আজকাল
গদাধরের ঘুম ভালো হয় না । আবছা আবছা ,
ছেঁড়া ছেঁড়া , হালকা মেঘের মত । ছায়ার মত , বাতাসের মত । খালি আসছে আর যাচ্ছে ।
আসছে আর যাচ্ছে । ঘুম আর ফাতনা গিলছে না ।
তাকে ধরি ধরি মনে করি ,ধরতে গিয়ে আর পারি না । আর ঠিক তখখুনি গদাধরের কোঠা বাড়ির সমুখের রাস্তা দিয়ে হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
সংকীর্তন চলছে ,আবেগে মতোয়ারা । খোল বাজছে , ভোরের আলো প্রায় ফুটি ফুটি । সাদা টগর লাল জবা সবে চোখ খুলছে ।
গদাধর তড়িঘড়ি উঠে খড়খড়ি ফাঁক করে দেখে রূপ
সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা , তার বাড়ির
সমুখ দিয়ে চলে গেল । ফরসা খোলা পিঠ ,লম্বা দুটি হাত । আর
কিছু দেখতে পেল না । আপনা থেকেই হাত দুটো প্রণামের মতো জড়ো হয়ে গেল গদাধরের । আর ঘুমনোর
বালাই নেই । সটান উঠে দিঘির ধারে দাঁড়িয়ে গদা নিমের ডাল ভেঙে দাঁতন করতে লাগল । জলপিপি
পানকৌড়ি ডুব মারছে ।ডানা ঝটপটিয়ে সাদা কালো হাঁসের দল জলে নেমে গেল । দিঘির পারের
সব ঝুপসি গাছগুলোয় নিমাই পন্ডিতের কাঁচা সোনার আলো এসে পড়েছে । তারও ওপারে যেখানে
ভোরের আকাশ আলতো ভাবে ফুটে উঠছে গদার মনে তখন কে যেন বাঁশি বাজাচ্ছে ওগো সুদূর
বিপুল সুদূর তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি ...মোর ডানা নাই । নাহ , গদার চোয়াল দুটো শক্ত হোল । তার দুটো
অদৃশ্য ডানা আলবাত আছে । শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের কী যেন হয় গঙ্গারামের মতই বাঙালির
ছেলে বিজয় সিংহ , হেলায় লঙ্কা করিয়া জয় , তাদের কি যেন কি একটা হত বলে সে বাপ
পিতেমোর মুখে বহুবার শুনেছে ।
বউ টা মারা
যাওয়া ইস্তক ঘরেও তার মন টেকে না । গদাধরদের
বানিজ্যে বসত লক্ষ্মী । এই
শান্তিপুর নবদ্বীপের যত শাড়ি আর নানান তেজারতি ব্যাবসা সেই কোন জন্ম থেকে তারা করে
আসছে । বাঙলার ব্যাবসা পত্তর মন্দ না । পায়ের উপর পা তুলে ফেলে ছড়িয়ে খাবার রসদ
তার আছে । কিন্তু ওই যে গদার বদ রোগ , এক জায়গায় তার মন বসে না । এ গ্রাম সে গ্রাম করে নদে শান্তিপুর
সে চষে ফেলেছে । ঢাকা ফরিদপুরে মসলিনের
কারবার করতেও গেছে । কিন্তু এই উড়ো
স্বভাবটার জন্য তার তো বিশেষ কিছু করার নেই । সে মেষ রাশি মেষ লগ্ন । চরে বেড়ানোর
জন্যই তার জন্ম । গদার যদিও জানার কথা নয় কারণ তার সময়ের আরো তিনশ বছর পর অমনি এক মেষ রাশি মেষ লগ্ন এক চৌহদ্দির
