Friday 29 August 2014

ইকো ফ্রেন্ডলি

 
“সকালবেলা একা একা আবার হাঁটতে যাবেন না যেন ।“
“কেন, গেলে কী হবে? “ খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি ।  আমার তো যাবার খুবই ইচ্ছে । হবে নাই বা কেন? যে দিকে দু চোখ যায় সবুজ গাছের সারি আর চকচকে রাস্তা । দেখলেই মন ভাল হয়ে যায় ।
“কিছুদূর গিয়েই হয়ত দেখলেন চুপিচুপি পেছনে একটা চিতাবাঘ আসছে । তখন ? এখানে যে কতো দুর্ঘটনা ঘটেছে ,তাই বলছিলাম সাবধানের মার নেই”।
আমাকে এই কথা গুলো বুঝিয়ে সে রাতের মতো কেয়ারটেকারটি বিদায় নিল ।
না এটা কোন বনবাংলো নয় । এসেছি চান্দায় (মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর) গোলাবারুদ ফ্যাক্টরি তে নিতান্তই অফিসের কাজে । ফ্যাক্টরিগুলো শহরের বাইরেই বেশি হয় । বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গাছপালা ঘেরা অনেক অনেক জায়গা  । তার যে এমন মারাত্মক গল্প আছে কে জানতো ।
পরের দিন প্রায় সারা রাত ধরে ক্যানেস্তারা পেটানোর শব্দ শুনলাম , চিতা বাঘ তাড়ানো হচ্ছে । ইঁদুর ধরার  খাঁচা বাড়িতে যেমন রাখা হয় তেমনি চিতা ধরবার জন্য বড়বড় খাঁচা বসান হয় এখানে ।
চান্দায় এসেছি অথচ তাড়োবার জঙ্গল দেখতে যাব না ? এখানকার সেই  চার বাচ্চেওয়ালি বাঘিনী তখন রীতিমত বিখ্যাত ।
“তাড়োবায়  আর গিয়ে কী করবেন ? এখানেই বসে থাকুন , ওখানে যা যা দেখতে পেতেন ,দেখবেন সবই  একে একে আপনার সামনে হাজির হচ্ছে । “ কর্মকর্তাদের একজন কেউ আমাকে বললেন । আসলে তাড়োবার জঙ্গল ঘিরে আছে চান্দা ফ্যাক্টরিকে । “জঙ্গল তো পাতলা হয়েই আসছে । তাই এখানেই আমরা  অনেক  কিছু দেখতে পাই “।   অর্থাৎ চান্দার গেস্ট হাউস কোন ফরেস্ট বাংলোর চেয়ে কম কিছু নয় ।
সেদিক থেকে আমাদের সল্টলেকের সরকারি বাড়িটা ছিল খুবই ইকো ফ্রেন্ডলি । মাঝে মাঝে শীতের রাতে জমকালো হুক্কাহুয়া হুয়া হুয়া  ডাকে মনে হত যেন শীতটা আরো জাঁকিয়ে পড়ল । বাগানে একটা ঢোঁড়া সাপ নিয়ম করে বেড়াতে আসত । তবে খুব বেশি নয় কারণ চারদিকে বেজিরা টহল দিত ।  আর ছিল প্রচুর পাখি । ফিঙে , দোয়েল , মৌটুসি আরো অনেক আমি তাদের নামও জানিনা ।  একটু হলুদ ডানার ঝলক একটু বাহারি ঝুঁটির দেমাক দেখিয়ে উড়ে পালিয়ে  যেত ।  বাগানে রাজত্ব ছিল কাঠবেড়ালিদের । আমরা মুড়ি বাদাম ছড়াতাম , পাখিদের খাবার দিতাম । নীল ডানা ছড়িয়ে কিংফিশার মাছরাঙা  বসে থাকতো  ।  এমনকি লাল চোখো রাগী কোকিল কতবার পাতার ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেছে । গা ঘষটে ঘষটে শামুকের দল বারান্দায় উঠে পড়ত । অবিশ্যি ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফের খেসারৎ ও  ছিল ভালোই  ।  দেওয়াল আলমারিতে উই লেগে সবকিছু নষ্ট হয়ে যেত ।

