সেদিন এক শিখ সর্দারনী আর বাঙালি পুত্তরের বিয়ের নেমন্তন্ন পেলাম । মেয়ের বাবা আমাকে বাঙালি বলে খুব ঘটা করে যেতে বললেন । এদিকে দিল্লির রাস্তা ভালভাবে না চেনার জন্য একজন
ভদ্রলোককে আমার সঙ্গে জুড়েও দিলেন । কিন্তু দেখা গেল উনিও জায়গাটা ভাল চেনেন না । তিনি প্রায় প্রত্যেকটা
অটোওয়ালা ঠ্যালা ওয়ালা সব্বাইকে জিগ্যেস
করতে করতে চলেছেন আর তারাও ইস গলিসে উস গলিসে পতলি গলিসে বাঁয়ে ডাইনে আগে পিছে এইসব বলে ভদ্রলোকের কালঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে ।
এইরকম করে আমরা নানান অলিগলি ,ফোরড গাড়ির শোরুম
ঘুরতে ঘুরতে চলেছি । আর ভদ্রলোক সমানে “দিল্লি আব রেহনে কা
লায়েক নহি হ্যাঁয়” বলতে বলতে নভেম্বরেও কপালের ঘাম মুছছেন
। শেষ পর্যন্ত বিয়েবাড়ির দেখা পাওয়া গেল । প্রচুর সর্দার আর সর্দারনীর জনস্রোত
। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন গুরুদ্বার থেকে আনন্দ কারজ অর্থাৎ কিনা বিয়ে সেরে বর বউ
সবে এসেছে । বর বউ খুব ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে । তাদের পেছনে একটা ছোটখাটো ভিড় । আমি সেই ভিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে
পড়লাম । হলঘরে ঢুকতে হবে তো । এমন সময়ে সেই ভদ্রলোক হাঁপাতে হাঁপাতে
এসে বললেন ম্যাডাম মনে হচ্ছে ভুলভাল জায়গায় এসে পড়েছি । দামাদ মানে বর তো
বঙ্গালী হবার কথা । কিন্তু এতো পাগড়ি কৃপাণ গালপাট্টা ওয়ালা শিখ সর্দার । চলুন
মারধোর খাবার আগে কেটে পড়ি । আমি বললাম কেটে পড়লেই হল । এতো সাজুগুজু করে এসেছি ,
মাথার ওপর সুজ্জিমামা উঠে বসেছেন , পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে । আবার ওই কৌন গলি
গয়ো শ্যাম করে ফিরতে হবে । কই দেখি কি ব্যাপার ?
সত্যিই দেখলাম নব বিবাহিত সর্দার দম্পতি এগিয়ে চলেছেন , সর্দার আবার কৃপাণ তুলে ধরেছেন । ভদ্রলোকের ঘামে ভেজা করুণ মুখ । আমি তখন তুরুপের তাসটি ফেললাম ,
বললাম চিন্তা করবেন না । ভিড়ের মধ্যে আমি আড় চোখে
দেখে নিয়েছি একজনের হাতে ধরা ব্যাগে গোটা গোটা বাংলায় লেখা আছে শ্রী চৈতন্য বস্ত্রালয় মেদিনীপুর ।
যাক
, ভুল হয় নি শেষ মেষ কিন্তু দামাদ? আরে বিয়েটা প্রথমে হল শিখমতে । তাই বরের এই শিখ বেশ । তবে মানিয়েছিল বেশ ,শিখী
পাখা না পরেই ।
হলঘরে
ঢুকে কান মাথা চোখ সব
ধাঁ
ধিয়ে গেল । ভাংরার দাপট আলোর রোশনাই আর উপচে পড়া খাদ্য সম্ভারে আমার তখন মাথা
ঘুরছে । তার মধ্যেই দেখলাম ঘরের এককোণে টিমটিম করে ছাদনাতলা তৈরির কাজ শুরু হয়ে
