Monday 12 December 2016

দিল্লি দাস্তান ৭


গোরস্থানে মধুরাত
কেমন সোনার পাথরবাটি শোনাচ্ছে কি না ? তাহলে ধান ভানার আগে শিবের গীত খানিকটা গাওয়াই যাক । সংস্কৃতে প্রাচীনকালের অনেক হেঁয়ালি , ধাঁধা , উদ্ভট শ্লোকের ছড়াছড়ি । রাজা সভাকবিকে এতো পাত্তা দেন, কিন্তু পণ্ডিতকে অতটা নয় ।এই নিয়ে পণ্ডিতের মন বড় খারাপ । কবির মধ্যে কীই এমন বেশি আছে যে রাজামশাই এতো মজে আছেন । রাজা বললেন বটে? ওহে পন্ডিত তোমার সামনে ওটা কী পড়ে আছে ? পন্ডিত বললেন কেন? শুষ্ক ং কাষ্ঠ ং তিষ্ঠ ত্যগ্রেকবি তখন সবে চাট্টি দই চিঁড়ে মধু দিয়ে মেখে  খেয়ে ধীরে ধীরে আসছেন । হঠাৎ  রাজা চেঁচিয়ে বললেন ওহে সভাকবি , সামনে ওটা কী পরে রয়েছে , একটু দ্যাখো তো । কবি জানালেন নীরস তরুবরো পুরতো ভাতি ।  
একই কথা, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি আলাদা । তাই তোমার থেকে কবিকে একটু বেশি ভালোবাসি যে ।
সিন্দুরবিন্দু বিধবা ললাটে! সে কি করে হয় ? হেঁয়ালির  জট ছাড়াও দিকি । তিনটি প্রশ্নের সম্মিলিত উত্তর এলো  ।
পুরনারীদের কপালে কে শোভা পায় ? সটান উত্তর এলো, সিন্দুর ।
মধুযামিনীর রাতে কোন নারী কাঁদে? যে দুর্ভাগ্যে বিধবা হয়েছে ।
কস্মিন বিধত্তে শশিনাম মহেশ ? চাঁদকে মহাদেব কোথায় ধারণ করেন? ললাটে। কপালে ।
তাই গোরস্থানে সাবধান না হয়ে মধুরাত কেন সেটা বলতে গিয়ে আরেকটু শিবের ভজনা করি । ধানগুলো বরঞ্চ খানিক তোলা থাক ।
শেষ মুঘল বাহাদুর শাহ জাফর , মেহরাউলিতে জাফরমহল বানিয়েছিলেন । তখন আলোর রোশনাই কমে এসেছে , আতরের খুশবু ফিকে হয়েছে , রঙের জেল্লা গেছে ।  একেই অপদার্থ, বেচারা কবি মানুষ। ব্রিটিশ তো সব লুটে নিয়ে গেলো ।বাহাদুর শাহ গরম কালে জাফরমহলে মেহরাউলির সবুজের মধ্যে প্রাণ জুড়োতে আসতেন ।  এই মেহরাউলিতেই আছে কুলিখানের সমাধি । কুলি খান তেমন কোন মনে রাখার মতো চরিত্র নয় । কিন্তু কুলিখানের মা ছিলেন ভয়ানক জাঁদরেল । আকবরের ধাই মা । মাহাম আনঘা । তার এক ছেলে হল এই কুলি খান । ইতিহাসে উপেক্ষিত হলেও তার  গোরস্থানটি  কিন্তু খাসা । আটকোনা ছিমছাম , বড় সুন্দর ।  ভেতরে চমৎকার কারুকাজ । চত্বর থেকে দেখা যায় কুতুব মিনার ।


মুঘল দরবারের শেষ ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ছিলেন টমাস মেটকাফ । সব লুটে পুটে খেয়ে  খুব আরামে গা ভাসিয়ে থাকতেন । তিনি এবার করলেন কি কুলিখানের সমাধিটাকে বেশ খানিক মেজে ঘসে সেখানে একটা রিসোর্টের  মতো বানিয়ে ফেললেনসোজা কথায় বলতে গেলে গেস্ট হাউস । চারদিকে প্রচুর গাছপালা লাগানো হল । লোদি আমলে বানানো একটা মান্ধাতা  তালাও কে নৌকাবিহারের কাজে লাগিয়ে দিলেন ।ব্যাবসা বুদ্ধি বলে কথা!  মনের মতো করে পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে নাম দিলেন “দিলখুশা” । কুলি খানের মকবারার  ওপর দিলখুশায় শুরু হল  সাহেবি মোচ্ছবের ঢালাও কারবার । তার ওপর আবার নব বিবাহিতদের মধুচন্দ্রিমা যাপনও  শুরু হয়ে গেলো ।  মেটকাফ আসলে দিলখুশা কে ভাড়া দিতেন হানিমুন করার জন্য । একের পর এক নতুন বরবউ হাতে হাত দিয়ে কুলিখানের হাড়গোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে শ্যাম্পেনের ছিপি  খুলে অরগ্যানের বাজনার সঙ্গে কোমর জড়িয়ে নাচছে, ভেতরে সাঁঝবাতির নরম আলো। বাইরে ফুরফুরে হাওয়ার সঙ্গে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে কুতুব মিনারের পেছনে।  মকবারা ভাড়া খাটিয়ে পকেটে আসছে দেদার চাঁদি । আর চাঁদি গুনতে গুনতে  মেটকাফ আড়ালে বসে  টেরিয়ে টেরিয়ে দেখতে থাকে জাফর মহলের ভেতর বাহাদুর শাহ  করেটা কি  ? 
     




1 comment:

  1. কেমন নতুন করে জায়গাগুলো চিনিয়ে দিচ্ছেন সুপর্ণ!

    ReplyDelete