Thursday 1 October 2015

আপ রুচি খানা


“আজকে  কি রাঁধলে বেস্পতিদি? “

দেওয়ালে সরু  রোগা পিঠটা ঠেকিয়ে মেঝের ওপর বসে বেস্পতিদি  আয়েস করে একটা কড়া চায়ে লম্বা  চুমুক দিয়ে বলত “ আজ আলু দে (দিয়ে) বেগুন দে কুচো চিংড়ি দে একটা গা মাখা গা মাখা তরকারি করিচি , বাড়ি গে (গিয়ে)ভাত চাপিয়ে দোবো, গরম গরম ভাত আর...”এই পর্যন্ত বলা হয়েছে কি হয়নি আমার মনে হচ্ছে একছুট্টে বেস্পতির বাড়ির দাওয়ায়  থালা নিয়ে বসে পড়ি আবার কখনো বলত, ” আজ আর বেশি কিছু করার সময় পাইনিকো ,বিউলির ডাল, ঝাল ঝাল পোস্ত এট্টু করিচি, ব্যাসন গুলে রেখে এইচি , গরম গরম কুমড়োফুলের বড়া ভেজে নেবো’খন ।“





বেস্পতিদি তার  দিন আনি দিন খাই  সংসারের  খাবারের কথা যখনই  বলত আমার দর্শনেন্দ্রিয় ঘ্রাণেন্দ্রিয় আর স্বাদেন্দ্রিয় ,আমার মধ্যে  একযোগে একটা ভয়ঙ্কর বিপর্যয় তৈরি করত । আমি ভাবতাম ,ইস বেস্পতিদিরা  কী সব ভাল ভাল খাবার খায় ! আমি মানসচোখে দেখতে পেতাম বেস্পতিদি আর তার বর পুতুলদা তাদের ছানাপোনা সবাই মিলে মাটিতে বসে হুশহাশ খাচ্ছে । চেটেপুটে থালা বাটি সাফ হয়ে যাচ্ছে , মাটির দালানে রোদ ভাসছে , হাওয়ায় ভাসছে সেই অকিঞ্চিতকর  আয়োজনের সুঘ্রাণ । বেস্পতিদি আমাদের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত । আমার ছোটবেলায় মফস্বলের কোন একটা জায়গায় ।এমন নয় যে সেই নিতান্ত খুদে বয়সে আমি বেজায় খাদ্যরসিক বা পেটুক ছিলাম । বরং ঠিক তার উল্টোটা । কিন্তু কিভাবে বেস্পতিদিকে তার হাঁড়ির খবর জিগ্যেস করা আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়ালো তা আমি নিজেই  ঠিক জানি না ।

ভূগোল জল হাওয়া পরিবেশ রুচি সামর্থ্য  যে খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে দেয় তাতেই  আমাদের প্রাণের আরাম,মনের আনন্দ আত্মার শান্তি , সে  আবার সহজে  কোন আপোষও মানতে চায় না একটা পুরো অঞ্চল বা জাতির মেজাজ মর্জি নিয়ে সে  দিব্যি সময়ের  ভেতর দিয়ে বয়ে যায় ।

আমাকে সবজিরুটি গোত্রের অনেকে জিগ্যেস করতেন ,এখনো করেন,  তোমরা প্রতিদিন মাছ খাও ? প্রতিদিন? কেন?

আমি কি তাকে উলটে জিগাইব, আপনি   রোজ রোজ রুটি ভাজি খাইয়া কি আমোদ পাইতাসেন?

যাকগে , কাজের কথায় আসি ।  ট্রেনিং পর্বে আমরা একবার  সদলবলে শিমলা থেকে কলকাতায় এসেছিলাম । এখানে নামা মাত্রই  আমাদের দলের একজনের মনে হল আকাশে বাতাসে জলে স্থলে সর্বত্র মৎস্যগন্ধ বিচ্ছুরিত হইতেছে । তার পক্ষে নিঃশ্বাস নেওয়াই নাকি কষ্টকর । আর এদিকে যত জায়গায় আমাদের খাওয়া দাওয়া হচ্ছিল সেখানে তো  আমিষের মোচ্ছব , বরিশালের বাঙালরা যাকে বলে জোতাপট্টি

