Wednesday 17 May 2017

গল্প নয় কিন্তু

  কাল খান  মার্কেট থেকে কী মিস্টি রঙের ওই বল টা কিনলাম , পছন্দ হল না মেয়ের । শোনো , তোমার ছেলেকে দিয়ে দেবো ।  কিচ্ছু কিনব না ওর জন্য আর  । “
“ ও তাই ?  সে ও লুফে নেবে , যা হ্যাংলা “।
“ তোমার ছেলেকে ডাক্তার দেখালে ? অসুখটা সারছে না কিন্তু। স্পেশালিস্ট দেখাও “।
“ হ্যাঁ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। ছুটিও নিচ্ছি কাল। সারাদিন ওর পেছনেই যাবে “। অতসী   চশমা মুছতে মুছতে বলে ।
“ এদিকে কি হয়েছে জানো ? আয়াটা এত্ত পাজি , ভালো করে খাওয়াচ্ছেই না । আমি কোন টা সামলাবো বল তো । বাড়ি না অফিস? এদিকে রিপোর্ট জমা দিতে হবে । মিড টার্ম রিভিউ ।  বসের মুখ ভার । কোথায় যাই বলতো ? “ নন্দিতা বোধহয় কেঁদেই ফেলবে ।
“ আমারো সেই হাল । কাকে আর বলছ?  কলকাতার মাসি মণির তো মতিগতি বোঝাই দায় , এক কাঁড়ি টাকা দিয়ে নিয়ে এসেছি । এই তুমি রাঁচি থেকে একটা লোক আনবে বলছিলে ? তার কি হল? তোমার মেয়েটা যা রোগা । ইশ , খুব যত্নের দরকার গো  “
“সত্যি, আমার না আজকাল আর কিচ্ছু ভালো লাগে না , উফ কবে যে একটা ঠিকমত কাজের লোক পাবো ? তোমার রনি তো দিব্যি ভালো ছেলে ।  কুটুস টা  যদি একটু  ভালো করে খাওয়া দাওয়া করত !  আবার এতো মা নেওটা না ? ঠিক বুঝতে পেরে যায় আমি বেরুবো , ব্যাস শুরু হয়ে যাবে নাকি  কান্না “।


ওপরের  এই টুকরো টাকরা কথাবার্তা দুই নারীর। দুই কর্মরতা নারীর । এদের দুজনেরি বদলির চাকরি । তাদের বরেরা  কেউই কোনরকম হ্যাপা পোহানোর জন্য দৃশ্যমানতার মধ্যে নেই  অর্থাৎ তাদের কর্মস্থল আলাদা আলাদা  । এই দুই নারী নিজের বাড়ি থেকে বহুদূর ।  ঊনকোটি পঞ্চাশ ঝামেলা নিয়ে তারা কালাতিপাত করে । দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর নিঃশ্বাস । ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর দেহ এবং মন । তবু তারই মধ্যে দুজনে একসঙ্গে বসে কোনো  একজনের ঘরে বসে  লাঞ্চ খায় ।  আনে ঝিঙে পোস্ত ,  সরোজিনী নগর থেকে বেছে বুছে কিনে আনা চুনো মাছের ঝাল , প্রচুর ধনে পাতা দেওয়া লাউ ঘন্ট , ছেঁচকি , আমের টক । শেষ পাতে পায়েস পায়েস না থাকলে  তারা বাটার স্কচ আইসক্রিম আনিয়ে  খায় ।  এখানে মিস্টি খেয়েও সুখ নেই  । দূর দূর , খেতেও শেখে নি ভালো করে  । আইস ক্রিম খেতে খেতেই আবার তারা  ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে  দুঃখের পাঁচালি শুরু করে । চারপাশের লোকজনের পাষাণ হৃদয় বেয়াক্কেলে হাবভাব বা অদ্ভুত হাস্যকর আচরণ তাদের ঘনঘন শিহরিত  করে । কি করে মানুষ এমন ধারা হয়? এইসব ভেবে টেবে  আইস ক্রিম শেষ হলে পরে দু কাপ দার্জিলিং চা খেয়ে তারা নিজের নিজের ঘরে চালান হয়ে যায় ।
আবার পরের দিন দইমাছ , কালোজিরে দিয়ে চচ্চড়ি , এঁচোড়ের ডালনা , সুজির পায়েস । আবার রনি আর কুটুসের গল্প ।রনি আর কুটুস । কুটুস আর রনি । একই  চাকা ঘুরে ঘুরে চলে । কুটুসের চোখ ছলছল , তো রনির বাঁদরামি । হোয়াটস অ্যাপে ছবি বদল । কখনো রনি ডিগবাজি খাচ্ছে, কখনো কুটুসের গলা জড়িয়ে নন্দিতা হামি খাচ্ছে ।



