চিত্রা
ঘোষের নিজস্ব কিছু স্টাইল স্টেটমেন্ট ছিল । তবে স্টাইলিশ মহিলা বলতে যে ছবিটা
আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিত্রা কিন্তু তার থেকে শত যোজন দূরে ছিলেন।
বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের যেমন সিগনেচার মার্ক থাকে যেমন গান্ধিজির গোল চশমা , রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা ,ফিদা হোসেনের খালি পা , ঊষা উথথুপের কপালে ক তেমনি চিত্রা
ঘোষও সারাজীবন ধরে তার কতগুলো
স্টাইল ধরে রেখেছিলেন। সিমি গারেওয়াল কে তিনি জানতেন কিনা জানা নেই তবে সারাজীবন তার শাড়ির রঙ ছিল সাদা , সঙ্গে সরু পাড় । ওটা
মাস্ট । তা নাহলে সে শাড়ি তিনি পরবেনই না। শাড়ি থাকত ভাঁজহীন টানটান ,পাট পাট গুছিয়ে পরা। প্রসাধন বা বিলাসিতার বালাই ছিল না। মাথায় ঠাসা কাঁচা
পাকা চুল দিয়ে তিনি একটা গোল খোঁপা করতেন । গয়না গাটি প্রায় পরতেন না বললেই চলে।
মোটা ফ্রেমের চশমা । পায়ে পাতলা চটি,হাতে গোব্দা কালো ব্যাগ ,এই ছিলো তার চিরকালের সাজ । বিয়ে বাড়ি থেকে শ্রাদ্ধ বাড়ি,অফিস থেকে বন্ধুর বাড়ি,বাজার থেকে বেড়াতে যাওয়া
সর্বত্র তিনি একই রকম থাকতে পছন্দ করতেন । ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত তিনি হাতে ঘড়ি
পরে থাকতেন । দফায় দফায় নানা কাজ করতেন ঘড়ি ধরে।
তার
মধ্যে একটা প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন মানুষ কে নিয়ে তার নিরন্তর চিন্তা । চিন্তা না
বলে দুঃশ্চিন্তা প্রবাহ বললে ঠিক বলা হয়। এর মধ্যে পরমাত্মীয় ,আত্মীয়,অনাত্মীয় সবাই থাকতো । তিনি চিন্তা করতে
ভালবাসতেন। কেন এত অকারণ চিন্তা কর? এর উত্তরে সবসময় ই বলা
হত -কি আর করতে পারি আমি? সকলের ভালমন্দ চিন্তায় উচাটন হয়ে
থাকতো তার মন। আন্তরিক ভাবে । ভীষণ আন্তরিক ভাবে ।
অবসর
সময়ে তার আর একটা প্রধান কাজ ছিল বই পড়া। নানা পত্র পত্রিকা আর বই তার সব সময়ের
সঙ্গী ছিল। বই ছাড়া তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তার
কালো জাব্দা ব্যাগ টার মধ্যে থাকতো অনেক রকম মুখশুদ্ধি –আমলকী , যোয়ান , হজমি গুলি।
এটা একটা বড় আকর্ষণ ছিল কচিকাঁচাদের মধ্যে।
চিত্রা
ঘোষ কখনই খালি হাতে কারুর বাড়ি যেতেন না । ন মাস ছ মাসের সৌজন্য সাক্ষাৎ নয় । ঘনঘন
কোথাও গেলেও খালি হাতে কদাপি নয় । সামান্য হলেও তার হাতে কিছু না কিছু থাকবেই । তার পছন্দের মিস্টির দোকান গাঙ্গুরাম,ভীম নাগ বা দ্বারিক । জামাকাপড় উপহার দিতে হলে খাদির দোকান ।এর অন্যথা বড়
একটা দেখিনি । এটাই
ছিল তার দস্তুর । ফ্রিডম ফাইটার পেনশন নেবার জন্য আমাদের অফিসে আসতেন,সঙ্গে একটি নয় দুটি মিস্টির প্যাকেট নিয়ে, একটা আমার
আরেকটা আমার সহকর্মী বান্ধবীর । আগে বলেছি না চিত্রার আপন পর ভেদ টা বড় কম ছিল ।
বরিশালের
মেয়েদের এমনিতেই মধুরভাষিণী বলে কোনদিন সুখ্যাতি ছিল না।
চিত্রা ঘোষ তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে কি ছোটবেলায় আমি এই মহিলাকে একটু এড়িয়ে চলতাম । ওনার চাঁচাছোলা কথাগুলো আমার
