Saturday 29 July 2017

মেরহাবা, আওয়ারগি / শেষ পর্ব


ব কিছু কি আর মুছে ফেলা যায় ? অনেকটা উঁচুতে  ছাদের ডোম । ১৮০ ফুট লম্বা বাড়ি ।  ঘাড় উঁচু করে চোখ কপালে  তুলে দেখি সেই কোথায় ওপরে কাঁচের ভেতর দিয়ে সকালের রোদ্দুর এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে মা আর শিশুর কোমল শরীর । পবিত্র প্রজ্ঞা ,আয়া সোফিয়ার আলো বিকীর্ণ হচ্ছে সেই প্রাসাদের মত বিশাল বাড়িটার ।  একেবারে ওপরে মা মেরির কোলে যিশু । মোজেইকের কাজ । “করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায় কাহারে /সহসা দেখিনু নয়ন মেলিয়ে এনেছ তোমারি দুয়ারে”গলা আপনিই  বুজে আসে , চোখ আপনিই বন্ধ হয় , আঙুলে আঙুল ঢুকে দুটো হাত আপনিই জড়ো হয়ে থুতনির কাছে উঠে  আসে । আয়া  সোফিয়া । পঞ্চম শতব্দী থেকে ইতিহাসের পালাবদলের সাক্ষী , বিশ্বের অন্যতম মহিমময় স্থাপত্য । আয়া সোফিয়ার মধ্যে সেই পুরোনো সময় পুরোনো  পরিবেশের একটা অতীন্দ্রিয় মোহজাল । প্রত্যেকটা অলি গলি সিঁড়ির বাঁকে  ছমছমে রহস্য । ফেলে আসা সময় যেন যেতে গিয়েও যাচ্ছে না । নিজেকে প্রচ্ছন্ন অথচ  প্রকট করে রেখেছে সব জায়গায় । পুরোনো নকশায় , রঙ চটা মোজাইকে , আর্চের কারুকাজে , ফ্রেস্কোতে ,  পাথুরে পাকদন্ডীতে , চক মিলানো মেঝেতে  সব জায়গায় সময় যেন থমকে আছে ।  এর বিশাল আয়তনে আজো ভিজে ভিজে  হয়ে রয়েছে   মধ্য যুগের ইতিহাসের গন্ধ  । সেই গন্ধ  আজো মুছে ফেলা যায় নি আয়া সোফিয়ার দেহ থেকে । সাতশ বছর ধরে কনস্টান্টিনোপল ছিল দুনিয়ার সেরা শহর । চতুর্থ ক্রুশেড  তছনছ করে দিল এই শহরটাকে । খ্রিস্টান এবং জেরুসালেম সমেত মধ্য প্রাচ্যের ইসলামদের এই ক্রুশেডে খ্রিস্টানরাই অর্থোডক্স আর রোমান ক্যাথলিকে ভাগ হয়ে নিজেদের দুর্বল করে দেয় । আয়া সোফিয়া এই তুলুম দলবাজি থেকে রেহাই পায় নি ।  প্রথমে ছিল গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ । তারপরে রোমান ক্যাথলিক ।  আয়া সোফিয়ায় রোমান ক্যাথলিকদের তাণ্ডব । ধর্ম বশ মানে অর্থের । কন্সটান্টিনোপলের ধন সম্পদ লুটে নেওয়া ধর্মীয় সংহতির চেয়ে পরম রমনীয় মনে হয়ে ছিল  তাই “সুদূর নতুন দেশে সোনা আছে বলে/মহিলারি প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল/  টের পেয়ে দ্রাক্ষা দুধ ময়ূর শয্যার কথা ভুলে “চার নম্বর ক্রুশেডে তিন দিন ধরে শহর লুঠপাট ।








 প্যারিস ,ভেনিস মিলানো জেনোয়া সব নগর থেকে  পিছিয়ে পড়ে কনস্টান্টিনোপল তখন ধুঁকছে , সেই তেরো শতকের প্রথম দিকে । সিল্ক রুটের পথও ঘুরে গেলো ।  তারপর ১৪৫৩ সনে অটোমান টার্কের হাতে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়লো বাইজান্টাইন রোম । এইসব  দামাল পালাবদলের ক্ষত আয়া সোফিয়ার সারা গায়ে । ভেঙে চুরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলা হয় অনেক  মূর্তি , অনেক  মহার্ঘ শিল্প কীর্তি । চারটি মিনার তুলে মসজিদ হয়ে গেল গির্জা । কিন্তু সব কি আর মুছে ফেলা যায় ? অনেক অনেক ওপরে দেওয়ালে ছাদে অপরূপ মোজেইকের বর্ণিল বিষণ্ণতার আড়ালে এক ধ্বংসের বিষাদ গাথা ।  বড় বড় ফলকে সোনালি অক্ষরে আল্লাহ্‌র নাম , সুলতানদের নাম  । মক্কামুখী মিরহাব । পাথুরে বিশালাকার পাকদন্ডী বেয়ে দোতলায় উঠি । পাহাড়ের ঢালের মত পথ ।  স্তম্ভ।খিলান, গম্বুজ ফ্রেস্কো , রঙিন নকশি কাঁচ । আলো আঁধারে সেই গুমগুমে বিশালের মধ্যে আচ্ছন্নের মত কিছু সময় মিশে যাওয়াএখন এটা মিউজিয়াম । কোন ধর্মীয় কাজকর্ম হয় না ।  






