“সতীপতি গোস্বামী (Superintendent) আমাকে একদিন বললেন বাচ্চা হতে দেখেছ । অবাক
হলাম হঠাৎ প্রশ্নে । সামান্য লজ্জায় বিব্রতও বটে । কবিতা লিখি তখন পুরোদস্তুর ।
বল্লাম ঃ না । অন্যমনস্ক ভাবে প্রবীণ
ডাক্তার বলে যাচ্ছিলেন “সে এক অদ্ভুত দৃশ্য । পদ্মনাভ শুনেছ? শ্রীকৃষ্ণের এক নাম ।
সৃষ্টির প্রথমে ছিল জল । জলের ওপর পদ্ম । সেই পদ্মলগ্ন নাভিতে ঈশ্বর শয়ান ।
শিশুর ভূমিষ্ঠ
হওয়াও সেই পৌরানিক কাহিনীর মতই । একটি রক্তপদ্ম অর্থাৎ প্ল্যাসেন্টার মাঝখানে
,জলের মধ্যে ভাসছে জায়মান শিশু । সে এক অপার্থিব দৃশ্য “। সত্যি, একজন সার্জেন না
হয়ে কবি হলে বেশ হত তার পক্ষে। এতদিন পরেও তার কথা আমার মনে আছে ।“
ওপরের
লেখাটি আমার বাবার লেখা (বাসুদেব দেব) স্মৃতিকথা
থেকে নেওয়া, ষাটের দশকের একেবারে
প্রথমদিকের ঘটনা ।
এর পরে কেটে গেছে
আরো কয়েকটা দশক । ২০০১ সালে ভুবনেশ্বর বদলি হই । বাড়ির কাছে বদলি হবার সুবাদে ঘনঘন
কলকাতা আসা হতই । শুক্রবার এলেই মনটা পালাই পালাই করত । রেলের ব্যাবস্থাপনাও ছিল
সময় মিলিয়ে । কাকভোরে কলকাতায় হাজির হও আবার ভাল মন্দ চাট্টি খেয়ে সোমবার সূর্য
ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফেরত যাও । এতদিন পরে মিথ্যে বলব না, কলকাতায় আসার জন্য যেমন মন
আনচান করত আবার ভুবনেশ্বর ফিরে গেলে শান্ত সবুজ শহরটা তার সবটুকু ভালবাসা দিয়ে
জড়িয়ে ধরত । গেট খুলে লাল নুড়ির রাস্তা দিয়ে
বাড়ির দরজার দিকে যেতে যেতে দেখতাম বাগানে কেমন ফুল এসেছে ,ভেজা ভেজা ঘাস ,গাছের
ছায়া ,আমার দরজা জানালা হাট করে খোলা বাড়ি , অরবিন্দ আশ্রমের ধূপের গন্ধ ,কাঁচের
বাটিতে বাগান থেকে তোলা ক’টি সাদা ফুল আমারই অপেক্ষায় বসে আছে ।
সেবারে আউট হাউস
থেকে গোপী লছমির জায়গায় থাকতে এল প্রফুল্ল নায়েক আর সুকান্তির জমজমাট সংসার ।
তাদের দুটো মেয়ে । প্রফুল্ল অটো চালায় ।
সুকান্তি আমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করে । মাঝে মাঝে প্রফুল্লর মা আর বোনও আসে ।
সেবারে আমি আর
আমার সর্ব ঘটে সহকারী ড্রাইভার কাম কেয়ারটেকার কাম সেক্রেটারি মিত্তুন
দু জনেই কলকাতায় গেছিলাম । ফিরে দেখি বাড়িটা অদ্ভুত শান্ত । বাচ্চাগুলো
স্কুলে গেছে । প্রফুল্ল ও নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে । সুকান্তিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না ।
ও তো জানে আমরা ফিরে আসব সাত সকালেই । ভয়ানক নিঝুম চারদিক । কী হল রে বাবা এদের ?
আমি সুকান্তির ঘরের দিকে যেতে থাকি । ওদের ঘরটা বাড়ির পি ছন দিকে । সেদিকে
আম আর কাঁঠালের রাজত্ব । এতোটাই ঘন পাতার ঘেরাটোপ যে মাটিতে রোদ প্রায় পড়েই না
। হিজলের নয়,সেই আম কাঁঠালের বনে তখন
ঘুঘুর ডাকের কনসার্ট । সকালেই দুপুরের ঘুম এসে যাচ্ছে সেই একটানা ডাকে। দেখতে পেলাম
সুকান্তির ঘরের দরজা আধ খোলা । তালা দেওয়া নেই । তাহলে সে গেল কোথায় ? আমি
সুকান্তি সুকান্তি বলে ডাকতে ডাকতে ঘরের দিকে এগুচ্ছি,কিন্তু কেউ সাড়াও দিচ্ছে না
। দু ধাপ সিঁড়ি উঠে আমি দরজা টা হাট করে খুলে যা দে খলাম তাতে আমি হতবাক আর নিশ্চল
হয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত ।
দেখলাম সুকান্তি
মাটিতে পড়ে আছে । জলে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে । জন্ম হচ্ছে একটি শিশুর । জন্ম হচ্ছে
পদ্মনাভর । মায়ের শরীরের সঙ্গে জুড়ে আছে তার নাভি ।জলের মধ্যেই শুয়ে আছে সে । আমার
শব্দ শুনে চোখে করুণ মিনতি নিয়ে সুকান্তি হাত দুটোকে কোন রকমে মাথার ওপর তুলে প্রণামের ভঙ্গি করে নির্বাক আকুতি জানাচ্ছে
,বলতে চাইছে বাঁচাও আমাদের। আমার জীবনের এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা । ভয়ে,উত্তেজনায় তখন
আমি আর আমার মধ্যে নেই । সম্বিত ফিরে পেয়ে মিত্তুন কে ডাকতে থাকি।
এখখুনি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে যা ,নার্স ,দাই যাকেই পাবি নিয়ে চলে আয়।
মিত্তুন হতভম্ব ।
আমি একা পারব না ,আপনিও চলুন ।
আমি তখন ভেতরে
ভেতরে কাঁপছি ,বললাম এদের একা রেখে কীভাবে যাবো? যদি কুকুর বেড়াল ঢোকে? তুই চলে
যা। সময় নষ্ট করিস না ।
মিত্তুন চলে গেলে
আমি সেই অদ্ভুত নিরালা সকালে ঝরে পড়া
একরাশ আম পাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই ঈশ্বর আর
তার জন্মদাত্রীকে পাহারা দিতে থাকলাম । ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই ।
একেকটা মুহূর্ত
কে মনে হতে থাকল অনন্তকাল ।
কয়েক বছর পরে আবার ভুবনেশ্বর । একদিন বিকেলবেলায়
দেখি সুকান্তি আসছে ।ছোট জায়গা তো । খবর পেয়েছে বোধহয় , সঙ্গে আসছে আরো একজোড়া ছোট ছোট পা। সুকান্তির আঁচলে তার মুখ ঢাকা । হাসিমুখে
সুকান্তি দাঁড়ায় । আঁচলটা সরিয়ে নিয়ে তার পিঠে ঠ্যালা দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলে “পুঅ “ ।
No comments:
Post a Comment