ছাতিমগাছের ছাতার তলা দিয়ে সকালবেলায় যখন
হাঁটতে বেরোই কানে একটা মধুর শব্দ, মানে আমার কানে মধুর লাগে , ঘনঘন শুনতে পাই। ট্রি কিচ ট্রি কিচ ট্রি কিচ ট্রি কিচ । না,ওটা পাখিসব করে রব, নয়। জহুরী কান বুঝে নেবে ওটা কাঠবিড়ালিদের ডাক । আমি যেখানেই যাই না কেন, তা সে যে রকম জায়গাই হোক না কেন অদ্ভুত ভাবে কাঠবিড়ালিদের
দেখা পাবোই পাবো । আমাদের অরোবাবুও এইসেদিন নেহরু পার্কে পুরুষ্টু কাঠবিড়ালি দেখে তার নতুন শেখা
শব্দে squirrel squirrel বলে উত্তেজিত
ভাবে চেঁচিয়ে আবার জিনগত কারণে কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি বলে খুব হল্লা করেছিলেন । অবিশ্যি এই বুড়োবয়সে কাঠবিড়ালিদের
গপ্পো শোনানোর কোন বাসনা আমার নেই । কিন্তু এমন একটা বয়সে এসে পৌঁছেছি যখন সামনের বাঁক টা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তখন কিছু
অমূল্য ঋণ, শোধ না করা গেলেও স্বীকার করে নিতে খুব ইচ্ছে করে ।
আজকাল বাচ্চা মানুষ করাটা রীতিমত
গবেষণার বিষয় । অরোবাবুর বাপ মাও তার খুব ব্যতিক্রম নয় । বিজ্ঞান মনস্তত্ব দর্শন আরো
কতকিছু মিলেমিশে একখানা জবরদস্ত মেল্টিং পটে সবাই নাস্তা নাবুদ হচ্ছে , দেখতে পাই । অথচ আমার ক্ষেত্রে তখন একমাত্র মেয়ে
হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবা মা কিন্তু সেই কাদার
তালের কুমোরের চাক হলেন না । সেই কাদার তাল টিকে তাঁরা যার হাতে
সমর্পণ করলেন তিনি হলেন গীতা সেন মানে আমার গীতা পিসি । তখন তিনি অবিশ্যি গীতা দেব ছিলেন । গীতাপিসি রামকৃষ্ণ মিশনের শিশু বিভাগের টিচার
ছিলেন । আমাদের বাড়িতে নিয়মত ঘনঘন আসাযাওয়া ছিল । স্বভাব মাধুর্য যেন ঝরে ঝরে পড়ছে । কী
অপূর্ব কথা বলার ধরন । কে বলবে এ মেয়ে মারকাটারি বরিশালের! এ যেন নদের নিমাইয়ের বাড়ির পাশের চালাঘরে জন্মেছে । আমি পিসির মেনি বেড়াল হয়ে গেলাম । পিসির পায়ে পায়ে ঘুর ঘুর করতাম । সেই থেকে পিসির হাতে আমার মানুষ হবার পালার শুরু । পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে দেদার আজগুবি গল্প শোনা , স্বপ্ন আর কল্পনার ফানুস উড়িয়ে
দেওয়া । পিসি কেমন স্কুলে পড়ায় আর নানা
জায়গায় একা একা ঘুরে বেড়ায় , ডাকঘরের
অমলের মত আমিও স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে থাকতাম । মনে মনে ভাবতাম আমিও ওরকম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কেমন ঘুরে বেড়াব ! সেই স্বপ্ন যে কিছুটা সত্যি হয়ে কালে কালে এমন পৃষ্ঠব্রণ র মত হয়ে উঠবে সেটা কি আর তখন জানতাম! পিসির
আরও একটা আকর্ষণ ছিল । দুপুরবেলায় পিঠভরতি এক ঢাল কোঁকড়া কালো চুল মেলে দীঘল দুটো হরিণ চোখ আর শ্যামলা
দুটো হাত দিয়ে পিসি জল রঙে ছবি আঁকত । আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেছিল পিসি । আর সে কি দারুণ সব ছবি । আমাদের ব সার
ঘরে বাবা বাঁধিয়ে টাঙি য়ে রাখত । মোটা তুলির সবুজ ছোপ ছোপ কেমন
গাছপালা হয়ে যাচ্ছে , একটু লাল কমলা রঙের আলতো আভাস পাতায় রোদের আলো বুলিয়ে দিচ্ছে,চোখের সামনে একের পর এক
স্বপ্ন জগত খুলে দিচ্ছে পিসির সরু মোটা
