“আপনাকে একটা কফি দেব
তো স্যার ?”
“ ম্যাডাম তো আজকে কন্টিনেন্টাল খেতে চেয়েছেন “
“একদিন আপনাকে ভালো করে ডিনার খাওয়াব, স্যার ।”
“ আজই চলে যাচ্ছেন ম্যাডাম ?”
“আচ্ছা , ম্যাডাম, আমাদেরও আজ ডিউটি শেষ , আপনারা ও
ফিরছেন” ।।
ব্যাস, এইখানে থেমে গেলে ভাবা যেতেই পারে সমুদ্র , নুড়ি পাথর ,ঝিনুক ঝাউবন অথবা পাহাড় ,
কুয়াশা , মেঘ রোদ্দুর বিরহ মধুর
বাতাসের খোলা ক্যানভাসের সামনে উইক এন্ডে চলছে ননাসুদু ( নর নারীর সুখ দুঃখ,পূষন
দেব উবাচ ), নির্জন কটেজ , বা শান্ত
বারান্দা । কিন্তু
না । এটি একটি হাসপাতালের ঘর । বিলাসী পর্যটন এবং ব্যয় বহুল চিকিৎসা ,দুটোর মধ্যে মূল্যবোধের ফারাক
এখন খুব কম । দুটোই
ব্যাপক লাভজনক ব্যাবসা ।
কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা , ডাক্তার , উকিল আর পুলিশ
ছুঁলে ঘা এর সংখ্যা তো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে
এবং ঘটনা যে কোনদিকে পরিণতি নেবে তার কিচ্ছুটি আগে থেকে কেউ বুঝতে পারবেন নাকো । এর মধ্যে বাঘ টাই বরং ভালো । ডিসিশন মেকিং এ খুব একটা সমস্যা নেই । হয় এস্পার কি ও স্পার ।
দায়ে ঠেকে হাসপাতালে যখন যেতেই হল সমস্ত পরিবেশ তখন আমার
কাছে অনন্ত অঙ্ক পরীক্ষার খাতা । খালি গুরগুর আর ঢিপঢিপ । আর এরই মধ্যে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো এসে গেল জগদ্ধাত্রী পুজো । এখন পুজোর সংখ্যা বেড়েছে । যুব শক্তির আত্মপ্রকাশ দরকার । আগে আমাদের পাড়ায় একটা পুজো হত , এখন
গোটা সাতেক । তাছাড়া সন্সকিতি সম্পন্ন (উচ্চারণ টা ইংরিজি এস
এর মতো) হবার উদগ্র বাসনার জন্য সেই পুরনো ব্র্যান্ড । রবিবাবু । মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ
কোন একটা বুধবার যাবেন । বেশ
সাজো সাজো রব । এদিকে
হয়েছে কি, মৈত্রেয়ী দেবীর খাস ভৃত্য দিন
ক্ষণ এবং কবির নাম সব গুলিয়ে জিজ্ঞেস করল
, “আচ্ছা , মা , রবিবার তো আমাদের বাড়িতে বুধুবাবু
আসবেন , না? “
আমাদের পাড়ার পুরনো পুজোটায় দুদিন আগে থেকেই সেই রবিবাবু
বাজছেন । সে কি
সব গান ! ভালো করে শুনে বুঝলাম একটাই সিডি বাজছে যার দু তিনটে গান ছেড়ে দিলে বাকি
সবগুলোই তখন আমার হৃদপিণ্ডের গতি বন্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট । কি নেই সেখানে , যে রাতে
মোর দুয়ারগুলি, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, তোমার অসীমে ,বাজে করুণ সুরে থেকে শুরু করে আছে দুঃখ আছে মৃত্যু । আমি আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে থাকি , আমাকেই এমন সময়ে এগুলো শুনতে হচ্ছে কেন? সন্সকিতি
সম্পন্নদের যে বোধ সম্পন্নও হওয়া দরকার সেটা তো এখনো তারা বোঝে নি । কিন্তু আমি ততক্ষণে দিনশেষে দেখি ছাই
হল সব হুতাশে হুতাশে ।
পূষন দেব বলল রাত করে বাড়ি ফেরার সময় ও সেই পুজো
প্যান্ডেলে গিয়ে ছিল । শুনশান
পাড়া । অবাক রাতের তারারা আকাশে মিটি মিটি
করে চায় , আর টুনি বাল্বগুলো ঝিকিমিকি জ্বলছে । ঠাণ্ডা রাত । প্রতিমার সোনালি মুখ । ওর নাকি খুব ভালো লাগছিল । মাইকে অবিশ্যি তখন দিনগুলি মোর সোনার
খাঁচায় রইল না , বাজছিল । হঠাৎ পূষন দেব দেখে , আরে এতো ছোটকাই , পুজোর মুখ্য
উদ্যোক্তাদের একজন । সে ঠিক করল ওকে যখন এতো রাতে দেখাই গেছে তাহলে বলেই ফেলি ,”কি
সব গান বাজাচ্ছ বল তো তিনদিন ধরে ? কার শোকসভা , কার ফেয়ারওয়েল , ভাই? বেচারা দিদি
তো তোমাদের গানের গুঁতোয় প্রায় মরতে বসেছে
হাসপাতালে যাবার আগেই ”।
কিন্তু বলতে পারল না । আমি অধৈর্য হয়ে বলে ফেললাম , কেন কিছু বলতে পারলি না ?
