আলতাফ আমার বাড়িতে এলে একটা বড় কাপ কফি আর মারি গোল্ড বিস্কুট
খায় । ডিমান্ড সাপ্লাই ব্যাবস্থা মেনে আমার বাড়িতে খুব একটা রকমারি খাদ্যসম্ভার
মজুত থাকে না । অনেক কিছু কিনে রেখে দেখেছি , হয় পিঁপড়ে লেগে যায় , নয় ছাতা
ধরে যায় ,নরম হয়ে যায় , বা ডেট পেরিয়ে যায় বা আমি নিজেই বেমালুম ভুলে যাই ।আলতাফের নিজেরও আসার ঠিক নেই । সেদিন হল কি ,বাড়িতে কিছু ভাল ভাল
কুকি ছিল । আমি
ভাবলুম ছেলেটা শুধু মারি বিস্কুট খায় , আজ
ওকে বেশ কুকি দিয়ে কফি দেওয়া যাবে । আলতাফের মত এমন নিঃস্বার্থ পরোপকারী ছেলে আমি খুব কম
দেখেছি । কুকির
প্লেট এসে গেল । বললাম
“নাও আলতাফ , খাও “ । আলতাফ প্লেটের
দিকে তাকিয়ে আছে । আমি
ভাবলাম এইবার বলে বসবে বোধহয় , আজ হঠাৎ
কুকি? আপনি তো মারি বিস্কুট ছাড়া আর কিছু...। আলতাফ সে সব কিছু
না করে সটান জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা ,এই কুকির প্যাকেট বা বাক্সটা কি ফেলে
দিয়েছেন না আছে? “ শোনো কথা , এতো মহা বিপদ! কি করবে রে বাবা প্যাকেট টা নিয়ে? আমি আমতা আমতা করে বললাম, দাঁড়াও , দেখছি ।
খুব বরাত জোরে প্যাকেট টা পাওয়া
গেল । আলতাফ অমনি আলোর দিকে ধরে কি সব
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগল । তারপর খুব উজ্জ্বল চোখ মুখ নিয়ে বলল ,” ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই , এতে ডিমমেশানো আছে । আমি তো খেতেই পারব না । তারচেয়ে বরং দুটো মারি বিস্কুট
ই দিন ।“ আলতাফ কট্টর নিরামিষাশী । অনেক ভেজিটেরিয়ানকে আমি সানন্দে ডিম
খেতে দেখেছি । কিন্তু
এর বেলায় পেঁয়াজ রসুন মাংস মাছ ডিম মুর্গা
কলিজা ভেজা কিছুই চলবে না , এর গল্প
আরো জটিল । কোন অসুখ বিসুখ বা স্বাস্থ্যের কারণে
নয়
,সে ছোটবেলা থেকেই এমন । রান্নাঘরে মাংস রান্না হচ্ছে আর তার পাশে চা তৈরি হলে
আলতাফ সে চায়ে ভুলেও চুমুক দেবে না । কদাপি না । যদি চায়ের মধ্যে মাংসের
ঝোলের ছিটে পড়ে যায় ? কে গ্যারান্টি দেবে? তোমার বাড়িতে এসব নিয়ে ঝামেলা হয়
না ? খুব হত একসময়ে । এখন সবাই মেনে নিয়েছে ।আলতাফ বলেছিল ওর দুই বোন নাকি
ডাকসাইটে রাঁধিয়ে । আমি মনে মনে ভাবতে থাকি, ছুটির দিনে আম্মি আব্বু
সবাই মিলে লাল মেঝেতে বসে জাফরানি পোলাও , ভুনা গোস্ত , মুর্গ মখমলি কাবাব খাচ্ছে ,পুদিনার
চাটনি দিয়ে। চারদিকে খুশবু ভুরভুর করছে ।জাফরিকাটা দরজার লাল সবুজ নীল
কাঁচ দিয়ে দুপুরের রঙিন রোদ যেন বেগম
আখতারের গজল । এমন স্বপ্নের মত দৃশ্যে আলতাফ এক্কেবারে মূর্তিমান তালভঙ্গ, আলাদা
বসে আছে, রুটি আর ঘিয়া কি ডাল মানে লাউ
দিয়ে ডাল নিয়ে । তাও আবার সেটা বানানো হয়েছে গ্যাসের
উনুন ধুয়ে মুছে শোধন করে ।
“তুমি দাওয়াত বা শাদি তে যাও না ? সেখানে কি কর? “
“ খুব যাই , আমার কত রিস্তেদার বন্ধুবান্ধব আছে, জানেন ?
