কোন খসে পড়া
তারা
মোর প্রাণে
এসে খুলে দিল আজ 
সুরের
অশ্রুধারা
গায়ের
রঙ ছিল একেবারে সাদা ফ্যাটফেটে । মনের মধ্যে ছিল জিলিপির  ঘোরতর  প্যাঁচ । অসম্ভব ধূর্ত , চিতার মতো ক্ষিপ্র ,
গোপন খবর চালাচালিতে তুখোড় , মনের মধ্যে নেই  মায়াদয়ার লেশ । তীক্ষ্ণ শকুনের মতো ।  এতো কঠিন  ধার্মিক যে লোকে বলতো জিন্দা পীর । ভাই , ভাইপো
দের একের পর এক খুন করে , কাউকে কয়েদবন্দী করে বিষ খাইয়ে বুড়ো বাপকে আগ্রা দুর্গে
বন্দী করে মসনদে বসে কট্টর পন্থা কায়েম করলেন তিনি । বিধর্মী কাফের বলে বড় ভাই এর
গলা টা কেটে বুড়ো বাপের কাছে পাঠিয়েও দিলেন সম্রাট । বড় বোন কেঁদে কেঁদে শামদানের
নিভু নিভু কাঁপা কাঁপা  আলোয় সেই ভ্রাতৃ
দ্রোহ আর নির্মমতার কাহিনি লিখে রাখলেন । যদিও দরবারের ওয়াকিয়া নবীশ রা খুঁটিনাটি
সবই লিখে রাখত । 
এক
সন্ন্যাসীকে একবার শাহজাহান জিজ্ঞেস করেছিলেন সন্তানদের কাছ থেকে তাঁর কোন বিপদ
আছে কি না । উত্তর এসেছিল সবচেয়ে ফর্সা যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে বিপজ্জনক । তখন থেকেই
বাবার স্নেহ টলে গেছিল । আওরংজেবের  বয়স
তখন মাত্র দশ । ছেলেকে  তিনি আড়ালে ডাকতেন
সাদা সাপ । 
আওরংজেব ফরমান
জারি করলেন যে তাঁর মুলুকে কোনরকম গান বাজনা , নৃত্য এইসব আমোদ প্রমোদ করা চলবে না
। যারা  সঙ্গীত সাধনা করে , গান বাজনা
যাদের পেশা সেইসব শিল্পীর দল মহা বিপদে পড়ল । দিন গুজরান আর হয় না ।
নবাব আমিরদের
মজলিশ জলসা আর সব ফুটানি বন্ধ ।  
 ইটালির পর্যটক নিকোলো মানুচ্চি অনেক গপ্পগাছা
লিখে গেছেন এই ব্যাপারে । তিনি লিখেছেন এমন ফরমান জারি হয়েছিল যে যদি কোনো বাড়ি
থেকে সামান্য গান বাজনা শোনা যায় সঙ্গে সঙ্গে কয়েদ , বেদম মার , এমনকি মেরেও ফেলা
হতে পারে । প্রচুর বাদ্যযন্ত্র এই সময় ভেঙে ফেলা হয়েছিল । গাইয়ে বাজিয়ের দল ঠিক
 করল তারা কোন না কোন ভাবে সম্রাটের কাছে বিক্ষোভ
জানাবে। 
এক জুম্মাবারে
সম্রাট মসজিদে যাবেন । তিনি দেখলেন প্রায় খান কুড়ি সুসজ্জিত কফিন বয়ে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছে । স্বাভাবিক ভাবেই তিনি একটু উৎসুক হলেন, সার সার শবদেহগুলো কাদের ? জানতে
চাওয়া হল কার ইন্তেকাল হল হে  ? গাইয়ে
বাজিয়ের দল ভাবল খুব একটা প্যাঁচে ফেলা গেছে । উত্তর এলো মৌসিকির , জাঁহাপনা  । মৌসিকির
 ইন্তেকাল হয়েছে । তাই কবর দিতে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছে । খুব ঠান্ডা গলায় আওরংজেব বলেছিলেন , আহা আহা ওনার আত্মার শান্তি কামনা করি
, ভালো করে গোর দিও, ভালো করে। কোন ফাঁক যেন না থাকে । 
যে পরিবারের
রক্তে  এতো রসবোধ , নাচ গান বাজনা , ছবি ,
স্থাপত্য বাগ বাগিচা , খানা পিনার এতো অপরূপ নকশা এতো   জমকালো
ঝঙ্কার , এতো মহার্ঘ শখ শৌখিনতা  প্রজন্মের
পর প্রজন্ম লালিত হয়েছে  , হঠাৎ  এমন বেতালা কেন হল , এমন বেসুরো কেন হল ? যে
পরিবারের নানান প্রেমগাথা কালজয়ী হয়ে আছে আর এনার মনে তাঁর এতোটুকু দোলাও লাগে
নি  কেন? 
