Sunday 21 September 2014

যদি সেদিন


ফিস যেতে আসতে রাস্তার দুধারে ডান দিকে বাঁদিকে  ওপর দিকে তির চিহ্ন দিয়ে নানা জায়গার নাম হুশহাশ পেরিয়ে যায় ।

I S B T । আনন্দবিহার I S B T, কাশ্মিরি গেট I S B T, সরায় কালু খাঁ I S B T । কালু খাঁ টা আবার কে? মোগল আমলে কোন সরাইখানার মালিক হবে হয়ত ।  সে যাক গে , দেখছ কান্ড ! এতো গুলো I S B T ! মানে  Inter state bus terminal    

আমি  তো  জানতাম  একটাই  আছে এ শহরে   শুধু এইটুকুই  খালি ভেবেছি , অমনি মাথার মধ্যে গুটিকয়েক ফচকে জোনাকি ফিচেল হেসে চোখ মটকে বলল  মনে পড়ছে ? তোমার সেই বোকামির  কীর্তি কাহিনীগুলো ?

সেবারে হোল কি আমার আর যশোধরার মনে হল কলকাতা থেকে শিমলা এই মরুতীর্থ হিংলাজের মত লম্বা জার্নিটাকে একটু  কেটে ছেঁটে স্ট্রিমলাইন্ড করা যাক । উদ্দেশ্য  একটাই,  যতটা বেশি সময় কলকাতায় থাকা যায় । তখন তো আর ট্রেনিং থেকে কথায়  কথায় ছুটি পেতাম না ।

এমনিতে আমরা চিড়ে গুড় বেঁধে নিয়ে মোটামুটি তিন দিনের জন্য দুগ গা বলে হাওড়া কালকায় চেপে বসতাম । তারপর কখন  পৌঁছাবে  দেখা যাক । কিন্তু সেবারে ঠিক হল যে  আমরা রাজধানীতে করে দিল্লি যাব ,সেখান থেকে বাসে করে শিমলা   রানাঘাট , কলকাতা , তিব্বত  ব্যাস ।  এতে আমাদের সময় অনেকটা বাঁচবে ।

দিল্লি নেমে I S B T থেকে বাস ধরে নিলেই হবে ।  সোজা ব্যাপার । তখন আমরা খুব ছিমছাম চিন্তা ভাবনা করতাম । এতো যন্ত্রপাতিও ছিল না ,এতো জটিলতাও ছিল না ।  আঙ্গুলের ডগায় এতো ইনফরমেশন ছিল না ।

ঠিকঠাকই এগুচ্ছিল । দিল্লি নেমে  একটা কুলি ধরা গেল । না হলে উপায় নেই । আমরা একটা ব্যাগ নিয়ে বাড়ি যেতাম , ফিরতাম তিনটে নিয়ে ।

কুলির মাথায় , ঘাড়ে হাতে মাল পত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হল । সবার ওপরে রইল ধুসো রঙের ভুসকো একটা ব্যাগ । ব্যাগটা কার ছিল এখন আর মনে নেই ।

আমি কুলিটাকে পই পই করে বলে দিলাম   আহিস্তা চলিয়ে । জরা আহিস্তা চল । আর ওই বাঁধ ভাঙা জনসমুদ্রে আমার নিশানা ওই ধুসো রঙের ভুসকো  ব্যাগ , যেটা শাকের আঁটির মত সবার ওপরে দেখা যাচ্ছে । আমরা এগুচ্ছি । চলছি চলছি । চোখের সামনে কুলি,কুলির মাথায় ব্যাগ ।

হঠাত কী হল জানিনা , কয়েক সেকেন্ডের এদিক ওদিক হবে । আমার চারদিকে শুধু কালো কালো মাথা , যশোধরা নেই , কুলি নেই , ধুসো রঙের ভুসকো  ব্যাগটা ?  এবার কী হবে?  আমি অসহায় ভাবে এদিক ওদিক দেখতে থাকি ।  না কাউকে দেখা যাচ্ছে না ।  ভিড়ের ঠ্যালায় তখন নাজেহাল অবস্থা । কুলিটা কোন গেট দিয়ে বের হবে সেটাও তো জানি না । এখানে তো আবার অনেক গুলো  গেট আছে । কী আপদ ! এখন কী করি?

