Sunday 10 July 2016

দিল্লি দাস্তান ৩


দাদি পোতি
দাদি আম্মা, কিসসা সুনাও না । ছোট্ট রুকবানু ঝাঁপিয়ে পড়ে দাদি আম্মার কোলে।
পশমিনা শালের গরম । রঙদার কার্পেট চারপায়ার ওপর  পেতে দাদি তখন গুরগুর করে তামাক টানছে , অম্বুরি তামাকের গন্ধ , দাদির চুলের মেহেন্দির গন্ধ মিলেমিশে সে একটা ভারি মিঠে আমেজ তৈরি করেছে , রুকবানুর খুব পছন্দ । দাদির নাকে হিরের নাকছাবি , সুর্মা টানা চোখে কিসসা ঝিকঝিক করছে ।  সামনে রাখা জর্দা পানের খোপকাটা রেকাবি । ফেলে আসা আফঘানিস্তানের গল্প , তার টলটলে নীল হ্রদ , তার ওপর নীল আকাশ , ঝকঝকে রোদ্দুর , জাফরান খেত , পাহাড়ের মাথায় বরফ ,পাখতুনি গান তারপর এদেশে চলে আসা । রুকবানুর দু’চোখের নীল তারায় তার ফেলে আসা দিনের ছবি দেখতে থাকেন দাদি আম্মা ।  তারপর কোথা থেকে কি হয়ে গেলো কেউ জানে না , কেউ না ।  শুধু আজ সকালে জমজমাট হৌজ খাসে রাস্তার বাঁকে হঠাৎ চোখে পড়ল শতাব্দীর পর শতাব্দী এক ঠাকুমা আর নাতনি পাশাপাশি শুয়ে সবুজ ঘাসে ঘাসে মিশে মিশে অনন্তকাল ধরে গল্প করে চলেছে । লোকজন ভিড়ভাট্টা গরম শীত বৃষ্টি শহরের ইতিহাসের কতো পালাবদল  তাদের আলাদা করতে পারে নি । সেই চকিতে দেখা নিরালা সবুজ ঘাসের দুপুর হঠাৎ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের মাথায় । ওয়েলিংটনের শনশনে বাতাসিয়া দুপুরে ওইরকমই এক নিরালা কোণে বসেছিল তিনজনে ঘন  হোয়ে, দাদু দিদুন আর নাতি । কতো লোক ক্যাফেটারিয়ায় মাছ ভাজা আর বিয়ার খাচ্ছিল, বাচ্চারা বল খেলছিল , সুগন্ধি গাছপালারা ছায়া দিচ্ছিল । আর ওরা নিজেদের মধ্যে খুনশুটি করছিল, সেবার ক্রিসমাসে কত্ত মজা হয়েছিল , বরফ জমা রাত, তারা ভরা রাত, বাতি জ্বলা রাত - Silent night, holy night!
All is calm, all is bright.
Round yon Virgin, Mother and Child.
Holy infant so tender and mild,
Sleep in heavenly peace,
Sleep in heavenly peace







এই দিল্লি শহরের আনাচে কানাচে পরতে পরতে দানা দানা আফসানা লুকিয়ে আছে ,তুলে নাও , কুড়িয়ে নাও , তুলোর বীজের মতো ,মেঘের মতো ,  পাখির পালকের মতো হাওয়ায় উড়ছে তারা । কোথাও বাসা বাঁধে না , কোথাও থিতু হয় না । “ছায়া দেয় , মায়া দেয় , দুঃখ দেয় , হারিয়ে যায় । স্বপ্নবীজ কাপাশের মতো রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় ছড়িয়ে পড়ে “ এক অদৃশ্য  স্বপ্নের চাদর মুড়ে আছে  শহরটাকে চারদিকে ব্যস্ততা , শোরগোল , হাঁকাহাঁকি , দর কষাকষি , নতুন উদ্ধত ইমারত , আধুনিক দুরস্ত মানুষ , গতিশীল যানবাহন ,ঝাঁ চকচকে জীবন,রাজনীতির কূট কচালি   এসবের মধ্যে আজও অমলতাসের হলুদ রঙা নিঝুম দুপুরে মেহেরাউলির রাস্তায় অথবা ঠিক সন্ধে নামার মুখে হজ খাস বা আজিম খান মকবারা ,  সফদারজং বা পুরানা কিল্লার আশেপাশে  ভুঁইফোড়ের মতো হাজির হবে এক উস্কোখুস্কো    দাস্তানগো । শ্যাওলাধরা গম্বুজের  গায়ে হেলান দিয়ে নিচে তুমুল শহরকে বিন্দুমাত্র  নজর না করে কুতুবমিনারেরে পেছনে ওই ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে চলবে





