Monday 3 August 2015

ক্যানবেরা ক্যানভাস


ন্ধকারের চূড়ায় তোমার বাড়ি
আমলকি পাতা সারারাত যায় ঝরে...

আমলকি পাতা নয়, পায়ের তলায় ঝরে পড়া  একরাশ ম্যাপল পাতা  আর চোখের পাতা ছোঁয়া ঠান্ডা হালকা হাওয়া।  ক্যানবেরায় তখন  সুহানি আঁধারি  মাঝরাত ।  এ দেশের পশ্চিম থেকে পুবে চলে এলেম ,সময় দু ঘন্টা এগিয়ে ।
সকালে আলো ফুটলে দেখলাম বাইরে  রঙের বাহার , নীল আকাশে বেলুনবিলাস আর নীল পাহাড় বেড় দিয়ে ঘিরে আছে চারদিক








অনেকের কাছে ক্যানবেরা মানে ভয়ানক বোরিং একঘেয়ে একটা শহর বা একটা বড়সড় গ্রাম শুনশান । পার্থে যদি বাংলা বন্ধ , তাহলে এখানে কারফিউ সবাই সিডনি মেলবোর্ন করে করে লাফায় । ছুটি পেলেই পালিয়ে যায়কিন্তু এসবের মধ্যে  এখানকার বাসিন্দা রোজি কালরা বললেন অন্য কথা । তবে রোজি কালরারা হলেন চিরকালের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় । চারিদিকে উঁচু উঁচু বাড়ি , হুশ হাশ গাড়ি , গুঁতো গুঁতি ভিড়, চোখ ধাঁধানো আলো, শপিং মলের চেকনাই আর হাজারটা বোকা বোকা পয়সা খরচের জায়গা না থাকলে জায়গাটা জাতে উঠল না বলে যারা নিন্দে মন্দ করবেন আর হাই তুলবেন তাদের জন্য সিডনি মেলবোর্ন তো রয়েইছে ।
রোজি বললেন আমার এ জায়গাটা খুব ভাল লাগে জানেন । সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত আমার বাড়ির সামনেটা কেমন একটু একটু করে বদলে যায়। কেমন এক আশ্চর্য ম্যাজিক । কেউ যেন একই ক্যানভাসে একটার পর একটা ছবি আঁকছে , সূর্যের সাতটা রঙ তার প্যালেটে গুলে দিচ্ছে ঘাসের শিশির আর হঠাৎ বৃষ্টির জল ,আলো আর হাওয়ার তুলি বুলিয়ে  বুলিয়ে সে বদলে দিচ্ছে একই দৃশ্যপট । কখনো মায়াবী , কখনো ছায়াবী , কখনো রহস্যময় ছমছমে, কখনো উল্লাস , স্নিগ্ধতা , অলসতা,শান্তি । আমার কেমন নেশা লেগে যায় । বাড়ির পাশের ঢিবিটায়  সন্ধে বেলায়  ক্যাংগারুর দল  এসে জোটে । আর বাগানে যে কতো বাহারি  রঙ বেরঙের তোতাপাখি এসে বসে থাকে! লক্ষ করে দেখবেন প্রকৃতির নিজস্বতাকে এখানকার লোকেরা কি যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে ।
কেমন করে , একটু বলুন না , শুনি । আমি হলাম গিয়ে দুদিনের মুসাফির । যা দেখি  যা শুনি তাই ভাল লাগে ।
নিজের হাতে বানানো ব্ল্যাক ফরেস্ট কেকের একটা টুকরো প্লেটে তুলে দিয়ে রোজি বললেন,দুদিন থাকলে নিজেই বুঝতে পারবেন । এদের কি পয়সার  অভাবঅথচ দেখুন কতো কম আলো ব্যাবহার করে ।   শহরে গাছপালা ,  আলো আঁধার , তিরতিরে বয়ে যাওয়া জলে দিবারাত্রির কাব্য । পায়ের নিচে জমে ওঠে শিশির আর ঘন হয়ে আসে  ঝিঁঝিঁ র ডাক । কোথায় শহরের শেষ আর জঙ্গলের শুরু ঠাহর করতে পারবেন না । শহর যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে টিডবিনবিল্লার জঙ্গলে ।  পাখি ক্যাংগারু এদেরি রাজত্ব এখানে । মানুষকে এরা বিশেষ পাত্তাও দেয় না ।  গাড়িকেও ভয়টয় পায়না ।
আমি ভাবলাম বেশ মজা তো । এবারে তাহলে বেশি লিখতে টিখতে হবে না । ব্লগে শুধু ছবি দিয়ে দেব । আর নাম দেব ক্যানবেরা ক্যানভাস ।









"ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মত করি পান ।"
অফিসের পাশে ওয়েস্টন পার্ক আর গ্রিফিন লেক । কাজের ফাঁকেই দুপুরের খাবার আর জল নিয়ে সেই সব ছবির মত পার্কে ঘাসের মধ্যে ঘাস হয়ে বসে থাকি আর সেই আশ্চর্য জাদু শিল্পীর ছবি দেখতে থাকি ।
ওয়েস্টন পার্কে ক্যাংগারুদের বারোয়ারি সম্মেলন । বিভিন্ন পরিবার পুত্রপুত্রীকলত্র সমেত জড়ো হয়েছে । অনেকেই দুপুরে গা এলিয়ে রোদ্দুর মেখে শুয়ে আছে , কেউ কেউ বিশ্রম্ভালাপে মগ্ন , একদল আবার  পলিটিক্স নিয়ে বেজায় তর্কে মেতেছে , একেবারে দু’পা তুলে মারামারিএরই মধ্যে একটা পরিবার আবার সটকে পড়ার তাল করছে আর আমাদের মত কিছু আদেখলে মানুষের দল পট পট করে ফোটো তুলতে ব্যাস্ত । লম্বা লম্বা সেলফি স্টিক, কুচো কাঁচাদের মহা উৎসাহ । তাতে ওদের কিছুই যায় আসে না, কোনই হেলদোল নেই ।












এক ছুটির দিন চললাম টিডবিনবিল্লার জঙ্গলে । পথের দুপাশে রাজার ভান্ডারের মত ছড়িয়ে থাকা সেই বিশাল ক্যানভাসের কিছুটা কানাকড়ির মত তুলে নিলাম দেখলাম সবুজ উপত্যকায় পাহাড়তলির পিকনিক ।

























কাক্কেশ্বর কুচকুচের N R I ভাই  Magpie  


মনের মত বিজ্ঞপ্তি


মনের মত বিজ্ঞপ্তি
দেখা হল টেলস্ট্রা টাওয়ার থেকে পুরো শহরের ছবি । আর সব ট্যুরিস্টদের যা যা দেখা কর্তব্য সেগুলোও বাদ পড়েনি । ওয়ার মিউজিয়াম , আনজাক প্যারেড গ্রাউন্ড ।পার্লামেন্ট , মিন্ট এবং  ক্যানবেরার ন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়াম ।







আনজাক প্যারেড গ্রাউন্ড


ওয়ার মিউজিয়াম

্পুরোনো পার্লামেন্ট


নতুন পার্লামেন্ট


টাঁকশাল


আর্ট গ্যালারি


আমার দুই জাঁদরেল ভেজিটেরিয়ান সঙ্গী এবারে আরো কট্টর হয়ে উঠল দেখছি । হোটেলের শেফকে দিয়ে
ঘাড় ধরে  প্রতিদিন চাল ডাল সবজি দিয়ে একটা ডিশ বানিয়ে নিত । মাঝে মাঝে আমিও ভাগ নিতাম কিন্তু প্রত্যেকদিন ওই জগাখিচুড়ি হজম করা মুশকিল, তাই আমার খুব ফেভারিট হয়ে দাঁড়ালো  নারকেলের দুধ , লেবু পাতা আর নানান সুগন্ধি হারব দেওয়া  থাই চিকেন কারি আর ভাত ।