বেশ নার্ভাস লাগছে । কিন্তু ঘাবড়ে গিয়ে ক্যাবলামি করলে আরো গন্ডগোল ।  আমি চারপাশের লোকের পা মাড়িয়ে কনুইয়ের গুঁতো মেরে নিচে নেমে এলাম । আচ্ছা, আমাদের তো অটো বা ট্যাক্সি নিয়ে  I S B T যাবার কথা । সুতরাং  অটো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকেই যাওয়া যাক । এরপর আমি বিভিন্ন গেটের অটো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে  দফায় দফায় খোঁজ নিতে থাকি । আচ্ছা ভাইসাব কাউকে এরকম দেখেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি এমনকি ওই ভুসকো ব্যাগের কথাটাও বাদ গেল না । তারপর যখন পাকাপাকি ভাবে বোঝা গেল যে কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই বা বোনের মত আমরা দিল্লি স্টেশনের জনারণ্যে সত্যিই হারিয়ে গেছি , তখন আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল । কিন্তু মুখের মধ্যে কিছুতেই ফুটিয়ে ওঠা চলবে না যে আমি ঘাবড়ে গেছি । সঙ্গে হাতব্যাগে টাকা পয়সা তো আছে  । অতএব আমি যতদূর সম্ভব স্মার্ট হয়ে একটা অটোওয়ালাকে খুব শান্তভাবে বলি, I S B T চলিয়ে । দিল্লি শহরটাকেই তখন ভালোভাবে চিনি না , I S B T তো দূর অস্ত ।

এখন যদি অটোওয়ালা বলে  বসতো , কোন I S B T যেতে হবে ?

অটো চলতে শুরু করল । সে আমাকে কোথায় কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে ,ঠিক না ভুল  রাস্তায় ? কোন বদ মতলব নেই তো ? আবার বার বার  জিগ্যেস করলে ও তো বুঝেই নেবে যে এ তো কিছুই চেনে না । তাই মুখচোখে খুব একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বেশ গম্ভীর ভাবে বসে রইলাম । এদিকে তো বুকের মধ্যে দুম দুম করে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে । আমি কোথায় চলেছি কে জানে ? আর ওদিকে যশোধরা গুণে গুণে ছ’ পিস লাগেজ নিয়ে  হিমশিম খাচ্ছে আর আমাকে নির্ঘাত শাপশাপান্ত করে চলছে । পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করে শিউরে ওঠা ছাড়া আর কোন গতি ছিল না । অটোওয়ালা গোঁগোঁ করে ছুটেই চলছে । দিল্লিতে এর আগে একেবারেই আসিনি তাতো নয় , শহরটাকে একটুকুও চিনিনা কেন ছাই !

শিমলায় বরফের তলায় চলে গেলে যখন কল খুললে জল পড়ত না , বাজারে সব্জির আকাল দেখা যেত , আম্বালা না পাটিয়ালা থেকে আনা দুধ জমে কুলফি হয়ে যেত , পড়াশুনো ডকে তুলে আমরা যখন স্নো ম্যান বানানোর প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম তখন আমাদের ঘাড় ধরে দিল্লিতে নামিয়ে আনা হত । গালভরা সব নাম ছিল পার্লামেন্টারি অ্যাটাচমেন্ট , ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট এই সব । আবার যখন খবর মিলত যে জলটল পড়ছে , বাজারে কপি , আলু টমাটর দেখা যাচ্ছে তখন আবার হেড কাউন্ট করে করে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত । দিল্লিতে যখন নামিয়ে আনা হত ,সেই সময় শনি রবি গুলো আমাদের ওপর নজরদারি ব্যবস্থা কিছু শিথিল থাকত । অনেকেই মামা কাকা মাসি পিসির বাড়ি যেত, কেউ কেউ যেত পুরনো ইয়ার দোস্ত দের সঙ্গে গুলতানি করতে । আর যাদের বাড়ি একটা সুবিধেজনক দূরত্বের মধ্যে তাদের তো কথাই নেই ,ফি হপ্তায় বাড়ি । মুশ কিলে পড়তাম আমরা । কেননা তত দিনে হাঁ করে কুতুব মিনার , যন্তর মন্তর লালকেল্লা দেখার দিন অনেকদিন ফুরিয়েছে । কাজেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম । একবার গেলাম ভোপাল । এমনিই মাথায় ধাঁ করে আইডিয়া এল,চল ভোপাল দেখে আসি ।