এই  প্রকৃতি ,মহাবিশ্ব মহাকাশ আর আমি একা  মানুষ এই দুই এর  মধ্যে যে নিবিড় অচ্ছেদ্য একাত্মতা   সেটা ভেঙে গেলেই যত উৎপাত আর গন্ডগোলের শুরু । মানসিক শারীরিক সবকিছুর ।  আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাইরোসোনিক্সের   ( Gyrosonics)  গবেষণার বিষয় তাই । সজল দা বলেন মাটির কাছাকাছি থাকবি, ঘাসে ,রোদে জলে মিশে । সজলদা চিনিয়ে দেন ,দেখ সব জায়গায় কেমন একই প্যাটার্ন , গাছের পাতায় শিরা উপশিরার জালি , আকাশ চেরা বিদ্যুৎ, তোর হাতের রক্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া নালী গুলো সব এক প্যাটার্নের । ছক একটাই । ফ্র্যাক্টাল ।   চালাকি করে ডিজাইন ভেঙেছিস কি মরেছিস ।  সজল দা কে বলি ,জানেন কাঠগোলাপ গাছটায় বসার একটা সুন্দর ব্যাবস্থা বের করেছি । নাম দেওয়া যেতে পারে Frangipani couch  । বেশ আরামেই বসা যায় । আমি সকালে ওখানে বসেই চা খাই , খবরের কাগজও পড়ি । দু একটা কাঠ পিঁপড়ে আসে না যে তা নয় ,একটু টোকা মেরে ফেলে দিলেই হয় । একদিন  ঝিরঝিরে বৃষ্টি  এসে গেল । ঘন পাতার জন্য গায়ে জল  পড়ছিল না । ওমা , কোত্থেকে একটা বড় পাখি (নাম জানিনা) বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাছটার পাতার নিচে এসে বসলো । আমি ও বসে আছি , পাখিও বসে আছে । আমাদের দুজনকেই গাছ জড়িয়ে আছে নিবিড় ভালবাসায় ।
সজলদা শুনে বলেন গাছ থেকে এনার্জি নিয়ে নিবি ,  ওর থেকে  শক্তিশালী  পজিটিভ  এনার্জি  বের  হয় । চুপ করে বসে থাকবি ওর নিচে ।
যত্ন করে প্রাণায়াম তো আর করা হয় না ,ওই একদিন বসে দম নিচ্ছি ,ছাড়ছি । একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ,একটা ছন্দে বলা যেতে পারে । একটা মৌটুসি পাখি তার রিনরিনে সুরেলা গলায় ওই একই মাত্রায় ডেকে যাচ্ছে ,আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আর তার ডাক তালে তালে কেমন জড়িয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে !


Frangipani couch    সল্ট লেকের বাড়িতে


আজকাল লোকে দেদার পয়সা খরচ করে ইকো ফ্রেন্ডলি ট্যুর করে । দুই কিস্তিতে সাত বছর ভুবনেশ্বর বাস আমার সে শখ মিটিয়ে দিয়েছে । আমি দুটো বাড়িতে থেকেছি  এক নম্বর আর এগারো নম্বর ।  এলাকা টার নামও একেবারে মানানসই , ফরেস্ট পার্ক ।
এক নম্বর বাড়িতে বারান্দাটা দেখা যেত না । ছাদ থেকে লতানো পাতা দিয়ে পাতার ঠাসবুনুনি পর্দা করা ছিল মাটি পর্যন্ত । আমি তো আর টারজান নই । সেই পর্দা উপড়ে ফেলতেই হল । সাবাড় করে দিতে হল পাতা পচানো সারের দুটি ঢিবি । তার দুর্গন্ধে টেকা দায় । বাগানের চৌবাচ্চায় এই বড়বড় কচ্ছপের সাইজের ব্যাং থাকত । আর তাদের কী ডাক । পিলে চমকানো । আর সারা বাড়ি জুড়ে তিড়িং বিড়িং লাফাতো নানান সাইজের ব্যাং । সাপের কথা আর আলাদা করে কি লিখব ।
গাছপালার বাড়বাড়ন্তের সীমা তো ছিলই না । এই কাটছি এই গজাচ্ছে  । এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম ।  নাম না জানা পোকা বোঁ করে ঘুরপাক খেয়ে কামড়ে দিয়ে চলে যেত । সেই ভয়ঙ্কর মুখ নিয়ে অফিস ও করতে হয়েছে । বোলতার কামড় তো খেতে হয়েইছে । চান টান করে বেশ তোয়ালে দিয়ে গা হাত পা মুছলেন , কিন্তু সারা শরীর চুলকে একসা ! তোয়ালের গায়ে তো শুঁয়ো পোকা লেগেছিল । তাকে তো খেয়াল করাই হয় নি । এসব তো আমাদের হামেশাই হত ।  ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফে আরেকটা দরকারি বিষয় হল সেন্স অফ টাইমিং । সেটা কী রকম ? যেমন পিঁপড়ের সারি যেই মাটি তুলতে শুরু করবে বুঝে নিতে হবে মেঘ ডাকল বলে । কাজেই হাতের কাছে সব গুছিয়ে নিতে হবে কারণ গাছের দুলুনিতে ঘষা খেয়ে এক্ষুনি ইলেক্ট্রিকের তার ছিঁড়ে কারেন্ট চলে যাবে । ইনভারটার আবার ইকো ফ্রেন্ডলি বাড়িতে থাকে নাকি ?
বৃষ্টি শেষ হলেই ফড়ফড় করে উড়তে শুরু করবে উই পোকার দল । যদি দরজা জানালা খোলা পায় তবে আর রক্ষে নেই । রেড্ডি আগেরদিন নুনের বদলে   চিনি দিয়ে চিকেন রান্না করেছিল বলে আমি রেগে মেগে নিজেই রান্না ঘরে ঢুকলাম । খেয়ালও করিনি যে গোধূলির আকাশ পতঙ্গে পতঙ্গে ছয়লাপ । তারপর যা হবার তাই হল । চিকেন আর উইপোকার একটা নতুন রেসিপি ।
সেদিন অফিস থেকে  ফিরে দেখি বাড়ির চারদিকে প্রচুর লোকের জটলা । এ তল্লাটে  যে এতো লোক আছে  তাই জানতাম না । তারা সব্বাই পর দিকে গাছগুলোর মাথার দিকে তাকিয়ে খুব উত্তেজিত ভাবে  খুব চিল্লামিল্লি করছে ।
“ওই যে ওখানে । না না ওই তো সেই দিকে” এপটে  ওপটে  পিছপটে । তার মধ্যে আমাদের মিত্তুন আর রেড্ডি লাঠি সোটা নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করছে । সে এক মহা যুদ্ধের প্রস্তুতি । আমার গলা শোনা তো দূরের কথা । আমাকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না । কোনরকমে ওদের থামিয়ে জিগ্যেস করি , ব্যাপারটা কি ? কি  হয়েছে বলবি তো?
ঘেমে নেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ গোলগোল করে রেড্ডি বলল “শ  রি  য়া  প তি নি”।
সেটা কি  ? ভূতপেত্নী না কোন অপদেবতা? অনুমান করলাম শরিয়াপতিনি বলে কিছু একটা এ ডালে সে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে । সবাই তারই পেছনে পেছনে ছুটছে । তবে  রেড্ডি যেভাবে  কথাটা বলল তাতে মনে একটু খটকা লাগছিল । একটু চিন্তাও হচ্ছিল ।  কাছেই চন্দকা ফরেস্ট । কি জানি কী এসে পড়ল আবার? তবুও   এ ভাবে কাঁহাতক আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় ? ঘরে ঢুকতে যাব ,সমস্বরে চিৎকার “পশি গলা ,পশি গলা ,পশি গলা  ”।
আবার কি  হল ? জানা গেল সেই শরিয়াপতিনি লাফ দিয়ে রান্নাঘরের চিমনির মধ্যে ঢুকে পড়েছে । চিমনি দিয়ে যে রান্নাঘরে সেঁধিয়ে যাবে সে উপায় নেই কারণ সে রাস্তা আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে  ।  ধোঁয়া বের হবার চিমনি ,আজকাল তার ব্যাবহার নেই । তার মানে শরিয়াপতিনি এখন অন্ধকূপে নাকানি চোবানি খাচ্ছে । দেখলাম মিত্তুন  আর রেড্ডি  লাফ মেরে  কার্নিশ বেয়ে  একেবারে বাড়ির ছাদে । নিচে দাঁড়িয়ে থাকা  আগ্রহী জনতার একদল স্রেফ মজা দেখছে , আরেক দল ওই দু জনকে নানান উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে । জল ঢাল , না না আগুন দিয়ে ভয় দেখাও , নানা অন্য কিছু কর , দাঁড়াও, ভেবে বলছি  । রেড্ডি এরই মধ্যে বাঁশের মাথায় কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে আগুন জ্বালাবার জন্য তৈরি । চারদিকে হুলুস্থূল ,চেঁচা মেচি আর চিমনির ভেতরে সেই শরিয়াপতিনির লম্ফঝম্প ।
 এদিকে বসার ঘরে টেলিফোন ঝন ঝন করে বেজেই যাচ্ছে । উফ এসময় আবার কে ফোন করে? ফোন টা তুলতেই হল ।
ওপাশ থেকে কেউ বলে চলেছে “ আপনার বাড়িতে একটা  শরিয়াপতিনি আটকে পড়েছে ? “
“হ্যাঁ পড়েছে ,তা আমি কি করতে পারি বলুন?” আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি ।  
“ওড়িশা ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট অনুসারে শরিয়াপতিনি এনডেঞ্জারড স্পেসিস ।  সুতরাং প্রাণী টির যদি কোন ক্ষতি হয় বুঝতেই পারছেন  আপনার কী  হতে পারে?”
“মানে? আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন ? আমার বাড়িতে ঢুকে গেলে আমি কী করতে পারি ?” 
কে ফোন করছে, কোত্থেকে  করছে , কিভাবে খবর পেল ?  কিছু না জিজ্ঞেস করে আমি  অসম্ভব রেগে যেতে থাকি । এমনিতেই মাথা গরম হয়েই  ছিল ।
“আমি অত কিছু জানতে চাই না । শুধু জানাচ্ছি আইন অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব যদি শরিয়াপতিনির কিছু হয়...”
মিনিট কয়েক ধরে  আমাদের চাপান উতোর চলতেই  থাকে ।
 হঠাত্  লোকটির গলা ছাপিয়ে তখন আরেকটা চিল চিৎকার , এবার হিন্দিতে , “নিকাল গয়া, নিকাল গয়া , 
নিকাল গয়া ”।

