“ কাল
খান মার্কেট থেকে কী মিস্টি রঙের ওই বল টা
কিনলাম , পছন্দ হল না মেয়ের । শোনো , তোমার ছেলেকে দিয়ে দেবো । কিচ্ছু কিনব না ওর জন্য আর । “
“ ও তাই ? সে ও লুফে নেবে ,
যা হ্যাংলা “।
“ তোমার ছেলেকে ডাক্তার দেখালে ? অসুখটা সারছে না কিন্তু। স্পেশালিস্ট
দেখাও “।
“ হ্যাঁ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। ছুটিও নিচ্ছি কাল। সারাদিন ওর
পেছনেই যাবে “। অতসী চশমা মুছতে মুছতে
বলে ।
“ এদিকে কি হয়েছে জানো ? আয়াটা এত্ত পাজি , ভালো করে খাওয়াচ্ছেই না ।
আমি কোন টা সামলাবো বল তো । বাড়ি না অফিস? এদিকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে । মিড টার্ম
রিভিউ । বসের মুখ ভার । কোথায় যাই বলতো ?
“ নন্দিতা বোধহয় কেঁদেই ফেলবে ।
“ আমারো সেই হাল । কাকে আর বলছ? কলকাতার মাসি মণির তো মতিগতি বোঝাই দায় , এক
কাঁড়ি টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছি । এই তুমি রাঁচি থেকে একটা লোক আনবে বলছিলে ? তার কি
হল? তোমার মেয়েটা যা রোগা । ইশ , খুব যত্নের দরকার গো “।
“সত্যি, আমার না আজকাল আর কিচ্ছু ভালো লাগে না , উফ কবে যে একটা ঠিকমত
কাজের লোক পাবো ? তোমার রনি তো দিব্যি ভালো ছেলে । কুটুস টা
যদি একটু ভালো করে খাওয়া দাওয়া করত
! আবার এতো মা নেওটা না ? ঠিক বুঝতে পেরে
যায় আমি বেরুবো , ব্যাস শুরু হয়ে যাবে নাকি কান্না “।
ওপরের এই টুকরো টাকরা
কথাবার্তা দুই নারীর। দুই কর্মরতা নারীর । এদের দুজনেরি বদলির চাকরি । তাদের বরেরা
কেউই কোনরকম হ্যাপা পোহানোর জন্য দৃশ্যমানতার
মধ্যে নেই অর্থাৎ তাদের কর্মস্থল আলাদা
আলাদা । এই দুই নারী নিজের বাড়ি থেকে বহুদূর । ঊনকোটি পঞ্চাশ ঝামেলা নিয়ে তারা কালাতিপাত করে ।
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিঃশ্বাস । ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর দেহ এবং মন । তবু তারই
মধ্যে দুজনে একসঙ্গে বসে কোনো একজনের ঘরে
বসে লাঞ্চ খায় । আনে ঝিঙে পোস্ত , সরোজিনী নগর থেকে বেছে বুছে কিনে আনা চুনো মাছের
ঝাল , প্রচুর ধনে পাতা দেওয়া লাউ ঘন্ট , ছেঁচকি , আমের টক । শেষ পাতে পায়েস । পায়েস না থাকলে তারা বাটার স্কচ আইসক্রিম আনিয়ে খায় । এখানে মিস্টি খেয়েও সুখ
নেই । দূর দূর , খেতেও শেখে নি ভালো
করে । আইস ক্রিম খেতে খেতেই আবার
তারা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে দুঃখের পাঁচালি শুরু করে । চারপাশের লোকজনের
পাষাণ হৃদয় বেয়াক্কেলে হাবভাব বা অদ্ভুত হাস্যকর আচরণ তাদের ঘনঘন শিহরিত করে । কি করে মানুষ এমন ধারা হয়? এইসব ভেবে টেবে
আইস ক্রিম শেষ হলে পরে দু কাপ দার্জিলিং
চা খেয়ে তারা নিজের নিজের ঘরে চালান হয়ে যায় ।
আবার পরের দিন দইমাছ , কালোজিরে দিয়ে চচ্চড়ি , এঁচোড়ের ডালনা , সুজির
পায়েস । আবার রনি আর কুটুসের গল্প ।রনি আর কুটুস । কুটুস আর রনি । একই চাকা ঘুরে ঘুরে চলে । কুটুসের চোখ ছলছল , তো
রনির বাঁদরামি । হোয়াটস অ্যাপে ছবি বদল । কখনো রনি ডিগবাজি খাচ্ছে, কখনো কুটুসের
গলা জড়িয়ে নন্দিতা হামি খাচ্ছে ।
আমিও এই দলে আছি বটে । তবে খানিকটা গ্রিন রুমের মধ্যে । খাওয়া দাওয়াও করি বটে । তবে খুব একটা পারটিসিপেট করতে পারিনা । মানে ওই রনি কুটুসের গপ্পে আমার কিছুই অবদান থাকে
না । নন্দিতা এবং অতসী দুজনেই মাতৃত্বের কর্তব্যে হিমশিম । এই জায়গাটা
