Friday 28 February 2020

বিনি পয়সার ভোজ


পুবের মিঠে রোদ গাছপালার মাথায় আলতো ভাবে ঝিলমিলিয়ে ওঠার পর মহারাজ সেদিকে মাথা নুইয়ে প্রণাম করেন । মহারাজ নামটা অবশ্য আমিই দিয়েছি । সকালের পর সকাল, দিনের পর দিন , ওনার জীবনযাপনের ঝলক দেখে আমার মহারাজ নামটাই মনে ধরেছে  । শুধু সূর্যদেব নয় , আমার সঙ্গে  চোখা চোখি হলেও মহারাজের হাতদুটো জড়ো হয়ে যায় । পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি গরমের তন্দুর   শুরু হবার আগে সময়টা বেশ কিছুক্ষণ মনোরম থাকে ।  সকালবেলায়  চারপাশে যে সব ছবি দেখা যায় সাঁঝের বেলা তারা কোথায় উবে যায় , সব কেমন অচেনা লাগে । বাড়ি থেকে বেরিয়েই প্রথমেই মহারাজের দর্শন । বিরাট এক বুড়ো পিপুল গাছের তলায় মহারাজের ডেরা । গাছের নিচে ছোট একখানা সাধুর মূর্তি বসানো মহারাজের গুরু ।  মহারাজ সবসময় সাদা জামা কাপড় পরেন । টেনিসকোরটের রেলিং ঘেঁসে  ওনার প্রাসাদ ।  এক খানা ছোট্ট চৌকি নিয়ে এক রত্তি জায়গা কোনমতে ঘেরা । পিপুল গাছের তলায় গৌতম বুদ্ধকে সুজাতা যেমন পায়েস খাইয়েছিল মহারাজকেও তেমনি কেউ না কেউ খাবার জোটায় বলে আমার ধারনা । আমি চায়ের কাপ আর ফ্লাস্ক দেখতে পেয়েছি ।
মহারাজ সাদা পাগড়ি দিয়ে মাথা ঢেকে রাখেন । আর সামনে হুঁকোটি পরিপাটি সাজানো  থাকে । মহারাজ আর টেনিসবলের ঠোকাঠুকি আর তাদের বিচিত্র উল্লাসধ্বনিকে কে পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করি । দিল্লি দুধ সাপ্লাই এর দোকানের ঝাঁপ সবে খুলেছে । ভৃত্যের দল বিচিত্র দর্শন  রাজকীয় সারমেয়দের প্রাত ভ্রমণ এবং কৃত্যাদির জন্য নিয়ে বেরিয়েছে আর তাদের দেখে  নানান কটু কাটব্য,  মন্তব্য ছুঁড়ে মারছে রাস্তার যত অসভ্য লোফার কুকুরের দল ।
কুকুর থেকে বরাবরই আমি নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পছন্দ করি । রাস্তা এখনো ভারি শান্ত , ঝিরঝিরে হাওয়া আর তিরতিরে রোদ , অমলতাস ফুল ঝরে ঝরে রাস্তা হলুদ হয়ে গেছে , নাকে নিমফুলের গন্ধ আসছে , একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে বাবা আর ছোট্টখোকা । বাবার পিঠে খোকার বোঁচকা , বাবা পুরোদস্তুর তৈরি, হাঁটবার জন্য । খোকার চোখে ঘুমের এঁটুলি পোকা । খোকার স্কুলবাস এখোনো আসে নি । পাশ কাটিয়ে যাবার সময় শুনতে পেলাম , বাবা বলছে ঘুমের এঁটুলিকে, “তুমহারে পাস তিন রুপিয়া, মুন্নিকে পাস পাঁচ আউর পাপ্পুকে পাস চার , তো বোলো বেটা কিতনা হুয়া?” আমার এইসা রাগ হোল । পাশ দিয়ে কাঠবিড়ালি ছুট মারছে , বাতাস চুলে বিলি কাটছে,  নিম আর আমলতাস পর্যন্ত টুপটাপ ফুল ঝরিয়ে দিচ্ছে আদর করে, আর এই তোর শুভঙ্করীর আঁক শেখানোর সময় ? পাশ কাটিয়ে বাঁক ঘুরে দেখি আরেক তামাশা । এখানে মা আর মেয়ে । দুজনেই ছোটো বড়  দুটো