আয়োজন কর্তারা সক্কলে  শশব্যস্ত হয়ে  ধোঁকার ডালনা পটলের দোলমা ছানার কোপ্তা , দই আর হরেকরকম মিস্টিতে  অতিথিসৎকারে লেগে পড়েছিলেন আর বলছিলেন, ইস এ হে হে , আপনার তো কিছুই খাওয়া হল না দেখছি   সে ভারি অবাক হয়ে আমাদের বলেছিল, আচ্ছা এই এতো এতো খেতে দিয়ে, কিছুই খান নি কিছুই খান নি বলছেন কেন এনারা?

আসলে নিরামিষ খেলে এখানকার লোকেরা মনে করে যে কিছুই খাওয়া হল না । তাই আর কি...। শুনে সে ভারি তাজ্জব হয়ে গেছিল । আমাদের পরের গন্তব্যে , মনে আছে, রাত্তিরবেলা  কোন একটা হোটেলে অনেকক্ষণ   মেনুকার্ড খুঁটিয়ে দেখার  পর  তার  সাবধানী কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম , “রোটি , অড়হর ডাল ,পাঁপড়” ।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ...।

তবে অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই , আমরা স্বধর্মের ব্যাপারে  সেই সময় খুবই কট্টরপন্থী ছিলাম ।  পন্ডিতজির হেঁশেলে দিব্যি সবার জন্য দরাজ খাবার ব্যাবস্থা ছিল । ছুটির দিনে  ভরন্ত দুপুরে চারদিক  মিঠে ঠান্ডায় ঝিম মেরে থাকত, রোদ্দুর আর প্রজাপতির দল বাগানে লুটোপুটি   খেলত , সব্বাই সোনা সোনা মুখ করে খেতে বসত, ডাইনিং হল জুড়ে পন্ডিতজি অ্যান্ড কোং এর  হাতে বানানো কালি ডাল , গোবি মটর , পালক পনীর ,ভিন্ডি মশালা, পুর ভরা করেলা আর শিমলা মিরচি হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকত , সেই সময় আমরা,  ছ্যা ছ্যা ,এসব আবার ছুটির দিনে খেতে আছে নাকি এই সব বলে  নিজেদের ঘরে হিটার জ্বালিয়ে কার্পেটের ওপর থেবড়ে বসে ভাত , মুসুর ডাল সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ , আলু সেদ্ধ কাঁচা লঙ্কা ও কলকাতা থেকে আনা ঝর্না ঘি দিয়ে সে যা খাওয়া হত না , যখন খাওয়া দাওয়া শেষ  করে  জাতধর্ম রক্ষা করতাম বিকেলের টয় ট্রেন হুইসল বাজিয়ে পাকদন্ডী বেয়ে নেমে যেত ।

দেখতে গেলে তো সেটা একধরনের বে আইনি ছিলোই আর রসদপত্র যোগাড় করাও কিছু কম ঝামেলার ছিল না ।

শিমলায় আরো কতগুলো ঘটনা ঘটেছিল । আমাদের সবাইকে পালা করে প্রতিদিন খাবারের দায়িত্ব নিতে হত । মেস ডিউটি অফিসার । সেদিনের মেনু বাজার ভাঁড়ার পন্ডিতজির সঙ্গে আলাপ বিলাপ প্রলাপ  সব এর মধ্যে পড়বে । বঙ্গ সন্তানদের হাতে দায়িত্ব এলেই মাছ রান্না করতেই হবে । সেই সব মাছেদের  জাতি কুল গোত্র খুবই সন্দেহজনক । অজ্ঞাতকুলশীল মাছ অনেকেই খুব পছন্দ করত না । তাতে কট্টপন্থীদের আরো ভাল । তবে মাঝে  মাঝে বদখৎ গন্ধও পাওয়া যেতো আবার একদিন খিচুড়ি বেগুনি মেনু করাতে সবার কী রাগ ! কে আজকের  মেস ডিউটি অফিসার?  পাঠাও তলব , বসাও পঞ্চায়েত ।  কেন ? কি সমস্যা?