শোনো , একটা গল্প বলি । কোন এক কালে  একটা কবুতর ছিল, কুঁড়ের বাদশা ,খ্যাপাটে আর বুদ্ধু । না আছে আজকের চিন্তা , না গতকালের জন্য কোন আফসোস । হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, মেঘের সঙ্গে গল্প করে ।আর সন্ধে হলে কোন একটা উঁচু গাছের মগডালে চড়ে ঢলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ও বলত, মেঘের ওপাশ থেকে কেউ একজন আসবে তার জন্য, তাকে নিয়ে ও চাঁদের দেশে পাড়ি দেবে । বাকি পাখিরা এসব শুনে  ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতসময় এইরকমই  এলোমেলো ভাবে কেটে  যাচ্ছিল । কিন্তু একদিন হোলো কি , আমাদের এই পাখি একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেল ,তারপর কি হল জানো, চোখে চোখে দেখা হল ,বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল,রক্তের তেজ বেড়ে গেল, একে অন্যের নিঃশ্বাসে জড়িয়ে গেলোআর আমাদের এই আওয়ারা কবুতরের জীবনটাই কেমন  পালটে গেলো , রামধনুর সাতটা রঙ রাঙিয়ে দিল সেই পাগলাটাকে । আমাদের কবুতর নেশা জড়ানো আধবোজা চোখে নতুন সঙ্গীকে বলে কে তুমি সুন্দরী? যাকে দেখে আমি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলছি ।
আমি? আমি তো মেঘের ওপাশ থেকে এসেছি”।
“আচ্ছা বলতো, তোমার চোখের এই কাজল তুমি কোত্থেকে পেলে ? আমি যেন আগে কোথাও দেখেছি ।“
“সত্যি বলব? কাল চুরি করে এনেছি কালো মেঘের কাছ থেকে “।
“তুমি না , তুমি এক্কেবারে আমার মতো “।
“হি হি হি হি ,তোমার মতো ? কি যে বলো ? তুমি কোথাকার একটা পাগলাটে ছোকরা , উস্কোখুস্কো , চেহারা দেখেছ নিজের? এসো তো আমি ঠিক করে দি “।
এরপর দুজনায় একসঙ্গে থাকতে শুরু করে । বর্ষার টুপটাপ ঝরা জলে , ভরা শ্রাবনের ঘনঘটায়, বসন্তের রঙে , ঝরে পড়া পাতায়, সবসময় । সবচেয়ে উঁচু গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে নতুন স্বপ্ন দিয়ে এক ঘরন্দা বানানো হল । 
এরপর জানো কী হোলো? আমাদের সেই পাগলা পরিন্দা বিলকুল বদলে গেলো । এখন শুধুমাত্র নিজের স্বপ্ন নিয়েই মেতে থাকত না । আলসেমি কুঁড়েমি  কোথায় উধাও হল ।
একদিন খুব ঝড় বাদল শুরু হল । খুব শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছিল । সঙ্গী বলল “ তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল “।
 “হুম, বল না , আমি শুনছি”।
“এই রাগ করবে না বলো?আমি মেঘের ওপারে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছি , সেখানে আবার ফিরে যেতে হবে,জানো? আমি তো ওদেশের রাজকুমারী । ওখানে একদিন দম আটকে এলো , আমি তাই খোলা হাওয়ায় উড়ে চললাম । তারপর তোমার সঙ্গে দেখা আর তোমার বাউন্ডুলেপনায় কেমন জড়িয়ে ভেসে গেলাম । কিন্তু এখন আমাকে যেতেই হবে । এই , তুমি শুনছ তো?”
কিন্তু আমাদের বেচারা ভালোমানুষ কবুতর তার সঙ্গীর ডানার ওমের মধ্যে ততোক্ষণে ঘুমে ঢলে পড়েছে । গভীর রাতে সবচেয়ে বড় তুফান এলো , সেই সময়ের সবচেয়ে ভয়ানক তুফান, সব কিছু ভেসে গেলো ,  সব কিছু উজাড় হয়ে গেলো । সকাল বেলা তুফান থেমে সব শান্ত হয়ে  গেলো ।





