“সকালবেলা একা একা আবার হাঁটতে যাবেন না যেন ।“
“কেন, গেলে কী হবে? “ খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি । আমার তো যাবার খুবই ইচ্ছে । হবে নাই বা
কেন? যে দিকে দু চোখ যায় সবুজ গাছের সারি আর চকচকে রাস্তা । দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়
।
“কিছুদূর গিয়েই হয়ত দেখলেন চুপিচুপি পেছনে একটা চিতাবাঘ আসছে । তখন ? এখানে যে
কতো দুর্ঘটনা ঘটেছে ,তাই বলছিলাম সাবধানের মার নেই”।
আমাকে এই কথা গুলো বুঝিয়ে সে রাতের মতো কেয়ারটেকারটি বিদায় নিল ।
না এটা কোন বনবাংলো নয় । এসেছি চান্দায় (মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর) গোলাবারুদ
ফ্যাক্টরি তে নিতান্তই অফিসের কাজে । ফ্যাক্টরিগুলো শহরের বাইরেই বেশি হয় । বেশ
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গাছপালা ঘেরা অনেক অনেক জায়গা
। তার যে এমন মারাত্মক গল্প আছে কে জানতো ।
পরের দিন প্রায় সারা রাত ধরে ক্যানেস্তারা পেটানোর শব্দ শুনলাম , চিতা বাঘ
তাড়ানো হচ্ছে । ইঁদুর ধরার খাঁচা বাড়িতে যেমন রাখা হয় তেমনি চিতা ধরবার জন্য বড়বড়
খাঁচা বসান হয় এখানে ।
চান্দায় এসেছি অথচ তাড়োবার জঙ্গল দেখতে যাব না ? এখানকার সেই চার বাচ্চেওয়ালি বাঘিনী তখন রীতিমত বিখ্যাত ।
“তাড়োবায় আর গিয়ে কী করবেন ? এখানেই
বসে থাকুন , ওখানে যা যা দেখতে পেতেন ,দেখবেন সবই একে একে আপনার সামনে হাজির হচ্ছে । “
কর্মকর্তাদের একজন কেউ আমাকে বললেন । আসলে তাড়োবার জঙ্গল ঘিরে আছে চান্দা
ফ্যাক্টরিকে । “জঙ্গল তো পাতলা হয়েই আসছে । তাই এখানেই আমরা অনেক কিছু
দেখতে পাই “। অর্থাৎ চান্দার গেস্ট হাউস কোন ফরেস্ট বাংলোর
চেয়ে কম কিছু নয় ।
সেদিক থেকে আমাদের সল্টলেকের সরকারি বাড়িটা ছিল খুবই ইকো ফ্রেন্ডলি । মাঝে মাঝে শীতের রাতে জমকালো হুক্কাহুয়া হুয়া হুয়া ডাকে মনে হত যেন শীতটা আরো জাঁকিয়ে পড়ল । বাগানে
একটা ঢোঁড়া সাপ নিয়ম করে বেড়াতে আসত । তবে খুব বেশি নয় কারণ চারদিকে বেজিরা টহল
দিত । আর ছিল প্রচুর পাখি । ফিঙে , দোয়েল
, মৌটুসি আরো অনেক আমি তাদের নামও জানিনা । একটু হলুদ ডানার ঝলক একটু বাহারি ঝুঁটির দেমাক
দেখিয়ে উড়ে পালিয়ে যেত । বাগানে রাজত্ব ছিল কাঠবেড়ালিদের । আমরা মুড়ি
বাদাম ছড়াতাম , পাখিদের খাবার দিতাম । নীল ডানা ছড়িয়ে কিংফিশার মাছরাঙা বসে থাকতো
। এমনকি লাল চোখো রাগী কোকিল কতবার
পাতার ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেছে । গা ঘষটে ঘষটে শামুকের দল বারান্দায় উঠে পড়ত । অবিশ্যি
ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফের খেসারৎ ও ছিল ভালোই । দেওয়াল আলমারিতে উই
লেগে সবকিছু নষ্ট হয়ে যেত ।
এই প্রকৃতি ,মহাবিশ্ব মহাকাশ আর আমি একা মানুষ এই দুই এর মধ্যে যে নিবিড় অচ্ছেদ্য একাত্মতা সেটা
ভেঙে গেলেই যত উৎপাত আর গন্ডগোলের শুরু । মানসিক শারীরিক সবকিছুর । আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের
জাইরোসোনিক্সের ( Gyrosonics) গবেষণার বিষয় তাই । সজল দা বলেন মাটির কাছাকাছি
থাকবি, ঘাসে ,রোদে জলে মিশে । সজলদা চিনিয়ে দেন ,দেখ সব জায়গায় কেমন একই প্যাটার্ন
, গাছের পাতায় শিরা উপশিরার জালি , আকাশ চেরা বিদ্যুৎ, তোর হাতের রক্ত বয়ে নিয়ে
যাওয়া নালী গুলো সব এক প্যাটার্নের । ছক একটাই । ফ্র্যাক্টাল । চালাকি করে ডিজাইন ভেঙেছিস
কি মরেছিস । সজল দা কে বলি ,জানেন
কাঠগোলাপ গাছটায় বসার একটা সুন্দর ব্যাবস্থা বের করেছি । নাম দেওয়া যেতে পারে Frangipani couch । বেশ আরামেই বসা যায় । আমি সকালে ওখানে বসেই চা খাই , খবরের কাগজও পড়ি । দু
একটা কাঠ পিঁপড়ে আসে না যে তা নয় ,একটু টোকা মেরে ফেলে দিলেই হয় । একদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি এসে গেল । ঘন পাতার জন্য গায়ে জল পড়ছিল না । ওমা , কোত্থেকে একটা বড় পাখি (নাম