আয়া সোফিয়া থেকে বেরিয়ে বাইরের রোদ্দুরে ভেসে  যেতে যেতে টাটকা কমলালেবুর রস খেতে খেতে ব্লু মস্কের দিকে হাঁটা লাগালাম । এই জন্য সুলতান আহমেট স্কোয়ার জায়গাটা এতো ভালো লাগে । এখানে ট্রাম আসে কিন্তু যান জট এড়াতে বাস আসে না ।  সবকিছুই যেন হাতের নাগালে । তুরস্কে ব্লু মস্কে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী আসেতারপরেই কোনিয়ার রুমি ।
ব্লু মস্কে মোট ছটি মিনার । ব্লুমস্ক বা সুলতান আহমেট মসজিদে বড় জাঁক । প্ল্যাস্টিকের জুতোর খোপে পা ঢুকিয়ে ভেতরে যাও । কিছুদিন আগেও তো যথেষ্ট আধুনিক ছিল । এখন অবিশ্যি পুজোপাঠের জায়গা রয়েছে । ফুল প্যান্ট না পরার জন্য একটা মেয়েকে ঢুকতে দিলো না । খুব কারু কাজ চারদিকে । খুব সুন্দর । নীল টালির ব্যাবহার । বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলুম ।







সারা সন্ধে আবার সেই গুলতানি করেই কেটে গেলো । সত্যি কথা বলতে কি ইস্তানবুলের সন্ধে বেলার  আড্ডাগুলো প্রচন্ড আওয়ারগির । ভোলা কঠিন । তার মাদকতাই আলাদা । আসলে তুরস্কের নিজস্ব ঘরানাটা এতো বর্ণ ময় আর মজবুত, ওদের কারুর থেকে ধার নেবার ব্যাপারটা বিশেষ চোখে পড়ে না । মশলা কেনার সময় মশলা ভাই  বলছিল পেঁয়াজ কেটে লেবুর রস মাখিয়েএকটু সুমাক ছড়িয়ে দেবে , আঃ , যেন অমৃত । বন্ধুবরের মুখে যেন নিমের পাঁচন । আর পারিনা বাপু , সেই এক ঘেয়ে দইএর ঘোল ,বোরেক ,  গুচ্ছের স্যালাড , মোটা মোটা বাদামি ভাত,  ঝলসানো মাংস মাছ ।মেডিটেরানিয়ান খাবার ! নিকুচি করেছে । অন্য কোন ধরনের খাবার সহজে  পাওয়াই যায় না । ওমা ! যেমন বলা , ঠিক দেখি একটা কোরিয়ান রেস্তোরাঁ , হংস মধ্যে  বক যথা । সেখানে বন্ধুবর বেশ খানিকটা গারলিক চিকেন ,সাদা ভাত ,কিমচি খেয়ে  মুখে একশো পাওয়ারের বাতি জ্বেলে বলল  , উফ একটু স্বস্তি পাওয়া গেল ।
সেই স্বস্তি সঙ্গে করে নিয়ে ট্রামে চাপা হল । নেমে গেলাম গালাটা ব্রিজ । ওরে ব্বাবা , সেখানে তখন আরেক মস্তি । ওপরে নীল চকচকে আকাশ , গালাটা ব্রিজের নিচে চকচকে নীল মারমারা সাগরএই নীলের ক্যানভাসে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফেনার ঢেউ , ছোট বড় স্টিমার জাহাজ ,দূরে দূরে লম্বা লম্বা মিনার , কিন্তু সব্বাইকে ছাপিয়ে গেছে ব্রিজের ওপর দিয়ে ঝুলে থাকা রাশি রাশি ছিপ । অদ্ভুত মেছো গন্ধে চারদিকটা ভুরভুর করছে । মেছুয়াদের চাঁদের হাট । পোকা, কেঁচো , মাছের টোপ । গলা খেলিয়ে খেলিয়ে গানের তানকারি করার মত ছিপ খেলিয়ে খেলিয়ে মাছের পকড় আনাও একটা সাঙ্ঘাতিক ক্লাসিক্যাল ব্যাপার । বড় মাছ ধরা পড়লে ভালো , ছোট মাছ গুলো ওরা ছুঁড়ে মারছে আকাশে , ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে সি গালের দল । মাছ , পাখি , মেছুয়া , বড়শি ফাতনা ,পাশে আবার লেবুর রস নুন দিয়ে শামুক গুগলির ফাস্টফুড কিয়স্ক । আমরা খুব খানিকটা মজা দেখে , এর পাশে ওর পাশে খানিকটা দাঁড়িয়ে , দু একটা মন্তব্য দু এক ফালি হাসি ছুঁড়ে দিয়ে ব্রিজের নিচে নেমে যাই ।