আমাদের কবুতর ঘুম থেকে উঠে  চারদিক দেখল , কিন্তু সঙ্গীকে খুঁজে পেল না ,সব জায়গায় খুঁজে খুঁজে বেড়াল , কোথাও সে নেই । আর আমাদের সেই বিন্দাস পরিন্দা যে নিজেকে নিয়েই খুশি থাকত সবসময়, সে একদম ভেঙে পড়ল, ভেঙে ভেঙে একেবারে  চুরমার হয়ে যেতে লাগলো ।


  কবুতরের গল্প আসিফ খান দেহেলভি



Saturday 9 July 2016

দিল্লি দাস্তান ২


জামালি কামালি
ল্প পড়ার মতোই গল্প শুনতে ততোটাই আমোদ , একেবারে নেশার মতো   কাজেই  হেরিটেজ বৈঠক  শাম এ আওয়াধের  মৌতাত কাটতে না কাটতেই দাস্তানগো মানে গল্প বলিয়ে আসিফ ভাই কে ধরলাম , পরেরটা কবে হবে , হ্যাঁ ? আর এবারে  কি বলবে?  তা বলে যে উত্তরটা এলো সেটাও  আবার একেবারে  আশা করিনি
“রাত মে তা রোঁ কে ছাও মে ,জামালি কামালি ফরেস্ট মে ভূতো কি কহানিয়া “
রহস্য ছমছমিয়ে উঠল  জামালি কামালি নামটাতেই যেন জমকালো শিরশিরানি   ঘন হয়ে উঠছে  নিশুতি   রাত , জঙ্গল ঝোপঝাড় ,তারার সলমা চুমকির চাদর , ভূত  রা  ঘুর ঘুর করছে  কোনো রাতচরা পাখি মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে ।
দিল্লির খাঁজে খাঁজে কোনে কোনে গল্প ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে শুধু তুলে আনার অপেক্ষায়
এ ক শনিবার  মেহেরাউলির দিকে রওনা দিলাম গন্তব্য জামালি কামালি মসজিদ কোন গল্প বলা টলার বৈঠক  নেই,  স্রেফ নিজের কৌতূহল বেশ খানিকটা নাকাল হবার পর একটা ডাব ওয়ালা বলল তিন নম্বর ডাব ওয়ালা যেখানে বসেছে তার পাশের রাস্তা ধরে চলে যান এবারে ডাব ওয়ালা গোনার পালা ঢিবি করে রাখা আছে  ডাব তিন নম্বর সত্যি সত্যি পাওয়াও গেল পাশ দিয়ে একখানা মাটির রাস্তা ধুলো ধুলো সন্ধে হয়ে আসছে , হালকা মলিন আলো মেহেরাউলি আরকিওলজিক্যাল পার্ক আদতে একটা ঘেরা জঙ্গল নানান দিক থেকে ঢুকে পড়া যায় এই জঙ্গলের  মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে ইতিহাস বাওলি(step well) , মকবারা , মসজিদ , বুলন্দ ইমারতের খন্ডহর জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা গিয়ে দেখা পেলাম জামালি কামালির