খিচুড়ি কেন ? আমাদের তো জ্বর পেটখারাপ হয় নি ।তাহলে খিচুড়ি কেন খাব?

আমরাও তেড়েফুঁড়ে উঠি । আরে এতো আমাদের ডেলিকেসি । ভুনি খিচুড়ি জানিস? খেয়েছিস কোনদিন?

ডে-লি-কে-সি । হাসালে । খাওয়াটা দিলে  তো বরবাদ করে ।








এরপর  ভুবনেশ্বরে থাকার সময় একদিন হাতে এল গালা সিল লাগানো গোপনীয় খাম । চিঠিতে লেখা আছে এই অফিসের জনা তিনেক কর্মী চেন্নাইতে ট্রেনিং এ গিয়ে সেখানকার আইন লঙ্ঘন করে হোস্টেলের ঘরে স্টোভ জ্বালিয়ে  কিসব রান্নাবান্না করে খেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যেন যথোচিত ব্যাবস্থা নেওয়া হয় । ব্যাপারটা কি ? খোঁজ নিতে হয় । ট্রেনিং সেন্টারে খাবারের  ভালমত ব্যাবস্থা আছে , তা সত্ত্বেও মাত্র দিন সাতেকের ট্রেনিং এ এত বড় ঝুঁকি কেন নেওয়া হল? গন্ধটা বড় সন্দেহজনক ।কেমন যেন শিমলার গন্ধ পাচ্ছি ।

আমি সুলুকসন্ধান করতে শুরু করি । প্রথমেই জানতে হবে তারা কী রান্না করেছিল যেটা ছাড়া আর থাকতে পারা  যাচ্ছিল না । উত্তর এল

“ডালমা রসুই করিথিলে, ” অর্থাৎ তারা ডালমা রান্না করেছিল ।

দলমা পাহাড়ের নাম শুনেছি । ডালমার সঙ্গে পরিচয় হয় নি তখনো । পরে ডালের মধ্যে মাতৃস্থানীয়া ডালমার স্নেহধন্য হয়েছি তবে খুব মুগ্ধ হই নি কারণ এনার মা দিদিমা জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা  আমাদের পাকশালে অনেকদিন ধরেই জমিয়ে রাজত্ব করছেনআরো জেনেছি উৎকলবাসী এই ডালমার জন্য পারে না হেন কাজ নেই । এ একেবারে  তাদের প্রাণের রসদ । সোল ফুড ।

হড়দ (অড়হর) বা মুগ  ডালি ,কচ্চা কদলী( কাঁচ কলা), সারু (কচু) বাইগন , কখারু( কুমড়ো) ,আলু (ল এর উচ্চারণ খুব কঠিন, মূর্ধা তালু , দন্ত তিনটেই ব্যাবহার হবে, খুব শক্ত ), টমেটো,সজিনা ছুঁই (সজনে ডাঁটা)  অমৃতভান্ড (পেঁপে, পপিতা , পাপায়া, অথচ কী সুন্দর নাম এরা দিয়েছে)  তেজপত্র, শুখিলা লঙ্কা ,পঞ্চফুটন ,লু্‌ন (অ) , জিরা , সরিষা, হলুদ ,পেঁয়াজ (অ)  তেল (অ) এবং আরো নানা সবজি সহযোগে রান্না হয় ডালমা ।এর মধ্যে যদি একটু নড়িয়া কোড়া (নারকেল কোড়া) ফেলে দেওয়া যায় তবে তো আর কোন কথা হবে না , সোজা দারুব্রহ্মের ভোগে ।

একবার কি একটা বড়সড় কাজ নির্বিঘ্নে মিটে যাবার পর কয়েকজন  এসে বলল আমরা  একটু  ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া করব । এরকমটা অফিস কাছারিতে হয়েই থাকে । বেশ তো , ভাল কথা ।

আমি ছিলাম না । পরে ফিরে এলে খুব খুশি হয়ে ওরা সব বলল, দারুণ ফিস্ট হয়েছে । বেস্পতির রান্নাঘরে উঁকি মারা স্বভাব আমার যাবে কোথায় ? তা কি কি আইটেম ছিল ?  ভাত ,ডালমা আর খটা । খটা হল টমেটোর টক । আমাদের চাটনির মত বাহারি নয় মোটেও ।  সত্যি কথা বলতে কি এই  সামান্য আয়োজনে এত খুশি হতে পারে লোকজন ভেবে খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম আপ রুচি খানার  পেছনে কতো  যে সমাজ সংস্কৃতি ইতিহাস অর্থনীতি কাজ করে !