 সেখানে দেখি  সার সার খাবারের দোকান । সবাই প্রায় হাত পা ধরে ইন্দিস্তানি  ইন্দিস্তানি বলে মাছ খাওয়াতে চায় । এর মধ্যে একটা লোক বন্ধুবরের দিকে এগিয়ে এসে বলল ব্রাদার ,আমার নাম তুমি ভুলে গেছ , তাকিয়েও দেখলে না পর্যন্ত । আমি কিন্তু তোমাকে ভুলিনি । এসো ভাই , খাবে এসো । ভালো চিংড়ি এনে রেখেছি । এসো বসো । আমরা বললাম আমাদের অলরেডি খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে । পরে আসবো কেমন? লোকটা এসে বন্ধুবরকে জড়িয়ে ধরে বলল নিশ্চই আসবে । তুমি ভুলে গেলে কি হবে, আমি যে ভুলিনি ভাই ।
 আহা ! নাটক দেখে মন জুড়িয়ে গেল । হোক না নাটক , দরদ খানা দেখার মত । বন্ধুবর মাথা চুলকায় । কপালে ভাঁজ , চিন্তায় পড়েছে মনে হচ্ছে ।  ইতিমধ্যেই দুয়েকটা ট্যাক্সি ড্রাইভার বন্ধুবরকে ইরানি বলেছে । কাপাদোকিয়ার আজুরে কেভের মালিক ফারহাদ বলেছে তুমি আমার এক নিকট আত্মীয়ের মত দেখতে কিন্তু । সে কে , জিগ্যেস করায় বলেছিল, আমার শ্বশুর । কোনিয়ায় গাইড আহমেটকে দেখতে প্রায় বন্ধুবরের বাবার মত । তাই সে তার উৎস নিয়ে একটু ধন্ধে পড়ে গেল , মনে হল ।
হঠাত শুনি বোস্ফোরাস বোসফোরাস বলে কারা হাঁকডাক লাগিয়ে দিয়েছে এমিনোনু  স্কোয়ার থেকে বোসফোরাস ক্রুজ শুরু হবে । ভরন্ত বিকেল । চারদিকে যেন উৎসবের রোশনাই  । আমরাও টিকিট কেটে মিনি জাহাজের ছাদে চড়ে বসলুম । রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছে চারদিক  । নীল জলের রোদ মাখা  কুড়মুড়ে হাওয়া । উড়ে যাচ্ছে চুল , গলার উড়নি । মিনি জাহাজ বেশ খানিক পরে সময় মত ছাড়লো । আমার পাশে বসেছেন এক মহিলা , কি যেন বলছেন । আমি বললাম , নো তুরকিশ, ওনলি ইংলিশ । মহিলা কাকে একটা ডাকলেন , একটা সোনালি রঙ করা লম্বা চুল এসে হাজির । সেই মেয়েটা এক্কেবারে আজকের মেয়ে । সার কথা হল পাঁচ জন মহিলার একটা গ্রুপ এরা । সবাই এক পরিবারের । এরা থাকে তেহরানে । ইরানে সব জিনিসের  খুব দাম  । তাই সস্তার বাজার হাট করতে আমরা যেমন লেকটাউন থেকে হাতি বাগান যাই , এরা তেমনি মাত্র তিন ঘন্টার ফ্লাইটে তেহরান  থেকে ইস্তানবুল এসেছে । হপ্তা খানেক থাকবে । তারপর ফেরত । ইরান যেতে চাই শুনে বলল , চলে এসো , আরে দারুণ লাগবে । তবে হ্যাঁ , মাথাটা ঢেকে রাখতে  হবে ।  সমুদ্রের হাওয়ায় শঙ্খ চিলের মত উড়ে যাচ্ছে তার সোনালি রঙা খোলা চুল,  রঙচঙে সানগ্লাসে উপচে পড়ছে ক’দিনের লাগাম ছাড়া আনন্দ ।আহা , দেশে ফিরে গেলে এই সাধের চুল ঢেকে রাখতে হবে ।  সেলফি উঠছে পটাপট । ইনিবিনিইনিবিনি করে মহিলা কিছু বললেন , পেস্তা ভরা হাত এগিয়ে এলো । মেয়েটা বলল আমার দাদু একটা ইন্ডিয়ার গান  গাইতো , ইচক দানা বিচক দানা , দানে উপর দানা ইচক দানা । পাঁচ টা কৌতূহলী মুখ আমার দিকে চেয়ে । গানটার মানে কি বলতো ?
ইচক দানা বিচক দানা,  দানে উপর দানা  ইচক দানা/ ছজ্জে উপর লড়কি নাচে , লেড়কা  হ্যাঁয় দিওয়ানা ।
 আমি মানে  করে করে বলছি আর মেয়েটা ইনিবিনিইনিবিনি করে তর্জমা করছে । আর পাঁচটা মুখ খিল খিল করে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে , যেন টিউলিপ বাগানে বাতাস বয়ে গেল মহিলা বলে দিলেন ইরানে গেলে  কোথায় কোথায় যাবো । সিরাজ , ইশফাহান , পারসেপোলিস । কোনো প্রবলেম নেই তো ? মেয়েটা হেসে কুটোপাটি, প্রবলেম ? হোয়াত প্রবলেম ?
দুদিনের প্রমোদ । ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো । দুদিন পরেই ইরানে বোমা ফাটল ।
একদিকে এশিয়া অন্যদিকে ইওরোপ । বসফোরাসের দুদিকে চোখ জুড়োনো একের পর এক ছবি। আমার মাথার ভেতরে আওয়ারগির জোনাকি । বুকের মধ্যে তোলপাড় ।







গাইড মেসুট  বলেছিল ইভিল আই এর কথা ।তুরস্কে নেমেই দেখবে তোমাকে কারা যেন সবসময় দেখছে । ভালোর জন্যই দেখছে অবিশ্যি  । ওরা ইভিল আই । আজকাল আবার শুনতে পাই, গ্রিকদের মত ওদেরও ইভিল আই আছে । মেসুদ টিপ্পনি কাটে , তবে আমি বলি কি ? তুর্কি ইভিল আই, গ্রিসের চেয়ে ইভিলকে বেশি ঠেকাতে পারে!
রঙ্গরসিকতায় তুর্কি দের জুড়ি মেলা ভার । বাঙালিদের মত । তার ওপর দুধ ছাড়া তুরকিশ চা ,আমরা যার প্রতি ভক্তিতে একেবারে ভেসে গেছি । এক্সট্রা মালাই মারকে ,ইলাইচি চায়ের পায়েস খেতে হচ্ছে না ।

