পেত্রা
আজ সকাল থেকে ব্যস্ত। আজ সে দোলমা বানাবে । কুচি কুচি চুল উড়ে যাচ্ছে তার কপালের
চারদিকে
। নাকে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম । গরম পড়েছে। ঈজিয়ন সাগর থেকে একটা নোনা হাওয়া
দিচ্ছে
।চারদিকে নীল সমুদ্র, বালু ভূমি আর রোদ্দুর । পেত্রার বাড়িটা পাহাড়ের খাঁজে। সাদা রঙের ।
পেত্রার বাড়ি /উৎস ঃ গুগল |
মাথাটা
গোল, নীল রঙের । আর পাঁচটা বাড়ির মতই।গ্রিসে যেমন হয় তেমনই । তাদের বাড়ির
দেয়ালে লতিয়ে উঠছে আইভি লতা আর প্রিমরোজ । পেত্রার স্বামী কাজ করে এথেন্সে । সে
ছুটি পেয়ে বাড়ি আসছে । তাই পেত্রার কাজের আর শেষ নেই ।
এমনিতে
সে খুব একটা লম্বা নয় ,তাই একটা আঁকশি দিয়ে আঙুর পাতা পাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে । ওদিকে চুলায়
ধিকিধিকি সিদ্ধ হচ্ছে বেঁটে দানার ভাত আর গোরুর মাংসের কিমা ।
অনেক
আঙুর পাতা পাড়া হয়েছে । কাঠের বালতিতে জল নিয়ে পেত্রা গলা সপ্তমে তোলে
“...অরেস্টিস,কোথায় গেলি ,বাঁদর
ছেলে? এদিকে আয় ,পাতাগুলো জল দিয়ে ধুয়ে
দে।“ অরেস্টিসের
কোন
পাত্তা নেই । এদিক ওদিক তাকিয়ে পেত্রা নিজেই ধুতে শুরু করে। গোরুর মাংসের কিমার
মধ্যে খানিকটা ওয়াইন ঢেলে দেয়। ওয়াইন তাদের বাড়িতেই বানানো হয় । আঙুরবাগিচা তাদের
আছে মোট
তিনটে
। তাদের দেখভাল কি কম হ্যাপার কাজ । এ কাজ টা সে ক্রিস্তফারকে ঠেকা দিয়েছে।
ওয়াইনের পিপেগুলো অন্ধকার কুঠরিতে থাকে । যত পুরনো হয় তত দাম চড়ে। পেত্রার
ব্যবসায়িক
বুদ্ধির
তারিফ করতে হয় ।
আঙুর
পাতার মধ্যে ভাত মাংসের পুর ভরে চটপট দোলমা বানানোর কাজ টা সেরে ফেলে সে । আর
হ্যাঁ, পেত্রার বাড়িতে তৈরি হয় দই আর চীজ, ফেতা চীজ। আঙুর
আর দই চীজের একটা অদ্ভুত গন্ধে
তার
ঘর উঠোন ভরে থাকে । তাদের একটা অলিভ বাগিচাও ছিল একসময় । এখন অলিভ তেল আর অলিভ
বাইরে থেকেই জোগাড় করে সে । পেত্রা তার সাদা নীল চৌখুপি কাটা এপ্রনে হাত মুছে
নেয়
। তার মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা । ক্রিট দ্বীপে তার বাপের বাড়ি হবার সুবাদে মাছ ধরা
কাটায় সে ওস্তাদ । অরেস্টিসের বাবার জন্য পেত্রা বানাচ্ছে দোলমা, টাটকা ফেতা
চীজ আর ঝলসানো
বেগুন
আর টোম্যাটো, রসুন আর গোল মরিচ মাখানো ,তার ওপর ঢালবে অলিভ তেল ।
পিটা ব্রেড সদ্য আভেন থেকে বের করে আনবে । ক্রিট দ্বীপের খাবার আপাকি বানাতে চায়
সে । শুয়োরের
মাংসের।
এর সঙ্গে দেবে দই এর মধ্যে কুচি করে শশা,অলিভ তেল ,অরেগানো, পারস্লে, দিল,
থাইম আর সেজ । এর নাম জাতজিকি । সামুদ্রিক মাছের ফিলে দিয়ে বানাবে
মাছের সুপ কাকাভিয়া ।
মিস্টির
মধ্যে বানাচ্ছে আমন্ড বাদামের কেক ওপরে ঘরে বানানো তাজা ক্রিম আর বাকলাভা
।বাকলাভাতে একটু ঝামেলা আছে । কিন্তু সেটা বানাতে হবেই অরেস্টিসের জন্য । নইলে সে
বিচ্ছুকে
কে
সামলাবে?