কোথায় উঠব কিভাবে যাব এই সব ভেবে আমরা মাথাটাকে অকারণ জটিল করতাম না । আগেই বলেছি চিন্তা ভাবনা ছিল খুব ছিমছাম ।



ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেল খুব সহজেই । আমরা ছোট্ট একটা করে ব্যাগ নিয়ে  গুটি গুটি রওনা দিতে যাব ,অমনি আমাদের ব্যাচমেট সন্ধ্যা দেখতে পেয়ে  বলল ,এই তোমরা  চললে কোথায়?

ভোপাল ।

ভোপাল ? কেন ?

এমনই ।

আমাকে বললে না তো ?

আমাদের মনেই ছিল না সন্ধ্যার বাড়ি ভোপালে ।

তুমি যেতে চাও?

হ্যাঁ , অফকোর্স ।

দশ মিনিট টাইম পাবে ,মাত্র দশ মিনিট ।

সন্ধ্যা প্রায়  সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল । আমাদের সঙ্গে চলল বিনা টিকিটে । আমরা ঠিকঠাক ভোপাল পৌঁছেছিলাম । টিকিটের ব্যবস্থাও হয়ে গেছিল ।  একটা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা শহরে একটা বেশ সাধারণ মানের হোটেলে রাত কাটিয়েছিলাম , কাবাব খেয়েছিলাম , সন্ধ্যা ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে ভোপাল লেক, ভারত ভবন ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল । কোন সমস্যা হয় নি । কোন ভয় গলা টিপে ধরে নি । কেন ধরেনি ?  এখন ভাবলে খুব  অবাক হয়ে যাই  

আর এক উইকেন্ডে আমাদের গন্তব্য হল জয়পুর । সেবার জে এন এউ হোস্টেলে যশোধরার এক বন্ধু কাকলির সঙ্গে এক রাত্তির থেকে  পরের দিন কাকডাকা ভোরে ট্যুরিজমের বাসে জয়পুর রওনা দিলাম । যথারীতি কোথায় থাকা হবে  ঠিক নেই । এবারে আমাকে আর পায় কে? কারণ জয়পুর আমার দেখা শহর । বাবার সঙ্গে লেজুড় হয়ে দিল্লি এসেছিলাম । ঝাড়া দুদিন হৌজ খাসের গেস্ট হাউসে বসে থাকার পরে  বাবার আপিসের কাজ সারা হলে পরে আমরা বাবা আর আমি জয়পুর ঘুরতে গেলাম । গাংগৌর নামে কী সুন্দর একটা  থাকবার জায়গা ! ফোক সং হচ্ছে, বিশাল পাগড়ি বাঁধা রাজস্থানি লোক  কাঠপুতলি নাচাচ্ছে । সুতরাং ওদের খুব মুরুব্বিয়ানার সঙ্গে বললাম আরে আমি খুব ভাল থাকার জায়গা জানি । কোন অসুবিধে তো হবেই না ,ওখানে  জায়গা না পেলে  সিধে চলে যাব সার্কিট হাউস । হ্যাঁ, সোনার কেল্লার শ্যুটিং হয়েছিল । ওই বিছে ধরার  সিন টা তো ওখানেই ।

ওরাও আমার এই জ্ঞানগম্যিতে বেশ খুশিই হল দেখা গেল । বুকিং টুকিং কিচ্ছু করা নেই ,চিন্তার মধ্যেও নেই ।

চমৎকার বাস জার্নি । শকিল সাহাব নামে আপাদমস্তক শরিফ এক  বয়স্ক উর্দু কবি খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলছিলেন । কে না জানে কবিরা বানিয়ে বানিয়ে সুন্দর কথা বলতে ওস্তাদ । আমরা বললাম, কিছু শোনান দেখি । উনি বললেন

“এক পরিন্দা উড়া

আঁখে নম হুই

সমঝা, ম্যায় তুমহে ভুলা নহি “
আবার বললেন 
"বড়হে  শওক  সে  সুন রহা থা জমানা /হম হি  সো গয়ে দাস্তান   কহতে   কহতে"
নামবার সময় বললেন, আপনারা একলা একলা ঘুরতে বেড়িয়েছেন ? উনি কি বোঝাতে চাইছিলেন সঙ্গে কোন পুরুষ সঙ্গী নেই কেন?  
আমাদের তিনজনকে আপনার একলা একলা লাগছে ?