এদিকে খালি বিদায় বিদায় তানপুরার জমা ধুলো শুনতে শুনতে আমার নাড়ি ছেড়ে যাবার জোগাড় ।
পূষন দেব বলল , ছোটকাই তার ভুঁড়ির আশি শতাংশ বের করে একটা পাটাতনে মাথা দিয়ে , একহাত দিয়ে চোখ ঢেকে
আরেকটা হাত আকাশের দিকে সটান তুলে একটা পায়ের ওপর আরেকটা পা দিয়ে শুয়ে শুয়ে ওপরে
তোলা হাত আর মাটিতে রাখা পা দিয়ে গানের
সঙ্গে তাল দিচ্ছে । এতো
সুন্দর জমাট মৌতাতের ছবি খানা আর খানখান
করতে ইচ্ছে করল না রে ।
মানুষের ভয় , দুরবস্থা এই সব সময়ে প্রচুর উপদেষ্টা জুটে যায় , প্রচুর
বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনি সমানেই সামনে আসতে
থাকে । আমার ক্ষেত্রেও তাই হল । এটি একটি আদ্যন্ত সত্যি ঘটনা । কোন ভেজাল নেই ।
হয়েছিল কি , বলরামপুর গ্রামের অনাদি ডাক্তারের বিশেষ সুনাম
ছিল । উনি একটা নার্সিং হোম পর্যন্ত খুলেছিলেন
। ওই গ্রামেরই অজয় বাবু এখন শহরে চাকরি
করেন । সেবারে অজয়বাবু গ্রামে এসে বেজায়
অসুস্থ হয়ে পড়েন। পেটে
ব্যাথা ।খুব । অনাদি ডাক্তার নিদেন হাঁকল “ওহে তোমাকে একটা
অপারেশন করাতে হবে বাপু , এখখুনি “। অজয়বাবু নার্সিং হোমে ভর্তি হয়ে গেলেন । অপারেশনের দিন তার শরীরের আধখানা অবশ
করে সামনে একটা পর্দা ঝুলিয়ে ডাক্তার সব
জোগাড় যন্তর শুরু করলেন । অজয়ের কানে সব শব্দ ঢুকতে লাগল । “ছুরি কাঁচি চিমটি সব এনেছিস ? ও ই মাথামোটা হরেন , বলি তুলো গজ, ডেটল
রেখিছিস তো? “
“সে সব বলতে লারবেক , সব নিয়া এসচি বাবু “।
নানান খুটুর খাটুর শব্দে অজয়বাবু বারবার উদ্বিগ্ন হয়ে
পড়ছেন “ও ডাক্তারবাবু সব ঠিক আছে তো ‘?
“আঃ তুমি বাপু বড্ড উতলা , শুয়ে থাক দিকি , আমাকে কাজ
করতে দাও “
খানিক পরে হরেন ডাক ছাড়ে “ বাবু , ন্যান তাহলে , শুরু
করেন “।
বেশ যাত্রা থিয়েটারের মতো বড়বড় আলো জ্বলে উঠলো । পালাগান শুরু হবে । এমন সময় , এই যা , ঝপ করে আলো নিভে
সব অন্ধকার ।
অ জয়বাবু প্রায় ডুকরে কেঁদে ফেললেন আর ডাক্তার এক ধমক
দিয়ে বললেন কি রকম মানুষ তুমি ভায়া ? আরে আলো গেছে তো কি হয়েছে? পাঁচ ব্যাটারির
টর্চ আছে না আমাদের ? কিসসু ভেবো না । এই হরেন , যা তো , ওই বাইরে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে
,ব্যাটাকে ভেতরে ডেকে নে ।
অজয়বাবুর কাকার ছেলে সদ্য কলেজে ঢোকা টিকিটিকে রেবন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঘরে ঢুকলে ডাক্তার বলে নাও তো বাপু , এই টর্চ টা
ভালো করে, এই এমনি করে ধরত । হ্যাঁ , ঠিক আছে ।
কাজ চলছে । হরেনের গলা শুনতে পেলেন অজয়বাবু “ পেরায় হইয়ে এলো ,
বলেন?”
