়িয়ে পড়ছে ঘাসে , ফুলে ,পাতায়, শিশিরে ।  আমরা হাঁটছিলাম আর সেই ঢালু বনবীথির মধ্যে  আর আমাদের সঙ্গে সারা  পথ  ভৈরবী বাজিয়ে চলছিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া । ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে  আসছি ঢালু পাহাড়ি পথে, রাগ বিভাসের সঙ্গে তখন মিশে গেছে রামকেলির সঙ্গত, সুরের সেই মধুরিমা লেগে আছে নাম না জানা ফুলের রঙে,  পাতার শোভায়,শিশিরের জলে প্রকৃতির দরাজ আতিথ্য ।  সবুজ গালচের ওপর খেলা  করছে শ্রুতি শাডোলিকরের  আহির ভৈরব । কখনো নির্জন পথের বাঁকে বাঁকে মানুষের আনন্দ আয়োজন । বাচ্চারা খেলা করছে ,নরম রোদে  রঙ বেরঙের উলের গোলা । নিস্তব্ধতার মধ্যে টুকরো টুকরো প্রাণের হিন্দোল , তীব্র মধ্যম আর ধৈবতের গমকে সন্তুর বাজনার মত । সবুজের ঘেরাটোপে হাতে হাত রেখে বসে আছে বৃদ্ধ দম্পতি । মুখে  কোন কথা নেই । সেই না বলা কথা যেন আমির খানের বিলাসখানি টোড়ি । বড় বেদনার মত মধুর । আরো এগিয়ে চলি চরাই উৎরাই বেয়ে । বেলা বাড়তে থাকেবদলে যাচ্ছে রোদ্দুরের রঙ । আলো ছায়া মাখা একা আশাবরী পথ । বড় মোলায়েম ,আপন জনের মত   এক গ্লাস ঠান্ডা জল নিয়ে কেউ যেন  অপেক্ষা করে আছে পথের শেষে ।









আরো কিছু দূরে  যাবার পর সুগন্ধবহ বাতাস এসে হাত ধরে ,কপাল ছুঁয়ে যায় । ল্যাভেন্ডারের বেগুনি ফুলের ভারি গন্ধে ঝিম ধরে আছে চারপাশ । আমরা চলে এসেছি সুগন্ধিবীথিতে । ছোট্ট ছোট্ট ফুলে ভরা গাছে পাতার ঠাস বুনোন ,সবুজ বাদামি রুপুলি , আর একটার পর একটা নাম না জানা সৌরভ । মহার্ঘ সুরভির আঁতুড় ঘর ।



মাথার ভেতর ঝামরে পড়ছে  বৃন্দাবনী সারঙের জলতরঙ্গ । শেষ দুপুরের কমলালেবু রঙের রোদ সেই জলতরঙ্গ নিয়ে গাছে গাছে ঝরে পড়ছে ,  এদিকে রোজমেরি  দিল পারস্লে থাইমের ঘন ঝোপে ঝাড়ে  ঝলসানো অঙ্গারে চিজ গলে গলে যেন রোদ্দুরে শুকোনো চেরি টমেটোর সঙ্গে পেনে পাস্তা রান্নার গন্ধ পাচ্ছি  । জলতরঙ্গের বাজনা ফিকে হয়ে আসছে যেন ।  অমনি ওয়েলিংটনের এই বোটানিক্যাল গার্ডেন,  চারপাশের পাহাড়টা , আকাশটা , গাছপালা সব কেমন বদলে বদলে ঝাপসা ঝাপসা হয়ে গেলআমি দেখতে পেলাম  গ্রামের মেয়ে পুরুষেরা সাজগোজ করে মেলায় চলেছে , ভুট্টা খেতের পাশ দিয়ে , সঙ্গে চলেছে লোম ঝুলঝুলে কুকুর , কোলে কাঁখে লাল লাল গালফুলো বাচ্চা , আলপাইন বনের শনশনে হাওয়ায়  ঘুরছে  উইন্ডমিলের চাকা, উড়ছে গলার রঙিন স্কার্ফ আজ রাতে ভেড়ার তুলতুলে মাংসের রোস্ট হবে অথবা সদ্য ধরা ট্রাউট মাছ , পারস্লে থাইম রোজমেরি মাখানো,সঙ্গে কুড়মুড়ে হেজলনাট  । ইয়র্কশায়ারের স্কারবোরো গ্রামের মেলায় দেদার ফুর্তির বেলুন লোকজনদের পথ আটকে দাঁড়ায় উস্কোখুস্কো চুল ,এক ছোকরা ,নীল চোখদুটো তুলে ,বলে-
Are you going to Scarborough Fair?
Parsley, sage, rosemary, and thyme
Remember me to one who lives there
She once was a true love of mine