এরপর আমার থাকার জায়গা খোঁজার পালা  । সামনেই কিছু ঘোড়ার গাড়ি , হালকা ভিড় ,জটলা । আমি এগিয়ে যাই ।

হাম লোগোকো গাংগৌর জানা হ্যায় । ক্যায়সে জায়েঙ্গে ?

গাংগৌর জানা হ্যাঁয় ? কিন্তু গাংগৌর তো একটা তেওহার । হামলোগ মনাতে হ্যাঁয় । জ্যায়সে তিজ, হোলি । তবে আপনি যদি খুব বেশি আগ্রহী হন তবে সিধা বিকানের চলে যাইয়ে ।

কী বলে লোকটা ? পাগল নাকি ? কিসসু জানে না দেখছি । আরে আমি নিজে থেকেছি ইত্যাদি ইত্যাদি । এইসব বলতে বলতে সামনে তাকিয়ে দেখি বড়বড় করে লেখা আছে  গাংগৌর, রাজস্থান ট্যুরিজম , পধারো মাহরে দেশ ।

জয়পুর ট্রিপ তো ভালো হয়েইছিল । থাকার জায়গাও একটু দামি হলেও পাওয়া গেছিল ওই গাংগৌরেই  মানে ট্যুরিস্ট লজে।

 এদিকে অটো অবশেষে থামল ।  I S B T এসে গেছে । আমার সঙ্গে প্রথম তার পরিচয় । বাস অড্ডা । নানান রাজ্যের গুমটি । শিমলার বাস যেখান থেকে ছাড়বে সেখানে ধুপ করে বসে পড়ি । ভারি মনখারাপ লাগছে । যশোধরাকে তো  I S B T   আসতেই হবে । ঠিক আসবে তো? এইসব  চিন্তাই করছি । বেশ কিছুক্ষণ ।

 হঠাত  আমার চোখ আটকে গেল ,আরে দেখতে পেয়েছি ! ওই তো ধুসো রঙের ভুসকো ব্যাগ !   কুলির মাথায় ।  আর আমাকে পায় কে । রাগে গিরগির করতে করতে এক ছুটে কুলিটার সামনে গিয়ে  ঝামড়ে পড়ে বলতে থাকি ,সেই ইস্তক বলে আসছি আহিস্তা চলিয়ে , আহিস্তা চলিয়ে, সুনতাই নহি । কি ভেবেছ কি তুমি,অ্যাঁ ?

আমার গলা ছাপিয়ে যশোধরা  বলে ওঠে, মাথাটা না হয় গেছে ।চোখটাও গেছে তোর? এটা কি সেই স্টেশনের কুলি? তাকে আমি ট্যাঁকে নিয়ে  এতোক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছি ? এটা  I S B T র কুলি ।

ওঃ তাই তো!

তারপর পাক্কা আধ ঘন্টা ধরে একে অন্যকে দোষারোপ করার পর আমরা একটু ঠান্ডা হয়ে বসলাম । তারপর শিমলা যাবার একটা লম্বা ডিলাক্স বাসে চেপে বসি । কিন্তু কী আশ্চর্য বাস টা অদ্ভুত রকমের খালি । পথে লোকজন তুলতে তুলতে যাবে বোধহয় । কিন্তু না । সবমিলিয়ে সাত জনের বেশি লোক দেখা গেল না । আমাদের সামনেই বসে ছিলেন এক বয়স্ক দম্পতি । ভদ্রমহিলা আলাপ করলেন ।  আমরা ছাড়া উনিই একমাত্র মহিলা যাত্রী ।দু একটা লোক মাঝপথে নেমেও যেতে লাগলো । একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল শিমলায় কেউই যাবে না । এমনকি ওই ভদ্রমহিলারাও না । এরমধ্যে বাসটার নানা রকম ঝামেলা শুরু হল । এই বন্ধ হয়ে যায় , এই চলতে শুরু করে । শিমলা প্রায় ছ’সাত ঘণ্টার পথ । ক্রমশ একটা অনিশ্চিতির দানা জমাট বাঁধতে শুরু করে । তখনও ভয় বা সন্দেহ মনের মধ্যে আসেনি । তখন একটাই চিন্তা । রাতের মধ্যে যে ভাবেই হোক শিমলা পৌঁছুতেই হবে । কারণ পরের দিন সকালে আমাদের  টানা সাত দিন তিব্বত বর্ডারে এক্সকারশন আর ট্রেকিং শুরু হয়ে যাবে । সময় মত হাজিরা না দিলে যে ঠ্যালা সামলাতে হবে সেই চিন্তাই আমাদের পাগল করে মারছিল । সন্দেহের বীজটা বুনতে শুরু করলেন ওই ভদ্রমহিলা । উনি বললেন  তোমরা ভাই কী করবে ? ভেবে দেখ । শিমলায় কেউ যাবে না । রাত কতো হবে কে জানে ? তার ওপর এই বাস টার তো কোন ভরসাই নেই । তোমরা দুজন মেয়ে । একলা একলা ।