চারদিকে লোকজন প্রায় নেই বললেই  চলে খুব শুনশান হয়ত সন্ধে নেমেছে বলেই মসজিদের লোহার গেট বন্ধ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি , জায়গাটা কেমন যেন ভুতুড়ে মতো লম্বা লম্বা গাছ ,ঝুপসি  ঝুপ্সি ছায়া , উঁচু নিচু ঢিবি , কোন লোকজন নেই, শব্দ নেই একটা  দুটো লোক দেখা যাচ্ছে ,তাদেরই   একজন কাছে  এসে বলল , মসজিদ তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে সাড়ে  পাঁচটার পর কেউ আর ঢোকে না
ঢোকা বারণ যেই না বলল বারণ , অমনি গন্ধটা সন্দেহজনক
“ কেন? কেন? “
“ঢুকলেই থাপ্পড় খেতে হবে
 “থাপ্পড় ?”
“ চুল ধরেও টানতে পারে যেটা কপালে আছে
 আমার বন্ধুবর(বন্ধু+ বর ) জয়ন্ত  বলল , সে একটা থাপ্পড় না হয় খেলামই
“একটা? একশটাও এসে পড়তে পারে ভেতরে ঢুকলেই একটা অদ্ভুত শিরশিরানি  টের পাবেন  ব্লাড প্রেশারের ফারাক টা বুঝতে পারবেন ওনারা এইসময় কেউ ঢুকলে বিরক্ত হন
“কারা ? জামালি কামালি ? “
“না না , ওনারা তো সুফি সাধক ছিলেন এই সব  জায়গায় আস্তানা গেড়ে বসে আছে জিন রা
সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল পাঁচিলের ওপাশ থেকে অন্ধকার কুঠরিগুলো থেকে কারা যেন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আর ভারি বিরক্ত হচ্ছে
আর দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানেই হয় না আবার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে খন্ডহরের ভেতর   দিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ি
পরিত্যক্ত ভাঙা  চোরা বাড়ি ঘর নিঝঝুম লোক জন নেই এমন জায়গায় জিনেরা বাস করে এই যেমন ধরুন  ফিরোজ শাহ কোটলা চোখ ধাঁধানো আলো তুমুল হট্টগোলের মধ্যে বল্লেবাজি ক্রিকেট সোফায়
 বসে  কফি চিপস খেতে খেতে সবাই দেখে, সেই কোটলার অন্যএক পোড়ো জংলা  প্রান্তে  সন্ধে নামার  আগে লোকজন  অন্ধকার সব আনাচ কানাচে বাতি জ্বালিয়ে জিনের কাছে মনের কথা জানাতে আসে চিঠি লিখে দরখাস্ত লিখে, প্লিজ লুক ইনটু দ্য ম্যাটার বলে দেওয়ালে সাঁটিয়ে দিয়ে আসে
আসিফ ভাই স্পিরিচুয়াল  তায় সুফি তার সঙ্গে এসব জায়গায় ঘুরলে অনেকেই নাকি  গোলাপের চন্দনের গন্ধ পায় অথচ ধারে কাছে কোন ধূপ বা সুগন্ধি নেই
তবে সেও নাকি বলে এইসব বৈঠকে লম্বাচুল ভালো করে বেঁধে আসতে হবে আর কোনো পারফিউম মাখা চলবে না কারণ ওই দুটোই জিনদের  খুব আকর্ষণ করে । মানুষের মধ্যে যেমন ভালমন্দ ,জিনদের মধ্যেও তাই । মন্দ জিনকে চটিয়ে লাভ কি !
কৌতূহল এমন মারাত্মক হয়ে উঠলো যে  আবার পরের দিন ঠিক দুপুর বেলা ভূতে মারে ঢ্যালা অর্থাৎ প্রচণ্ড ঝলসানো গরমে রোদ্দুরে গিয়ে দেখি মসজিদের গেট খোলা , তেতে পুড়ে ঝামা হয়ে আছে পাথরের চত্বর পা দেওয়া যাচ্ছে না চারদিক শান্ত , ভীষণ শান্ত । সন্ধের নিভে যাওয়া আলোয় যাকে দেখে গা ছমছম করে উঠেছিল সেই প্রশস্ত দালান আর  অপূর্ব নকশা তোলা বন্ধ দরজা গুলো যেন বলছে ,বসে দুদন্ড জিরিয়ে নাও বাপু ।