তুলি , প্যালেটে গোলা রং ,তুলির টান । পিসি জলে তুলি ভিজিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছে । আর আমি কৃতার্থ হয়ে গিয়ে বলছি “ জলটা পালটে আনি? তুলিগুলো ধুয়ে আনি?” সেই
ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে ছবি আঁকার মুগ্ধ দর্শক হতে হতে , নিজে আঁকতে না পারলেও ছবির
প্রতি একটা ভালবাসা জন্মে গেল । ভালবাসাটা দিল গীতা পিসি । চার ঘণ্টায় শ্রীরামকৃষ্ণের এক টা
সুন্দর ছবি এঁকেছিল , এখনও সেই ছবিটাকেই
পিসি পুজো করে । আজ সত্তর পেরিয়েও পিশেমশাই যখন বলেন “দেব
বাড়ির বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটাকে আমি তুলে এনেছি “, তখন ভাল লাগায় গলা বুজে
আসে ।
আমার জীবনে প্রথম শেখা গান , সুর তাল
ছন্দ নিয়ে আস্ত একখানা গান খুব দুঃখ জনক ভাবে কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত ছিল না । অরোবাবুর প্রথম গান “আলো আমার আলো” । এমনকি অরো বাবুর বাবা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে “ আমি পথভোলা
এক পথিক এসেছি” আর “পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে” গাইতে গাইতে খেলার মাঠ থেকে বাড়ি
ফিরত,একেবারে নিয়ম করে, এমনকি শীত গরমের দিনেও । আমার বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেই
আপনা থেকেই তাঁর চোখ বুজে ফেলতেন , এমনকি
আমার তরুণী মা কেও আমি “তৃষ্ণারও শান্তি”,
“বসন্তে ফুল গাঁথল” এইসব গানের সঙ্গে নাচতে পর্যন্ত দেখেছি কোন এককালে। আর লোডশেডিং হয়ে গেলে বারান্দায় বসে
বাবার ভয়ঙ্কর বেসুরো গলায় “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে “ আমাদের পাড়ার সক্ক লে
শুনেছে । আমার ঠাকুরদা এস্রাজে সুর তুলতেন “করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায়
কাহারে” । এইসব উজ্জ্বল উদাহরণের পাশে আমার
প্রথম শেখা গানটা ছিল কাঠবিড়ালিদের
নিয়ে ।গীতা পিসি শিখিয়েছিল । গানটা এইরকম
ঃ ইনটি বিনটি সিন্টি উঁকি মারে /গাছের
আড়াল থেকে শনিবারে /একদিন নাকি সুরে গাইছিল গান /তাই শুনে ইনটি বিনটির উড়ে গেল
প্রাণ । ইনটির খিদে পেল/ গাছ থেকে নেমে এলো /
খিচুড়ি খাবে বলে কাঁদিল রে।
মা এসে দু ’ঘা দিল /খাওয়া তার ঘুচে
গেল/ ইনটি বিন্টি রাগ করে শুতে গেল রে ।
তাই ইনটি বিন্টি সিনটি দের
দেখলেই গানটা
আমার মনে পড়ে যায় আর তখনি দেখতে
পাই পুরনো ক্যানভাসে একটা জল রঙের ছবি ।
গাঢ় গোলাপি লম্বা ডাঁটা ওয়ালা হলিহক ফুল , বেগুনি হলদে কসমস ফুলের দল হাওয়ায় দুলছে, রোগা টিংটিঙে ফ্রকপরা একটা মেয়ে দোলনায়
দুলছে আর বারান্দায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে
আমার চিরকালের দিদিমণি , কোঁচকানো কালো চুল, হরিণের মত চোখ আর শামলা রং । ক্যানভাসটা হলদে হয়ে গেছে বটে । ছবিটার রং কিন্তু এখন ও জ্বল
জ্বল করছে ।
আগেভাগেই জেনে গিয়েছিলাম যে এবার যাবার
সময় মিডল সিট ছাড়া আর গতি নেই । প্লেনের মিডল সিট নিয়ে আমার একধরনের ফোবিয়া
আছে । এই বুঝি দুপাশে দুই হিমালয় আর বিন্ধ্য
পর্বতের মধ্যে গিরিখাত হয়ে দম আটকে যাব । উইন্ড সিট সমানেই টয়লেট যাবে । আইল সিট ছটর ফটর করবে , পান পরাগের সুগন্ধ ছড়াবে ।এইসব ভেবে ভেবে নিজের অন্তহীন আহাম্মকির জন্য মনে মনে দুগালে ঠাস ঠাস করে দুই থাপ্পড় কশিয়ে গলাটা যতদূর সম্ভব মিহি
