গাছের পাতাগুলো
বৃষ্টিতে ভিজে চুব্বুস। বড়
বড় জলের ফোঁটা পাতায় পাতায় ঝুলছে। সরু রাস্তার দু ধারে মাঝে মাঝে লাল জবা ফুটে আছে
। আকাশ ছেঁচে বর্ষার পর পড়ন্ত বিকেলের ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলোতে তেমন তেজ ছিল না।
দূরে কালো কালো পাহাড় আর ওমনি একটা ঘন সবুজ রাস্তা দিয়েই চিড়িয়াটাপু যেতে হয়।
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে এই পঁচিশ তিরিশ কিলোমিটার হবে।
সূর্যাস্ত
দেখতে সবাই চিড়িয়াটাপু যায় । আন্দামানের বিখ্যাত সান সেট পয়েন্ট।
লেখাটার
নাম চিড়িয়াটাপুর সূর্যাস্ত হতেই পারত । তবে এমনি তেই সে দিন
সূর্যাস্তের সেই আড়ম্বরপূর্ণ ব্যাপারটায় অনেকটাই জল ঢেলে দিয়েছিল বৃষ্টি ।
আমরা
যখন ঘন বনের ভেতর দিয়ে সেখানে পৌঁছলাম সমুদ্র তখন অনেকটা
দূরে । চারদিক বেড় দিয়ে ঘিরে আছে আন্দামানের ট্রপিকাল রেন ফরেস্ট । প্রায় সন্ধের
আলোতে চারদিক কী মায়াবী ! আকাশে গোলাপি ,লাল কমলা রঙের
সূর্যের আলো মাখা মেঘ । দূরে কালা পাহাড় , হাত পা ছড়িয়ে
দাঁড়িয়ে আছে । বড্ড ভালো লাগছিল । সূর্যাস্ত নাহয় তেমনভাবে নাই দেখা হল কিন্তু কী অপার্থিব অলৌকিক সৌন্দর্য !
লোকজনের
ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে । সোনায় সোহাগা । বৃষ্টির জন্য নাকি?
এমনিতেই বেশি ট্যুরিস্ট দেখলেই আমার বিরক্ত লাগে যেন একমাত্র আমি ই
থাকব সেখানে! দিব্যি হেঁটে হেঁটে অনেক দূর চলে গেলাম । আর কতো রকমের ঝিনুক । কী
সুন্দর । কতো যে কুড়োলাম । আর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলাম, এত আন পলিউটেড নেচার , কোথাও কোন কৃত্রিমতার ছাপ নেই, দেখেছ? একেবারে আদিম প্রকৃতি । শুধু তাই নয় , কোথাও বাদাম,
আইসক্রিম, চিপস বিক্রি হচ্ছে না, অকারণ কেউ ভেঁপু বাজাচ্ছে না, সাবানের
ফেনার বুদবুদ তুলছে না । মাছ ভাজার আঁশটে গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে
যাচ্ছে না , সস্তায় কড়ি পুঁতির মালা গছাচ্ছে না, গলা জড়িয়ে খচাত খচাত করে ছবি তুলছে না । নাহ এ বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে
যাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির মধ্যে মিশে যাচ্ছি । ইন ফ্যাক্ট এমনি ভাবে একটা জায়গাকে দেখতে পাব এত টা আমরা ভেবেই আসিনি । অথচ এমনটাই তো আমরা বরাবর প্রাণে মনে চেয়ে এসেছি । আলো আরও কমে আসতে লাগলো । সমুদ্র অনেক দূরে
ছিল তো আমরা তাই অনেক দূর
চলে যেতে লাগলাম । পায়ের
পাতায় এবারে জল ছুঁয়ে যাচ্ছে । পিছন ফিরে আর দেখছি ই না।
চিড়িয়াটাপু
তে শুধু সমুদ্র ,বন আর পাহাড় ই নেই আছে প্রচুর পাখি । পাখির জন্যই
জায়গাটার এমন নাম ।
হঠাত