বারবি ডল । আজকাল মায়েরা এরকমই । হুশ করে একটা গাড়ি চলে গেলো । শুনি, বড় বারবি ছোট জনাকে বলছে ,” টেল মি দ্য নাম্বার অফ দ্য কার?” কী ভয়ানক পরিস্থিতি এই সব ভাবতে ভাবতে দেখি, ওই দেখা যায় আমার  বাড়ি , মালঞ্চেরই বেড়া ঘেরা । আমার পার্ক এসে গেছে । পুরো পার্ক টাই অজস্র মাধবীলতার ঝাড় দিয়ে ঘেরা । তাতে অঢেল  অঢেল ফুল পুব হাওয়ায় দোলা খাচ্ছে আর হালকা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে ।  ঢোকার পরেই প্রতিদিনের সেই কমেডি টা আরেকবার শুরু  হবে । কমেডি কুইন বলাই বাহুল্য আমি নিজে । একটি মেয়েকে(থুড়ি এখন মহিলা বলাই ঠিক ,মানুষ কিছুতে বুড়ো হতে চায় না দেখছি!) দেখে আমি  মুন্নাভাই ফিল্মের বিদ্যা বালানের মতো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলবো “গুড  মঅ অ অ র্নিং , ভিনীতা   ইয়ে... মানে ভীনাকশি”  প্রতিদিন মানুষের একই ভুল কী করে হয়? ভীনাকশি( নামের মানে জানি না, মীনাক্ষী হলেও না হয়   বুঝতাম) পালটা হাসি দিয়ে নির্ঘাত ভাবে “ প্রথম দিনেই যে রকম গবেট দেখেছিলাম ,এতোগুলো বছর পার করেও একটুও বদলায় নি । আশ্চর্য !”  আমরা ব্যাচমেট ছিলাম, যদিও  ও অন্য সার্ভিসের । পার্কে হাঁটার সময় আমাকে ধরে ফেলবেন আরো একজন । ইনি কিছুটা বয়সে বড় বলে মনে হলেও ওনার এঞ্জিন কিন্তু আমার মডেলের চেয়ে ভালো । আমাকে পেরিয়ে যাবার সময় খুব অস্ফুট একটা হ্যালো বলে টপ করে এগিয়ে যান বা এড়িয়ে যান তার  একটা কারণ আছে । প্রথমে উনি একদিন নিজে থেকেই আলাপ শুরু করেছিলেন, আমরা একই ব্লকে থাকি, চলতে চলতেই কথা হচ্ছিল ,কথা হতে হতেই আমি লক্ষ করলাম উনি একটু বেশিমাত্রায় কৌতূহলী ,কাজেই প্রশ্নপত্র বেশ লম্বা আর ওনার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমার এগারো নম্বরের গিয়ার চার থেকে পাঁচছয় করতে হচ্ছে । লাগাতার পাঁচ ছয় করতে করতে আমি যাকে বলে দড়াম করে সটান পাথুরে ট্র্যাকে ক্রিকেটের ক্যাচ মিস করার কায়দায় পড়ে গেলাম । মোবাইল ছিটকে পড়ে গেলো , ভালো এঞ্জিন বেশ ঘাবড়ে গেলেন । হাঁটু আর থুতনির দফা রফা হয়ে যেতে পারত কিন্তু গেলো না । ভালো এঞ্জিন কিন্তু খুব ভালো করেই বুঝে গেছিলেন এই পতনে তার কিছুটা অবদান আছে । তারপর থেকেই উনি আধোস্বরে হ্যালো বলে এগিয়ে যান । ঝিরঝিরে হাওয়া আর টুপটাপ ফুল ঝরার মধ্যে হন্টন শেষ করে ফেরার পথে বাঁ দিকে মন্দিরে টং টং ঘন্টা বাজে । কোনদিন যাই না । একদিন এমনি  মনে হল চলে গেলাম । ঘন্টা বাজালাম । সে আওয়াজ চারদিকে রিনরিনে প্রতিধ্বনি তুলল। কেউ কোথাও  নেই । পরিচ্ছন্ন মন্দির । প্রদীপ জ্বলছে,  লাল শাড়ি পরা শেরাওয়ালি মায়ের সামনে । ভারি শান্ত নিরালা স্নিগ্ধ । এবারে ডানদিকে ঘুরি, বাড়ির পথে । সূর্য দেব এখোনো চুল্লি ধরান  নি । 