Tell her to make me a cambric shirt
   (On the side of a hill in the deep forest green)
Parsley, sage, rosemary, and thyme
   (Tracing a sparrow on snow-crested ground)
Without no seams nor needlework
   (Blankets and bedclothes the child of the mountain)
Then she'll be a true love of mine
   (Sleeps unaware of the clarion call)


Are you going to Scarborough Fair?
Parsley, sage, rosemary, and thyme
Remember me to one who lives there
She once was a true love of mine

রোজমেরির বাগান জুড়ে তখন গান গাইছে সাইমন আর গারফাঙ্কেল । তাদের গিটারের ঝঙ্কারে বুকের ভেতরটা যেন হুহু করে উঠছে । পারস্লে সেজ রোজমেরি থাইম...।
সেই নেশার ঘোর কেটে যেতে দেখি পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেছি । পা  টনটন করছে , একটু বসলে হয় না ? অনেকটা ওপরে ঠান্ডা হাওয়া পাচ্ছি , নিচে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ গোলাপের বাগান । সামনে একটা  কাঠের বেঞ্চ । বসলাম । কী অদ্ভুত শান্তি । কেউ কোথাও নেই । কোন শব্দ নেই ,নেই আমার সঙ্গীরাও  কিন্তু আমি কি  এখানে একা বসে আছি? আমার চারপাশে কারা যেন ভিড় করে এসেছে । গোলাপের সুগন্ধ নিয়ে হাওয়ার সঙ্গে তারা সব এসেছে আজ । everything happens for a reason.
বিনা কারণে কিছুই ঘটে না । আমার এখানে আসাটাও নয় । বেটি স্মিথ ডিক স্মিথ আর তাদের নাতি যেন আমাকে বলছে , আর একটু বিশ্রাম নাও, কেমন? তুমি আজ এখানে বসবে বলে আমরা অপেক্ষা করে আছি যে ! আমরা এখানে রোজ আসি । সবার মধ্যে সকলের সঙ্গে এই হাওয়ায় ঘাসে রোদে  মিশে আছি ।  



গোলাপ বাগানের ক্যাফেটারিয়ায় ছুটির দিনের ভিড়ে  উপচে পড়ছে আমোদ । ভেসে আসছে মাছভাজা আর কফির গন্ধ ।   ফোয়ারার জলে খেলে বেড়াচ্ছে আদুরে হাঁস তাদের সবুজ নীল বাদামি পালক নিয়ে , পোষা কুকুরগুলো তেড়ে যাচ্ছে ওদের দিকে । প্রেমিক প্রেমিকা বাবা মা দাদু দিদু কাচ্চা বাচ্চা , জম্পেশ গুলতানি । নিমেষে ফুরিয়ে যাচ্ছে কোকের বোতল ,ফুরিয়ে যাচ্ছে সময় , ফুরিয়ে যাচ্ছে আনন্দহাট ...জীবন ।