মনে পড়ছিল কলকাতার অফিসগুলোর কথা । ভাদ্রমাসের তালপাকা গরমে একটি তাঁতের শাড়ি , লম্বা বিনুনি হাসি হাসি মুখে বলেছিল , “আমরা না কাল একটু খাওয়াদাওয়া করব “।

তা বেশ তো করুন ।

 মনেমনে ভাবছিলাম  উপলক্ষের তো অভাব নেই । লাগিয়ে দিলেই হল । ইনক্রিমেন্ট, প্রোমোশন ছেলেমেয়ের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক ,জয়েন্ট এন্ট্রান্স , ছেলেমেয়ের চাকরি, বিয়ে, বিদেশ যাত্রা , অ্যাকসিডেন্টের ফাঁড়া কাটা , অসুখ বিসুখ সেরে যাওয়া এমন সাড়ে বত্রিশ রকম উপলক্ষ সারা বছর ধরেই ঘোরাঘুরি করে ।

“আমরা না কাল ইলিশ মাছ খাব” ।

অফিসের এতোগুলো লোক মিলে ইলিশ মাছ খাবে ? এই গরমে? এই বন্ধ এয়ার কন্ডিশন্ড অফিসে? তাকে কিছু মৃদু মধুর কথা বলেছিলাম মনে আছে এবং ঠিক তাই আমার সমস্ত আশঙ্কাকে ঘোরতর সত্যি করে পুরো অফিসটা বিয়েবাড়ির আইবুড়ো ভাতের ফাংশান হয়ে উঠল । ওরে জল দে রে , লেবু নুন দে , হাঁক ডাক , গোপাল কোথায় গেলি , পেটিগাদাগুলো মিশিয়ে ফেললি কেন , মাছের ডিমভাজা গুলো আগে দে.. বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে  শুনতেই থাকলাম ।  এ সি ঘরে সেই দম আটকানো গন্ধে তখন পালাতে পারলে বাঁচি ।

আরেকবার একজনের অবসর গ্রহণ । তিনি সবাইকে খাওয়াবেন । সাধু প্রস্তাব । কিন্তু তিনি পাত পেড়ে খাওয়াবেন ।  সেকশনের সব চেয়ার টেবিল জোড়া দিয়ে তুমুলহর্ষে পঙক্তি ভোজন চলছে , যেন অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্ন খেতে এসেছি
এমন একটা পাবদা মাছ খেতে দিল দেখতে ঠিক ছোটখাট কুমির ছানা । দেখলাম সবার পাতেই ওই রকম কুমির ছানা , আরো কতগুলো গামলার মধ্যে রয়েছে । বিস্ময় প্রকাশ করতে ভদ্রলোক বললেন, “আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম এইরকম মাছই খাওয়াবো , নয় তো খাওয়াবোই না”


ভুবনেশ্বরের গল্প এখনও  কিছুটা বাকি আছে । এদের খাওয়াদাওয়া কিছুটা সরলীকৃত হলেও পুবের দেশের লোকদের মত এরাও বেশ ভালই খাদ্যরসিক । এ হেন পুবের কলিঙ্গকন্যাকে বিয়ে করে ফেলল পশ্চিমের পট্টবর্ধন । চিৎপাবন  ব্রাহ্মণ । মারাঠা  পেশোয়া বালাজি বাজিরাও এর বংশধর । সারাদিন ধরে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা সকালে দুপুরে বিকেলে রাতে কী কী খাবে তাই নিয়ে আলোচনা করে । খাবার নিয়ে এত আলোচনার কি আছে সে ভেবেই পায় না । তাদের তো পাও দিয়েই খাওয়া সারা হয়ে যায় । বড়া পাও, মিসাল পাও , পাও ভাজি, বয়দা (ডিম) পাও।  পাও দিয়েই খাওয়া সারা হয়ে যাচ্ছে ,খামোকা হাতের আর কি দরকার ! দুপুর বেলায় সবাই যত্ন করে নতুন জামাইকে খেতে বসায় ।  জামাই আদর । ভালো ভালো মাছ , নানান সুখাদ্য । পট্টবর্ধন খেতে টেতে ভালোই বাসে । কিন্তু সেদিন তার হাত আর কিছুতেই সরছে না ।গল্পটা অবশ্য ওর মুখ থেকেই শোনা ।