 জামালি ছিলেন এক সুফি সন্ত এবং কবি। কামালির পরিচয় নিয়ে ধন্দ আছে ।  পাগল বাবরালির চোখের মত এলোমেলো আকাশের নিচে জামালি  কামালি মসজিদ , মেহেরাউলির জঙ্গল ,বিস্তীর্ণ ধ্বংসস্তূপ,  প্রশস্ত   বাওলি  জুড়ে  শুধু  পড়ে আছে  স্তব্ধতা   অখণ্ড নীরবতা । এক সন্ত কবির প্রার্থনা।  সেখানে যার  কণ্ঠস্বর শোনা যায় তাতে কোন শব্দ নেই ,শুধু অনন্তের স্তবগান , যে শুনতে চায় সেই  কেবল শুনতে পায় আর কেউ নয়    

 চন্দন রঙের আলো বুকে নিয়ে যে
মানুষ একা হেঁটে যায়
তুমি তাকে ডেকেছ কখনও?
তার কাছে বৃষ্টি আছে । আছে
দিন বদলের গান ।
ডাকো, তাকে ডেকে নাও কাছে
রয়েছে আখর যত শুদ্ধতম স্পর্শ দিয়ে
শোনো...।


কবিতা রেহান কৌশিক 







দিল্লি দাস্তান ১


শাম এ আওয়াধ
মোঘল সাম্রাজ্যের  রাজধানী দিল্লির সঙ্গে আন বান শান শওকত খানা পিনা গানা শায়েরি মুশায়েরা মহফিলে পাল্লা দিতে পারত একটি মাত্র  প্রদেশ যেখানে মুর্গাকে জাফরান আর কস্তুরীর বড়ি খাওয়ানো হত জবাই করার আগে ,যাতে খাবার সময় প্রতি পরতে পরতে মেহক ছড়িয়ে পড়ে মুখের ভেতর । এতো স্রেফ খাওয়া  নয় এ হল দস্তুর , পেশকশ ,  এ এক শিল্প । সেই প্রদেশটি হল আওয়াধ বা অযোধ্যা । আওয়াধ ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে একটি প্রদেশ ।  প্রদেশ শাসন করতেন একজন নবাব বা গভর্নর ।
দিল্লি শহরে বড় রাস্তা ছোট রাস্তা মহল্লার নামের মধ্যে বেঁচে আছেন অনের সুলতান সম্রাট , যারা দিল্লির মসনদে বসে ছিলেন । হয়তো ইতিউতি আছেন কিছু দিল্লির প্রভাবশালী রাজপুরুষ। সুফি সন্ত নিজামুদ্দিনের নামও বুকে আগলে রেখেছে এ শহর ।তার নামে আছে রেল স্টেশন , আছে লোকালয় । কিন্তু এদের সবাইকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে দিল্লির বাসিন্দা  না হয়েও আজও ভীষণ ভাবে অস্তিত্বময় আওয়াধের দ্বিতীয় নবাব সফদরজং । মাত্র ছেচল্লিশ বছরের জীবন ছিল তার । কেন্দ্র রাজনীতি ও শাসনের  শিখরে উঠেছিলেন তিনি । সুবেদার হিশেবে নানান লড়াই যুদ্ধে সাফল্যের পর তার মাথায় উঠল ‘মীর এ আতশ” এর শিরোপা। সম্রাট মুহম্মদ শাহের আমলে পুরো শাসন ভার টাই তারই কব্জায় ছিল । কিন্তু এসবের মধ্যেও আওয়াধের উন্নতি ও শান্তি শৃঙ্খলা কখনোই ভুলে জান নি । একটা কথাই মাথায় থাকত তার তিনি আওয়াধের ।   