 আর তার একটু দূরে একটু ওপরে  নিকলসন আর কলিন হাত ধরাধরি করে বসে আছে । দেখতে পাচ্ছেন না ?ওই যে সবুজ ঘাসের ঢালু জমিটা ,ওইখানে ।  কেমন দুজনে বসে আছে । তাকিয়ে আছে দূরের গোলাপ বাগানের দিকে ।  সেখানে খুশির আতস বাজি জ্বালিয়েছে সবাই ।
কলিনের হাতের মধ্যমায় হিরের আংটি,  সেই কবে নিকলসন উপহার দিয়েছিল । হালকা গোলাপি স্কারট আর সাদা ব্লাউস , তাতে মুক্তোর মত ছোট ছোট বল লাগানো , নিকলসন পুরোদস্তুর সাহেব সেজে আছে । লম্বা কালো ছাতাটা হাতের কাছে । কলিনের হাতে বাস্কেট ঝুরির মত ব্যাগ । সাদা গোলাপি খোপকাটা টুপি আলতো করে ধরে আছে তার রুপুলি পাক ধরা বাদামি চুল । হাসছে ওরা । চোখের দুপাশে চামড়া কুঁচকে কুঁচকে  যাচ্ছে ।



“ক্রিম লাগাচ্ছো না ?” নিকলসন জিজ্ঞেস করে ।
“ওসব তো লাগে না এখন” ।
দুজনে চোখে চোখ রেখে নীরবে হাসে আর বাতাসে খেলা করে বিঠোফেনের মুনলাইট সোনাটা । শুধু নিকলসন আর কলিনই নয়  আরো অনেক ভালবাসা ও উত্তাপ  এই ঘাসের ওপরে পাহাড়ের ঢালে ছড়িয়ে আছে , তুমি শুধু শ্রান্ত হয়ে তাদের আশ্রয়ে এসে বোসো ,দেখো  এই সুগন্ধি  বনবীথির মধ্যে কী অর্থপূর্ণ করে ওরা রেখে  গেছে ওদের জীবন । “কতো  স্মৃতি কতো কথা কতো দীর্ঘশ্বাস আর হাসি কতো গান আর অভিমান আমাদের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অশরীরী , অনবয়ব “
এই শান্ত সকালে তারা যেন ছুঁতে চায় আমাদের । বিছিয়ে রেখেছে  সমৃতি মাখা  আরাম  কেদারা  
 “কী দেখছো অত বাছা? “
পেছন ফিরে দেখি দুই মাসি দাঁড়িয়ে আছে ।  ধরা যাক অ্যানি আর ক্যাথি মাসি । যদিও এখানে কেউ গায়ে পড়ে কথা বলেনা । এরা কিন্তু বললেন ।
আমি বললাম , খুব ভালো লাগছে , দেখুন কতো ভালোবেসে স্মৃতিকে আগলে রেখেছে । যারা লিখেছে তারাও হয়তো অনেকেই নেই , কিন্তু খুব বেশি করে আছে , আমাদের থেকেও অনেক বেশি করে । তাদের ভালবাসার উত্তাপ স্নেহের স্পর্শ আমার মত ভিনদেশিকেও কেমন ছুঁয়ে যাচ্ছে ।

দেখলাম ওদের চোখ একটু চিকচিক করছে ।
বলল , “তোমার ভাল লেগেছে”?
চুপ করে রইলাম ।
 প্রকৃতির এই নিবিড় ব্যাপ্তির মধ্যে একদিকে  খন্ড জীবনের নশ্বর  কলতান আর একদিকে  স্মৃতিকীর্ণ পথে অনন্ত জীবনের উদাস স্নিগ্ধতার মধ্যে দিয়ে দুজনে চলে গেলেন ।
কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে দেখি ওপরে পাহাড়ের কিনারে ওরা নিচে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, হাসছেন  । হাত নাড়লাম ।
ভালো থেকো , অ্যানি মাসি ক্যাথি মাসি ।

“অস্থায়ী তাঁবুর নিচে এই তো কজন
কিছুদিন থাকা কাছাকাছি
ঘরোয়া বাগানটুকু যেন তাঁর খেলাঘর
খোঁজ নিতে পাঠান মৌমাছি
পাঠান রোদ ও জ্যোৎস্না ঝড় ও বৃষ্টি
মাঝে মাঝে উড়ো চিঠি
“আছি, আমি আছি “


কবিতাঃ বাসুদেব দেব