ফুটপাথে গাছের তলায় টাটকা সবজি সাজাচ্ছে পুনম আন্টি । পুনম আন্টির পুরো শরীরটাই হাসে । নমস্তে টমস্তে  সারা হয় । সবজিগুলো দেখবার জন্য একবার দাঁড়াই । আমি জানি পছন্দ মতই সবজি আন্টির বউমার হাত দিয়ে আমার বাড়ি চলে যাবে । কাছেই মস্ত বড় গাড়ির বাজারে ওদের খাবারের ব্যাবসা ছিল । দু চারজন রোগা পটকা ছেলেও খাটত । কিন্তু এতো ঝক্কি কত্তা গিন্নি নিতে পারলেন না , তাই নিরিবিলি ছায়ায় বসে দুজনে সবজি বেচেন । সঙ্গে থাকে ফ্লাস্কে চা। বিস্কুট।  আন্টির হাতের রান্নার  জবাব নেই । লছমি মানে বউমার হাত দিয়ে আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে কিছু কিছু আসে । আমি একদিন বলেছিলাম এতো দোকানকে ফেল করিয়ে দেবে । তখনই লছমির কাছ থেকে ওদের পুরোনো কথা জানতে পারি ।
দেশি তোড়ি মানে ঝিঙে  দেখে একটু খুশি খুশি ।  দানা দানা করে পোস্ত, কাঁচালঙ্কা দিয়ে বাটা (শিলে বাটা, গীতাজির শিল আমার রান্নাঘরে প্রায় জবর দখল) ঝিঙে আলু পোস্ত । কতদিন খাইনি । এখানকার সবজি বাজারে দেশি তোড়ি বড্ড কম দেখা যায় । গরবা মে সংগ লাগিরে, লাগিরে ও মিত বিহরবা , আনন্দ ভইলবা , মেরে অঙ্গন বা ।। মাস্টারমশাই সেই কতকাল আগে শিখিয়েছিলেন । রাগ টোড়ি  । সক্কালবেলা পুনম আন্টির ঝিঙে কতো সুর মনে পড়িয়ে দিল ।   সরেস ঝিঙেকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি মহারাজের  হুঁকোর টিকেতে আগুন ধরেছে , গ্লাসে চা , সামনে তিন চারটে লোক, জমছে জুতোর পাহাড়, মহারাজের সারাদিনের কাজ , জুতো মেরামতি । সময় গড়াচ্ছে  গোলাপি শাড়ির আঁচল ধরে,  রঙ্গ  সারি গুলাবি চুনরিয়ারে, মোহে লাগে নজরিয়া সাঁবরিয়ারে।।। পেটানো রাজস্থানী শরীরে গুলাবি কোটা শাড়ি , মাথায় ইস্তিরির কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে টান টান হয়ে হাঁটছে বিমলা ।  এর কাটাকাটা নাক মুখ ছিপছিপে  আত্মবিশ্বাসী চেহারা দেখলে কেন জানিনা আমার মনে হয় হুড খোলা জিপে হাতে লাল হলুদ একগাছি সুতো বেঁধে  কোমরে রুপোর চাবি ঝমঝম, নাকছাবি ঝিকিয়ে বিমলা রুখু ধুলো উড়িয়ে ভোটের প্রচার করছে। ওর বর বয়সে তিনগুণ বড়ো  রামস্বরূপ ধোবির সঙ্গে বিমলাকে দেখলে তাই আমার ভারি বিরক্তি লাগে ।