মধ্যে পাঁচ পাঁচ খানা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন , ওই এক কারণ, এক জায়গায় মন বসে না । আবার
তিনিই লিখেছিলেন মায়েরা সন্তানদের বাঙালি করে রেখেছে । আস্ত মানুষ বানায় নি ।
তারা সক্কলে বোতাম আঁটা জামার নিচে
শান্তিতে শয়ান । ইহার চেয়ে হতাম যদি আরব বেদুইন । না, গদা আরব বেদুইন হতে চায় নি বটে তবে আরবের
ব্যাবসাদারদের সঙ্গে তার বিলক্ষণ মোলাকাত
হয়েছে । তাদেরই একটা দলের সঙ্গে তার বেশ
লাগে কথা কইতে । একটু অসুবিধে হয় , তবে আকারে ইঙ্গিতে ভালোই কাজ চালানো যায় । হুশেন
শাহি জমানায় বাঙলায় মোটের ওপর খুব কিছু অশান্তি নেই । সেই আরবি
ভিনদেশিরাই একটা প্রস্তাব দিয়েছে । দেশের
লোক সঙ্গে থাকলে ভিনদেশিদের সুবিধে হয় । গদার মাথায় সেইটাই ঘুরপাক খাচ্ছে আজ প্রায়
হপ্তা খানেক হবে ।
গদাধর মুখ ধুয়ে
রাধা মাধবকে পেন্নাম ঠুকে উঠোনে এসে বসে ।
রাধামাধবের প্রসাদ ,তার সঙ্গে ফেনা ওঠা দুধ , চিঁড়ে , কলা আর বাতাসা । গদাধরের মা
আবার তার বিয়ে দেবেন বলে তোড়জোড় শুরু করেছেন । তিনি কি সব বলে যাচ্ছেন গদার কানে তা এক বর্ণ ও ঢুকছে না । শুধু
আমির উল্লাহের কথা তার কানে মাথায় বিজবিজ করছে ।
উঠোনে মালতী
লতার ঝাড়ে ভোমরার বোঁ বোঁ । বেলা বাড়ছে ।
সবাই যে যার কাজে লেগেছে । আড়তের লোকেরা বার দালানে জড়ো হচ্ছে । গদা বসেই আছে ।
যেন কোন হুঁশ নেই । শুধু একটা কুবো পাখি
ডেকে যাচ্ছে কুব কুব কুব কুব ।আর গদার মাথার ভেতরে কে যেন বলছে ঘর থেকে ছুট ছুট ছুট ।
পরের দিন আবার
খোল বাজল , কীর্তন হল , নিমাই পন্ডিত পথ আলো করে হেঁটে চলে গেলেন । কিন্তু গদাধর তার কিছুই শুনতে
পেল না , দেখতে পেল না । ততক্ষণে রসদপত্র
নিয়ে আরবি বনিকদের সঙ্গে সে ধরেছে
পশ্চিমের পথ । সার সার গোরুর
গাড়ি । টুং টাং গলার ঘন্টা , গাড়ির নিচে লন্ঠন নিভুনিভু । তন্দুরের রুটি আর ঝলসানো ভেড়ার মাংস । তার
এতোদিনের নিদ্রাহারা রাত আজ ঘুমে ঢলে
পড়েছে । অথচ মনের মধ্যে উত্তেজনার তোলপাড় । ওদিকে গদার মা শুয়ে শুয়ে ভাবছেন পান
সুপুরি পাঠিয়ে ছেলের বিয়ের পাকা কথা
সেরেই ফেলবেন রাত পোহালেই ।
গদাধরের জন্মগত
বংশগত ব্যাবসাবুদ্ধি , সেয়ানা বুদ্ধি , অজানাকে জানার অদম্য কৌতূহল , ক্ষমতা আর অর্থ স্পৃহা কে বাঙলার ধান মাছ নারকেল
ঠান্ডা হাওয়া আর কীর্তন সুখী করতে পারেনি
। কিছু লোক জন্মায় চির বুভুক্ষু । গদাধর সেই অদ্ভুত দলের । সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়
!
