শিমলার সামারহিলে পাইন আর
দেওদার গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে গ্লেন ভ্যালি । তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে
পাহাড়ি ঝরনা । বেশ খাড়াই পথ বেয়ে গ্লেন ভ্যালি যেতে হয় ।
এই উপত্যকার নামেই একটা বাড়ির নাম । তার ৩২ নম্বর ঘরে জীবনের মূল্যবান দুটি বছর কাটিয়েছিলাম ।
ট্রেনিং এ র সময় যে বাড়িটায় সবাই থাকত
তার নাম ইয়ারোজ(Yarrows)। সারা গায়ে আভিজাত্যের আতর মেখে সে ছিল বাড়াবাড়ি
রকমের দেমাকি আর শৌখিন । তাকে দেখভাল
করতেই একপাল অপোগণ্ড লোকের সারাদিন কেটে যেত । সেটাই তাদের রুজিরুটি । সে
তুলনায় গ্লেন ছিল একেবারে বেখাপ্পা, দড়াম করে বেমক্কা উঠে দাঁড়িয়েছে। এটা নাকি
অ্যাকাডেমির গেস্ট হাউস । নতুন হয়েছে।
বনেদি ইয়ারোজের পাশে এমন একটা খাপছাড়া প্রোলেতারিয়েত বাড়ির প্ল্যান যারা করেছে তাদের যে এতটুকু
অ্যাস্থেটিক সেন্স নেই তা নিয়ে সিনিয়ররা খুব আলোচনা করতেন মনে আছে ।
আমাদের দল টা আয়তনে বেশ বড় । এতো লোকের জায়গা তো ইয়ারোজে হবে না । অতএব ছজনকে চলে যেতে হবে গ্লেনে । সেই থেকে ৩২ নম্বর হল আমাদের ডেরা । একটা
ঘরে দুজন ।
৩২ নম্বর গ্লেনে ইয়ারোজের ঠাটবাটের
বালাই ছিল না ,মোম দিয়ে মেঝেও পালিশ হত
না, ফায়ার প্লেসও ছিল না ।বাথরুমের দেওয়ালে আদুরে প্রিম রোজও লতিয়ে উঠত না। তাতে আমাদের
কিছু যায় আসত না । যা ছিল তাতেই আমাদের দিব্যি চলে যেত। বেশ ছিমছাম আরামদায়ক মনে হত সবকিছু ।
এই ঘরে এমাথা থেকে ও মাথা কাঁচের জানালা । জানলার ওপারে ছিল এক স্বপ্নরাজ্য । পাইনের জমাট
বন । দূরে হিমাচল ইউনিভারসিটি দেখা যেত । টয়ট্রেন হুইসল বাজিয়ে পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে
নামত ।
এই কাঁচের জানালার ওপারে প্রকৃতির কতো রকম আমোদপ্রমোদের কতো বিচিত্র খেলা আমরা
দেখেছি তা কয়েকটা শব্দ দিয়ে বলা যাবে না । চোখের সামনে একটা তীব্র নীল ক্যানভাসে
একের পর এক তুলির টান দিয়ে চলছেন তিনি তাঁর নিজের খেয়ালে । কখনো রঙের খেলা আর মায়াবী আলো বেগুনি,লাল,কমলা,গোলাপি, কখনো মেঘ পাহাড়ের গল্প,
কখনো বন আর বৃষ্টির মাতামাতি , কখনো ক্যানভাসে ওয়াশের কাজ, বা তুলির জোরালো টান ।
বাতাস বেয়ে বৃষ্টির সুবাস,দূরে কুহেলী পাহাড়ের সা রি । বৃষ্টি ধোওয়া আকাশজোড়া
রামধনু ,উপত্যকার গভীর থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠা মেঘ , ঝিরঝিরে সাদা তুলোর মত বরফ
পড়া ,আর রাতে পরিষ্কার আকাশে মস্ত বড় চাঁদ
যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে ,ঝকঝকে তারা, যেন কার গয়নার বাক্স উলটে সব হিরে জহরত
ছড়িয়ে পড়েছে । মনে আছে অনেক সময় আলো নিভিয়ে দিয়ে সেই সব দৃশ্য আমরা কাঁচের ওপার
দিয়ে সিনেমার মত দেখতাম ।
৩২ নম্বরের বাসিন্দাদের ঠিক দলছুট বলা না গেলেও তাদের পছন্দ অপছন্দর ব্যাপারটা
একটু জোরালো ছিল বৈকি । তারা একটা প্যারালাল