খুব ছোট্ট জায়গা, খুব অল্প লোকজন , ভারতীয়দের সংখ্যাও বেশ  কম । বেশির ভাগই নানান প্রফেশনাল , আই টি , ডাক্তারব্যাবসা । গুজরাটি , পাঞ্জাবি । ছাত্র । আরেকটা দল আছে । ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়া ভারতের যুব সম্প্রদায় । দেশে থাকলে থিকথিকে লোকের ভিড়ে  মকান তো দূর অস্ত, রোটি কপড়া জোটানোই যাদের কালঘাম  ছুটিয়ে দিত , তারা এদেশে এসে অডি গাড়ি হাঁকাচ্ছে , অ্যাপেলের মোবাইল আর ট্যাব হাতে ঘুরছে । কেউ দূতাবাসে গাড়ি চালায় কেউ আবার সিকিউরিটি গার্ড । ভারি মোলায়েম ব্যাবহার, সদা হাস্যমুখ ।  কেরালার নিষাদ হরিয়ানার খুশবিন্দর বহাল তবিয়তে আছে, দেখেও ভাল লাগে । কী ই বা করতে পারত এরা দেশে ?  এর ওর  পেছনে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে  ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত  আজ আমার থেকেও ভাল তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান । তবে এদের মধ্যে আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল রামভজের চাকরিটা । দূতাবাসের দুধসাদা বারান্দায় যেখানে গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি খেলা চলছে  সেখানে রামভজ সারাদিন একটা দুধসাদা বড় বেতের চেয়ারে রোদ্দুরে পা মেলে বসে থাকে । তার পাশে নকল ঝর্না ঝরঝর বয়ে চলছে । নীল আকাশ ,  আকাশ ছোঁয়া কটকটে হলুদ ফুল , বেতের চেয়ারে রোদ্দুর  আর রামভজসেও সিকিউরিটি গার্ড । তবে রামভজ লোকাল স্টাফ নয়, সে দেশ  থেকে গেছে , পোস্টিং । এমন পোস্টিং ও আছে  তাহলে? আমি তাকে দেখলে ডাকঘরের অমলের মত প্রায় বলে ফেলি, রামভজ ও রামভজ ,তোমার মত যদি  সিকিউরিটি গার্ড হতে পারতুম তাহলে বেশ হত ।
নীল পাহাড়  আর  গ্রিফিন লেকের ধারে তুমি কেমন করে অফিস পাহারা দাও? আমায় শিখিয়ে দাও ।
রামভজ অমনি বলে উঠত, পাহারিদারি করায় যে এত সুখ তা আপনার কাছ থেকে শিখে নিলুম ।




ক্যানবেরায় শুধুই সরকারি অফিস আদালত, ব্যাবসাপত্তর সব অন্যান্য  শহরে । আর সরকারি কাজের মতই অনেকের কাছে এই জায়গাটা বোরিং ।  আরো জানতাম এখানে ভারতীয়দের সংখ্যা বেশি নয় ,  লাইব্রেরি ঘরে হঠাৎ দেখি বইএর ফাঁকে উঁকি মারছে এই ছবিটা । তাহলে বঙ্গজনেরা এখানেও আছে , আছে শুধু নয় জমিয়েই আছে , আবার জমিয়েই শুধু নয় তাড়াতাড়ি না এলে জায়গা নাও পাওয়া যেতে পারে  বলে চেতাবনিও দেওয়া আছে।