লেগেছিল ।
তখন তিনি মধ্য
তিরিশ , একাধিক বিবাহ  , ছয় সন্তানের বাবা
। 
২
ভ্রূপল্লবে
ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে
বুরহানপুর ।
তাপ্তী নদী । দক্ষিণ ভারতের প্রবেশ দ্বার । তাপ্তীর ওপারে জাইনাবাদ । জাইনাবাদের
আহুখানায়( হরিণ পার্ক )  মাটির নিচে শুয়ে
আছেন আম্মিজান । মুমতাজ মহলকে প্রথমে এখানেই গোর দেওয়া হয়েছিল । আওরংজেব , দক্ষিণ
ভারতে অনেকদিন শাসন কাজ সামলেছেন । তিনি একবার বুরহানপুরে মাসির বাড়ি গেছিলেন ।
মেসোমশাই , বুরহানপুরের প্রদেশ কর্তা , গভর্নর । সইফ খান । বেজায় খিটকেল লোক ।
মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি, আওরঙ্গজেবও বেশ খোশ মেজাজে  মহলের ভেতরে ঢুকে পড়লেন । আড়াল আবডাল নিয়ে কেউ
বিশেষ মাথা ঘামালো না । উপরন্তু বদ মেজাজি সইফ খান আবার বাড়িতেও ছিল না । ঠিক সেই
সময়ে চন্দনের নয় , আম বাগানে ডান হাত দিয়ে একটা ডাল ধরে দুলতে দুলতে নিচু গলায়
গুনগুন করে গান গাইছিল হিরা বাঈ , হারেমে তাঁর নাম ছিল জাইনাবাদি । বেশ কম বয়সের
হিন্দু মেয়ে । ওই যে আকবর নিয়ম করেছিলেন হারেম সুন্দরীদের সঙ্গে তাদের জায়গার
পরিচয়ও জুড়ে দিতে হবে । আওরংজেব  সেই ভ্রূ
পল্লবের ডাকে আর হিরা বাঈ এর সুন্দর মুখ খানা, তার  কটাক্ষে  আর গানের সুরের বিদ্যুৎ ঝলকে একেবারে সটান
তড়িতাহত হয়ে মাটিতে দড়াম করে পড়ে মুচ্ছো গেলেন । মহলের ভেতরে খবর গেলো , মাসি তখন
দস্তরখান সাজাচ্ছিলেন রকাবদারদের দিয়ে , বোনপো বলে কথা । তিনি তো পড়িমরি করে দৌড়ে
এসে কান্না কাটি জুড়ে দিলেন । এতো সাধ করে কতো আয়োজন করেছেন । বেশ অনেক ক্ষণ পরে
আওরংজেবের হুঁশ ফিরে এলো ।  ততক্ষণে মাসি
নানা দরগায় মানত করে ফেলেছেন । মাসি জিজ্ঞেস করল , হ্যাঁ বাছা , তুমি কি  প্রায়ই এরকম মুচ্ছো যাও? 
“আমি যদি আমার
অসুখের কথা তোমাকে বলি, তুমি সারাতে পারবে তো ?”
“সে কি? কী যে
বলিস? আমার জান কুরবান”।
আওরংজেব বললেন
তিনি হিরা বাঈকে চান । মাসির মুখ দিয়ে আর আওয়াজ বেরোয় না । ভয়ে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে
মাসি বলে তোর মেসো তো এসে প্রথমে আমাকে কাটবে , তারপর জাইনাবাদিকে । আমার কথা ছেড়ে
দে, ও বেচারা কি দোষ করেছে বল যে বেঘোরে প্রাণ টা দেবে? 