আমিও এই দলে আছি বটে । তবে খানিকটা গ্রিন রুমের মধ্যে ।  খাওয়া দাওয়াও করি  বটে তবে খুব একটা  পারটিসিপেট করতে পারিনা । মানে ওই রনি কুটুসের গপ্পে আমার কিছুই অবদান থাকে না । নন্দিতা  এবং অতসী  দুজনেই মাতৃত্বের কর্তব্যে হিমশিম । এই জায়গাটা তো তাদের নিজের জায়গা নয় । প্রতিদিন ই নতুন নতুন ঝামেলা লেগেই আছে । ছেলেপুলেরা তো মায়ের সঙ্গেই থাকবে । সেটাই স্বাভাবিক । এরই মধ্যে আজ বেসিনের কল দিয়ে জল পড়ছে না তো কাল রান্নাঘর ভেসে গেলো , পাইপের গ্যাস সাপ্লাই দুম করে বন্ধ হয়ে গেলো ,অত সাধের ট্যাঙরা মাছ গুলো  আয়াদিদি এক কাঁড়ি জল দিয়ে ফুটিয়ে ঘন্ট পাকিয়ে দিল এদিকে কুনাল দর্জি কিছুতেই  কামিজের  গলা ঠিক করে বানাতে পারে না । এখন নতুন দর্জি পাই কোথায় ? সমস্যা কি একটা ।  তার মধ্যে সব কটা লোক চূড়ান্ত  বিরক্তিকর । ড্রাইভারটার প্রত্যেকটা ছুটির দিনে বিয়ে বাড়ি থাকে । বিশ্বাস হয় ? প্যাট্রিয়ারকি,  প্যাট্রিয়ারকি  ঘোরতর পিতৃ তন্ত্র । আমরা ছেলে  হলে পারতিস এই ত্যাঁদড়ামি গুলো করতে ? বাচ্চাগুলোকে ছুটির দিন লোধি গার্ডেনে একটু বেড়াতে নিয়ে যাবো , তার উপায় নেই । 
কুটুস একটু লাজুক লাজুক। মুখচোরা । মানে ইন্ট্রোভারট আর কি । আমি দু একবার ওকে  বাড়ির সামনের পার্কে আয়ার সঙ্গে দেখেছি । একটু মিনমিনে টাইপ ।  সে তুলনায় রনি তো দামাল বিচ্ছু । এই সোফায় উঠছে , এই মেঝেতে গড়াচ্ছে , এই  ধুম করে পড়ে গেলো । এইসব লেগেই আছে । তারপর কনভেন্টে পড়েছে , কেতা দুরস্ত ।
কুটুসের হল কি, ওই বদলির চাকরির ঝকমারিতে মাদার ল্যাঙ্গয়েজ স্কুল রয়ে গেলো । এই বদলির ঝামেলার জন্যই   নন্দিতা  কুটুসের দাদা কাটুস কে মামাবাড়ি রেখে এসেছে । এছাড়া নন্দিতার  আর কোন উপায় ছিল না । কলকাতায় বাবা আপিসে বেরিয়ে গেলে কে দেখবে কাটুসকে ? আবার দুটো  বাচ্চার দায়িত্ব  এই নতুন জায়গায় কি ভাবে নন্দিতা  করবে ?একা একা ?  অগত্যা মামাবাড়ি ।



এরই মধ্যে আবার  ঢুকে পড়ে নতুন নতুন জামা খেলনা , মোবাইলে দুষ্টুমির নানা ছবি দুই মা বসেবসে দেখে আর বেগুন ভরতায় কলকাতা থেকে আনা রাঁধুনি মাসি কী আক্কেলে  চিনি মিশিয়ে দিল বলে খুব অবাক হয়ে যায় । বাইরে কার্নিশে দুটো পায়রা মজা দেখে আর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি গরমকে আরো তাতিয়ে দেয় জারুলের বেগনি রঙ । ভেতরের ঠান্ডা ঘরে তখন রনি আর  কুটুসের কথা সাবানের ফেনার বুদবুদের মতো দুই মায়ের মনকে স্বপ্নাবিষ্ট করে রাখে । গালে কপালে শাড়ির আঁচলে  পিছলে পিছলে পড়ে সন্তান স্নেহ ।
সেদিন নন্দিতা  খুব ব্যাজার মুখে আলুর দম খেতে খেতে বলল , কাটুসের জন্য খুব মন খারাপ লাগছে । কত্তদিন ছেলেটাকে দেখি না । অতসী  বলল, একবার সময় করে দেখে এসো। ফোন তো করছই রোজ ।
না গো , খুব মনে হচ্ছে ক’দিন ধরে । দেখেই আসি ।
এই গরমে যাবে? তোমার এতো কাজের চাপ ?ভুবনেশ্বরে এখন খুব গরম কিন্তু ।
না চলেই যাই । আজকেই ফ্লাইট বুক করে ফেলি ।পয়সা বেশি লাগলেও কিচ্ছু করার নেই ।
পরের দিন আবার সেই ঘন্ট শাক ছেঁচকি বাটার স্কচ চা এবং রনি কুটুস পালাগান শেষ হলে নন্দিতা  বলল ‘আমি শনিবার যাচ্ছি , রোববার ফিরে আসব । ছেলেটাকে জাস্ট দেখেই ফিরে আসব । আয়াটার হাতে কুটুসকে   কি ভাবে রেখে যাবো বেশিদিন ? কাজেই যাবো আর আসব । আর তুমি খবর নেবে কিন্তু, অতসী তোমাকে কুটুস খুব পছন্দ করে ।
অতসী  আশ্বস্ত করল , কোন চিন্তা নেই । সাবধানে যেও । মারাত্মক গরম , জল টল বেশি করে খেও । চিন্তা করো না একদম ।আমি তো রইলামই ।  চিকেন স্টু রেঁধে দেবো ।


