যা চোখে দেখিনি কানে শুনিনি তা বাপু বিশ্বাস করছিনা , এই নড়বড়ে ভাঙাচোরা ডোবাপুকুরের
মত জীবনে এর থেকে বড় আহাম্মকি আর
কিছু আছে কি?
সেবারে
লিঙ্গরাজের জিম্মায় আমাকে রেখে বাবা
ভুবনেশ্বর ছাড়বার পর থেকে আমার নতুন
বাড়িটাকে কীভাবে বাসযোগ্য করা যায় সেটা আমার প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়ালো ।
বিয়াল্লিশ ডিগ্রি গরমে বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ওই আশ শ্যাওড়া ,কালকাসুন্দি
আর যজ্ঞি ডুমুর গাছের ঘন জঙ্গলে ঢাকা এক তলা বাড়িটা দেখে মেয়ের মনের ভাব কী হতে
পারে সেটা তো বাবার জানাই ছিল। তাই
আর কা্লক্ষেপ না করে বলে ওঠেন,’’আরে এত তপোবন । বাঃ,তার ওপর আবার পঞ্চবটী , স্থান মাহাত্ম্য আছে বলতেই হবে । একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে এই আর কি”
বাবা
পঞ্চবটীর গাছগুলো কী করে এতো তাড়াতাড়ি আইডেন্টিফাই করল এসব প্রশ্ন তখন আমার মনে
আসেনি । সাজিয়ে গুছিয়ে নেবার কাজটা কি রকম চলছে দেখার জন্য একদিন দুপুরবেলা
গেছিলাম ,দেখলাম চারদিকে প্রবল ঘুঘু ডাকছে আর দুটো রঙের মিস্ত্রি হাঁ করে ঘুমোচ্ছে
। এক চুল কাজও এগোয় নি। মনটা বেজায় মুষড়ে পড়ল । অবশেষে এক দিন সত্যি সত্যি বাড়িটায়
গিয়ে উঠলাম । জঙ্গল পরিষ্কার করতে কিছুলোকের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়েছিল । শুঁয়ো
পোকা, জোঁক আর চড়াই পাখির সাইজের মশা তাদের প্রায় প্রায়
মেরেই ফেলেছিল আর কি । মনে আছে একজনের ধুম জ্বর এসে গেছিল । কিন্তু
আসল রহস্যের তখনো বাকি ছিল।
অফিসের
বড়বাবু কান টান চুল কে বলল, “চারদিকে একটু কার্বলিক অ্যাসিড দেবেন। একটু গাছ টাছ আছে তো? আর ওই যে... যাক গে সে পরে হবে খোন ।“
তার মানে? সাপ আছে? আর
কি কি আছে?”
“ হ্যাঁ রে নন্দনা এরা কি বলে গেল রে?”। নন্দনা আমার
বন্ধু । সে ভুবনেশ্বরে ছিল । অন্য অফিসে।
আমার
এ হেন অজ্ঞতায় ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে নন্দনা বলে “ডোন্ট ইউ নো ? ভুবনেশ্বর ইস দ্য ল্যান্ড অফ
কোবরাস । আই থট ইউ অলরেডি নো “,এই বলে সে তার বিস্তারিত
অভিজ্ঞতা ,”হোয়েন মাই মম ইন ল কেম ,দ্যাট ডে ইন
দ্য কিচেন... দ্যাট ডে হোয়েন ছোটু ওপেন্ড দ্য লেটার বক্স.”.. ...আমার কাছে একের পর ধারাবিবরণী
দিতে থাকে আর আমি নিজের ক্ষমাহীন অজ্ঞতায় জর্জরিত হতে থাকি। নন্দনার পরামর্শ মত