সারাদিন পর্যটনে পা টন টন । অসাড় ঘুম । পরদিন সোজা তোপকাপি প্যালেস । হয়তো বিপুলায়তন নয় কিন্তু মারাত্মক  গ্ল্যামার ।  রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো । অটোমান সুলতানদের প্রাসাদ । এখানে হজরত মোহম্মদের দাঁত আরও অনেক দুষ্প্রাপ্য জিনিশ পত্র রাখা আছে । আমিতো প্রাসাদ সৌন্দর্যের প্রেমে তখন পাগল  আওয়ারা । 









 আবার প্রশস্ত চাতাল থেকে গোল্ডেন হর্ন দেখা যায় , মারমারা  বোসফরাসের নীলে নীলে  প্রাসাদের সাদা বারান্দায়  সোনালি নীল সবুজ সেরামিকের নকশায়  নকশায় স্বপ্নের জাল বুনে তাকে রেখে এসেছি । কেউ তাকে ভেঙে দিও না । ছিঁড়ে  ফেলো না । আমাদের ভালোবাসাগুলো বেঁচে থাক । আমাদের স্বপ্ন গুলো বেঁচে থাক । আমরা যেন আবার অবাক হতে পারি , বিস্মিত হতে পারি , ভালবাসতে পারি ।এমনই সুন্দর থাকো , শহর আমার !
 “ থেঁৎলানো ফুল ,আইসক্রিমের ওপর রক্তের ছিন্টে ... গোলাপ বাগান জ্বলছে,সেখানে, ট্যাঙ্কের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে আরব্য রজনীর বাঁকা চাঁদ “,আমাদের যেন দেখতে না হয় ।




কবিতা নাজিম হিকমত 

ছবি লেখক

Saturday 22 July 2017

মেরহাবা, আওয়ারগি /১


 টোমান আর বাইজান্টাইন রোমান । জোর লড়াই ।  কনস্টান্টিনোপলের বুকে জোর লড়াই । কত রক্ত । কত হত্যা । কত লুটপাট । কৃষ্ণসাগরের জল লালে লাল হয়ে গেল । কামান দেগে নগরের পাঁচিল ভেঙে ফেলে ঘোড়া টগবগ করে ছুটিয়ে মেহমুদ সোজা হাজির হলেন আয়া সোফিয়া গির্জায় । রাতারাতি সেই গ্রিক রোমান চার্চ হয়ে গেল তুরকিশ মসজিদ  । তারপর প্রাণ মন দিয়ে কনস্টান্টিনোপল কে  ইস্তানবুল বানিয়ে তাকে সাজিয়ে সাজিয়ে নাস্তানাবুদ করে তুললেন ।
আজ সন্ধ্যায় রাস্তার দুপাশে বাতিগুলো ঝলমল করে জ্বলে উঠেছে । সাঁঝের মিঠে   হাওয়ায় টুং টাং করে দোল খাচ্ছে রঙ বেরঙের কাঁচের ডোমশিশা বা হুঁকোর  জ্বলন্ত টিকের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে লেবু , কফি , আপেল , মিন্টের সুগন্ধ । সেই সুগন্ধ , কৃষ্ণসাগরের তাজা মাছ ঝলসানোর উমদা খোশবায়ে ,  বেলোয়ারি বাতির রঙ মশালে , অপরূপ নক্সাকাটা  কুশনের স্বপ্নজমিনে বসে আমার তখন তুমুল  নেশার ঘোর ।  
উঠে পড়ে ঢিমে তালে প্রায় মাতালের মতই হাঁটছি । আর দেখছি সামনে প্রস্তুত  যুদ্ধ ক্ষেত্র সেনাবাহিনী তটস্থঅটোমান আর বাইজান্টাইন রোমান । আগুপিছু আগুপিছু । জবরদস্ত তাদের পোশাক । আমিও যুদ্ধ দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম । পাথুরে পাঁচিলের গা ঘেঁসে ম্যাপল গাছের তলায় তখন দারুণ লড়াই
আমাদের দেখে চশমা পরা হাসিমাখা চোখ দুটো ওপরে উঠল ।
একগাল হেসে নুরানি বলল , খুব ভালোবাসি দাবা খেলতে । সাত বছর বয়সেই দাবা ধরেছি । বসো বসো , তোমরা ইন্দিস্তানি । আমরা ব্রাদার তো । ভাই ভাই । ইন্দি তুর্কি ভাইভাই ।
দেখলাম নুরানির চারদিকে বেশ সুন্দর করে চেয়ার পাতা, রাস্তার ধারে  । বসো , খেলো , হুঁকো খাও । ভারি মজলিসি এরা ।
তুমি একা একাই দাবা খেলো ?
এই সামনের দোকানটা আমার ।

দেখলাম থরেথরে লোভনীয় রঙদার রকমারি জিনিশ দিয়ে সাজানো বেশ বড় দোকান ।
কাজ না থাকলে থাকলে দুহাত খেলে নিই ।

নুরানির সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গপ্প জুড়ি । এখানে সব্বাই খুব গল্প করতে ভালোবাসে । বকর বকর বকর বকর ।
নুরানি আরো বলে , ও সাইকোলজি নিয়ে পড়ে । রাত বারোটায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি যায় ।
আবার সকাল সাতটায় উঠতে হয় । পড়তে বসতে হয় একটু ।  
আচ্ছা নুরানি , তুমি ভালো গাইডের সন্ধান জানো ? এই আমাদের ঘুরিয়ে টুরিয়ে দেখাবে ?
কেন ? গাইডের কি দরকার ? এই চারপাশেই তো সব । হেঁটে হেঁটে নিজেরাই দেখে নাওনা  । ফালতু  গাইডের কোনো দরকারই নেই আর ট্রামে করে ঘোরো ।  
নুরানি একলাইনেই সব ছিমছাম করে দিলো । পরে বুঝছিলাম ব্যাটা ঠিকই বলেছিল , খুব ইয়ার দোস্তি আর আওয়ারগির শহর  ।কোন অসুবিধেই হয় না ।  
আচ্ছা নুরানি, এখন খেতে যাই । কোথায় যাবো বলতো ?
এখানে কত খাবারের দোকান , যে কোনো একটায় চলে যাও । না না রাত্তির হলে কোনো ভয় নেই । এই শহর রাতে জেগে থাকে ।
তা বেশ, আমরা বন্ধু হলুম । আবার দেখা হবে ।