এ
সব কথা ভাবতে ভাবতে পেত্রার নীল চোখ হাসিতে ঝিকিয়ে ওঠে । কিন্তু কথায় সেই দস্যিটা ? অনেকক্ষণ
দেখছি না তো ! অরেস্টিস একটা মিস্টি ছেলে আবার বিচ্ছুও । এরই মধ্যে চার্চের কয়ারে
বেহালায়
ছড় টানে । আবার আঙুর জলপাই পায়ের তলায় চেপে চেপে উঠোন নোংরা করে । কাঠ বিড়ালির লেজ
কেটে দেয় । অলিভপাতার মুকুট বানিয়ে রাজা রাজা খেলে । আর সুযোগ পেলেই
সমুদ্রের
ধারে চলে যায় । দুই নীল চোখ দিয়ে মাপতে চায় ওই সুদূর নীলিমার গভীরতা । সমুদ্রের
ফ্যানা জমে কত রকমের আকার নেয়। অরেস্টিস সেগুলো জমায় । আর নানারকম শঙ্খ,নুড়ি,
ঝিনুক
। সন্ধে
নামার সময় তাদের এই এভিয়া দ্বীপের নোনা হাওয়ায় মিশে যায় বুনো ল্যাভেন্ডার আর
আইরিসের গন্ধ । সন্ধের আকাশ ভরে ওঠে অজস্র তারায়। ওই দুই চোখ দিয়ে সে পড়বার চেষ্টা
করে
তারার প্রদীপে লেখা কোন সঙ্কেত বাণী । যতক্ষণ না পর্যন্ত পেত্রা এসে তাকে টেনে
নিয়ে না যায় সে বসেই থাকে আর ভাবে ।
নাহ,আর তো বসে
থাকলে চলে না । পেত্রা ছেলেকে খুঁজতে বের হয় । খুঁজতে খুঁজতে আঙুর বাগানের রাস্তায়
ঢোকে । তার স্বামীরা ছিল দেলফি এলাকার লোক । দেলফির সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর
নামে
তার নাম । আঙুর বাগানে আলোছায়ার নক্সা বুনছে দুপুরের রোদ্দুর । সী গালের চিলচিতকার
দূর থেকে শুধু শোনা যাচ্ছে । এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই । শুধু পাতার ঝিরঝির ।
বাগানের
যে পথ টা ঢালু হয়ে বেলাভূমিতে মিশেছে, পেত্রা দেখতে পায় সে পথ দিয়ে
আঙুর বাগানের দিকে উঠে আসছে বাবা আর ছেলে। অরেস্টিসের খালি পা।সারা শরীর বালি মাখা,
তার পরনের সাদা
পাতলা
ঢলঢলে জামা হাওয়ায় ফুলে ফুলে উঠছে । তার লাল লাল চুলে ঝিকঝিক করছে অভ্রকুচি,ঠোঁট দুটো
করমচার মত টুকটুকে ।আর দুই নীল চোখ জুড়ে দুষ্টুমি ।সে যেন এই পৃথিবীর
নয়, যেন সিস্তিন
চ্যাপেলের ফ্রেসকো নেমে এসেছে মাটিতে ।তড়িঘড়ি এগিয়ে যায় পেত্রা। ওমা, ওকি ?বাবা আর ছেলের হাত ভর্তি কালামারি । এই শেষ
বেলায় ?
তাকে
কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনে বলে ওঠে, আজ রান্না হবে কালামারি দিয়ে
রিসত্তো ।
পিয়ালি আর অরো |
কয়েক
শতাব্দী বাদে আবার ফিরে এসেছে সেই আঙুর বাগানের মা ও ছেলে ।
সময়ের
জোনাকিমেলায় তারা রূপ বদলে নিয়েছে। হয়েছে পিয়ালি আর অরো । কিন্তু সব কিছু কি
বদলানো
যায়? বদলানো কি যায় সেই লাল লাল চুল আর নীল নীল চোখ?
No comments:
Post a Comment