বাড়ি ফিরে বাবা মায়ের সঙ্গে বসে শান্ত সকালে চা বিস্কুট খাই  ওরা ছবির মধ্যে হাসে । গ্রিল আর পর্দার ফাঁক দিয়ে তেরছা করে রোদ রঙ পাল্টায় । সময় আরো এগোয় ।
বাবার কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে মায়ের কথা
কুঞ্জোর ঠান্ডা জলের কাছে
দু হাত পাতে নীরবতা

গীতা জি ঘর মুছতে মুঝতে  দিনের এইসময় টাতে খুব গভীর কিছু দর্শনের কথা বলতে থাকে ।বাইরে কোকিলের ডাকে কান  ঝালাপালা  গীতাজি বলতে থাকে,  কতো রকম যে ইমতেহান নেয় ভগবান , আগে থেকে  কোশ্চেন পেপার কেউ জানতে পারে না ।আমি টিপ্পনি কেটে বলি রেজাল্ট কেমন হয় ?  ভালো হয়  ?
-- হাঁ হাঁ কিউ নহি ? কভি কভি আপ সোচ ভি নহি সকেঙ্গে । ইতনা আচ্ছা ।
গীতার সামাজিক অবস্থান , পয়সার টানাটানি , সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ বসে গভীর রাত অবধি পড়াশুনো এসব জানার আর ওইসব কথা শোনার পর আমার লজ্জায় ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে ।  
তারপর আর কি ?  অফিস যাবার জন্য দ্রুত তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে চেঁচিয়ে  গীতাকে বলতে  থাকি,   খিড়কিআঁআআ । মানে  জানালা বন্ধ করতে ভুলো  না কারণ তা না হলে বিকেলের ধুলো ঝড়ে আঁধি তে  পুরো বাড়ি জুড়ে আবিদা পরভিন হয়ে থাকবে।। আঁধি চলি তো নকশে  ,কাফে পা নহি মিলা ।। দিল জিসে মিল গয়া হো ,দুবারা নহি মিলা ।
বাইরে তখনো মন্দ মন্দ হাওয়া । আশ্চর্য । সুরজজির  চুলা তখনো ভালভাবে ধরে নি কিন্তু । এই পর্যন্ত একটা খোশমেজাজ বেশ ধরে রাখা গেছিল । কিন্তু যাত্রাপথের দু ধারে বৃক্ষরাজি ও পুষ্পরাজির অপরূপ রূপ লাবণ্য পুরো কিসসার মাত্রাটাই ঘুরিয়ে দিল । সে মায়াবী পথে সুপর্ণা অডিটরের  সঙ্গে রাজিয়া সুলতানের তেমন কোনো  তফাত  নেই । একেবারে হরিপদ কেরানির কেস!   আমার চোখে ঘোর লাগে  । মনে হল যেন সিরাজির ঘোর । আমি নিম চিতবন( ছাতিম)  পিপুল জারুল গুলমোহরের অমলতাসের  রঙে পাগল হয়ে যাচ্ছি , পুরো রাস্তা জুড়ে প্রাচীন নিম যেন ঝরোখার  আড়ালে দাঁড়িয়ে   ঘুঙ্গটের ফাঁক দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে বলছে বলছে,  সুলতান সুলতান  । সলামত রহে সুলতান ।  আকাশ দেখা যায় না কোনও কোনও জায়গায় । সবুজের চাঁদোয়া  ঢেকে দিয়েছে সূর্য । সারি সারি গাছ  যেন হাজার হাজার জনতা , বৃক্ষ ,  মহীরূহ ,তরু , প্রাচীন  , আমির গরিব ,সব্বাই আশীর্বাদ  করছে সুলতানকে
বনস্পতয়ঃ শান্তিঃ পৃথিবী শান্তিঃ


No comments:

Post a Comment