গেছে । এক গাদা কাঁঠালি কলা আর গাঁদা ফুল জড়ো করছেন কয়েকজন লাল সাদা শাড়ি ।
সসুরাল গেন্দা ফুল। দ্বিতীয় দফার বাঙালি বিয়ে বিকেল বিকেল শুরু হবে ।
এর মধ্যে একজন এসে আমি মিসেস চাওলা বলে আলাপ করে আমাকে রসগোল্লা খাওয়াবেনই । এদিকে আমি জলেবি আর রাবড়ি খাব বলে কখন থেকে বসে আছি ।
আরেকজন বয়স্ক মহিলা অনেক কিছু বলে চলেছেন ,বলতে বলতে আবার পিঠে চাপড় মারছেন । আমি সম্যক বুঝলাম এরা আমাকে বরের বাড়ির লোক বলে ভুল করছেন ।
আর বেশি ভুলভ্রান্তি যাতে নাহয় তারজন্য এবার সত্যি কেটে পড়লাম । একটা আপশোস থেকে গেল বর বউ এর বাঙালি অবতার দেখা হল না । আমার এক অত্যুৎসাহী সহকর্মী সেটারও একটা ছবি আমাকে মোবাইলে পাঠিয়েছিলেন । ধুতি কুর্তায় বরকে লাজুক লাজুক দেখাচ্ছে । পঞ্চনদের তেজ আর ফুটে উঠছে না । সবই ভাল ছিল কিন্তু ওই যে ,ওই শোলার টোপর টা , সেটার ডিজাইন টা একেবারে যা তা
এর মধ্যে একজন এসে আমি মিসেস চাওলা বলে আলাপ করে আমাকে রসগোল্লা খাওয়াবেনই । এদিকে আমি জলেবি আর রাবড়ি খাব বলে কখন থেকে বসে আছি ।
আরেকজন বয়স্ক মহিলা অনেক কিছু বলে চলেছেন ,বলতে বলতে আবার পিঠে চাপড় মারছেন । আমি সম্যক বুঝলাম এরা আমাকে বরের বাড়ির লোক বলে ভুল করছেন ।
আর বেশি ভুলভ্রান্তি যাতে নাহয় তারজন্য এবার সত্যি কেটে পড়লাম । একটা আপশোস থেকে গেল বর বউ এর বাঙালি অবতার দেখা হল না । আমার এক অত্যুৎসাহী সহকর্মী সেটারও একটা ছবি আমাকে মোবাইলে পাঠিয়েছিলেন । ধুতি কুর্তায় বরকে লাজুক লাজুক দেখাচ্ছে । পঞ্চনদের তেজ আর ফুটে উঠছে না । সবই ভাল ছিল কিন্তু ওই যে ,ওই শোলার টোপর টা , সেটার ডিজাইন টা একেবারে যা তা
প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারাটিকে না খসিয়ে তাকে রসেবশে রাখবার জন্য কতরকম যে
কান্ডকারখানা করতে হয় ! তার
মধ্যে একটা হল , চেনা পরিচিতির গণ্ডি বাড়ানো । প্রবাস কে যতটা সহনীয় করে তোলা যায় আর কি । তবে
কিনা এসব করতে গেলে সূত্র লাগে । দুম করে তো আর গায়ে পড়ে আলাপ করা যায়
না । সুতো ধরে ধরে এগিয়ে যেতে হয় । সেই
সুতোর কথাতেই আসছি । তার আগে দু একটা বাড়তি কথা ।
আমাদের
পুরো ছোটবেলাতেই intelligent quotient বা IQ রমরমিয়ে রাজত্ব করেছিল । আই কিউ কার কতটা আছে ,
কি ভাবে মেজে তাকে আরও চকচকে করা যায় ,
অমুকের ছেলে তমুকের মেয়ে কি ঝকঝকে ব্রাইট ,কি
বুদ্ধিদীপ্ত , কি তেজালো তাদের আই
কিউ । চাকরির পরীক্ষা , টেস্ট অফ রিজনিং ,
পাজল আর অঙ্কের বুদ্ধির মারপ্যাঁচে আই কিউ শানিত করার সেই সব