সুলতান আহমেট স্কোয়ারে রাস্তার দুপাশে যেন মোচ্ছব লেগেছে । দু পাশের দোকান থেকে সবাই জবরদস্তি খাওয়াতে চায় । আমরাও হাঁটতে হাঁটতে উঁচু নিচু ঢালু পথ পেরিয়ে বেশ অনেকটা চলে এলুম । এবারে একটা দোকানে ঢুকতেই হয় ।  সন্ধ্যায় ইস্তানবুলে এসেছি , এখন  রাত প্রায় সাড়ে দশ । আরে আসুন । আপনার পথ চেয়েই বসে আছি যে টাটকা মাছ , ব্ল্যাক সি থেকে , এখখুনি গ্রিল করে নিয়ে আসছি । এখন একটু মেজে খেতে থাকুন ।
এই বলে গুচ্ছের হামাস বাবাগানুশ অলিভ , পারস্লে, রুটি ,দই দিয়ে সে ভেতরে চলে গেল । তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর একটা মস্ত মাছ আস্ত গ্রিল করে নিয়ে এলো ।
আমি বললাম , যাব্বাবা , আমি ফিলে করতে বল্লুম যে । আর রুটিটাও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ।
আ হাহা , রাত হয়ে গেছে , রমজান চলছে , আমার রাঁধুনি ব্যাটা ভালো করে শোনে নি বোধহয় । কালকের লাঞ্চটা জব্বর করিয়ে দেবো । আচ্ছা, মাছের কাঁটা গুলো আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি ।
এই বলে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আমাদের পাতে তুলে দিচ্ছে আর দুনিয়ার গপ্প বলে যাচ্ছে ।
এই যে জার্মানি ফ্রান্স ইটালি , একদম দেখতে পারি না জানোতো ? আমাদের হ্যাটা করে আমাদের কি নেই ? সব সব সব আছে । বোস্ফোরাস ক্রুজ নেবে ? একদম নিও না । হাবিজাবি হাবিজাবি । কতগুলো যাত্রার মত ড্রেস পরে নাটক করবে, যা তা খাওয়াবে , আর বেলি ডান্স দেখাবে । অমন বেলি ডান্স আমিও জানি , দেখিয়ে দেবোখন । শোনো গালাটা ব্রিজ থেকে জাহাজ ছাড়ে , চড়ে বসলেই হল অত ক্রুজ ট্রুজ করতে হবে না । মাছটা দেখো কি ফ্রেশ ! কোনো বাসি জিনিশ  নেই আমার দোকানে। সব টাটকাওই গালাটা ব্রিজের নিচে রাশি রাশি দোকান। সব বাসি খাবার । একদম খাবেনা কিন্তু ।
ও গাইড ? কোনো দরকার নেই । নিজেরা চলে যাও । গিয়েই দেখবে সব্বাই কথা বলছে , টকিং টকিং টকিং। কিন্তু শোনার লোক নেই । আর যদি মনে হয় শুনবে একটু, কোনো একটা গ্রুপের পাশে টুক করে বোকা বোকা মুখ দাঁড়িয়ে পড়বে ।
ওর কথা তখনো অফুরন্ত । এদিকে আমাদের খাওয়া শেষ । পাশের দোকান থেকে ইফতারের হুল্লোড় ভেসে আসছে । ডুগি বাজনা বাজিয়ে কারা গান গাইতে গাইতে চলে গেল । আইসক্রিম খেতে খেতে ছেলেমেয়ে নিয়ে গেরস্থরা বাড়ি ফিরছে ।
আচ্ছা চলি।  
কাল এসো , মনে করে, আমার দোকানে সবসময় টাটকা...





খাওয়া শেষ করে একটা বিটকেল ঘুরন্ত পথে হোটেলে ফিরলাম । ঝকঝকে নীলচে কালো আকাশের নিচে ব্লু মস্ক আর আয়া সোফিয়ার সঙ্গে দেখা হল । যখন হোটেলে ফিরছি, রাত হয়েছে ঢের , কিন্তু জমজমাট ইফতার ,হাসির ছররা , খুশির তুফান রাতকে যেন দিন করে দিয়েছে ।



সকালবেলা আমাদের হোটেলের খাবার ঘর থেকে দেখি বসফোরাসের নীল জলে রোদের আলো , ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ , আর সি গাল বড় বড় ডানা মেলে উড়ছে । তার মানে জলের প্রায় কাছাকাছি আছি আমরা  । শহরটা উঁচু নিচু । শোবার ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখি সেই ম্যাজিক পাড়াটা উধাও । শুনশান । কে বলবে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই স্বপ্নের তারাবাতিরা জ্বলে উঠছিল । নুরানির দোকান বন্ধ । চেয়ারগুলো নেই । মানে সকালটা একটু দেরিতে শুরু হয় এখানে  ।