শরিয়াপতিনি একটা ওয়াইল্ড ক্যাট ,জংলি বিল্লি বা লেপার্ড ক্যাট ( Prionailurus Bengalensis)  !


Tuesday 5 August 2014

পদ্মনাভ




“সতীপতি গোস্বামী (Superintendent) আমাকে একদিন বললেন বাচ্চা হতে দেখেছ । অবাক হলাম হঠাৎ প্রশ্নে । সামান্য লজ্জায় বিব্রতও বটে । কবিতা লিখি তখন পুরোদস্তুর । বল্লাম  ঃ না । অন্যমনস্ক ভাবে প্রবীণ ডাক্তার বলে যাচ্ছিলেন “সে এক অদ্ভুত দৃশ্য । পদ্মনাভ শুনেছ? শ্রীকৃষ্ণের এক নাম । সৃষ্টির প্রথমে ছিল জল । জলের ওপর পদ্ম । সেই পদ্মলগ্ন নাভিতে ঈশ্বর শয়ান ।

শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়াও সেই পৌরানিক কাহিনীর মতই । একটি রক্তপদ্ম অর্থাৎ প্ল্যাসেন্টার মাঝখানে ,জলের মধ্যে ভাসছে জায়মান শিশু । সে এক অপার্থিব দৃশ্য “। সত্যি, একজন সার্জেন না হয়ে কবি হলে বেশ হত তার পক্ষে। এতদিন পরেও তার কথা আমার মনে আছে ।“

ওপরের লেখাটি  আমার বাবার লেখা (বাসুদেব দেব) স্মৃতিকথা থেকে নেওয়া,  ষাটের দশকের একেবারে প্রথমদিকের ঘটনা ।

এর পরে কেটে গেছে আরো কয়েকটা দশক । ২০০১ সালে ভুবনেশ্বর বদলি হই । বাড়ির কাছে বদলি হবার সুবাদে ঘনঘন কলকাতা আসা হতই । শুক্রবার এলেই মনটা পালাই পালাই করত । রেলের ব্যাবস্থাপনাও ছিল সময় মিলিয়ে । কাকভোরে কলকাতায় হাজির হও আবার ভাল মন্দ চাট্টি খেয়ে সোমবার সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফেরত যাও । এতদিন পরে মিথ্যে বলব না, কলকাতায় আসার জন্য যেমন মন আনচান করত আবার ভুবনেশ্বর ফিরে গেলে শান্ত সবুজ শহরটা তার সবটুকু ভালবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরত   গেট খুলে লাল নুড়ির রাস্তা দিয়ে বাড়ির দরজার দিকে যেতে যেতে দেখতাম বাগানে কেমন ফুল এসেছে ,ভেজা ভেজা ঘাস ,গাছের ছায়া ,আমার দরজা জানালা হাট করে খোলা বাড়ি , অরবিন্দ আশ্রমের ধূপের গন্ধ ,কাঁচের বাটিতে বাগান থেকে তোলা ক’টি সাদা ফুল আমারই অপেক্ষায় বসে আছে ।