সংগ্রামী দিনগুলো মনে পড়লে আমি আজও শিউড়ে উঠি । আই কিউ এর খেলায় অগাধ হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে
একসময় পায়ের তলায় বরাত
জোরে নিজের জমি হল । এবার সেই জমি যখন শক্ত হতে শুরু করেছে তখন দেখি আই
কিউকে হটিয়ে বাজারে নেমে গেছে emotional quotient বা EQ. মানুষ হতে গেলে
বুদ্ধিবৃত্তি যথেষ্ট নয় , দরকার মায়া দয়া অনুকম্পা মূল্যবোধ । শুধু
মস্তিষ্ক নয় চাই হৃদয় । যন্ত্র নয় হতে হবে সৃষ্টি শীল । আই কিউ ধুয়ে ধুয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বাবা
মায়ের দল কেমন কাঁধ উঁচিয়ে হাত ঘুরিয়ে বলতে থাকল, ছেলেমেয়েরা
ওদের যা পছন্দ তাই করুক ,মন যা চায়, প্রাণ যা চায় তাই করুক, আগে তো ভাল মানুষ হোক ,
তাহলে ক্যানেস্তারা পেটাও ,
বা কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে পুতুল বানাও কিছুতেই কোন আপত্তি থাকতে
পারেনা । যথেষ্ট ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ি গাড়ি রেখে গেলুম , এবার EQ দিয়ে
সেগুলোর সদব্যাবহার কর ।
সারা
জীবন ধরে emotional quotient এর কট্টর সমর্থক মদীয় পিতৃদেব মনে করতেন আমার EQ তেও যথেষ্ট ঘাটতি আছে ।
আমার
ব্যক্তিত্বের প্রকৃতিটা খানিকটা প্যানপেনেগোছের । এই প্যানপেনে স্বভাবটা নিয়ে আমি আমার কাছের লোকজনকে নিরন্তর জ্বালিয়ে মারি । আর বেশি
জ্বলতে চায় না বলে আমার একমাত্র ভ্রাতা তড়িঘড়ি করে কিছু কলকাঠি নাড়ল । যার ফল
হিসেবে মোবাইলে ঘন ঘন ফোন । “ আমরা বন্ধুরা আপনার
কাছেই
আছি” । কাছে মানে জানা গেল একেবারে খোদ আমার
নিচের ফ্ল্যাটেই । এই সূত্রেই আলাপ হল পড়শি দিদি আর তার মেয়ের সঙ্গে । মেয়েটির
সঙ্গে কথা কইতে গেলে চোখদুটো কপালে তুলতে হয় অথচ সে আমার হাঁটুর বয়সী । আমাদের
আলাপের মধ্যে এবারে সূত্র ধরিয়ে দিল একটি পদ্মফুল ।রাজনীতির নয় ,তার থেকে বহু যোজন দূরে এই
পদ্ম ফুটেছিল খ্রিস্টের জন্মেরও আগে । পদ্ম সূত্র ।
অর্থাৎ
মহাযান বৌদ্ধদের লোটাস সূত্র । জানলাম এই পদ্মই তার সুতোয় জড়িয়েছে ,
এক বিপুল সংখ্যায় ,সারা বিশ্বের বিভিন্ন
দেশের মানুষকে । এই সূত্র ধরে আমিও জড়িয়ে পড়লাম অনেক নতুন বন্ধুর সঙ্গে । একগুচ্ছ হাসিখুশি
পরোপকারী ঝলমলে উদার সামাজিক মানুষ । এদের একটা মূলমন্ত্র আছে , পুরনো
চিনে ভাষায় । মন্ত্র একাধারে শক্তি ও রহস্য। এর অর্থ বুঝে
নেওয়া যেমন দরকার তেমনি পড়বার সময় মূলভাষাতে পড়াই বাঞ্ছনীয় ।
যাই
হোক, ওনারা আমাকে জানালেন যে কোন অসুবিধে যে কোন সমস্যায়