খেতে পারছিলে না কেন?

 “কি করে পারব ম্যাডাম? মছলিকা আঁখ দিখতা হ্যাঁয়” । অর্থাৎ মাছমুন্ড মানে মাছের মুড়ো জামাইকে  খেতে দেওয়া হয়েছিল  আর সে ব্যাটা চোখ প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে থাকলে চিৎপাবন  ব্রাহ্মণ  খায় কেমন করে?   

তবে দেশের পুব পশ্চিম কে হারিয়ে দেবে বাংলার পু্ব পশ্চিমের রান্না নিয়ে কাজিয়া ।ওই সব দেখেই তো কিপলিং সাহেব চুরুট খেতে খেতে লিখলেন
East is East and West is West, and never the twain shall meet





রান্নাপুজো গোটাষষ্ঠী নবান্ন পোঙ্গল রাইসের মত  ওড়িশাতেও তেমনি একটা বিশেষ রান্নাকেন্দ্রিক উৎসব হল ঘ্যাঁট(অ) বা ঘন্ট । একটা পুরো দিন ঘ্যাঁট কে উৎসর্গ করা । মরসুমি সবজি দিয়ে অতি উপাদেয়  ,বাদাম ছোলা এবং নড়ির (বড়ির লম্বা আত্মীয়,অনেকটা কুড়কুড়ের মত দেখতে) সঙ্গতে  আরো সুস্বাদু মাখোমাখো ঘ্যাঁট নানান ছোটো বড় বাক্সে করে অফিসে আসত , এমনকি ঊর্ধ্বতনদের খুশি করবার জন্যও ।

ভুবনেশ্বর থেকে  তো হামেশাই বাড়ি যাওয়া হত । সে রকমই একবার ট্রেনে সামনের বার্থ এ মা আর মেয়ে যাচ্ছে, ওরাও কলকাতারই  । কথায় কথায় আলাপ জমে ওঠে । ভদ্রমহিলা জানান তার স্বামী চাকরিসূত্রে এখানেই থাকেন ।  প্রথম দিকে খাবার  নিয়ে খুব  কষ্ট পেয়েছেন । ভাল রান্নার বা কাজের লোক ছিল না । এদিকে নিজেও রাঁধতে বাড়তে জানেন না । দিনের পর দিন বেজার মুখে থাকার পর, একদিন কাজের ছোকরাটি জানাল , বাবু কাল  দুপুরে আপনাকে খুব ভাল কিছু  খাওয়াব । তখন প্রচন্ড গরম পড়েছে বাবুর তো খুশি আর ধরে না । ছুটির দিন , বাবু সক্কাল সক্কাল চিরতার জলটল  খেয়ে রেডি । কখন দুপুর হবে , কখন খেতে বসবেন । কিন্তু রান্নাঘর থেকে কোন সাড়া শব্দ আসছে না কেন? ছ্যাঁক ছোঁক চটর পটর । তার গিন্নি তো ঘেমে নেয়ে জল হয়ে যান । এইসব ভাবনাচিন্তার  মধ্যেই কাজের লোক টি ডাকতে আসে । বাবু কোনরকমে প্রায় ছুটেই খাবার টেবিলে যান ।কিন্তু খাবার কোথায় ? “কই রে ? কোথায় দিয়েছিস” ?