সেবারে আউট হাউস থেকে গোপী লছমির জায়গায় থাকতে এল প্রফুল্ল নায়েক আর সুকান্তির জমজমাট সংসার । তাদের দুটো মেয়ে ।  প্রফুল্ল অটো চালায় । সুকান্তি আমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করে । মাঝে মাঝে প্রফুল্লর মা আর বোনও আসে ।  

সেবারে আমি আর আমার সর্ব ঘটে সহকারী ড্রাইভার কাম কেয়ারটেকার কাম সেক্রেটারি  মিত্তুন   দু জনেই কলকাতায় গেছিলাম । ফিরে দেখি বাড়িটা অদ্ভুত শান্ত । বাচ্চাগুলো স্কুলে গেছে । প্রফুল্ল ও নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে । সুকান্তিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । ও তো জানে আমরা ফিরে আসব সাত সকালেই । ভয়ানক নিঝুম চারদিক । কী হল রে বাবা এদের ? আমি সুকান্তির ঘরের দিকে যেতে থাকি । ওদের ঘরটা বাড়ির পি ছন দিকে ।   সেদিকে আম আর কাঁঠালের রাজত্ব । এতোটাই ঘন পাতার ঘেরাটোপ যে মাটিতে রোদ প্রায় পড়েই না ।  হিজলের নয়,সেই আম কাঁঠালের বনে তখন ঘুঘুর ডাকের  কনসার্ট  । সকালেই দুপুরের ঘুম এসে যাচ্ছে সেই একটানা ডাকে। দেখতে পেলাম সুকান্তির ঘরের দরজা আধ খোলা । তালা দেওয়া নেই । তাহলে সে গেল কোথায় ? আমি সুকান্তি সুকান্তি বলে ডাকতে ডাকতে ঘরের দিকে এগুচ্ছি,কিন্তু কেউ সাড়াও দিচ্ছে না । দু ধাপ সিঁড়ি উঠে আমি দরজা টা হাট করে খুলে যা দে খলাম তাতে আমি হতবাক আর নিশ্চল হয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত ।

দেখলাম সুকান্তি মাটিতে পড়ে আছে । জলে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে । জন্ম হচ্ছে একটি শিশুর । জন্ম হচ্ছে পদ্মনাভর । মায়ের শরীরের সঙ্গে জুড়ে আছে তার নাভি ।জলের মধ্যেই শুয়ে আছে সে । আমার শব্দ শুনে চোখে করুণ মিনতি নিয়ে সুকান্তি হাত দুটোকে  কোন রকমে মাথার ওপর তুলে  প্রণামের ভঙ্গি করে নির্বাক আকুতি জানাচ্ছে ,বলতে চাইছে বাঁচাও আমাদের। আমার জীবনের এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা । ভয়ে,উত্তেজনায় তখন আমি আর আমার মধ্যে নেই । সম্বিত ফিরে পেয়ে মিত্তুন কে  ডাকতে থাকি।  এখখুনি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে যা ,নার্স ,দাই যাকেই পাবি নিয়ে চলে আয়।

মিত্তুন হতভম্ব । আমি একা পারব না ,আপনিও চলুন ।

আমি তখন ভেতরে ভেতরে কাঁপছি ,বললাম এদের একা রেখে কীভাবে যাবো? যদি কুকুর বেড়াল ঢোকে? তুই চলে যা। সময় নষ্ট করিস না ।

মিত্তুন চলে গেলে আমি সেই অদ্ভুত নিরালা সকালে  ঝরে পড়া একরাশ আম পাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে  সেই ঈশ্বর আর তার জন্মদাত্রীকে পাহারা দিতে থাকলাম ।  ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই 

একেকটা মুহূর্ত কে মনে হতে থাকল অনন্তকাল ।


 কয়েক বছর পরে আবার ভুবনেশ্বর । একদিন বিকেলবেলায় দেখি সুকান্তি আসছে ।ছোট জায়গা তো । খবর পেয়েছে বোধহয় ,  সঙ্গে আসছে আরো একজোড়া ছোট ছোট পা।  সুকান্তির আঁচলে তার মুখ ঢাকা । হাসিমুখে সুকান্তি দাঁড়ায় । আঁচলটা সরিয়ে নিয়ে তার পিঠে ঠ্যালা দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলে  “পুঅ “ ।