উজ্জয়িনী ইন্দোর
পেরিয়ে বছর দশেক পর গদাধর হাজির হল
এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গায় । এরমধ্যে মাড়বার , কচ্ছ , সিন্ধ ও আরবি ব্যাবসায়ীদের
সঙ্গে মেলামেশায় তার কূপ মন্ডুকের সীমানা
অনেক অনেক বেড়েছে । বংশগত বুদ্ধি
হয়েছে ছুরির ফলার মত ধারালো ,
কথাবার্তা হয়েছে তুখোড় , হাতে এসেছে বিস্তর অর্থ , চেহারায় তেল চেকনাই চলে গিয়ে
এসেছে একটা কেঠো আকর্ষণ । রাজপুতদের সঙ্গে মিশে
মিশে অনেকটা তাদের মত হাবভাব রপ্ত করেছে । অবিশ্যি এটা বঙ্গজদের জাতগুণ । নকল করতে
তারা ওস্তাদ । গদাধর নাম টা এখন তার কানে বিচ্ছিরি শোনায় । তাই গদা নিজেকে পরিচয়
দেয় মেদিনী রায় বলে । মেদিনী রায় রাজপুত ।
এক ভরা বর্ষায়
এক সবুজ মলমলে চাদরে ঢাকা সুন্দর জায়গায় গদা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হাজির । এখানে সে
ব্যাবসা করবে । গত দশ
বছরে অনেক নতুন নতুন পণ্যের সঙ্গে তার
পরিচয় হয়েছে । সে আগে কখনো এসব দেখেনি । সরু সরু উজ্জ্বল হলুদ সোনালি রঙের সুতোর মত , দারুণ সুবাস , নাম
জাফরান । পাহাড়ে বরফের দেশ থেকে আসে , আসে মৃগ নাভি কস্তুরি । তার সুরভি নেশা
ধরিয়ে দেয় । বড় দুর্লভ । চড়া দাম । নবাব
বাদশাদের এগুলো না হলে চলে না । আরো একটা
নতুন জিনিশের কারবার সে দেখেছে , হাতির দাঁত । এখানকার কারিগররা সেই দাঁত দিয়ে কী
যে সব সূক্ষ্ম কারুকাজ করে, না দেখলে গদা বিশ্বাসই করত না । এ জায়গাটায় কোন সমুদ্র
নেই , বন্দর নেই । কিন্তু বানিজ্যের স্বর্ণ সুযোগ । কারণ আরব দেশ থেকে আফ্রিকা
থেকে লোকজন আনাগোনা করে অথচ পণ্য সরবরাহের তেমন প্রতিযোগিতা নেই । অনেক কৌশলে গদা
এইসব খোঁজ খবর জোগাড় করেছে অনেকদিন ধরে । বিস্তর আট ঘাট বেঁধে গদা তাই মালব দেশের এই নিবিড় সবুজ প্রান্তে এসে নোঙর
বাঁধল । পালকি
করে পাকদন্ডী বেয়ে ভেজা সবুজের গন্ধ মেখে
মেখে গদা মান্ডু চলেছে । বিস্তীর্ণ সবুজের মাঝে মাঝে সুরম্য প্রাসাদ । ভুট্টার খেত
। বড় বড় ফটক । কড়া নজরদারি । এত সবুজ গত দশ বছরে গদা দেখেনি । হঠাত গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেল । সেই দশ বছর আগে এমনই ভরন্ত
সবুজ এক দেশ ছেড়ে সে চলে এসেছিল । দুনিয়া
দেখবে বলে ।
এমনই ঠান্ডা
বাতাস বইছিল সেদিন । প্রাণ জুরোনো , মায়ের
মতো । অনেক দিন পরে গদার চোখে জল এলো । পালকি থামিয়ে গদা খাড়াই পথ বেয়ে হাঁটতে থাকল । বৃষ্টি ভিজিয়ে
দিচ্ছে তার কোঁকড়ানো সামান্য লম্বা চুল , তার রেশমি পোশাক , দামি নাগরা । সেই
মহার্ঘ পোশাক ছাড়াও শ্রাবণ তখন গদাধরের
হৃদয়ের একূল ওকূল ভিজিয়ে আকুল । চোখের জল ,
বৃষ্টির ধারাজলে কখন মিশে গেছে । গদার কান্না কেউ দেখতেই পেল না ।
কিন্তু গদা সফল
হয়েছিল । খুব সফল । পাইকারি হারে ব্যবসার আড়ত খুলেছিল মান্ডুতে । বিশাল কারবার । সরাইখানা । দুটো বড় বড় বাওলি
, অন্ধেরা আর উজালা । এতো বড় ব্যাবসা , কত মাল এসে জমা হত । ছোট ছোট ব্যাপারীরা
কিনে নিয়ে যেত । সার সার দোকান । খোদ রাজপ্রাসাদে হারেমে তার গুদাম থেকে রাশি রাশি
জিনিশ পাঠানো হত । পাইকারি আড়ত না বলে
আধুনিক শপিং মল বললেই যেন ঠিক হয় । কে
না জানে বাঙালিরা বাঙলার বাইরে বেশি সফল । দেশের জন্য নাড়ির টানে কিনা জানিনা ,
গদা , মেদিনী রায় নামটা আর লেখেনি ।
ফটক |
গদার দোকান |
তা প্রায় সাড়ে
চারশো বছর পরে আমাদের গাড়ি এক ভরা শ্রাবনের দুপুরে পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে উঠছিল । আমরাও ফটক পেরিয়ে