দিল্লি মসনদের টালমাটাল ঝড়ো হাওয়ায় সফদরজং হলেন ওয়াজির উল মামলুক ই হিন্দুস্তান অর্থাৎ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী । তার ওই স্বল্প জীবন দেখেছে প্রচুর সাফল্য ও সম্মান । কিন্তু রাজনীতির কুহেলিকা জাল থেকে তিনিও বের হতে পারেন নি শেষপর্যন্ত আওয়াধেই ফিরে মারা যান আর তার সমাধি সৌধ গড়ে তোলে দিল্লি । আজ তার নামে রাস্তা , হাসপাতাল , সফদরজং এয়ারপোর্ট । সফদরজং  এনক্লেভ ,  সফদরজং টারমিনাস , এতোটা আর কারুর ক্ষেত্রেই দেখা যায় নি । শোনা যায় আওয়াধের এই দ্বিতীয় নবাব খুব উদার ছিলেন,পন্ডিত কবি শিল্পী , গরিব অনাথদের  সাহায্য করতেন দরাজ হাতে । আজ তার  সমাধি ক্ষেত্রে খোলা প্রাঙ্গনে আকাশের নিচে পড়ন্ত বিকেলে  সফদরজঙ্গের সমাধির পাশে শুরু হল  শাম এ আওয়াধ ।
এককথায় আধুনিক কথকতা । হিন্দি উর্দু মেশানো ভাষায় কথক আমাদের নিয়ে চল্লেন আওয়াধ এবং লখনউ এর ইতিহাসে, হাভেলিতে, অলিন্দে অলিন্দে । অনুষ্ঠান শুরু হল লখনভি কেতায় । হাতে হাতে ঘসে দেওয়া হল খসখসের ইত্বর ,  তারপর এলো রুপুলি তবকে মোড়া  ভাজা ইলাইচি- নোশ ফরমাইয়ে। ঠান্ডা ভেজা মটকায় ছোট্ট ছোট্ট পানের খিলি,মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় ,আবার –নোশ ফরমাইয়ে । খসখস মেশানো সোঁদা গন্ধ মাখা হাওয়া আর কথকের ধারা কাহিনি তে  ভেসে এল কখনো যুদ্ধের দামামা,রাজনীতির কুটিল চক্রান্ত , দেহলভি আর লখনভি কেতার মজাদার কিসসা, শের শায়েরি মুশায়েরার চমকদার লখনউ , তার জাঁক জমক , পায়রা মুরগি তিতিরের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো ,দস্তরখান বা খানা পিনার তাজ্জব করা গল্প , ভিস্তি ওলা র রাস্তায়  কেওড়া, ইত্তর,  গুলাব মেশানো জল ছিটানো , মিঠি বোলি আর তমিজ ,এতোটাই কেতা দুরস্ত ছিল  সেকালের চাল চলন ।


রাফতা রাফতা হর পুলিশ ওয়ালে কো শায়ের কর  দিয়া
মেহফিল এ শের ও সুখান মে ভেজ কর সরকার নে 
এক কয়েদি সুবাহ কো ফাঁসি লগা কর মর গয়া
রাত ভর গজলে সুনাই উসকো থানেদার নে ।