আমি সত্যিই ভাবি , কি রকম এই রকম ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এই মায়েদের জীবন ! চাকরি বদলি বাচ্চা তাদের হাজারো বায়না ,অসুখ । বর নামধারী সাপোর্ট সিস্টেম এখানে নাগালের বাইরে । এইসব ভেবে ভারি বিমর্ষ   মনে আমিও আমার ঘরে ফিরে আসি । আর ভাবি  বাড়ির পেছনের বারান্দার জাল টা ঠিক করতে হবে । পায়রা ঢুকে পড়ছে যখন তখন ।
নন্দিতার  ঝটিকা সফর শেষ হল । সোমবার খাবার সময় আমি বললাম, এবার শান্তি তো ? দেখা হল ? ছেলে কী বলল ?
“ আরে আর বলিস না ? দেখামাত্রই দুড়দাড় করে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল । আর সে কি আদর !” নন্দিতার  চোখ চিক চিক , গলায় খুশির জল তরঙ্গ  
চলে আসার সময় কি করলি? কাঁদল না ?
লুকিয়ে এসেছি , বলতে পারিস পালিয়ে এসেছি । ল্যাংচা নিয়ে গেছিলাম। কাটুস খুব ভালবাসে । তোদের জন্যও ছানাপোড়া এনেছি ।
ছানাপোড়া প্লেটে তুলতে তুলতে নন্দিতা  বলল , ওদের মায়ের সঙ্গেও দেখা হল । ওই যে,  তুই যে বাড়িটায় থাকতিস তার পাশের  এক আই পি এস এর বাড়িতে  থাকে । বাড়িতে কেউ ছিল না ,বুঝলি আমি গেটের বাইরে থেকে ডাকলাম রকি রকি রকি   লক্ষ করলাম নন্দিতার  আওয়াজ টা তার সপ্তকের নি সা, নি সা , নি সা র  মতো শুনতে লাগলো ।
দৌড়ে এলো জানিস ? তারপর লনের মধ্যে লুটোপুটি , হুটোপুটি আদর দেখাচ্ছিল আমাকে ।  কি খুশি !কি খুশি!
ততোক্ষণে ন ন্দিতার  গলায় আমির খান সাহেবের পাল্টা মাপাধনি , নিধাপামা ,ধামাপানি, নিপামাধা পামাধানি
তারপরই গলা মন্দ্রস্বরে নামিয়ে বলল , তবে যত্ন খুব একটা হয় বলে মনে হয় না । ওই একটু সেফ থাকে , এই যা মনোরঞ্জন তো আমাকে সবই জানায় । কাটুসকে তো ভালই দেখভাল করছে ।  সেবার কি ভাবে ওকে রেখে এলাম  বল? ল্যাংচার মধ্যে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে পাঁচশো কিলোমিটার গাড়িতে করে...।  
আমরা সবাই ছানাপোড়া শেষ করি ।  চা শেষ করি ।  আবার দেহ তুলে যে যার ঘরে ফিরে যাই । সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমি  ভাবতে থাকি     The more you know people the more you love your dog

আর তখখুনি কাঁচের বাইরে  জারুলের ঘোর বেগনি রঙ আর পায়রা দুটো ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী পাখির মতো যেন বলে উঠলো , আরে ও দুটো তো  সামান্য কুকুর , গোটা বিশ্ব সংসার তালগোল পাকিয়ে যেত যদি ভালোবাসার এই নদীগুলো না থাকতো ! স্যালুট !




4 comments:

  1. Reglna Ezera ekjon latavian mohila lekhok, khub nami keu non. tar lekha ekta uponyas A man needs a Dog...er kotha mone pore gelo..sesher line gulo ei lekhatike ekta sonar tikli poriye diyeche "ও দুটো তো সামান্য কুকুর , গোটা বিশ্ব সংসার তালগোল পাকিয়ে যেত যদি ভালোবাসার এই নদীগুলো না থাকতো "

    ReplyDelete
  2. আমার কৃতজ্ঞতা

    ReplyDelete
  3. কি ভালো ছানাপোনাগুলো গো!আর তেমনি লেখা!ন্যাজ নাড়াটিও দেখা যাচ্ছে ।

    ReplyDelete