কিচেন চালাত ওই ঘরের মধ্যেই ।সবাই যখন ইয়ারোজের ডাইনিং হলে রবিবার দিন পন্ডিতজির হাতের রাজমা চাওল আলুগোবি আর আচার খেত , ৩২ নম্বরে হিটারে বানানো হত ভাত,মুসুরির ডাল সেদ্ধ, ডিম আলু সেদ্ধ , সঙ্গে
থাকতো ঝরনা ঘি,কাঁচা লঙ্কা। তার জন্য মাঝে মধ্যে কিছু রসিকতা ,কটু কাটব্য শুনতে হত ইয়ারোজের এলিটদের
কাছ থেকে । ৩২ নম্বর সে সব গায়ে মাখত না ।
৩২ নম্বর উপচে পড়ত বই , ছবি আর গানে । বাগানের মরসুমি ফুলের হামেশাই আনাগোনা
ছিল এই ঘরে । দেওয়াল জোড়া পোস্টারে সালভাদোর দালি থেকে যামিনী রায় সবাই হাজির ছিলেন।
৩২ নম্বরে রবীন্দ্রনাথের গান তো ছিলই
এছাড়াও রাতে ডিনারের পরে ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়ায় যখন গাছের পাতাগুলো
কাঁপত ,
তারাগুলো মিট মিট করত, পায়ের কাছে কম্বল টা গুটিসুটি পড়ে থাকত , ৩২ নম্বর
থেকে আবিদা পরভিন গেয়ে উঠতেন অ্যায়
দিলনশী তালাশ তেরে কুবকু নহি অথবা হর
তরন্নুম মে মিলি হ্যায় তেরি আওয়াজ মুঝে , কখনো বা ইয়ে ধুপ ছায়ো কা আলম রহা জুদাই না থি । আরো শোনা
যেত ফরিদা খানুম,মালিকা পুখরাজ আর তাহিরা
সইয়দ ,রেশমার গলা, মেহদি হাসানের রঞ্জিসি সহি ,গুলাম আলি আর জগজিত সিং । উও কাগজ কি কাস্তি উও বারিশ কে
পানি ।
৩২ নম্বরের দিল বড় দরাজ ছিল । সেখানে বাংলা লোকগীতির পাশেই বাজত মারাঠি নাট্যগীতি
আর আভংগ । ঢোলক বাজিয়ে পিঞ্জরেওয়ালি
মুনিয়ার থেকে সুর অনায়াসে চলে যেত ক্লেডারম্যানের পিয়ানোয় , মোৎজারট, বিঠোফেন
বাখের সিম্ফনিতে । বিটলস , বেলাফন্টে,জন ডেনভার ,কারপেন্টার সলিল
চৌধুরী, ,শচিন কত্তা এখনকার কবীর সুমনের পাশাপাশি দাপটের সঙ্গে থাকতেন যশ রাজ ,ভীম
সেন জোশি ,বীণা সহস্রবুদ্ধে ,আশ্বিনি ভিদে দেশপান্ডে ,শ্রুতি সাডোলিকর। গিরিজা দেবী, শোভা গুরতুর
কাজরি ,চৈতি আর হোরি –আজ বিরজ মে হোলি রে রসিয়া –যেন এখনো শুনতে পাই । ৩২ নম্বর
একটা গানের আখড়া ছিল সে সময় । আর তার চরিত্র ছিল একেবারে যাকে বলে গ্লোবাল ।
৩২ নম্বরের হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াতো
জীবনানন্দ ,শঙ্খ ঘোষ ,শক্তি ,আয়ান রশিদ খান এবং আরো অনেকের কবিতা । সে সময় আমরা খুব
মজেছিলাম শের শায়েরিতে । গালিব ,বাহাদুর শাহ জাফর , মির তকি মির থেকে কৈফি আজমি র
নজম গজলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত বাড়ি থেকে
বহু দূরে দুটো মানুষের মনের দুঃখ কষ্ট ,তাদের
নিজস্ব একাকিত্ব ,আরো অনেক না বলা কথা ।
এই ঘরের এক বাসিন্দা আজন্মকাল কবিদের দেখে দেখে বড় হয়েছে , কবির ঘরে তার
জন্ম । বাড়িতে বই আর লিটল ম্যাগাজিনের
সমুদ্রস্রোতে তার মা চাল ডাল মুড়ি চানাচুর বিস্কুট রাখার জায়গাও পেত না । সে একদিন জানতে
পারে তার সঙ্গিনী টি কবিতা লেখে! তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল - কী আপদ! এখানেও রেহাই নেই ! এরা
দেখছি শান্তিতে থাকতে দেবেনা । কবিতা শোনাতে আসবে না তো আবার ?