তো তাদের নিজের জায়গা নয় । প্রতিদিন ই নতুন নতুন ঝামেলা লেগেই আছে । ছেলেপুলেরা তো
মায়ের সঙ্গেই থাকবে । সেটাই স্বাভাবিক । এরই মধ্যে আজ বেসিনের কল দিয়ে জল পড়ছে না
তো কাল রান্নাঘর ভেসে গেলো , পাইপের গ্যাস সাপ্লাই দুম করে বন্ধ হয়ে গেলো ,অত
সাধের ট্যাঙরা মাছ গুলো আয়াদিদি এক কাঁড়ি
জল দিয়ে ফুটিয়ে ঘন্ট পাকিয়ে দিল । এদিকে কুনাল দর্জি কিছুতেই কামিজের
গলা ঠিক করে বানাতে পারে না । এখন নতুন
দর্জি পাই কোথায় ? সমস্যা কি একটা । তার
মধ্যে সব কটা লোক চূড়ান্ত বিরক্তিকর । ড্রাইভারটার প্রত্যেকটা ছুটির দিনে বিয়ে বাড়ি
থাকে । বিশ্বাস হয় ? প্যাট্রিয়ারকি, প্যাট্রিয়ারকি
ঘোরতর পিতৃ তন্ত্র । আমরা ছেলে হলে
পারতিস এই ত্যাঁদড়ামি গুলো করতে ? বাচ্চাগুলোকে ছুটির দিন লোধি গার্ডেনে একটু
বেড়াতে নিয়ে যাবো , তার উপায় নেই ।
কুটুস একটু লাজুক লাজুক। মুখচোরা । মানে ইন্ট্রোভারট আর কি । আমি দু
একবার ওকে বাড়ির সামনের পার্কে আয়ার সঙ্গে
দেখেছি । একটু মিনমিনে টাইপ । সে তুলনায়
রনি তো দামাল বিচ্ছু । এই সোফায় উঠছে , এই মেঝেতে গড়াচ্ছে , এই ধুম করে পড়ে গেলো । এইসব লেগেই আছে । তারপর
কনভেন্টে পড়েছে , কেতা দুরস্ত ।
কুটুসের হল কি, ওই বদলির চাকরির ঝকমারিতে মাদার ল্যাঙ্গয়েজ স্কুল রয়ে
গেলো । এই বদলির ঝামেলার জন্যই নন্দিতা কুটুসের দাদা কাটুস কে মামাবাড়ি রেখে এসেছে ।
এছাড়া নন্দিতার আর কোন উপায় ছিল না ।
কলকাতায় বাবা আপিসে বেরিয়ে গেলে কে দেখবে কাটুসকে ? আবার দুটো বাচ্চার দায়িত্ব এই নতুন জায়গায় কি ভাবে নন্দিতা করবে ?একা একা ? অগত্যা মামাবাড়ি ।
এরই মধ্যে আবার ঢুকে পড়ে নতুন
নতুন জামা খেলনা , মোবাইলে দুষ্টুমির নানা ছবি দুই মা বসেবসে দেখে আর বেগুন ভরতায়
কলকাতা থেকে আনা রাঁধুনি মাসি কী আক্কেলে চিনি মিশিয়ে দিল বলে খুব অবাক হয়ে যায় । বাইরে
কার্নিশে দুটো পায়রা মজা দেখে আর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি গরমকে আরো তাতিয়ে দেয় জারুলের
বেগনি রঙ । ভেতরের ঠান্ডা ঘরে তখন রনি আর কুটুসের
কথা সাবানের ফেনার বুদবুদের মতো দুই মায়ের মনকে স্বপ্নাবিষ্ট করে রাখে । গালে
কপালে শাড়ির আঁচলে পিছলে পিছলে পড়ে সন্তান
স্নেহ ।
সেদিন নন্দিতা খুব ব্যাজার
মুখে আলুর দম খেতে খেতে বলল , কাটুসের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে । কত্তদিন ছেলেটাকে
দেখি না । অতসী বলল, একবার সময় করে দেখে
এসো। ফোন তো করছই রোজ ।
না গো , খুব মনে হচ্ছে ক’দিন ধরে । দেখেই আসি ।
এই গরমে যাবে? তোমার এতো কাজের চাপ ?ভুবনেশ্বরে এখন খুব গরম কিন্তু ।
না চলেই যাই । আজকেই ফ্লাইট বুক করে ফেলি ।পয়সা বেশি লাগলেও কিচ্ছু
করার নেই ।
পরের দিন আবার সেই ঘন্ট শাক ছেঁচকি বাটার স্কচ চা এবং রনি কুটুস
পালাগান শেষ হলে নন্দিতা বলল ‘আমি শনিবার
যাচ্ছি , রোববার ফিরে আসব । ছেলেটাকে জাস্ট দেখেই ফিরে আসব । আয়াটার হাতে কুটুসকে কি ভাবে
রেখে যাবো বেশিদিন ? কাজেই যাবো আর আসব । আর তুমি খবর নেবে কিন্তু, অতসী । তোমাকে কুটুস খুব পছন্দ করে ।
অতসী আশ্বস্ত করল , কোন
চিন্তা নেই । সাবধানে যেও । মারাত্মক গরম , জল টল বেশি করে খেও । চিন্তা করো না
একদম ।আমি তো রইলামই । চিকেন স্টু রেঁধে
দেবো ।
আমি সত্যিই ভাবি , কি রকম এই রকম ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এই মায়েদের জীবন !