ওরা সব্বাই আমার পাশে আছেন । ওদের সঙ্গে একটা বড় মিটিঙে গেলাম । সন্ধে বেলায় হাসনুহেনা ফুলের ভরাট গন্ধমাখা জমাট অন্ধকার পেরিয়ে
ঘরে ঢুকলাম । এক ঝাঁক হাসি হাসি মুখ , মুখের
রেখা মসৃণ , দেখলেই মন ভাল হয়ে যায় । এখন তো লোকে হাসতেই
ভুলে গেছে । গৃহকর্ত্রী আকর্ণ হেসে হাত দিয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন । অনেকে
মাটিতেও বসেছে । আমার ষষ্ঠে ন্দ্রিয় কিছু একটা জানান দিচ্ছে । ঠিক তাই , চোখে পড়ল , দেখলাম
আমার পায়ের বুড়ো আঙুল টার মাথা ছুঁয়ে লুটিয়ে আছে একটা নধর লোমশ লেজ , মাটিতে শুয়ে আছে একটা পুরুষ্টু অতিকায় ল্যাব্রাডর । ঘুমোচ্ছে যদিও , কিন্তু
জাগতে কতক্ষণ ! আমার সারমেয় ভীতি একটু মেলোড্রামাটিক । অতি নাটকীয় যা ত্রাপালা গোছের ।
এই
নিয়ে ভুবনেশ্বরে আমার বন্ধু নন্দনার কম গঞ্জনা আমাকে সইতে হয় নি ! নন্দনার বাড়িতে
ছিল তিনটে কুকুর । দুটো সুখ দুঃখের কথা কইতে গেলে তারা আমাকে দেখা মাত্রই এমন হাঁক ডাক লম্ফ ঝম্ফ শুরু করে দিত ।
আর দেখেছি কুকুরের মালিক মালকিনরা তাদের একেবারেই বেঁধে রাখতে চায় না । যেন
কুকুরে ভয় পাওয়াটাই একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার । জানতে পারলাম ওর নাম লারা । যে ব্যাপারটা আরও আমার কৌতূহল জাগালো সেটা হল অল্পবয়সীদের ভিড় । অসম্ভব প্রাণবন্ত সব মুখ । খুব উৎসাহী
আর সব কাজ খুব ভালবেসে করছে । এতগুলো
কচি কাঁচা দেখব , আশা করিনি । তাই আমার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে হাঁটুর বয়সী পাশে সরে এসে বলল ,” বুঝলে না ,
এটা হল এস কিউ এর যুগ ।” এস কিউ ? “হ্যাঁ , এস কিউ , spiritual quotient । এদের রিচুয়ালে বিশ্বাস নেই ।” মগজ
পেরিয়ে হৃদয় উজিয়ে এখন আত্মানম বিদ্ধি । হাঁটুর বয়সী আরও জানালো এই নব্য এস কিউ ধারকদের দুটো জনপ্রিয় জায়গা আছে । “কোথায় “
? একটা ধরমশালা আরেকটা পন্ডিচেরি । দুটোতেই কোন রিচুয়াল লাগে না ।
এ দিকে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু
হয়েছে । শান্ত পরিবেশে মন্ত্রধ্বনি ।ঘরে মৃদু আলো , সুগন্ধি মোম গলে গলে পড়ছে , কাঁচের
পাত্রে ভাসমান ফুল । বাইরে হিম পড়ছে ঘাসের ওপর । মাঝে মাঝে লারা সুন্দরী নড়ে চড়ে উঠছে , আমারও
ধুকপুকুনি বেড়ে যাচ্ছে । হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার পরিচিত মূলমন্ত্র টা
এখন আর পড়া হচ্ছে না । তার জায়গায় সবাই মিলে যা বলে চলেছে সেটা আমার অশিক্ষিত
কানে শুনতে লাগছে “গরম চায়ে লেঙ্গে , গরম চায়ে
লেঙ্গে , গরম চায়ে লেঙ্গে” । তালে তালে সুরে সুরে সবাই