তত ক্ষণে পানিপথ কুরুক্ষেত্র ঐতিহাসিক পৌরাণিক যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে এসেছি ।  চন্ডীগড়ের প্রায়  কাছে এসে  বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামার মুখে বাস জবাব দিয়ে দিল যে সে  পাদমেকং ন গচ্ছামি । এখন কী কর্তব্য ? আবার ওই লটবহর নিয়ে কোথায় যাব ? একটু দিশেহারা দুজনেই ।

এরপর আমাদের  চমকে যাবার পালা । যে ড্রাইভার আর তার হেল্পারকে সারা রাস্তা  অকথ্য কুকথ্য গালিগালাজ করতে করতে আমরা এসেছি  তারাই এগিয়ে এসে বলল আমরা আপনাদের চন্ডীগড় পৌঁছে দেব । হেল্পারটি একটা অটো করে বাস স্টপে নিয়ে গেল এবং একটা ভিড় থিকথিকে শিমলার বাসে তুলে দিল ।

আমাদের সেই রোমাঞ্চকর দিনটি এখানেই শেষ হয়ে গেল না । প্রায় মাঝরাতে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হল  শিমলার টানেল নম্বর ১০৩ এ ।

এই টানেল থেকে আমাদের মই এর মত খাড়াই পথ বেয়ে চৌরা ময়দানে উঠতে হবে সেখান থেকে উৎরাই । আমাদের একাডেমি । জোগাড় করতে হবে আবার সেই একটি কুলি । যশোধরা কুলির খোঁজ নিতে ওই পাহাড়ি মই এর মত রাস্তায় উঠতে শুরু করল । আমি এক রাশ মালপত্র নিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলাম । রাত প্রায় বারোটা । দুটো শিমলা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে । তাদের মধ্যে কোন হেলদোল দেখা গেল না । কোন কৌতূহলও নেই আবার সাহায্যের ইচ্ছেও নেই ।    বিধি বাম । কার মুখ দেখে সকালে উঠে ছিলাম কী জানি । অত রাতে কুলি পাওয়া গেল না ।

তারপর একটি করুণ, মর্মান্তিক ও অভাবনীয় দৃশ্য । ওই খাড়াই পথে ছ’পিস ব্যাগ নিয়ে আমাদের অভিযান । নাওয়া নেই খাওয়া নেই ক্লান্ত অবসন্ন দুটি দেহ  যেন পাপের বোঝা নিয়ে ধুঁকতেধুঁকতে এক পা এক পা করে চলছে । এর সঙ্গে একমাত্র প্রভু যিশুর ক্রুশ নিয়ে চলার তুলনা দেওয়া যেতে পারে । ক্লাসিক । সাক্ষী হয়েছিল শুধু  পাইন গাছ ,রাতের তারা আর হিমেল হাওয়া ।

যদি সেদিন মোবাইল থাকত তাহলে পথের বাঁকে বাঁকে এই অকিঞ্চিৎকর রোমাঞ্চ ,রহস্য আর বিস্ময়ের তুচ্ছ গল্পটা আজ আর বলা হত না ।


2 comments:

  1. ভাগ্যিস মোবাইল বস্তটি ছিল না তখন!

    ReplyDelete