 ছোকরা সব কটা দাঁত বের করে ইশারায় দেখিয়ে দেয় । বাবু দেখেন টেবিলের ওপর একটা মাঝারি সাইজের স্টিলের বাটি ,থালা দিয়ে চাপা । আর কিছু নেই । রাগে দুঃখে বিস্ময়ে হতাশায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে  বাবু দেখেন স্টিলের বাটির সাদাটে  শান্ত ঘোলা জলে ঘুমিয়ে আছে একরাশ মোটা মোটা ফুলো ফুলো ভাতের দানা, বোধহয় রাত থেকেই , আর তার চার পাশে ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে নানান অনুপান আলুসেদ্ধ ,বড়িভাজাগুঁড়ো , টক দই , লঙ্কা পেঁয়াজ ।

“এটা কী ? ইয়ার্কি পেয়েছো “?

“আজ্ঞা ,পখাল ।এই গরমে পখাল ছাড়া আর কীই বা খাবেন বাবু ? আমাদের ছেলে বুড়ো মেয়ে মদ্দ সবাই পখাল পেলে আর কিছু চায় না । তাই ভাবলাম আপনিও যদি...।“

কথাটা একশ ভাগ সত্যি । ওড়িশার গরমে পান্তাভাত একটা দারুণ উপকারী খাবার । ডাক্তারদের বিবেচনাতেও    গ্রীষ্মকালে রাস্তার পাইস হোটেল থেকে তারকা খচিত হোটেল সর্বত্র পখাল পাওয়া যায় ।ঘরে ঘরে তো বটেই ।






আমরাও শখের পান্তা খেতাম । ভাতের মধ্যে সামান্য ঠান্ডা জল দিয়ে আলুসেদ্ধ  শুকনো লঙ্কা পোড়া পেঁয়াজ কুচি সরষের তেলের ঝাঁজ দিয়ে  যে লোভনীয় খাদ্যটি তৈরি হত তার কাছে কোথায় লাগে পোলাও কালিয়া ।

 “বউঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভাল, খাওয়াতে ভালবাসতেন, এই খাওয়াবার সখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন।ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তাঁর আপন হাতের প্রসাদ । চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পান্তা ভাত যেদিন মেখে দিতেন, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কথা ছিল না “ (ছেলেবেলা রবীন্দ্রনাথ)

দিল্লিতে গীতাজি আমার ঘরদোর  দেখাশোনা  করে ।  নাগপুরের ওই দিকে বাড়ি । দেশ থেকে ফিরে এলে  আমার আবার খুব জানতে ইচ্ছে করে কি কি খেয়েছে  বাপের বাড়ি গিয়ে ।
“সীতাফল , খুব খায়া ” ।  
সীতাফল মানে কাঁড়ি কাঁড়ি আতা খেয়েছে দশ দিন ধরে । বাপরে !  কি বেরসিক রে বাবা ! দূর , এর চেয়ে বেস্পতি ভালো ছিল ।

তবে নিতান্তই ফলাহারের দুটো বর্ণনা  , যেন দুটো ছবি

“খাদ্যের আয়োজন দেখে পুরঞ্জয় বললেন , বাঃ কি সুন্দর! সাত্ত্বিক ভোজন একেই বলে । সাদা কম্বলের আসন , সাদা পাথরের থালায় ধপধপে সাদা চিঁড়ে , সাদা কলা , সাদা সন্দেশ , সাদা বরফি, সাদা নারকেল কোরা , পাথর বাটিতে সাদা দই । আবার সামনে একটি সাদা বেরাল বসে আছে। যশো ,তোমার রুচির তুলনা নেই “।(যশোমতী,রাজশেখর বসু)

দ্বিতীয়টা

“বৌঠাকরুন ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন নিজের হাতের মিষ্টান্ন কিছু কিছু থাকত তার সঙ্গে, আর তার উপরে ছড়ানো হত গোলাপের পাপড়ি গেলাসে থাকত ডাবের জল কিংবা ফলের রস কিংবা কচি তালশাঁস বরফে ঠাণ্ডা করা সমস্তটার উপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদি খুঞ্চেতে করে জলখাবার বেলা একটা দুটোর সময় রওনা করে দিতেন কাছারিতে “(ছেলেবেলা,রবীন্দ্রনাথ)