মিমার সিনান একজন নামজাদা স্থপতি ছিলেন অটোমান দের সময়ে । বিভিন্ন সুলতানদের নামে পেল্লাই সব মসজিদ গুলোর তিনিই রূপকার । আমাদের তাজমহলেও নাকি তার চিন্তা ভাবনার মিশেল ধার করা হয়েছিল । ইস্তানবুলে মিমার সিনানের নামে ফাইন আর্টস ইউনিভার্সিটিও আছে ।  ১৫৮৪ সনে সিনান কে দিয়ে হাম্মাম বানালেন সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের বেগম নুরবানো ।  সুলতান আহমেট স্কোয়ার থেকে মাত্র এক স্টপ পরেই মাহমুদ পাশা মস্কের পাশেই চেম্বারলিটাস হাম্মামি । সেই তখনকার আমলের বানানো  । প্রায় সারাদিন খোলা । আমরা সটান গিয়ে হাজির । সব কিছু দেখে শুনে ঠিক হল আমরা কালকে আসব টার্কিশ বাথ নিতে । কারণ আমরা তো চান  টান করেই কুমড়োর তরকারি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম, যদিও পাঁজিতে কুমড়ো খাওয়া বারণ ছিল, কিন্তু কুমড়ো টা পচে যাচ্ছিল কিনা তাই । তারপর  রাস্তায় মশলার দোকানে ঢুকে আবার গুলতানি । ট্রামের টিকিট কিছুতেই কাটা যাচ্ছে না । আবার সেই মশল্লা ওয়ালাকে ধরে তাকে গুনে গেঁথে ভাড়া দিয়ে তার মান্থলি ট্রাম পাসটা মেশিনে ছুঁইয়ে তবে শান্তি । ব্লু মস্ক আর আয়া সোফিয়া জুড়ে সুসজ্জিত এলানো চত্বরে তখন জাঁকালো মেলা । কিছুক্ষণ পরেই ইফতার । ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে কত কত পরিবার জড়ো হয়েছে । সকলের মিলিত খুশি বিকেলের সোনালি আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে , পায়ের নিচে পরিষ্কার পথ , নকশা কাটা জলের কল , ফেল্টের মত নরম সবুজ ঘাস । ফলের রস কোল্ড ড্রিঙ্কস আইরান কাবাব রুটি একে একে জড়ো হচ্ছে । ওদিকে ইস্তিকলাল স্কোয়ারের বিখ্যাত মিষ্টান্ন  ভান্ডার হাফিজ মুস্তাফার লোকেরা এখানেও দোকান খুলে বাকলাভা কুনেফে  বাকলাভা কুনেফে বলে চিল চিৎকার করছে আর কি এনার্জি লেভেল । সারাদিন উপোস করেও কি বাজখাঁই গলা ! দেভরিশ ক্যাফে তে এখন তো  কিছুই পাওয়া যাবে না । কাজেই একটা করে  দোনদুরমা খাওয়া যেতে পারে । ওমা সেখানেও কি নৌটঙ্কি !





আমরা হাতে কোন ধরে দাঁড়িয়ে আছি  , সেই কোনের মধ্যে  এক খাবলা দোনদুরমা থুড়ি আইস্ক্রিম ঠুসে দেওয়া হবে । কিন্তু পুরো কেনা বেচাটাই একটা নাটক ! দোনদুরমা আসছে যাচ্ছে , মুখের থেকে সরে যাচ্ছে , প্রায় ম্যাজিক দেখানোর মত করে দোনদুরমার পরতে পরতে দিল্লাগি মজাক আর নৌটঙ্কি মিশিয়ে দিচ্ছে দোকানের লোকগুলো ।
ক্রেতাকে কতটা আনন্দ দেওয়া যায় , আহা দেখে বড্ড ভালো লাগল ঝানু ব্যাবসাদার, সন্দেহ নেই । কিন্তু পেশকশ টি বড় মধুর । বড় মন কাড়া । সবজায়গায় । আমার মনে পড়লো বেশ কয়েক বছর আগে কায়রোর কথা । সেখানে বিক্রিবাটার দিকে কোন উৎসাহ নেই । একটা দোকানে ঢুকে দেখি একটা মুশকো লোক চেয়ারে পা তুলে টিউনিশিয়া আর ইজিপ্টের ফুটবল ম্যাচ দেখছে । আমরা যে দোকানে ঢুকেছি তাকিয়ে দেখছেও না পর্যন্ত । আমরা গলা খাঁকড়িয়ে বললাম ইয়ে বাটার আছে? ও হরি , নড়েচড়েও না । কিছুক্ষণ পরে বলল বাটার ?  তারপর হাত মাথা নেড়ে বোঝালো সে জানে না সেটা খায় না মাথায় দেয় !
একটি মহিলা , তিনিও কেনাকাটি করতেই এসেছেন , গলা তুলে বললেন ,  জাবদা । তখন মুশকো লোকটা খুব অনিচ্ছার  সঙ্গে  একতাল গোবদা  মাখন এনে রাখলো । টার্কি এক্কেবারে উলটো মেরুতে ।