সারা বাড়ি বাইরে এবং ভেতরে রাখা হল কার্বলিক অ্যাসিড ভরা ছোট ছোট কাঁচের শিশি ,ছিপিতে ফুটো করে ।
নতুন
জীবন শুরু হল। দেদার টেনশন মাথায় নিয়ে ।
অফিসে
আমার সহকারী একটি মেয়ে ছিল এমলিন খালকো ।সম্বল পুরের মেয়ে , বাচ্চা
মেয়েকে নিয়ে একা একা থাকে আর ভারি ঠাণ্ডা চুপচাপ । আমি তারিফ করে বললাম এমলিন ,তোমার তো খুব সাহস ,বাচ্চা নিয়ে কেমন একা একা থাকো ।
এমলিন
তার ঠান্ডা চোখদুটো বড় বড় করে বলল , ম্যাডাম আপনি আমাকে কী বলছেন! আমরা তো আপনাকে নিয়ে আলোচনা করি, সত্যি আপনার সাহসের জবাব নেই,ক্যায়সে রহতে হ্যাঁয় আপ
উয়ো ভূত বাংলা মে? বলে কি মেয়েটা? নিজের
সীমাহীন অজ্ঞতা তো বটেই সেই সঙ্গে নিজের বোকা স্বভাব টার জন্য গা জ্বলে যেতে লাগল আমার । কি দরকার ছিল এমলিনের সঙ্গে অত সুখদু:খের কথা বলার? চোখের সামনে ভাসতে লাগল ঘোর জঙ্গলে ঢাকা ইউনিট ওয়ানের ১১ নম্বর একতলা বাড়ি
,সাপ আর...
এলাকা
টা এমনিতেই খুব নিঝঝুম । একেকটা বাড়ির মধ্যে দূরত্ব অনেক । টিমটিমে আলো জ্বলে ।
ঝোপঝাড়
বলে আরো ম্লান দেখায় । আর আমার কল্পনাশক্তি আমাকে কখনোই রেহাই দেয়না। রাতে
ঘুমোতেও দেয় না ।
ধীরে
ধীরে একে একে অনেক শুভানুধ্যায়ীর দল নানান রকম ভাবে আমাকে বেশ ভালো করে বুঝিয়ে
দিলেন যে ১২ নম্বর বাড়িটা অর্থাৎ জোড়া বাংলোর একদিক টা যাকে বলে হন্টেড হাউস । ১২
নম্বরে কেউ থাকতেই পারে না । ওনাদের তো গতিবিধির কোন বাধা নেই।। ১২
থেকে ১১ নম্বরে এসে পড়লেই হল। আপন এঠারে কেমিতি রহিবে?
রসিয়ে খেলিয়ে একটি রোম হর্ষক গপ্পো আমাকে শোনাতে আসতো অনেকে । যেন মজা দেখতে এসেছে । শেষে এমনটা হল যে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমাকে অনেককে এড়িয়ে চলতে শিখতে হল ।
এর
মধ্যে মিত্তুন এসে বাড়ির সদস্য সংখ্যা বাড়াল । বাড়ি থেকে বলল, “বনবাদাড়ে
থাকিস, যেতে চাইছে যখন সঙ্গে নিয়ে যা” । স্বেচ্ছায়
এই বনবাস বেছে নিয়ে সে যে খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দেয় নি
সেটা সে আসা মাত্রই বুঝতে পেরেছিল । মিত্তুন কলকাতায় আমার ঝরঝরে ফিয়াট টা অসীম
দক্ষতায় চালাত । কী করে তা সেই ভাল বলতে পারবে। সে বাঘের
বাচ্চা । ভয়ডর নেই । ডাকাবুকো । তখন তার কৈশোর কাটেনি বললেই চলে । আমার মা তাকে
নিজের ছেলের মতোই ভালবাসেন।
দিন
চলতে লাগলো । ফি হপ্তায় মিত্তুনের হাতে বাড়ি ভূতবাংলা সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আমি কলকাতায় কেটে পড়তাম। মিত্তুন