সাতারায় গান্ধিজির সেবাগ্রামের পাশে খুব সুন্দরএকটা  খাবার দোকান আছে  , মটকায় জল রাখা , নিচু নিচু টেবিল , চারপায়া , নিচে ফরাসের ওপর বসার ব্যাবস্থা । পুরন পোলি , সাবুদানা খিচড়ি ,আমরস পুরী (অমরেশ পুরী খেতে ভালোবাসতেন কিনা জানা নেই অবিশ্যি), ধোকলা , খান্ডভি , শ্রীখন্ড নানা রকম মারাঠি গুজরাটি খাবার ।  ড্রাইভার আর সঙ্গের লোকটি  একটু দূরে বসে খাচ্ছে । অমনি আমার জানতে ইচ্ছে করল ওরা কি খাচ্ছে ।

চোখে মুখে হাসি নিয়ে তারা জানাল জুঙ্কা আর ভাকরির রোটি ।  জুঙ্কা মানে  শুকনো শুকনো ব্যাসন ভাজা । এমন সুযোগ ওরা হাতছাড়া করতে চায় না কারণ আজকাল এইসব খাবার বাড়িতে প্রায় বানানোই বন্ধ হয়ে গেছে । দেশ গাঁয়ে  কেউ  কেউ বানায় । আমার মনে পরে গেল একবার ট্রেনে দুজন রাজস্থানিকে কড়কড়ে দুটো রুটি ঝুরিভাজা দিয়ে খেতে দেখেছিলাম ।




পন্ডিচেরি আশ্রমের খাবার নিয়েও বেশ সরেস গল্প চালু আছে ।  কবি  ও  শিল্পী আশ্রমিক  নিশিকান্ত রায়চৌধুরীর  বাড়ি থেকে আশ্রমের ডাইনিং হলে যাবার শর্টকাট রাস্তাটাকে ওনারা বলতেন খাইবার পাস । সেখানে খাবারের গুণগত উৎকর্ষ নিয়ে তো কোন প্রশ্নই নেই । কিন্তু খাবারটা বড় সাদামাটা । লক্ষ করেছিলাম অনেক আশ্রমিক ডাইনিং হলে না খেয়ে টিফিন বাক্সতে খাবার ভরে নিয়ে যাচ্ছেন । সত্যিমিথ্যে জানি না আমাকে একজন বলেছিলেন ওমা তাও জানেন না , খাবারটা নিয়ে বাড়ি গিয়ে যে যার মত ফোড়ন টোরন দিয়ে নেয় । কেউ পাঁচ ফোড়ন , কেউ মেথি , ধনেপাতা , সরষে কারিপাতা একটু হলুদ একটু লঙ্কা জিরে  –যার যার স্বাদ মুকুলের চাহিদা মেনে ।

স্বাদ মুকুলের চাহিদা বড় সাঙ্ঘাতিক । লীলা মজুমদার যখন  শান্তিনিকেতনে পড়াতেন, একবার সাঁওতাল  ছেলেমেয়েদের শিঙাড়া জিলিপি খাইয়েছিলেন । সবাই খুব আনন্দ করে খেল । উনি জিগ্যেস করলেন, কিরে কেমন লাগল ?

ভালো, কিন্তুক মেঠো ইঁদুর এর চেয়েও ভালো 

আবার একটা গল্প মনে পড়ল । সোফিয়াদি আর রেজাউলদা কোন এক জংলা জায়গায় আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করত । এটাও ওড়িশাতে, যোশিপুরে । সোফিয়াদিকে ওরা খুব ভালবেসে পাতায় মুড়ে কিছু খেতে দিল । পাতা খুলে তো চোখ ছানাবড়া । কিলবিল করছে পোকা । সোফিয়াদি আর কি করে ? যদি না খায়  ওরা খুব অপমানিত হবে । সোফিয়াদিদের কাজকর্ম শিকেয় উঠবে । তখন বুদ্ধি খাটিয়ে বলেছিল , “শোন তোদের যেমন খাবার ধরাবাঁধা সময় আছে । আমাদেরও তাই । এই খাবারটা বাড়িতেই নিয়ে যাই , সময় মত খেয়ে নেব । কি বলিস?”