যাই তো ।অনেক
কাজকর্ম করে দি । কিন্তু খাই না । “
“ কেন? মিঠাই সিমুই শাহি টুকরা , ফালুদা এগুলো কি ক্ষতি
করল? “
“ কে জানে ,
গোস্তের পাহাড়ের পাশেই হয়ত মিঠাই এর থালি রাখা আছে । ওরে বাবা, আমি কোন চান্স নিই না ।”
আলতাফ বলেছিল আপনার বাড়িতে একদিন পরাঠা খায়েঙ্গে । আমি সোৎসাহে হ্যাঁ হ্যাঁ , এ আবার
কোন ব্যাপার নাকি? বলেই মনে হল ,এটা সত্যিই একটা ব্যাপার । কারণ আলতাফকে পরোটা খাওয়াতে গেলে
আমার ঘোরতর আমিষ পাকশালের পলেস্তারা খসিয়ে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না । এদিকে আমার আবার মেজপিসির গল্প মনে
পড়ে গেল । পিসিকে (চিত্রা ঘোষ) নিয়ে আমার ব্লগে
একটা লেখা আছে । পিসির তো
পায়ের তলায় সর্ষে। একবার ট্রেন লেট ,
হরতাল, কি সব মিলিয়ে মিশিয়ে খাবারের খুব সমস্যা হয়েছিল । বহুত ঝুটঝামেলার পর শেষে খাবার পাওয়া
গেল । ঢাকা খুলে পিসি দেখে মোটা মোটা করে কাটা
আলু পিঁয়াজের তরকারি । পিশেমশাই চলে যাবার পর তো পিসির
নিরিমিষ । আমরা
জিজ্ঞেস করলাম ইশ , তুমি তাহলে কি করলে ?
পিসি বলল “কি আর করুম? প্যাঁজ গুলান ফ্যালায়ে
দিয়া খাইয়া থুইলাম কোনমতে “। আলতাফ হলে মনে হয় মারা যেত । একবার বেশ শরীর খারাপ হয়েছিল, আলতাফ
খুব মোলায়েম করে বলেছিল ,”একটু ফোন করে দেবেন, আমি সাবুত মুংগ কি খিচড়ি নিয়ে আসব,
খুউব পুষ্টিকর ”। শুনে
আমি এতো বিরক্ত হয়েছিলাম, ভাবলাম একবার বলেই ফেলি, কেন রে? মাটন পায়া ,নিহারি এইসব
উমদা খাবারের কথা কি তোর মনে পড়ে না? ওই সাবুত মুংগ দিয়ে আন্ডা ভুরজি,কিমা, বড়া ইলাইচি আর কসুরি মেথি দিয়ে তড়কার
ডাল রাঁধিয়ে আন দেখি ।
এই তো গেল খাওয়া দাওয়া । আলতাফের আরো অনেক গুণ । সে গড়গড়িয়ে সংস্কৃত বলতে পারে ,
ইতিহাসের বৈদিক যুগ তার খুব পছন্দের, কেনোপনিষদে কত নম্বর সূক্তে যম নচিকেতাকে কি কি
বলেছিল সে সব তো বটেই উর্দু আরবি কোরান হাদিসও একই রকম ভাবে হজম করে ফেলেছে
মহাভারতের ইল্বল বাতাপির মত । তারপর আগেই বলেছি তার পরোপকারের
তুলনা নেই ।
আলতাফের খুব পছন্দের শব্দ হল ইত্তেফাক অর্থাৎ কিনা কো ইন্সিডেন্স অর্থাৎ
কিনা সমাপতন । ওতেই
জীবনের সব রহস্য লুকিয়ে আছে বলে ওর মনে হয় । এই যেমন আমার বন্ধু রিনা আর্কাইভের
গবেষণা করতে দিল্লিতে না এলে আলতাফের সঙ্গে আমার দেখাই হত না । এরকম অজস্র ইত্তেফাকের কাহিনি নিয়ে
আলতাফের সোজা সরল মজার জীবন । আমি বললুম, চলো