সাগর খইয়ামি সাহাবের এই কবিতাই বলে দিচ্ছে কি বিপজ্জনক ছিল সেকালের আওয়াধ বা লখনউ । মুশায়েরা তে পুলিশদের ডিউটি লাগানো হত । সারারাত ধরে শের শায়েরি শুনে সকালবেলায় লাল চোখ নিয়ে কোতোয়ালিতে গিয়ে সে ব্যাটার তখন বদ হজম  হয়ে নানান কিসিমের  শায়েরি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে । কাকে  সে শোনাবে ? কয়েদি গুলো ছাড়া আর তো কেউ নেই সামনে  । কানের কাছে নানান সুরে নামতা শোনায় একশ উড়ের মতো দিনের পর দিন থানেদারের গজল শুনে গলায় দড়ি ছাড়া কয়েদিদের  আর কোন গতি নেই ।   
লখনউ এর আগে আওয়াধের নয়নমণি ছিল ফইজাবাদ । গঙ্গা যমুনি তেহজিবের প্রাণকেন্দ্র । নবাব সুজাউদৌল্লার আমলে তার কী  সাজ সজাওট আর রৌনক  । শহর তো চার ক্রোশ দূর, ফটক থেকেই তার চমচমাহট শুরু হয়ে যেত । রঙ্গিলা বেফিকর জীবন । জলসা , মুজরা , মেহফিল । খেল তামাশা । এরপর ফইজাবাদের জলুস কমে গেলো কারণ ততদিনে আসফ উদ দৌলা লখনউতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন । সন ১৭৭৫ । শুরু হল লখনভি  দাস্তান । মৌসিকি আর ফনকারের দলের মৌতান  শহর মাতিয়ে দিল  । দরিয়া কিনারে নবাব আর মোসাহেবের ঘুরে বেড়ান , নবাব দেখেন হায়দরি সাহেব মাথা নিচু করে হাঁটছেন । বড় ভালো গান করেন , নবাব বললেন , আমাকে গান শোনান । হায়দর সাহেব বলেন , আমি তো আপনার বাড়ি চিনি না । আমি যেতে পারি  তবে হালুয়া পুরি খাওয়াবেন তো ?প্রাসাদে ঢুকে  হায়দর  মিয়াঁ বুঝতে পারলেন আরে এতো নবাবের বাড়ি । হালুয়া পুরি তো খেলেনই , আবার বিবির জন্য ছাঁদা বেঁধে নিয়ে গেলেন । নবাবি মর্জি । গানা শুনে খুশ । এরপর ফরমায়েশ এলো , নবাবকে কাঁদাতে হবে , নাহলে উস্তাদ কে দরিয়ার পানিতে ডুবিয়ে দেবো । যাক সে যাত্রা হায়দরি প্রাণে বেঁচে গেছিলেন ।
আর ছিল দাস্তানগোই । গলপ বলা ।  দিল্লিতেও দাস্তানগোই ছিল । তবে সিধা সাদা । লখনউতে দাস্তান গোই ছিল শের শায়েরিতে ভরপুর । দাস্তান । ম্যায়খানা । হুক্কাখানা । আফসানা আর দাস্তানের মধ্যেই বুঁদ হয়ে থাকত সবাই । ছিল ভাঁড় , তাদের নৌ টঙ্কি । আর ছিল দস্তরখানের কেরামতি । বাবুর্চিখানা র মধ্যে ছিল নানান গ্রেড । নবাবি খানাপিনা মানে খাসা পেশ করা , দস্তরখান সাজানো বড় বাহাদুরির কাজ ছিল তখন । রকাবদার আর বাবুর্চি দের মেজাজ মর্জি ও ছিল তেমনি দেমাকি ফিনফিনে । দিল্লি আর লখনউ এর মধ্যে বেশ একটা পাল্লা দেবার ব্যাপার ছিল তখন বাদশা আর নবাবদের মধ্যে । মুর্গা কে খাওয়ানো হত জাফরান আর কস্তুরির গুলি, রান্না করার পর তার যা খোশবায় হত ! তবে লখনউ পছন্দ করত পুলাও ।  বিরিয়ানি ছিল বদনুমা খানা । লখনভি খানায় ইরানি প্রভাব বেশি ছিল । মশল্লার সুচতুর ব্যাবহার ।  যাকে বলে খানদানি রইস । সঙ্গে বাখরখানি রোটি মোতি পুলাও । নবরতন পুলাও । আনারদানা পুলাও । ভাতের দানা অর্ধেক লাল , অর্ধেক শাদা । খাবার পেশকশ ও সেই রকম । রেকাব এগিয়ে দেবার সময় সমানেই বলা হত তসলিম , তসলিম , আদাব আদাব । যতটা খাওয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগই আদব কায়দায় চলে যেত  । কোথায় জানি একবার পড়ে ছিলাম, নবাব তার খাস নফরকে নিয়ে দাওয়াতে গেছেন । নিমন্ত্রণ কর্তা সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন । এমন সময় তার খাস বান্দা মিহিসুরে গেয়ে উঠলো ফুলের তলে বুলবুল ছানা ,তারে উড়িয়ে দেনা উড়িয়ে দে না । এই কথা কানে যাওয়া মাত্র সেই কর্তা তার দাড়ির মধ্যে আটকে থাকা  সরু লম্বা ভাতের দানাটি ঝেড়ে ফেলে দিলেন । এদিকে আমাদের এই নবাবের ব্যাপারটা খুব মনে ধরে গেলো । তিনিও একদিন সবাইকে দাওয়াতে ডাকলেন । নফরকে বললেন শোন , সেদিন অমুক মিয়াঁ র  বাড়িতে দেখেছিলি না ওনার নফর কেমন কায়দা করছিল? তুইও ওরকম করবি , কেমন? যথাসময়ে আমাদের এই নবাব তার দাড়ির মধ্যে একটা ভাত ফেলে দিয়ে তার নফরকে ইশারা করে কেরামতি দেখাতে বললেন । আর সেই নফর তখন বলে উঠল, সেই যে কাদের বাড়িতে কিসের না কিসের কথা হয়েছিল না? আপনার দাড়িতে তাই হয়েছে ।