লীলা মজুমদারের সেই গল্পটাও একেবারে মোক্ষম । ওনার বাবা জরিপের কাজে ঘুরে বেড়াতেন ,বর্মা মুলুকের  কোন এক জঙ্গলে ডেরা বেঁধেছেন । একদিন  গ্রামের লোকেরা ঙ াপ্পি তুলছে । পোকা পচানো মাটি দুর্গন্ধে টেকা দায় । প্রায় বমি উঠে আসে আর কি ।  গন্ধ টন্ধ কমে গেলে চান টান করে খেতে  বসেছেন , ঠাকুর গাওয়া ঘি দিয়ে লুচি ভাজছে । এমন সময় একদল লোক নিয়ে মোড়ল এসে হাজির । হাত জোর করে করুণ মিনতি, “ও সাহেব তোমরা কি খাচ্ছ? আমরা যে  গন্ধে আর টিকতে পারছি না “।

 আরেকটা বাজে গল্প আমাদের ডিপার্টমেন্টের  দুই কর্তাদের নিয়ে শুনেছিলাম । দুই জনায় এক জায়গায় বদলি হয়েছিলেন । দুই পরিবারে খুব মিলমিশ । বদলির চাকরিতে যেমনটা হয়ে থাকে । একদিন ক এর বাড়িতে খ গিয়ে হাজির হল এক বারকোশ কাঁঠাল নিয়ে । ক এর আবার কাঁঠাল দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে । এদিকে ক গিন্নি কচুর কোপ্তা সুন্দর করে ধনেপাতা দিয়ে  সাজিয়ে  খ গিন্নিকে দুপুরবেলায় দিয়ে এলেন । দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল  থেকে সন্ধে থেকে রাত থেকে গভীর রাত হল । ক বাবু এদিক ওদিক দেখে একটা কাগজে কাঁঠাল গুলো ভালো করে মুড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সটান ডাস্টবিনের সামনে এসে  ফেলতে গিয়ে দেখেন চারদিকে ছড়িয়ে আছে তাদের অত সাধের  কচুর কোপ্তা । সেই ইস্তক খ বাবুর সঙ্গে তার বনিবনা নেই । দুজনে একজন আরেকজনকে দেখলেই সুরুত করে পালিয়ে যান । ডিপার্টমেন্টের সবাই জানত  ওদের সম্পর্ক ভাল নয় কিন্তু  আসল কারণটা কারুরই জানা ছিল না  ।

আপ রুচি খানা শেষ করব একেবারে হালের একটা গল্প দিয়ে । এবারে দীর্ঘ দিন দেশের বাইরে কাজে গিয়ে দুই চরমপন্থী কট্টর নিরামিষাশীর পাল্লায় পড়ে  প্রথম দিকে বেশ অশান্তির মধ্যে কাটিয়েছিলাম । যেখানেই যাই না কেন হোটেলে গিয়ে শেফদের দিয়ে নিজেদের মত খাবার বানিয়ে নিত । তা সে শেফ হনলুলু , উলানবাটোর, গুয়াতেমালা , আদ্দিস আবাবা ,মাসাইমারা  যেখানকারই হোক না কেন ওই দুজনের পছন্দমাফিক খাবার তাদের বানাতেই হত । এমনি ভাবে দিন কাটতে কাটতে একদিন মেলবোর্নে গিয়ে জানা গেল হোটেলের শেফ একজন ভারতীয় । আর যায় কোথায় ? ঝটপট কাজ হয়ে গেলশুধু ওরা বলল আপনারা নিজেদের ঘরেই খাবেন কেমন?

মিথ্যে বোলব না , অনেকদিন পরে দেখলাম রাত আটটায় দরজার ঘন্টি বাজলেই মনটা কেমন আনচান করে উঠত ।   একটা ফিনফিনে মেয়ে বিশাল ট্রলিতে করে খাবার নিয়ে আসতো  , সঙ্গে আমের চাটনি। 



 এরপর ,  open seasame open seasame .

খুলজা সিম সিম ।

 চিচিং ফাঁক ।
স্বধর্মে  নিধনং শ্রেয়:




ছবির উত্স :গুগল  /নিজের তোলা