একটু আগেই বৃষ্টি হয়ে
গেছে । এই পাথুরে ধ্বংস স্তূপে পায়ে পায়ে যত ধুলো জড়ো হয়েছিল সব ধুয়ে গেছে । ধুয়ে
মুছে যায় নি কেবল একটি পায়ের ছাপ । মসৃণ , সামান্য নিষ্প্রভ মর্মর পাথরে একটি বড়
বাঁ পায়ের ছাপ । একটি মেয়ের মুখ । একটি মুদ্রা রাখার গর্ত আর উল্টো দিকের পথনির্দেশ । এফেসাসে জড়ো হয়ে
থাকা ভাঙা চোরা পাথরের মধ্যে পৃথিবীর আদিমতম জীবিকার জন্য সম্ভবত প্রাচীনতম
বিজ্ঞাপন । বড় পায়ের ছাপ মানে প্রাপ্ত
বয়স্ক হলেই এসো , ওই যে গর্ত তার
মধ্যে যত পারো মুদ্রা ঢালো , তাহলে পাবে তোমার কাঙ্ক্ষিত মেয়েটিকে । যদি এসব না
থাকে উল্টোপথে হাঁটো , সোজা চলে যাও সেলসাস লাইব্রেরিতে । যদি বয়স কম হয় যদি পয়সা
না থাকে সেলসাস লাইব্রেরির জ্ঞান ভাণ্ডার তোমার
উপযুক্ত জায়গা । অন্তত নিজের মেধাকে শানিত করতে পারবে ।
এটি ছিল একটি বন্দর শহর । তাই
ভিনদেশি বনিক নাবিকদের অবাধ আনাগোনা ।
মারিয়াম আনা বা মা মেরির বাড়ি
দেখে এফেসাসে ঢুকেছি । একটা গোটা শহরের ধ্বংস স্তূপ । ইজিয়ন সমুদ্রের ধারে একটা
প্রাচীন বন্দর শহর । খুব বড় নয় কিন্তু স্বয়ং সম্পূর্ণ । সব কিছু ছিল এখনকার এই ছোট প্রত্ন শহরে। পেল্লাই সব মন্দির ,বড় বড় অ্যাম্পি থিয়েটার ,
গোসল খানা , ফোয়ারা , পাবলিক টয়লেট ,লাইব্রেরি , চওড়া রাস্তা , মিউনিসিপ্যালিটি ,দেড়
হাজার বছরের পুরোনো মোজেইকের ফুটপাথ, বাতি
স্তম্ভ যেখানে এককালে অলিভ তেলের বাতি জ্বলত, মাইল ফলক , জিমনাসিয়াম , মাটির নিচের পাইপ , ভগ্ন খিলানে অপরূপ নক্সা , রাস্তার
দু পাশে খুপরি খুপরি ঘর মানে সারি সারি
দোকান , মৃতদেহ রাখার কফিন । ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ সব
চিহ্ন ধরে রেখেছে সেই “ ... শব
থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়” ।
অ্যাম্পি থিয়েটারের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে খালি গলায় গান গাইছেন জাপান
বা কোরিয়ার কোন এক পর্যটক । গমগম করে কানে বাজছে তার ভিনদেশি গান । বিস্ময়কর !
Temple |
Gate |
Public Latrin |
Celsus Library (1st Century AD)/ Underground pipes |
Mosaic Footpath 1st century AD |
coffins |
milestones |
বিশাল মন্দির স্তম্ভ । দেবী
কই ? কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না । শূন্য
মন্দিরে দেবী নেই ! এফেসাসের নির্যাস কিন্তু মেয়েদের হাতে ।
এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়ায় যুদ্ধ করত আমাজনরা । এফেসাসের প্রতিষ্ঠার
মূলেও রয়েছে এই নারী যোদ্ধা দের দুর্দমনীয় বীরত্ব । মাজোস বা স্তন (ডান
দিকের) কেটে ফেলত তারা যাতে ভালোভাবে তির
ধনুক চালানো যায় । স্তন হীন তাই আ মাজন । কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তাকে নিয়ে
যুদ্ধে যেত । ছেলের জন্ম দিলে বাপের কাছে ফেলে রাখত । খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে গড়ে ওঠা এই ভরভরন্ত
নগরীর টুটাফুটা মোহে আমি এতোটাই ভেবলিয়ে গেছিলাম যে আমাজনদের প্রত্ন স্মারক খুঁজে পেলুম না । একবারটি চোখে দেখার বড় ইচ্ছে
ছিল ।
কিন্তু সেই আশ্চর্য দেবী কই ? আরটেমিস ? আনাতোলিয়ার আদিম কাল্টের মাতৃ
দেবী কাইবেলে মিশে গেলেন গ্রিক আরটেমিসের সঙ্গে । পুরোনো এবং
নতুন আগ্রাসী সভ্যতার মেলবন্ধন ! এমন নজির আমাদের দেশেও আছে প্রচুর ।
আরটেমিসের সাদৃশ্য পাওয়ায়া
যাবে রোমান ডায়নার মধ্যে । উর্বরতা ও প্রাণিজগতের দেবী । প্রবল দাপুটে ছিলেন আরটেমিস ।অন্তত এশিয়া মাইনরের গ্রিকদের
কাছে । দৈহিক পবিত্রতা নিয়ে ভয়ানক ছুঁৎ মার্গ ছিল তাঁর । তাঁর সারা দেহ জুড়ে
ডিম্বাকৃতি নকশাগুলো কি ? মনে হতে পারে
বক্ষদেশ , অনেকে বলেন ডিম্বাণু অথবা অণ্ডকোষ । জানি না কি ! তবে পাগান সভ্যতার
রহস্যময়তা ধরা পড়ে । মানুষের জন্মই তখন বিরাট রহস্যের খনি । কিন্তু দেবী কোথায় ?