ব্লু মস্ক থেকে হেঁটে হেঁটে আরাস্তা বাজার । সেখানে আমার সদ্য পাতানো ভাই সেলিমের হাম্মাম সামগ্রীর দোকান । কতরকমের সাবুন , পেস্তামাল (তোয়ালে) মুখে মাখার মাটি , বাথ  সল্ট , লুফা । দোকানটা সুগন্ধে ভুরভুর । এর মধ্যে আবার এরদোগানের মুখ এক কোনায় লটকে আছে  । সামনের রেস্তোরাঁয় ভরপুর মজলিশ । গানের তালে তালে দরবেশ নাচছে , চুল এলিয়ে তুর্কি সুন্দরী হুঁকো খাচ্ছে ,  খাবারের জোগান দিতে লোকজন হিমশিম । ক্যারমের ঘুঁটির মত ঘুঁটি আর একটা বাক্স নিয়ে প্রচন্ড খেলা চলছে , আড্ডা তুঙ্গে উঠেছে ,হই হই হই হই ।  কিশোর  দরবেশের সাদা পোশাকের ঘেরে  ঝাপটাচ্ছে  মারমারা সাগরের ঢেউ
 এই ফাঁকে আমি সেলিম ভাই কে  জিগ্যেস করি , হ্যাঁ গো , সেলিম ভাই , তুমি এরদোগানকে বেশ পছন্দ কর,তাই না?
দোকানে ছবি দেখছি যে । 
সেলিম বলল , তুমি যেহেতু আমার বোন ( এমন ভাবে বলল যেন আমি ওর কত জন্মের বোন ! ) তোমায় বলতে কোন অসুবিধে নেই , এরদোগান ঠিক করছেন । আতাতুরক এতো বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন না ! আমাদের খুব বেশি করে ইওরোপ বানিয়েছেন । আরে বাবা আমাদের তো নিজেদের ধর্ম সংস্কৃতি আছে না কি ? সব তো চুলোয় যেতে বসেছিল ।
নুরানির গলাতেও একই কথা শুনেছিলাম । সে বলেছিল অটোমান সংস্কৃতি মুছে দিয়েছেন আতাতুরক । অটোমান , উফ কি তাদের ইতিহাস ,  কি তাদের বীরত্ব,  কী গ্ল্যামার ! আমাদের খুব বর্ণাঢ্য ট্র্যাডিশন , সব উনি উলটে দিতে চেয়েছেন ।
আমি জানিনা কোন পথে ইতিহাস চলছে । একসময়এখানে  হিজাব পরা , দাড়ি রাখা নিষেধ ছিল । ইসলাম হয়েও সেক্যুলার রাষ্ট্র এখন কোন পথে হাঁটছে ? এতো সুন্দর একটা দেশ যেন নষ্ট না হয় ! আমাদের আশা ভরসা স্বপ্নের পরিসর ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে !






পরের দিন সুলতানের হাম্মামে দাঁত কেলিয়ে হাজির হলাম । ভেতরে ঢুকেই মনে হল কয়েক শতাব্দী হুশ করে পিছিয়ে গেছি । ও , বলতে ভুলেই গেছি । চেম্বারলিটাস হামামের জিনিশপত্র আমার ভাই এর দোকানে দেখে বললাম, হ্যাঁ রে ভাই , তুই কি ওদের জিনিশপত্র বিক্রি করার এজেন্সি নিয়েছিস ? সে খুব অবাক হয়ে একচোট হেসে বলল  , ওটা তো আমাদের হাম্মাম । এই নাও আমি সই করে স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছি, ভালো ডিস্কাউন্ট পাবে । সত্যিই ডিস্কাউন্ট পেলাম ।
গোল গম্বুজ । ওপর থেকে অনেক উঁচু থেকে আলো আসছে । ঘরের ভেতরে গুমগুম প্রতিধ্বনি হচ্ছে । চারকোনা শ্বেত পাথরের মঞ্চ । গরম তপতপে হয়ে আছে । অতি রমনীয় রাজকীয় প্রমোদ ।সওনা , বাবল বাথ , অ্যারোমা মাসাজ । খুব খুশি খুশি মন নিয়ে সুবাসিত হয়ে  আইরান বোরেক আর কাবাব দিয়ে লাঞ্চ সেরে সোজা গ্র্যান্ড বাজারপনেরো শতকে এই বাজারের শুরু , এখানে চার হাজার দোকান আছে , অজস্র গলি আছে , সে সব শুকনো তথ্য দেবার কি দরকার ! সেখানে ঢুকে কিনি আর নাই কিনি পণ্য সম্ভারের উপচে পড়া বর্ণাঢ্য সম্ভার যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ডাকাডাকিও চলছে প্রবল । মেরহাবা বললেই আরো বেশি করে ডাকছে । দরদস্তুর করতে হবে সেয়ানার মত । এরা খুব ব্যাবসা ভালো বোঝে । রমজান চলছে । খুব ক্লান্ত ভুখা সব । তার মধ্যে কী যে প্রাণশক্তি ! একদিকে কার্পেটের দোকান, একদিকে গয়না গাটি বাসনপত্র কাপড়জামা , কাঁচ , সেরামিক , চামড়া , পাথর , এন্তার দেদার । জৌলুস । রকমারি ।  এসব দেখে আমার আলিবাবা  গীতিনাটকের একটা গান ডাক ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছিল , হমে ছোড়ি দেরে সাঁ ইয়া ছোড়ি দেরে ম্যায় নহি জানে দুনিয়াদারি ।
তারপর টাটকা কমলালেবুর রস খেয়ে   ট্রামে চেপে বসলুম ।  কায়রোতে এরকম  একটা বাজার আছে , খান এল খলিলি । সেটা  অবিশ্যি এতো সাজানো গোছানো বাজার নয় । বাজারের পাশেই একটা দোকানে বসে সাহিত্যিক নাইব মেহফুজ মিন্ট চা খেতেন । তা এখানে ওরহান পামুক বা আমার প্রিয় কবি নাজিম ঘোরাঘুরি করতেন কি না সেই তথ্য জোগাড় হয় নি । ট্রাম চলছে । প্রাচ্য পশ্চিমি মেলানো শহর । প্রাচ্যের উষ্ণতা আবেগ আর পশ্চিমি কায়দার মোড়ক । চমৎকার ট্রাম । কোথায় চলেছি কে জানে ! প্রায় পুরো শহরটাই লম্বালম্বি ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে । দেখা হয়ে যাচ্ছে লোকজন । শিষ্ট সভ্য । সুন্দর শহর । ভারি সুন্দর । ভারি চমৎকার  সৌন্দর্য বোধ । টিউলিপ তাদের প্রিয় ফুল । এরও সূত্র বাঁধা অটোমান ইতিহাসে । সব জায়গায় টিউলিপের ছবি ,মোটিফ , নকশা । হল্যান্ড যতই চেঁচাক , টিউলিপের টিকি তুরস্কেই বাঁধা । অটোমান জমানায় একটা সুন্দর স্বল্পকালীন সময় এসেছিল , অনেকটা রেনেসাঁ র মত, তাকে বলে টিউলিপ পিরিয়ড । ইওরোপের টিউলিপ ম্যানিয়ারও আগে । ইস্তানবুলে এখনও টিউলিপ উৎসব হয় । ফুলের গড়ন পাগড়ির মতন অনেকটা , ফারসি টারবান থেকে শব্দটা এসেছে । অটোমান এলিটদের হাত ধরেই ইওরোপে পাড়ি দিয়েছে টিউলিপ ।