বলে চলেছে । আমি ওভাবেই মুখ নেড়ে যেতে পারতাম ।
কিন্তু এই সুন্দর মানুষ গুলোর সঙ্গে শঠতা করতে মন সায় দিল না । আমি চুপ করে বসে
থাকলাম । আমি নবীনতম সদস্য । অনেক কিছুই জানি না । এদিকে
লারার ছটফটানি বেশ বাড়ছে ।লোমশ লেজটা মাঝে মাঝে ঝাপটা মারছে পায়ের ওপর । বুকের ভেতরটা গুর গুর করে
উঠছে । লারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেছে , আমি পা
দুটো সটান তুলে ফেলেছি চেয়ারের ওপর । আবার এদিকে মন্ত্রও বদলে গেল , আবার আমার
অশিক্ষিত কান শুনতে লাগল , ‘’আপনি কোথাও যাবেন না, আপনি কোথাও যাবেন না ,আপনি কোথাও যাবেন না “ । তালে তালে সুরে সুরে সবাই বলে চলেছে ।
একদিকে
কোথাকার ফালতু একটা কুকুরকে ভয় অন্যদিকে অজ্ঞ হয়ে থাকার বিচ্ছিরি
লজ্জা আর কোনও ধরনের quotient অর্জন করতে না পারার ন্যক্কার জনক আত্মধিক্কার নিয়ে
আমি হাস্নুহেনার ভরাট গন্ধ মাখা জমাট অন্ধকার গলি দিয়ে একরকম পালিয়ে
বাঁচি ।
দিল্লির কামানি
অডিটোরিয়ামে থিকথিকে ভিড় ।
চলছে তিন দিন ধরে মার্গসঙ্গীতের অনুষ্ঠান । কোপার্নিকাস মার্গ ছাড়িয়ে সর্পিল
লাইন । একেবারে সেই লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ালাম । ইতিমধ্যে গীতালি ও এসে পড়েছে ।
সরকার বাহাদুরের সেবা করতে গিয়ে প্রথম দিন পরভিন সুলতানা শোনা হয় নি । শেষ দুদিন শুনতেই হবে । এদিকে লাইন আরও লম্বা হচ্ছে । আধঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে ।
সন্ধে নেমে আসছে দ্রুত । অফিস ফেরতা আসছি । দুটো সরু লম্বা ঠোঙা ভরতি ঝাল ঝাল মটরভাজা কিনে দুজনে খেতে থাকলাম । ভিড়,
কিন্তু সুশৃঙ্খল । মারামারি গুঁতো গুঁতি আর চেঁচামেচি
নেই । এইসব অনুষ্ঠানে এলেই আমার তিনটে জিনিশ মনে পড়ে । এক, আমার তানপুরাটা , যেটা এককালে
খুব যত্ন করে চার থেকে ছয় তার করা হয়েছিল । দুই , উস্তাদ
আমির খান সাহেবের পায়ের তলায় বসে গান শেখা শাগিরদ আমার মাস্টারমশাই , কোন তহজিব এ মৌসিকি বা কুদরৎ রঙ্গ বিরঙ্গি তে যার কোন উল্লেখ কোনদিন থাকবে না আর তিন হল আমাদের আশাবরী
ফ্ল্যাটের শিমুল কদম আর কৃষ্ণচূড়া গাছ ঘেঁষা ঘরে রবিবারের সেই উজ্জ্বল দিনগুলো ।
সময়মাফিক হলে
ঢুকে বেশ মনের মত একটা জায়গা স্রেফ কপালের জোরে পেয়ে গেলাম । চারদিকে শুধু বিপুল জনগণ । আট
থেকে আশি । লাঠি হাতে দাদু দিদা , কপালে দু টাকা সাইজের টিপ
, কাজল লেপা চোখ , তসর শাড়ির খস খস,
ঘামে ভেজা টি শার্ট জিনস পিঠে বোঁচকা , কত রকম
পোশাকের চলমান প্রদর্শনী ,দিশি
বিদেশি দলে দলে ঢুকছে , বসার জায়গা আর নেই । সবাই মাটিতে বসে পড়েছে । আমার