এই পাথরের মধ্যেই বসে আছেন জয়ের দেবী নাইকে । বেশ প্রসন্নভাবেই বসে আছেন এখনো । এখনকার নামকরা
স্পোর্টস ব্র্যান্ড । সেই কোনকালে নাইকা নাইকা বলে চিৎকার করে বনিকের দল বিদ্রোহ
করেছিল সম্রাট কনটান্টাইনের বিরুদ্ধে ।
এফেসাস এক অসাধারণ গ্রিক রোমান শহর ছিল , ভগ্নাবশেষ তার প্রমাণ । খ্রিস্ট
ধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মূর্তি পুজোয় প্রবল বাধা আসে । এই শহরের অনেক
সুন্দর কারুকাজ নাকি নতুন রোমানদের নতুন রাজধানী কন্সটান্টাইন (ইস্তানবুল) সাজাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । বহিরাগত শাসক , নতুন
ধর্মের উত্থান , সমুদ্রের সরে যাওয়া , বন্দরের ব্যাবসায় ভাঁটা সব মিলিয়ে এফেসাস ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়তে থাকে ।
এক গেট দিয়ে ঢুকে পথ ঘুরে ঘুরে আরেক গেট দিয়ে বের হওয়া । এই ভাবেই
পুরো শহর টা দেখা হয়ে যাবে ।
জায়গায় জায়গায় রেস্টোরেশনের কাজ চলছে । ছোট ছোট অন্ধকার কুঠরিতে
গ্রিলের গেটে তালা । ছেনি বাটালির মতো যন্ত্রপাতি ডাঁই করে রাখা আছে , সবই সেকালে
ব্যাবহার হত । ওমা , দেখি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই দেবী , সারা গায়ে মুন্ডমালার মতো
ডিম্বাকৃতি সাজ ! বলছে , আমাকে বের করো ,
সবাই দেখুক আমাকে । জানুক আমার মহিমা ! সেকালে দুনিয়া কাঁপাতাম আমি ! আমার মন্দির
ছিল সেকালের সেরা ।
সেই অদ্ভুত আলো আঁধারের পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে আছে তালা বন্ধ আরটেমিস ।
কেউ ভিড় করছে না । কেউ দেখছে না । কোনও গাইড ,ট্যুরিস্ট দের দেখাতে নিয়ে আসছে না । কোনো রকমে হাত ঢুকিয়ে ছবি তুললাম। অবহেলায় অগোচরে পড়ে রয়েছেন সেই প্রবল শক্তিময়ী নারী , এক অসাধারণ ঐতিহাসিক শিল্প স্মারক । ঠিক যেভাবে কোন অবহেলায় চাপা পড়ে যাচ্ছে তামাম
দুনিয়ার মেয়েরা , ঠিক যেভাবে মেয়েদের সমস্যা তুলে কথা বলতে গিয়ে অপ্রিয় অবাঞ্ছিত উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তকমা
এঁটে দেওয়া হয় এক অধ্যাপক কে, আমার চোখের সামনে ।
আমি প্রেতিনীর মতো খুলে দিচ্ছি অপ্রিয় সকাল
তোমরা তো ভালো পারো প্রিয়মিথ্যা বলে পাশ ফেরা...
কবিতা যশোধরা রায়চৌধুরী
ছবি লেখক
রবিবারটি পূর্ণ হল।আহা!
ReplyDeleteরবিবারটি পূর্ণ হল।আহা!
ReplyDeleteআহা এইতো অনুরাধা এসেছে!
ReplyDelete