জানিনা) বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাছটার পাতার নিচে এসে বসলো । আমি ও বসে আছি , পাখিও
বসে আছে । আমাদের দুজনকেই গাছ জড়িয়ে আছে নিবিড় ভালবাসায় ।
সজলদা শুনে বলেন গাছ থেকে এনার্জি নিয়ে নিবি , ওর থেকে শক্তিশালী পজিটিভ এনার্জি
বের হয় । চুপ করে বসে থাকবি ওর নিচে ।
যত্ন করে প্রাণায়াম তো আর করা হয় না ,ওই একদিন বসে দম নিচ্ছি ,ছাড়ছি । একটা
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ,একটা ছন্দে বলা যেতে পারে । একটা মৌটুসি পাখি তার
রিনরিনে সুরেলা গলায় ওই একই মাত্রায় ডেকে যাচ্ছে ,আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আর তার
ডাক তালে তালে কেমন জড়িয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে !
Frangipani couch সল্ট লেকের বাড়িতে |
আজকাল লোকে দেদার পয়সা খরচ করে ইকো ফ্রেন্ডলি ট্যুর করে । দুই কিস্তিতে সাত
বছর ভুবনেশ্বর বাস আমার সে শখ মিটিয়ে দিয়েছে । আমি দুটো বাড়িতে থেকেছি এক নম্বর আর এগারো নম্বর । এলাকা টার নামও একেবারে মানানসই , ফরেস্ট পার্ক
।
এক নম্বর বাড়িতে বারান্দাটা দেখা যেত না । ছাদ থেকে লতানো পাতা দিয়ে পাতার
ঠাসবুনুনি পর্দা করা ছিল মাটি পর্যন্ত । আমি তো আর টারজান নই । সেই পর্দা উপড়ে
ফেলতেই হল । সাবাড় করে দিতে হল পাতা পচানো সারের দুটি ঢিবি । তার দুর্গন্ধে টেকা
দায় । বাগানের চৌবাচ্চায় এই বড়বড় কচ্ছপের সাইজের ব্যাং থাকত । আর তাদের কী ডাক ।
পিলে চমকানো । আর সারা বাড়ি জুড়ে তিড়িং বিড়িং লাফাতো নানান সাইজের ব্যাং । সাপের
কথা আর আলাদা করে কি লিখব ।
গাছপালার বাড়বাড়ন্তের সীমা তো ছিলই না । এই কাটছি এই গজাচ্ছে । এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম । নাম না জানা পোকা বোঁ করে ঘুরপাক খেয়ে কামড়ে
দিয়ে চলে যেত । সেই ভয়ঙ্কর মুখ নিয়ে অফিস ও করতে হয়েছে । বোলতার কামড় তো খেতে
হয়েইছে । চান টান করে বেশ তোয়ালে দিয়ে গা হাত পা মুছলেন , কিন্তু সারা শরীর চুলকে
একসা ! তোয়ালের গায়ে তো শুঁয়ো পোকা লেগেছিল । তাকে তো খেয়াল করাই হয় নি । এসব তো
আমাদের হামেশাই হত । ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফে
আরেকটা দরকারি বিষয় হল সেন্স অফ টাইমিং । সেটা কী রকম ? যেমন পিঁপড়ের সারি যেই
মাটি তুলতে শুরু করবে বুঝে নিতে হবে মেঘ ডাকল বলে । কাজেই হাতের কাছে সব গুছিয়ে
নিতে হবে কারণ গাছের দুলুনিতে ঘষা খেয়ে এক্ষুনি ইলেক্ট্রিকের তার ছিঁড়ে কারেন্ট
চলে যাবে । ইনভারটার আবার ইকো ফ্রেন্ডলি বাড়িতে থাকে নাকি ?
বৃষ্টি শেষ হলেই ফড়ফড় করে উড়তে শুরু করবে উই পোকার দল । যদি দরজা জানালা খোলা
পায় তবে আর রক্ষে নেই । রেড্ডি আগেরদিন নুনের বদলে চিনি
দিয়ে চিকেন রান্না করেছিল বলে আমি রেগে মেগে নিজেই রান্না ঘরে ঢুকলাম । খেয়ালও করিনি
যে গোধূলির আকাশ পতঙ্গে পতঙ্গে ছয়লাপ । তারপর যা হবার তাই হল । চিকেন আর উইপোকার
একটা নতুন রেসিপি ।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি বাড়ির
চারদিকে প্রচুর লোকের জটলা । এ তল্লাটে যে
এতো লোক আছে তাই জানতাম না । তারা সব্বাই ওপর
দিকে গাছগুলোর মাথার দিকে তাকিয়ে খুব উত্তেজিত ভাবে খুব চিল্লামিল্লি করছে ।
“ওই যে ওখানে । না না ওই তো সেই দিকে” এপটে
ওপটে পিছপটে । তার মধ্যে আমাদের
মিত্তুন আর রেড্ডি লাঠি সোটা নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করছে । সে এক মহা যুদ্ধের প্রস্তুতি ।
আমার গলা শোনা তো দূরের কথা । আমাকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না । কোনরকমে ওদের থামিয়ে
জিগ্যেস করি , ব্যাপারটা কি ? কি হয়েছে বলবি তো?