বিশেষ পছন্দ ছিল না। বেশ অনেক দিন পর্যন্ত বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান হবার জন্য যে
আদর ও পুতুপুতু ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে চলত তাতে তিনি অনেক সময় মতামত দিয়ে থাকতেন।
আমাদের তিনি ভাল বাসতেন তো বটেই কিন্তু কোন আদিখ্যেতা বা দেখনধারি ভাব তার ধাতে
সইত না। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা ঘোষ কে দেখার ও বোঝার ধরন টাও ক্রমশ
বদলাতে থাকে।
তার
রাজনীতিবোধ ছিল প্রখর । খুব তীব্র ও তীক্ষ্ণ ভাবে তিনি তার রাজনৈতিক মতামত দিতেন ।
তার ওই সাদা ভাঁজ হীন শাড়িটার মতই ভানহীন ছিল তার চরিত্র
। রাজনীতিসচেতন ছিলেন কিন্তু ডিপ্লোম্যাসির ধার পাশ দিয়ে কোনদিন হাঁটেন নি ।
সাংসারিক
দায়দায়িত্ব পুরোদস্তুর পালন করেও চিত্রা কিন্তু সেভাবে সংসারী ছিলেন না। একটা বড়
ব্যাপ্তির মধ্যে যেন নিজেকে খুঁজে পেতে চাইতেন । বাড়াবাড়ি রকমের ভ্রমণ বিলাসী
ছিলেন । ভারতবর্ষের হেন জায়গা নেই যেখানে তার পদধূলি পড়েনি । বার্ধক্য এবং নড়বড়ে
শরীরও তার মনকে দমাতে পারে নি। শরীরের ওপর ভাঙচুর হয়েছে প্রচুর । সত্যি বলতে কি
তার এই অদম্য প্রাণশক্তি আমাদের তাজ্জব করে দিত । মাঝে মাঝে ওঁর সামনে নিজেদের খুব
ছোট বলে মনে হত।
ছোঁয়াছুঁয়ি
বাছবিচার নিয়ে মাথা খারাপ করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। পরিস্থিতি যেমন হত তিনি
তেমন মানিয়ে নিতেন।
তার
দুই পুত্র সন্তান মুক্তিস্বপ্ন আর বিপ্লবঅগ্নি কিশোর আর যুবক বয়সেই
অকালে বিদায় নিয়েছিল।
শোক
যে কতো সম্ভ্রান্ত,নিভৃত আর ব্যক্তিগত হতে পারে চিত্রার সুদীর্ঘ জীবন তার প্রমাণ । কোনদিন
তাদের প্রসঙ্গ ওঠেনি ,সবার সামনে কোনদিন চিত্রা চোখের জল
ফেলেন নি,সহানুভূতি নিতে চান নি কারুর । শুধু আমরা
জানতাম ও বাড়িতে ভাইফোঁটা
হয় না, চিত্রা কে কোথাও খেতে ডাকলে জেনে
নিতে হয় তিনি কীকী খান না কেন না ছেলেদের সব পছন্দের খাবার তিনি বর্জন করেছিলেন
।আর ও জানতাম চিত্রার বুকের মধ্যে একটা প্যাকেট থাকে ,তার মধ্যে দুই ছেলের ছবি-শুধু শোবার সময়
প্যাকেটটা বের করে
রাখেন।
অন্যায়ের
সঙ্গে আপোষ না করা আর অপ্রিয় সত্যভাষণ চিত্রার এই দুই সিগ্নেচার মার্ক নিয়ে প্রচুর
ঘটনা আছে ।
আমার পরিষ্কার মনে আছে ভি আই পি রোড দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে । চিত্রার সঙ্গে আছে তার ছোট মেয়ে
।উল্টোডাঙ্গার কাছে এসে চিত্রা দেখলেন একটা লরির ড্রাইভার পুলিশকে টাকা দিচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা বলে ওঠেন,আমি কিসু কমু । মেয়ে ধমক দেয়,
না কিছু বলবে না তুমি । যথারীতি ট্রাফিকজ্যামে
গাড়ির গতি কমলো, চিত্রা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে তার ঈষৎ ধারালো
সরু গলায় জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পুলিশ টাকে বলে ওঠেন ঘুষ নিচ্ছেন ? লজ্জা করে না আপনার?