গেলাম একটা একটা । আমাদেরও চোখে পড়ল সবুজের ঢেউয়ের মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে
থাকা প্রাসাদের মসজিদের ভাঙা শরীর , শ্যাওলা জমা , বিষণ্ণ । বর্ষার সঙ্গে রেণু রেণু ধোঁয়া , জলের
বাষ্প । আর কি আশ্চর্য ! চারটি ফটক পেরিয়ে
শহরে ঢোকার ঠিক আগে গদার শপিং মলের
বিশাল চেহারা আমাদের থামিয়ে দিল । আড়ালে থেকে গদাই থামিয়ে দিল বোধহয় । কোনো প্রাসাদ নয় ,অট্টালিকা নয় মন্দির মসজিদ , বিলাস ঘর বা প্যাভিলিয়ন নয় , কেল্লা নয় , এক বিপুলায়তন
দোকানঘর । গদার দোকান ।
সেই নিস্তব্ধ
শুনশান বর্ষার দুপুরে হঠাত দাঁড়িয়ে পড়লাম সেই পাথুরে বাড়ির সামনে । কোন টিকিট লাগবে না । কেউ
পাহারাও দিচ্ছে না । শুধু এ এস আই এর একটা ফলক । আমরা ভেতরে ঢুকি আর আর আমাদের
বিস্মিত করে রাখে এর বিশাল আয়তন । অনেক কুঠরি । বোধহয় পণ্য দ্রব্যের আড়ত । সারি সারি দোকান ।
মারোয়ারি গদি ধরনের । দেওয়ালের দু ধারে জিনিশ পত্র রাখার তাক বা র্যাক । ছড়ানো
চাতাল । একটু দূরেই দুটো বাওলি । জলের
দরকার হত অবশ্যই । সেখানেই সার বাঁধা কয়েকটা ঘর । মনে হল গেস্ট হাউস । সবুজ ঘাসে
ঘাসে আর শ্যাওলায় চাপা পড়ে আছে অজস্র বনিকের হট্টগোল , দরদাম , দর কষাকষি ।আরবি বাজার
বা সুক
(souk) ছিল এই জায়গাটা । বিস্তর মালপত্র জমা হল আড়তে
।
সৈয়দ মুজতবা আলীকে
কে একেবারে বসিয়ে দেওয়া যায় “ মজার ই শরিফ থেকে কার্পেট এসেছে
, বদকশান থেকে লাল রুবি, মেশেদ থেকে তসবি,
আজারবাইজান থেকে …”
না ভাই এবারের
মুক্তো গুলো তেমন ভালো ঠেকছে না ।
কি হল ?
শান্তিপুরের দুকুল ঢাকার মসলিন ,আমার সাত গাঁঠরি লাগবে যে !
জাফরানের দাম
কিন্তু এবারে বেশি পড়বে । পারস্য থেকে
এসেছে ভায়া , মুখের দিকে চেয়ে থাকলে কি হবে ?
হাতির দাঁত অমন
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছ যে ! এখানে বাজে জিনিশ রাখি না বুঝলে । আজ সকালেই সুলতানের খাস
কারিগর চোখ বন্ধ করে কিনে নিয়ে গেছে ।
একবস্তা আখরোট ফাউ নেব কিন্তু!
কস্তুরি ,বিশেষ
যত্ন করে রাখা থাকে । কাপড়ে ঢেকে । গুপ্তধনের মতো । ওদিকে সরাই খানায় রান্নার
বন্দোবস্ত । জোব্বা জাব্বা খুলে বিশ্রাম নিচ্ছে পথ ক্লান্ত বনিকের দল । এদের মধ্যে
কেষ্ট বিষ্টু গোছের কেউ কেউ যাবে সুলতানের সঙ্গে দেখা করতে , ভেট নিয়ে । গদা তাদের
সাহায্য করে খুবই । আফ্রিকা থেকে এক ধরনের গাছ আনিয়েছেন সুলতান । মান্ডুর এই ঠাসা
জঙ্গুলে আবহাওয়ায় সে গাছ দিব্যি বেঁচে গেল । আজ মান্ডুতে গেলেই চোখে পড়বে আফ্রিকার
বাওবাব । সাতশো বছর বাঁচে । একেক টা গাছ বহু ইতিহাসের সাক্ষী , নেহাত কথা কইতে
পারে না । প্রকান্ড প্রকান্ড গুঁড়ি । ফল
হয় ইয়া বড় বড় । নারকেলের মতো শক্ত খোলা । খোলা ফাটালে শুকনো রাম টক বিচিওয়ালা ফল ।
মান্ডুকি ইমলি । স্থানীয় লোকেরা তাই বলে । জামি মসজিদের সামনে রূপমতীর
প্যাভিলিয়নে রাস্তার ধারে সব জায়গায় যত্র
তত্র এই ইমলি বিক্রি হচ্ছে ।
লে কে যাও লে কে
যাও , মান্ডু কি ইমলি , মশহুর । সুলতান আফ্রিকা
থেকে আনিয়েছিলেন , এটা পঞ্চাশ , ওটা চল্লিশ । দশ বছরেও কিচ্ছু হবে না । হাত নাড়িয়ে পার্বতী দেবী এর গুণ আর ইতিহাস গড়্গড়িয়ে
বলে গেল । আমাদের দেশে আপনারা এসেছেন। থ্যাংক ইউ । চলে আসার সময় দেখলাম পুরো গোন্দ
স্টাইলে পায়ে রুপোর নক্সা করা মল আর ঝুমঝুমি লাগানো বিছুয়া পরে আছেন সব কটা আঙ্গুলে ।
ইমলি |
বাওবাব গাছ |
মান্ডুর
সিগনেচার আইটেম কি কি?