ঘেমে নেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ গোলগোল করে রেড্ডি বলল “শ রি
য়া প তি নি”।
সেটা কি ? ভূতপেত্নী না কোন অপদেবতা? অনুমান করলাম শরিয়াপতিনি বলে কিছু একটা এ
ডালে সে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে । সবাই তারই পেছনে পেছনে ছুটছে । তবে রেড্ডি যেভাবে
কথাটা বলল তাতে মনে একটু খটকা লাগছিল । একটু চিন্তাও হচ্ছিল । কাছেই চন্দকা ফরেস্ট । কি জানি কী এসে পড়ল আবার?
তবুও এ ভাবে কাঁহাতক আর দাঁড়িয়ে থাকা যায়
? ঘরে ঢুকতে যাব ,সমস্বরে চিৎকার “পশি গলা ,পশি গলা ,পশি গলা ”।
আবার কি হল ? জানা গেল সেই শরিয়াপতিনি লাফ দিয়ে রান্নাঘরের চিমনির মধ্যে ঢুকে
পড়েছে । চিমনি দিয়ে যে রান্নাঘরে সেঁধিয়ে যাবে সে উপায় নেই কারণ সে রাস্তা আগেই
বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । ধোঁয়া বের হবার চিমনি ,আজকাল তার ব্যাবহার নেই
। তার মানে শরিয়াপতিনি এখন অন্ধকূপে নাকানি চোবানি খাচ্ছে । দেখলাম মিত্তুন আর রেড্ডি
লাফ মেরে কার্নিশ বেয়ে একেবারে বাড়ির ছাদে । নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আগ্রহী জনতার একদল স্রেফ মজা দেখছে , আরেক দল
ওই দু জনকে নানান উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে । জল ঢাল , না না আগুন দিয়ে ভয় দেখাও , নানা
অন্য কিছু কর , দাঁড়াও, ভেবে বলছি । রেড্ডি এরই মধ্যে বাঁশের মাথায় কাপড়ের পুঁটলি
বেঁধে আগুন জ্বালাবার জন্য তৈরি । চারদিকে হুলুস্থূল ,চেঁচা মেচি আর চিমনির ভেতরে
সেই শরিয়াপতিনির লম্ফঝম্প ।
এদিকে বসার ঘরে টেলিফোন ঝন ঝন করে বেজেই যাচ্ছে । উফ এসময় আবার কে ফোন করে? ফোন টা
তুলতেই হল ।
ওপাশ থেকে কেউ বলে চলেছে “ আপনার বাড়িতে একটা
শরিয়াপতিনি আটকে পড়েছে ? “
“হ্যাঁ পড়েছে ,তা আমি কি করতে পারি বলুন?” আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি ।
“ওড়িশা ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট অনুসারে শরিয়াপতিনি
এনডেঞ্জারড স্পেসিস । সুতরাং প্রাণী টির
যদি কোন ক্ষতি হয় বুঝতেই পারছেন আপনার
কী হতে পারে?”
“মানে? আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন ? আমার বাড়িতে ঢুকে গেলে
আমি কী করতে পারি ?”
কে ফোন করছে, কোত্থেকে করছে , কিভাবে খবর পেল ? কিছু না জিজ্ঞেস করে আমি অসম্ভব রেগে যেতে থাকি । এমনিতেই মাথা গরম হয়েই ছিল ।
কে ফোন করছে, কোত্থেকে করছে , কিভাবে খবর পেল ? কিছু না জিজ্ঞেস করে আমি অসম্ভব রেগে যেতে থাকি । এমনিতেই মাথা গরম হয়েই ছিল ।
“আমি অত কিছু জানতে চাই না । শুধু জানাচ্ছি আইন অনুযায়ী ব্যাবস্থা
নিতে বাধ্য হব যদি শরিয়াপতিনির কিছু হয়...”
মিনিট কয়েক ধরে আমাদের
চাপান উতোর চলতেই
থাকে ।
হঠাত্ লোকটির গলা
ছাপিয়ে তখন আরেকটা চিল চিৎকার , এবার হিন্দিতে , “নিকাল গয়া, নিকাল গয়া ,
নিকাল গয়া ”।
নিকাল গয়া ”।
শরিয়াপতিনি একটা ওয়াইল্ড ক্যাট ,জংলি বিল্লি বা লেপার্ড ক্যাট ( Prionailurus Bengalensis) !