, হজরত নিজামুদ্দিনের দরগায় একদিন যাই । যেখানে উনি সাধনা করতেন সে নাকি খুব শান্তির জায়গা ।আমার বন্ধুরা বলেছে । আলতাফ একটু চুপ করে রইল , বলল , আপনি বলছেন, আমি
নিশ্চয়ই যাব কিন্তু আমি মসজিদ দরগায় যাই
না , তাই আপনাকে হয়ত ভাল করে গুছিয়ে সব বলতে পারব না ।আমি বললাম সে তো আমিও নিয়মিত মন্দিরে যাই না । তাতে কী এসে গেল ? মেহবুব- এ- ইলাহি
এই সুফি সাধকের দরগায় সব ধর্ম আর জাতের মানুষরা যায়। আর এখানেই পাশাপাশি চিরশান্তিতে শুয়ে
আছেন মুরীদ আর মুর্শিদ , শিষ্য আর গুরু ।
চিস্তি সুফিয়ানা সিলসিলা ধরে রেখেছে বিখ্যাত শায়ের ,সঙ্গীতজ্ঞ , কাওয়ালির স্রষ্টা ,ভাষার জাদুকর আমির খুসরো আর
তাঁর গুরু নিজামুদ্দিন আউলিয়ার গভীর
প্রীতিময় আখ্যান ।
অহং ধুয়েধুয়ে
গুরুর পায়ে জল হয়ে বয়ে গিয়েছিলেন খুসরো, সব নাম যশ সম্মানের শিরোপা ছাপিয়ে একটাই সত্য ছিল তাঁর
জীবনে , তিনি এক সাচ্চা মুরীদ , এক অতীন্দ্রিয় অধ্যাত্ম পথের কলন্দর, এক অনুগামী ভক্ত ছাড়া আর কিছু নন ।হজরতই
তাঁর আকাশ , তাঁর পৃথিবী । একবার নিজের খুব প্রিয় ভাইপোর ইন্তেকালে শোকে পাথর হয়ে
গিয়েছিলেন নিজামুদ্দিন । তাঁকে কেউ শান্ত
করতে পারছিল না, এমনকি খুসরোও না ।
ভক্তদের মুখ মলিন। এইসময় একদিন খুসরো দেখলেন মন্দির থেকে
বেরিয়ে আসছে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে একদল মেয়ে,গাঁদা ফুলের মালা পরে।
সোনালি রোদ্দুর, হলুদ সর্ষে খেত গাঁদা ফুলের মালায় তখন লেগেছে বসন্ত উৎসবের আবির । খুসরো পেয়ে গেলেন
একটা দারুণ ফন্দি । তিনি ওই মেয়েদের মত
ঘাঘরা চোলি পরে সেজেগুজে নিজামুদ্দিনের কাছে গিয়ে নিজেই গান বেঁধে গাইতে আর নাচতে শুরু করলেন “আজ বসন্ত মনালে সুহাগন” । সব জানতে
পেরে নিজামুদ্দিনের অট্টহাসি। শোকের পাথর নেমে গেল। সেই থেকে সুফি বসন্ত উৎসবের শুরু । সুফিয়ানা মস্তি, প্রত্যেক বছর। যেখানে থাকে শুধু ইশক আর ইবাদত,
ভালবাসা আর প্রার্থনা ।
বললাম, এমন
জায়গায় তোমার মত সাচ্চা ইনসান যাবে না তো যাবে টা কে ? তবে হ্যাঁ , আমি তো পুণ্যযাত্রা শেষ করব দস্তরখান- এ- করিমের কাবাব খেয়ে । তুমি তখন কি করবে শুনি? খুব রহস্যের
একখানা হাসি দিয়ে আলতাফ বলে, আমি বাইরে
একদমই খাই টাই না তবে ওখানে করিম চাচা যেমন
আছে তেমনি শুদ্ধ শাকাহারী খানা ,পরান্ঠাওয়ালে, দহি ভাল্লা আর হালয়াই কা দুকান ভি তো হ্যাঁয় না ? ইত্তেফাকসে ।
ছবির উত্স :গুগল
ছবির উত্স :গুগল