চাকরি বদলি বাচ্চা তাদের হাজারো বায়না ,অসুখ । বর নামধারী সাপোর্ট সিস্টেম এখানে
নাগালের বাইরে । এইসব ভেবে ভারি বিমর্ষ মনে আমিও আমার ঘরে ফিরে আসি । আর ভাবি বাড়ির পেছনের বারান্দার জাল টা ঠিক করতে হবে ।
পায়রা ঢুকে পড়ছে যখন তখন ।
নন্দিতার ঝটিকা সফর শেষ হল । সোমবার
খাবার সময় আমি বললাম, এবার শান্তি তো ? দেখা হল ? ছেলে কী বলল ?
“ আরে আর বলিস না ? দেখামাত্রই দুড়দাড় করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল । আর সে কি
আদর !” নন্দিতার চোখ চিক চিক , গলায় খুশির
জল তরঙ্গ ।
চলে আসার সময় কি করলি? কাঁদল না ?
লুকিয়ে এসেছি , বলতে পারিস পালিয়ে এসেছি । ল্যাংচা নিয়ে গেছিলাম।
কাটুস খুব ভালবাসে । তোদের জন্যও ছানাপোড়া এনেছি ।
ছানাপোড়া প্লেটে তুলতে তুলতে নন্দিতা বলল , ওদের মায়ের সঙ্গেও দেখা হল । ওই যে, তুই যে বাড়িটায় থাকতিস তার পাশের এক আই পি এস এর বাড়িতে থাকে । বাড়িতে কেউ ছিল না ,বুঝলি । আমি গেটের বাইরে থেকে ডাকলাম রকি রকি রকি । লক্ষ করলাম নন্দিতার আওয়াজ টা তার সপ্তকের নি সা, নি সা , নি সা র মতো শুনতে লাগলো ।
দৌড়ে এলো জানিস ? তারপর লনের মধ্যে লুটোপুটি , হুটোপুটি । আদর দেখাচ্ছিল আমাকে । কি খুশি !কি খুশি!
ততোক্ষণে ন ন্দিতার গলায় আমির
খান সাহেবের পাল্টা মাপাধনি , নিধাপামা ,ধামাপানি, নিপামাধা পামাধানি ।
তারপরই গলা মন্দ্রস্বরে নামিয়ে বলল , তবে যত্ন খুব একটা হয় বলে মনে হয়
না । ওই একটু সেফ থাকে , এই যা । মনোরঞ্জন তো আমাকে সবই জানায় । কাটুসকে তো ভালই দেখভাল করছে । সেবার কি ভাবে ওকে রেখে এলাম বল? ল্যাংচার মধ্যে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পাঁচশো কিলোমিটার
গাড়িতে করে...।
আমরা সবাই ছানাপোড়া শেষ করি ।
চা শেষ করি । আবার দেহ তুলে যে যার
ঘরে ফিরে যাই । সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি ভাবতে থাকি The more you know
people the more you love your dog ।
আর তখখুনি কাঁচের বাইরে
জারুলের ঘোর বেগনি রঙ আর পায়রা দুটো ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী পাখির মতো যেন বলে
উঠলো , আরে ও দুটো তো সামান্য কুকুর ,
গোটা বিশ্ব সংসার তালগোল পাকিয়ে যেত যদি ভালোবাসার এই নদীগুলো না থাকতো ! স্যালুট
!
Reglna Ezera ekjon latavian mohila lekhok, khub nami keu non. tar lekha ekta uponyas A man needs a Dog...er kotha mone pore gelo..sesher line gulo ei lekhatike ekta sonar tikli poriye diyeche "ও দুটো তো সামান্য কুকুর , গোটা বিশ্ব সংসার তালগোল পাকিয়ে যেত যদি ভালোবাসার এই নদীগুলো না থাকতো "
ReplyDeleteআমার কৃতজ্ঞতা
ReplyDeleteকি ভালো ছানাপোনাগুলো গো!আর তেমনি লেখা!ন্যাজ নাড়াটিও দেখা যাচ্ছে ।
ReplyDeletekumvomela......
Delete