শাহজাদা বললেন
ঠিক আছে , আমি অন্য রাস্তা দেখছি । সেই সময় দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খানকে ডেকে পাঠানো
হল ।অনুগত মুর্শিদ কুলি তখখুনি সইফ খানকে কচুকাটা করতে বেরিয়ে যায় আরকি । শাহজাদা
তাকে থামিয়ে বললেন, আমার মাসিজান বিধবা হবে তা  তো আমি চাই না । ভগবানের ওপর ভরসা রাখো , মেসোর
সঙ্গে কথা বল গিয়ে ।
সইফ খান খিটকেল
রগচটা হওয়া সত্ত্বেও  বললেন এ আর এমন কি
কথা ? শাহজাদাকে আমার সেলাম দিও । মোঘলহারেমের ছত্তর বাঈকে পাঠিয়ে   দাও আর
হিরাকে নিয়ে যাও । 
৩
প্রহর শেষের
আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে
দেখে ছিলাম আমার সর্বনাশ 
শাহজাদার সব
নিষ্ঠা সংযম চুলোয় গেলো । হিরাবাঈ জাহানাবাদি তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে চৈতি
বসন্তের আগুন ধরিয়ে দিল । হিরাবাঈ ছিল সুকন্ঠী । শাহজাদার প্রাণে
খুশির তুফান । জাইনাবাদ একটা ছোট্ট জায়গা । 
এতো সরু সরু রাস্তা যে পালকি বা ঘোড়া চলতে পারে না । হিরাবাঈ জাইনাবাদে
কখনো গেলে হয়তো পায়ে হেঁটে চলছেন , আওরংজেব ও ঘোড়া থেকে নেমে পড়তেন । পায়ে হেঁটে
চলতেন । একদিন   মদিরার পেয়ালা শাহজাদার দিকে  এগিয়ে দিল হিরা বাঈ  , আওরংজেব তার ধর্মীয় অনুশাসনে বাঁধা জীবনে  কখনও সুরা স্পর্শ করেন নি । কিন্তু হিরা বাঈ যদি
সে পেয়ালা এগিয়ে দেয়  তাহলে জেনেশুনে বিষ
টাই পান করে নি । তিনি হাত বাড়ালেন । ঠোঁটের সামনে ধরলেন , এবার চুমুক দেবেন । হিরাবাঈ
ছোঁ মেরে পেয়ালা সরিয়ে ফেলে দিয়ে বলল , আমি আপনার মোহব্বত পরীক্ষা করছিলাম । আপনার
ধর্ম নষ্ট  করা আমার উদ্দেশ্য নয়  । 
এই বিভোর প্রেমের
কথা শাহজাহানের কানেও পৌঁছেছিল। কিন্তু খুব দুর্ভাগ্য,  ফুলটি অকালে ঝরে গেলো , অনেকে বলেন শাহজাদার ছোট
বোন রোশেনারার নাকি এ ব্যাপারে হাত ছিল ।  ইতিহাসের কলঙ্কিত নায়কের শুকনো  চোখে জল এনে ফেলল ভালোবাসা । শামদানের নিভু নিভু
কাঁপা কাঁপা আলোয় জাহানারা লিখেছিলেন আওরংজেব অন্তত একজনকে ভালবেসেছিলেন ।
জাইনাবাদির জন্য অন্তত কিছুক্ষণ আওরংজেব বিশ্বজগত ভুলে থাকতে পারতেন। প্রেমের খেলা
করে সঙ্গীতের মাধ্যমে সে আওরংজেবের হৃদয়ের গোপন কক্ষে ঢুকতে পেরেছিল । “প্রেমময়ী
জাইনাবাদীকে আমি চিরকাল স্মরণ করব “
আওরঙ্গাবাদে জাইনাবাদিকে
 সমাধিস্থ করা হয় । আওরংজেব কাঁদলেন  তো বটেই, অসুস্থও হয়ে পড়লেন । বেরিয়ে পড়লেন শিকারে
। পারিষদরা সব বলল,  এ অবস্থায় কি না গেলেই
নয়?  শাহজাদা বললেন ঘরের মধ্যে হাহুতাশ
আমাকে শান্ত করতে পারবে না , একাকিত্বের মধ্যে যদি তাকে খুঁজে পাই । 
এরপর থেকেই
নাকি কট্টর পন্থা প্রবল ভাবে আওরংজেবকে চেপে ধরে । সমস্ত আমোদ প্রমোদ হাসি কলতানকে
গলা টিপে মেরে ফেলাই তার  কাজ হয়ে দাঁড়ালো
। প্রেমহীন শুষ্ক জীবন আশিক কে করে তুলল ইবলিশ ।
ছবিঃ শিরিন
শাহবা