একদিন কাজের ফাঁকে দূতাবাসের লাউঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রং বেরঙের ম্যাগাজিন দেখছি ।আমার সামনে সেজো কর্তা গোছের একজন পায়চারি করতে করতে  মোবাইলে  কথা বলে চলেছেন।
“আচ্ছা, শাদি ডট কম । দহেজ ভি দে দিয়া । কিতনা? ওকে ওকে । নহি নহি , চিন্তা মৎ কিজিয়ে । হাম হ্যাঁয় না ? “
উনি খুব নরম ভাবে বার বার “নহি নহি ওকে ওকে”  বলে চলেছেন । কাঁহাতক মিনিয়েচার পেন্টিং আর বুদ্ধের আধবোজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় ? পুরোটা না শুনে তো যেতেও পারছি না বাপু  বেশ কিছুক্ষণ এইসব ডায়ালোগ চলার পর সেজো কর্তা যেই বেরিয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আমি সটান গিয়ে বললাম, ও মশাই , তারপর কী হল? উনি খুব হকচকিয়ে বললেন, মানে?
মানে ওই যে , শাদি ডটকম, দহেজ তারপর?  সত্যি, আপনি এতো চাপের মধ্যে আছেন !
ওই শেষের লাইনটাতেই ম্যাজিকের মত কাজ হল । তারপর যদি সেটা অডিটের লোকের কাছ থেকে শোনা যায় তাহলে তো কথাই নেই । এই ভদ্রলোকও তাই  উজাড় করে দিলেন সব দুঃখের কথা ।
কিন্তু সত্যিই পুরো ব্যাপারটাই বাস্তবে  খুব দুঃখের । দুর্ভাগ্যের । অপমান ও অসম্মানের । শুধু এই ফোনটাই নয় এরকম অজস্র ফোন তারা পেয়ে থাকেন ।  স্টোরিলাইনটা মোটামুটি এইরকম, পয়সা রোজগারের লোভে দেশ থেকে অনেক  লোক এসে জোটে  এখানে এদের অনেকেই  একটা সময় দেশে ফিরে  গিয়ে প্রচুর  পরিমান পণ নিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করে । মেয়ের বাপ মা গদগদ হয়ে বিলাইতি দামাদের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে পরম শান্তি লাভ করে । কিন্তু মেয়েকে ছেলেটি তখনই নিয়ে ফেরে না । অস্ট্রেলিয়ার ডিভোর্স পদ্ধতি খুব সহজ । একবছর একসঙ্গে না থাকলে সহজেই  ডিভোর্স । অনেক কাঠ এবং খড় পুড়িয়ে ভিসা নিয়ে কেউ কেউ স্বামীর সন্ধানে চলেও আসে । স্বামী তাকে সরাসরি অস্বীকার করে । মদত দেয় লোকটির বাড়ির লোকজনও।  সেই সময় এইসব মেয়েদের অবস্থা ভয়ানক শোচনীয় হয়ে ওঠেদূতাবাসের সাহায্য ছাড়া , ভারতীয় কমিউনিটির  সাহায্য ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকেনা । শুধু ক্যানবেরাই নয় যেখানেই আমরা গেছি এই  একই কাহিনি শুনতে পেয়েছি ।
এছাড়া ভাল অবস্থাপন্ন ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধ বাবা মায়ের চিকিৎসা , মৃত্যুর পর দাহকার্য সবই  দূতাবাসের কমিউনিটি রিলিফ থেকে করতে চায় । এই সব নানান রকম ঊনকোটি পঞ্চাশরকমের ঝামেলা লেগেই আছে । সেজোকর্তা এই পর্যন্ত বলে জল খেলেন ,আমিও উঠে পড়লাম, বাইরে গাছের ছায়া লম্বা হয়ে এসেছে । বিকেলের রোদ ছড়িয়ে পড়েছে ঘাসে।


ক্যানবেরার পাততাড়িও গুটিয়ে ফেলতে হয় একদিন । প্রকৃতির মায়াময় স্পর্শ , এই ক’দিনের অনুপম ছবিগুলো তোরঙ্গে ভরে ভরে রাখি । শেষ বারের মত ওয়েস্টন পার্কে লাঞ্চবক্স নিয়ে হাজির হই । সাদা তোতা পাখিগুলো গাছের ডালে । ফিরে আসার সময় দেখি ডালে আটকে আছে একটা সাদা পালক ।

প্রিয়সখা ভাল থেকো ,
ভুলে যেও তুচ্ছ ভুলচুক
মনে রেখ, একদিন একটি
পালখ সাদা, সুদূর পাখির
ছুঁয়েছিল তোমাদের বুক






কবিতা ঃ বাসুদেব দেব