সামনেই হন্ত দন্ত হয়ে ঘুরছেন আর অসহায়ভাবে চারদিক দেখছেন একজন হাঁসফাঁশ কোট টাই
প্যান্ট , মাথায় টাক । খুব বিরক্ত । কেমন যেন বোঝাই
যাচ্ছে মেজ কর্তা সোজা শাস্ত্রী ভবন বা সাউথ ব্লক থেকে আসছেন । নিরঘাত শেষ
বেলায় বকা খেয়েছেন বড়কর্তার কাছে । দুটো ইম্পরট্যান্ট ফাইল ছাড়া হয় নি । দু
চার জন নাছোড় ভিজিটরকে হ্যাঁ না বলে বিদায় দিয়ে দিল্লির ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে কোনরকমে এসে
পৌঁছেছেন ।এখন আর বসার জায়গা পাচ্ছেন না । মঞ্চে এসেই পণ্ডিত রাজন সাজন মিশ্র দাঁড়িয়ে থাকা
শ্রোতাদের মঞ্চে উঠে এসে বসতে বললেন । নিঃশব্দে ডায়াসের চারদিক
ভরে গেল । মেজ কর্তা স্টেজের সিঁড়ির ধাপে বসে মাথার টাক মুছলেন । পকেট থেকে মোবাইল বের করে
রেকর্ড করা চালু করে দিলেন যদিও একটু আগেই আদুরে ঘো ষিকা মাখন মাখন গলায় রেকর্ড
করতে মানা করে গেছেন । বাতাসে তখন সুরের রংমশাল ফুলঝুরি আর তুবড়ি । অব হুঁ না আয়ে শ্যাম ,
শুদ্ধ মধ্যমের সৌন্দর্য খেলিয়ে খেলিয়ে রাগ নন্দ
গাইছেন শিল্পী ,বিরহিণীর দুঃখ টুপটাপ ঝরে পড়ছে , মেজ কর্তা আমার দুহাত দূরে মাথা নিচু করে ফেলেছেন । শ্যাম এসে গেছে । এরি
জানে না দুঙ্গি , এখন তো আর যেতে দেওয়া যায় না , চমকে বিজুরি মেঘা বরসে ,নন্দ থেকে
অনায়াস চলনে তিলক কামোদ । আহা কি মিষ্টি রাগ । সেই পুরবৈয়া ঠাণ্ডা বাতাসে ভিজে
যাচ্ছে সবাই । মেজ কর্তা মাথা দোলাচ্ছেন , গোঁফের তলায় হাসি
টা আস্তে আস্তে চওড়া হচ্ছে । আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ।
এবার পুরো শরীরটা দুলছে । চোখ দুটো বোজা । সুরে অবগাহন করছি সবাই । কখন অজান্তে
লেগে গেল হামীরের সুর । সময় যে পেরিয়ে গেছে । প্রিয়মিলনের পর এখন
বাড়ি যাবে কেমন করে সেই বিরহিণী , বড় উৎকণ্ঠা । ক্যায়সে ঘর জাঁউ লঙ্গরবা। তীব্র
মধ্যমের কম্পনে আকুলি বিকুলি করছে উত্তেজনা । সে এক জাল বিছানো ব্যাকুল
ধুকপুকুনি । আর সেই ঘোরের মধ্যেই দেখলাম মেজকর্তা খিটখিটে খ্যাঁক
শেয়াল থেকে কেমন আস্তে আস্তে নধর
চিত্রল হরিণ হয়ে গেলেন ।
কি ভালো কি ভালো।অমূল্য মণিরতন।শীতের সকালবেলা ঝকঝকে রোদদূরে বসে গরম মশলা দার চায়ের সুগন্ধ ।
ReplyDeleteকি ভালো কি ভালো ।মন জূড়ানো।প্রাণ ভরানো।
ReplyDeleteঅপূর্ব ।আরো লিখুন ।
ReplyDeleteকি ভালো কি ভালো
ReplyDeleteকি ভালোই যে লাগল!
ReplyDeleteআরে অনুরাধা আপনার কমেন্ট পেয়ে আমি তো উড়ে যাচ্ছি হাওয়ায় ...অজস্র অকুন্ঠ ধন্যবাদ আপনি ব্লগে আসেন বলে।
ReplyDelete