করে সহযাত্রীকে অনুরোধ করলাম যে উনি অকারণ দয়া দেখিয়ে আইল সিট খানা আমায় ছাড়বেন কি
? ভদ্রলোক হিমালয় বিন্ধ্য তো দূরের কথা , বিহারিনাথ শুশুনিয়ার ও তুতোভাই নন
,অর্থাৎ এনাকে পাহাড় গোত্রীয় কোনমতেই বলা যাবে না । বেশ কাট ছাঁট ওয়ালা রঙ্গন ফুল গাছের
মত ভদ্রলোক টি আমার চেয়েও মিহি গলায় বললেন
তাঁর হাঁটুতে একটা ব্যথা আছে, তাই পা লম্বা করে
ডাইনে বাঁয়ে ওপরে নিচে ঘোরাতে হয় , তাই...। অগত্যা আর কিছু করার ছিল না ।
কিছুক্ষণ পরে দেখি সামনে মাধবীলতার আলুথালু
লম্বা এক খানা ঝাড়ের মত উইন্ড সিট এসে গেছে । উড়ো ঝুরো চুল , লম্বা দুল , লুটিয়ে পরা আঁচল , ইয়া বড় টিপ । মুখে একটা আলগা হাসি । বডি ল্যাঙ্গোয়েজে কোন অদৃশ্য পাঁচিল
তোলার চেষ্টা নেই । উনি সিটে বসার পরেই আর সবার মতোই মোবাইল ফোন
নিয়ে খুটুর খুটুর করতে শুরু করে দিলেন । এরপর খুব চাপা গলায় বলতে শুনলাম
,”সয়াবিনের তরকারি করবে। হ্যাঁ সয়াবিন ,আদা রসুন পিঁয়াজ টমেটো , বেশ মাখা মাখা , মাংসের মতন করবে । “ আবার ফোন চালু করে বলতে শুনলাম”
মিক্সড ডাল করবে । সবরকম ডাল মিশিয়ে , হ্যাঁ হ্যাঁ ওইভাবে। “ আমি কান খাড়া করে রইলাম যাতে কিছু মিস না করি । “ চিকেন কাবাব গুলো ম্যারিনেশন করা
আছে , চাপিয়ে দিলেই হবে “ । ওপরের কথাগুলো বার তিনেক নানাভাবে রিপিট করে উনি ফোন বন্ধ করলেন । এই সময় আমার সঙ্গে একটা হাসি বিনিময়
হল । সে হাসি প্রশ্রয়ের , সে হাসি আয়নার মত পরিষ্কার , সে হাসিতে অনেক কথা বলা হয়ে
গেল । আর অমনি আমি গায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম , “দিল্লিতে কাজে যাচ্ছেন বুঝি
?”
সেই কাকভোরে হাওড়ার গ্রাম থেকে আসছেন । বাড়িতে কিছু গুছিয়ে রেখে আসতে পারেন
নি , তাই ছোট বাচ্চা মেয়ে , ছেলে , কর্তা সবার খাবার ব্যাবস্থা করছিলেন ।
যাবেন দিল্লিতে, সেমিনার আছে । একটা মহিলাদের এন জি ও র সেক্রেটারি । কোথায় কথা বাড়ে । কুরুশের লেস বোনার মত । মহিলাদের সেলফ হেল্প গ্রুপ গড়েছেন , স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে জোরদার কাজ
করছেন, বিদেশি গ্রান্ট জোগাড় করেছেন , অনেকবার বিদেশ গেছেন কাজের সূত্রে । ওনার নাম রাহিমা খাতুন । দেখা গেল দুজনেরই অনেক মানুষ চেনা
শোনা , সরকারি বেসরকারি দুই দিকেই । রোশনি সেন থেকে অঞ্চিতা ঘটক , দিলিপ ঘোষ , সুকুমার ভট্টাচার্য , আওধ কিশোর সিং , অনুরাধা কাপুর , পাপিয়াদি
দীপঙ্করদা , লিস্ট বেড়েই চলছে । আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ছি । কখনো উনি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছেন , কখনো
আমার চোখ গোল গোল হয়ে যাচ্ছে । আরে পৃথিবীটা এত ছোট নাকি ! কখন কেটে গেল দুঘণ্টা জানতেই পারলাম না । হঠাত পাশের রঙ্গন গাছের দিকে চোখ পড়ল
। পুরো ব্যাপারটা উনি খুব লক্ষ করেছেন বোঝা গেল । বললেন, আমি যদি আপনাকে এই সিট টা
ছেড়ে দিতুম এমন আড্ডা টা কিন্তু আপনাদের হত না । আসলে কি বলুন তো , আমার না একটা
ফোবিয়া আছে । মাঝের সিটে বসলেই মনে হয় পা দুটো বুঝি আটকে গেল । আর কোনদিন খুলবে না , তাই...। কিন্তু কি জানেন , everything happens for a reason.
No comments:
Post a Comment