বেয়াদ অ অ প...।
একবার
তার এক খুব ঘনিষ্ঠ জন তার মামার বাড়ি যাবে । চিত্রা তার মেয়েকে জানান, অমুকে মামার বাড়ি যাইতে চায়।
তা
বেশ তো যাবে ।
“কিন্তু তার মামা আছে কোন দিন শুনি নাই তো ,সত্য কথা
কইতাসে না”’
“তোমার অত জানার দরকার নেই । তুমি বলবে ,মামার বাড়ি
যাবে? তা বেশ তো ,ঘুরে এস। তারপর টাকা
দিয়ে বলবে মিস্টি কিনে নিয়ে যেতে ।তারপর আরও বলবে যে মামাদের যেন আমাদের
বাড়ি আসতে নেমন্তন্ন
করে ,কি মনে থাকবে তো?”
মেয়েকে
খুব একটা চটাতে চান না চিত্রা ।তারা তার মত কট্টরপন্থী নয়। তাকে বুঝতেও পারেনা ।
যথারীতি
চিত্রা টাকা দিলেন,
মেয়ে যা বলতে বলেছিল সব ই বললেন। এইবার যেই পর্দা সরিয়ে ঘনিষ্ঠটি ঘর
থেকে বেরুতে যাবে চিত্রা আর থাকতে না পেরে তার সেই ট্রেডমার্ক গলায় বলে ফেলেন,
তা
তোমার মামা আছে কোন দিন শুনি নাই তো !
চিত্রার
নন কনভেনশনাল চরিত্রের আর
একটা
মন্ত্র ছিল আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া ,বুকের
মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। সে কারণেই তার একমাত্র ভাইপোর স্কুলে নেতাগিরিতে ভাই
এর বউ যখন ভয়ানক শঙ্কিত ,চিত্রা রায় দেন “বাইরের পৃথিবী ডাকলে বাঁধিয়া রাখতে পারবা?”
একই
তাগিদে ছুটে গিয়েছিলেন মেধা পাটকরের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে ,শুধুমাত্র তাকে
সমর্থন জানাবার জন্য। খোলা আকশের নিচে বোল্ডারের ওপর ত্রিপল বিছিয়ে আন্দোলনকারীদের
সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন তিনি ।তখন তার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে।
চিত্রা
ঘোষের চেহারার মধ্যে নজরকাড়া কোন ব্যাপার ছিল না । আর পাঁচজন গড়পড়তা বাঙালি মেয়ের
মতই ছোটখাটো,মাজা রঙ , সামান্য ভারি শরীর । ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে
যাবার চেহারা।
কিন্তু
চিবুকে,ঠোঁটের রেখায় আর নাকের গড়নের মধ্যে ধরা
ছিল তার ব্যক্তিত্ব। একটা
চাপা তেজ ।
প্রায় এক খানা শতাব্দী জুড়ে তাঁর জীবন । আর সেই জীবনের পরতে পরতে কতো কিছু যে তিনি শিখিয়ে গেছেন ,কখন যে সেই আটপৌরে গেরস্থ জীবনটাকে অনায়াসে টপকে গেছেন তিনি হয়ত তা নিজেও
জানতেন না ।
বরিশালের
হেড মাস্টারের মেয়ে ছিলেন তিনি । খাঁটি স্বদেশী পরিবার । মেয়েরা ছোরা খেলত,পিকেটিং করত। চরকা কাটা হত । সারাদিনের কাজের
শেষে তার মা ,বাড়ির মেজবউ, বাড়ির
বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতেন।অশ্বিনী কুমার দত্ত,মুকুন্দ দাসের
মত স্বদেশপ্রেমীরা বাড়িতে আসতেন । বিয়েও হয়েছিল বরিশালে ।
পাত্রপক্ষ বড়লোক ,ব্যাবসায়ী । পাত্রটি স্বদেশী করত । অনুশীলন
সমিতি। জেল খাটা ও নজরবন্দী হওয়া ,ছদ্মবেশ পরে মাঝি সেজে নৌকো বাওয়া, সব রকম অভিজ্ঞতাই তার হয়েছিল।
যতদূর
জানা যায় বাপের বাড়িতে চিত্রা বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়েই ছিলেন। বিয়ের পর ঘরকন্না