বন্ধুবর বলে ,  নামো এবার । আমরা যাবো তাক্সিম স্কোয়ারে । পরিবহন ব্যাবস্থা পুরোপুরি পশ্চিমি ধাঁচেরতাক্সিম স্কোয়ারে আতাতুরকের স্ট্যাচু । জায়গাটা পুরো এসপ্ল্যানেড । ভিড়টা একটু কম । সামনেই আবার  ভিড় ঠাসাঠাসি ইস্তিকলাল  । কাতারে কাতারে লোক । বেশ সম্ভ্রান্ত পাড়া । পার্ক স্ট্রিট টাইপের । আমি বল্লুম ওহে চলো , ভাইদের কাছে সুলতান  আহমেটে ফিরে যাই । ওখানে ম্যাজিক আছে ।আওয়ারগির ম্যাজিক । কেয়ারফ্রি স্টেট অফ মাইন্ড । আর  এতো মিনি কলকাতা । এ দেখার কোনো মানে হয় না ।





সেলিমের মামাতো পিসতুতো যত ভাই, তারাও এখন আমার ভাই । আরাস্তা বাজারে এসে মনের সুখে একেক ভাই এর দোকানে ঢুকে হরেক রকমের মশলা জাতার সুমাক ,পুদিনা, দিল , রোজমারি ।  নানান কিসিমের চা,শীতের চা, গরমের চা, অটোমান চা, ভালোবাসার চা ।  কোথাও কারপেট,বেদানার দানা ভাঙা ডিজাইন , কোথাও মাদালিন বা শক্তির প্রতীক, সুলতানের প্রতীক নানান কার্পেট ।  পেয়ালার পর পেয়ালা তুরকিশ চা , কত গল্প ,  তুরকিশ ডিলাইটের কিটকিটে মিস্টি নয় অথচ ভারি  সুস্বাদু চকোলেট, সব দোকানে ঢুকে ঢুকে  খুব খানিক আড্ডা দেওয়া হল ।ভাইরা খুব দুঃখ করে বলছিল গ্র্যান্ড বাজার স্পাইস বাজার এসবের কি এখন জাত ধর্ম বজায় আছে ? চিনের জিনিশ ঢুকে যাবার পর আগের সেই চরিত্র আর নেই ।

 খুব সুইট চারমিং শহর , একটু বিচ্ছু , একটু দুষ্টু , একটু একটু মিচকে বদমাশ আর ভরপুর ড্রামাবাজি  । আহ বড্ড ভালো । আবার মিঠে ঠান্ডা রাতে উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে বেয়ে বেলোয়ারি কাঁচের টুং টাং কানে নিয়ে মোজোর দোকানে হাজির হই । মোজো খাওয়াবে টেস্টিসি কাবাব । একটা মাটির কুঁজোর মত পাত্রের মধ্যে কাবাব টা রান্না হবে আর ফটাস করে সেটাকে ফাটিয়ে ভেতর থেকে কাবাব বের করে প্লেটে নিয়ে খেতে হবে । মানে সব কিছুর মধ্যে মেলোড্রামাটা একটু বেশি । সামান্য  জোলো স্টু ধরনের, বেশ হালকা । মোজোর দোকানে আমরা হুঁকো খেলাম । লেবু আর মিন্ট । আমার হুঁকো খাওয়া দেখে মোজো আর হেসে বাঁচে না । হাসতে হাসতে বোধহয় ফেটেই যাবে ।



ফেরার সময় দেখলাম নুরানি দাবা খেলছে । অটোমানদের নির্ঘাত জিতিয়ে দিচ্ছে । যে পথ দিয়ে হাঁটছি সেটা ইতিহাসের পথ, কত শতাব্দীর কত মানুষ হেঁটে গেছে । সেই সব অচেনা পায়ের ছাপ তো একেবারে মুছে যায় নি , তারা ফিরে ফিরে এসেছে বারবার , সেলিম হয়ে , নুরানি হয়ে, মোজো হয়ে ।  আমরা পা ঘসটাতে ঘসটাতে ফিরছি  আর ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া গান গাইছে

ইয়ে দিল ইয়ে পাগল দিল মেরা
কিউ বুঝ গয়া আওয়ারগি
ইস দস্ত মে এক শহর থা  
উয়ো কেয়া হুয়া আওয়ারগি
এক অজনবি ঝোঁকে মে
জব পুছা মেরে ঘম কা শবব
শেহরা কি ভিগি রেত পর
ম্যায়নে লিখা আওয়ারগি ।।




কবিতা মোহসিন নকভি

ছবি লেখক