রইসি আরো ধরা পড়ত পানদানের আকারের ওপর । যতবড় পানদান তত বেশি রইসি । বিশেষ করে মেয়ের বিয়ের সময় বিরাট বিরাট পানদান দিয়ে পাঠানো হত । চার কাহার ডোলি সাজিয়ে যখন দুলহনকে শশুরাল ছাড়তে যেত , দেখা যেত , পালকির মধ্যে এককোণে গুটিসুটি মেরে ছোট্ট বউ বসে আছে। পুরো পালকিই জুড়ে রাজত্ব করছে বিশাল পানদান ।  জলে ভেজানো  মাটির পাতলা পাতলা ভাঁড়ে পান ঠান্ডা করে রাখা হত ।
এইছিল সেকালের মিঠে পানপাতার মতো গপ্প গাছা । চলতেই থাকে , ফুরোয় আর না । এই অঞ্চলেই গঙ্গা যমুনি তেহজিবের কেন্দ্র ছিল । তেহজিব মানে এটিকেট অযোধ্যার নবাবরা এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । হিন্দু মুসলমান যৌথ ভাবে এই  তেহজিব মেনে চলত ।  বেনারস আর মথুরার ব্রাহ্মণরা সরকার বাহাদুরের পতনের পর একবছর কোন তেওহার পালন করেনি ।  
গল্প জমে উঠেছে । দেখি  আমাদের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কেমন জোনাকি জ্বলে ওঠে , ইতিহাস কেমন ফিসফিসিয়ে ওঠে, নানান দিলচস্পি কিসসা কহানির মধ্যে  আসর জমে উঠছে আজ  আওয়াধের  “মীর এ আতশ” সবার অগোচরে  তার খুশির রোশনাই জ্বালিয়ে দেবেন, যদিও আমরা কেউ দেখতে তা  পাব না ।


সফদরজঙ্গের সমাধি
কাহিনি সূত্রঃ আসিফ খান দেহেলভি