মনে হল খুব দূর থেকে কিসের যেন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ।ঠিক ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না । পেছন ফিরলাম । তারপর যা দেখলাম ! শুধু বুঝতে পারলাম শিরদাঁড়া দিয়ে নামছে একটা ঠান্ডা স্রোত । আমরা চলে এসেছি তীর থেকে
অনেক দূর ।কখন যে জলে থই থই হয়ে গেছে চারদিক বুঝতেই পারিনি । নিঃশব্দে চুপিচুপি জল আমাদের ঘিরে ধরেছে । যে জায়গাটা ছিল ধূ ধূ বালি বালি ,তা জলে উপচে পড়ছে। একেবারে
টইটম্বুর। আর সেই উথলানো জলের ওপারে লিলিপুটের মত কিছু লোক হাত নেড়ে কাউকে চেঁচিয়ে
চেঁচিয়ে ডাকছে মনে হচ্ছে । কাউকে আবার কি? আমাদেরই ডাকছে
প্রাণপণে । আমরা জলবন্দী । তার চেয়েও বড় কথা যে জল শুধু পায়ের পাতা ছুঁয়ে ছিল তা এখন হাঁটু ছাড়িয়ে যাচ্ছে । হাল্কা অন্ধকার নেমে
আসছে । বালির স্তর কোথায় কেমন জানা নেই। পা দিলেই ভুস করে যাব কিনা জানা নেই ।
চোরাবালি আছে কিনা, আন্ডার কারেন্ট আছে কিনা জানা নেই ,
কিচ্ছু জানা নেই । এতটা পথ যাব কি করে? কয়েক
মুহূর্ত মাথা একদম কাজ করল না । তারপর ঠাহর করে দেখলাম পারে দাঁড়ানো লোকেরা হাত
দিয়ে একটা ডিরেকশন দিচ্ছে,বলতে চাইছে যে ভাবে আমরা দেখাচ্ছি এইভাবে এস। হাত ধরাধরি করে আমরা সেই ভাবে কিছুদূর
এগুলাম । অনেকটা সেমি সারকুলার ভাবে এগিয়ে চললাম । চেহারাগুলো খানিক টা স্পষ্ট হল
। দেখলাম একটি দক্ষিণ ভারতীয় পরিবার ।বাবা মা ভাই বোন । খুব উদ্বিগ্ন । এদিকে
তাদের সঙ্গে জুটেছে স্থানীয় একটি লোক। একটা ভাঙা গাছের ডাল দিয়ে এবার সে পথ বাতলাতে থাকল । সোজা ভাবে নয় আমাদের ঘুর পথে
ডাঙায় উঠতে হবে । কারণ সোজা পথে বিপদ আছে । এখানে গভীর নালার মত একটা কিছু আছে,
অসতর্কতায় পা ফেললে সিধে সলিল সমাধি । খুব অসহায় লাগছিল। মনে আছে অনেক কসরত করে যখন পারে এসে পৌঁছলাম,কন্ঠতালু শুকিয়ে কাঠ । সবাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগল আমরা কী কী বিপদ
পেরিয়ে এসেছি । ওরা আগে থেকেই স্পটটা সম্মন্ধে জানতেন । প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন ,আচমকাই আমাদের দেখতে পান।
তারপর তো যাবার প্রশ্নই ওঠেনা । ভাঁটায় জল সরে গেলে আহাম্মকি করে অত দূরে যাবার
দুঃসাহস না দেখানোই ভাল কারণ, ইউ নেভার নো,কী হতে পারে ! প্রকৃতি একটা রহস্য । যে রহস্যের তল কেউ পায় নি । তাকে দূর
থেকে দেখাই ভালো ।
চিড়িয়াটাপু
|
ফিরে
আসবার সময় মেঘ কেটে মস্ত চাঁদ উঠেছিল । ঝাউ গাছের মাথায় ভেজা হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ ।
ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল জলের উপর মুখ উঁচিয়ে ছিল ।
আমার
আর ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিল না।
No comments:
Post a Comment