এমন সময়ে রেবন্ত কোন আক্কেলে নিচের দিকে বেমক্কা তাকিয়ে ফেলল , রক্ত, নাড়ীভুঁড়ি ,এই সব দেখেই
টর্চ হাতে নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে মুচ্ছো ।
এ বাবু , দ্যাখেন দ্যাখেন , ব্যাটা তো মুচ্ছো গেলো । এখন কি হবেক ?
আবার চারদিক অন্ধকার । ডাক্তার বলল যা শিগগিরি , রামলোচন
দারওয়ান কে ধরে নিয়ে আয় ।
অপারেশন হয়ে গেলো । ডাক্তার এসে অজয়বাবুকে বলল , কোন
চিন্তা নেই । করে
দিয়েছি । ঘেমে
যে এক্কেরে জল হয়ে গ্যাচো , হরেন রুগীকে হাওয়া কর ।
হরেন একটা ভাঙা তালপাতার পাখা নিয়ে হাওয়া করতে লাগল ।
ডাক্তার বলল , সব ঠিকই আছে ভায়া , তবে তোমাদের বাড়ির ওই
ছেলেটা খুব দুর্বল । ওকে একটু যত্ন আত্তি কর তো ।
আমি ও ওরকম
অজয়ের মতো, চিঁ চিঁ করে বললুম , আচ্ছা , অপারেশনে কত সময় লাগবে ?’’
দাড়ি গোঁফের ভেতরে জুলজুলে চোখ জিজ্ঞেস করল “ শাম কো
ফ্লাইট পকড়না হ্যাঁয় ক্যা ?”
আমি আবার চিঁ চিঁ করে বললাম , না মানে ইয়ে ।
তারপর তো আর কিছু জানি না ।
আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরলে একদিন চেয়ারে বসলাম । দেখি কি , লালচটি নীল চটি ঘর
পরিষ্কার করছে । ততদিনে
চিঁ চিঁ ভাব আর নেই , একটু কোঁ কোঁ করে গলা
তুলেই বললাম , শুনুন, হয় আপনি ভুল চটি পরে এসেছেন বা আমার মাথা বা চোখ কোনও একটা
আপনাদের খরচের বহর দেখে খারাপ হয়ে গেছে ।
উত্তর এলো “ না দিদিভাই ( এবারে ম্যাডাম বলে নি , তাও
ভালো দিদিমা বলে নি ) আপনার মাথা আর চোখ দুটোই একদম ঠিক । যদি বাইরে জুতো বিক্কিরি করে দি ,
তাই সারা হাসপাতালে এমনটাই ব্যাবস্থা । এক পাটি লাল, একপাটি নীল । অডিটের লোক তো ,তাই এমন অভিনব
ইন্টারনাল কন্ট্রোল দেখে মনে মনে একটু খিকখিকে হাসি এলো ।
তারপর দিন কয়েক পরে
মেডিক্লেমের চক্করে ফেঁসে রাত বারোটায় হুইল চেয়ারে করে যখন বেরুচ্ছি তখন
হাসপাতাল ধোয়া হচ্ছে । সেই
ফ্যানার বুদবুদের ভেতরে আস্তে আস্তে হুইল চেয়ার এগোচ্ছে আর আমি মনে মনে বলছি, “
কোনওরকমে বাইরে নিয়ে যাও , বিপত্তারিনি । আর হাড়গোড় ভেঙ্গে দিও না গো মা “। এমন সময় দেখি জুলজুলে চোখ একটা দরজা
ঠেলে বেরিয়ে আসছে ।
আমি এবার হাঁক ছাড়লুম “ ও ডাক্তার , এই যে এই দিকে “
বাঃ , ছাড়া পেয়ে গেছো ।
বললুম “ ফ্লাইট পকড়না হ্যাঁয় না ? “
বেশ খানিকটা হেসে জুলজুলে চোখ বলল ডক্টর কো কভি সি ইউ মাত বোলো । এই বলে রাজেশ খান্না আর দেবানন্দ
পাঞ্চ করে একটা হাতের মুদ্রা করে সিঁড়ির আড়ালে মিলিয়ে যেতে যেতে বলল বাই বাই , বাই বাই ।
কোই না রোকো দিল কি উড়ান কো
দিল উয়ো চলা ….
আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যাঁয়
আজ ফির ….