রূপমতী
বাজবাহাদুরের প্রেম ও সঙ্গীত গাথা । রূপমতী প্যাভিলিয়ন বানানো হয়েছিল শুধুমাত্র এই
সুন্দরী গায়িকার নর্মদা দর্শনের জন্য । তার একেবারে ওপরের তলা থেকে গহিন জংগলের
বুনোটে বাজবাহাদুরের প্রাসাদ দেখা যায় । আর এই ওপরের তলা থেকেই কাঙালের মতো কুড়িয়ে নিতে হয় বর্ষা স্নাত মান্ডুর গভীর
শ্যামলিমা , বিন্দু বিন্দু বাষ্প বয়ে নিয়ে আসে রূপমতীর সৌরভ আর সঙ্গীত । অদৃশ্য তরঙ্গ বয়ে নিয়ে আসে প্রেম সঙ্গীত
সৌন্দর্যের অতুলনীয় বন্ধন । “পথ হতে আমি
গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যূথীর মালা / সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা “।
সেই সোঁদালো
সন্ধেয় যখন নেমে আসছি , সঙ্গের একজন বললেন, এই মেয়েটা আপনার সঙ্গে কথা বলবে । একটা
হাসি হাসি মুখ । সরল কিশোরী । একটু অবাক
হলাম বটে ! কেনই বা কথা বলবে ? কি নাম রে তোর ? বৈশ্নো । আমি বল্লুম দূর পাগলি ,
তুই তো রূপমতী । মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসে ।
রূপমতী দেখা
দিয়ে গেল ! সেও তো গাঁয়ের মেয়েই ছিল ।
রূপমতীর প্যাভিলিয়ন |
বাজবাহাদুরের বাড়ি |
অজস্র বাওবাব
গাছ আর মান্ডু কি ইমলি । হোসংগ শাহ সমাধি
বা মিনি তাজমহল , দুটো কৃত্রিম জলাশয়ের
মাঝখানে বানানো জাহাজ মহল যাকে বর্ষার ডুবন্ত জলে ভেসে থাকা জাহাজের মতো দেখাতো , হিন্দোলা মহল
যার তেরছা দেওয়ালে ঝুলা বেঁধে তিজ উৎসব পালন
করতেন বেগম শাহজাদির দল আর বীনকার বাজাতেন রাগ হিন্দোল । আশরাফি মহল যেখানে
নুরজাহান একেকটা সিঁড়িতে তার পদ্ম কমল বিছিয়ে দিতেন আর জাহাঙ্গির একটা করে আশরাফি
রাখতেন । পরে ওই সোনার মুদ্রা বিলিয়ে দেওয়া হত গরিবদের মধ্যে । মোঘল শাসন কায়েম
হবার পর মান্ডু তে জাহাঙ্গির সময় কাটাতে ভালোবাসতেন ।
জাহাজ মহল |
থিয়েটার হল |
এ ছাড়া আরো দুটো
কথা খুব জরুরি । মান্ডুর বিভিন্ন প্রাসাদে শব্দ কৌশল বা acoustics
এর ব্যাবহার । মনে হতে পারে এ এমন কি কথা ? যে কোন কেল্লা বা প্রাসাদে
গেলে অমনি গাইড বলবে ওইখানে গিয়ে ফস করে একটা দেশলাই জ্বালছি আপনি এইখানে
দাঁড়িয়ে পরিষ্কার শুনতে পাবেন । না, ঠিক এমন টা নয় । জাহাজ মহলে আছে
গ্রিনরুম সমেত পুরোদস্তুর স্টেজ পারফরমেন্সের ব্যাবস্থা , অদ্ভুত ভাল
শব্দব্যাবস্থা । গমগম করে উঠছে ।
বাজবাহাদুরের
প্রাসাদে একেবারে ওপরের তলা থেকে নিচের ছোটখাটো বসতি দেখা যায় । ওই খানে দাঁড়িয়ে
