আমাদের
আশাবরী বাড়িটার সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গা ছিল তিনতলার বারান্দা ছোঁয়া কদম আর শিরীষ গাছ ।
হাত দিয়ে তাদের পাতা ধরা যেত । বারান্দায় পড়ে থাকত কদম আর শিরীষ ফুল । সেই কারণেই বারান্দায় আমরা গ্রিল লাগাই নি । গাছের পাতাগুলো ছাতার মত জায়গাটাকে ঘিরে থাকত ।
ভারি স্নিগ্ধ আর নরম ।
বাড়িটার আরো একটা ল্যান্ডমার্ক ছিল ,
সামনে ছিল একটা ন্যাড়া পার্ক । চোখের দৃষ্টি কোথাও আটকাত না । অনেকটা আকাশ দেখা
যেত । পুবের নরম রোদ সকালবেলায় বারান্দার দরজা দিয়ে লাজুকভাবে ঢুকে খাবার ঘরের
দেওয়ালে টাঙানো মঞ্জুষা থেকে কেনা মা
দুর্গার তেলতেলে মুখ টা য় এসে পড়ত । তখনই বাবার ধ্যানে বসার সময় । কখনও স্তোত্রপাঠ,
একটু পরেই চা আসবে । বাবা চাএর ব্যাপারে খুঁতখুঁতে । সকালের চা ভাল হওয়া চাই।
ন্যাড়া পার্কে পাড়ার বাচ্চারা খেলত । আমরা
বাড়ির ঠিকানা বলার সময় বলতাম ,ন্যাড়া পার্কের ঠিক সামনের বাড়িটা । কিন্তু পার্ক টার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওখানে পাড়ার
দুর্গা পুজো হত। বাড়ির সামনেই পুজো ।এর থেকে ভাল আর কিছু হয়
নাকি? গাছের ডালপালা আর ঘন পাতার চালচিত্রের মধ্যেই প্যান্ডেল বাঁধা হত।সেটাই
ছিল মন্ডপের শোভা । বেশ দেখাত ।
অষ্টমীর দিন বাড়িতে বাবা চন্ডী পড়তেন শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে ।
অষ্টমীর দিন বাড়িতে বাবা চন্ডী পড়তেন শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে ।
পুজো মন্ডপেও বাবাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হত চন্ডীপাঠ করার জন্য। মুখের সামনে কোন বাড়ি না থাকাটা আমাদের বাড়ির একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল। ফাঁকা জমিটার কোন মালিক ছিল না। অন্তত পাড়ার
পুরোন লোকেরা কিছু জানত না। বাবা পাড়ার মাতব্বরদের বলেছিলেন ওখানে বেড়া দিয়ে
বাচ্চাদের একটা পার্ক করে দিতে ,তাহলে জবরদখলের হাত থেকে জমিটা বাঁচতে পারে। এক চিলতে জমি কোথাও খালি পরে থাকে না । বলাটাই সার । কেউ গায়ে মাখে নি । বিনি পয়সায় কিছু পেলে তার কদর থাকে না ।
একদিন দেখা গেল জমিটার চারদিকে কিছু নতুন মুখের আমদানি। নানান রকম গাড়ি, ওজনের
ভারে জাহাজের মত দুলতে থাকা লোকজন,পান পরাগের পাউচ । ক্রমশ প্রকাশ্য রহস্য গল্পের
মত জানা গেল জমিটার নাকি একটা মালিকও আছে । তার কাছে সব কাগজপত্র আছে । পাড়ার লোক তো শুনে থ । আরো
জানা গেল সর্ষের মধ্যে ভূতের মত পাড়ারই কিছু লোকের মদত আছে এর পেছনে ।
ওখানে নাকি একটা ফ্ল্যাট বাড়ি উঠবে ।
আমাদের বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেল। বাবার ভালবাসার ডালপালা তো পরিবারের
মধ্যে আটকে ছিল না । তাই সময় অসময়ের বালাই নেই ,দুপুর দুটো,রাত দশটা সবসময় তারা সদল
বলে হাজির । দলে প্রচুর মহিলা । অতএব পরিবেশ সরগরম । বলাই বাহুল্য মা আর টুম্পার (মায়ের সহকারী ,মেয়ের মত) মৃদু আপত্তি বাবা কানেই তোলেন নি । মানুষ মানুষের কাছে আসবে , উপকারে আসবে এ টাই তো তার মনের কথা । বাবা সাধ্যমত পরামর্শ দিতেন ।
কাগজপত্র তৈরি করে দিতেন,অ্যাপ্লিকেশন লিখে দিতেন। আন্দোলন ধোপে টিকলো না । কারণ
সদুপদেশ দিলেই তো হয় না, দাতা গ্রহীতাকে
সমভাবাপন্ন হতে হয় । উপরন্তু প্রতিপক্ষ শক্তিশালী । অর্থে , ক্ষমতায় , কৌশলে । বাবাকে বলতে শুনেছিলাম “তোমাদের না আছে সদিচ্ছা,না আছে নেতৃত্ব ,না আছে
সংগঠন । তোমাদের অনেকদিন আগে থেকেই আমি বলে আসছি “
এতদিনের পুজোটা কি তাহলে উঠে যাবে? বাচ্চারাই বা খেলবে কোথায় ? এইসব নানান জল্পনা কল্পনায় সবাই বিশেষ করে মহিলারা
দিশেহারা ।
সেপ্টেম্বর নাগাদ পার্কে প্যান্ডেল বানানোর বাঁশ এসে পড়ল না তার বদলে টিনের পাত দিয়ে পার্ক টাকে পাঁচিল
দেওয়া হল। সেদিন পুলিশ ও ছিল ।
আরেক দিন রাতে টুম্পা বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠল “এই ,এই তোমরা কী করছ? গাছ টায় কী
করছ?”। কারা যেন শিরীষ গাছটায় কিসব ঢেলে
দিয়ে পালিয়ে গেল । চোখের সামনে অতবড় গাছটা শুকিয়ে শুকিয়ে মরে যেতে থাকল । জায়গাটা
খাঁখাঁ করতে লাগ ল । আমাদের বুকের ভেতরটাও।
এতদিনের পুজো তো বন্ধ করা যায় না । এর গ্যারাজ ,ওর গেট ,রাস্তা বন্ধ করে একটা
মন্ডপ বানানো হল ।
এদিকে সামান্য কারণে ভুল চিকিত্সার জন্য শরীরে
বিষক্রিয়ায় আচমকা ম্যাজিকের মত আমাদের অমন সজাগ সচেতন , প্রাণবন্ত বাবা চলে গেলেন ।
মন্ডপের উদ্বোধন হয়েছিল । তবে ঢাকের বোলে নয়, চার সন্তান নিয়ে বাপের বাড়িতে
আসা মায়ের মুখের ঝলমলে হাসিতে নয়। হয়েছিল পাড়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধার মানুষটির শোকসভা
দিয়ে ।
যথারীতি মন জুড়িয়ে গেল।যেন আশাবরী রাগটি।
ReplyDeleteএ আমার বড় বেদনার কথা অনুরাধা । আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
ReplyDelete