আমার মুন্ডপাত করত ।একে একে রেড্ডি এল, আমাদের অন্নসংস্থানের
দায়িত্ব নিয়ে,এল বদন মালি । কতো মাস কেটে গেল ।
বাগানে
জিনিয়া,সূর্য মুখী ফুটল । মাঝখানে মা এলো । বাড়ি আরো পরিষ্কার হল , রেড্ডি মায়ের
জাদুমন্ত্রবলে আলুপোস্ত , মুসুরির পাতলা ডাল, মাছের ঝোল ,আমের টক বানাতে শিখে গেল,আমাদের বাধ্যতা মূলক ঝুরুঙ্গা ভাজি(বরবটি ভাজা)খাবার দিন শেষ হল ,পেছনের আউট হাউসে গোপী আর লছমি সংসার পাতলো,উইকেন্ডে
পুরী যাওয়া শুরু হল ,ভাল ভাল বন্ধু হল , কোকিল , পিউ কাঁহা ,বোউ কথা কও সঙ্গ দিতে লাগলো ,
শিশু ভুর্সুঙ্গা পত্র (কা রি
পাতা ) তরুণী হল ,এমনকি গাছের
আম পেড়ে আচার বানিয়ে কলকাতায় সাপ্লাই দেওয়াও শুরু হল।
এর
পর একটা লম্বা ছুটিতে কলকাতা গেলাম মিত্তুন সহ । বাড়িতে দিব্যি আড্ডা চলছে । আমি
বললাম ,”তাহলে দেখলে? বেশ ভালোই তো কাটাচ্ছি ওখানে । সাপ ভূত
কিছুই তো চোখে পড়লো না।“
সঙ্গে
সঙ্গে লক্ষ্য করলাম মা আর মিত্তুনের মধ্যে যেন চোখাচোখি হল এবং হঠাত ই মিত্তুন উঠে
দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বলতে শুরু করল ,ওঃ বললেই হল? আপনাকে যেন
সবকথা জানানো হত? সাপ আর নেই বুঝি ? আমি
আর রেড্ডি কি কম মেরেছি? বাড়ির গেট জুড়ে তো সাপ শুয়ে থাকে ,আমার বাথরুমে প্রায় প্রতিদিন চিতি সাপ ঢুকে থাকে , আর
কামিনী গাছের ঝোপে ?ওই যে সেদিন জিজ্ঞেস করছিলেন তোরা ওখানে
কি করছিস ? ওখানে কেউটের বাচ্চা ঢুকে গেছিল। আর বদন মালি ত
হামেশাই ঘাস কাটতে গিয়ে সাপ ধরে ফেলত । মা কে সব জানাতাম টেলিফোনে ,আপনি অফিস চলে গেলে । মা বলে
দিয়েছিলেন খবরদার, দিদির কানে ওসব তুলিস না । পাঁচ ব্যাটারির
টর্চ আর লাঠিটা কি এমনি এমনি রাখতাম? আরো শুনুন , আপনি তো দিব্যি চলে যেতেন কলকাতা। একদিন রাতে গোপী বলল চল আজ একসাথে খাই,খিচুড়ি বানাই ।রাত একটু বেশি হয়ে গেছিল ।আপনার বেড রুম লাগোয়া ঢাকা
বারান্দায় খেতে বসলাম ।বললে বিশ্বাস করবেন নি দিদি , হঠাত
বারান্দার সামনের বট গাছ টা প্রচণ্ড জোড়ে দুলে উঠল যেন ঝড় এসেছে ।কিন্তু চারদিকে
ঝড়ের নামগন্ধ নেই ,হাওয়াও দিচ্ছিল না সেদিন । গোপী তো দে ছুট ।আমাকেও বলল চলে যেতে ।একটা খুব জোরে ঝুপ করে আওয়াজ । গোপী চেঁচাল “মিত্তুন বিলকুল পিছে মত দেখনা”। এই
দেখুন গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে...
ভু ব নে শ্ব রের বা ড়ি |
No comments:
Post a Comment