উনি দর্শন দিতেন আর কথা কইতেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে । দর্শন দিতেন , না হয় মানা গেল
। কথা কইতেন কি করে? সামনেই পাহাড়ি ঢালে জঙ্গলের মধ্যে ছুটকো ঘর বাড়ি । কিছু ইন্টিবিন্টি
খেলে বেড়াচ্ছে । তাদের দেখাচ্ছে লিলিপুটের থেকেও ছোট । আমাদের গাইড মোহম্মদ কুরেশি
হাল ছাড়বেন না ।
তিনি একেবারেই
না চেঁচিয়ে খুবই স্বাভাবিক ডেলিমালে বাচ্চাগুলোকে ডেকে, হ্যাঁ রে ইস্কুল যাস নি ? তোরা ক’ভাই বোন রে ? এইসব
হালাং তালাং বকতে লাগলেন । আর ওই নিচ থেকে পরিষ্কার সব শোনা যেতে লাগল ।
“ আসিছে সে
ধারাজলে সুর লাগায়ে ,নীপবনে পুলক জাগায়ে “।বাজবাহাদুরের ছিমছাম প্রাসাদে একটা
সুন্দর ভাইব্রেশন ছিল । খুব ইচ্ছে করছিল
আরো কিছু সময় থাকি । যেন মাথার জট খুলে যাচ্ছে , মনটা শান্ত । কেউ যেন ভালবাসছে
অন্তরাল থেকে । যেন আপনা থেকেই পা দুটো আটকে থাকছে , সরছে না । ভালো লোক ছিলেন তো । প্রেমিক , গায়ক । সুর তাল
ভালোবাসার তরঙ্গ আজো রয়ে গেছে বাতাসে ।
্বাজবাহাদুর প্রাসাদ |
মান্ডুর আরেকটা
আকর্ষণ হল , জল বন্টন ব্যাবস্থা । বছরের সব সময় এমন ধারা জল সিক্ত থাকে না সে ।
গরমে সব রুখা শুখা । শুকনো খাঁ খাঁ । তাই প্রতিটি জায়গায় বর্ষার জল ধরে কিভাবে
তাকে ব্যাবহার করা যায় , তয়খানা কেমন ঠান্ডা রাখা যায় তার নজির ধরে রাখা আছে ।
কিছু শুনলাম। কিছু ভুলে গেলাম । ঘোরতর ইঞ্জিনিয়ারিং । প্রাসাদের মধ্যে সুইমিং পুল
। বড় বড় তালাও । তালাও মধ্যে বসে ঢালাও আমোদের আয়োজন । প্রচুর
জলঘোলা হল ।
হিন্দোলা মহল |
পরের দিন ফিরে
আসছি , কেন জানি না গদার দোকানের সামনে আবার থামলাম । আসলে ওর গড়নটাই খুব বলিষ্ঠ
, সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় না
।
আমাদের মুখ ভরতি
মান্ডুর ভুট্টার দানা । আমাদের রূপমতী
বাজবাহাদুর , গদাধর সবার সঙ্গেই দেখা হয়েছে , নানান মাধ্যমে, নানান ভাবে । একটা একটা করে চারটে ফটক পেরিয়ে নিচে নেমে
যাচ্ছি , বারিশ কা বুন্দ আর হরিয়ালি মেখে মেখে নিয়ে । ড্রাইভার রাজেশ এসি বন্ধ করে
জানলা খুলে দিয়েছে । হাওয়া লুটোপুটি খাচ্ছে । আর পেন ড্রাইভে বাজছে
কতরা কতরা মিলতি হ্যাঁয়
কতরা কতরা জিনে দো
জিন্দগি হ্যাঁয় , বেহনে দো
পিয়াসি হুঁ ম্যায় , পিয়াসি রহনে
দো
রহনে দো না………
হলকে হলকে কোহরে কে ধুঁয়ে মে
শায়দ আসমান তক আ গয়ি হুঁ……
গুলজারের কবিতা
ছবি লেখক