সামলানোর দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়ে । রান্না বান্নায় অসাধারণ পারদর্শিতার সূচনা এই
সময়েই। অনেকটাই তার খাদ্যরসিক স্বামীর তত্ত্বাবধানে । এই ভাবেই দিন কাটছিল । বাপের
বাড়িতে চিত্রার যাওয়া মানেই এলাহি ব্যাপার । প্রচুর
উপহার । চকলেট ল্যাবেঞ্চুস । ছোটদের পোয়াবারো । হাতে পয়সাকড়ি থাকত অনেক ।
দেদার
বিলিয়েছেন । হৃদয় টা ছিল সোনা দিয়ে বাঁধানো
কিন্তু ঘাতক কখন যে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াবে তা তো তিনি বুঝতে পারেন নি ।
বন্যার
জলে খড়কুটোর মত ভেসে গেল পরিবার । এল দেশভাগ আর ছিন্নমূল হবার অভিশাপ । ব্যাবসা
উঠল লাটে । যে কঠিন বাস্তবটার সামনে স্বামী সন্তান নিয়ে চিত্রা দাঁড়ালেন তা হল
দারিদ্র। চিত্রার একমাত্র ছোটভাই বিস্মিত হয়েছিল যখন সে দেখে তার বড়লোক দিদি তাকে
বলছে হ্যাঁরে,
তোর কাছে দশ টাকা হবে?
টাকাটা
সে দিয়েছিল । আর সারা রাস্তা হেঁটে বাড়ি ফিরেছিল।
শুরু
হল আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। আলো দেবার জন্য প্রদীপ যেমন জ্বলে,গন্ধ দেবার জন্য ধূপ পোড়ে,মাটির সঙ্গে ঘসা খেয়ে যেমন
চাকা দৌড়োয় তেমনি ঘসা খেয়ে জ্বলে পুড়ে তৈরি হচ্ছিলেন চিত্রা, তৈরি করছিলেন আমাদের সামনে এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
ঘরের
বাইরে এলেন তিনি । খুব সাধারণ মানের একটি চাকরি পেলেন । সম্মানের সঙ্গে মাথা তুলে
বেঁচে থাকার প্রথম পদক্ষেপ । চার ছেলেমেয়ের মা তিনি । ম্যাট্রিক
পর্যন্ত পড়েছেন । অক্লান্ত পরিশ্রম তখন তার সঙ্গী । যতদিন
দিন গেছে শানিত হয়েছে তার ব্যক্তিত্ব,বলিষ্ঠ ও ঋজু হয়েছে তার
মেরুদণ্ড ।
বুঝেছিলেন ওই জায়গায় পড়ে থাকলে চলবে না। নিজের বড় মেয়ের সঙ্গে বি এ
পাশ করেন তিনি । ধীরে ধীরে চাকরিতে উন্নতি হয় । কর্তব্যনিষ্ঠায় সমীহ আদায় করেছেন
সহকর্মীদের ।
তার
সম্পূর্ণ জীবন টাই একটা শিক্ষা যার মর্ম একালের সিন্থেটিক মেয়েরা বুঝতেই পারবে না।
নারীবাদের
কোন ধ্বজা তুলে নয়,নারীত্বের শ্রেষ্ঠত্ব, তার শক্তি , প্রখর আত্মসম্মান,সাহস , তেজ,কর্তব্য নিষ্ঠা তার ছিল ষোলআনার উপর আঠার আনা ।
চিত্রা ঘোষ তাই অনন্য । চিত্রা ঘোষ আমার মেজ পিসি।
আমার মায়ের জীবনকথা… অবিকল। পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিল।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteএই ব্যক্তিত্বময়ীকে নমস্কার।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteবেশ ভালো লাগল। এরকম অনেক চিত্রা ঘোষকেই আমরা সকলেই হয়ত চিনি, যাঁরা সময়ের অমোঘ হাতছানিতে আমাদের জীবন থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ । আশা করব বাকি লেখা গুলো ও পড়বেন।
ReplyDeletebhalo laglo - tinni
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteধন্যবাদ , তিন্নি
ReplyDeleteকি অসম্ভব উষ্ণতা ।চিত্রা পিসি মনের মধ্যে থেকে গেলেন।
ReplyDeletethank you so much Anuradha
ReplyDeletethank you so much Anuradha
ReplyDelete