শুধু তাই নয়, এ আবার তার বাবার প্রাণের বন্ধুর ভাইঝি ! তবে নিজে থেকেই একদিন সে বললো ,শোনা দেখি তোর কবিতা । পাহাড়ের
তলায় একটা সমুদ্র বয়ে যায় , কোথা
থেকে সেখানে আসে একটা জাহাজ ,নির্জনে । এ রকমি একটা কবিতা ছিল সেটা । তার বেশ
ভাল লাগে । কেমন অন্য রকম । আরো
শোনা তোর কবিতা । সে শুনতে থাকে । আর
ভাবতে থাকে এর হবে । এতোটা কাল কবি বাবার কাছে লালিত পালিত হয়ে যদি এটকু না বুঝতে
পারে তাহলে আর হলোটা কী ? সেই থেকে ৩২ নম্বর একালের এক নামজাদা কবির আঁতুড়ঘর না
হলেও কর্মশালা ছিল বলা যেতেই পারে ।
পাহাড়ি পথে ওঠা নামা হাঁটা চলা ,
ক্লান্তি ,পরিশ্রম , অনেক নতুন কিছুর সঙ্গে আপোষ করা , মানিয়ে নেওয়া , অনেক
ছোটখাট তুচ্ছতা, ভুল বোঝাবুঝি, মান অভিমান
সব কিছু মুছে দিত , লুকিয়ে রাখত ৩২ নম্বর গ্লেন । দিনের শেষে আমরা জানতাম, টেবিল
ল্যাম্পের নরম আলো মেখে সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে । তার কাঁচের জানালার
ওপারে বসে আছে অজস্র মথ আর প্রজাপতি । বাথরুমে মজুত করা আছে জুগনুর ( হিটারের
মত,মাঝে মাঝে গিজার খারাপ হয়ে যেত) মধ্যে গরম জল । ঘরের
উষ্ণতার মধ্যে ওম হয়ে বসে আছে একটা অদ্ভুত শান্তি । ঠিক যেন মায়ের মতো। সেন্টেড মোমবাতির হালকা সুগন্ধ , ছাদ গড়িয়ে
কুয়াশা নামছে আর দুটো কাপে হিটারে বানানো
সুইট কর্ণ সুপ থেকে ধোঁয়া উঠছে ।
আর সে সব এফ আর এস আর , ব্যালেন্স শিট, ফান্ড ফ্লো, ক্যাশ ফ্লো, প্রফিট
অ্যান্ড লস আকাউন্ট, পেনশন রুল , ড্রাফট প্যারা , অডিট ডেবিট ক্রেডিট তাদের কি হল? তারা কেউ জানালা
দিয়ে উড়ে গেছে,কেউ কার্পেট চাপা পড়েছে, আর বাকিদের হয়ত টেকচাঁদ পুরন চাঁদ করমচাঁদের
দল ঝাড়ু মেরে বিদায় করেছে ।
কোন কিছু আগের মত থাকেনা । ৩২ নম্বর গ্লেন ও নেই । তার যে সব এলোঝেলো সাদাসিধে ভালমানুষ গোছের
ব্যাবস্থাপনায় আমরা বেশ খুশিই ছিলাম, তার একটাও আজ আর নেই । সে আজ
ভীষণ কেতা দুরস্ত । কর্পোরেট ।
প্রফেশনাল । ফিটফাট । সে যে কোন পাঁচতারা হোটেলের ঘরের সঙ্গে পাল্লায় নামতে
পারে । তার দেওয়ালের এমাথা ওমাথা জুড়ে যে
বিরাট জানালাটা ছিল সেটা অনেক ছোট করা
হয়েছে । কিন্তু এখনও তার ভেতর দিয়ে আকাশটা সে রকমই নীল । পাইন বন জুড়ে সেই রকমই
স্তব্ধ শান্তি ।
নতুন জানালা - গ্লেন |
আর ৩২ নম্বরের সে দুজন বাসিন্দা । তারাও কি আগের মতন আছে? সব কিছুই কি গেছে ?
ওই নীল আকাশটার মতো , নিরালা পাইন বনটার মতো
কিছুই কি নেই বাকি?
সেই দুজনার ছবি
এবং এই গানের লিংক টা Yesterday Once More - Carpenters
সেই দুজনার ছবি
যশোধরা - সুপর্ণা |
এবং এই গানের লিংক টা Yesterday Once More - Carpenters
http://www.naaa.gov.in/en/
ReplyDeleteমুগ্ধতা!
ReplyDelete